জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

নারীর চেহারা পর্দার গুরুত্বপূর্ণ অংশ
একটি দালীলিক বিশ্লেষণ

মাওলানা ইমদাদুল হক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

 

হাদীস : ২৭

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহ তাআলা মুহাজির নারীদের প্রতি রহম করুন। যখন এ আয়াত নাযিল হয়-

وَ لْیَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلٰی جُیُوْبِهِنَّ.

[তারা (নারীরা) যেন তাদের  জামার গলার কাটা অংশে খিমার তথা ওড়নার আঁচল নামিয়ে দেয়। -সূরা নূর (২৪) : ৩১]

তখন তারা বড় চাদর কেটে ওড়না বানিয়ে ঐভাবে পরে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৫৯

তো তারা এ ওড়না কীভাবে পরতেন, হাদীস ব্যাখ্যাকারগণ তা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছেন। হাফেয ইবনে হাজার রাহ. বলেন-

فاختمرن أي غطين وجوههن.

তারা তাদের চেহারা ঢেকে নেয়। -ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ৮/৪৯০

আল্লামা আইনী রাহ. বলেন-

غطين وجوههن بالمروط الَّتِي شققنها.

অর্থাৎ তারা ঐ কাটা কাপড় দিয়ে তাদের চেহারা ঢেকে নেয়। -উমদাতুল কারী ১৯/৯২

শায়খুল ইসলাম যাকারিয়া আলআনসারী রাহ. বলেন-

فغطت كل منهن به أي بشق مروطها.

অর্থাৎ, তাদের প্রত্যেকে সে কাটা কাপড় দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয়। -মিনহাতুল বারী ৮/৬৭

এ হাদীসে যে আয়াত উল্লেখিত হয়েছে, তা নাযিল হওয়ার প্রেক্ষাপট হিসেবে ইমাম ফাররা বলেন-

إن نساء الجاهلية كن في الجاهلية يسدلن خمرهن من ورائهن فينكشف ما قدامها فأمرن بالاستتار.

জাহেলী যুগের নারীরা ওড়না পরে পেছনে ঝুলিয়ে দিত আর তাদের সম্মুখভাগ খোলা থাকত। এ আয়াতে তাদেরকে ঢেকে থাকার আদেশ দেয়া হয়েছে। -মাআনিল কুরআন ২/৭৫৩

একই কথা ভাষাবিদ যামাখশারী ও মুফাসসির নাসাফীও বলেছেন। তাদের বক্তব্যের আরবী পাঠ নিম্নরূপ-

وكنّ يسدلن الخمر من ورائهنّ، فتبقى مكشوفة، فأمرن بأن يسدلنها من قدامهنّ حتى يغطينها.

-তাফসীরে  কাশ্শাফ ৩/২৩১

তাফসীরে নাসাফীতে আছে-

وكن يسدلن الخمر من ورائهن، فتبقى مكشوفة، فأمرن بأن يسدلنها من قدامهن، حتى تغطينها.

-তাফসীরে নাসাফী ৩/১১৮

হাদীস :  ২৮

আয়েশা রা. বলেন, যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট যায়েদ ইবনে হারেসা, জাফর ইবনে আবী তালেব ও আবদুল্লাহ ইবনে আবী রাওয়াহা রা.-এর শাহাদাতের (শহীদ হওয়ার) সংবাদ এল, তখন তিনি সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে বসলেন। তাঁর চেহারায় বেদনার ছাপ। আমি দরজার ফাঁক দিয়ে তা দেখছিলাম।

আরবী পাঠ-

لما جاء النبي صلى الله عليه وسلم قتل ابن حارثة وجعفر بن أبي طالب وعبد الله ابن رواحة، جلس يعرف فيه الحزن، وأنا أنظر من صائر الباب - تعني شق الباب - فأتاه رجل...

-সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯৯

তো দেখুন, এত বড় ঘটনা, আল্লাহর নবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বড় বড় তিন সাহাবী শহীদ হয়েছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গেছেন। তাঁর চেহারায় বেদনার ছাপ। এ তিন সাহাবীর শাহাদাতের ঘটনা সাহাবীদের মাঝে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাই নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের নিয়ে রীতিমত মসজিদে বসে যান। আর এত বড় ঘটনা আয়েশা রা. অবলোকন করেন দরজার ফাঁক দিয়ে। তাও দরজা খুলে ফাঁক করে নয়, বরং বন্ধ দরজার যে ফাঁক থাকে, তা দিয়ে। যদি চেহারা খুলে পরপুরুষের সামনে নারীদের আসা জায়েয হত, তাহলে কমপক্ষে এ ঘটনায় আয়েশা রা. সামনে আসতেন।

হাদীস : ২৯

আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-

পুরুষের হজ¦ তার মাথায় আর নারীর হজ¦ তার চেহারায়। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৫/৪৭

ইবনে উমর রা.-এর একথার উপর গোটা উম্মত একমত। একারণেই হজে¦র সময় নারীদের জন্য কাপড় লেপ্টে দিয়ে চেহারা ঢাকা নিষেধ, যেমন পুরুষের জন্য মাথা ঢাকা নিষেধ। সাধারণ সময়ে যদি নারীর চেহারা পরপুরুষের সামনে খোলা রাখা যেত, তাহলে হজে¦র ক্ষেত্রে বলা হত যে, তারা কোনোভাবেই যেন চেহারায় কাপড় না দেয়; যেমন ইহরাম অবস্থায় পুরুষ তার মাথায় কাপড় দেয় না। অথচ, সাহাবা, তাবেয়ীনসহ সকল ফকীহ মুজতাহিদ আলেম বলেছেন, নারীরা ইহরাম অবস্থায় চেহারার সামনে কাপড় ঝুলিয়ে দেবে। বিশেষভাবে যখন পরপুরুষ এসে যায়। হাঁ, তবে নেকাব বা কাপড় মুখের সাথে লেপ্টে মুখ ঢাকবে না।

আয়েশা রা. বলেন, আমরা হজে¦র সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে ছিলাম। যখনই কোনো আরোহী দল আসত, আমরা আমাদের মাথার উপর থেকে চেহারার সামনে কাপড় ঝুলিয়ে দিতাম। যখন তারা চলে যেত, তখন আমরা তা সরিয়ে দিতাম। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৮৩৩

আলী রা. বলেন, নারীরা (ইহরাম অবস্থায় চেহারার সাথে মিলিয়ে) নেকাব পরবে না, তবে তারা তাদের চেহারার উপর কাপড় ঝুলিয়ে দেবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১৪৫৩৯

তাউস রাহ. বলেন-

ترد المحرمة الثوب على وجهها و لا تنتقب.

মহিলারা তাদের চেহারার উপর কাপড় ঝুলিয়ে রাখবে চেহারার সাথে মিলিয়ে নেকাব পরবে না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ১৪৫৪০

আতা ইবনে আবি রাবাহ রাহ. বলেন-

تسدل المحرمة ثوبها على وجهها.

(ইহরাম অবস্থায়) নারীরা তাদের  চেহারার উপর কাপড় ঝুলিয়ে দেবে। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ১৪৪৪৯

খলীফাতুল মুসলিমীন আবু বকর রা.-এর কন্যা আসমা রা. বলেন-

كنا نغطي وجوهنا من الرجال وكنا نمتشط قبل ذلك.

হজে¦র সময় আমরা পরপুরুষদের থেকে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম। -সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ২৬৯০

তাবেয়ী ফাতিমা বিনতে মুনযির রাহ. বলেন-

كنا نخمر وجوهنا ونحن محرمات ونحن مع أسماء بنت أبي بكر الصديق.

এক হজে¦র সফরে আমরা আসমা বিনতে আবু বকর রা.-এর সঙ্গে ছিলাম; তখন আমরা ইহরাম অবস্থায়ও আমাদের মুখ (কাপড় ঝুলিয়ে) ঢেকে নিতাম। -মুয়াত্তা মালেক, পৃ. ২৪৯

হাদীস : ৩০

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদেরকে দেবর থেকে বেঁচে থাকার খুব তাকিদ দিয়েছেন। তেমনিভাবে কোনো পুরুষকে পরনারীর ঘরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছেন। এসব হাদীস থেকেও বোঝা যায়, নারীরা পরপুরুষ থেকে চেহারা ঢেকে পর্দা করবে।

এক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে বলেন-

(إياكم والدخول على النساءفقال رجل من الأنصار يا رسول الله أرأيت الحمو؟ قال : (الحمو الموت)

খবরদার! তোমরা পরনারীর ঘরে  প্রবেশ করো না। তখন এক আনসারী সাহাবী বলে উঠল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! দেবরের বিষয়ে কী বলেন?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন (তার বিষয় তো আরো ভয়ংকর), দেবর তো মৃত্যু। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২১৭২

হাদীস : ৩১

তাবুক যুদ্ধে যে তিনজন সাহাবী যেতে পারেননি, তাদের মধ্যে একজন আবু লুবাবা রা.। তিনি নিজেকে মসজিদে নববীর খুঁটিতে বেঁধে রেখেছিলেন। যখন তাঁর তাওবা কবুল হওয়ার কথা নাযিল হয়, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের তা জানালেন। তখন উম্মে সালামা রা. বললেন-

أَفَلَا أُبَشِّرُهُ يَا رَسُولَ اللهِ بِذَلِكَ؟

হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাকে সুসংবাদ দিব না?

তিনি বললেন, অবশ্যই, যদি চাও। উম্মে সালামা রা. বলেন-

فَقُمْتُ عَلَى بَابِ حُجْرَتِي فَقُلْتُ: وَذَلِكَ قَبْلَ أَنْ يُضْرَبَ عَلَيْنَا الْحِجَابُ: يَا أَبَا لُبَابَةَ! أَبْشِرْ، فَقَدْ تَابَ اللهُ عَلَيْكَ.

তখন আমি আমার কামরার দরজায় দাঁড়াই, আর এটা ছিল আমাদের উপর পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে। আমি বললাম, হে আবু লুবাবা, সুসংবাদ গ্রহণ কর, আল্লাহ তাআলা তোমার তওবা কবুল করেছেন। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৭/৯২

লক্ষ করি, উম্মে সালামা রা. দরজায় কীভাবে দাঁড়ালেন! তার কারণ বলতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেন যে, তা ছিল পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে। অর্থাৎ পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে এ ছাড় ছিল। যা পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর রহিত হয়ে যায়।

হাদীস : ৩২

আবু জাহলের ছেলে ইকরিমা রা.। মক্কা বিজয়ের দিন তিনি পালিয়ে ইয়ামানে চলে যান। ঐ দিন তাঁর স্ত্রী মুসলমান হয়ে যান। এরপর স্ত্রী তাঁকে খুঁজতে বের হয়। বুঝিয়ে-সমঝিয়ে তাকে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে নিয়ে আসে। এসময় তাঁর স্ত্রী নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে কীভাবে আবৃত ছিল, আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রা. বিষয়টি এভাবে বর্ণনা করেছেন-

فوقف بين يديه ومعه زوجته متنقبة.

ইকরিমা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এসে দাঁড়ায়, সাথে ছিল তার স্ত্রী। সে ছিল নেকাব পরিহিতা। -তারীখে দিমাশক, ইবনে আসাকির ৪১/৬৩

হাদীস : ৩৩

ইয়াযীদ ইবনে বাবনূস বলেন, আমি ও আমার এক সাথী আয়েশা রা.-এর কাছে যাই। আমরা তাঁর ঘরে প্রবেশের অনুমতি চাই। তিনি আমাদের দিকে বসার বালিশ ছুঁড়ে দিলেন এবং পর্দা টেনে দিলেন।

আরবী পাঠ-

عن يزيد بن بابنوس قال   :ذهبت أنا وصاحب لي إلى عائشة، فاستأذنا عليها، فألقت لنا وسادة وجذبت إليها الحجاب.

-মুসনাদে আহমাদ ৬/২১৯

হাদীস : ৩৪

মাসরুক বলেন, একদিন আয়েশা রা. কাঁদছিলেন। আমার মাঝে ও তার মাঝে ছিল পর্দা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে উম্মুল মুমিনীন, আপনি কাঁদছেন কেন?

জবাবে তিনি বলেন, আমি যখন পেট ভরে খাবার খাই, তখনই নবীজীর কথা স্মরণ হয়- তিনি কত কষ্ট করেছেন!

আরবী পাঠ-

عن مسروق، قال: بكت عائشة وبيني وبينها حجاب، فقلت: يا أم المؤمنين، ما يبكيك؟ قالت: يا بني ما ملأت بطني من طعام فشئت أن أبكي إلا بكيت، أذكر رسول الله صلى الله عليه وسلم وما كان فيه من الجهد، ما جمع رسول الله صلى الله عليه وسلم طعام بر في يوم مرتين حتى لحق بربه.

-তাহযীবুল আছার, তবারী ২/৬৯৬

হাদীস : ৩৫

উম্মুল মুমিনীন যায়নাব বিনতে জাহাশ রা. যখন মারা যান, তখন উমর রা. জানাযার নামায পড়ান। নামাযের পর বলেন, কে তাকে কবরে নামাবে? সাহাবায়ে কেরাম বলেন-

يُدْخِلُهَا قَبْرَهَا مَنْ كَانَ يَرَاهَا فِي حَيَاتِهَا. بَنُو أَخِيهَا وَبَنُو أُخْتِهَا.

যারা তাঁকে জীবদ্দশায় দেখতে পারত তারা তাঁকে কবরে নামাবে। তাঁর ভাতিজা ও ভাগিনারা। -তবাকাতে ইবনে সাদ ১০/১০৯

কোনো কোনো বর্ণনায় আছে, নবী-পত্নীগণ বললেন-

إنه لا يحل لك أن تدخل القبر، وإنما يدخل القبر من كان يحل له أن ينظر إليها وهي حية.

হে উমর, আপনার জন্য তাঁকে কবরে নামানো বৈধ হবে না। তাঁকে তো সেই কবরে নামাতে পারবে, যে তাঁকে জীবদ্দশায় দেখতে পারত। -তবাকাতে ইবনে সাদ ১০/ ১০৮

হাদীস : ৩৬

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

وَلاَ تَنْتَقِبِ المَرْأَةُ المُحْرِمَةُ، وَلاَ تَلْبَسِ القُفَّازَيْنِ.

মুহরিম নারী নেকাব পরিধান করবে না এবং হাতমোজা পরবে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৮৩৮

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রাহ. বলেন-

وهذا مما يدل على أن النقاب والقفازين كانا معروفين في النساء اللاتي لم يحرمن، وذلك يقتضي ستر وجوههن وأيديهن.

এ হাদীস দ্বারা বোঝা যায়, সে যুগে ইহরাম ছাড়া অন্য সময় নারীরা নেকাব ও হাতমোজা ব্যবহার করা প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ ছিল। যার দ্বারা বুঝা যায়, নারীরা হাত ও চেহারা ঢেকে রাখতেন। -মাজমুউল ফাতাওয়া, ইবনে তাইমিয়া ১৫/৩৭২

সাফিয়্যাহ বলেন-

رأيت عائشة طافت بالبيت وهي متنقبة.

আমি আয়েশা রা.-কে দেখেছি, তিনি নফল তাওয়াফ করছেন নেকাব পরিহিত অবস্থায়। -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৮৮৫৯

হাদীস : ৩৭

বিশিষ্ট তাবেয়ী ইবনে শিহাব যুহরী রাহ.-কে জিজ্ঞাসা করা হয়-

من كان يدخل على أزواج النبي صلى الله عليه وسلم؟ فقال: كل ذي رحم محرم من نسب أو رضاع، قيل: فسائر الناس؟ قال: كن يحتجبن منه حتى إنهن ليكلمنه من وراء حجاب، وربما كان سترا واحدا إلا المملوكين والمكاتبين، فإنهن كن لا يحتجبن منهم.

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর স্ত্রীদের কারা দেখতে পারত?

তিনি বলেন, দুধ ও বংশীয় সম্পর্কের মাহরামগণ।

তাঁকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হয়, তাহলে অন্য সকল মানুষ?

তিনি বলেন, তারা এ ছাড়া অন্য সকল মানুষ থেকে পর্দা করতেন। এমনকি তাদের সাথে কথা বললে পর্দার আড়াল থেকে বলতেন। আড়াল কখনো একটি পর্দার কাপড় দিয়ে হতো। তবে নিজেদের দাসদের থেকে পর্দা করতেন না। -তাবাকাতে ইবনে সাদ ১০/১৭০

হাদীস : ৩৮

বিশিষ্ট তাবেয়ী আসেম আহওয়াল রাহ. বলেন-

 كنا ندخل على حفصة بنت سيرين، وقد جعلت الجلباب هكذا وتنقبت به، فنقول لها: رحمك الله، قال الله: وَ الْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَآءِ الّٰتِیْ لَا یَرْجُوْنَ نِكَاحًا فَلَیْسَ عَلَیْهِنَّ جُنَاحٌ اَنْ یَّضَعْنَ ثِیَابَهُنَّ غَیْرَ مُتَبَرِّجٰتٍۭ بِزِیْنَةٍ (سورة النور)

وهو الجلباب. قال: فتقول لنا: أي شيء بعد ذلك؟ فنقول: وَ اَنْ یَّسْتَعْفِفْنَ خَیْرٌ لَّهُنَّ، فتقول: هو إثبات الجلباب.

আমরা ইলম অর্জনের জন্য হাফসা বিনতে সীরীন রাহ.-এর ঘরে প্রবেশ করতাম। তখন দেখতাম, তিনি জিলবাব দিয়ে নেকাব পরা অবস্থায় আছেন। আমরা বলতাম, আল্লাহ আপনার প্রতি রহম করুন। আপনাদের (মত বৃদ্ধার) ক্ষেত্রে তো আল্লাহ বলেছেন, ... অর্থাৎ চেহারায় নেকাব না দিলেও হবে।

তিনি বলেন, আয়াতের পরের অংশ কী? আমরা বললাম-

وَ اَنْ یَّسْتَعْفِفْنَ خَیْرٌ لَّهُنَّ.

আর যদি তারা সাবধানতা অবলম্বন করে, তবে সেটাই তাদের পক্ষে শ্রেয়। (সূরা নূর : ৬০)

তিনি বলেন, এটাই, অর্থাৎ এ শেষাংশের জন্যই তিনি মুখে নেকাব পরে আছেন। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৭/৯৩

হাদীস : ৩৯

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর স্ত্রী যায়নাব বলেন, এক বৃদ্ধা আমাদের ঘরে আসত। আর আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. যখন ঘরে প্রবেশ করতেন গলা খাঁকারি দিতেন এবং আওয়াজ করতেন। একদিন ঐ বৃদ্ধা আমাদের ঘরে থাকা অবস্থায় আব্দুল্লাহ আওয়াজ করে ঘরে প্রবেশ করলেন। তখন ঐ বৃদ্ধা পর্দার আড়ালে চলে গেল।

আরবী পাঠ-

عَنْ زَيْنَبَ قَالَتْ: كَانَتْ عَجُوزٌ تَدْخُلُ عَلَيْنَا تَرْقِي مِنَ الْحُمْرَةِ، وَكَانَ لَنَا سَرِيرٌ طَوِيلُ الْقَوَائِمِ، وَكَانَ عَبْدُ اللهِ إِذَا دَخَلَ تَنَحْنَحَ وَصَوَّتَ، فَدَخَلَ يَوْمًا فَلَمَّا سَمِعَتْ صَوْتَهُ احْتَجَبَتْ مِنْهُ، فَجَاءَ فَجَلَسَ إِلَى جَانِبِي فَمَسَّنِي فَوَجَدَ مَسَّ خَيْطٍ فَقَالَ: مَا هَذَا؟ فَقُلْتُ: رُقًى لِي فِيهِ مِنَ الْحُمْرَةِ فَجَذَبَهُ وَقَطَعَهُ فَرَمَى بِهِ وَقَالَ: لَقَدْ أَصْبَحَ آلُ عَبْدِ اللهِ أَغْنِيَاءَ عَنِ الشِّرْكِ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: إِنَّ الرُّقَى، وَالتَّمَائِمَ، وَالتِّوَلَةَ شِرْكٌ.

-সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৩৫৩০

হাদীস : ৪০

উম্মে সিনান আলআসলামিয়া রাহ. বলেন, যখন আমরা সফর থেকে ফিরে মদীনায় প্রবেশ করি, তখন সাফিয়্যা রা.-এর আগমনের খবর শুনে নিজেদের ঘরে প্রবেশের পূর্বে তাঁর ঘরে প্রবেশ করি। আনসার ও মুহাজির নারীগণ পর্দায় আবৃত হয়ে তাঁকে দেখতে আসেন। তখন নবীপত্নীগণের  চারজনের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। তাঁরা সবাই নেকাব পরা অবস্থায় ছিলেন। তাঁরা হলেন, যায়নার বিনতে জাহাশ, হাফসা, আয়েশা ও জুওয়াইরিয়া রা.।

আরবী পাঠ-

عَنْ ثُبَيْتَةَ بِنْتِ حَنْظَلَةَ عَنْ أُمِّهَا أُمِّ سِنَانٍ الأَسْلَمِيَّةِ قَالَتْ: لَمَّا نَزَلْنَا الْمَدِينَةَ لَمْ نَدْخُلْ مَنَازِلَنَا حَتَّى دَخَلْنَا مَعَ صَفِيَّةَ مَنْزِلَهَا. وَسَمِعَ بِهَا نِسَاءُ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنْصَارِ فَدَخَلْنَ عَلَيْهَا مُتَنَكِّرَاتٍ فَرَأَيْتُ أَرْبَعًا مِنْ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - مُتَنَقِّبَاتٍ: زَيْنَبَ بِنْتَ جَحْشٍ وَحَفْصَةَ وَعَائِشَةَ وَجُوَيْرِيَةَ.

-তবাকাতে ইবনে সাদ ১০/ ১২২

হাদীস : ৪১

তাবেয়ী কাহমাস রাহ. বলেন, আমরা একবার উমর রা.-এর সাথে বসা ছিলাম। এসময় এক নারী তার নিকট এসে তার স্বামীর ব্যাপারে অভিযোগ করল, আমার স্বামীর মাঝে ভালো বিষয় কমে গিয়েছে এবং খারাপ বিষয় বেড়ে গিয়েছে।

উমর রা. তাকে  জিজ্ঞেস করলেন, তোমার স্বামী কে?

সে বলল, আবু সালামা। উমর রা. এক লোককে বললেন, তাকে ডেকে নিয়ে আসো।

লোকটি মহিলার স্বামীকে ডেকে নিয়ে এলে উমর রা. তাকে বললেন, আমার পেছনে বসা মহিলাটি তোমার ব্যাপারে কী বলছে?

সে বলল, হে আমীরুল মুমিনীন মহিলাটি কে? উমর রা. বললেন, সে তোমার স্ত্রী...। -মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালিসী, হাদীস ৩১

লক্ষ্য করি, মহিলাটিকে স্বামী চিনছে না। অর্থাৎ, মহিলাটি পর্দায় আবৃত ও চেহারা ঢেকে রাখার কারণে স্বামী তাকে চিনতে পারছে না। এতে বোঝা গেল, ঐ যুগে নারীরা প্রয়োজনে পরপুরুষের সামনে আসতে হলে চেহারা ঢেকেই আসত।

হাদীস : ৪২

সাহাবী আনাস রা. বলেন, আমি আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.-এর ঘরে যাই। তখন তিনি আমাকে তার ঘরের একপাশে বসতে দেন। তার স্ত্রী ছিল আরেক পাশে। আমাদের মাঝে ও তার মাঝে ছিল পর্দা। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ১৯/১৯১ (৩৫৭৬৫)

হাদীস : ৪৩

সাহাবী মুগীরা ইবনে শোবা বলেন, আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট গিয়ে বলি, আমি অমুক নারীকে বিবাহের প্রস্তাব দিতে চাচ্ছি।

তিনি বললেন, যাও তাকে দেখ। কেননা তা তোমাদের মাঝে মিল-মহব্বত সৃষ্টি করবে।

তখন আমি আনসারী ঐ নারীর বাড়িতে এসে তার মা-বাবার নিকট বিবাহের প্রস্তাব দেই এবং নবীজী দেখার অনুমতি দিয়েছেন- সে কথা জানাই। তখন কেন যেন মেয়েটির মা-বাবা বিষয়টি অপছন্দ করল। ভেতর থেকে মেয়েটি বলে উঠল, যদি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাকে দেখার আদেশ দেন তাহলে দেখো। কিন্তু জেনে রাখো, এ বিষয়ে আমি তোমাকে আল্লাহর শপথ দিচ্ছি।

সাহাবী মুগীরা বলেন, (বিয়ের জরুরতে দেখার প্রসঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও) মেয়েটি দেখাকে ভারী মনে করল। এরপর আমি তাকে দেখি এবং বিবাহ করি। আমাদের মাঝে খুব মিল-মহব্বত হয়। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮১৩৭

লক্ষ্য করি, নারী যদি পরপুরুষের সামনে অনায়াসে চেহারা খোলাই রাখতে পারত তাহলে তো এ মেয়ে মুগীরাকে দেখা-না দেখার বিষয়ে কসম দিত না এবং তার দেখাটাকে ভারী মনে করত না।

হাদীস : ৪৪

আরবের এক আলেম এক্ষেত্রে একটি হাদীস থেকে সুন্দরভাবে বিষয়টি প্রমাণ করেছেন।

সাহাবী ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোনো নারী যেন তার স্বামীর নিকট অন্য নারীর অবয়বের বিবরণ এভাবে না দেয় যে, মনে হয় যেন স্বামী সে নারীকে দেখছে।

এখানে মনে হয় যেন স্বামী সে নারীকে দেখছে।একথা থেকে বোঝা যায়, পরনারীর দিকে তাকানো নিষেধ। আরো বোঝা যায় যে, নারীরা পরপুরুষ থেকে আড়ালেই থাকবে।

যদি পরপুরুষের সামনে পরনারী চেহারা খুলে আসতেই পারত, তাহলে তাকে তো এমনিতেই দেখত। তখন নারীর বিবরণ স্বামীর কাছে দিতে অসুবিধা কী? স্বামী তো তাকে এমনিতেই দেখছে। সুতরাং এভাবে নিষেধ করার কী মানে যে, যেন সে তাকে দেখছে।

আরো বোঝা যায়, পরনারীর চেহারা ও আকৃতি অন্যের বিবরণ ছাড়া নিজে দেখার কোনো সুরত নেই।

আপাতত এ কয়টি হাদীস ও আছার উল্লেখ করেই প্রসঙ্গের ইতি টানছি। এখানে মাত্র ৪৪টি হাদীস ও আছার উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আমরা দেখেছি, পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর নারী সাহাবীগণ কীভাবে ও কতভাবে পরপুরুষ থেকে চেহারা ঢেকে রাখতেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীকে উটে বসিয়েছেন, তখন তাঁকে ঢেকে নিয়েছেন, উট থেকে পড়ে গেছেন, সাথে সাথে তাঁকে ঢেকে নিয়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন, কত বড় বিপদ এ সময়, পরপুরুষ আসার সাথে সাথে চেহারা ঢেকে নিয়েছেন। দুধচাচা ঘরে প্রবেশ করেছে, পরপুরুষ ভেবে নিজে সাথে সাথে পর্দার আড়ালে চলে গেছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের সময় স্ত্রীগণ বসা, হঠাৎ আব্বাস রা. ঘরে প্রবেশ করলে সবাই চেহারা ঢেকে ফেলেন। গোলাম থাকা অবস্থায় নবীপত্নীগণ কারো সাথে দেখা দিতেন; যখনই মুক্ত হয়ে গিয়েছে তখনই তার থেকে সবাই পর্দা করা শুরু করেন। বালেগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত নবীপত্নীগণের সাথে দেখা করতে পারত, বালেগ হওয়ার পর আর পারে না। নবী-পত্নীগণকে কতজন কত মাসআলা জিজ্ঞাসা করেছে, কতজন তাদের থেকে ইলম অন্বেষণ করেছে, সবই পর্দার আড়াল থেকে হয়েছে। নারীগণ হজে¦ গিয়েছেন, তো সেখানেও পরপুরুষ এলে চেহারায় কাপড় ঝুলিয়ে দিতেন। মুকাতাব ছিল, এখনো কিছু দিরহাম বকেয়া আদায়ের সামর্থ্য নেই, তার থেকে নবী-পত্নীগণ পর্দা করেননি, কিন্তু যখনই তা আদায় করে দেয় বা আদায়ের সামর্থ্য হয়ে যায় সাথে সাথে তার থেকে পর্দা শুরু করেছেন। পরপুরুষের আগমনে বৃদ্ধা নারীও আড়ালে চলে যেতেন। এ ধরনের অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি। এ থেকে কত পরিষ্কার যে, সাহাবা-তাবেয়ীনের নারীগণ পর্দার বিধান অবতীর্ণ হওয়ার পর পরপুরুষ থেকে চেহারা ঢাকাকে কোন্ পর্যায়ের আবশ্যক বিধান মনে করতেন। আশা করি, এত নমুনা ও উদাহরণ পাওয়ার পর এ বিষয়ে ধোঁয়াশা থাকবে না- ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ্ই হেদায়েত দানকারী। হ 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement