রবিউল আখির ১৪২৮   ||   মে ২০০৭

আহলে কিতাব নারীকে বিয়ে করা প্রসঙ্গে
একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

মাওলানা মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া

বরাবর,

ফতোয়া বিভাগ

মারকাযুদদাওয়া আলইসলামিয়া

৩০/১২ পল্লবী, মিরপুর, ঢাকা

যথাবিহীত সম্মান প্রদর্শন পূর্বক বিনীত নিবেদন এই যে, আমি নিম্ন স্বাক্ষরকারী বিবাহ সংক্রান্ত একটি বিধান জানতে আগ্রহী। অনুগ্রহপূর্বক কুরআন-হাদীসের উদ্ধৃতি ও দলীলসহ জানিয়ে চিরকৃতজ্ঞ করবেন।

একজন মুসলিম যুবক বাইবেল/ইঞ্জিল বিশ্বাসী খ্রীস্টান যুবতীকে বিবাহ করতে পারবে কি না? পারলে কোনো শর্ত প্রযোজ্য হবে কি নাআর না পারলে কী কী কারণে পারবে না।

 

নিবেদক

সাইয়্যেদ জুলফিকার জহুর

বাসা নং ৫৮৫/বি

রোড-১২/এ

ধানমণ্ডি, ঢাকা-১২০৯

 

মুসলিম ছেলেদের জন্য আহলে কিতাব মেয়েদেরকে বিবাহ করার বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের হুকুম কয়েক ভাগে বিভক্ত এবং বিভিন্ন শর্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যার দাবীদার। তাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে একটি ভূমিকাসহ কিছুটা বিস্তারিতভাবে এর জবাব পেশ করা হল।

ভূমিকা

অনেক মানুষকে বলতে শোনা যায় মুসলমান ছেলেদের জন্য আহলে কিতাব মহিলাদের বিবাহ করা বৈধ। এটি একটি ব্যাখ্যাবিহীন অসম্পূর্ণ কথা। কেউ কেউ একথা শুনে মনে করেন যে, যে কোনো ইহুদী-খৃস্টান মহিলাকে বিবাহ করা বৈধ। অথচ এ ধারণা নিতান্তই ভুল।

প্রকাশ থাকে যে, এ উত্তরপত্রে তিনটি শব্দ ব্যবহৃত হবে। (১) বিবাহ সংগঠিত হওয়া (২) বিবাহ না জায়েয হওয়া (৩) বিবাহ অনুত্তম হওয়া। এ তিনটি শব্দের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ :

বিবাহ সংগঠিত হওয়ার অর্থ হচ্ছে, এ কাজ সম্পাদনের পর ওই দম্পতির স্বামী-স্ত্রী সুলভ সম্পর্ক ব্যভিচার বলে গণ্য হবে না এবং তাদের সন্তান বৈধ বলে গণ্য হবে।

আর বিবাহ না জায়েয হওয়ার অর্থ হচ্ছে, কাজটি করা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ ও গোনাহের কাজ এবং তা থেকে বিরত থাকা কর্তব্য।

আর বিবাহ অনুত্তম বলে বুঝানো হয়েছে কাজটি সম্পূর্ণ অবৈধ না হলেও তা পরিত্যাজ্য ও গর্হিত এবং তা থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।

জেনে রাখা আবশ্যক যে, কোনো ইহুদী-খৃস্টান মহিলার সাথে বিবাহ শরীয়তের দৃষ্টিতে বিবাহ বলে গণ্য হওয়ার জন্য দুটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত রয়েছে। এদুটি শর্তের কোনো একটি না পাওয়া গেলে সেটি বিবাহ বলেই গণ্য হবে না; বরং যিনা ও ব্যভিচার সাব্যস্ত হবে। তবে উভয় শর্ত পাওয়া গেলেই যে তাদেরকে বিবাহ করা বিনা দ্বিধায় নিঃশর্ত জায়েয ও বৈধ হয়ে যাবে বিষয়টি এমনও নয়; বরং বিবাহের পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বেই আরও কয়েকটি শর্তের উপস্থিতির ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া আবশ্যক। যদি ওই শর্তগুলো না পাওয়া যায় তবে সে ক্ষেত্রেও বিবাহ জায়েয হবে না। এর পরের কথা হল, এই শর্তগুলোও যথাযথ বিদ্যমান থাকলে বিবাহ তো জায়েয হয়ে যাবে, কিন্তু এ কাজ যে অবশ্যই মাকরূহ হবে তা তো বলাই বাহুল্য। ইসলামী শরীয়তে যেখানে মুসলিম নারীকে বিবাহ করার ক্ষেত্রেও নামাযী ও শরীয়তের অনুসারী নারীকে পছন্দ ও অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে সেখানে যে মহিলা ইসলামের কালিমাকেই মানে না (যদিও সে আহলে কিতাব হয়ে থাকুক এবং বিবাহ সহীহ হওয়ার নির্ধারিত শর্তসমূহও বিদ্যমান থাকুক) তাকে বিবাহ করা কি আদৌ পছন্দনীয় হতে পারে? এখানে ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ এই যে, প্রধান দুই শর্ত সাপেক্ষে আহলে কিতাব মহিলার সঙ্গে বিবাহ শুদ্ধ হওয়াকেই জায়েয হওয়া বলে মনে করা হয়। অথচ বিবাহ শুদ্ধ হলেই জায়েয হয় না; বরং জায়েয হওয়ার জন্য ভিন্ন শর্ত রয়েছে। সেদিকে লক্ষ করা হয় না। এরপর বিবাহ জায়েয হওয়ার শর্তাবলি বিদ্যমান থাকা অবস্থায় যে বিবাহ সম্পন্ন হয়, তাকে মাকরূহ বিহীন বিবাহ ধারণা করা হয়ে থাকে; অথচ এ ধারণা সহীহ নয়। এজন্য নিম্নে আহলে কিতাব মহিলাদের বিবাহ করা সম্পর্কিত ইসলামের নির্দেশনাসমূহ তিনটি স্তরে কিছুটা বিশ্লেষণের সাথে তুলে ধরা হল। বিষয়টি যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া আবশ্যক।

এক. বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি

প্রথমেই জানা দরকার যে, এ যুগের অধিকাংশ ইহুদী ও খৃস্টান আহলে কিতাব নামধারীরা আদমশুমারীতে ওই দুই ধর্মের লোক বলে সরকারিভাবে রেজিষ্ট্রিকৃত হলেও মূলত তারা কোনো আসমানী কিতাব বা ধর্মে বিশ্বাসী নয়; বরং ঘোষিত বা অঘোষিতভাবে জড়বাদী ও বস্তুবাদী নাস্তিকই বটে। তাই কোনো নারীর শুধু সরকারী খাতায় ধর্মাবলম্বী বলে নিবন্ধিত হওয়া কিংবা ইহুদী বা খৃস্টান নামধারী হওয়াই তার সাথে মুসলমান পুরুষের বিবাহ সহীহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়; বরং বিবাহ শুদ্ধ হওয়ার জন্য নিুোক্ত শর্তসমূহ পূর্বে যাচাই করে নিতে হবে।

(১) মেয়েটি বস্তুবাদী নাস্তিক না হতে হবে; বরং প্রকৃত অর্থে ইহুদী বা নাসারা তথা আহলে কিতাব হতে হবে। এ জন্য তার মধ্যে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর উপস্থিতি জরুরি।

(ক) আল্লাহ তাআলার সত্তা ও অস্তিত্ব স্বীকার করা।

(খ) আল্লাহ প্রেরিত যেকোনো নবী-রাসূল ও তার উপর নাযিলকৃত আসমানী কিতাবের উপর ঈমান থাকা।

(২) মেয়েটি পূর্ব থেকেই ইহুদী বা খৃস্টান ধর্মে বিশ্বাসী হতে হবে। মুরতাদ, অর্থাৎ ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে ইহুদী বা খৃস্টান হয়েছে এমন না হতে হবে। এমনিভাবে কোনো মুরতাদের ইহুদী-খৃস্টান মেয়ের সাথেও মুসলমান পূরুষের বিবাহ সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নেই।

এসব শর্ত কোনো ইহুদী বা খৃস্টান মেয়ের মধ্যে পাওয়া গেলে শরীয়তের নিয়ম অনুযায়ী তাকে বিয়ে করলে বিবাহ শুদ্ধ বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ এ সকল শর্ত সাপেক্ষে বিবাহের আকদ করলে তাদের একত্রে থাকা ব্যভিচার হবে না; বরং তাদের মেলামেশা বৈধ ধরা হবে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, কেবল এ শর্তগুলো পাওয়া গেলেই তাদেরকে বিবাহ করা জায়েয তথা নিস্পাপ কাজ বলে গণ্য হবে; বরং সে জন্য দরকার আরও কয়েকটি শর্তের উপস্থিতি। যা পরবর্তী ধাপে বর্ণনা করা হচ্ছে। -আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ২/৩২৩-৩২৬; তাফসীরে রূহুল মাআনী ৪/৬৪; ফাতহুল কাদীর ৩/১৩৫; আদ্দুররুল মুখতার ৩/৪৫, ৪/২৫৫-২৫৬; বাদায়েউস্ সানায়ে ৬/১২৫-১২৬; বুহুস ১/৪১৫; তাফসীরে মাজহারী ৩/৪২

দুই. বিবাহ জায়েয হওয়ার শর্তাবলি

(১) ইহুদী-খৃস্টান মেয়েকে বিবাহের আগে এই বিষয়ে প্রবল আস্থা থাকতে হবে যে, এই বিবাহে স্বামীর দ্বীন-ধর্মের কোনো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই; বরং এই বিবাহের পরও সে ঈমান ও দ্বীনের উপর অটল থাকতে পারবে ইনশাআল্লাহ।

(২) এই ব্যাপারেও নিশ্চিত ধারণা ও আস্থা থাকতে হবে যে, এই দম্পিতির যে সন্তানাদি জন্মগ্রহণ করবে (মা আহলে কিতাব হওয়ার কারণে) তাদের দ্বীন-ঈমান রক্ষার ক্ষেত্রে কোনো বাধা শিক্ষা-দীক্ষা অনুযায়ী জীবন কাটাতে পারবে। পুরুষ অথবা তার ভবিষ্যত সন্তানদের ক্ষেত্রে উক্ত বিষয়ে কোনো আশঙ্কা থাকলে বিবাহ জায়েয হবে না।

(৩) বিবাহের আগে ভালোভাবে জেনে নিতে হবে, যে রাষ্ট্রের মহিলাকে বিবাহ করার ইচ্ছা করছে সে রাষ্ট্রে সন্তানদেরকে মায়ের ধর্মের অনুসারী গণ্য করার আইন রয়েছে কি না। অর্থাৎ মা অমুসলিম হলে সন্তানও অমুসলিম ধর্তব্য হবে এরকম আইন থাকলে সেখানে থেকে ওই মহিলাকে বিবাহ করা জায়েয হবে না।

(৪) তালাক বা স্বামীর ইন্তেকালের কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেলে সন্তানরা ধর্মের দিক থেকে মায়ের অনুসারী গণ্য হবে এবং স্বামী বা স্বামীর ওয়ারিশরা তাদের নিতে পারবে না-এই ধরনের কোনো আইন যে দেশে রয়েছে সে দেশে অবস্থিত কোনো আহলে কিতাব মহিলাকেও বিবাহ করা জায়েয হবে না।

(৫) যদি আলামত-প্রমাণের মাধ্যমে স্পষ্টত বোঝা যায় যে, এই বিবাহের কারণে ইসলামী রাষ্ট্র বা মুসলমানদের কোনো ক্ষতি হবে তাহলে এ বিবাহ থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। বিধর্মী রাষ্ট্রের ইহুদী-খৃস্টানদের মধ্যে যেহেতু সাধারণত উপরোক্ত শর্তগুলো পাওয়া যায় না তাই ফুকাহায়ে কেরাম ঐক্যবদ্ধভাবে এই ফতোয়া দিয়েছেন যে, বিধর্মী রাষ্ট্রের কোনো আহলে কিতাব মহিলাকে বিবাহ করা মাকরূহে তাহরীমী; তথা না জায়েয ও গোনাহের কাজ। কোনো আহলে কিতাব মহিলা যদি ইসলামী রাষ্ট্রের অধিবাসী হয়ে থাকে এবং উপরোক্ত শর্তগুলো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায় তাহলে বিবাহ যদিও সংঘটিত হয়ে যাবে কিন্তু তা হবে খুবই অনুত্তম কাজ। যার আলোচনা তৃতীয় ধাপে আসছে। উপরোক্ত আলোচনার স্বপক্ষে কিছু নির্ভরযোগ্য দলীল প্রামাণ নিম্নে পেশ করা হল,

جاء في روح المعاني /৬৬ : قال ابن عباس رضي الله عنه : لَا يَحِلُّ نِكَاحُ نِسَاءِ أَهْلِ الْكِتَابِ، إِذَا كَانُوا حَرْبًا.

প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আহলে কিতাব মহিলাগণ হারবী তথা কাফের রাষ্ট্রের অধিবাসিনী  হলে তাদের সাথে বিবাহ বন্ধন বৈধ নয়। -তাফসীরে রুহুল মাআনী ৪/৬৬

সুপ্রসিদ্ধ ফক্বীহ আল্লামা ইবনে হুমাম রহ. (মৃত : ৮৬১ হি.) বলেন,

وتكره كتابية الحربية إجماعا، لانفتاح باب الفتنة من إمكان التعلق المستدعي للمقام معها في دار الحرب وتعريض الولد على التخلق بأخلاق أهل الكفر.

কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ে করা ফিকাহবিদদের সর্বসম্মতিক্রমে মাকরূহে তাহরীমী (না জায়েয)। কারণ স্বামীকে কাফের রাষ্ট্রে তার সাথে বসবাস করতে হবে। ফলে সকল প্রকার ফিতনার দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে এবং এতে সন্তানদেরকে কাফেরদের  সমাজে তাদের মতো করে বেড়ে উঠতে বাধ্য করা হবে। -ফাতহুল কাদীর ৩/১৩৫

সুপ্রসিদ্ধ ফকীহ আল্লামা দারদীর রহ. বলেন,

ويتأكد الكره أن تزوجها بدار الحرب، لأن لها قوة بها لم تكن بدار الإسلام فربما ربت ولده على دينها ولم تبال باطلاع أبيه على ذلك.

কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মেয়েকে বিয়ে করা আরও কঠিনভাবে নিন্দনীয়। কারণ মুসলিম রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলার চেয়ে এদের ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে। ফলে মহিলাটি সন্তানদেরকে স্বীয় ধর্মের উপর লালিত পালিত করতে থাকবে এবং সন্তানের পিতাকে এ ব্যাপারে সে কোনো পরওয়াই করবে না। -আশশারহুস সাগীর ১/৪০৬

বিখ্যাত ফকীহ আল্লামা শারবীনী রহ. বলেন,

لكن تكره حربية ليست بدار الإسلام وكذا تكره ذمية على الصحيح لما مر من خوف الفتنة لكن الحربية أشد كراهة منها.

কিন্তু যে সকল আহলে কিতাব মহিলা কাফের রাষ্ট্রে থাকে তাদেরকে বিবাহ করা মাকরূহ। তদ্রƒপ বিশুদ্ধ মতানুযায়ী মুসলমান দেশে বসবাসকারিনী আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ে করা দোষনীয়; ফিতনার আশঙ্কার কারণে। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রের চেয়ে কাফের রাষ্ট্রের অধিবাসিনীকে বিয়ে করা অধিক গর্হিত কাজ। -মুগনীল মুহতাজ ৩/১৮৭

জামেয়া আজহারের প্রখ্যাত শায়খ আব্দুল্লাহ আল গুমারী রহ. বলেন,

ومنها ما هو أشد قبحا أن الأولاد يتنصرون حتما تبعا لأمهم النصرانية، لأن الزوج إذا مات ضمتهم الأم إليها وربتهم على دينها وإذا طلقها فلا يسمح له القانون أن يأخذ أولاده بل يبقون مع والدتهم النصرانية.

কাফের রাষ্ট্রের আহলে কিতাব মহিলাদেরকে বিয়ে করার বড় একটি খারাবী হল, সন্তানাদি মার মতোই খৃস্টান হয়ে যায়। কারণ পিতার মৃত্যু ঘটলে মা নিজের ধর্মের অনুসারী করে সন্তানদেরকে লালন করতে থাকে। আর যদি স্বামী তালাক দিয়ে দেয় তাহলে রাষ্ট্রীয় আইনে স্বামী সন্তান নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পায় না। ফলে সন্তানরা মার সাথে থেকে তার ধর্মেই দিক্ষিত হয়। -দফউশশক ১৯

এরপর তিনি (শায়খ আব্দুল্লাহ) বেশ কিছু বাস্তব ঘটনার উদাহরণ নিয়ে এসেছেন, যেগুলোতে দেখা গেছে যে, সন্তানরাও তাদের মায়ের ধর্মাবলম্বী হয়েই বড় হয়ে উঠেছে ও আহলে কিতাব হয়ে গেছে।

আরও দ্রষ্টব্য : আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ২/৩২৬; আহকামুল কুরআন, থানভী ১/৪০৪; তাফসীরে মাজহারী ৩/৪১; তাতার খানিয়া ৩/৭

তিন. মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাসকারিনী ইহুদী-খৃস্টানকে বিবাহের হুকুম

আহলে কিতাব নারী যদি মুসলমান রাষ্ট্রে বসবাসকারিনী হয় এবং তাদেরকে বিয়ে করলে স্বামী বা সন্তান বিধর্মী হওয়ার আশঙ্কা নাও থাকে তবুও সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও চার মাযহাবের ফেকাহবিদগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাদেরকে বিয়ে করা মাকরূহ বলেছেন।

أخرج ابن أبي شيبة في مصنفه ৩/২৯৬ـ২৯৮ : تَزَوَّجَ حُذَيْفَةُ يَهُودِيَّةً فَكَتَبَ إِلَيْهِ عُمَرُ أَنْ خَلِّ سَبِيلَهَا، فَكَتَبَ إِلَيْهِ: إِنْ كَانَتْ حَرَامًا خَلَّيْتُ سَبِيلَهَا فَكَتَبَ إِلَيْهِ: إِنِّي لَا أَزْعُمُ أَنَّهَا حَرَامٌ، وَلَكِنِّي أَخَافُ أَنْ تَعَاطَوُا الْمُومِسَاتِ مِنْهُنَّ.

সাহাবী হুযায়ফা রা. এক ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। হযরত উমর রা. পত্র মারফত ওই মেয়েকে ছেড়ে দেওয়ার পারমর্শ দিলেন। তখন তিনি লিখে পাঠালেন, যদি তাকে বিয়ে করা হারাম হয়ে থাকে তাহলে আমি ছেড়ে দিব। উত্তরে হযরত জানালেন, আমি হারাম হওয়ার কথা বলি না, তবে আমার ভয় হয় এদের মাধ্যমে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়বে। -ইবনে আবি শাইবা ৩/২৯৬-২৯৮

অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,

وأخرج عبد الرزاق في مصنفه ৬/৭৮ : عَنْ قَتَادَةَ: أَنَّ حُذَيْفَةَ نَكَحَ يَهُودِيَّةً فِي زَمَنِ عُمَرَ، فَقَالَ عُمَرُ: طَلِّقْهَا فَإِنَّهَا جَمْرَةٌ.

হুযায়ফা রা. হযরত উমর রা.-এর শাসন আমলে এক ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করেন। তখন উমর রা. তাকে বললেন, তুমি ওই মেয়েকে তালাক দিয়ে দাও। কারণ সে হল অগ্নিকু-। -মুসান্নাফু আবদির রাজ্জাক ৬/৭৮

এ ঘটনার কিছু দিন পর হযরত হুযায়ফা রা. ওই মেয়েকে তালাক দিয়ে দেন।

أخرج عبد الرزاق في مصنفه ৬/৭৯ : أَنَّ طَلْحَةَ بْنَ عُبَيْدِ اللَّهِ نَكَحَ بِنْتَ عَظِيمِ الْيَهُودِ قَالَ: فَعَزَمَ عَلَيْهِ عُمَرُ إِلَّا مَا طَلَّقَهَا.

হযরত ত্বলহা রা. জনৈক ইহুদী মহিলাকে বিয়ে করলে খলিফা হযরত উমর রা. তাকে তালাক দিতে বাধ্য করেন। -মুসান্নাফু আবদির রাজ্জাক ৬/৭৯

হযরত উমর রা.-এর যুগ স্বর্ণযুগের অন্তুর্ভুক্ত। তার প্রশাসনের অধীনে বসবাসকারিনী আহলে কিতাব মহিলার বিয়ের ব্যাপারে যদি তার এ অভিমত হয়ে থাকে তবে বর্তমান যুগে ইহুদী-খৃস্টান নারীদের অবস্থা দেখলে তিনি কি হুকুম দিতেন তা সহজেই অনুমেয়। হযরত হাসান রা.কে একদা আহলে কিতাব মহিলাকে বিয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল। তিনি এর জবাবে বলেছিলেন,

مَا لَهُ وَلِأَهْلِ الْكِتَابِ وَقَدْ أَكْثَرَ اللَّهُ الْمُسْلِمَاتِ.

আহলে কিতাব মহিলাকে কেন বিবাহ করতে হবে? অথচ আল্লাহ তাআলা প্রচুর মুসলমান রমণী রেখেছেন। -রুহুল মাআনী ৪/৬৬

আল্লামা জাসসাস রহ. তাদের নারীকে বিয়ে করা মাকরূহ হওয়ার আরেকটি কারণও বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ তাআলার ইরশাদ

لَا تَجِدُ قَوْمًا یُّؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ یُوَآدُّوْنَ مَنْ حَآدَّ اللّٰهَ وَ رَسُوْلَهٗ.

অর্থ :- যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে তাদেরকে আপনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচরণকারীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে দেখবেন না। -সূরা আলমুজাদালাহ ২২

আর বিবাহ যে ভালোবাসা সৃষ্টি করে এটা তো বলাই বাহুল্য। -আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ২/৩২৬

এছাড়াও চার মাযহাবের ফকীহগণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে মুসলিম দেশে বসবাসকারিনী আহলে কিতাব মহিলাদেরকেও বিয়ে করা মাকরূহ তথা অনুত্তম বলেছেন। -আদদুররুল মুখতার ৩/৪৫; ফাতহুল কাদীর ৩/১৩২-১৩৬; আলমুগনী ৬/৫৯০; আলমুফাস্সাল ৭/১৮-১৯; আহকামুল কুরআন, জাস্সাস ২/৩২৪; আহকামুল কুরআন থানভী ১/৪০৫

পুরো বিষয়টির জন্য আরও দেখা যেতে পারে তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৩০; তাফসীরে কুরতুবী ৩/৫১; মাআরিফুল কুরআন ৩/৬০-৬৪; আলমাবসুত ৪/২১০; আলমুহীতুল বুরহানী ৪/১১০; আলবাহরুর রায়েক ৩/১০৩; আননাহরুল ফায়েক ২/১৯৪; ফাতহুল কাদীর ৩/১৩৫-১৩৬; আলমুফাস্সাল ৭/১২-২৪; দাফউশ্শাক্কি ওয়াল ইরতিয়াব, আব্দুল্লাহ আলগুমারী রহ.

والله أعلم بالصواب

 

 

advertisement