সফর ১৪২৮   ||   মার্চ ২০০৭

খাদ্য গ্রহণে ও স্বাস্থ্য সংরক্ষণে ইসলামের রীতি নীতি

মুহাম্মাদ হাসীবুর রহমান

আল্লাহ তাআলা খাদ্যকে মানুষের শরীরের জন্য এতটা জরুরি করেছেন যে, খাদ্য গ্রহণ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। সুতরাং বাঁচতে হলে মানুষকে খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। শরীর সুস্থ রাখতে হবে। শরীর সুস্থ থাকলে এই পৃথিবীতে পাঠানোর যে মাকসাদ আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী করা-তা যথাযথ আদায় কর সম্ভব হবে। অতএব, সুস্থতা হল ইলম-আমলের পূর্ণ হক আদায় করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক।

সুস্থতা এবং শরীরের ভারসাম্য মানুষকে যেমন কাজকর্মে স্পৃহা জোগায় তেমনি কাজটি যথাযথ আঞ্জাম দেওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি করে। শরীর সুরক্ষার জন্য খাদ্য নির্বাচন হল মূল বিষয়। কেননা মানুষের স্বভাব-রুচির বৈচিত্রের কারণে খাদ্যের পরিমাণ, কার্যকারিতা ও উপযোগিতায় তারতম্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই এই তারতম্যের ভিত্তিতেই খাবার নির্বাচন করতে হয় আর এর ব্যতিক্রম করার কারণেই সাধারণ মানুষের শরীরের অধিকাংশ রোগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং সাধারণভাবে সকল ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা মধ্যম পন্থা এর নীতি অবলম্বন করতে হবে। ইসলামী তাহযীব জীবনের সকল ক্ষেত্রের মতো এ বিষয়টিকেও সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছে। আলোচ্য বিষয়ে ইসলামের শিক্ষা হল-

১। হালাল খাদ্য গ্রহণ ও বৈধ পন্থায় উপার্জন

ক. ইসলামে যেহেতু বৈরাগ্যের কোনো স্থান নেই তাই খাদ্য গ্রহণের বিষয়টি এখানে অবহেলিত নয়; বরং মানুষ প্রয়োজনমাফিক খাদ্য গ্রহণ করবে এটাই ইসলামের শিক্ষা। মানব রুচিতে যেটা অরুচিকর মনে হবে সেটা অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারবে। এক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে কি ধরনের খাদ্য গ্রহণ করবে তার একটি সুস্পষ্ট মানদণ্ড ইসলামে রয়েছে।

ক. হালাল খাদ্য খেতে হবে। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الرُّسُلُ كُلُوْا مِنَ الطَّیِّبٰتِ وَ اعْمَلُوْا صَالِحًا

হে রাসূলগণ! পবিত্র হালাল বস্তু আহার করুন এং সৎ কাজ করুন।-সূরা মুমিনূন : ৫১

উল্লেখিত আয়াতে হালাল খাবার গ্রহণ করতে বলা হয়েছে এবং নেক আমলের আদেশ করা হয়েছে। হালাল রুজি খেয়ে আমল করলে কলব ইবাদতের স্বাদ অনুভব করবে এবং আল্লাহর কাছে তা মাকবুল হওয়ার অতি নিকটে পৌঁছবে।

অন্য একটি আয়াতে আরও স্পষ্ট করে মানব সম্প্রদায়কে উদ্দেশ করে খাবারের মানদণ্ড বর্ণনা করা হয়েছে এভাবে-

یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِی الْاَرْضِ حَلٰلًا طَیِّبًا

হে মানব সম্প্রদায় পৃথিবীর হালাল ও পবিত্র বস্তু আহার কর।-সূরা বাকারা : ১৬৮

হালাল খাবার যে স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী এবং ইবাদতের ক্ষেত্রে শক্তিশালী সহায়ক সেটাও কুরআনে কারীমে স্পষ্ট তুলে ধরা হয়েছে এবং স্বাস্থ্য ঠিক রাখার মাধ্যমেই ইবাদত যথাযথ পালন করা সম্ভব তা সেখান থেকে প্রকাশ পেয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

فَكُلُوْا مِمَّا رَزَقَكُمُ اللّٰهُ حَلٰلًا طَیِّبًا ۪ وَّ اشْكُرُوْا نِعْمَتَ اللّٰهِ اِنْ كُنْتُمْ اِیَّاهُ تَعْبُدُوْنَ

যদি তোমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর তবে তোমাদেরকে যেসব হালাল ও পবিত্র বস্তু তিনি দিয়েছেন তা থেকেই তোমরা আহার কর এবং আল্লাহর নেয়ামতের শোকর আদায় কর।

আর মন্দ ও হারাম খাদ্য ভক্ষণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

وَ یُحِلُّ لَهُمُ الطَّیِّبٰتِ وَ یُحَرِّمُ عَلَیْهِمُ الْخَبٰٓىِٕثَ

তিনি (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের জন্য পবিত্র বস্তুসমূহ হালাল ঘোষণা করেন এবং অপবিত্র বস্তুসমূহ নিষিদ্ধ করেন।-সূরা আরাফ : ১৫৭

খ. উপার্জিত খাদ্য বৈধ পন্থায় হতে হবে

আহার্য যেমন শরীয়তে নিষিদ্ধ নয় এমন কোনো বস্তু হতে হবে তেমনি সেটা উপার্জন করতে হবে বৈধ পন্থায়। তাহলে এই খাদ্য স্বাস্থ্যের পুষ্টি জোগাযে, কলবের উত্তম গিযায় পরিণত হবে, আমলে তারাক্কী হবে, আল্লাহর নিকট আমল কবুল হওয়ার অতি নিকটে পৌঁছবে। পক্ষান্তরে শরীয়ত যে খাদ্যগুলোকে স্বাস্থ্যের অনুপযোগী, মন্দ, অনুত্তম ও হারাম করেছে সেগুলো পরিহার করে চলতে হবে। অন্যথায় এগুলো কখনো বাহ্যিক কিছু ফায়দা দিলেও ক্ষতির সম্ভাবনাই থাকবে বেশি। এতে নূরের পরিবর্তে কলবে মাঝে জুলমাত সৃষ্টি হবে এবং একদিন সেই জুলমাতের তাড়নায় সত্যবিমুখ হয়ে যাওয়ারও সমূহ আশংকা রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَاْكُلُوْۤا اَمْوَالَكُمْ بَیْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ

হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না।-সূরা নিসা : ২৯

উল্লেখিত আয়াত থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, অবৈধ পন্থায় উপার্জিত খাদ্য গ্রহণ করা শরীয়তে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আর হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

يصبح أحدكم أشعث أغير يقول : يَا رَبِّ، يَا رَبِّ، وَمَطْعَمُهُ حَرَامٌ وَمَشْرَبُهُ حَرَامٌ، وَمَلْبَسُهُ حَرَامٌ، وَغُذِيَ بِالْحَرَامِ فَأَنَّى يُسْتَجَابُ لَهُ ؟

তোমাদের কেউ এলোমেলো চুলে, ধুলায় ধুসরিত হয়ে সকাল বেলা বলবে হে প্রভু! হে প্রভু! অথচ তার খাবার হবে হারাম, পানীয় হবে হারাম, পরিধেয় বস্তু হবে হারাম এবং হারাম বস্তু দিয়ে খাদ্য গ্রহণ করবে তাহলে কীভাবে তার দুআ কবুল করা হবে।

এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, হারাম বস্তু গ্রহণের ফলে ইবাদত কবুল হয় না। তাই হারাম বস্তু গ্রহণ করা থেকে আমাদেরকে বেঁচে থাকতে হবে।

২. শরীয় সুস্থ রাখা বা স্বাস্থ্য সংরক্ষণ করা

উত্তম খাদ্য গ্রহণ ও বৈধ পন্থায় উপার্জনের সাথে সাথে শরীর সুস্থ রাখার ব্যাপারেও ইসলামে গুরুত্বারোপ করা হযেছে। শরীরের উপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। কেননা মানুষের উপর তার রক্ত ও মাংসের, স্বাস্থ্য ও শরীরের বিরাট হক রয়েছে। সে হকের প্রতি নজর রাখা এবং শরীরকে সুস্থ রেখে ইবাদত বন্দেগীতে মগ্ন থাকা মানুষের দায়িত্ব। হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, অসুস্থ হওয়ার আগে সুস্থতাকে গনীমত মনে কর।-মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস : ৭৯১৬

কেননা সুস্থতা হল আল্লাহর নেয়ামত সেটার যথাযথ কদর করা মানুষের কর্তব্য।

আরেকটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে যখন আমার সম্পর্কে এই সংবাদ পৌঁছল যে, আমি লাগাতার রোযা রাখি, রাতে নামায পড়ি, (অন্য বর্ণনায় আছে, সারা রাত কুরআন পড়ি) তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

فَلَا تَفْعَلْ، فَإِنَّ لِعَيْنَيْكَ عَلَيْكَ حَقًّا، وَلِنَفْسِكَ عَلَيْكَ حَقًّا. وفي رواية : فإن لجسدك عليك حقا.

তুমি এ রকম করো না। নিশ্চয় তোমার চোখের হক রয়েছে, তোমার শরীরের হক রয়েছে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৮২; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৮৪

আলোচ্য হাদীস দুটি দ্বারা সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, শরীরের সুস্থতার প্রতি যত্নবান হওয়া জরুরি এবং যথাযথ ইবাদত করার জন্য সুস্থতার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে অবহেলা করা যাবে না এবং উত্তম ও হালাল খাবার গ্রহণে শিথিলতা প্রদর্শন করা যাবে না। যেমন শরীয়তে মুসাফিরদের জন্য সফর অবস্থায় রোযা না রাখার যে ছাড় দেওয়া হয়েছে, মুফাসসিরগণের ব্যাখ্যায় তার অন্যতম কারণ হল শরীর হেফাজত করা, যাতে দুর্বল হয়ে না পড়ে এবং স্বাস্থ্য ভেঙ্গে না যায়।

৩. পরিমিত খাদ্য গ্রহণ

ইসলাম সব ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দিয়েছে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। সম্পদ থাকা সত্ত্বেও একেবারে না খেয়ে বা অতি অল্প খেয়ে ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে থাকার কথা ইসলাম বলেনি। আবার অতি ভোজনে শরীরকে অচল করে ইসলামের বিধান পালনে অবহেলা প্রদর্শন করাও বৈধ করেনি; বরং সব সময় ভারসাম্য বজায় রাখতে বলেছে। কেননা অতি ভোজনে যেমন স্বাস্থ্যের ভারসাম্য বজায় থাকে না তেমনি ইবাদতেও একাগ্রতা পয়দা হয় না, অবহেলা দেখা দেয়। কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَّ كُلُوْا وَ اشْرَبُوْا وَ لَا تُسْرِفُوْا ۚ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الْمُسْرِفِیْنَ

তোমরা খাও ও পান কর, কিন্তু সীমাতিরিক্ত করো না। আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না।-সূরা আরাফ : ৩১

উল্লেখিত আয়াতটি এদিকে ইঙ্গিত করে যে, খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে মাত্রা অতিক্রম করা যাবে না, ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। তাহলে কাজকর্মে স্বতঃস্ফূর্ততা থাকবে এবং ইবাদত বন্দেগী করা সহজ হবে।

খলীফাতুল মুসলিমীন হযতর উমর রা. খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে سرف অপচয় বা সীমা লঙ্ঘণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে-

كفى بالمرأ سرفا أن يأكل كلما اشتهى

একজন মানুষের অপচয়ের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কামনার সব কিছুকে ভোগে রূপান্তরিত করে।-কিতাবুয যুহদ, আহমাদ ইবনে হাম্বল : ১২৩

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আল্লাহ তাআলা পানাহারকে হালাল করেছেন যতক্ষণ তা অপচয় (মাত্রাতিরিক্ত) হবে না এবং গর্ব করার জন্য হবে না।-তাফসীরে তাবারী ৫/৪৭২; তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/২৩৫

অর্থাৎ খাবারের স্বাভাবিক মাত্রা অতিক্রম করে অতি ভোজনে মেতে ওঠা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আর খাদ্য নিয়ে গর্ব করার রূপ তো বহুমুখী। উল্লেখযোগ্য একটা হল খাদ্য নিয়ে বাজি ধরা। যেহেতু বাজি ধরা মানেই হল, স্বাভাবিক ভক্ষণের চেয়ে অতিরিক্ত ভক্ষণ তাই এটা নিষেধ করা হয়েছে। একেতো এভাবে বাজি ধরাই নাজায়েয। সাথে আবার যুক্ত হয়েছে গর্ব প্রদর্শনের মাধ্যমে উদরপূর্তির প্রতিযোগিতা। অনেক সময় এই প্রতিযোগিতার ভক্ষণ জীবনের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শরীয়ত এগুলো কখনো সমর্থন করে না। নাফে বলেন-

كَانَ ابْنُ عُمَرَ، لاَ يَأْكُلُ حَتَّى يُؤْتَى بِمِسْكِينٍ يَأْكُلُ مَعَهُ، فَأَدْخَلْتُ رَجُلًا يَأْكُلُ مَعَهُ فَأَكَلَ كَثِيرًا، فَقَالَ: يَا نَافِعُ، لاَ تُدْخِلْ هَذَا عَلَيَّ، سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ المُؤْمِنُ يَأْكُلُ فِي مِعًى وَاحِدٍ، وَالكَافِرُ يَأْكُلُ فِي سَبْعَةِ أَمْعَاءٍ.

ইবনে উমর রা.-এর অভ্যাস ছিল, যতক্ষণ কোনো মিসকীনকে তার সঙ্গে খাওয়ার জন্য বসানো না হত ততক্ষণ তিনি খাবার খেতেন না। নাফে বলেন, আমি এক লোককে তার সঙ্গে খাবার খাওয়ার জন্য বসালাম। সে প্রচুল খেল। তখন ইবনে উমর রা. আমাকে উদ্দেশ করে বললেন, একে আর আমার সঙ্গে বসাবে না। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছি, মুমিন খায় এক অন্ত্রে আর কাফের খায় সাত অন্ত্রে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩৭৫

এই হাদীস থেকে স্পষ্টভবে বুঝা যায়, ভারসাম্য বজায় না রেখে মাত্রাতিরিক্ত খাওয়া মুসলমানের অভ্যাস নয়; বরং সব সময় পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করাই হল ইসলামের শিক্ষা। এই পরিমিত খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে শরীয়তের মূলনীতি যে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে তা তুলে ধরছি-

عَنْ مِقْدَامِ بْنِ مَعْدِي كَرِبَ، قَالَ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: مَا مَلأَ آدَمِيٌّ وِعَاءً شَرًّا مِنْ بَطْنٍ. بِحَسْبِ ابْنِ آدَمَ أُكُلاَتٌ يُقِمْنَ صُلْبَهُ، فَإِنْ كَانَ لاَ مَحَالَةَ فَثُلُثٌ لِطَعَامِهِ وَثُلُثٌ لِشَرَابِهِ وَثُلُثٌ لِنَفَسِهِ.

رواه الترمذي وقال : هذا حديث حسن صحيح.

অর্থ : মানুষ উদরের চেয়ে মন্দ কোনো পাত্র পূর্ণ করে না। তাদের জন্য মেরুদণ্ডকে সোজা রাখে এই পরিমাণ কয়েক মুঠো আহারই যথেষ্ট। একান্ত যদি আরও বেশি খেতে হয় তাহলে উদরকে তিন ভাগ করে এক ভাগ খাবারের জন্য বরাদ্দ করবে, আরেক ভাগ পানি পান করার জন্য, আরেক ভাগ শ্বাস নেওয়ার জন্য। -জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩৮০; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস : ৬৭৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩৩৪৯

খাদ্য গ্রহণে উল্লেখিত সীমা রেখা যে কোনো জ্ঞানী মানুষ শোনামাত্রই নির্দ্বিধায় গ্রহণ করে নিবে। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্রও হাদীসে উল্লেখিত শিক্ষার সঙ্গে একমত এবং গবেষণার মাধ্যমে হাদীসে বর্ণিত খাদ্য গ্রহণ করার পদ্ধতিকে স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী বিবেচনা করেছে।

আমার এক বন্ধু জানালেন, তিনি একটি পত্রিকায় দেখেছেন, আমেরিকার একটি বড় হাসপাতালের প্রধান ফটকে উদরকে তিন ভাগ করে খাদ্য গ্রহণ করার কথা লেখা রয়েছে। দেখুন, বিধর্মী হয়েও তারা ইসলামের শিক্ষাটাকে সাইনবোর্ডে ঝুলিয়েছে নিজেদের স্বার্থে, জাতির স্বার্থে এবং শরীরটাকে সুস্থ রাখার স্বার্থে।

হযরত উমর রা. একদিন খুতবা দিতে গিয়ে বললেন, তোমরা অতিরিক্ত ভোজন থেকে বেঁচে থাক। কেননা এটা নামাযে অলসতা সৃষ্টি করে এবং শরীরের জন্য কষ্টদায়কও বটে। তোমরা দৈনন্দিন খাবারে পরিমিত আহার কর। কারণ এটা তোমাদেরকে প্রাচুর্যের অহংকার থেকে দূরে রাখবে এবং শরীরের জন্য উপকারী হবে। ইবাদতে অধিক শক্তি যোগাবে। জেনে রাখবে, মানুষ তখনই ধ্বংস হয় যখন সে দ্বীনের উপর নিজের খাহেশাতকে প্রাধান্য দেয়।

৫. স্বাভাবিক এবং সাধারণ খাবার খাওয়া

সাধারণ খাদ্য খাওয়া এবং সহজলভ্য খাবার খেয়ে পরিতৃপ্ত থাকা, বেশি বেশি ইবাদত-বন্দেগী করা এটা ইসলামের আদর্শ। খাদ্য নিয়ে মেতে থাকা এবং ভোগ-বিলাসে লিপ্ত হওয়া ইসলাম সমর্থন করে না। যার যতটুকু সামর্থ্য আছে এবং যে পরিমাণ আল্লাহ রিযিকে রেখেছেন ততটুকুতেই সন্তুষ্ট থকা এবং নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা। কিন্তু অনেকের মুখে সাধারণ খাদ্যের ব্যাপারে অনেক অভিযোগ শোনা যায়। কখনো কাউকে জিজ্ঞাসা করা হলে, ভাই কী দিয়ে ভাত খেলেন; যদি ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে থাকে, তাহলে এমন ভাব প্রকাশ করে যে, সেটা যেন খাদ্যের আওতায় পড়ে না। অথচ ওটাও তো আল্লাহর নেয়ামত। ওটাও তো আল্লাহর দেওয়া রিযিক। আমরা তো ডাল ভাত পেয়েছি। কত আল্লাহর বান্দা রয়েছে যারা এটাও পাচ্ছে না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সাধারণ খাবার খেয়েছেন; উপস্থিত যা পেয়েছেন তাই আগ্রহভরে গ্রহণ করেছেন এবং শুকরিয়া আদায় করেছেন। হরেক রকম খাদ্যের পিছনে পড়েননি এবং জাঁকজমকপূর্ণ খাবারের ব্যবস্থা করতে বলেননি। নিম্নোক্ত হাদীসটি তার উজ্জ্বল প্রমাণ-

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَأَلَ أَهْلَهُ الْأُدُمَ، فَقَالُوا مَا عِنْدَنَا إِلَّا خَلٌّ، فَدَعَا بِهِ، فَجَعَلَ يَأْكُلُ بِهِ، وَيَقُولُ نِعْمَ الْأُدُمُ الْخَلُّ، نِعْمَ الْأُدُمُ الْخَلُّ.

জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিবারের কাছে তরকারি চাইলেন। তারা বললেন, আমাদের কাছে সিরকা ছাড়া আর কিছু নেই। রাসূল তা-ই আনতে বললেন, অতপর তা দিয়ে খাওয়া শুরু করলেন এবং বললেন, সিরকা কতই না উত্তম তরকারি। -সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০৫১

রাসূলের উপরোক্ত হাদীস আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। কিন্তু সমাজের চিত্র অবলোকন করলে দেখা যায়, এক শ্রেণীর লোক আয়েশি জীবন এবং রকমারি খাদ্যের তাগিদে সদা ধাবমান। এমনকি হালাল-হারাম বাছ-বিচার করার প্রয়োজন তাদের নেই। পার্থিব জগতে শুধু ‘‘খাও দাও ফূর্তি কর’’ এই দর্শনে তারা বিশ্বাসী। তারা পরকাল থেকে সম্পূর্ণ গাফেল হয়ে ইহকালকে প্রাধান্য দিচ্ছে। অথচ পরকালের জীবনই অসীম ও অনন্ত। অতএব পরকালের সফলতা অর্জনের জন্য ক্ষণস্থায়ী ভোগ বিলাস পরিত্যাগ করতে হবে। আমাদের দুনিয়ায় আসার উদ্দেশ্য আরাম আয়েশে মত্ত থাকা নয়; বরং কে কত উত্তম আমল করতে পারে তার জন্য। সুতরাং ইবাদতের বিষয়টি হতে হবে মূল আর খাদ্যের বিষয়টি হবে প্রয়োজন পূরণের পর্যায়ে। অতএব এটা পোলাম না, ওটা খেলাম না এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে এবং স্বাভাবিক রিযিকে যা আসে তা-ই সানন্দে গ্রহণ করার গুণ অর্জন করতে হবে।

উম্মে হানী রা. বলেছেন-

دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ هَلْ عِنْدَكُمْ شَيْءٌ؟ فَقُلْتُ: لَا، إِلَّا كِسَرٌ يَابِسَةٌ وَخَلٌّ، فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَرِّبِيهِ، فَمَا أَقْفَرَ بَيْتٌ مِنْ أُدْمٍ فِيهِ خَلٌّ.

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট তাশরীফ আনলেন এবং বললেন, তোমার কাছে কিছু আছে? আমি বললাম, শুধু শুকনা কয়েক টুকরা রুটি ও সিরকা আছে। তখন রাসূল বললেন, তাই নিয়ে আস। এরপর বললেন, যে ঘরে সিরকা রয়েছে সে ঘর তরকারি শূন্য নয়।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৮৪০

উপরোক্ত হাদীসে দেখুন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কয়েক টুকরা শুকনা রুটি এবং সাধারণ সিরকাও সানন্দে গ্রহণ করেছেন।

সুতরাং যার যে পরিমাণ সামর্থ্য আছে; অপব্যয়, অপচয় ও সীমা লঙ্ঘন না করে স্বাভাবিক পানাহার করুন। সামনে যে ধরনের ধাদ্য উপস্থিত হয় আল্লাহর নেয়ামত হিসেবে প্রফুল্লতার সাথে তা-ই গ্রহণ করুন এবং শুকরিয়া আদায় করুন। এতে খাদ্যের অভাব হবে না এবং না পাওয়ার কষ্টও অনুভব হবে না।

৪. উদরপূর্তি নয়; কখনো পরিতৃপ্তি, কখনো অল্পে তুষ্টি

পরিমিত খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে পিছনে মোটামুটি প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করা হয়েছে। এখানে অল্পে তুষ্টি এবং প্রয়োজনে ক্ষুধার্ত থাকার ইসলামী শিক্ষা তুলে ধরছি।

অল্পে তুষ্টি সম্পর্কে হাদীসের কয়েকটি স্পষ্ট বাণী তুলে ধরা সমীচীন মনে করছি। আশা করি, বিষয়টি বুঝতে অতিরিক্ত ব্যাখ্যার প্রয়োজন হবে না। কারণ হাদীসগুলো শুনলে যে কোনো ব্যক্তিই অনুধাবন করতে পারবেন যে, সেগুলোতে কী শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। অল্পে তুষ্টি সম্পর্কে কিছু হাদীস উল্লেখ করা হল।

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، أَنَّهُ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ طَعَامُ الِاثْنَيْنِ كَافِي الثَّلاَثَةِ، وَطَعَامُ الثَّلاَثَةِ كَافِي الأَرْبَعَةِ.

১ম হাদীস :

হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুইজনের খাদ্য তিনজনের জন যথেষ্ট। তিনজনের খাদ্য চারজনের জন্য যথেষ্ট। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৩৯২

উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. ইবনে জারীর রাহ.-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, এই হাদীসের অর্থ হল, যে পরিমাণ খাদ্য একজনকে পরিতৃপ্ত করে, সেটা দুইজনের ক্ষুধা দূর করতে যথেষ্ট। আর যে পরিমাণ খাদ্য দুইজনকে পরিতৃপ্ত করে সেটা চারজনের খোরাক হিসেবে যথেষ্ট।-ফাতহুল বারী ৯/৪৪৬

২য় হাদীস :

عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِنَّ طَعَامَ الْوَاحِدِ، يَكْفِي الِاثْنَيْنِ، وَإِنَّ طَعَامَ الِاثْنَيْنِ، يَكْفِي الثَّلَاثَةَ وَالْأَرْبَعَةَ، وَإِنَّ طَعَامَ الْأَرْبَعَةِ، يَكْفِي الْخَمْسَةَ وَالسِّتَّةَ.

উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজনের খাবার দুইজনের জন্য যথেষ্ট। দুইজনের খাবার তিন-চার জনের জন্য যথেষ্ট। আর চারজনের খাবার পাঁচ-ছয় জনের জন্য যথেষ্ট।-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩২৫৫

৩য় হাদীস  :

عن جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللهِ، يَقُولُ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: طَعَامُ الْوَاحِدِ يَكْفِي الِاثْنَيْنِ، وَطَعَامُ الِاثْنَيْنِ يَكْفِي الْأَرْبَعَةَ، وَطَعَامُ الْأَرْبَعَةِ يَكْفِي الثَّمَانِيَةَ. رواه مسلم والترمذي.

জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, একজনের খাবার দুইজনের জন্য যথেষ্ট এবং দুইজনের খাবার চারজনের জন্য যথেষ্ট। আর চারজনের খাবার আটজনের জন্য যথেষ্ট।-সহীহ মুসলিম; জামে তিরমিযী

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement