জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৪   ||   জানুয়ারি ২০২৩

নববর্ষ
নতুন বছরটি হোক সত্য ও ন্যায়ের, সৌজন্য ও মানবিকতার

ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী একটি বর্ষ শেষ হয়েছে, নতুন আরেকটি বর্ষ শুরু হয়েছে। এই নববর্ষ আমাদের সবার জন্য হোক কল্যাণের পথে নতুন উদ্দীপনা।

পথ চলতে মানুষের যেমন দরকার হয় চলৎশক্তির তেমনি প্রয়োজন হয় উৎসাহ-উদ্দীপনার। উদ্দীপনাহীন মানুষ সকল সক্ষমতা সত্ত্বেও অচল। তাই মানুষের জন্য চাই প্রাণসঞ্জিবনী কোনো কিছু।

মহান আল্লাহ আমাদের চারপাশের প্রকৃতিতে উদ্দীপনার বহু উপাদান সৃষ্টি করেছেন। রাত-দিন, মাস বছরের আবর্তন তেমনই এক উপাদান। প্রতিটি নতুন ভোর মানুষকে সতেজ করে, নব উদ্দীপনায় বলীয়ান করে। গতকালের অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দ্বারা বদলে ফেলার সজীব সংকল্প মানুষের মনে নতুন করে বাসা বাধে। নববর্ষও মানুষের মন-মানসে নিয়ে আসে নতুনের ঘ্রাণ, নতুনের বার্তা।

নতুন বছরে মানুষ নতুন প্রত্যাশায় উদ্বেলিত হয়। এ প্রত্যাশা আল্লাহর রহমতের প্রত্যাশা। পরম করুণাময় হয়তো ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্য গচ্ছিত রেখেছেন শান্তি ও সাফল্য, কল্যাণ ও নিরাপত্তা। নতুন বছরে মানুষকে নতুন করে এই সংকল্পে উদ্দীপ্ত হতে হয় যে- সব আলস্য ত্যাগ করে, সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, অতীতের ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আবারো সে সত্য-ন্যায়ের পথে জোর কদমে এগিয়ে যাবে।

নববর্ষে আমরা যে নবপ্রত্যাশায়, নতুন সংকল্পে বলীয়ান হই- তা আমাদের অনেক বড় চালিকাশক্তি। তবে এই শক্তি আমাদের কোন্ পথে পরিচালিত করবে তা নির্ভর করে আমরা কোন্ পথটি অবলম্বন করছি তার উপর। আমরা কি কুরআন-সুন্নাহ্য় নির্দেশিত সত্য ও কল্যাণের পথ অবলম্বন করছি, না শয়তান ও প্রবৃত্তি নির্দেশিত মিথ্যা ও অকল্যাণের পথ অবলম্বন করছি।

নতুন বছরের শুরুতে আমরা সংকল্পবদ্ধ হতে পারি সৌজন্য ও মানবিকতার পথে চলার। আমাদের জীবনে যেন আসে সৌজন্যের ঘ্রাণ, মানবিকতার আলো। ইসলামের দৃষ্টিতে সৌজন্য অতি বাঞ্ছিত ও কাম্য বিষয়। ছোট বড় সকলের সাথে সৌজন্যপূর্ণ আচরণ ইসলামের শিক্ষা। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট কথা-কাজও সৌজন্যের স্পর্শে সুরভিত হয়ে উঠতে পারে। সুন্দর কথা, ভদ্র ব্যবহার, মার্জিত চাল চলনের মাধ্যমে একজন মানুষ হয়ে উঠতে পারেন সবার প্রিয়পাত্র। ছোট ছোট মানবিক আচরণও মানুষের হৃদয়পটে স্থায়ী দাগ কাটতে পারে। কাজেই সৌজন্য ও মানবিকতার চর্চা খুবই প্রয়োজন। বিশেষত মুসলিমদের জন্যে তা আরো বেশি প্রয়োজন। একে তো এটা ইসলামের শিক্ষা; দ্বিতীয়ত মুসলিমমাত্রই দ্বীনের দাঈ। প্রত্যেক মুসলিমকে এ সত্য অত্যন্ত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, তিনি আল্লাহর অনুগ্রহে যে দ্বীন অবলম্বন করেছেন তা-ই আল্লাহর কাছে মনোনীত একমাত্র দ্বীন। এটিই মানবজাতির জন্য সর্বোত্তম জীবনাদর্শ। প্রত্যেক মুসলিম নিজে যেমন এই জীবনাদর্শের অনুসারী হবেন তেমনি অন্যকেও এর দিকে আহ্বান করবেন। আর উভয় ক্ষেত্রেই সৌজন্য ও মানবিকতা অতি প্রাসঙ্গিক।

একজন ভালো মুসলিম অবশ্যই উন্নত সৌজন্যবোধ ও মার্জিত আচরণের অধিকারী। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

المُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ المُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.

মুসলিম সে, যার হাত ও জিহ্বা থেকে মুসলিমেরা নিরাপদ থাকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০

হাদীস শরীফে আরো ইরশাদ হয়েছে-

تَبَسُّمُكَ فِي وَجْهِ أَخِيكَ لَكَ صَدَقَةٌ.

তোমার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসা সদাকা। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৫৬

হাদীস শরীফে কোমলতাকে বলা হয়েছে সবকিছুর সৌন্দর্য বিধানকারী।

ইরশাদ হয়েছে-

إِنَّ الرِّفْقَ لَا يَكُونُ فِي شَيْءٍ إِلّا زَانَهُ، وَلَا يُنْزَعُ مِنْ شَيْءٍ إِلّا شَانَهُ.

যে বস্তুতেই কোমলতা আসে তা সুন্দর হয় আর যে বস্তু থেকেই তা উঠিয়ে নেয়া হয় তা ত্রুটিযুক্ত হয়ে পড়ে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৯৪

আল্লাহ তাআলা কোমলতার মাধ্যমে এমন কিছু দান করেন, যা কঠোরতার মাধ্যমে দেন না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৯৩

হাদীস শরীফের এইসকল বাণী ও নির্দেশনা আমাদের জানাচ্ছে যে, নম্রতা, ভদ্রতা, সৌজন্য ও কোমলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গুণ। ভালো মুসলিম হওয়ার জন্য, আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য এইসকল গুণ অর্জন করা অতি জরুরি। পার্থিব জীবনেও সামষ্টিক, সামাজিক ও দাওয়াতী কাজ কর্মে সাফল্য লাভের জন্যও এর বিকল্প নেই। এটা এমনই বৈশিষ্ট্য যে, তা যদি কাফির-মুশরিকেরাও অর্জন করে তাহলে তারাও পৃথিবীতে সুনাম ও জনপ্রিয়তা অর্জন করবে। এমনকি মুসলিমদের মনেও তাদের প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হতে পারে। বাস্তবেও এর অনেক উদাহরণ দেখা যায়। বিশেষত সেলিব্রেটিদের ছোট ছোট সৌজন্যপূর্ণ আচরণ, মানবিকতার ছোট-বড় দৃষ্টান্তগুলো সাধারণ মানুষকে অত্যন্ত গভীরভাবে নাড়া দিয়ে থাকে।

মানুষকে আল্লাহ তাআলা হৃদয় নামক যে জিনিসটি দিয়েছেন তা অত্যন্ত সংবেদনশীল। সৌজন্য ও মানবিকতা একে প্রভাবিত করেই থাকে। একারণে মুসলমানদের কর্তব্য, ইসলামের এই শিক্ষাকে খুব ভালোভাবে রপ্ত করা এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে এর সঠিক চর্চার মাধ্যমে একজন প্রকৃত সজ্জন মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা।

অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর অবক্ষয় ও অনৈতিকতাকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ না করে তাদের কিছু কিছু সৌজন্যমূলক আচরণ থেকে আমরা যদি আমাদের মহান দ্বীনকে স্মরণ করতে পারি, যা জগদ্বাসীকে সৌজন্য ও মানবিকতার পূর্ণাঙ্গ ও সর্বোত্তম শিক্ষা দান করেছে, তাহলে তা-ও কল্যাণ ও সান্ত¡নার বিষয় হতে পারে।

আসুন আমরা ইসলামের সৌজন্য ও মানবিকতার শিক্ষাকে স্মরণ করি। আমরা যদি নতুন বর্ষের সূচনায় আমাদের জীবন ও কর্মকে আদর্শের আলোয় আলোকিত করার সংকল্প গ্রহণ করতে পারি তাহলে সেটা হবে অসংখ্য আতশবাজি এবং ক্ষণিকের আনন্দ-ফুর্তি ও অন্যদের অন্ধ অনুকরণে মেতে ওঠার চেয়েও মনোরম, হৃদয়গ্রাহী ও কল্যাণকর।

 

 

advertisement