রবিউল আখির ১৪৪৪   ||   নভেম্বর ২০২২

প্রশ্নোত্তর

[আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের সর্বশেষ শিরোনাম প্রশ্নোত্তর এর অধীনে প্রত্যেক সংখ্যায় ইনশাআল্লাহ তিন থেকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে। সংক্ষেপের জন্য প্রশ্নকারীর নাম-পরিচয় অনুল্লেখ থাকবে।]

 

প্রশ্ন ৪৪ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তো কাফের মুশরিকদের অনেকেই কষ্ট দিয়েছে, তাদের সবার মধ্য থেকে শুধু আবু লাহাবের প্রতি অভিসম্পাত করেই কেন সূরা নাযিল হল? 

উত্তর : নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওত লাভের কিছুদিন পর সাফা পাহাড়ে উঠে নিজ বংশের লোকজনকে ডাকেন এবং ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করেন। তখন আবু লাহাব বলে উঠল-

تَبًّا لَكَ، أَلِهذَا جَمَعْتَنَا؟

ধ্বংস হও! এজন্যই কি আমাদেরকে ডেকেছ?

তার এ কথার প্রতিউত্তরে সূরা লাহাব নাযিল হয়। এর প্রথম আয়াতে আবু লাহাবকে অভিশাপ দিয়ে বলা হয়েছে, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নয়, বরং আবু লাহাবের দুই হাতই ধ্বংস হোক।

আরবী বাগধারায় হাত ধ্বংস হওয়া দ্বারা ব্যক্তির ধ্বংসই বোঝানো হয়। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৮০১; তাফসীরে তবারী ২৪/৭১৫-৭১৬; যাদুল মাসীর ৯/২৫৮-২৫৯)

 

প্রশ্ন ৪৫ : আমি শুনেছিলাম, মানুষের ভালো-মন্দ কাজ যে ফিরিশতাগণ লেখেন, তাদের নাম কিরামান কাতিবীন। কথাটি কি ঠিক?

উত্তর : কিরামান কাতিবীন (كِرَامًا كَاتِبِیْنَ) শব্দদুটির অর্থ সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ। মানুষের ভালো-মন্দ কাজের হিসাব যে ফিরিশতাগণ রাখেন তাদের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য কুরআন কারীমে এক জায়গায় এভাবে বর্ণিত হয়েছে-

وَ اِنَّ عَلَیْكُمْ لَحٰفِظِیْنَ كِرَامًا كَاتِبِیْنَ   یَعْلَمُوْنَ مَا تَفْعَلُوْنَ .

অর্থাৎ, তোমাদের জন্য কিছু তত্ত্বাবধায়ক (ফিরিশতা) নিযুক্ত আছে, সম্মানিত লিপিকরবৃন্দ, যারা জানে তোমরা যা কর। -সূরা ইনফিতার (৮২) : ১০-১২

কিরামান কাতিবীন সে ফিরিশতাগণের নাম নয়। কুরআন-হাদীসে তাঁদের নাম বর্ণিত হয়নি। (তাফসীরে কাবীর ১১/৭৮; আলহিদায়া ইলা বুলূগিন নিহায়া, সূরা ইনফিতার; তাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৭৫৮)

 

প্রশ্ন ৪৬ : হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে যখন মিসরে গোলাম হিসেবে বিক্রি করা হয়েছিল, তখন তাঁকে কে কিনেছিল?

উত্তর : হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামকে মিসরের যে ব্যক্তি কিনেছিলেন, তার নাম কিতফীর কিংবা ইতফীর। তিনি ছিলেন তখন মিসরের রাষ্ট্রীয় কোষাগারের প্রধান বা অর্থমন্ত্রী। তার উপাধি ছিল আযীয। (তাফসীরে কাবীর ৬/৪৩৫; তাফসীরে কুরতুবী ৫/১৫৮-১৫৯; আলবিদায়া ওয়াননিহায়া ১/২৯২)

 

প্রশ্ন ৪৭ : আমি শরহে বেকায়া জামাতের ছাত্র। কয়েক মাস আগে আলকাউসার পত্রিকার আনওয়ারুল কুরআন বিভাগের প্রশ্নোত্তর পর্বে মুফরাদাতুল কুরআন বিষয়ে কিছু কিতাবের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় জেনেছি। আমি সেগুলোর মধ্য থেকে মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির  لغات القرأن  কিতাবটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাচ্ছি।

উত্তর : মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির লুগাতুল কুরআন (لغات القرأن) কিতাবটি সর্বপ্রথম দিল্লির নদওয়াতুল মুসান্নিফীন-এর পক্ষ থেকে কয়েক পর্বে ছাপা হয়। পরবর্তীতে এটি আবার দারুল ইশাআত করাচি থেকে ১৯৮৬ সনে ছয় খ-ে তিন ভলিউমে প্রকাশিত হয়। এর প্রথম চার খ- তথা আইন (ع) হরফের শেষ পর্যন্ত মাওলানা আবদুর রশীদ নুমানী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন আর শেষ দুই খ- তথা গইন (غ) হরফ থেকে শেষ পর্যন্ত মাওলানা সায়্যেদ আবদুদ দা-ইম আল-জালালী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি লিখেছেন। এ কিতাবে কুরআন কারীমের শব্দগুলো আরবী হরফের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী বিন্যস্ত। প্রতিটি হরফের নামে অধ্যায়ের শিরোনাম। তারপর সেই অধ্যায়ের অধীনে আবার প্রতিটি হরফের নামে আলাদা আলাদা (فصل) পরিচ্ছেদ। এ কিতাবের কিছু বৈশিষ্ট্য হল-

ক. এ কিতাবে লেখক কুরআনের শব্দাবলির অনুবাদ ও বিশদ ব্যাখ্যা করেছেন।

খ. যে শব্দ একাধিক জায়গায় এসেছে, তা কোন্ জায়গায় কোন্ অর্থে এসেছে, সেটা উল্লেখ করেছেন এবং সে শব্দটি কোথায় কোথায় আছে তাও বিশেষভাবে চিহ্নিত করে দিয়েছেন।

গ. কোনো শব্দে মুফাসসিরগণ বা আহলে লুগাতের মধ্যে একাধিক ব্যাখ্যা বা মতপার্থক্য থাকলে সে সবই উল্লেখ করেছেন এবং সিদ্ধান্তমূলক রায়ও দিয়েছেন।

ঘ. শব্দগুলোর কেবল আভিধানিক অর্থই করেননি, বরং কুরআন মাজীদ যা বোঝাতে চেয়েছে এবং আহলে হক আলেমগণ যে অর্থ বুঝেছেন, সেই অর্থই করেছেন। সেইসঙ্গে কুরআন বোঝার জন্য প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় বহু ফায়েদাও লিখেছেন।

ঙ. যে শব্দের ব্যাখ্যায় হাদীস বা আসার রয়েছে, তা উল্লেখ করেছেন।

চ. কুরআনে আম্বিয়ায়ে কেরাম ও অন্যান্য যে মহান ব্যক্তিগণের নাম এসেছে তাদের ঘটনাবলি বিশুদ্ধ বর্ণনায় যতটুকু রয়েছে তা উল্লেখ করেছেন। বিভিন্ন আয়াতে প্রসঙ্গক্রমে যে কাফের মুশরিকদের নাম এসেছে, তাদের পরিচয়ও দিয়েছেন। কুরআনে উল্লেখিত স্থানগুলোরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন।

ছ. সকল ক্ষেত্রে কেবল সহীহ সনদের বর্ণনাই উল্লেখ করেছেন। জাল ও ইসরাঈলী বর্ণনা কেবল উপেক্ষাই করেননি, বরং কখনো কখনো সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ জাল বর্ণনাগুলো চিহ্নিতও করে দিয়েছেন।

এছাড়াও এ কিতাবের আরও অনেক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যার কিছু লেখক নিজেই ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। তবে কোনো কোনো শব্দে এত বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়নি।

 

প্রশ্ন ৪৮ : সূরা আলে ইমরানের ৫৯ আয়াতে আছে-

اِنَّ مَثَلَ عِیْسٰی عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ اٰدَمَ.

(অর্থাৎ আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত আদমের মত।) এ দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা জানতে চাচ্ছি। 

উত্তর : এ আয়াতে হযরত ঈসা আলাহিস সালামের দৃষ্টান্ত হযরত আদম আলাইহিস সালামের মতো বলার কারণ হল, আদম আলাইহিস সালামের মতো ঈসা আলাইহিস সালামকেও আল্লাহ তাআলা জগতের সাধারণ নিয়ম বহির্ভূতভাবে পিতা ছাড়াই সৃষ্টি করেছেন। কুরআন মাজীদের এস্থলে এ কথা বলার কারণ হল, নাজরানের কিছু খ্রিস্টান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছিল, আপনি ঈসা আলাইহিস সালামকে মানুষ বলেন, অথচ তার তো কোনো মানবপিতা ছিল না। তার যেহেতু কোনো পিতা নেই, কাজেই স্বয়ং আল্লাহ তাআলাই তার পিতা এবং তিনি আল্লাহর পুত্র। এ আয়াতে তাদের সেই কথার জবাব দেওয়া হয়েছে যে, হযরত আদম আলাইহিস সালামেরও তো পিতামাতা কিছুই ছিল না। পিতা ছাড়া হওয়াতে যদি হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলার পুত্র বলতে হয়, তবে আদম আলাইহিস সালামকে তো আরও আগে আল্লাহর পুত্র বলা উচিত। কিন্তু তাকে তো তোমরাও আল্লাহর পুত্র বল না। সুতরাং কেবল পিতাবিহীন হওয়ায় হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকেও আল্লাহর পুত্র বলা যায় না। এদিক থেকে তারা দুজন আল্লাহ তাআলার কাছে একই রকম এবং উভয়েই তাঁর বান্দা। (তাফসীরে তবারী ৫/৪৫৯-৪৬২; তাফসীরে কুরতুবী ৪/১০২-১০৩)

 

 

advertisement