জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

যে দান হারিয়ে যাওয়ার নেই ভয়

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

মানুষের কাছে নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় কিছু আছে? নেই। মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। অথচ জীবন-যৌবন সবই মানুষ বিলিয়ে দেয় অর্থ উপার্জনের পেছনে। অবশ্য অর্থের পেছনে এ ছুটে চলাও নিজের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে, অধীনস্থ পরিবারপরিজন আর সন্তানাদির জীবন সুখময় করার জন্য। নিজের ও পরিজনদের ভবিষ্যৎচিন্তাই মানুষকে প্রাণবন্ত করে রাখে কর্ম ও উপার্জনের নিষ্ঠুর ময়দানে। এ চিন্তাই তার সামনে সহজ করে দেয় অর্থ উপার্জনের জন্যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলা আর শরীরের রক্ত পানি করা। এত কষ্ট করে যে উপার্জন, যে ভবিষ্যত সামনে রেখে এ সাধনা, এসব কিছুটা ভুলে গিয়ে, কিছুটা এড়িয়ে গিয়ে উপার্জিত অর্থ অন্যের প্রয়োজনে বিলিয়ে দেয়া সহজ কথা নয় মোটেও। এর জন্যে প্রয়োজন বুকভরা সাহস, প্রয়োজন আকাশের মতো উদার একটি মন। তবেই সম্ভব মানবতার ডাকে সাড়া দেওয়া।

যারা দান করেন, তারা কেন করেন? নিজের কষ্টের টাকা কেন অন্যকে দিয়ে দেন? ভবিষ্যতের চিন্তায় উপার্জিত ও সঞ্চিত টাকা কেন বিলিয়ে দেন অন্যদের প্রয়োজনে? এর নানান উত্তর হতে পারে। কেউ হয়তো সম্মান-সুখ্যাতির আশায় দান করেন, কেউ নিজের দল ভারি করার জন্যে টাকা বিলিয়ে দেন, কেউ নিজের চিন্তা ও আদর্শ ছড়িয়ে দেয়ার স্বার্থে অন্যদের পাশে দাঁড়ান। যারা আল্লাহবিশ্বাসী মুমিন, তাদের দানের একমাত্র উদ্দেশ্য- আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিই তাদের জীবনের পরম লক্ষ্য। শুধু দান কিংবা পরোপকারই নয়, জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপেই তারা মহান মালিকের সন্তুষ্টি হাসিল করতে চান। তাদের এক কথা-

اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا.

আমরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই তোমাদের খেতে দিই। তোমাদের কাছ থেকে আমরা কোনো বিনিময় চাই না, চাই না কৃতজ্ঞতাও। -সূরা দাহর (৭৬) : ৯

দানের জন্য যে পুরস্কারের ঘোষণা এসেছে পবিত্র কুরআন ও হাদীসে, তা নিশ্চিত করতে হলে এ শর্তে উত্তীর্ণ হতেই হবে। দুনিয়ার সুনাম-সুখ্যাতি লাভ, নিজের দল ভারি করা কিংবা পার্থিব কোনো বিনিময়প্রাপ্তি নয়, একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা। যাদের দান এ শর্তে উত্তীর্ণ, তাদের দান বিফলে যেতে পারে না। দানের প্রতিদান তারা পাবেই। এ ঘোষণা পবিত্র কুরআনের-

وَ مَثَلُ الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمُ ابْتِغَآءَ مَرْضَاتِ اللهِ وَ تَثْبِیْتًا مِّنْ اَنْفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍۭ بِرَبْوَةٍ اَصَابَهَا وَابِلٌ فَاٰتَتْ اُكُلَهَا ضِعْفَیْنِ  فَاِنْ لَّمْ یُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ.

আর যারা নিজেদের সম্পদ খরচ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় এবং নিজেদেরকে সুসংহত করার লক্ষ্যে তাদের দৃষ্টান্ত এমন, যেন সমতল উঁচু ভূমিতে একটি বাগান, তাতে ভারি বৃষ্টি হয়, তখন তা দ্বিগুণ ফল দেয়; আর যদি ভারি বৃষ্টি না হয় তাহলে হালকা বৃষ্টিই (যথেষ্ট)। আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্মের সম্যক দ্রষ্টা। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৫

দানকে এ আয়াতে বৃষ্টির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আলোচ্য ব্যক্তিদের দান এমন, তারা যদি অধিক পরিমাণে দান করে তবে সওয়াব হবে অনেক বেশি। আর যদি দানের পরিমাণ কম হয়, তবুও তাদের দান হারিয়ে যাবে না, বৃথা ও নিষ্ফল হয়ে পড়বে না। তাদের স্বল্প দানেও মিলবে সওয়াব ও পুরস্কার। মানে ও পরিমাণে হয়তো বেশি দানকারীদের মতো হবে না। কিন্তু তাই বলে পরিমাণে কম হওয়ায় এ দান প্রত্যাখ্যাত হবে না। উদাহরণ দেয়া হয়েছে এভাবে- একটি উর্বর জমিতে বৃষ্টি যতটা বেশি হবে, ফসলের পরিমাণও সে অনুপাতে বাড়বে। আর জমি উর্বর হওয়ায় অল্প বৃষ্টিতে ফসল ফলবে। তবে এজন্য এখানে দুটি শর্তের কথা বলা হয়েছে :

এক. আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় দান করা।

দুই. নিজেদেরকে সুসংহত করার লক্ষ্যে দান করা।

নিজেদের সুসংহত করার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর কাছ থেকে বিনিময় পাওয়ার বিষয়ে অন্তরকে দৃঢ় করা; মনে এ স্থির বিশ্বাস লালন করা দানসদকার সওয়াব হারিয়ে যেতে পারে না। আর এ তো বলাবাহুল্য, আল্লাহ তাআলার কাছে সওয়াবের আশা করতে হলে নিজের দান হতে হবে কেবলই তাঁর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায়। দুনিয়ার কোনো মোহে কিংবা প্রাপ্তির আশায় দান করলে এর বিনিময় আল্লাহর কাছ থেকে আশা করা বৃথা।

আল্লাহ তাআলার রহমতের আশাবাদী যারা, যারা পরকালের শান্তিময় জীবন কামনা করে, সে মুমিনেরা তো প্রতিটি পয়সা ব্যয় করার সময় চিন্তা করে- এতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি আছে কি না। আল্লাহ তাআলা অসন্তুষ্ট হতে পারেন এমন যে কোনো খাতে তারা নিজেদের সম্পদ ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হয়। মুমিনদের এ চরিত্র আল্লাহ তাআলা এভাবে বর্ণনা করেছেন-

وَ مَا تُنْفِقُوْنَ اِلَّا ابْتِغَآءَ وَجْهِ اللهِ.

তোমরা তো কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যেই ব্যয় করে থাক। -সূরা বাকারা (২) : ২৭২

শুধু দানসদকাই নয়, যে কোনো ইবাদতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের পরিবর্তে যদি সুনাম-সুখ্যাতি অর্জন কারও উদ্দেশ্য হয়, ইবাদতে যদি ইখলাস না থাকে, তবে সেটাও একপ্রকার শিরক। এ শিরকের মাত্রা হয়তো মূর্তিপূজার মতো অতটা ভয়াবহ নয়, তবুও তা শিরক। আর নামায বা এজাতীয় ইবাদতের তুলনায় দানসদকায় এ অপরাধের আশঙ্কা বরাবরই বেশি থাকে। সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে বাবা-মা আত্মীয়স্বজন ইয়াতিম মিসকিন, কাছের প্রতিবেশী, দূরের প্রতিবেশী, সঙ্গীসাথী, মুসাফির ও মালিকানাধীন দাস-দাসী- সকলের প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, তারা যখন প্রয়োজনগ্রস্ত হয়ে পড়বে, তখন তাদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করাও সদাচারেরই অন্তর্ভুক্ত। এ আর্থিক সহযোগিতাকেই আমরা দান বা সদকা বলে থাকি। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে দানসদকা তাই সরাসরি আল্লাহ তাআলারই নির্দেশ। কিন্তু মহাপুরস্কার অর্জিত হবে যে আমলে- বিষাক্ত রিয়া এসে তা বরবাদ করে দেয়ার চেষ্টা তো করবেই। বনি আদমকে বিভ্রান্ত করা আর তার আমলগুলো বরবাদ করার জন্যে শয়তান প্রতি মুহূর্তেই ওত পেতে আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে উপরোক্ত সদাচরণের আদেশ দেয়ার আগেই সতর্ক করেছেন এভাবে-

(তরজমা) তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। তাঁর সঙ্গে কোনোকিছুই শরিক করো না। -সূরা নিসা (৪) : ৩৬

অর্থাৎ সতর্ক থেকো, কোনো প্রকার রিয়া যেন তোমাদের ইবাদতে যুক্ত হয়ে না পড়ে। ইবাদতের লক্ষ্য তো কেবলই আল্লাহর সন্তুষ্টি। ছোট-বড় কোনো শিরকই যেন ইবাদতকে নষ্ট করে না দেয়।

দানে যাদের ইখলাস ও নিষ্ঠা থাকে না, রিয়া ও লোকদেখানো মানসিকতা যাদের দানকে গ্রাস করে নেয়, দান করে যারা সুনাম-সুখ্যাতি হাসিল করতে চায়, পবিত্র কুরআনে তাদের জন্যে বর্ণিত হয়েছে একটি হৃদয়স্পর্শী উপমা। এক লোক সারা জীবনের শ্রম-সাধনায় গড়ে তুলেছে একটি চোখজুড়ানো বাগান। যৌবনের সবটুকু সাধ্য বিলিয়ে দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলা সে বাগানে কী নেই! সবরকম ফলের যেন সমাহার সেখানে। আছে সারি সারি খেজুর গাছ। আছে আঙুরের বাগান। এ দুটোই বলা যায়, আরবের শ্রেষ্ঠতম ফল। বাগানটির পাশ দিয়ে কুলকুল করে বয়ে গেছে নদী। একদিকে নানারকম ফলে সমৃদ্ধ এ ছায়াঘেরা বাগান, এর সঙ্গে জুড়ে আছে নদী। তাই বাগানের ফলফলাদি দেখে যেমন চোখ জুড়ায়, শরীর জুড়িয়ে যায় নদীর তীরের স্নিগ্ধ বাতাসে। এমন একটি বাগান যার থাকে, এ দুনিয়াতে তার আর কী চাই! নিজের জীবন তো কেটে যাবেই, স্বাচ্ছন্দে কেটে যাবে সন্তানের জীবনও। তার সন্তান এখনো কাজের বয়সে পৌঁছেনি। কিন্তু তাতে কী! এই এক বাগানই তো যথেষ্ট। এদিকে বাগানের মালিকেরও যৌবন ফুরিয়ে এসেছে। বার্ধক্যের আঘাতে সে আক্রান্ত। কাজের শক্তি নেই শরীরে। সন্তানও অল্পবয়স্ক। সারা জীবনের শ্রম দিয়ে গড়ে তোলা বাগানটিই এ বৃদ্ধবয়সে একমাত্র ভরসা। এমন একটি বাগান এমন সময়ে এসে এক অগ্নিক্ষরা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। জীবনধারণের একমাত্র অবলম্বনটি এভাবে চোখের পলকে হারিয়ে গেল। এ আঘাত যদি যৌবনে আসত, তবে নতুন করে সে স্বপ্ন বুনতে পারত। এক বাগানের পরিবর্তে আরও তিনটি বাগান গড়তে পারত। কিন্তু বার্ধক্যের হানায় তো তার স্বপ্ন দেখার শক্তিটুকুও নেই। এমন অসহায়ত্বের মুহূর্তে লোকটির সারা জীবনের উপার্জন যেমন কোনোই কাজে আসছে না, তেমনি যারা অন্যদের দেখানোর জন্যে দান করে, এ দানও তাদের কোনোই উপকার করবে না। পরকালের কঠিন সময়ে যখন তারা নেকি খুঁজে বেড়াবে, দুনিয়ার জীবনে উদার হস্তে বিলানো কাড়ি কাড়ি দানের বিনিময়ে কোনো নেকিই তখন তাদের ভাগ্যে জুটবে না। [দ্র. সূরা বাকারা (২) : ২৬৬]

এই হচ্ছে লক্ষ্যভ্রষ্ট দানের ভয়াবহতা। চরম সংকটের মুহূর্তে এ দান কোনোই কাজে আসবে না।

এ রিয়া ও লোকদেখানো মানসিকতার মতোই দানের সুফল বিনষ্টকারী আরেকটি বিষয়- দান করে খোঁটা দেয়া। পরিণাম বিবেচনায় এটা রিয়ার চেয়েও গুরুতর। দানে যদি রিয়া থাকে, তবে এতে দানগ্রহীতা উপকৃত হয়ে যায় ঠিকই, বঞ্চিত হয় কেবলই দাতা- দানের অপরিসীম পুরস্কার থেকে। কিন্তু দান করে যখন গ্রহীতাকে দাতা খোঁটা দেয় কিংবা কষ্টদায়ক কোনো আচরণ করে, তখন দানের পরকালীন পুরস্কার থেকে দাতা যেমন বঞ্চিত হয়, দুনিয়ার বিচারেও সে দান আর ভালো কিছু বলে বিবেচিত হয় না। একজন বিপদে পড়লেই তো আরেকজন পাশে দাঁড়ায়। তাকে দান করে। তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। সংকটের গর্ত থেকে উপরে উঠে আসতে তাকে সহযোগিতা করে। এরপর দাতা যখন দানের কথা বলে খোঁটা দেয়, গ্রহীতার তখন মনে হয়- আমি যদি বিপদেই পড়ে থাকতাম, তার কাছ থেকে যদি সহযোগিতাটুকু গ্রহণ না করতাম! দানগ্রহীতার জন্যে এ যেন আগের চেয়েও বড় বিপদ। স্বাভাবিক কথা, এক বিপদে সহযোগিতা করে যদি কেউ আরও বড় কোনো বিপদে ফেলে দেয়, তবে সে সহযোগিতা অর্থহীন, সে দান নিষ্ফল। সহযোগিতা যে গ্রহণ করে, মানসিকভাবে সে এমনিতেই দুর্বল থাকে। এর ওপর যদি যোগ হয় সহযোগিতাকারীর পক্ষ থেকে খোঁটা, তবে তা রীতিমতো তার অন্তরে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এমন সহযোগিতা করার চেয়ে না করাই ভালো। এ ভালো সবার জন্যেই- গ্রহীতা যদিও বিপদগ্রস্ত, কিন্তু এক বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে আরও বড় কোনো বিপদে তাকে পড়তে হবে না, খোঁটা শোনার মতো বড় যন্ত্রণা তাকে সইতে হবে না। আবার নিষ্ফল দান না করে নিজের সম্পদ নিজের কাছেই রয়ে গেল- এতে সহযোগিতাকারীরও একপ্রকার ভালোই হল। আবার দান করে, বিপদে  সহযোগিতা করে যারা খোঁটা দেয়, তারা যেমন সমাজের চোখে মন্দ বলে বিবেচিত হয়, তারা আল্লাহ তাআলার বিচারেও মন্দ। আল্লাহ তাআলা স্পষ্টই বলে দিয়েছেন- দান করে খোঁটা দেয়ার তুলনায় দান না করে সুন্দর কথায় ফিরিয়ে দেয়া অনেক উত্তম। পড়ুন-

قَوْلٌ مَّعْرُوْفٌ وَّ مَغْفِرَةٌ خَیْرٌ مِّنْ صَدَقَةٍ یَّتْبَعُهَاۤ اَذًی.

সুন্দর কথা ও (সহযোগিতাপ্রার্থীর পীড়াপীড়ি) ক্ষমা করে দেয়া এমন দান থেকে উত্তম, যার পরে কষ্ট দেয়া হয়। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৩

দান করে খোঁটা দিলে সে দান অর্থহীন। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ এমন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تُبْطِلُوْا صَدَقٰتِكُمْ بِالْمَنِّ وَ الْاَذٰی.

হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের দানগুলো খোঁটা ও কষ্ট দিয়ে নষ্ট করে ফেলো না। -সূরা বাকারা (২) : ২৬৪

এক খোঁটার মধ্যে রয়েছে অনেক রকমের অপকারিতা। এতে গ্রহীতাকে কষ্ট দেয়া হয়, পরিণতিতে নিজের দান বিফলে যায় এবং আল্লাহ তাআলার কাছে এ দানের কোনো বিনিময় পাওয়ার সম্ভাবনাই থাকে না। উল্টো একে হাদীস শরীফে কঠিন পাপ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি খোঁটাদানকারী সমাজের চোখেও মন্দ বলে বিবেচিত হয়। সমাজের মানুষের সামনে তার নীচু মানসিকতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। নিজেকে সে নামিয়ে আনে মহানুভবতার সুউচ্চস্তর থেকে নীচুতার গভীর খাদে। যে খোঁটা দেয়, সে নিজেকে বড় মনে করে আর গ্রহীতাকে তুচ্ছ মনে করে বলেই খোঁটা দেয়। অথচ কাউকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখা অহমিকা ছাড়া আর কী! এমন তো হতেই পারে, বিপদগ্রস্ত কিংবা পার্থিব বিচারে সহায়সম্বলহীন একজন মানুষ আল্লাহ তাআলার কাছে বিত্তবান সহযোগিতাকারীর চেয়ে অনেক বেশি প্রিয়। এমনকি আমাদের চারপাশের দেখা বাস্তবতাও এমন- টাকাপয়সায় পিছিয়ে থেকেও কর্মে-গুণে-আচরণে-সামাজিকতায় এবং পড়াশোনায় সমাজের বিত্তশালীদের ছাড়িয়ে যায় অনেকে। তো শুধু টাকাপয়সার জোরে কেন এ বাহাদুরি? এ বাহাদুরি আর অহমিকাই আসলে এ কুকর্মের মূল, এ খোঁটাদানের শেকড়।

দান করে খোঁটা দেয়া একপ্রকার ধৃষ্টতাও। মুমিনের বিশ্বাস এমন হতেই হবে- আল্লাহ তাআলা যদি মেহেরবানী করে আমাদের তাওফীক দেন, তবেই কেবল আমরা কোনো ভালো কাজ সম্পাদন করতে পারি। আল্লাহ তাআলার তাওফীক পেলেই আমরা কোনো মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারি। আমাদের সকল ইবাদতের মতো দানসদকাও এ বিশ্বাসেরই আওতাভুক্ত। এর বাইরে নেই কিছুই। এ বিশ্বাস যদি কারও মনে জাগ্রত থাকে, তবে সে কি আর খোঁটা দিতে পারে? তার মনে তো থাকবে দয়াময় আল্লাহ তাআলার প্রতি শোকর ও কৃতজ্ঞতা যে, আল্লাহ তাকে একটি নেক কাজ করার তাওফীক দিয়েছেন বলে। গ্রহীতাকে সে নিজের উপকারকারী মনে করবে। তার ভাবনায় সে নিজেই উপকার-গ্রহীতা। গ্রহীতাকে না পেলে সে দান করত কোথায়- এ ভাবনা তার মনে গ্রহীতার প্রতি সম্মান আরও বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কারও ধারণা যখন উল্টে যায়, সে যখন ভাবতে শুরু করে- নিজের টাকায় আমি তাকে উপকার করেছি, বিপদ থেকে বাঁচিয়েছি, তাকে সহযোগিতা করতে পারা আমার নিজের কৃতিত্ব, তখনই সে খোঁটা দেয়ার সাহস করে। তাই যদি হয়, তবে এ ভাবনা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কী হতে পারে!

কেউ কাউকে সহযোগিতা করলে তাদের মধ্যে একটা আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়। আরবীতে প্রবাদ আছে- আলইনসান আবদুল ইহসান। অর্থাৎ মানুষ অনুগ্রহের দাস। তাই কাউকে অনুগ্রহ করলে, বিশেষত বিপদে সহযোগিতা করলে সে দাসহয়েই যাবে। কিন্তু সহযোগিতাকারী যদি খোঁটা দেয়, তখন আন্তরিকতা বদলে যায় মনোমালিন্যে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে দূরত্ব, সৃষ্টি হয় শত্রুতা। এক সময়ের উপকারের কথা ভুলে গিয়ে একে-অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে যায়। এর মূলেও এই খোঁটা।

হাঁ, মানুষের সমাজে কিছু মন্দ মানুষ থাকাও বিচিত্র নয়। এরা উপকারকারীর উপকার তো স্বীকার করবেই না, উল্টো তাদের ক্ষতি করার চেষ্টাও করতে পারে। তখন খোঁটা দেয়ার পরিবর্তে হাঁটতে হবে সবর ও ধৈর্যের পথে। মনে জাগরূক রাখতে হবে আমাদের দান ও সহযোগিতার চেতনা। কুরআনের ভাষায়-

اِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللهِ لَا نُرِیْدُ مِنْكُمْ جَزَآءً وَّ لَا شُكُوْرًا.

আমরা তো তোমাদেরকে খাওয়াই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে। আমরা তোমাদের কাছে কোনও প্রতিদান চাই না এবং কৃতজ্ঞতাও না। -সূরা দাহর (৭৬) : ৯

দান করে খোঁটা দেয়া যাবে না- বিষয়টি আসলে সহজ নয়। এর জন্যে শুধু দান করার সময় নিয়তের বিশুদ্ধতা ও ইখলাসই যথেষ্ট নয়। লক্ষ্য যদি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন ছাড়া অন্য কিছু হয়, তবে তো তা প্রথম ধাপেই ব্যর্থ। এমন দানকে আল্লাহর পথে ব্যয়বলা যাবে না। বিশুদ্ধ নিয়তে দান করার পরই শুরু হবে সাধনার পরবর্তী স্তর। এ স্তরের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। এ জীবনে কখনোই দানগ্রহীতাকে খোঁটা দেয়া যাবে না। নিজের অনুগ্রহের কথা তাকে মনে করিয়ে দিয়ে কষ্ট দেয়া যাবে না। যেখানে যে পরিবেশে দানগ্রহীতা বিষয়টি লুকিয়ে রাখতে চায় সেখানে তা প্রকাশ করে দিয়ে তাকে বিব্রত করা যাবে না। কখনো যদি দানগ্রহীতার কোনো আচরণে দাতা কষ্ট পায়, তখন দিতে হবে ধৈর্যের পরিচয়। খোঁটা না দেয়ার আসল পরীক্ষাটি তখনই হয়। এ পথ তখন বড়ই পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। সেসময় সর্বোচ্চ সতর্কতায় চলতে হবে পথ। মনে রাখতে হবে- সামান্য অসতর্কতা ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে দীর্ঘদিনের সাধনা। বিশুদ্ধ নিয়তে দান করার পর যারা এভাবে নিজেদের দান আগলে রাখেন, দানের যাবতীয় পুরস্কার তাদের জন্যেই। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা-

(তরজমা) আল্লাহ অণু পরিমাণও জুলুম করেন না। যদি তা পুণ্য হয় তাহলে তিনি তা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবেন এবং তাঁর নিজের পক্ষ থেকে মহা পুরস্কার দেবেন। -সূরা নিসা (৪) : ৪০

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকে মহা পুরস্কার বলেছেন, তার সীমা আমরা কী করে কল্পনা করব! তিনি তো পুরো দুনিয়ার ভোগ্যসামগ্রীকেই বলেছেন নিতান্ত তুচ্ছ। পরকালে এমন মহা পুরস্কার যদি পাওয়া যায় দুনিয়ার সামান্য সম্পদ দান করে, পরোপকারে বিলিয়ে দিয়ে, তবে আর ভয় কীসের! না, কোনো ভয় নেই। এ দান হারিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন-

اَلَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ اَمْوَالَهُمْ فِیْ سَبِیْلِ اللّٰهِ ثُمَّ لَا یُتْبِعُوْنَ مَاۤ اَنْفَقُوْا مَنًّا وَّلَاۤ اَذًی  لَّهُمْ اَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْۚ     وَ لَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ

যারা নিজেদের সম্পদরাজি আল্লাহর পথে ব্যয় করে, অতঃপর ব্যয় করার পর খোঁটা দেয় না এবং কোনোরূপ কষ্টও দেয় না, তাদের জন্যে তাদের প্রভুর নিকট তাদের প্রতিদান রয়েছে, তাদের কোনো ভয় নেই, তারা দুঃখিতও হবে না। -সূরা বাকারা (২) : ২৬২ হ

 

 

advertisement