জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

এ বর্ণনাটি প্রমাণিত নয়
যে দুআ পড়লে মা-বাবার হক অদায় হয়ে যায়!

মকছুদোল মোমিনীন শিরোনামের এক পুস্তিকায় একটি বর্ণনা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে-

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনা শরীফের মসজিদে বসিয়া বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি (নিম্ন লিখিত) এই দোয়াটি নিয়মিত পাঠ করিবে রব্বুল আলামীন তাহাকে মাতা-পিতার হক আদায়ের সমপরিমাণ নেকী দান করিবেন। দোয়াটি হল-

الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ السَّموَاتِ وَرَبِّ الْعَالَمِينَ، وَلَهُ الْكِبْرِيَاءُ فِي السَّموَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ، الْحَمْدُ لِلهِ رَبِّ السَّموَاتِ وَرَبِّ الْأَرْضِ ورَبِّ الْعَالَمِينَ، وَهُوَ الْعَظَمَةُ فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ، لِلَّهِ الْحَمْدُ رَبِّ السَّموَاتِ وَرَبِّ الْأَرْضِ ورَبِّ الْعَالَمِينَ، وَلَهُ النُّورُ فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ.

এটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস হিসেবে প্রমাণিত নয়। এর নির্ভরযোগ্য কোনো সনদ নেই। যে সনদে এটি বর্ণিত হয়েছে তাতে বিশ্র ইবনুল হুসাইন নামে একজন বর্ণনাকারী রয়েছে, যার ব্যপারে ইবনে হিব্বান রাহ. বলেন-

يروي بشر بن الحسين، عن الزبير نسخة موضوعة شبيها بمِئَة وخمسين حديثًا.

বিশ্র ইবনুল হুসাইন যুবায়ের (ইবনে আদী) থেকে একটি জাল পুস্তিকা বর্ণনা করে, যাতে একশত পঞ্চাশটির মতো জাল বর্ণণা রয়েছে।

আবু হাতেম রাহ. বলেন-

يكذب على الزبير.

সে (বিশ্র ইবনুল হুসাইন) যুবায়ের (ইবনে আদী)-এর নামে মিথ্যা বলে। [দ্রষ্টব্য : লিসানুল মীযান ও মীযানুল ইতিদাল, বিশ্র ইবনুল হুসাইনের তরজমা (জীবনী)]

আমাদের আলোচ্য বর্ণনাটিও বিশ্র ইবনুল হুসাইন যুবায়ের ইবনে আদী থেকে বর্ণনা করে। (দ্র. আততারগীব ফী ফাযাইলিল আমাল, ইবনে শাহীন, বর্ণনা ৩০২)

সুয়ূতী রাহ. যাইলুল লাআলীতে দায়লামীর সূত্রে বিশ্র ইবনুল হুসাইন থেকে এর কাছাকাছি একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। ইবনে ইরাক রাহ. তানযীহুশ শরীআহ্য় উক্ত বর্ণনাটি উল্লেখ করার পর বলেন-

وَفِيه بشر بن الْحُسَيْن.

এ বর্ণনায় বিশ্র ইবনুল হুসাইন রয়েছে। (দ্র. তানযীহুশ শরীআহ, ইবনে ইরাক ২/৩২৯; যাইলুল লাআলিল মাসনূআহ, সুয়ূতী, পৃ. ৬০৫, বর্ণনা ৭৩৮)

যাইহোক, বর্ণনাটির সূত্র নির্ভরযোগ্য নয়; সুতরাং তা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা বৈধ নয়।

বর্ণনাটি অনির্ভরযোগ্য হওয়ার সাথে সাথে এতে বর্ণিত কথাটিও আপত্তিকর; নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কথা বলতে পারেন না। কারণ, ইসলামী শরীয়তে মা-বাবার হক অনেক গভীর ও ব্যাপক। কেবলমাত্র একটি দুআর মাধ্যমে তা আদায় হবার নয়।

আসলে সন্তানের পক্ষে মা-বাবার হক আদায় করা সম্ভবই নয়। নবীজী বিষয়টি উল্লেখ করার সাথে সাথে একটি উদাহরণও দিয়েছেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لَا يَجْزِي وَلَدٌ وَالِدًا، إِلّا أَنْ يَجِدَهُ مَمْلُوكًا فَيَشْتَرِيَهُ فَيُعْتِقَهُ.

কোনো সন্তানের পক্ষে বাবার প্রতিদান দেওয়া (বা হক আদায় করা) সম্ভব নয়; হাঁ, যদি তাঁকে গোলাম অবস্থায় পায় আর খরিদ করে আযাদ করে দেয়! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫১০

বাবার বিষয়েই যদি এভাবে বলা হয়, তাহলে মায়ের বিষয়ে নবীজী কী বলতেন। কারণ, ইসলামে মায়ের হক বাবার চেয়ে অনেক বেশি।

একবার ইবনে উমর রা.-কে এক ব্যক্তি বলল-

حملت أمي على رقبتي من خراسان حتى قضيت بها المناسك، أتراني جزيتها؟ قال: لا، ولا طلقة من طلقاتها.

আমার মাকে আমি খুরাসান থেকে মক্কা পর্যন্ত কাঁধে বহন করে এনেছি এবং কাঁধে করেই হজ¦ করিয়েছি। আপনার কী মত- আমি কি আমার মায়ের প্রতিদান দিতে পেরেছি?

ইবনে উমর রা. বললেন, না, মোটেও না; তুমি মায়ের প্রসব বেদনার একবারের আহ্-এরও প্রতিদান দিতে পারনি। (দ্র. বিররুল ওয়ালিদাইন, ইবনুল জাওযী, পৃ. ৩)

শেষকথা হল, আমাদের উচিত, নির্ভরযোগ্য কিতাবাদি থেকে দ্বীনী জ্ঞান অর্জন করা; মকছুদোল মোমিনীন, বার চান্দের ফযীলত জাতীয় পুস্তিকা থেকে নয়। কারণ এসকল কিতাবে প্রচুর পরিমাণে অনির্ভরযোগ্য বর্ণনা উল্লেখ করা হয়; সাথে সাথে নিজ থেকেও বাড়িয়ে বলা হয়। আলোচ্য বর্ণনায়- মদীনা শরীফের মসজিদে বসিয়া বলিয়াছেন, দোয়াটি নিয়মিত পাঠ করিবে, মাতা-পিতার হক আদায়ের সমপরিমাণ নেকী দান করিবেনসবই নিজ থেকে বাড়িয়ে বলা হয়েছে। বিশ্র ইবনুল হুসাইনের বর্ণনায় এসব কথা নেই বা এভাবে নেই। সেখানে রয়েছে, যে এ দুআ পড়ল এবং মা-বাবার নামে বখশে দিল, সে মা-বাবার সকল হক আদায় করল।

তাছাড়া দুআর বাক্য উল্লেখ করার ক্ষেত্রেও নিজের মতো করে উল্লেখ করা হয়েছে; وله العظمة -এর স্থলে লিখেছে وهو العظمة  যা আরবী ভাষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। হ

 

 

advertisement