জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

হ্যালোইন : বিজাতীয় উৎসব, পৌত্তলিক সংস্কৃতি

ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল

একটা অন্যায় যখন গুটিকয়েক মানুষ করে বা সমাজে যে অন্যায় এখনো ছড়িয়ে পড়েনি- সে অন্যায়ের আলোচনা এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। সেই পাপ ও অন্যায়ের মুসীবতে আক্রান্ত গুটিকয়েক মানুষকে নীরবে বুঝিয়ে-সমঝিয়ে নিবৃত্ত করাই তখনকার করণীয়। এমন ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে-

أَمِيْتُوْا الْبَاطلَ بِالْسُّكُوْتِ عَنْهُ.

নীরবতার মাধ্যমে বাতিলকে নিঃশেষ করে দাও।

সেই সূত্র ধরে উলামায়ে কেরাম অনেক বাতিল ও অন্যায়কে এড়িয়ে যান। কারণ, অনেক বাতিল শ্রেণির মানুষ নিজের অন্যায় চিন্তাধারা প্রসারের জন্য ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতিবাদের অপেক্ষায় থাকে। ফলে নেতিবাচক প্রচারণায় বাতিল প্রসারিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে।

বাংলাদেশে অনেকটাই অপ্রচলিত পাপ ছিল হ্যালোইন উৎসব। খুব কম মানুষই এই উৎসব সম্পর্কে জানত। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক ও   অন্ধ ব্যবহারের ফলে আজকাল হ্যালোইনের মতো পৌত্তলিক ও ইবলিসী উৎসবও তাওহীদবাদী এই সমাজে পরিচিত হয়ে উঠছে। দেশের কিছু বিলাসবহুল হোটেল ঘটা করে এমন ধর্ম ও সমাজবিরোধী উৎসবের আয়োজন করছে। সে উৎসবে যোগদান করা কিছু মুসলিম সন্তানের সাক্ষাৎকার দেখলাম। তাদের কেউই এই উৎসবের ইতিবৃত্তের কিছুই বলতে পারেনি। তাদের চেহারায় ছিল কেবলই যৌবনের উচ্ছ্বাস আর লাগামহীন ফুর্তির উন্মাদনা।

স্বদেশের মানুষের এসব দেখছি আর হতভম্ব হচ্ছি। এরইমধ্যে সংবাদমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে, সৌদি আরবেও হ্যালোইন উৎসব পালিত হচ্ছে। বিশাল আয়োজনের হ্যালোইন উৎসব। সেখানে প্রবেশ একদমই ফ্রি। শর্ত কেবল একটিই- অদ্ভুত ও ভয়ংকর সাজ-পোশাকে যোগ দিতে হবে এখানে। সৌদি আরবের ইসলামবিরোধী কর্মকা- অন্য আট-দশটি দেশের মতো নয়। ওদেশে ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ হলে এদেশের ইসলামবিরোধীরা সেসব দিয়ে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষকে কুপোকাত করার চেষ্টা করে। যেই সৌদি আরব এদেশের সুশীলদের চোখের বিষ সে সৌদি আরবই তখন তাদের কাছে চূড়ান্ত দলীল। অথচ ওদেশে যারা ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ করছে তারা তেমনই, যেমন এদেশের তথাকথিত সুশীলরা। মানুষ নিজ নিজ খাহেশাতকে প্রামাণ্য করতে গিয়ে কত যে দ্বীচারিতার শিকার হয়- সে হুঁশই থাকে না।

যাইহোক, বিপদ যেহেতু দুয়ারে। তাই আমাদেরকে বিপদ মোকাবেলার জন্য বিপদ চিনতে হবে। এমন শিরকী কাজ থেকে বিরত থাকতে নিজেকে এবং নিজের আশপাশের সবাইকে আন্তরিকভাবে সচেতন করতে হবে। ব্রিটানিকার বিবরণ অনুযায়ী-

ঐবষষড়বিবহ-হ্যালোইন আমেরিকার একটি উৎসব। ৩১ অক্টোবরে পালিত হয়। এই দিনে রাস্তাঘাট, বাজার-মার্কেট, অবকাশ কেন্দ্র ও বিভিন্ন জায়গায় ভীতিকর মুখোশ পরে মানুষ ঘুরে বেড়ায়। অধিকাংশ ঘরের বাইরে বড় বড় মিষ্টিকুমড়া দেখা যায়। যেগুলো ভেতর থেকে শূন্য করে ফেলা হয়। এগুলোকে কেটে বিভিন্ন চেহারার আকৃতি দেওয়া হয়। এরপর ভেতরে মোমবাতি জ্বালানো হয়। ফলে সন্ধ্যায় ভয়ংকর সব দৃশ্যের অবতারণা হয়। অনেকে বাড়ির সামনে ভয়ানক আকৃতির মূর্তি সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। কাছ দিয়ে গেলে অট্টহাসি দিয়ে ভড়কে দেয়। এ দিনের বড় একটি কাজ হল, শিশুদের ট্রিক আর ট্রিট। অর্থ্যাৎ শিশুরা নানা রকম ভৌতিক সাজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ে। বলে, হয় চকলেট উপহার দাও, না হয় আমাদের কোনো চালাকির শিকার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।

এর ইতিহাস দেখলে আমরা দেখতে পাই, খ্রিস্টপূর্বে প্রাচীন বৃটেন ও আয়ারল্যান্ডের কেল্টদের মাঝে প্রচলিত সামহেন উৎসব থেকে হ্যালোইনের উৎপত্তি। তাদের বছর শুরু হত পহেলা নভেম্বরে। তা ছিল শীতকালেরও প্রথম দিন। এদিন চারণভূমি থেকে পশুপাল ফেরত নিয়ে আসা হত। জমির মেয়াদ নবায়ন করা হত। ধারণা করা হত, সামহেন উৎসবের সময় মৃত আত্মাগুলো তাদের বাড়িঘর দেখতে আসে এবং গতবছর যারা মারা গেছে তাদের আত্মাগুলো অন্যজগতে প্রবেশ করে। লোকেরা শীতে তাদের চুলায় আগুন জ¦ালানোর জন্য এবং প্রেতাত্মাদের ভয় দেখানোর জন্য পাহাড়ের চূড়ায় অগ্নি প্রজ¦লিত করত। তারা মুখোশ পরত ও অন্যান্য ছদ্মবেশ ধারণ করত, যাতে ভূতেরা তাদের চিনতে  না পারে।

সপ্তম শতকে পোপ চতুর্থ বোনিফেস সাধু-সন্ত দিবস ঘোষণা করে। প্রথমে এ দিবস ছিল ১৩ মে। পরে তা পহেলা নভেম্বরে স্থানান্তর হয়। সাধু-সন্তদের দিবসের আগের সন্ধ্যা অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় হ্যালোইন উদ্যাপন করা হয়। হ্যালোইন ছিল একটি সেক্যুলার উৎসব, আর সাধু-সন্তদের দিবস তো ধর্মীয় উৎসব। কিন্তু মধ্যযুগের শেষে এসে এ দুটি দিবস একীভূত হয়ে যায়।

আমেরিকা আবিষ্কারের পর ইউরোপের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখানে চলে আসে। তারা সঙ্গে করে নিজ সংস্কৃতি-আচার-অনুষ্ঠানও নিয়ে আসে। কথিত আছে, প্রথমদিকে মেরিল্যান্ড ও দক্ষিণ দিকের জনবসতিগুলোতে ইউরোপীয় অভিবাসীরা ছোট পরিসরে হ্যালোইন উদ্যাপন করত। ১৯ শতকে বিপুলসংখ্যক ইউরোপীয় আমেরিকায় অভিবাসন গ্রহণ করে। যাদের মধ্যে অনেক আইরিশ মানুষ ছিল। তাদের আগমনের মাধ্যমে হ্যালোইন উৎসব অনেক খ্যাতি ও গতি লাভ করে। এতে অনেক নতুন নতুন বিষয়ও যুক্ত হয়। যার মধ্যে অন্যতম হল, ট্রিক আর ট্রিট। যা আজকাল এই উৎসবের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

উনিশ শতকে আমেরিকায় হ্যালোইন উৎসব ব্যাপক হতে থাকে। ছেলে-বুড়ো সবাই  এতে অংশগ্রহণ করতে থাকে। এসব পার্টিতে খেলাধুলা ও ভোজের পাশাপাশি ভীতিকর সাজ-পোশাক পরা হয়।

এই ইতিহাসের মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পাই, এই উৎসবের ঐতিহাসিক যে ভিত্তি আছে, সে ভিত্তি পৌত্তলিকতার অথবা খ্রিস্টবাদের। এই সূত্র ধরলেই তো এ উসৎব আয়োজন করা বা অন্য কোনো অজুহাতে এতে অংশগ্রহণ করার সুযোগ মুসলমানের জন্য থাকে না।

এসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আমাদেরকে পৌত্তলিক বা খ্রিস্টান জাতির মতো করে তোলে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আমাদেরকে এই মূলনীতি বলে গেছেন-

مَن تَشَبَّه بقومٍ فهو منهم.

যে যে জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে তাদেরই মধ্যে গণ্য হবে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০৩১

আর ভিন জাতির উৎসব হওয়াই তো আমাদের জন্য এ উৎসব পালন করা হারাম হওয়ার জন্য যথেষ্ট। মদীনায় এসে নবীজী সাহাবীদেরকে ভিন জাতির উৎসব পালন করতে দেখে বলেছিলেন-

إنَّ الله قَدْ أبدَلَكُم بهما خَيرَاً مِنهما: يَومُ الأضحى، ويَومُ الفِطرِ.

আল্লাহ তাআলা তোমাদের এ দুই উৎসবের বদলে উত্তম দুটি উৎসব দিয়েছেন- ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।  -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১১৩৪

ইসলাম মানুষকে দান করতে শেখায়, হাত পাততে নয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাত পাততে বিরত থাকার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন-

اليدُ العُلْيَا خير من اليدِ السُّفْلَى.

দাতার হাত উত্তম প্রার্থীর হাত থেকে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩৩

নবীজী একবার সাহাবীদের থেকে বাইআত গ্রহণ করতে গিয়ে বলেছিলেন-

لا تسألوا الناس شيئا.

তোমরা মানুষের কাছে কিছুই চাইতে যেয়ো না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৩৩

এ বাইআতে অংশগ্রহণ করা সাহাবায়ে কেরাম নবীজীর সঙ্গে কৃত এ অঙ্গীকার এতটাই আন্তরিকতার সাথে পালন করেছেন যে, ঘোড়ায় ওঠার পর হাত থেকে চাবুক পড়ে গেলেও নিজেই উঠাতেন। নিচে থাকা অন্য কাউকে অনুরোধ করতেন না।

এর বিপরীত শিক্ষা দেখুন হ্যালোইনের মধ্যে। ট্রিক অর ট্রিটের নামে শিশুদেরকে অন্যের কাছে হাত পাতা এবং অন্যের জিনিসের প্রতি লোভাতুর করে তোলা হচ্ছে। অথচ আজকের শিশুই তো আগামীর ভবিষ্যত। শিশুমনে যা গেঁথে যায় তাই জীবনভর প্রতিফলিত হয়। তাই শিশুদেরকে এ ধরনের উৎসব থেকে সচেতনভাবে বিরত রাখতে হবে।

এসবের পাশাপাশি এ উৎসবে আরও শরীয়তবিরোধী বিষয় আছে। এ উৎসবের অন্যতম বিশ্বাস হচ্ছে, এ দিনে আত্মা পৃথিবীতে ফিরে আসে। অথচ মাসে বা বছরে আত্মা ফিরে আসার কোনো বিষয় নেই।

এ অনুষ্ঠানের বড় একটি অনুষঙ্গ হল, অন্যকে ভয় দেখানো। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَا يَحِلُّ لِمُسْلِمٍ أَنْ يُرَوِّعَ مُسْلِمًا.

এক মুসলিমের জন্য আরেক মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৫০০৪

এ তো গেল মুসলমানের কথা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কিছু গির্জাও হ্যালোইন উৎসবের বিরোধিতা করেছে। পোপ ফ্রান্সিস বলেন, কী খারাপ দিনই না আমাদের দেখতে হচ্ছে। খ্রিস্টানরা শয়তানের উৎসব হ্যালোইন পালন করছে। আমাদের বিশ্বাসের কী হল? আমরা আত্মিকভাবে মরণাপন্ন। এটা হল কেল্টদের নিকট মৃত্যুদেবতার দিবস সামহেন, যে দিন আত্মারা পৃথিবী ভ্রমণে আসে বলে তাদের বিশ্বাস।

খ্রিস্টান ডটকমের এক লেখক বলেন, এধরনের শয়তানী উৎসবে অংশগ্রহণের ফলে আমেরিকার মতো ইউরোপ খ্রিস্টধর্ম ত্যাগ করেছে।

আলেকজান্ডারিয়ার কপটিক ক্যাথলিক চার্চের ওয়েবসাইটে আছে, এ ধরনের উৎসবগুলো লোক কাহিনী নির্ভর হয়ে থাকে, যেখানে অনেক হাস্যরস থাকে। তবে আমাদেরকে সতর্ক থাকতে হবে, এর স্বরূপ, প্রভাব ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে- এটি প্রসার লাভ করছে শয়তানের উপাসক ধর্মদ্রোহীদের দ্বারা। যারা ধর্ম ও মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস করতে চায়। সুতরাং হ্যালোইন শয়তানের উপাসকদের চার উৎসবের একটি উৎসব। -আলজাযিরা নেট, ৩১ অক্টোবর ২০২১

হেদায়েতের পথে আসা প্রায় প্রতিটি মানুষই বুক ভরা অভিমান নিয়ে বলে থাকেন, আমাকে কেন আগে জাহান্নামের পথ থেকে ফিরিয়ে আনা হল না? আমার কাছে কেন আগে হেদায়েতের বাণী পৌঁছানো হল না? এমন আক্ষেপের সামনে আমরা যারা জন্মসূত্রে মুসলমান তাদের হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। মুসলিমবিশে^ বিশেষত সৌদি আরবে হ্যালোইন উদ্যাপন হতে দেখে ৩১ বছর আগে ইসলাম গ্রহণ করা এক ব্যক্তি বলেন, আল্লাহু আকবার! সৌদি আরবের রিয়াদে এসব ঘটছে! ৩১ বছর আগে যখন আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি তখন থেকে এসব পৌত্তলিক উৎসব পেছনে ছুঁড়ে ফেলেছি। এটি একটি বিরক্তিকর ব্যাপার, যখন আপনি দেখেন, জন্মসূত্রে মুসলমানরা আপনার ছেড়ে যাওয়া পৌত্তলিক উৎসবগুলো উদ্যাপন করছে। সুবহানাল্লাহ!

আরেক নও মুসলিম বোন বলেছেন, কী করে হয়? এটা কি আসলেই সৌদি আরবে? তারা কি মুসলমান? আমি বুঝতে পারছি না। এটা ভয়ংকর।...

পৌত্তলিকতা ও কুসংস্কার ছেড়ে আসা মানুষের এমন স্পষ্ট ও মর্মস্পর্শী বার্তার পর বিপথগামী জন্মসূত্রের মুসলমানদের জন্য আর কী-ইবা বলার থাকে?!

 

টীকা :

1.https://www.britannica.com/topic/Halloween

(ইংরেজি থেকে ব্রিটানিকার এ উদ্ধৃতিটি অনুবাদে সহায়তা করেছেন মাওলানা সাইদুল হক ছাহেব। এ জন্য তাঁর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। মহান রাব্বুল আলামীন তাঁকে উত্তম প্রতিদান দান করুন- আমীন।)

 

 

advertisement