জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

মুমিনের শপথনামা

মাওলানা মুহাম্মাদ মুস্তাফিজুর রহমান

আল্লাহ তাআলা যখন মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তখন সর্বপ্রথম মানুষের কাছ তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করেছেন। সূরা আরাফে এ সম্পর্কে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذْ اَخَذَ رَبُّكَ مِنْۢ بَنِیْۤ اٰدَمَ مِنْ ظُهُوْرِهِمْ ذُرِّیَّتَهُمْ وَ اَشْهَدَهُمْ عَلٰۤی اَنْفُسِهِمْ اَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوْا بَلٰی شَهِدْنَا  اَنْ تَقُوْلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّا كُنَّا عَنْ هٰذَا غٰفِلِیْنَ،اَوْ تَقُوْلُوْۤا اِنَّمَاۤ اَشْرَكَ اٰبَآؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَ كُنَّا ذُرِّیَّةً مِّنْۢ بَعْدِهِمْ اَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُوْنَ،وَ كَذٰلِكَ نُفَصِّلُ الْاٰیٰتِ وَ لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُوْنَ.

আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব বনী আদমের পৃষ্ঠ থেকে তাদের সন্তানদের বের করলেন এবং তাদের ব্যাপারে এই মর্মে তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলেন যে, আমি কি তোমাদের রব নই?

তারা বলল, অবশ্যই, আমরা সাক্ষ্য দিলাম।

(তা এ কারণে যে) যাতে কিয়ামতের দিন তোমরা বলতে না পার যে, আমরা তো বেখবর ছিলাম। অথবা এ-ও না বলতে পার যে, ইতিপূর্বে আমাদের বাপদাদারা শিরক করেছিল, আমরা ছিলাম তাদের উত্তরসূরি। ফলে আপনি কি আমাদেরকে পথভ্রষ্টদের কর্মের কারণে ধ্বংস করবেন? এভাবেই আমি আয়াতসমূহ বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করি, যাতে তারা ফিরে আসে। -সূরা আরাফ (০৭) : ১৭২-১৭৪

এ সম্পর্কে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন-

أَخَذَ اللهُ الْمِيثَاقَ مِنْ ظَهْرِ آدَمَ بِنَعْمَانَ - يَعْنِي عَرَفَةَ - فَأَخْرَجَ مِنْ صُلْبِهِ كُلَّ ذُرِّيَّ ذَرَأَهَا، فَنَثَرَهُمْ بَيْنَ يَدَيْهِ كَالذَّرِّ، ثُمَّ كَلَّمَهُمْ قِبَلًا، قَالَ: اَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُوْا بَلٰی  شَهِدْنَا اَنْ تَقُوْلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّا كُنَّا عَنْ هٰذَا غٰفِلِیْنَ،اَوْ تَقُوْلُوْۤا اِنَّمَاۤ اَشْرَكَ اٰبَآؤُنَا مِنْ قَبْلُ وَ كُنَّا ذُرِّیَّةً مِّنْۢ بَعْدِهِمْ اَفَتُهْلِكُنَا بِمَا فَعَلَ الْمُبْطِلُوْنَ.

আল্লাহ তাআলা নামানতথা আরাফায় হযরত আদম আ.-এর পৃষ্ঠ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। তিনি আদমের পৃষ্ঠ থেকে প্রতিটি আদম সন্তানকে বের করে, তার সামনে শষ্যদানার মতো ছড়িয়ে দেন। এর পর তিনি তাদের সাথে সামনাসামনি কথা বলেন; তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের রব নই?

তারা বলল, অবশ্যই।... -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ২৪৫৫, আসসুন্নাহ, ইবনে আবি আসিম, হাদীস ২০২, মুসতাদরাকে হাকেম, হাদীস ৭৫ (হাদিসটি  সহীহ)

আল্লাহ তাআলার সামনে এই শপথবাক্যের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ অঙ্গীকার করেছিল। এটি ছিল মানুষের প্রথম অঙ্গীকার। এরপর আল্লাহ তাআলা মানব সৃষ্টির পর থেকে কয়েকটি ধাপে কয়েকবার এই শপথ ও অঙ্গীকার নবায়ন করেন। তিনি যুগে যুগে নবী প্রেরণ করে তাদের মাধ্যমে এই প্রতিশ্রুতি নবায়ন করেছেন। সূরা আহযাবে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذْ اَخَذْنَا مِنَ النَّبِیّٖنَ مِیْثَاقَهُمْ وَ مِنْكَ وَ مِنْ نُّوْحٍ وَّ اِبْرٰهِیْمَ وَ مُوْسٰی وَ عِیْسَی ابْنِ مَرْیَمَ وَ اَخَذْنَا مِنْهُمْ مِّیْثَاقًا غَلِیْظًا، لِّیَسْـَٔلَ الصّٰدِقِیْنَ عَنْ صِدْقِهِمْ ۚ وَ اَعَدَّ لِلْكٰفِرِیْنَ عَذَابًا اَلِیْمًا.

স্মরণ করুন, যখন আমি নবীদের থেকে তাদের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম এবং অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম আপনি, নূহ, ইবরাহীম, মূসা ও ঈসা ইবনে মারিয়ামের কাছ থেকে। আর আমি তাদের থেকে গ্রহণ করেছি দৃঢ় অঙ্গীকার। যাতে তিনি সত্যবাদীদেরকে তাদের সততা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আর তিনি কাফেরদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছেন যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৭-৮

আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে নবীদের মাধ্যমে তাদের উম্মতের কাছ থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন, তা পূর্বের অঙ্গীকারের চেয়ে সুদৃঢ় ও বিস্তারিত। এ অঙ্গীকার শুধু আল্লাহ তাআলাকে রব এবং একমাত্র রব বলে স্বীকার করার মাঝে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এ অঙ্গীকার হল, সমগ্র জীবন আল্লাহ তাআলার বিধান অনুসারে পরিচালনার অঙ্গীকার। সকল নবীই তাঁর উম্মতের কাছ থেকে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন। বনী ইসরাঈল থেকে যে অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছিল, সে সম্পর্কে কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذْ اَخَذْنَا مِیْثَاقَ بَنِیْۤ اِسْرَآءِیْلَ لَا تَعْبُدُوْنَ اِلَّا اللهَ وَ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا وَّذِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ قُوْلُوْا لِلنَّاسِ حُسْنًا وَّ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ثُمَّ تَوَلَّیْتُمْ اِلَّا قَلِیْلًا مِّنْكُمْ وَ اَنْتُمْ مُّعْرِضُوْنَ،وَ اِذْ اَخَذْنَا مِیْثَاقَكُمْ لَا تَسْفِكُوْنَ دِمَآءَكُمْ وَ لَا تُخْرِجُوْنَ اَنْفُسَكُمْ مِّنْ دِیَارِكُمْ ثُمَّ اَقْرَرْتُمْ وَ اَنْتُمْ تَشْهَدُوْنَ.

স্মরণ কর, যখন আমি এই মর্মে বনী ইসরাঈলের অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যেতোমরা আল্লাহ ব্যতীত কারও ইবাদত করো না। অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম পিতা-মাতা, নিকটজন, এতীম ও সহায়হীন মানুষের প্রতি ইহসানের। আর মানুষকে ভালো কথা বল, নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর। এর পর স্বল্পসংখ্যক লোক ব্যতীত তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিলে এবং উপেক্ষা করলে। আর এ-ও স্মরণ কর, যখন আমি এই মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করলাম যে, তোমরা নিজেদের রক্ত প্রবাহিত করো না, নিজেদেরকে ঘর থেকে বিতাড়িত করো না। এরপর তোমরা তা মেনে নিলে আর তোমরাই এর সাক্ষী। -সূরা বাকারা (০২) : ৮৩-৮৪

এই আয়াতসমূহের প্রথম ভাগে তাওহীদ, দ্বিতীয় ভাগে আদাবুল মুআশারাহবা সামাজিক আচরণ, তৃতীয় ভাগে ইবাদাতএবং চতুর্থভাগে উম্মাহর ঐক্যের অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়েছে। এই আয়াতগুলো বনী ইসরাঈলের ব্যাপারে অবতীর্ণ হলেও, এ অঙ্গীকারগুলো সকল নবীর উম্মতের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাইআতের মাধ্যমে অঙ্গীকার গ্রহণ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসসমূহ লক্ষ্য করলে, এই আয়াতে উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও বহু বিষয় পাওয়া যায়। উবাদাহ ইবনুস সামিত রা. বর্ণিত হাদীসে এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে-

قَالَ لَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَنَحْنُ فِي مَجْلِسٍ: تُبَايِعُونِي عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا، وَلاَ تَسْرِقُوا، وَلاَ تَزْنُوا، وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ، وَلاَ تَأْتُوا بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ، وَلاَ تَعْصُوا فِي مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ فِي الدُّنْيَا فَهُوَ كَفَّارَةٌ لَهُ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ فَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ، إِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ، وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ، فَبَايَعْنَاهُ عَلَى ذَلِكَ.

وفي رواية مسلم: وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللهُ إِلَّا بِالْحَقِّ.

আমরা কোনো এক মজলিসে ছিলাম। এ সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বললেন, তোমরা এই মর্মে আমার হাতে বাইআত হও যে, আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, সন্তানকে হত্যা করবে না, জেনেশুনে অপবাদ আরোপ করবে না এবং ন্যায়সঙ্গত ও ভালো কাজে অবাধ্য হবে না। যে অঙ্গীকার পূর্ণ করবে, তার প্রতিদান আল্লাহর কাছে। আর যে এ বিষয়গুলো থেকে কোনোটিতে লিপ্ত হয় এবং দুনিয়ায় শাস্তি পায়, তা হলে এটি তার জন্য কাফফারাহ। আর যে এমন কাজে লিপ্ত হয় আর আল্লাহ তা গোপন করেন, তার হিসাব আল্লাহ তাআলার কাছে; তিনি চাইলে শাস্তি প্রদান করবেন, অথবা ক্ষমা করে দেবেন। এরপর আমরা এই মর্মে বাইআত হই।

সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় আরো এসেছে- আর আল্লাহ যে প্রাণ হত্যা হারাম করেছেন, তোমরা ন্যায়সঙ্গত অধিকার (হক) ছাড়া তা হত্যা করো না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৭০৯

এই বাইআতটি বাইআতে নিসাতথা নারীদের বাইআত নামে প্রসিদ্ধ। কেননা এই বাইআতের উল্লিখিত বিষয়গুলো কুরআনে কারীমে বর্ণিত নারীদের বাইআতের বিষয়গুলোর অনুরূপ। ইরশাদ হয়েছে-

یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ اِذَا جَآءَكَ الْمُؤْمِنٰتُ یُبَایِعْنَكَ عَلٰۤی اَنْ لَّا یُشْرِكْنَ بِاللهِ شَیْـًٔا وَّ لَا یَسْرِقْنَ وَ لَا یَزْنِیْنَ وَ لَا یَقْتُلْنَ اَوْلَادَهُنَّ وَ لَا یَاْتِیْنَ بِبُهْتَانٍ یَّفْتَرِیْنَهٗ بَیْنَ اَیْدِیْهِنَّ وَ اَرْجُلِهِنَّ وَ لَا یَعْصِیْنَكَ فِیْ مَعْرُوْفٍ فَبَایِعْهُنَّ وَ اسْتَغْفِرْ لَهُنَّ اللهَ اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.

হে নবী, যখন মুমিন নারীরা আপনার কাছে এই মর্মে বাইআত হওয়ার জন্য আসে যে, তারা আল্লাহ তাআলার সাথে কোনো কিছু শরীক করবে না, চুরি করবে না, যিনা করবে না, সন্তানদের হত্যা করবে না, জেনেশুনে কোনো অপবাদ আরোপ করবে না এবং ভালো কাজে আপনার অবাধ্য হবে না, তাহলে তাদের বাইআত গ্রহণ করুন এবং আল্লাহ তাআলার কাছে তাদের জন্য ইসতিগফার করুন। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল, দয়াবান। -সূরা মুমতাহিনাহ (৬০) : ১২

জাবের রা. আকাবায় মদীনার লোকদের বাইআতের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-

تُبَايِعُونِي عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ، وَالنَّفَقَةِ فِي الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ، وَعَلَى الْأَمْرِ بِالْمَعْرُوفِ، وَالنَّهْيِ عَنِ الْمُنْكَرِ، وَأَنْ تَقُولُوا فِي اللهِ، لَا تَخَافُونَ فِي اللهِ لَوْمَةَ لَائِمٍ، وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُونِي، فَتَمْنَعُونِي إِذَا قَدِمْتُ عَلَيْكُمْ مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ، وَأَزْوَاجَكُمْ، وَأَبْنَاءَكُمْ، وَلَكُمُ الْجَنَّةُ.

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা বাইআত হও উদ্যম ও আলস্যে শোনা ও মানার, সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতায় দান করার, ভালো কাজে আদেশ, মন্দ কাজে নিষেধ এবং আল্লাহ তাআলার জন্যে হক কথা বলার উপর; তোমরা আল্লাহর জন্য হক কথা বলতে নিন্দুকের নিন্দার ভয় করো না। আর বাইআত হও আমাকে সাহায্য করার উপর। ফলে যখন আমি তোমাদের কাছে আসব, তখন তোমরা সে সকল বিপদ থেকে নিরাপত্তা দেবে, যা থেকে তোমরা নিজকে, স্ত্রীকে এবং সন্তানদেরকে রক্ষা কর। বিনিময়ে তোমাদের জন্য হবে জান্নাত। -মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৪৪৫৬, ১৪৬৫৩ (হাদীসটি সহীহ)

আওফ ইবনে মালেক রা.-এর বর্ণনায় বলা হয়েছে-

كُنَّا عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، تِسْعَةً أَوْ ثَمَانِيَةً أَوْ سَبْعَةً، فَقَالَ: أَلَا تُبَايِعُونَ رَسُولَ اللهِ؟...قَالَ: فَبَسَطْنَا أَيْدِيَنَا وَقُلْنَا: قَدْ بَايَعْنَاكَ يَا رَسُولَ اللهِ، فَعَلَامَ نُبَايِعُكَ؟ قَالَ: عَلَى أَنْ تَعْبُدُوا اللهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَالصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، وَتُطِيعُوا - وَأَسَرَّ كَلِمَةً خَفِيَّةً - وَلَا تَسْأَلُوا النَّاسَ شَيْئًا فَلَقَدْ رَأَيْتُ بَعْضَ أُولَئِكَ النَّفَرِ يَسْقُطُ سَوْطُ أَحَدِهِمْ، فَمَا يَسْأَلُ أَحَدًا يُنَاوِلُهُ إِيَّاهُ.

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নয়, আট অথবা সাত দিন অবস্থান করেছিলাম। তিনি বললেন, তোমরা কি আল্লাহর রাসূলের হাতে বাইআত হবে না? ...তিনি বলেন, তখন আমরা আমাদের হাত প্রসারিত করলাম এবং বললাম, আমরা বাইআত হলাম। কিন্তু কী বিষয়ের উপর বাইআত হব?

তিনি বলেন, এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে। তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে। আনুগত্য করবে। আরেকটি কথা নিম্নস্বরে বললেন (যা আমরা শুনিনি) এবং (বললেন,) মানুষের কাছে কোনো কিছু চাইবে না।

ঐ দলের কিছু সদস্যকে আমি দেখেছিলাম; তাদের কারো চাবুক পড়ে গেলেও তারা কারো কাছে তুলে দেয়ার জন্য অনুরোধ করতেন না। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০৪৩

৫ম হিজরীতে যখন আরবের সকল মুশরিকগোষ্ঠী একসাথে ইসলাম ও মুসলমানদের কেন্দ্রভূমি মদীনায় হামলা করার উদ্দেশ্যে এল তখন তাদের প্রতিরোধে মুসলিমরা খন্দক খনন করছিলেন। খননকাজে সাহাবীদের মেহনত ও পরিশ্রম দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন-

اللَّهُمَّ إِنَّ العَيْشَ عَيْشُ الآخِرَهْ، فَاغْفِرْ لِلْأَنْصَارِ وَالمُهَاجِرَه

(হে আল্লাহ! জীবন তো হল আখেরাতের জীবন, ক্ষমা করুন আনসার ও মুহাজিরদের।) উত্তরে সাহাবা রা. বলেছিলেন-

نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدَا + عَلَى الجِهَادِ مَا بَقِينَا أَبَدَا

(আমরা সেই সে জাতি, বাইআত হয়েছে যারা মুহাম্মাদের হাতে, জিহাদের বাইআত, রবো যতদিন পৃথিবীতে।) -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৮৩৪

এসকল বাইআতে উল্লেখিত অঙ্গীকারের সবগুলো ইসলামের অপরিহার্য অংশ হওয়ার কারণেই এগুলোর ব্যাপারে মৌখিক স্বীকৃতি গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে বাইআতের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসকল অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন, তা পূর্ণ করা আবশ্যক। এ বাইআত ও অঙ্গীকারসমূহের সারকথা হল, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অনুসারে পরিচালিত করার জন্য একজন মুমিন আল্লাহ তাআলার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইরশাদ হয়েছে-

اَلَمْ اَعْهَدْ اِلَیْكُمْ یٰبَنِیْۤ اٰدَمَ اَنْ لَّا تَعْبُدُوا الشَّیْطٰنَ  اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ،وَّ اَنِ اعْبُدُوْنِیْ هٰذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِیْمٌ.

হে আদম সন্তানেরা! আমি কি তোমাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে বলিনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং তোমরা আমার ইবাদত কর। এটাই সরল পথ। -সূরা ইয়াসীন (৩৬) : ৬০-৬১

কেউ আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত এই অঙ্গীকার গ্রহণের পর ভুল করতে পারে; কিন্তু যে ব্যক্তি অঙ্গীকার গ্রহণ করে না, বরং অস্বীকার করে, সে মুমিন নয়। কারণ অঙ্গীকার অস্বীকার করা হল ইসলামকে অস্বীকার করা আর অঙ্গীকার পূরণে অবহেলা ও ব্যর্থতা হল অপরাধ। অবশ্য মুখে অস্বীকারই অস্বীকারের একমাত্র পন্থা নয়; বরং অস্বীকার হতে পারে কর্মের মাধ্যমেও। যেমন কুরআনে কারীমের বিভিন্ন আয়াতে বনী ইরসাঈলকে অঙ্গীকার ভঙ্গের অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বনী ইসরাঈল আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত অঙ্গীকার স্বীকার করে নেয়ার পর বার বার তারা নিষিদ্ধ অপকর্মে লিপ্ত হয়ে অঙ্গীকার অস্বীকার করেছে। এক্ষেত্রে তারা তাওরাতকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে তাদের কর্মকা- বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছে। মূলত কোনো বক্তব্যের সম্ভাব্য বিভিন্ন অর্থ থাকলেও, বক্তব্যকে সেই অর্থেই প্রয়োগ করা আবশ্যক, যা বক্তার উদ্দেশ্য। বক্তব্যকে অন্যান্য সম্ভাব্য অর্থে প্রয়োগ করা গর্হিত বিকৃতি। এই বিকৃতি অস্বীকারের চেয়েও জঘন্য। কুরআনে ইহুদীদের এই স্বভাবের সমালোচনা করে বলা হয়েছে-

مِنَ الَّذِیْنَ هَادُوْا یُحَرِّفُوْنَ الْكَلِمَ عَنْ مَّوَاضِعِهٖ.

কতক ইহুদী রয়েছে, যারা শব্দকে তার স্থানচ্যুত করে। -সূরা নিসা (০৪) : ৪৬

আল্লাহ তাআলার সাথে অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার পর অঙ্গীকার বাস্তবায়নের নামে এজাতীয় প্রতারণা জাতিগতভাবে বনী ইসরাঈলের স্বভাবে পরিণত হয়েছিল। তবে বনী ইসরাঈল ব্যতীত যারা এ অপরাধে লিপ্ত হয়, তারাও সমান অপরাধী। কুরআন কারীমে বনী ইসরাঈলের শাস্তির উদাহরণ টেনে আমাদেরকে এজাতীয় অপরাধে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।

মূলত বনী ইসরাঈলের কাছ থেকে যেসকল অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে , তা উম্মতে মুহাম্মাদীর অঙ্গীকার থেকে ভিন্ন নয়; হুবহু একই অঙ্গীকার। ফলে যে অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে বনী ইসরাঈল অপরাধী ও অভিশপ্ত, এই উম্মতের কোনো ব্যক্তি যদি একই অপরাধে লিপ্ত হয়, সেও একই ভর্ৎসনা ও নিন্দার পাত্র। মূলত কুরআন কারীমে পূর্বের জাতিসমূহের কুকীর্তি ও পরিণতি উল্লেখ করে এসকল কর্মকা-ে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। এগুলো নিছক গল্প নয়।

কুরআন কারীমের অনেক আয়াতেই আল্লাহ তাআলা তার সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণের নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা আনআমে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوْا وَ لَوْ كَانَ ذَا قُرْبٰی وَ بِعَهْدِ اللهِ اَوْفُوْا  ذٰلِكُمْ وَصّٰىكُمْ بِهٖ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ.

আর যখন তোমরা বলবে, ন্যায়সঙ্গত কথা বলবে; যদিও নিকটজন হয়। আর আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তিনি তোমাদেরকে এ আদেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। -সূরা আনআম (০৬) : ১৫২

আর যারা আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত অঙ্গীকার পালন করে না, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-

الَّذِیْنَ یَنْقُضُوْنَ عَهْدَ اللهِ مِنْۢ بَعْدِ مِیْثَاقِهٖ وَ یَقْطَعُوْنَ مَاۤ اَمَرَ اللهُ بِهٖۤ اَنْ یُّوْصَلَ وَ یُفْسِدُوْنَ فِی الْاَرْضِ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ.

যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখতে আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং যমিনে ফাসাদ করে বেড়ায়- ওরাই ক্ষতিগ্রস্ত। -সূরা বাকারা (০২) : ২৬-২৭

اَفَمَنْ یَّعْلَمُ اَنَّمَاۤ اُنْزِلَ اِلَیْكَ مِنْ رَّبِّكَ الْحَقُّ كَمَنْ هُوَ اَعْمٰی  اِنَّمَا یَتَذَكَّرُ اُولُوا الْاَلْبَابِ،الَّذِیْنَ یُوْفُوْنَ بِعَهْدِ اللهِ وَ لَا یَنْقُضُوْنَ الْمِیْثَاقَ،وَ الَّذِیْنَ یَصِلُوْنَ مَاۤ اَمَرَ اللهُ بِهٖۤ اَنْ یُّوْصَلَ وَ یَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَ یَخَافُوْنَ سُوْٓءَ الْحِسَابِ،وَ الَّذِیْنَ صَبَرُوا ابْتِغَآءَ وَجْهِ رَبِّهِمْ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً وَّ یَدْرَءُوْنَ بِالْحَسَنَةِ السَّیِّئَةَ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عُقْبَی الدَّارِ،جَنّٰتُ عَدْنٍ یَّدْخُلُوْنَهَا وَ مَنْ صَلَحَ مِنْ اٰبَآىِٕهِمْ وَ اَزْوَاجِهِمْ وَ ذُرِّیّٰتِهِمْ وَ الْمَلٰٓىِٕكَةُ یَدْخُلُوْنَ عَلَیْهِمْ مِّنْ كُلِّ بَابٍ،سَلٰمٌ عَلَیْكُمْ بِمَا صَبَرْتُمْ فَنِعْمَ عُقْبَی الدَّارِ،وَ الَّذِیْنَ یَنْقُضُوْنَ عَهْدَ اللهِ مِنْۢ بَعْدِ مِیْثَاقِهٖ وَ یَقْطَعُوْنَ مَاۤ اَمَرَ اللهُ بِهٖۤ اَنْ یُّوْصَلَ وَ یُفْسِدُوْنَ فِی الْاَرْضِ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَ لَهُمْ سُوْٓءُ الدَّارِ.

যে বিশ্বাস করে যে, আপনার কাছে আপনার রবের পক্ষ থেকে যা নাযিল করা হয়েছে, তা সত্য, সে কি তার মতো, যে অন্ধ? উপদেশ তো গ্রহণ করে কেবল জ্ঞানীরা; যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূর্ণ করে এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করে না। আর যারা আল্লাহ যে সম্পর্ক বহাল রাখতে আদেশ করেছেন, তা অটুট রাখে, তাদের রবকে ভয় করে এবং মন্দ হিসাবকে ভয় করে। আর যারা তাদের রবের সন্তুষ্টির আশায় ধৈর্যধারণ করে, নামায কায়েম করে, আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে প্রকাশ্যে ও গোপনে ব্যয় করে এবং মন্দকে ভালো দিয়ে মোকাবেলা করে, তাদেরই জন্য রয়েছে আখেরাতের পরিণাম। (তথা) অনন্তকাল বসবাসের উদ্যান, যেখানে প্রবেশ করবে তারা এবং তাদের পিতা-মাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেককার তারা। আর ফিরিশতাগণ প্রতিটি প্রবেশপথ দিয়ে তাদের কাছে আসবে। (তারা বলবে,) তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক, কেননা তোমরা যে ধৈর্যধারণ করেছ। কত উত্তম এই পরিণাম! আর যারা আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখতে আদেশ করেছেন, তা ছিন্ন করে এবং যমিনে ফাসাদ করে, ওদেরই জন্য রয়েছে লানত, ওদেরই জন্য নিকৃষ্ট নিবাস। -সূরা রাদ (১৩) : ১৯-২৫

আরো ইরশাদ হয়েছে-

اَلَمْ اَعْهَدْ اِلَیْكُمْ یٰبَنِیْۤ اٰدَمَ اَنْ لَّا تَعْبُدُوا الشَّیْطٰنَ  اِنَّهٗ لَكُمْ عَدُوٌّ مُّبِیْنٌ،وَّ اَنِ اعْبُدُوْنِیْ هٰذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِیْمٌ.

হে আদম সন্তানগণ! আমি কি তোমাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে বলিনি যে, তোমরা শয়তানের ইবাদত করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং তোমরা আমার ইবাদত কর। এটাই সরল পথ। -সূরা ইয়াসীন (৩৬) : ৬০-৬১

মোটকথা, আমরা যথাযথভাবে ইসলামের প্রতিটি বিধান পালনে আল্লাহ তাআলার সাথে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাওহীদ, আল্লাহ তাআলার রবুবিয়াত, উলুহিয়াত, যাবতীয় বিশ্বাস, আমল ও আহকাম কেবলমাত্র শব্দ ও বাক্য নয়; বরং নবীদের মাধ্যমে যুগে যুগে সেই শব্দ ও বাক্যসমূহের মর্ম মানুষকে শিখিয়ে তা যথাযথভাবে পালনের জন্য মৌখিক স্বীকৃতি ও অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। এই অঙ্গীকার একবার নেয়া হয়নি; বরং বার বার নেয়া হয়েছে। ফলে একজন মানুষ যখন ইসলামের প্রতি ঈমান আনে, তিনি এই অঙ্গীকার করেন যে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে ইসলাম শিখিয়েছেন, সেভাবেই ইসলামের যাবতীয় বিষয় স্বীকার করেছেন এবং তা যথাযথভাবে পালনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদি কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে ইসলাম শিখিয়েছেন, সেভাবে ইসলামকে স্বীকার না করে, সে মুসলিম নয়। ফলে যারা মুসলিম তাদের আল্লাহ তাআলার সাথে কৃত অঙ্গীকার রক্ষায় নফসের ডাক উপেক্ষা করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গিতপ্রাণ হওয়া আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর সাথে কৃত অঙ্গীকার পূরণের তাওফীক দান করুন- আমীন! হ

 

 

advertisement