রবিউল আউয়াল ১৪২৮   ||   এপ্রিল ২০০৭

ইতিহাসের একটি অবহেলিত অধ্যায়

মুহাম্মদ আব্দুর রহীম ইসলামাবাদী

গত ১৫ মহররম ছিল দারুল উলূম দেওবন্দএর ১৪৫তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। আজ থেকে ১৪৫ বছর পূর্বে ১২৮৩ হিজরী সনে বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী শিক্ষকেন্দ্র দারুল উলূম দেওবন্দ স্থাপিত হয়। দারুল উলূম দেওবন্দএর প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম পৃষ্ঠপোষক মুরব্বী ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী রহ.। সম্প্রতি হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ.-এর একটি জীবনীগ্রন্থ বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকার বাংলাবাজারের আলআবরার প্রকাশনী বইটি প্রকাশ করেছে। অনেক দেরিতে হলেও জীবনী গ্রন্থটি প্রকাশিত হল। ভারতের মাওলানা আসীর আদরাভী এর প্রণেতা। প্রকাশ করেছে দারুল উলূম দেওবন্দের শায়খুল হিন্দ একাডেমী।

এ অঞ্চলে দেওবন্দ কেন্দ্রিক ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন চলছে ১৮৮০ সাল থেকে। একশ পঁচিশ বছরব্যাপী এ বিরাট খেদমতের কোনো বিস্তারিত ইতিহাস প্রকাশিত হয়নি। জাতীয় ইতিহাসেও এর স্থান হয়নি। ঐতিহাসিকরা এদিকে তেমন লক্ষও করেননি। অথচ এটা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এ অধ্যায়কে বাদ দিয়ে জাতীয় ইতিহাস ও বাংলাদেশের ইতিহাস রচিত হতে পারে না। হলেও তা অপূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হিসেবেই বিবেচিত হবে। ইতিহাসের লেখক, গবেষক, প্রকাশক ও পাঠক মহোদয়কে আমরা সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার আহবান জানাব। দেওবন্দ কেন্দ্রিক ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় আনুমানিক ১৮৮০ সাল থেকে। এ বছরই হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কাসেম নানুতবী রহ. ও বিখ্যাত মুহাদ্দিস বুখারী শরীফের টীকাকার ও প্রকাশক হযরত আল্লামা আহমাদ আলী সাহারানপুরী রহ. ইন্তেকাল করেন। আল্লামা আব্দুল ওয়াহিদ বাঙ্গালী রহ. ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দ-এর প্রথম যুগের ছাত্র। তিনি হযরত মাওলানা কাসেম নানুতবী রহ., হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ., হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমাদ রহ. প্রমুখের কাছে দেওবন্দে শিক্ষা লাভ করেন। ২ বছর তিনি হযরত মাওলানা ফযলে রহমান গাঞ্জে মুরাদাবাদী রহ.-এর খেদমতে অবস্থান করে আধ্যাত্মিকতা ও হাদীস শিক্ষা লাভ করেন। শাইখুল আরব ওয়াল আজম হযরত মাওলানা হাফেজ ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর কাছ থেকে তিনি খেলাফত লাভ করেন। অতঃপর চট্টগ্রাম প্রত্যাবর্তন করে ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। এ সংস্কারআন্দোলনে তার সহযোগী ছিলেন হযরত মাওলানা সূফী আজিজুর রহমান রহ., হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ রহ. ও হযরত মাওলানা আবদুল হামিদ রহ. -মাশায়েখে চাঁটগাম মাওলানা আহমাদ হাসান; তারীখে মাশায়েখে চিশত, শাইখুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ.

তারা  চট্টগ্রামের বোয়ালখালী, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা প্রভৃতি এলাকয় ছোট ছোট কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহেদ সাহেব রহ.-এর অনুপ্রেরণায় হযরত মাওলানা হাবীবুল্লাহ সাহেব রহ.  হাটহাজারী থানার চারিয়া গ্রামে রাস্তার পার্শ্বে একটি কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হাটহাজারী বাস ষ্টেশনের দক্ষিণ দিকে ঝারুয়া দীঘি এলাকায় হযরত মাওলানা আব্দুল হামিদ অপর একটি কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজ এলাকা আদর্শ গ্রামেও একটা কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। হাটহাজারী বাস ষ্টেশনের দক্ষিণ দিকে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা ছাড়িয়ে জোড়পুলের কাছে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসাকে একত্রিত করে ১৮৯৯ সনে হাটহাজারী বাজারের পশ্চিমে ফকির মসজিদের নিকটে প্রতিষ্ঠা করা হয়  দারুল উলূম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসা। যেখানে ২ বছর থাকার পর বর্তমানে যেখানে হাটহাজারী মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত আছে সেখানে ১৯০১ সনে দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা স্থানান্তর করা হয়। ১৮৮০ থেকে শুরু করে ১৯০১ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ২০/২১ বছরের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে ১৯০১ সনে বাংলায় প্রথম কেন্দ্রীয় কওমী মাদরাসা দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা হল। নতুন জায়গায় যেহেতু বড় আকারে প্রতিষ্ঠানটি কায়েম করা হয় তাই প্রতিষ্ঠার তারিখ ১৯০১ ইং স্থির করা হয়।

বাংলাদেশে দেওবন্দ কেন্দ্রিক শিক্ষা ও সংস্কার-আন্দোলনের একটা পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করে প্রকাশ করা কর্তব্য। দারুল উলূম দেওবন্দ এর রেজিষ্ট্রী দেখে নাম ঠিকানা ও সংগ্রহ করা যায়। প্রথমত হযরত কাসেম নানুতবী রহ., হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ., হযরত মাওলানা সৈয়দ আহমাদ রহ.-এর শাগরিদগণের নাম ও ঠিকানা, দ্বিতীয় পর্যায়ে শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমূদ হাসান রহ.-এর শাগরিদগণ, তৃতীয় পর্যায়ে আল্লমা সাইয়্যেদ মুহাম্মদ আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ.-এর  শাগরিদগণ এবং চতুর্থ পর্যায়ে শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ হোসাইন আহমাদ মাদানী রহ.-এর সাগরিদ এবং পঞ্চম পর্যায়ে হযরত মাওলানা ফখরুদ্দীন মুরাদাবাদী রহ.-এর সাগরিদগণের নাম ঠিকানা ও আলোচনা পেশ করা হলে এবং তাদের খেদমত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হলে তাতে এক বিরাট ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়ে যাবে।

মোটকথা, দারুল উলূম দেওবন্দের ১৪৫ বছরে ইতিহাস এবং এ অঞ্চলে দারুল উলূম দেওবন্দের ইলমী খেদমতের লিপিবদ্ধ হওয়া সময়ের এক বিরাট দাবি। সাথে সাথে দারুল উলূম দেওবন্দের আকাবির বুযুর্গগণের আধ্যাত্মিক সিলসিলা ও রূহানী খেদমতের বিবরণ  লিপিবদ্ধ হওয়াও সময়ের দাবি। শায়খুল আরব ওয়াল আজম হযরত মাওলানা হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ., ইমামে রাব্বানী হযরত মাওলানা রশিদ আহমাদ গাংগুহী রহ., হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মুহাম্মাদ কাছেম নানুতবী রহ., হযরত সৈয়দ হাজী আবেদ হোসাইন মোজাদ্দেদী এবং তাদের খলীফাগণের ও খলীফার খলীফাগণের আধ্যাত্মিক কর্মতৎপরতা বিবরণ প্রকাশও সময়ের অপরিহার্য দাবি। ভবিষ্যতে এ সম্পর্কে কিছু লেখার আশা পোষণ করে এ সংখ্যার লেখা এখানেই শেষ করছি।

 

 

advertisement