জুমাদাল উলা ১৪৪৪   ||   ডিসেম্বর ২০২২

বিশ্বকাপ ফুটবল
কাতার কি ইসলাম প্রচার করছে?

বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর সম্পর্কে সবাই জানেন। এইসব আসরের নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ সম্পর্কে সচেতন মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। যেখানে এইসব আসরের আয়োজন হয়ে থাকে তার আশেপাশে নানা ধরনের অনাচারের দৃশ্য-অদৃশ্য যে স্রোত প্রবাহিত হয় সে সম্পর্কেও অভিজ্ঞ মহল ওয়াকিফহাল। কাজেই এই আয়োজন কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার মধ্যে মুসলমানদের উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই। এখানে ইতিবাচক কোনো কিছু খুঁজে বের করে আত্মতৃপ্তিতে ভোগাটা বাস্তবে হীনম্মন্যতারই আরেক রূপ। বরং তা কোনো কোনো দিক থেকে আরো ভয়াবহ।

সম্প্রতি কেউ কেউ কাতারের বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজনের কিছু কিছু দিক খুব ফলাও করে প্রচার করছেন; বলা হচ্ছে, বিশ্বকাপ ফুটবলকে ইসলাম প্রচারের কাজে লাগাচ্ছে কাতার। রাস্তার পার্শ্বে বিভিন্ন জায়গায় হাদীস শরীফের পবিত্র বাণী দৃষ্টিনন্দন করে উপস্থাপনার মধ্যে ইতিবাচক ব্যাপার তো অবশ্যই আছে; কিন্তু এটা কোন্ উপলক্ষ্যে করা হচ্ছে  সেই প্রশ্নটা তো থেকেই যাচ্ছে। একই কথা স্টেডিয়ামে বিশ্ববিখ্যাত কারী ও মুসলিম স্কলারদের উপস্থিতির ক্ষেত্রেও। এই প্রশ্ন তো খুবই সহজ যে, কাতার কি আসলে অমুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার করছে, না একটি মুসলিম জনপদে পশ্চিমা ভোগবাদী ও অনৈতিক জীবন-ব্যবস্থার প্রচার করছে। স্টেডিয়ামে দু-চারজন কারী সাহেবের উপস্থিতির বার্তা ও আহ্বান বেশি শক্তিশালী, নাকি নানা দেশের তারকাখেলোয়ারদের গার্লফ্রেন্ড ও অসংখ্য মডেলদের খোলামেলা উপস্থিতির বার্তাটা বেশি শক্তিশালী? প্রচার ও দাওয়াতের প্রসঙ্গ যদি আসে, তাহলে এখানে ভোগবাদী জীবনের প্রচারটাই তো মুখ্য। গোটা আয়োজনটাই তো এই বিষয়ের। এর পাশে যদি ইসলামের কিছু থাকে সেটা নিতান্তই ছিটেফোঁটা মাত্র।

এখানে আরো গভীরের একটা ব্যাপার আছে। সেটা হচ্ছে, ইসলামের স্বরূপ আসলে কী? ইসলাম কি পার্থিব বিভিন্ন মতবাদের মতোই একটি মতবাদ, না তা ভেতরে-বাইরে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ তাআলার সামনে আত্মসমর্পণ? বর্তমান সময়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও দার্শনিক মতবাদের অনেক কিছুই শুধু বাহ্যিক প্রচারসর্বস্ব, যার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পার্থিব প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ইসলামের বিধি-বিধান তো এমন নয়। এখানে পার্থিব প্রতিষ্ঠা মুখ্য নয়। এখানে ভেতরে-বাইরে আল্লাহ তাআলার সামনে পূর্ণ সমর্পিত হওয়া কাম্য। আপাদমস্তক প্রবৃত্তিপরায়ণতার মধ্যে ডুবে থেকে মুখে মুখে দু-চারটা ভালো কথা বা বাহ্যত এক-দুটো ধর্মীয় কাজের দ্বারা অন্তত ইসলামের ধার্মিকতাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এ বিষয়ে সতর্কতা কাম্য।

নিঃসন্দেহে ইসলাম কাঠিন্য আরোপ করে না। ইসলামের বিধানে মানুষের পক্ষে অসম্ভব বা অতিকঠিন কিছুই নেই। কিন্তু বিধান তো আছে। বিধান পালনের স্বাভাবিক যে ত্যাগ ও পরিশ্রম তা-ও ইসলামে নেই- এমন তো নয়। কাজেই ইসলামকে সহজ করে উপস্থাপনের অর্থ এই নয় যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মানুষের প্রবৃত্তিপরায়ণতাকেও সমর্থন দিয়ে যেতে হবে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কাতারের মতো একটি মুসলিম দেশে যখন বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসে তখন ইসলামের দু-চারটি ভালো কথা এখানে সেখানে সেঁটে দেয়ার দ্বারা কি ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব হয়ে যায়?

গোটা বিষয়টাই যেখানে ইসলামের শিক্ষা-সংস্কৃতি পরিপন্থী সেখানে দু-চারটা দেয়াল লিখন দ্বারা ইসলামী সংস্কৃতির প্রচার হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা নিতান্তই শিশু-সুলভ সারল্য নয় কি? এজন্য যারা ঐ দু-চারটি ইতিবাচক বিষয় নিয়ে বলছেন তাদের কর্তব্য, অন্তত দুটো বিষয় প্রথমে পরিষ্কারভাবে ও বড় আকারে আলোচনা করা :

এক. বর্তমান সময়ের বিশ্বকাপ ফুটবল  ও এজাতীয় অন্যান্য আয়োজনের স্বরূপ এবং এর আর্থিক, নৈতিক ও আদর্শিক ক্ষতিকরতার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করা।

দুই. মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ঈমান-আকীদা, চিন্তা-চেতনা, নীতি ও আদর্শের সাথে এসবের অসঙ্গতিপূর্ণ হওয়ার দিকগুলো সবিস্তারে তুলে ধরা।

এই দুটো বিষয় পরিষ্কার হওয়ার পর দু-চারটে ইতিবাচক বিষয়, যা ভোগবাদের এই প্রবল জোয়ারের মধ্যে খরকুটোর মতো এখানে ওখানে দৃশ্যমান, তার আলোচনা যথার্থ আন্দাজে করতে বাধা নেই। অন্যথায় মুসলিম জনগণের কাছে ইসলাম সম্পর্কে একটি ভুল বার্তাই যেতে পারে।

বর্তমানে তো পশ্চিমা চিন্তা-ভাবনা, জীবন-দর্শন ও জীবন ধারার নানা কিছুতে ইসলামের লেবেল লাগানোর প্রবণতা খুব ব্যাপকভাবেই দেখা যায়। এটা যে কত ভয়াবহ ব্যাপার, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইসলামের প্রাজ্ঞ দায়ীদের জন্য যেমন এটা বড় রকমের সংকট তৈরি করে, তেমনি সাধারণ মুসলমানদের জন্যও ইসলামকে সঠিকভাবে বোঝা ও ইসলামের সঠিক আদর্শের উপর নিজেকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে অনেক বড় পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দেয়। প্রবৃত্তির সব ইচ্ছা পূরণ করেও যদি ধার্মিক হওয়া যায়, তাহলে কেন শুধু শুধু নিজেকে বঞ্চিত করা। এটা যে সাধারণ মুসলমানের জন্য কত বড় পরীক্ষা- তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন।

এজন্য আমরা যারা ছিটেফোঁটা কিছু দাওয়াতী কাজের সদিচ্ছা রাখি তাদের অবশ্যই সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে এবং সবকিছুকে স্বস্থানে রাখতে হবে। অতি উৎসাহী ও ত্বরা-প্রবণতা পরিহার করে আমাদের হক্কানী রব্বানী উলামা-মাশায়েখের কুরআন-সুন্নাহভিত্তিক আদর্শ ও আহ্বানকে অনুসরণ করে চলতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন। হ

 

 

advertisement