রবিউল আখির ১৪২৮   ||   মে ২০০৭

সাধারণ মানুষের জন্য কি দলীলসহ মাসআলা জানা জরুরি
কুরআনের একটি আয়াতে কতক গাইরে মুকাল্লিদ আলিমের তাহরীফ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই এ রীতি অব্যাহত রয়েছে যে, সাধারণ মানুষ আলেমদের কাছে, তালিবে ইলম উসতাদের কাছে এবং আলেমরা তাদের চেয়ে বড় আলেমের কাছে মাসায়েল জিজ্ঞেস করেন। কুরআন হাদীসের নিদের্শনা এবং দ্বীনী হুকুম আহকাম জানার এটিই স্বাভাবিক পদ্ধতি, যা অতীতেও অনুসৃত হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত অনুসৃত হবে ইনশাআল্লাহ।

জ্ঞানার্জনের এই স্বাভাবিক পদ্ধতির কথাই ইসলাম বলেছে এবং তা অনুসরণের তাগিদ করেছে। কুরআন হাকীমে ইরশাদ হয়েছে-

فَسْـَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ.

তোমাদের জানা না থাকলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর। -সূরা নাহল : ৪৩

হাদীস শরীফে এসেছে,

إِنَّمَا شِفَاءُ الْعِيِّ السُّؤَالُ.

না জানার সমাধান হল প্রশ্ন করা। -আবু দাউদ, হাদীস ৩৪০

মাসআলা জিজ্ঞেস করার দুটি পদ্ধতি রয়েছে। একটি এই যে, আলোচ্য বিষয়ে শরীয়তের হুকুম কী শুধু তা-ই জানতে চাওয়া। আর দ্বিতীয় পদ্ধতি হল, এ হুকুমের সূত্র কী অর্থাৎ কুরআনের কোন আয়াত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন হাদীস কিংবা শরীয়তের কোন মূলনীতি থেকে এ হুকুমটি আহরিত তা-ও জানতে চাওয়া। উভয় পদ্ধতিই প্রথম থেকে প্রচলিত ছিল। সাধারণ মুসলিমগণ যখন আলেমদের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করতেন, তখন সাধারণত এমনই হত যে, না তারা মাসআলার দলীল জিজ্ঞেস করতেন আর না উত্তরদাতা উত্তরের সঙ্গে দলীল উল্লেখ করতেন। খাইরুল কুরূন অর্থাৎ সাহাবী তাবেয়ীদের যুগে সাধারণ মুসলিম জনগণ মাসআলার সঙ্গে তার দলীলও জিজ্ঞেস করেছেন এমন নজির বিরল। তবে তালিবে ইলমগণ যখন তাদের উস্তাদদের কাছে কিংবা আলেমগণ তাদের চেয়ে বড় আলেমের কাছে মাসায়েল জিজ্ঞেস করতেন, তখন অনেক সময় দলীল প্রসঙ্গেও আলোচনা হত, তবে তা কোনো বাঁধাধরা নিয়ম ছিল না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই দলীল উল্লেখ না করে শুধু সমাধানটি উল্লেখ করা হত।

এখানে উল্লেখ্য যে, দলীল না থাকা এবং দলীল উল্লেখ না করা এক বিষয় নয়। যে মাসআলার দলীল নেই তা শরীয়তের মাসআলাই নয়। শরীয়তের মাসআলা সেটাই যা শরীয়তের দলীলের মাধ্যমে প্রমাণিত। মুফতী যখন মাসআলা বলেন তখন দলীলের ভিত্তিতেই বলেন। তবে সাধারণ মানুষকে মাসআলা বলার সময় দলীল-আদিল্লা উল্লেখ করা হয় না। জগতের সকল শাস্ত্রেই এই নীতি অনুসৃত।

সাহাবা যুগে মুজতাহিদের সংখ্যা খুবই সীমিত ছিল। সে সময় লোকেরা ব্যাপকভাবে  যাদের শরণাপন্ন হত এবং এ কারণে তাদেরকে অনেক মাসায়েল বয়ান করতে হত তাদের সংখ্যা চল্লিশেরও কম। (ইলামুল মুয়াক্কিয়ীন, ইবনুল কাইয়িম ১ তাঁদের এবং তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ী-  যুগের মুজতাহিদ মুফতীদের ফতোয়া হাদীস ও আসার বিষয়ক গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ বিষয়ে মুয়াত্তা ইমাম মালিক (১৭৯ হি.), মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক (২১১ হি.), মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা (২৩৫ হি.), সুনানে দারিমী (২৫৫ হি.), সুনানে সায়ীদ ইবনে মানসূর (২২৭ হি.), ইত্যাদি সমধিক প্রসিদ্ধ। মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক বড় বড় এগার খণ্ডে মুদ্রিত হয়েছে এবং মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার সর্বোত্তম সংস্করণ অল্প কিছুদিন আগে বৈরুত থেকে মোট ছাব্বিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

আলেমগণের অজানা নয় যে, এই কিতাবগুলোতে সংকলিত ফকীহ সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে তাবেয়ীদের অসংখ্য ফতোয়া এমন রয়েছে, যাতে না প্রশ্নকারী দলীল জিজ্ঞেস করেছেন আর না উত্তরদাতা দলীল উল্লেখ করেছেন। সাহাবী তাবেয়ীদের অধিকাংশ ফতোয়াই যে এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল তা উপরোক্ত কিতাবসমূহ থেকে বোঝা যায়। খাইরুল কুরূনের এই তাআমুল বা সম্মিলিত কর্মপন্থা থেকে এ বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, সাধারণ মানুষের জন্য দলীলসহ মাসায়েল জানা জরুরি নয়। কুরআন হাদীসেও মুসলমানদেরকে কিতাব-সুন্নাহর পারদর্শী আলেমের কাছ থেকে মাসায়েল জিজ্ঞেস করার ও তদনুযায়ী আমল করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে এই বাধ্য-বাধকতা আরোপ করা হয়নি যে, মাসআলার সমাধান জানার সঙ্গে সঙ্গে তার সূত্র ও দলীলও জানতে হবে। অতএব এটা সাধারণ মানুষের কর্তব্য নয়। এ ক্ষেত্রে তাদের যে কর্তব্য ইসলাম নির্ধারণ করেছে তা এই যে, কোনো অযোগ্য লোকের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করা যাবে না, কিতাব-সুন্নাহর  পারদর্শী ও হিদায়াতের উপর বিদ্যমান ব্যক্তির কাছ থেকেই মাসায়েল জিজ্ঞেস করতে হবে। অন্যদিকে আলেমকে বলা হয়েছে, তিনি যেন অত্যন্ত আমানতদারী ও সর্তকতার সঙ্গে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতে জওয়াব প্রদান করেন। ব্যক্তিগত মত বা মানসিক ঝোঁক দ্বারা যেন জওয়াবকে প্রভাবিত না করেন।

যদি প্রশ্নকারী তার সাধ্যমতো খোঁজ-খবর করে একজন ফতোয়াদানের উপযুক্ত দ্বীনদার আলিমের কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে ওই আলেম কোনরূপ তাহকীক ছাড়াই তাকে মাসআলা বলল, তাহলে হাদীস শরীফের ঘোষণা এই যে,

مَنْ أُفْتِيَ بِغَيْرِ عِلْمٍ كَانَ إِثْمُهُ عَلَى مَنْ أَفْتَاهُ.

যথাযথ না জেনে যদি কাউকে ফতোয়া দেওয়া হয় তবে এর গুনাহ ফতোয়াদাতাকেই বহন করতে হবে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রশ্নকারী দায়মুক্ত। -আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৪৯

তদ্রূপ ওই আলেম যদি যথাযথ তাহকীক করেই মাসআলা বলে থাকে কিন্তু ঘটনাক্রমে সমাধানটি ভুল ছিল তবে তার ব্যাপারেও হাদীসের কথা হল, সে একটি ছওয়াব লাভ করবে। -সহীহ বুখারী

তাহলে এক্ষেত্রে প্রশ্নকারী যে দায়মুক্ত হবে তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। কুরআন-হাদীসে যে বিষয়টি সাজাযোগ্য বলা হয়েছে তা এই যে, কোনো গোমরাহ লোককে নিজের ধর্মীয় গুরু বানিয়ে নেওয়া কিংবা কোনো অযোগ্য লোকের নিদের্শনা গ্রহণ করা অথবা দ্বীনী বিষয়কে গুরুত্বহীন মনে করে যেকারো কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে প্রশ্নকারী দায়মুক্ত হবে না; বরং করণীয় পালন না করার কারণে আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হবে।

মোটকথা, প্রশ্নকারীর কর্তব্য হল, যোগ্য লোকের কাছে প্রশ্ন করা, যার ব্যাপারে তার আস্থা রয়েছে যে, ইনি তাহকীক করে শরীয়তের দলীলের ভিত্তিতেই মাসআলা বয়ান করবেন। যোগ্য ক্যক্তির নিকট থেকে সমাধান লাভের পর তিনি তা কোন দলীলের ভিত্তিতে বললেন বা এর সূত্র কী এসব জানতে চাওয়া প্রশ্নকারীর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। শরীয়ত এটা তাদের কর্তব্য সাব্যস্ত করেনি। যুক্তির বিচারেও এ দায়িত্ব তাদের উপর চাপানো যায় না। কেননা, শরীয়তের সব মাসায়েল এক শ্রেণীর্ভুক্ত নয়। সব মাসায়েল এমন নয় যে, তার দলীল হিসেবে কোনো একটি আয়াত বা একটি হাদীস পড়ে তরজমা করে দিলেই তা স্পষ্ট বুঝে আসবে; বরং এক্ষেত্রে আয়াত বা হাদীস থেকে বিধানটি কীভাবে আহরণ করা হল তা দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ, যার পুরোটাই শাস্ত্রীয় আলোচনা। এ আলোচনা অনুধাবন করার জন্য বিভিন্ন ফন ও শাস্ত্রে পারদর্শিতা অপরিহার্য। যদি এটা না থাকে তাহলে দলীল ও তা থেকে বিধান আহরণের বিষয়টি বোঝা সম্ভব হবে না, শুধু আলোচনা শোনা সম্ভব হবে। তবে শুধু দলীল শোনার মাধ্যমে দলীল জানার যে উদ্দেশ্য-দলীলের পর্যালোচনা, তা কি সম্ভব হবে? তাহলে এ শ্রেণীর মানুষের উপর দলীল জানার দায়িত্ব কীভাবে আরোপ করা যেতে পারে?

যদি কোনো প্রশ্নকারী দলীল জিজ্ঞেস করেন এবং আলেম তাকে সংশ্লিষ্ট আয়াতটি শুনিয়ে দেন তাহলে পরবর্তী প্রশ্ন হবে, জনাব, আয়াতের অর্থ তো জানি না, তরজমা করুন। তরজমা বলার পর প্রশ্ন হবে, এখান থেকে উপরোক্ত সমাধান কীভাবে বের হল? আলেম বলবেন, বিধানটি ইবারাতুন নস থেকে নয়, ইশারাতুন নস থেকে আহরিত। এবার তাকে এই শাস্ত্রীয় পরিভাষাগুলো বোঝাতে হবে। আর এ আলোচনা শুধু মুখে মুখে শুনে পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব নয়। সুতরাং উপরোক্ত বিধানটি বাস্তবিকই ইশারাতুন নস থেকে আহরিত কি না, তা পরীক্ষা করার  তো প্রশ্নই আসে না। ধরে নেওয়া যাক, আলেম তাকে দলীলও বললেন এবং তা থেকে কীভাবে বিধান আহরিত হল তা-ও শোনালেন, আর শ্রোতা কিছু বুঝে কিছু না বুঝে তার কথা মেনে নিলেন, তাহলে এতদূর অগ্রসর হয়েই বা ফল কী হলমেনে নেওয়ার প্রশ্নই যখন আসল তো প্রথমেই মেনে নেওয়া উচিৎ ছিল।

এবার হাদীস প্রসঙ্গে আসি। এখানেও একই কথা। আলেম যদি মাসআলার দলীল হিসেবে কোনো হাদীস উল্লেখ করেন, তাহলে প্রশ্নকারীর প্রশ্ন হবে, জনাব, হাদীসটি সহীহ কি না? আলেম বললেন, সহীহ ইমাম তিরমিযী একে সহীহ বলেছেন। প্রশ্নকারী বলবেন। আমি তো আলবানী সাহেবের বই পড়েছি- তিনি তো  একে জয়ীফ বলেছেন। এখন আলেম যদি এই প্রসঙ্গে আলোচনাও করেন তবে এটি সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় বিষয় হওয়ায় শ্রোতা তা কতটুকুই বা বুঝতে সক্ষম হবেন আর তার পর্যালোচনাই বা কীভাবে করবেন? এখানেই শেষ নয়, এরপর প্রশ্ন হবে, হাদীসটির তরজমা বলুন। তরজমা বলা হলে প্রশ্ন হতে পারে, আমি তো ফাউণ্ডেশনের তরজমা পড়েছি, ওখানে তরজমা এভাবে নয়, ওভাবে করা হয়েছে। আলেম বললেন, ওই তরজমা সঠিক নয়। বলাবাহুল্য, এই প্রশ্নোত্তরের কোনো ফল দাঁড়াবে না। হয়তো প্রশ্নকারী শুধু শুনতে থাকবে কিংবা অযথা তর্ক করবে।

আরও কথা আছে, অনেক ক্ষেত্রে শুধু তরজমা থেকে মাসআলা বোঝা যাবে না, তখন প্রশ্ন হবে, এই হাদীস থেকে বিধান কীভাবে বের হল? অনেক মাসায়েলে এই প্রশ্নও হবে যে, আপনি যে হাদীসটি বললেন আমি তো এর বিপরীত হাদীস এই এই কিতাবে পড়েছি। এবারে তাআরুযুল আদিল্লাহর দীর্ঘ দুর্গম পথে প্রবেশ করতে হবে, যে পথে অগ্রসর হওয়া একজন সাধারণ পাঠকের জন্য মোটেও সম্ভব নয়, যদিও তিনি কিছু বাংলা  বা কিছু ইংরেজী বইপত্রের সাহায্যে কিছু পরিভাষা রপ্তও করে থাকেন। প্রশ্ন হয়, এসব বিষয়ে যদি সেই আলেমের আলোচনা শুনে তা মেনেই নেওয়া দাড়াল, যেহেতু পর্যালোচনার যোগ্যতা নেই; তাহলে এতসব প্রশ্নের ফল কী হল? আর যদি পর্যালোচনার যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তা মেনে নেওয়া না হয় তাহলে কি সেটা অজ্ঞ লোকের বাগাড়ম্বরে পর্যবসিত হবে না? এটা তো এমনই হবে যেমন কোনো রোগী তার চিকিৎসকের সঙ্গে কিংবা মক্কেল তার উকিলের সঙ্গে তাদের পরামর্শের ব্যাপারে অনধিকার তর্ক জুড়ল। মোটকথা সাধারণ মানুষকে দলীলসহ মাসায়েল জানতে বাধ্য করা যে যুক্তির  বিচারেও অগ্রহণযোগ্য তা বোঝা কঠিন নয়। তারপরও যদি তাদেরকে বাধ্য করতে হয় তাহলে তারচেয়ে উত্তম এই যে, সবাইকে কুরআন সুন্নাহর পারদর্শী আলেম হতেই বাধ্য করা। তবে এটাও ইসলাম পরিপন্থী।

এখান থেকেও বুঝা যায় যে, ইসলাম যখন সবাইকে আলেম হতে বাধ্য করে না তো সবাইকে মাসায়েলের দলীল জানতে বাধ্য করবে তাও হতে পারে না। এখানে একটি কথা বলে দেওয়া দরকার যে, তাওহীদ, রিসালাত ও অন্যান্য মৌলিক আকাইদ এবং শরীয়তের  বড় বড় মাসায়েল সাধারণত সবারই জানা থাকে এবং এ বিষয়ে অনেক আয়াত ও হাদীস রয়েছে। দ্বীনের মামুলী জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরাও এ দলীলগুলো জানেন। এসব বিষয়ে দলীল বলে দেওয়া সহজ, কিন্তু দলীলগুলো সাধারণত কেউ জানতে আসে না। যাহোক, আমাদের আলোচ্য বিষয় অর্থাৎ সাধারণ মানুষের জন্য মাসআলা দলীলসহ জানা জরুরি নয়-এর মতো একটি সহজবোধ্য কথাও যে কেউ অস্বীকার করতে পারে আমার জানা ছিল না। আমি আমাদের কিছু বাংলাদেশী সালাফী ভাইয়ের কাছে প্রথম শুনেছি যে, সাধারণ মানুষের জন্য মাসায়েল দলীলসহ জানা জরুরি। মুফতী যদি মাসআলা বলেন কিন্তু দলীল না বলেন তাহলে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যাবে না। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার  এই যে, তারা তাদের এ কথাটির উপর কোনো দলীল উল্লেখ করেনি। যেন আমাকেও একথাটি দলীল উল্লেখ করা ছাড়া স্বীকার করাতে চাচ্ছেন। অবশ্য এরূপ পরিষ্কার ভুল কথার দলীলই বা কোথায় পাওয়া যাবে।  এটা ছিল প্রথম। এরপর এক বন্ধু সৌদি থেকে একটি ক্যাসেট পাঠালেন যেখানে এক বাঙ্গালী সালাফীর বয়ান সংরক্ষিত ছিল। এ ব্যক্তি বাঙ্গালীদের মধ্যে সালাফী মতবাদ প্রচার কার্যে নিযুক্ত। ওই বন্ধুর আগ্রহ ছিল, আমি যেন ক্যাসেটটি শুনে এ ব্যাপারে মতামত লিখি। কেননা, এ জাতীয় বক্তৃতার মাধ্যমে নাকি সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশীদের পেরেশান করা হয়। ক্যাসেটটি শুনে আমার খুব আশ্চর্য হল। ওই বক্তা সূরা নাহলের, ৪৩-৪৪ নং আয়াত

فَسْـَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَۙ۝۴۳ بِالْبَیِّنٰتِ وَ الزُّبُرِ.

পড়ল এবং এর  তরজমা এভাবে করল যে, যদি তোমরা না জান তবে কুরআন ওয়ালা, হাদীস ওয়ালা উলামায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস কর দলীলের সাথে। আমি এটা শুনামাত্র ইন্নালিল্লাহ পড়লাম। কেননা, উপরোক্ত আয়াতের অর্থ এটা নয়। আয়াতের মর্ম এই যে, আল্লাহ এই আয়াতে মুশরিকদের ভ্রান্ত বিশ্বাস খ-ন করেছেন। মুশরিকদের প্রশ্ন ছিল মানুষ আবার রাসূল কীভাবে হবে? আল্লাহ এই ভ্রান্তি খ-ন করে উপরোক্ত আয়াতে বলেছেন, আমি পূর্ববর্তী সকল রাসূল তো মানুষের মধ্যেই প্রেরণ করেছি এবং সবাইকে বাইয়িনাত অর্থাৎ মুজিযা এবং যুবুর অর্থাৎ কিতাব দান করেছি। যদি তোমাদের তা জানা না থাকে তাহলে আহলে ইলমের কাছে জিজ্ঞেস কর। সালাফী আলেমদের লিখিত তরজমা ও তাফসীরেও এই মর্মই দেখতে পাবেন। ওই বক্তা بِالْبَیِّنٰتِ وَ الزُّبُرِ কে فَسْـَٔلُوْۤا এর সঙ্গে যুক্ত করে অর্থ করেছে দলীলসহ জিজ্ঞেস কর। এ তরজমা আরবী কাওয়াইদ, সুস্থ বিচার-বুদ্ধি এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকল মুফাসসিরের ইজমা পরিপন্থী।

প্রথমত ওই বক্তা উপরোক্ত আয়াতে তাহরীফ বা মর্মগত বিকৃতি সাধন করেছে, দ্বিতীয়ত একটি সম্পূর্ণ ভুল কথা আয়াতের উপর চাপানোর অপচেষ্টা করেছে। সাধারণ মানুষের জন্য সমাধান দলীলসহ জানা জরুরি- এ কথাটি একেবারেই ভুল। এ ভুল কথাটিকেই তিনি উপরোক্ত আয়াতের উপর আরোপ করে আয়াতের তাহরীফ করেছেন।

এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, প্রশ্ন হতে পারে যে, সাধারণ মানুষ দলীলের শুদ্ধতা কীভাবে যাচাই করবে? এর উত্তর এই যে, সাত-আটটি মাসআলা দলীলসহ জিজ্ঞেস করবে। যখন দেখা যাবে যে, মুফতী সাহেব দলীলসহ উত্তর দিচ্ছেন তো এরপর দলীল ছাড়াও তার কথা মেনে নেওয়া যাবে।

সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, তার এ বক্তব্য মোটেও আলেমসুলভ হল না এবং শরীয়তের ব্যাপারে দায়িত্বশীল মানসিকতার পরিচয় বহন করে না।

তার উপরোক্ত বক্তব্য সম্পর্কে প্রথম কথা এই যে, তার দাবি অনুযায়ী যদি কুরআনের উপরোক্ত আয়াতের অর্থ এই হয় যে, আলেমগণের কাছ থেকে দলীলসহ জিজ্ঞেস কর, তাহলে সাত-আটটি মাসআলা দলীলসহ জিজ্ঞেস করার পর বাকীগুলোতে আর তা লাগবে না-এ কথাটি তিনি কীভাবে বলছেন। একবার কুরআনের আয়াতে এই অর্থ আরোপ করলেন যে, মাসআলা দলীলসহ জানতে হবে। এরপর আবার স্বআরোপিত মর্ম থেকে সরে এসে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেন। কুরআনের আয়াতের সঙ্গে এতখানি দায়িত্বহীনতা কীসের পরিচয় বহন করে?

দ্বিতীয় কথা এই যে, যে সাধারণ মানুষটি শাস্ত্রীয় বিষয়াদি সম্পর্কে অনবগত তিনি সাত-আট মাসআলা কেন এক মাসআলার দলীলও কি পর্যলোচনা করতে পারলে? এটা তো খুবই সহজ কথা যে, যিনি শাস্ত্রীয় জ্ঞানে পারদর্শী তিনি সকল মাসআলার দলীলই পর্যালোচনা করতে পারবেন আর যার কাছে শাস্ত্রীয় জ্ঞান নেই তিনি এক মাসআলার দলীলও পর্যালোচনা করতে পারবেন না। তাহলে তার উপরোক্ত কথাটি কি একটি অসার কথা হল না।

তৃতীয় কথা এই যে, যে মুফতী সাহেব সাত-আট মাসআলায় দলীলসহ উত্তর দিলেন পারবর্তীতে তার কথা দলীল ছাড়াই গ্রহণ করা যাবে বলে তিনি যে মূলনীতিটি উল্লেখ করেছেন সে অনুযায়ী প্রশ্ন জাগে যে, ইমাম আবু হানীফা রহ.ও অন্যান্য মুজতাহিদ ইমাম যারা শত শত মাসআলা দলীলসহ উল্লেখ করেছেন এবং তা সঠিক হওয়ার ব্যাপারে সমগ্র উম্মাহর ইজমা রয়েছে তাদের সিদ্ধান্ত দলীল জানা ছাড়া গ্রহণ করার বৈধতা কি তার ওই মূলনীতি দ্বারাই প্রমাণিত হচ্ছে না?

অথচ ইমামগণের তাকলীদ অবৈধ সাব্যস্ত করার জন্যই তার এতসব কা- কারখানা। যাক মূলকথা এই ছিল যে, তিনি কুরআনের উপরোক্ত আয়াতটিতে তাহরীফ করেছেন।আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে, এখানকার কিছু কিছু গাইরে মুকাল্লিদও তাদের বিভিন্ন পুস্তিকা ও লিফলেটে জেনে বুঝে হোক কিংবা অজ্ঞতার কারণে হোক এই তাহরীফেরই পুনরাবৃত্তি করে থাকে।

সৌদির এই বাঙ্গালী প্রচারক যদি সৌদি আলেমগণের এবং সৌদি দারুলইফতা আল লাজনাতুদ দাইমার ফতোয়া সংকলনও উল্টে-পাল্টে দেখতেন তাহলে সেখানে এমন অনেক মাসায়েল পেয়ে যেতেন যাতে দলীল উল্লেখ নেই।

ওখানকার আলেমদের একাধিক ফতোয়া-সংকলন রয়েছে এবং فتاوى اللجنة الدائمة للبحوث العلمية والإفتاء ও মুদ্রিত আকারে রয়েছে। এগুলোতে আমরা বহু মাসায়েল এমন দেখেছি যেখানে মুফতী সাহেব কোনো দলীল উল্লেখ করেননি। আবার অনেক মাসায়েল এমন রয়েছে যেগুলোতে দলীলের প্রতি শুধু ইঙ্গিত করা হয়েছে বা সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা হয়েছে। দলীলের বিস্তারিত আলোচনা এবং দলীল থেকে মাসআলা আহরণের পদ্ধতি ইত্যাদি কিছুই উল্লেখিত করা হয়নি। বলাবাহুল্য, সাধারণ মানুষের পক্ষে দলীল শুনে এই সমস্ত কিছু বুঝে ফেলা  কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই একেও দলীল উল্লেখ করা বলা যায় না।

হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের গাইরে মুকাল্লিদ আলেমদের ফতোয়ার বিভিন্ন সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। এসব সংকলনেও আমরা দেখি যে, তারাও অনেক ক্ষেত্রে প্রশ্নকারীকে দলীলের উল্লেখ ছাড়াই উত্তর দিয়ে থাকেন। আমাদের দেশের গাইরে মুকাল্লিদরা তাদের যেসব আলেমদের  শরণাপন্ন হয়ে থাকে, যাদেরকে আহলে হাদীস উলামা বা সালাফী উলামা বলা হয়। তারা কয়টি মাসআলায় দলীল উল্লেখ করেন। এক সালাফী আলেমকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি যখন লোকদের মাসায়েল বলেন এবং তাদের প্রশ্নের জওয়াব দিয়ে থাকেন, তখন প্রত্যেক মাসআলার সঙ্গে দলীল উল্লেখ করেন কি? তিনি উত্তরে বললেন, আমি দলীল জিজ্ঞেস করার সুযোগ দিয়ে থাকি। তখন আদবের সঙ্গে জিজ্ঞেস করা হল, কথা তো এমন ছিল না। আপনাদের মতে যখন দলীল ছাড়া মাসআলা শুনলে তা মানাই জায়েজ নয় তখন আপনারা দলীল উল্লেখ না করে চুপ থাকেন কিভাবে? আর দলীল জিজ্ঞেসের সুযোগ দিলেই কি সমস্যার সমাধান হয়? তাছাড়া আপনারাই বা তাদের জিাজ্ঞাসার প্রতীক্ষায় থাকবেন কেন? আপনাদের উচিৎ নিজেরাই মাসায়েলের দলীল উল্লেখ করা এবং দলীল সংক্রান্ত সকল আলোচনার পাশাপাশি কীভাবে এই দলীল থেকে এই বিধান উৎসারিত হল তা-ও উল্লেখ করা, যদিও এতে এক মাসআলা বয়ান করতেই এক সপ্তাহ অতিবাহিত হতে পারে।

সূরা নাহলের যে আয়াতের আলোচনা উপরে এসেছে সেটি এবং এর সমার্থক আয়াত (সূরা আম্বিয়া, আয়াত-৭) এর তাফসীর যে কোনো নির্ভরযোগ্য তাফসীরগ্রন্থে দেখা যেতে পারে। আমি এখানে দুতিনটি কিতাবের উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি।

১. মসজিদে নববীর ওয়ায়েজ শাইখ আবু বকর জাবির আল জাযাইরীর প্রসিদ্ধ তাফসীর -আইসারুত্ তাফাসীর  খ. ৩, পৃ. ১১৯-১২১; ৩৯৭-৩৯৯

তিনি সেখানে একথাও লিখেছেন যে,

وفي الآية دليل على وجوب تقليد العامة العلماء، إذ هم أهل الذكر ووجوب العمل بما يفتونهم به ويعلمونهم به.

এই আয়াতে এ কথার দলীল রয়েছে যে, সাধারণ মানুষের জন্য আলেমগণের তাকলীদ ওয়াজিব এবং তাদের কুরআন-হাদীস ভিত্তিক ফতোয়া ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করা ওয়াজিব। কেননা, তাঁরাই হলেন আহলুয যিকর।

২. তাফসীরে ইবনে কাসীর খ. ২, পৃ. ৬২৮-৬২৯; খ. ৩, পৃ. ১৯২-১৯৩

৩. তাফসীরে কুরতুবী খ: ১, পৃ. ১০৮-১০৯, খ. ১১, পৃ. ২৭১-২৭২

কুরতুবী এখানে এ কথাও লিখেছেন যে, আলেমগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই যে, সাধারণ মানুষের জন্য আলেমগণের তাকলীদ অপরিহার্য এবং কুরআনের আয়াত فَسْـَٔلُوْۤا اَهْلَ الذِّكْرِ اِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُوْنَ-এ আলেমগণই উদ্দেশ্য। আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, অন্ধ ব্যক্তি যদি কিবলার দিক নির্ণয়ে অক্ষম হয় তখন তার জন্য একজন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির তাকলীদ করা যেমন জরুরি তদ্রƒপ যার ইলম নেই এবং অন্তদৃষ্টি নেই তাকেও দ্বীনের বিধি-বিধান মোতাবেক চলার জন্য দ্বীনের আলেমের তাকলীদ করতে হবে।  আর এ ব্যাপারেও আলেমদের কারো দ্বিমত নেই যে, সাধারণ মানুষের জন্য ফতোয়া দেওয়া জায়েজ নয়। কেননা, হালাল-হারামের সূত্র সম্পর্কে তারা অজ্ঞ।

 

 

advertisement