জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

মুমিন জীবনে বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে নববী

মাওলানা আবু তাহের রাহমানী

বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে নববী তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসৃত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ইহজাগতিক যাবতীয় কর্মকা-ও নেক আমলে পরিণত হয়। মানুষ মনে করে, মসজিদে গিয়ে নামায পড়া, কুরআনুল কারীম তিলাওয়াত করা, হজ্জ্বে বাইতুল্লাহ এবং রমযান মাসের সিয়াম সাধনা তো ইবাদত।

পক্ষান্তরে ক্ষুধা-পিপাসা নিবারণ, প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ, বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথোপকথন থেকে শুরু করে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যাবতীয় স্বভাবজাত কার্যক্রম শুধুই দুনিয়াবি কাজকর্ম। এর সাথে দ্বীন-ধর্ম ও ইবাদতের আবার কী সম্পর্ক? এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।

বস্তুত আমরা আমাদের জীবনব্যাপী  স্বভাবজাত যত ধরনের কর্মকা- সম্পাদন করে থাকি, তার প্রতিটিই নির্ভেজাল নেক আমলে পরিণত হতে পারে, যদি তা সুন্নাতে নববী তথা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণে করা হয়। শুধু প্রয়োজন বিশুদ্ধ নিয়তের।

বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে নববী যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে একজন মানুষের পানাহার, উঠাবসা, ঘুমানো, জাগ্রত হওয়া এবং বন্ধু-বান্ধবের সাথে চলাফেরা তথা জীবনের প্রতিটি কর্মকা-ই আমলে সালেহ তথা নেক আমলে পরিণত হতে পারে। তাই প্রত্যেক মুমিনের জীবনে বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে রাসূলের যথার্থ অনুসরণ অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

যেমন, রোযা বা সিয়াম সাধনা। যদি কেউ শুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত সারাদিন পানাহার থেকে বিরত থাকে, তা কিছুতেই ইবাদতরূপে গণ্য হবে না এবং তাতে কোনো সাওয়াব বা বিনিময় অর্জিত হবে না। কিন্তু তার এ উপবাস যাপন যদি রোযার নিয়তে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়, তখন তা ইসলামের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতে পরিণত হবে।

মোটকথা, শুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিপূর্ণ অনুসরণে আমাদের গোটা জীবন দ্বীনে পরিণত হয়ে যেতে পারে।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إِذَا أَكَلَ أَحَدُكُمْ فَلْيَذْكُرِ اسْمَ اللهِ تَعَالَى، فَإِنْ نَسِيَ أَنْ يَذْكُرَ اسْمَ اللهِ تَعَالَى فِي أَوَّلِهِ فَلْيَقُلْ بِسْمِ اللهِ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ.

তোমাদের কেউ যখন খাবার গ্রহণ শুরু করবে, তখন সে যেন বিসমিল্লাহ বলে। যদি সে খাবারের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলতে ভুলে যায়, তাহলে যেন সে খাবারের মাঝে বলে-

بِسْمِ اللهِ أَوَّلَهُ وَآخِرَهُ.

খাবারের শুরু ও শেষ আল্লাহর নামে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৭৬৭

আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَنْ أَكَلَ طَعَامًا فَقَالَ: الحَمْدُ لِلهِ الَّذِي أَطْعَمَنِي هَذَا وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلَا قُوَّةٍ، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ.

যে ব্যক্তি খাবার গ্রহণ শেষে বলবে-

الحَمْدُ لِلهِ الَّذِي أَطْعَمَنِي هَذَا وَرَزَقَنِيهِ مِنْ غَيْرِ حَوْلٍ مِنِّي وَلَا قُوَّةٍ.

তার বিগত জীবনের সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন।

দুআর অর্থ : সব প্রশংসা আল্লাহর, যিনি আমাকে এ খাবার আহার করিয়েছেন এবং জীবনোপকরণরূপে তা দান করেছেন; আমার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা ও শক্তি ব্যতীত। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪০২৩

অর্থাৎ যদি কোনো ব্যক্তি বিসমিল্লাহ বলে পানাহার শুরু করে এবং আলহামদু লিল্লাহ বলে শেষ করে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার বিগত সব সগীরা গুনাহ মাফ করে দেন। এখানে শুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে নববী অনুসরণের কারণে এত বড় কল্যাণ সাধিত হল। ক্ষুধা পিপাসা নিবারণের প্রয়োজন তো পূরণ হলই, পাশাপাশি পরকালীন বিশাল ফায়দাও অর্জিত হল।

বস্তুত ইসলাম এটাই চায়, মুমিনের ইহজাগতিক প্রতিটি কাজও যেন দ্বীন ও ইবাদতে পরিণত হয়। যেমন, একজন মুমিন রাতে এই নিয়তে ঘুমাবে যে, ঘুম থেকে উঠে সে তাহাজ্জুদ পড়বে। প্রাকৃতিক প্রয়োজন এ উদ্দেশ্যে পূরণ করবে যে, তাতে দৈহিক প্রশান্তি আসবে, ফলে স্বাচ্ছন্দে সে ইবাদত করতে পারবে। খাবার এ নিয়তে গ্রহণ করবে যে, তাতে শারীরিক শক্তি অর্জিত হবে, ফলে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা তার জন্য সহজ হবে। শুদ্ধ নিয়তের কারণে উল্লিখিত প্রতিটি কাজ নিখাদ ইবাদতে পরিণত হয়ে গেল।

ইসলামের প্রতিটি কাজে দ্বিমুখী সফলতা

মুমিন তার জীবনের প্রতিটি কাজে বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে নববী অনুসরণের মাধ্যমে ইহজাগতিক স্বার্থ ও পরজাগতিক কল্যাণ উভয় দিকই অর্জনে সক্ষম হতে পারে।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

السِّواكُ مَطهرةٌ للفمِ، مَرضاةٌ للرَّبِّ.

মিসওয়াক ব্যবহার করা মুখের পরিচ্ছন্নতা ও আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যম। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ৫; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২৮৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৩৫; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ১০৬৭

শুধু দাঁত পরিষ্কারের উদ্দেশ্যে মিসওয়াক করলে দাঁত তো পরিষ্কার হবে; কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে না। পক্ষান্তরে সুন্নাতে নববী অনুসরণের উদ্দেশ্যে মিসওয়াক করলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সন্তুষ্টিও হাসিল হবে। আরেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনে অনেক বেশি মিসওয়াকের আমল করতেন। বিশেষত পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের পূর্বে, তাহাজ্জুদের সময় এবং সাহাবীগণের সাথে কথা বার্তা থেকে অবসর হয়ে তিনি মিসওয়াক করতেন।

এমনকি জীবন সায়াহ্নে যখন তিনি শয্যাশায়ী, তখনও মিসওয়াকের দিকে তাকালেন। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. বুঝে ফেললেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াক করতে চান। আয়েশা রা. তাঁর হাতে মিসওয়াকটি দিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিসওয়াক করলেন। এরপর উক্ত মিসওয়াক দ্বারা আয়েশা রা. নিজেও মিসওয়াক করলেন। তিনি অন্যান্য উম্মাহাতুল মুমিনীনের উপর এ বলে গর্ব করতেন, আল্লাহর রাসূলের পবিত্র লালা তাঁর গলায় প্রবেশ করেছে এবং রাসূলের মাথা মুবারক তাঁর শিয়রে থাকাবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৮৯০, ৪৪৪৯, ৪৪৫১, ৫৬১০

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে আয়েশা রা. প্রশ্ন করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এত অধিক পরিমাণ মিসওয়াক কেন করেন?

তিনি বললেন, আল্লাহর রহমতের ফিরিশতাগণের সাথে আমার কথোপকথন হয়। মুখের দুর্গন্ধ তাদের অপছন্দ। তাই আমি অধিক পরিমাণ মিসওয়াক করে থাকি।

মোটকথা, ইসলামের প্রতিটি কাজে দুটি কল্যাণ ও সফলতা রয়েছে। একটি দুনিয়ামুখী এবং অপরটি দ্বীনমুখী।

খলীফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব রা. মৃত্যুশয্যায় শায়িত। জনৈক যুবক এলেন তাঁর শুশ্রƒষার জন্য। যুবক ফিরে যাওয়ার সময় খলিফা উমর রা. বললেন, যুবকটিকে ডেকে আনো।যুবক ফিরে এলে তিনি তাকে সম্বোধন করে বললেন-

يا ابنَ أخي ارفَعْ ثوبَك فإنَّه أَنْقَى لثوبِك وأَتْقَى لِربِّكَ.

বৎস হে! তুমি তোমার কাপড় টাখনুর উপরে উঠাও। কারণ, টাখনুর উপরে কাপড় পরা তোমার কাপড়ের জন্য অধিক পরিচ্ছন্নতা এবং তোমার পালনকর্তার অধিক তাকওয়া লাভের উপায়। -সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৬৯১৭

বস্তুত টাখনুর উপরে কাপড় পরিধান করার কাজ তো একটি; কিন্তু তাতে উপকারিতা দুইটি। একটি হল, কাপড়ের পরিচ্ছন্নতা, অপরটি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে-

ثلاثةٌ لا يُكلِّمُهمُ اللهُ، ولا يَنظُرُ إليهم يومَ القِيامةِ، ولا يُزكِّيهم، ولهم عَذابٌ أليمٌ: المُسبِلُ، والمنّانُ، والمُنفِّقُ سِلعَتَه بالحَلَفِ الفاجِرِ...

অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা হাশরের ময়দানে তিন ব্যক্তির দিকে রহমতের দৃষ্টিতে তাকাবেন না- টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোঁটা দানকারী এবং মিথ্যা কসমের মাধ্যমে পণ্য বাজারজাতকারী। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৬

কারণ, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করা অহংকারের নিদর্শন। ফলে তা আল্লাহ তাআলার ক্রোধ ডেকে আনে। সুতরাং টাখনুর উপরে কাপড় পরিধান করার মধ্যে যেমন কাপড়ের পরিচ্ছন্নতা রয়েছে, অনুরূপ তাতে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টিও নিহিত রয়েছে।

এ হাদীস থেকেও স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, ইসলামের প্রতিটি কাজের মধ্যে দুটি কল্যাণ রয়েছে; যদি তা বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্নাতে নববী অনুসরণের মাধ্যমে হয়।

অন্য আরেক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

وَفِي بُضْعِ أَحَدِكُمْ صَدَقَةٌ، قَالُوا: يَا رَسُولَ اللهِ، أَيَأتِي أَحَدُنَا شَهْوَتَهُ وَيَكُونُ لَهُ فِيهَا أَجْرٌ؟ قَالَ: أَرَأَيْتُمْ لَوْ وَضَعَهَا فِي حَرَامٍ أَكَانَ عَلَيْهِ فِيهَا وِزْرٌ؟ فَكَذَلِكَ إِذَا وَضَعَهَا فِي الْحَلَالِ كَانَ لَهُ أَجْرٌ.

তোমাদের প্রত্যেকের লজ্জাস্থানেরও একটি সদকা রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, আমাদের কেউ স্ত্রী মিলনের মাধ্যমে নিজের জৈবিক চাহিদা পূরণ করবে, তাতেও কি সাওয়াব লাভ হবে?

উত্তরে তিনি বললেন, এ চাহিদা যদি হারাম পথে পূরণ করা হত তাহলে কি গুনাহ হত না? সুতরাং যখন কেউ হারাম পথ পরিহার করে হালাল পথে তা পূরণ করল, তখন এটিই একটি পুণ্যের কাজে পরিণত হল। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০০৬

সুতরাং স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলনেও দুটি দৃষ্টিকোণ বিদ্যমান। একটি তো হল জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং অপরটি হল হারাম পথ বর্জন। ফলে হারাম পথ পরিহারের নিয়তে বৈধ স্ত্রীর সাথে দৈহিক মিলন হলে, অবশ্যই এটিও একটি নেক আমলরূপে গণ্য হবে।  

ইসলাম কাকে বলে?

বস্তুত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম ও বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করার নাম হল ইসলাম। যে কাজ আল্লাহ তাআলার হুকুম অনুযায়ী হবে, সেটিই ইসলাম ও আমলে সালেহরূপে গণ্য হবে। এমনকি কোনো এমন কাজ, যা সাধারণ অবস্থায় পাপ, কিন্তু কোনো বিশেষ অবস্থায় আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত তার অনুমতি দিয়ে থাকলে সেটাও হবে ইসলাম মোতাবেক এবং হবে নেক আমল। যেমন মিথ্যা বলা মহা পাপ। কিন্তু আপোষ মীমাংসা ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দূরীকরণে কিছুটা মিথ্যার আশ্রয় নেয়া অনিবার্য হয়ে গেলে, শরয়ী বিধানমতে ততটুকু মিথ্যা বলার অবকাশ রয়েছে।

তিন স্থানে মিথ্যা বলার অনুমতি থাকার কথা হাদীসে এসেছে।

আসমা বিনতে ইয়াযীদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لَا يَحِلُّ الْكَذِبُ إِلَّا فِي ثَلَاثٍ: يُحَدِّثُ الرَّجُلُ امْرَأَتَهُ لِيُرْضِيَهَا، وَالْكَذِبُ فِي الْحَرْبِ، وَالْكَذِبُ لِيُصْلِحَ بَيْنَ النَّاسِ.

তিন অবস্থাতেই কেবল মিথ্যা বলার বৈধতা রয়েছে- স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে, যুদ্ধক্ষেত্রে রণকৌশলের অংশ হিসেবে এবং সামাজিক বিবাদ-বিসংবাদ নিরসনে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯৩৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯২১

উম্মে কুলসুম বিনতে ওকবাহ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন-

ليس الكذَّابُ الذي يُصْلِحُ بينَ النَّاسِ فيقولُ خَيرًا، أو يَنْمِي خَيرًا.

সে ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে সমাজে আপোষ মীমাংসার জন্য (নিজের থেকে) ভালো কথা বলে বা ভালো কথা পৌঁছে দেয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৯২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৬৫

উদ্ধত ও দাম্ভিকদের উদ্দেশে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন-

وَ لَا تَمْشِ فِی الْاَرْضِ مَرَحًا اِنَّكَ لَنْ تَخْرِقَ الْاَرْضَ وَ لَنْ تَبْلُغَ الْجِبَالَ طُوْلًا.

ভূপৃষ্ঠে তুমি দম্ভভরে পদচারণা করো না, নিশ্চয় তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনোই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কিছুতেই পর্বতসমান হতে পারবে না। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৭

এর কারণ, মানুষ আল্লাহ তাআলার বান্দা ও দাস। বন্দেগী ও দাসত্ব করাই তার কাজ। পৃথিবীতে মানুষ আল্লাহর নিরঙ্কুশ ইবাদত ও দাসত্ব স্বীকার করবে- এ উদ্দেশ্যেই মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং তার চলনে-বলনে এবং আচরণে-উচ্চারণে মহামহিম সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বন্দেগী ও দাসত্বের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটতে হবে। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَ عِبَادُ الرَّحْمٰنِ الَّذِیْنَ یَمْشُوْنَ عَلَی الْاَرْضِ هَوْنًا.

রহমানের বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে বিনম্রভাবে বিচরণ করে। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬৩

এ আয়াতাংশে আল্লাহ তাআলা মানুষকে ভূপৃষ্ঠে অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রদর্শন করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, গোলাম বা কৃতদাসের জন্য দাম্ভিকতা প্রদর্শন মূর্খতা বৈ কিছু নয়। দম্ভ ও অহংকার সেই ব্যক্তিই প্রদর্শন করে, যে নিজ অস্তিত্বের উৎসমূল ভুলে যায়।

জনৈক উদ্ধত ব্যক্তি চরম দাম্ভিকতার সাথে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। প্রসিদ্ধ বুযুর্গ মালেক ইবনে দীনার রাহ.-ও সেই পথে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁর চলার মধ্যে বিনয়-নম্রতা ও ধীরস্থিরতা প্রকাশ পাচ্ছিল। তিনি উদ্ধত লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, বৎস হে! তুমি এমন দাম্ভিকতার সাথে চলছ কেন?

লোকটি উত্তেজিত হয়ে বলতে লাগল, জানো আমি কে?

অহংকারী লোকটি যদিও ছিল অর্থবিত্তে ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে বিরাট কিছু; কিন্তু মালেক ইবনে দীনার রাহ.-ও তাঁর ইবাদত-বন্দেগী এবং জ্ঞান ও গুণে কম ছিলেন না। তিনি বললেন, জানি, কে তুমি। কী তোমার পরিচয়। তোমার পরিচয় তো হল-

أوَّلُك نُطْفَة مَذِرَة وآخِرك جِيفَة قَذِرَة وأنت فيما بين ذلك تحمل العَذِرَة.

অর্থাৎ, তোমার অস্তিত্বের সূচনা এক বিন্দু নাপাক পানি, (যা দেহ স্পর্শ করলে দেহ নাপাক হয়, কাপড় স্পর্শ করলে কাপড় অপবিত্র হয় এবং দেহ থেকে নির্গত হলে গোসল আবশ্যক হয়।) তোমার সমাপ্তি হল, পঁচা দুর্গন্ধময় এক মৃতদেহ। আর এ দু অবস্থার মাঝে তুমি উদরে বহন করে চলছ নাপাক মল-মূত্র। (জীবনী অংশ, মালেক ইবনে দীনার রাহ., সিয়ারু আলামিন নুবালা)

মালেক ইবনে দীনার রাহ.-এর এ অমোঘ সত্যবাণী শ্রবণে উদ্ধত ব্যক্তিটি তার প্রকৃত পরিচয় উপলব্ধি করল। সে লজ্জিত, অনুতপ্ত ও অনুশোচনাগ্রস্ত হয়ে আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করল।

ইবাদতে ইখলাস ও ইত্তেবায়ে সুন্নাতের আবশ্যকতা

যে কোনো ইবাদত ও সৎকর্ম আল্লাহ তাআলার নিকট গৃহীত হওয়ার জন্য দুটি বিষয় অপরিহার্য- ইখলাস ও ইত্তেবায়ে সুন্নাত।

ইখলাস অর্থাৎ, দ্বীনী যে কোনো কাজকর্ম এবং যে কোনো ভালো আমল শুধু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য করা। রিয়া বা লোক দেখানো এবং সুনাম সুখ্যাতি ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে না করা। নামায-রোযা, হজ্ব-যাকাত থেকে শুরু করে অন্য যে কোনো ইবাদতে যদি ইখলাস বা একনিষ্ঠতা না থাকে, তাহলে উক্ত ইবাদত কিছুতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট গৃহীত হয় না। প্রতিটি ইবাদতেই আল্লাহর তাওহীদ ও একত্ববাদের চরিত্র বিদ্যমান থাকতে হবে। মুমিন যখন নামায পড়বে, শুধু আল্লাহ তাআলার জন্য পড়বে। যখন রোযা রাখবে শুধু আল্লাহর উদ্দেশ্যে রাখবে এবং যখন দান-খয়রাত করবে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই তা করবে। উল্লেখিত এসব ইবাদতে কোনোভাবেই কোনো সৃষ্টিকে অংশীদার করবে না। কারণ যে কোনো ইবাদত যতই সুন্দর হোক না কেন, তাতে ইখলাস ও নিষ্ঠা না থাকলে সেটি আল্লাহ তাআলার নিকট গৃহীত হবে তো দূরের কথা, তা ইবাদতরূপেই গণ্য হবে না।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-

أوَّلُ النّاسِ يُقْضَي فيهِ يومَ القيامةِ ثلاثةٌ: رجلٌ استُشهِدَ، فأُتِيَ بهِ فعرَّفَه نعِمَهُ، فعرَفَها فقال: ما عمِلتَ فيها؟ قال: قاتلتُ في سبيلِكَ حتّى استُشهِدتُ. فقال: كذبتَ إنّما أردتَ أن يُقالَ: فلانٌ جريءٌ، فقد قيلَ فأُمِرَ بهِ فسُحِبَ على وجهِهِ حتّى أُلْقِيَ في النّارِ، ورجلٌ تعلَّمَ العلمَ، وقرأ القرآنَ، فأُتِيَ بهِ، فعرَّفَهُ نعِمَهُ، فعرَفَها فقال: ما عمِلتَ فيها؟ قال: تعلَّمتُ العِلمَ وقرأتُ القرآنَ وعلَّمتُهُ فيكَ، قال كذبتَ وإنّما أردتَ أن يُقالَ فلانٌ عالمٌ، وفلانٌ قارئٌ، فقد قيلَ فأُمِرَ بهِ فسُحِبَ على وجهِهِ إلى النّارِ، ورجلٌ آتاهُ اللهُ مِن أنواعِ المالِ، فأُتِيَ بهِ فعرَّفَهُ نعِمَهُ فعرَفَها. قال: ما عمِلتَ فيها؟ قال: ما تركتُ مِن شيءٍ تحبُّ أن يُنفَقَ فيهِ إلّا أنفقتُ فيهِ لكَ. فقال: كذبتَ. إنّما أردتَ أن يُقالَ: فلانٌ جَوادٌ فقد قيلَ، فأُمِرَ بهِ فسُحِبَ على وجهِهِ حتّى أُلْقِيَ في النّارِ.

অর্থাৎ, হাশরের ময়দানে সর্বপ্রথম তিন ব্যক্তির ফায়সালা করা হবে :

এক. আল্লাহর পথে জীবন দানকারী। তাকে ডেকে আল্লাহ বলবেন, বান্দা! পৃথিবীতে আমি তোমাকে যৌবন, যৌবনের উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা এবং শক্তি-ক্ষমতা দান করেছিলাম। ইহজগতে তুমি তা কোথায় খরচ করেছ?

সে বলবে, আমি তা আপনার রাস্তায় জিহাদে ব্যয় করেছি, এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত বিলিয়ে দিয়েছি।

আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি তো চেয়েছিলে লোকেরা তোমাকে বীরপুরুষ বলবে। তা তো পৃথিবীতে বলা হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আদেশ করা হবে, ফলে তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

দুই. আল্লাহ তাআলা আলেম ও কারীকে ডেকে নিআমতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করবেন, পৃথিবীতে আমি তোমাকে ইল্ম ও কুরআন দান করেছিলাম। তা তুমি কোন্ কাজে ব্যবহার করেছ?

তারা বলবে, ইলম ও কুরআনের শিক্ষা অর্জন করেছি এবং মানুষকে শিখিয়েছি আপনার সন্তুষ্টির জন্যই। আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি তো তা করেছ, যেন লোকেরা তোমাকে আলেম বলে, কারী বলে। দুনিয়াতে তা বলা হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আদেশ করা হবে, ফলে তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।

তিন. ধনসম্পদের অধিকারীকে আল্লাহ বলবেন, পৃথিবীতে আমি তোমাকে বিপুল সম্পদের অধিকারী করেছিলাম। আমার প্রদত্ত সম্পদ তুমি কী কাজে ব্যয় করেছ?

সে বলবে, আপনার প্রদত্ত সম্পদ আমি অকাতরে আপনার রাস্তায় ব্যয় করেছি (তা দ্বারা নিঃস্ব-দরিদ্র অভাবগ্রস্ত ও অসহায়দের সাহায্য করেছি, মসজিদ মাদরাসা নির্মাণ ও জনকল্যাণমূলক কাজে  ব্যয় করেছি)।

আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছো, তুমি সবই করেছ, যেন লোকেরা তোমাকে বড় দানবীর বলে। তা তো পৃথিবীতে বলা হয়ে গিয়েছে। অতঃপর আদেশ করা হবে, ফলে তাকে টেনে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৩২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৫

আরবের মুশরিক ও পৌত্তলিকরা তাদের নজর-মানত, দান-খয়রাত এবং উৎপন্ন ফসল ও চতুষ্পদ জন্তুর কিছু অংশ আল্লাহর নামে আর কিছু অংশ তাদের বানোয়াট উপাস্যদের নামে নির্ধারণ করত। তাদের এই মূর্খতা ও অজ্ঞতাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের অসারতা তুলে ধরে আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন-

وَ جَعَلُوْا لِلهِ مِمَّا ذَرَاَ مِنَ الْحَرْثِ وَ الْاَنْعَامِ نَصِیْبًا فَقَالُوْا هٰذَا لِلهِ بِزَعْمِهِمْ وَ هٰذَا لِشُرَكَآىِٕنَا فَمَا كَانَ لِشُرَكَآىِٕهِمْ فَلَا یَصِلُ اِلَی اللهِ وَ مَا كَانَ لِلهِ فَهُوَ یَصِلُ اِلٰی شُرَكَآىِٕهِمْ سَآءَ مَا یَحْكُمُوْنَ.

আল্লাহ যেসব শস্যক্ষেত ও চতুষ্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, সেগুলো থেকে তারা (মুশরিকরা) এক অংশ আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করে এবং তাদের ধারণা অনুযায়ী তারা বলে, এটা আল্লাহর জন্য আর এটা আমাদের অংশীদারদের জন্য। কিন্তু যে অংশ তারা তাদের অংশীদারদের জন্য নির্ধারণ করেছে, তা আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। আর যা আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করেছিল তা তাদের অংশীদারদের নিকট পৌঁছে যায়। তাদের সিদ্ধান্ত কতই না নিকৃষ্ট। -সূরা আনআম (৬) : ১৩৬

এ আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, বান্দার আর্থিক ও দৈহিক যে কোনো ইবাদত একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর জন্য না হলে এবং তাতে আল্লাহর সাথে কোনো অংশীদার সাব্যস্ত করা হলে, উক্ত ইবাদত কিছুতেই আল্লাহ তাআলার নিকট গৃহীত হয় না; বরং তিনি তা ইবাদতকারীর মুখের উপর ছুড়ে মারেন।

অনুরূপভাবে মুমিন যখন যাকাত, ফিতরা, সদকা ও দান-খয়রাত করবে, তখন তা শতভাগ ইখলাস বা একনিষ্ঠতা তথা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই করবে। হাদীসের ভাষ্য মতে, সদকা ও দান-অনুদানের সঠিক পদ্ধতি হল, এমন গোপনীয়তার সাথে দান করা, যেন ডানহাত যা দান করবে বাঁ হাত তা না জানে।

মুমিন চাইবে শুধু আল্লাহর কাছে

তাওহীদ ও একত্ববাদে বিশ্বাসী একজন মুমিনের চরিত্র তো এই হবে, তার যা কিছু প্রয়োজন তা শুধুই আল্লাহ তাআলার নিকট চাইবে; কোনো মাখলুক বা সৃষ্টির কাছে নয়। হাদীসের ভাষ্যমতে, যদি কারো জুতার ফিতা ছিঁড়ে যায় এবং তা ক্রয় করার মত অর্থও তার থাকে, তখনো পকেটে হাত দেয়ার পূর্বে আল্লাহ তাআলার নিকট চেয়ে নেওয়া কর্তব্য। এর মধ্যেও পরকালীন সাওয়াব ও পুরস্কার নিহিত রয়েছে।

কল্যাণ ও অকল্যাণের কার্যকারণ আল্লাহ

যাবতীয় কল্যাণের প্রকৃত আধার ও কার্যকারণ হলেন শুধু আল্লাহ। কল্যাণ সাধনে যেসব উপায়-উপকরণ ব্যবহৃত হয়, সেগুলো কার্যকারণ নয়; বরং কারণ বা মাধ্যম। এ কারণ ও মাধ্যমসমূহের অস্তিত্ব দানকারীও স্বয়ং আল্লাহ। ফলে কোনো কল্যাণ সাধনে তার জন্য নির্ধারিত কারণ বা মাধ্যম ব্যবহৃত হলেই প্রত্যাশিত কল্যাণ অস্তিত্বে আসা আবশ্যক নয়।

যেমন আগুন, তা কোনো বস্তু ভস্মীভূত হওয়ার কারণ; কার্যকারণ নয়। কার্যকারণ হলেন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তিনি আগুনের চরিত্র বা বৈশিষ্ট্য তুলে নিলে, তখন এ আগুন কোনো বস্তু জ্বালাতে ও ভস্মীভূত করতে সক্ষম হয় না। যেমন, ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালামকে উদ্ধত নমরূদ যে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল, আল্লাহ উক্ত আগুন থেকে তার চরিত্র ছিনিয়ে নিয়ে তাকে নির্দেশ দিলেন-

یٰنَارُ كُوْنِیْ بَرْدًا وَّ سَلٰمًا عَلٰۤی اِبْرٰهِیْمَ.

 হে আগুন! তুমি ঠাণ্ডা শীতল ও শান্তিময় হয়ে যাও ইবরাহীমের উপর। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৬৯

ফলে নমরূদের প্রজ্বালিত অগ্নিকুণ্ডের ভেতরেও তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদ ও অক্ষত থাকলেন।

পানির অপর নাম জীবন। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন-

وَ جَعَلْنَا مِنَ الْمَآءِ كُلَّ شَیْءٍ حَیٍّ.

আমি আল্লাহ পানি থেকে সৃষ্টি করেছি প্রাণী জগতের সবকিছু। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৩০

অথচ এ পানিই দুরাচার ফেরাউন ও তার দলবলের জন্য লোহিত সাগরে ডুবে মৃত্যুর কারণ হল। আবার এ পানির মধ্য দিয়েই আল্লাহর নির্দেশে মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর অনুসারী বনী ইসরাঈলের বারোটি গোত্রের জন্য বারোটি পথ তৈরি হল। ফলে বনী ইসরাঈলের একেকটি গোত্র একেক রাস্তা দিয়ে নিরাপদে লোহিত সাগর অতিক্রম করল। কারণ, আল্লাহ তাআলা মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর অনুসারী বনী ইসরাঈলের জন্য লোহিত সাগরের পানি থেকে ডুবিয়ে ফেলার চরিত্র উঠিয়ে নিয়েছিলেন। আর দুরাচার ফেরাউন ও তার দলবলকে উক্ত পানিতেই ডুবিয়ে মেরেছিলেন।

মা-বাবা সন্তানের জন্য অস্তিত্ব লাভের কারণ, অস্তিত্ব দানকারী বা অস্তিত্ত্বের কার্যকারণ নয়, অস্তিত্ব দানকারী হলেন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। আল্লাহ তাআলা যদি চান, মা-বাবার মাধ্যম ব্যতীতও মানুষকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করতে পারেন। যেমন আদি পিতা আদম আলাইহিস সালামকে তিনি মা-বাবার মাধ্যম ব্যতীতই অনস্তিত্ত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন। আবার তিনি আপন কুদরতে ঈসা আলাইহিস সালামকে পিতার মাধ্যম ব্যতীত মারইয়াম আলাইহাস সালামের উদর থেকে সরাসরি দুনিয়াতে এনেছেন।

আল্লাহ তাআলার চিরন্তন নিয়ম তো হল, স্বামী স্ত্রীর দৈহিক মিলনের মাধ্যমেই পৃথিবীতে সন্তান অস্তিত্ব লাভ করে। অথচ ভূপৃষ্ঠে এমন অসংখ্য পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ রয়েছে, যেগুলো মা-বাবার মাধ্যম ব্যতীত শুধু ময়লা আবর্জনার স্তুপ থেকে অস্তিত্ব লাভ করে। এদিকে নির্দেশ করেই আল্লাহ তাআলা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন-

اَفَرَءَیْتُمْ مَّا تُمْنُوْنَ، ءَاَنْتُمْ تَخْلُقُوْنَهٗۤ اَمْ نَحْنُ الْخٰلِقُوْنَ.

তোমরা কি ভেবে দেখেছ, তোমাদের বীর্যপাত সম্পর্কে, তোমরা তা সৃষ্টি করেছ, না আমি সৃষ্টি করেছি? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৫৮-৫৯

اَفَرَءَیْتُمْ مَّا تَحْرُثُوْنَ، ءَاَنْتُمْ تَزْرَعُوْنَهٗۤ اَمْ نَحْنُ الزّٰرِعُوْنَ.

তোমরা যে বীজ বপন করো সে সম্পর্কে কি তোমরা ভেবে দেখেছ? তোমরা কি তা উৎপন্ন করো, না আমি তা উৎপন্নকারী? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৬৩-৬৪

اَفَرَءَیْتُمُ الْمَآءَ الَّذِیْ تَشْرَبُوْنَ،ءَاَنْتُمْ اَنْزَلْتُمُوْهُ مِنَ الْمُزْنِ اَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُوْنَ.

তোমরা যে পানি পান করো, সে সম্পর্কে কি তোমরা ভেবে দেখেছ? তোমরা তা মেঘমালা থেকে নামিয়ে আনো, না আমি তা বর্ষণ করি? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৬৮-৬৯

اَفَرَءَیْتُمُ النَّارَ الَّتِیْ تُوْرُوْنَ، ءَاَنْتُمْ اَنْشَاْتُمْ شَجَرَتَهَاۤ اَمْ نَحْنُ الْمُنْشِـُٔوْنَ،نَحْنُ جَعَلْنٰهَا تَذْكِرَةً وَّ مَتَاعًا لِّلْمُقْوِیْنَ.

তোমরা যে আগুন প্রজ¦লিত কর সে সম্পর্কে কি তোমরা ভেবে দেখেছ? তোমরা কি তার বৃক্ষকে অস্তিত্ব দান করেছ, না আমি অস্তিত্ব দান করেছি। আমিই সেই বৃক্ষকে করেছি মরুবাসীর জন্য ভোগোপোকরণ। -সূরা ওয়াকিয়া, (৫৬) : ৭১-৭৩

উল্লিখিত আয়াতসমূহ থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয়, মানুষের অস্তিত্ব দানকারী হলেন আল্লাহ; নারী-পুরুষের মিলন হল অস্তিত্ব লাভের কারণ। আকাশ থেকে বর্ষিত পানি অবতারণকারী হলেন আল্লাহ, আকাশে ভাসমান মেঘমালা হল পানি বর্ষণের কারণ। শস্য-দানা, ফল-মূল ও গাছগাছালি, বৃক্ষ-তরুলতা উৎপন্নকারী হলেন আল্লাহ। কৃষকের চাষাবাদ ও শস্যদানা রোপন হল অস্তিত্ব লাভের উপায় বা কারণ। মোটকথা, যাবতীয় শুভ-অশুভ, উপকার-অপকার, লাভ-ক্ষতি ও কল্যাণ-অকল্যাণের নিরঙ্কুশ মালিক হলেন আল্লাহ। মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর এই সৃষ্টজগতে যত ধরনের বস্তু ও উপায়-উপকরণ রয়েছে, সেগুলো হল কারণ বা মাধ্যম।

ইবাদত শুধুই আল্লাহর জন্য

আল্লাহ তাআলাই যেহেতু যাবতীয় কল্যাণ ও অকল্যাণের আধার। সর্বপ্রকার লাভ-ক্ষতি, শুভ-অশুভ এবং উপকার ও অপকারের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব যেহেতু তাঁরই নিকট। সুতরাং ইবাদত করতে হবে একমাত্র তাঁরই। দৈহিক ও আর্থিক সব ধরনের ইবাদত হতে হবে একমাত্র আল্লাহ তাআলারই উদ্দেশ্যে। নজর-মানত, রুকু-সিজদা তথা যাবতীয় উপাসনা ও আরাধনা করতে হবে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

قَالَ یٰقَوْمِ اِنِّیْ لَكُمْ نَذِیْرٌ مُّبِیْنٌ،اَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَ اتَّقُوْهُ وَ اَطِیْعُوْنِ، یَغْفِرْ لَكُمْ مِّنْ ذُنُوْبِكُمْ وَ یُؤَخِّرْكُمْ اِلٰۤی اَجَلٍ مُّسَمًّی اِنَّ اَجَلَ اللهِ اِذَا جَآءَ لَا یُؤَخَّرُ ۘ لَوْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ.

(নূহ আলাইহিস সালাম তার অবাধ্য সম্প্রদায়কে উদ্দেশ্য করে) বলেছেন, হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্য সুস্পষ্ট সতর্ককারী। এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে, আল্লাহকে ভয় করবে এবং আমার আনুগত্য করবে। তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহর নির্দিষ্টকাল যখন চলে আসবে, তখন অবকাশ দেয়া হবে না। যদি তোমরা তা জানতে। -সূরা নূহ্ (৭১) : ২-৪

মহান আম্বিয়ায়ে কেরাম আলাইহিমুস সালাম তো আল্লাহ তাআলার তাওহীদ ও একত্ববাদের বিশ্বাসের উপর এমন অটল-অনড় ছিলেন, কোনো দুঃখ-কষ্ট তাদের স্পর্শ করলে তারা অভিযোগ করতেন কেবল সর্বশক্তিমান আল্লাহর কাছে, মাখলুক বা সৃষ্টির কাছে নয়।

কুরআনুল কারীমের ভাষ্যমতে, হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের সৎ ভাইয়েরা যখন তাকে শিকারের নামে সাথে করে নিয়ে গভীর কুয়ায় নিক্ষেপ করল, তখন পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম পুত্র ইউসুফের শোকে কাতর হয়ে তাঁর দুঃখ কষ্ট কোনো মানুষের নিকট প্রকাশ না করে আপন রবের নিকট ব্যক্ত করে বললেন-

قَالَ اِنَّمَاۤ اَشْكُوْا بَثِّیْ وَ حُزْنِیْۤ اِلَی اللهِ.

আমি আমার অসহায়ত্ব ও দুঃখ-কষ্টের অভিযোগ শুধু আল্লাহর নিকটই করছি। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৮৬

কারণ, তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন, ইউসুফ আলাইহিস সালাম আল্লাহর ইচ্ছায়ই নিখোঁজ হয়েছেন এবং তাঁর ইচ্ছাতেই তিনি ফিরে আসবেন।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

إذا سَأَلْتَ فاسْألِ الله وإذا اسْتَعَنْتَ فاستَعِنْ باللهِ.

তুমি যখন কোনো কিছু চাইবে আল্লাহর নিকট চাও। আর যখন সাহায্য প্রার্থনা করবে, আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করো।

হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম পুত্র সন্তানের জন্য আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করলেন। পুত্র সন্তান লাভের সব উপকরণ অনুপস্থিত থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বললেন-

قَالَ رَبِّ اِنِّیْ وَهَنَ الْعَظْمُ مِنِّیْ وَ اشْتَعَلَ الرَّاْسُ شَیْبًا وَّ لَمْ اَكُنْۢ بِدُعَآىِٕكَ رَبِّ شَقِیًّا، وَ اِنِّیْ خِفْتُ الْمَوَالِیَ مِنْ وَّرَآءِیْ وَ كَانَتِ امْرَاَتِیْ عَاقِرًا فَهَبْ لِیْ مِنْ لَّدُنْكَ وَلِیًّا،یَّرِثُنِیْ وَ یَرِثُ مِنْ اٰلِ یَعْقُوْبَ وَ اجْعَلْهُ رَبِّ رَضِیًّا.

হে আমার পালনকর্তা! আমার অস্থি দুর্বল হয়ে গিয়েছে, আমার মাথা শুভ্রোজ্জ্বল হয়ে গিয়েছে। হে আমার রব! তোমাকে আহ্বান করে আমি কখনো ব্যর্থ মনোরথ হইনি। আমি আশঙ্কা করছি, আমার পর আমার স্বগোত্রীয়দের সম্পর্কে এবং আমার স্ত্রী বন্ধ্যা। সুতরাং তুমি তোমার পক্ষ থেকে আমাকে দান করো একজন উত্তরাধিকারী। যে আমার (নবুওত ও দ্বীনী শিক্ষার) উত্তরাধিকারী হবে এবং ইয়াকুবের বংশের উত্তরাধিকারী হবে। হে আমার পালনকর্তা! আপনি তাকে করুন সন্তোষজনক। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৪-৬

উপরোক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বান্দার প্রতি এ সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, বান্দা আল্লাহ তাআলার নিকট দুআ করবে সুদৃঢ় আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে।

জনৈক আরব বেদুঈন হজের উদ্দেশ্যে এল। কাবা শরীফের পাশে দাঁড়িয়ে সে আপন রবকে সম্বোধন করে তার সহজ সরল ভাষায় বলতে লাগল-

يا رب البيت، يا رب البيت، جئتك وأهلي في بيتي، ألا تغفر لي، ألا تغفر لي؟

হে কাবার মালিক! হে কাবার মালিক! তোমার দরজায় আমি হাজির। পরিবার পরিজন আমার বাড়িতে রেখে এসেছি। আমায় তুমি ক্ষমা করবে না? তোমার ক্ষমার চাদরে আমায় ঢেকে নেবে না?

দুআর ফলে বান্দা কখনো তো যা চেয়েছে তাই তৎক্ষণাৎ পেয়ে যায়, কিংবা তার চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি পায়। আবার কখনো দুআর ফলাফল বিলম্বে প্রকাশ পায়। এমনিভাবে বান্দার দুআ কখনো সারা জীবনে কবুল হয় না; কিন্তু বৃথাও যায় না; বরং জীবনের সব দুআ কিয়ামত দিবসে নেকীর বিশাল স্তুপে পরিণত হবে। বান্দা বলবে, রাব্বুল আলামীন! আমি তো দুনিয়াতে এত নেক আমল করিনি।

আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি দুনিয়াতে আমার নিকট অবিরাম দুআ করেছিলে। আমি তা তোমার আজকের এ দিনের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। সুতরাং নেক আমলের এ বিশাল স্তুপ তোমার সেসব দুআর ফসল।

এজন্য দুআ থেকে কখনোই হাত গুটিয়ে নেয়া উচিত নয়। দুআর তাৎক্ষণিক কোনো ফলাফল দৃশ্যমান না হলেও অবিরত দুআ করে যাওয়া মুমিনের কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

الدُّعَاءُ مُخُّ الْعِبَادَةِ.

দুআ হল যাবতীয় ইবাদতের নির্যাস। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭১; আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস ৩১৯৬

নির্যাস ব্যতীত শুধু খোসার উপর নির্ভর করা নির্বুদ্ধিতা বৈ কিছু নয়।

গাইরুল্লাহর প্রতি সম্মান

দুআ প্রার্থনা ও আবেদন নিবেদন করতে হবে শুধু আল্লাহ তাআলার নিকট। তাওহীদে বিশ্বাসী কোনো মুমিন গাইরুল্লাহ বা মাখলুকের নিকট দুআ প্রার্থনা করতে পারে না। তবে গাইরুল্লাহর মধ্য থেকে যেসব বস্তু আল্লাহ তাআলার নিকট সম্মানিত সেগুলোর প্রতি তাজিম ও সম্মান প্রদর্শন আবশ্যক। যেমন নবী-রাসূলগণের যথাযথ তাজিম ও ইত্তেবা আবশ্যক। কুরআনুল কারীমের সম্মান রক্ষা করাও অতি আবশ্যকীয় বিষয়। অজু ব্যতীত তা স্পর্শ করার অবকাশ নেই। অনুরূপ কাবা শরীফের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও অত্যন্ত জরুরি। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণকালে তার দিকে মুখ বা পিঠ করতে রাসূল নিষেধ করেছেন। কারণ কাবা শরীফ হল ইবাদতকারীদের জন্য কিবলা।

খালীফাতুল মুসলিমীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রাযিয়াল্লাহু আনহু একবার হজে¦র উদ্দেশে গেলেন। ভিড়ের কারণে হাজারে আসওয়াদ চুমু দেয়ার সুযোগ তিনি পেলেন না। তখন এমন শাসনব্যবস্থা ছিল না যে, পুলিশ দিয়ে তার সামনে থেকে ভিড় অপসারণ করা হবে। তাই তিনি তার লাঠি হাজারে আসওয়াদের সাথে লাগিয়ে উক্ত লাঠিতে চুমু খেলেন। আর হাজারে আসওয়াদকে সম্মোধন করে বলতে লাগলেন-

إنِّي لأَعْلَمُ أَنَّك حَجَرٌ، لا تَضُرُّ وَلا تَنْفَعُ، وَلَوْلا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلَّى اللَّه عليه وسلم يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ.

আমি জানি, তুমি একটি পাথর, কল্যাণ অকল্যাণ পৌঁছাবার ক্ষমতা তোমার নেই। আমি যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তোমায় চুমু খেতে না দেখতাম, আমি তোমাকে চুমু দিতাম না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১২৭০; জামে তিরমিযী, হাদীস ৮৬০; সুনানে নাসায়ী, হাদীস ২৯৩৭

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, জনৈক সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খিদমতে হাজির হলেন এবং তাঁর সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, তুমি এটা কী করলে?

সাহাবী বলতে লাগলেন, আমি রোমান সম্রাট কায়সার ও পারস্য সম্রাট কিসরাকে দেখেছি, লোকেরা তাদেরকে সিজদা করছে। আমার বিশ্বাস, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কায়সার ও কিসরা অপেক্ষা সিজদার অধিক উপযুক্ত।

তিনি বললেন, যদি আল্লাহ তাআলা ব্যতীত কাউকে সিজদা করার অনুমতি থাকতো, তাহলে আমি স্ত্রীদেরকে নির্দেশ দিতাম, সে যেন তার স্বামীদেরকে সিজদা করে। (দ্রষ্টব্য : সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২১৪০)

বস্তুত যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী ও রুকু সিজদা শুধুই আল্লাহ তাআলার মহাসত্তার জন্য নির্ধারিত। কোনো মাখলুকের উদ্দেশ্যে না ইবাদত-বন্দেগী করার আর না রুকু সিজদা করার অবকাশ রয়েছে।

নবী-রাসূলগণও আপন আপন উম্মতকে এই শিক্ষাই দিয়েছেন- তোমরা আল্লাহ তাআলার ইবাদত করো। শুধু তাঁকেই তোমাদের উপাস্যরূপে গ্রহণ করো। আল্লাহ তাআলা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেছেন-

مَا كَانَ لِبَشَرٍ اَنْ یُّؤْتِیَهُ اللهُ الْكِتٰبَ وَ الْحُكْمَ وَ النُّبُوَّةَ ثُمَّ یَقُوْلَ لِلنَّاسِ كُوْنُوْا عِبَادًا لِّیْ مِنْ دُوْنِ اللهِ وَ لٰكِنْ كُوْنُوْا رَبّٰنِیّٖنَ بِمَا كُنْتُمْ تُعَلِّمُوْنَ الْكِتٰبَ وَ بِمَا كُنْتُمْ تَدْرُسُوْنَ.

কোনো মানুষের জন্য সঙ্গত নয় যে, আল্লাহ তাকে কিতাব, হিকমত ও নবুওত দান করবেন, আর সে তা সত্ত্বেও মানুষকে বলবে, তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে আমার বান্দা হয়ে যাও। (বরং সে বলবে) তোমরা আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দা হয়ে যাও, তোমরা যে কিতাব শিক্ষা দাও এবং যা-কিছু নিজেরা অধ্যয়ন কর, তার ফলশ্রুতিতে। -সূরা আলে ইমরান (০৩) : ৭৯

মোটকথা, ইখলাসের অন্তর্নিহিত মর্মবাণী এই হল যে, মুমিন তার সমগ্র জীবনব্যাপী যত ধরনের ইবাদত বন্দেগী করবে, তা শুধুই আল্লাহ তাআলার জন্য করবে। তাতে আল্লাহ তাআলার সাথে অন্য কারো অংশীদারিত্বের লেশমাত্র থাকবে না। অহংকার রিয়া সুনাম সুখ্যাতি বা অন্য কোনো প্রকার স্বার্থ চরিতার্থ করার চিহ্নও তাকে স্পর্শ করবে না।

ইবাদত কবুলের অপর শর্ত ইত্তেবায়ে সুন্নাত

যে কোনো ইবাদত আল্লাহর নিকট গৃহীত হওয়ার দ্বিতীয় শর্ত ইত্তেবায়ে সুন্নাত। প্রতিটি ইবাদত এবং দ্বীনের যে কোনো কাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত পদ্ধতিতে হতে হবে। যে ইবাদত সুন্নাতে নববী অনুযায়ী হবে, তা আল্লাহ তাআলার নিকট ইবাদতরূপে গৃহীত হবে। সুন্নাতে নববী অনুযায়ী না হলে তা ইবাদতরূপে গৃহীত হবে না। যেমন কোনো ব্যক্তি যদি যোহরের ফরয নামায ইখলাসের সাথে অধিক সওয়াবের আশায় চার রাকাতের স্থলে ছয় রাকাত পড়ে, তাহলে তার এ নামায আল্লাহর নিকট গৃহীত হবে না। অনুরূপ যদি কোনো মুসাফির সফর অবস্থায় যোহর আসর কিংবা এশার ফরয নামায দুই রাকাতের স্থলে চার রাকাত পড়ে, কিংবা জুমার ফরয নামায দুই রাকাতের স্থলে চার রাকাত পড়ে, তার এ নামাযও ইবাদতরূপে গৃহীত হবে না এবং আল্লাহর নিকট কবুল হবে না। কারণ এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসৃত পদ্ধতির পরিপন্থী। এমনিভাবে যদি কেউ এরূপ চিন্তা করে, রোযা সূর্যাস্ত পর্যন্ত তো হচ্ছেই; কিন্তু আমি আজ সালাতুত তারাবীহ পর্যন্ত রোযা রাখব। সালাতুত তারাবীহ শেষ করেই তবে ইফতার করব। এমন রোযা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট কিছুতেই গৃহীত হবে না। কারণ, এতে সুন্নাতে নববী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুসরণ করা হয়নি। অনুরূপ যদি কেউ ঈদুল ফিতর শাওয়ালের এক তারিখের পরিবর্তে শাওয়ালের দুই তারিখ এবং ঈদুল আযহা দশ জিলহজে¦র পরিবর্তে নয় যিলহজ¦ উদ্যাপন করে, তাহলে এই ঈদ উদ্যাপন ইসলামী ঈদ হবে না; কারণ এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। বস্তুত ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত দ্বীন ও শরীয়তে আকাঈদ থেকে শুরু করে ইবাদত, আখলাক, মুআমালাত, মুআশারাত এবং জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে সর্ববৃহৎ স্তর পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নমুনা বা আদর্শ নেই।

সুতরাং নতুন করে কোনো নমুনা বা আদর্শ রচনার সুযোগ নেই। ইসলাম হল, একটি পরিপূর্ণ দ্বীন ও জীবনব্যবস্থা। তাতে সর্বপ্রকার হেদায়েত ও নীতি পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে। এটা শুধু ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য যে, পৃথিবীর কোনো জাতি গোষ্ঠী মুসলমানদের ন্যায় তাদের অনুসরণীয় নেতার সীরাত ও আদর্শ পৃথিবীর সামনে পেশ করতে পারবে না। শুধু মুসলিম জাতিই এ দাবি করার অধিকার রাখে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমগ্র জীবন আমাদের সামনে বিদ্যমান।

আমরা জানি, আমাদের নবী পানাহারে, আচরণে-উচ্চারণে, শয়নে-জাগরণে ও প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণে তথা মানব জীবনের প্রতিটি অঙ্গনে কী আদর্শ ও নীতি-পদ্ধতি রেখে গিয়েছেন।

হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, কতিপয় মুশরিক হযরত সালমান ফারসী রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট এসে বলতে লাগলো, আশ্চর্য! তোমাদের নবী তোমাদেরকে সবকিছু শিখিয়ে দিচ্ছে, এমনকি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের পদ্ধতিও।

প্রতিউত্তরে তিনি বললেন, হাঁ অবশ্যই, তিনি আমাদেরকে সবকিছু শেখাচ্ছেন, এমনকি প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণের পদ্ধতিও। তিনি আমাদেরকে আদেশ করেছেন, প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণকালে আমরা যেন কেবলার দিকে মুখ অথবা পিঠ না দেই। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬২)

সুতরাং হাদীসে যখন এমন ছোট ছোট বিষয়সমূহের পদ্ধতিও বিদ্যমান রয়েছে, তাহলে তাতে মানব জীবনের আর কোন্ বিষয় অসম্পূর্ণ থাকতে পারে?

এজন্য যে কোনো ইবাদতে ও দ্বীনী কর্মকাণ্ডে ইখলাস ও লিল্লাহিয়াত যত কম হবে তাতে রিয়া বা শিরকে খফী তত বৃদ্ধি পাবে। ইত্তেবায়ে সুন্নাত বা নববী আদর্শ তাতে যত সংকুচিত হবে, বিদআত ও কুসংস্কার তাতে সে পরিমাণই অনুপ্রবেশ করবে। বস্তুত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমগ্র জীবনই হল মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠতম আদর্শ।

لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِیْ رَسُوْلِ اللهِ اُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِّمَنْ كَانَ یَرْجُوا اللهَ وَ الْیَوْمَ الْاٰخِرَ وَ ذَكَرَ اللهَ كَثِیْرًا.

অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে সুন্দরতম আদর্শ, যারা আল্লাহ ও পরকালের আশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে। -সূরা আহযাব (৩৩) : ২১

আল্লাহ তাআলা আমাদের ইখলাস ও ইত্তিবায়ে সুন্নতের নিআমত পরিপূর্ণ দান করুন- আমীন। হ

 

 

advertisement