রবিউল আউয়াল ১৪৪৪   ||   অক্টোবর ২০২২

নারীর চেহারা পর্দার গুরুত্বপূর্ণ অংশ
একটি দালীলিক বিশ্লেষণ

মাওলানা ইমদাদুল হক

দ্বীন ও শরীয়তের অনেক বিষয় এমন যে, সেগুলো উম্মতের মধ্যে সালাফ থেকে সমাধানকৃত ও প্রতিষ্ঠিত এবং সাহাবা তাবেয়ীনের যুগ থেকে প্রজন্ম  পরম্পরায় অনুসৃত। দ্বীনের দাঈর জন্য আবশ্যক, এ ধরনের সুপ্রতিষ্ঠিত ও অনুসৃত বিষয়ে মানুষের মাঝে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি না করা। বরং সেগুলোকে আপন স্থানে রেখে এবং সামনে এগিয়ে দিয়ে মানুষের মাঝে অন্য যেসব ঈমানী-আমলী ও চারিত্রিক অধঃপতন ও স্খলন দেখা যায় সেগুলোর সংশোধনে সর্বাত্মক মেহনত করা। অন্যথায় সে যদি এসব বিষয় বাদ দিয়ে সাহাবা তাবেয়ীন থেকে প্রতিষ্ঠিত ও সমাধানকৃত বিষয়ে সংশয়-সন্দেহ সৃষ্টি করে এবং সেগুলোকে নড়বড়ে করার বিফল চেষ্টায় নিজেকে লিপ্ত করে তাহলে সেটা দ্বীনের খেদমত তো হবেই না; বরং দ্বীনের বিরাট ক্ষতিসাধনের চেষ্টা হবে। আর দ্বীন তো আল্লাহ্ই কিয়ামত পর্যন্ত হেফাযত করবেন; তাই এতে দ্বীনের কিছুই হবে না, উল্টো নিজের আখেরাত বরবাদ হবে।

ইদানীং দেখা যাচ্ছে, যেসব বিষয় সাহাবা তাবেয়ীন থেকেই প্রতিষ্ঠিত ও সিদ্ধান্তকৃত, কিছু লোক সেসব বিষয়ে প্রশ্ন তোলা, সন্দেহ সৃষ্টি করা এবং সেগুলোকে নড়বড়ে করার হীন চেষ্টাকেই এসময়ের দ্বীনের খেদমত মনে করছে। যেমন, মহিলারা মসজিদে জামাতে শরীক না হওয়া, তারাবীহ বিশ রাকাত, জুমার প্রথম আযান, জুমার খুতবা আরবীতে হওয়া ইত্যাদি। অথচ এসব মাসআলা সাহাবা তাবেয়ীন থেকেই সমাধানকৃত ও সিদ্ধান্তকৃত এবং পুরো মুসলিম বিশ্বে প্রজন্ম পরম্পরায় অনুসৃত হয়ে আসছে। কিছু লোক এসব প্রতিষ্ঠিত বিষয়ে সংশয় সৃষ্টি করাকে দ্বীনের মহান খেদমত মনে করছে।

এগুলো যদি ভুলই হতো তাহলে এ উম্মতের শ্রেষ্ঠ দুই প্রজন্ম সাহাবা তাবেয়ীনের মাঝে এসব ভুল প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল কীভাবে? এভাবে গোড়া থেকে চিন্তা করলে একজন সাধারণ বিবেকবান মানুষও সহজে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে যে, এ ধরনের কর্মকা- দ্বীনের খেদমত বা সেবা নয়; বরং দ্বীনের গোড়া নড়বড়ে করার অপচেষ্টা। দ্বীনের দাওয়াত নয়; বরং বাতিলের প্রসার।

এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় হল, পরপুরুষের সামনে মুসলিম নারীর চেহারা ঢেকে রাখা। এটাও উম্মতের মাঝে এমন প্রতিষ্ঠিত মাসআলা।

নবীজীর যুগ থেকে শুরু করে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন যুগ হয়ে এ পর্যন্ত এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত ও অনুসৃত যে, নারীরা পরপুরুষের সামনে চেহারা খুলবে না, ঢেকে রাখবে। নবীজীর সকল বিবি এ আমলের উপরই ছিলেন। এভাবেই সাহাবা তাবেয়ীন থেকে নিয়ে অদ্যাবধি দ্বীনদার নারীদের আমল চলে আসছে।

ইদানীং দেখা যাচ্ছে, এই সুপ্রতিষ্ঠিত মাসআলার ক্ষেত্রেও কেউ কেউ গোটা উম্মত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সংশয় সৃষ্টি করার বিফল চেষ্টা করছে। এবং বলছে, পরপুরুষের সামনে মুসলিম নারীর চেহারা খোলা জায়েয। এটার জন্য  বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক দলীল ও খোঁড়া যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। বিষয়টির নাযুকতা অনুভব করে অধম এ বিষয়ে কিছু পড়াশোনায় মগ্ন হয়। পর্দার দলীল আর এসব বিচ্ছিন্ন মতাবলম্বীদের হাকীকত তালাশে কিছুটা চেষ্টা করে। এ চেষ্টারই ফলাফল এ প্রবন্ধ। প্রবন্ধের প্রথমভাগে আমরা কিছু আয়াত উল্লেখ করেছি, যেগুলো দ্বারা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়, পরপুরুষের সামনে নারীর চেহারা ঢাকা কুরআনের বিধান।

এরপর বেশ কিছু হাদীস উদ্ধৃত করেছি, যেগুলো থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, নবীর যুগে মুমিন নারীগণ পরপুরুষ থেকে চেহারা ঢেকে রাখার ব্যাপারে কত কঠোর ছিলেন। এটি এ প্রবন্ধের অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়।

এরপর যারা চেহারা খোলা রাখা জায়েয বলে তাদের দলীলগুলো নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি।

এর পরের আলোচনা হল, অনেকে  মনে করে, হানাফী মাযহাবে  নারীদের চেহারা খোলা রাখা জায়েয বলা হয়েছে, অথচ তা সঠিক নয়। এ বিষয়ে কিছু পর্যালোচনা পেশ করেছি।

এর পর যুগে যুগে পর্দার কিছু দৃষ্টান্ত ও নমুনা উল্লেখ করেছি।

এরপর কয়েকজন আলেমের বক্তব্যের পর্যালোচনা, যেগুলো দ্বারা তারা প্রমাণ দিয়ে থাকে।

এভাবে প্রবন্ধটি সমাপ্ত হবে। আল্লাহ তাআলা এ ক্ষুদ্র মেহনত কবুল করুন। উম্মতকে হেফাযত করুন। আমাদেরকে তাঁর দ্বীনের খাদেম হিসেবে কবুল করে নিন।

চেহারা ঢাকার আয়াত

ইসলামের শুরু যুগে পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়নি। তার পরও সম্ভ্রান্ত নারীগণ তাদের সাজ সৌন্দর্য আবৃত করেই বের হতেন। কিন্তু এ বিষয়ে তখনো কোনো বিধান অবতীর্ণ হয়নি। একপর্যায়ে পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়। এরপর থেকেই নবী পত্নীগণসহ মুসলিম নারীগণ বের হলে চেহারা ঢেকে, আবৃত হয়েই বের হতেন। এরপর এ বিধানই মুসলিম নারী সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। নিম্নে এ প্রসঙ্গে আয়াত তুলে ধরছি।                                    

আয়াত : ১

আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে নবী-পত্নীগণের বিষয়ে আদেশ করেন-

وَ اِذَا سَاَلْتُمُوْهُنَّ مَتَاعًا فَسْـَٔلُوْهُنَّ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ ؕ ذٰلِكُمْ اَطْهَرُ لِقُلُوْبِكُمْ وَ قُلُوْبِهِنَّ

যখন তোমরা তাদের (নবী-পত্নীগণের) কাছে কোনো জিনিস চাইবে, তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। এটি তোমাদের ও তাদের অন্তরের জন্য অধিকতর পবিত্রতা দানকারী। -সূরা আহযাব (৩৩) : ৫৩

প্রখ্যাত মুফাসসির যাজ্জাজ রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-

إذا أردتم أن تخاطبوا أزواج النبي  صلى الله عليه وسلم في أمر فخاطبوهن من وراء حجاب، فنزل الأمر بالاستتار.

যখন কোনো প্রয়োজনে তোমরা নবী-পত্নীগণের সাথে কথা বলতে চাও তখন পর্দার আড়াল থেকে কথা বলবে। এ আয়াত দ্বারা পর্দার বিধান অবতীর্ণ হয়।  -মাআনিল কুরআন, যাজ্জাজ ৪/২৩৫

এ আয়াতে সুস্পষ্টভাবে আদেশ করা হয়েছে, নবী-পত্নীগণের সাথে কথা বলতে হলে পর্দার আড়াল থেকে কথা বলতে হবে। আয়াতটি যদিও নবী-পত্নীগণের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে, তবে বিধানটি অন্য নারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আল্লামা জাসসাস রাহ. বলেন-

وهذا الحكم وإن نزل خاصا في النبي صلى الله عليه وسلم وأزواجه فالمعنى عام فيه وفي غيره، إذ كنا مأمورين باتباعه والاقتداء به إلا ما خصه الله به دون أمته.

এ বিধানটি যদিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বিবিগণের বিষয়ে অবতীর্ণ হয়েছে, তবে বিধানটি সবার ক্ষেত্রে সমান। কেননা আমরা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আনুগত্য ও অনুসরণে আদিষ্ট। তবে যা তাঁর জন্য খাছ সেটি ভিন্ন বিষয়। -আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/৭১

ইমাম তবারী এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-

يقول: وإذا سألتم أزواج رسول الله صلى الله عليه وسلم ونساء المؤمنين اللواتي لسن لكم بأزواج متاعا (فاسألوهن من وراء حجاب) يقول: من وراء ستر بينكم وبينهن.

আল্লাহ তাআলা বলেন, যখন তোমরা নবী-পত্নীগণ এবং তোমাদের স্ত্রী নয় এমন নারীদের থেকে কিছু চাইবে তখন পর্দার আড়াল থেকে চাইবে। (তোমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে আড়াল থাকবে) সরাসরি তাদের কাছে প্রবেশ করবে না। -তাফসীরে তবারী ১৯/ ১৬৬

ইমাম ইযযুদ্দীন ইবনে আবদুস সালাম রাহ. বলেন-

أُمرن وسائر النساء بالحجاب.

এ আয়াত দ্বারা নবী-পত্নীগণ ও সকল নারীকে পর্দার আদেশ দেয়া হয়েছে। -তাফসীরে ইবনে আব্দুস সালাম ৫/৫৭

বিশিষ্ট মুফাসসির আল্লামা ওয়াহেদী রাহ. বলেন-

وكانت النساء قبل نزول هذه الآية يبرزن للرجال، فلما نزلت هذه الآية ضرب عليهن الحجاب، فكانت هذه آية الحجاب بينهن وبين الرجال.

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পূর্বে নারীরা পুরুষের সম্মুখে আসত। যখন এ আয়াত নাযিল হয়, তখন নারীদের উপর পর্দার বিধান আরোপ করে দেয়া হয়। তাই এ আয়াতকে নারী-পুরুষের মাঝে পর্দা বিধানকারী আয়াত বলে। -আলওয়াজীয ফী তাফসীরিল কিতাবিল আযীয, ওয়াহীদী ৭/২২২

আয়াত : ২

আল্লাহ তাআলা বলেন-

یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ

হে নবী, আপনি আপনার স্ত্রী, মেয়ে ও মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যেন তাদের জিলবাব (বড় চাদর)-এর কিছু অংশ তাদের উপর ঝুলিয়ে দেয়। -সূরা আহযাব  (৩৩) : ৫৯

লক্ষ করি, আয়াতে বলা হয়েছে নারীরা যেন তাদের বড় চাদরের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়। অর্থাৎ তারা বের হওয়ার সময় জিলবাব তো পরবেই, এরপর এই পরিহিত জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেবে।

দেখুন, আল্লাহ তাআলা এভাবে বলেননি যে, তারা যেন বের হওয়ার সময় জিলবাব পরে; বরং বলেছেন, তারা যেন তাদের পরিহিত জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেয়।

এখন প্রশ্ন হল, জিলবাব তো তারা পরেছেই; এর পরও বলা হচ্ছে, সেটার কিছু অংশ নিজেদের উপর ঝুলিয়ে দেবে। এর অর্থ কী?

এ কথাটি চিন্তা করলেই এ আয়াতের অর্থ বোঝার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাবে।

এর অর্থ হল, নারীরা জিলবাব তো পরবেই; সাথে সাথে জিলবাবের কিছু অংশ তাদের চেহারার উপর ঝুলিয়ে দেবে। যদি এ আয়াতে তাদেরকে চেহারা ঢাকা ছাড়া শুধু জিলবাব পরার আদেশ দেয়া হতো তাহলে শুধু এভাবে বলা হতো, তারা যেন জিলবাব পরে। কেননা চেহারা ঢাকা ছাড়া জিলবাব পরলে সেটাকে শুধু জিলবাব পরাই বলা হয়। তখন আয়াতে এভাবে বলা হতো না যে, তারা যেন নিজেদের উপর তাদের জিলবাবের কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেয়

আরেকটি বিষয় হল, আয়াতের শুরুতে আল্লাহ তাআলা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এভাবে বলেন, (তরজমা) হে নবী, আপনি বলে দিন আপনার পত্নীগণকে, আপনার কন্যাদেরকে ও মুমিনদের নারীদেরকে, তারা যেন নিজেদের উপর তাদের জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেয়। তাহলে বোঝা যায়, এ বিধানটি নবীপত্নীগণসহ সকল মুমিন নারীর জন্য সমান বিধান।

অনেক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, নবী-পত্নীগণ যখন কোনো প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হতেন তখন তাঁরা চেহারার উপর জিলবাব ঝুলিয়ে দিয়ে চেহারা ঢেকে বের হতেন। অতএব বোঝা গেল, আয়াতে যে বলা হয়েছে- তারা তাদের উপর জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেবে- এর অর্থ হল, তাঁরা তাঁদের চেহারা ঢাকবেন।

এ তো গেল, আয়াতের সরাসরি আরবী পাঠ ও তার অর্থ থেকে কী বোঝা যায় তা নিয়ে আলোচনা। এবার আসি তাফসীরবিদগণ এ আয়াতের অর্থ কী বুঝেছেন সে আলোচনায়।

ইবনে আব্বাস রা.-এর তাফসীর

সাহাবায়ে কেরামের মাঝে যারা কুরআন সম্পর্কে বেশি জ্ঞানী ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.। তাঁর জন্য নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষভাবে দুআ করেছেন, আল্লাহ তাআলা যেন তাকে কুরআনের তাফসীরের জ্ঞান দান করেন।

ইবনে আব্বাস রা. এ আয়াতের ব্যখ্যায় বলেন-

أمر الله نساء المؤمنين إذا خرجن من بيوتهن في حاجة أن يغطين وجوههن من فوق رؤوسهن بالجلابيب ويبدين عينا واحدة.

আল্লাহ মুমিনদের নারীদেরকে আদেশ দিয়েছেন, তারা যখন ঘর থেকে বের হবে তখন তারা পুরো চেহারা ঢেকে বের হবে। তবে শুধু এক চোখ খোলা রাখবে। -তাফসীরে তবারী ২০/৩২৪

ইবনে আব্বাসের কথাটি যে সনদে বর্ণিত, সে সনদটি সহীহ। ইমাম বুখারী রাহ. এটিকে সহীহ বলেছেন। এ সনদের মাধ্যমে তিনি ইবনে আব্বাসের অনেক তাফসীর তাঁর সহীহ বুখারীতে উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও সকল আহলে ইলম এ সনদটিকে সহীহ বলেন এবং এ সনদের মাধ্যমে তাঁরা ইবনে আব্বাসের কুরআনের ব্যাখ্যাগুলো গ্রহণ করেন এবং বর্ণনা করেন।

নারীরা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় জিলবাব দিয়ে চেহারা ঢেকে বের হবে- এটা ইবনে আব্বাস থেকে অন্য সনদেও বর্ণিত হয়েছে। ইহরামের সময় নারীদের বিধান হল, তারা চেহারার সাথে কাপড় লেপ্টে বা মিশিয়ে দিয়ে চেহারা ঢাকবে না; যেমনটা তারা অন্য সময়ে নেকাব পরার সময় করে থাকে; বরং ইহরামের সময় তারা চেহারা থেকে দূরত্ব রেখে মাথার উপর থেকে কাপড় ঝুলিয়ে দিয়ে পুরুষ থেকে চেহারা আড়াল করবে। এক্ষেত্রে ইবনে আব্বাসের ছাত্র প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আতা ইবনে আবী রাবাহ রাহ. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

قال تدلي عليها من جلبابها ولا تضرب به، قلت وما لا تضرب به؟ فأشار إلي كما تجلبب المرأة، ثم أشار إلى ما على خدها من الجلباب، فقال : لا تغطيه فتضرب به على وجهها فذلك الذي يبقى عليها، ولكن تسدله على وجهها كما هو مسدولا، ولا تقلبه ولا تضرب به ولا تعطفه.

ইহরামের সময় মহিলারা তাদের  চেহারার উপর জিলবাব ঝুলিয়ে দেবে, তবে তা চেহারার সাথে লেপ্টে দেবে না। আতা বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, লেপ্টে দেবে না- এর অর্থ কী?

জবাবে ইবনে আব্বাস বলেন, যেভাবে মহিলারা অন্য সময় জিলবাব পরে থাকে। অতঃপর তিনি মহিলাদের গালের উপর যে জিলবাব থাকে, তার দিকে ইশারা করে বলেন, এভাবে গালের সাথে মিশিয়ে দিয়ে ইহরামের সময় জিলবাব পরবে না; বরং জিলবাব মাথার উপর থেকে নিচের দিকে ছেড়ে দেবে। তা মুখের সাথে লেপ্টেও দেবে না, মুখের সাথে মুড়িয়েও দেবে না। -কিতাবুল উম্ম, ইমাম শাফেয়ী ২/ ১৬২

এ বর্ণনাটিও সহীহ। অতএব ইবনে আব্বাসের এ বক্তব্যে পরিষ্কারভাবে এসেছে, মহিলারা ইহরাম ছাড়া অন্য সময় জিলবাব পরে চেহারা ঢেকে রাখে।

ইবনে আব্বাস থেকে একাধিক সহীহ সূত্রে বর্ণনা পাওয়ার পর সন্দেহের আর কোনো অবকাশ থাকে না। তাহলে ইবনে আব্বাসের এ বক্তব্য থেকেও এটা বোঝা যায় যে, আয়াতে যে বলা হয়েছে- তারা যেন তাদের উপর জিলবাব-এর কিছু অংশ টেনে দেয়, এর অর্থ হল, চেহারা ঢাকা। সাথে সাথে এটাও বোঝা যায় যে, সে যুগে মুমিন নারীগণ ঘর থেকে বের হলে চেহারা ঢেকেই বের হতেন এবং এটাই সে যুগের রীতি ও বিধান ছিল। দেখুন, তিনি বলেছেন-

كما تجلبب المرأة.

(যেমন নারীরা জিলবাব পরে থাকে।) তাহলে বুঝা যায়, ঘরের বাইরে বের হলে চেহারা ঢেকে বের হওয়াটাই সাহাবা যুগের নারীদের রীতি ছিল।

আবীদা আসসালমানী রাহ.-এর তাফসীর

সাহাবীদের পর কুরআন-হাদীস তথা শরীয়ত সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি জ্ঞানী হলেন তাবেয়ীগণ। তাবেয়ীগণের মধ্যে যেসব তাবেয়ী ইলম, আমল প্রজ্ঞায় উচ্চস্তরে ছিলেন, তাদের একজন হলেন আবীদা আসসালমানী রাহ.। মৃত্যু ৭২ হিজরী। তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের মাত্র দুই বছর পূর্বে মুসলমান হন, কিন্তু তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখেননি। পরবর্তীতে আবীদা আলী রা. ও ইবনে মাসউদ রা.-এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁদের সেরা ছাত্রে পরিণত হন। ইলমে আমলে তাবেয়ী সরদারদের মধ্যে পরিগণিত হন।

উমর ফারুক রা.-এর খেলাফতকালে মুসলিম ইতিহাসের এক প্রসিদ্ধ বিচারক ছিলেন কাযী শুরাইহ। তার ইলম, প্রজ্ঞা ও বিচারিক জ্ঞান প্রবাদতুল্য। তিনি কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তে না পৌঁছতে পারলে আবীদার শরণাপন্ন হতেন।

সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কত বড় ফকীহ সকলেরই জানা। তাঁর অগণিত ছাত্র ছিল। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে সেরা কে- এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকে আবীদার কথা বলেন।

যাই হোক, আবীদা রাহ. তাবেয়ীন যুগের এক নক্ষত্র। ইসলামী ইতিহাসে সাহাবীদের পরে এক বিরাট ব্যক্তিত্ব। তিনিও ইবনে আব্বাসের মতোই আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা করেন। 

বিখ্যাত তাবেয়ী মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন রাহ. বলেন, আমি আবীদা আসসালমানীকে এ আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। (অর্থাৎ, নারীরা কীভাবে তাদের উপর জিলবাব ঝুলিয়ে দেবে?) তিনি তখন তার মাথা ও চেহারা ঢেকে শুধু বাম চোখ খোলা রেখে আমাকে তা দেখিয়ে দেন। আরবী পাঠ এই-

عن ابن سيرين قال: سألت عبيدة عن قوله (قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ) قال: فقال بثوبه، فغطى رأسه ووجهه، وأبرز ثوبه عن إحدى عينيه.

-তাফসীরে তবারী ২০/৩২৫

পূর্বে গিয়েছে, আবীদা রাহ. হযরত আলী রা. ও ইবনে মাসউদ রা.-এর বিশিষ্ট ছাত্র। তাহলে বোঝা যায়, তিনি এ ব্যাখ্যা তাঁদের থেকেই শিখেছেন। অতএব বলা যায়, এটি আলী রা. ও ইবনে মাসউদ রা.-এরও ব্যাখ্যা।

ইবনে সীরীন রাহ.-এর তাফসীর

তাবেয়ীদের মধ্যে আরেক বড় তাবেয়ী হলেন মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন। যাকে বসরা নগরীর শ্রেষ্ঠ তাবেয়ী বলা হয়। তিনিও এ আয়াতের ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন-

تُغَطّي إحدى عينيهَا وجبهتَها والشِّقّ الآخر، إلاّ العين.

নারীরা  বের হওয়ার সময় এক চোখ ছাড়া পুরো চেহারা ঢেকে নেবে। -মাআনিল কুরআন, র্ফারা, খ. ২, পৃ. ৩৪৯

ইকরিমা রাহ.-এর তাফসীর

সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের কুরআনের জ্ঞান সম্পর্কে একটু পূর্বে আলোচনা হয়েছে। তার থেকে যেসব ছাত্র কুরআন ও হাদীসের জ্ঞান আহরণ করেছেন তাদের মাঝে অন্যতম হলেন তাবেয়ী ইকরিমা রাহ.। প্রখ্যাত তাবেয়ী মুহাদ্দিস ইমাম শাবী রাহ. বলেন-

ما بقي أحد أعلم بكتاب الله من عكرمة.

কুরআন সম্পর্কে ইকরিমা থেকে বেশি জ্ঞানী কেউ অবশিষ্ট নেই।

মুহাদ্দিস কাতাদাহ বলেন-

وأعلمهم بالتفسير عكرمة.

মানুষের মধ্যে তাফসীর সম্পর্কে বেশি জ্ঞানী হলেন ইকরিমা। -তাহযীবুল কামাল ৫/২১১

ইকরিমা রাহ. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-

تُدْني الْجِلْبَابَ حَتّى لَا يُرَى ثَغْرَةُ نَحْرِهَا.

জিলবাব এমনভাবে ঝুলিয়ে দেবে যে, তার গলার কোটর পর্যন্তও যেন দেখা না যায়। -তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ১০/৩১৫৫

অর্থাৎ, পুরো শরীর তো ঢাকবেই, সাথে সাথে মাথার উপর থেকে গলদেশ পর্যন্ত জিলবাব ঝুলিয়ে দিয়ে ঢেকে নেবে।  

হাফসা বিনতে সীরীন রাহ.-এর তাফসীর

তাবেয়ীগণের মধ্যে আরেক নক্ষত্র হলেন নারী তাবেয়ী হাফসা বিনতে সীরীন। মৃত্যু ১০০ হিজরীর পর। কাযী ইয়াস ইবনে মুআবিয়া মেধা ও প্রজ্ঞায় প্রবাদতুল্য আলেম। মুসলিম ইতিহাসে তার মেধার প্রখরতা নিয়ে প্রবাদ আছে। তিনি বলেন, আমি যত মানুষকে দেখেছি, হাফসার মতো কাউকে দেখিনি। লোকেরা বলল, তাবেয়ী সরদার হাসান বসরী ও ইবনে সীরীনও নয়? জবাবে ইয়াস বললেন, না, তারাও হাফসার মতো নন।

হাফসা বিনতে সীরীন এ আয়াতের এ অর্থই করেন। বিষয়টির বিবরণ হল, সূরা আহযাবের এ আয়াতে তো আদেশ দেয়া হয়েছে যে, মুমিন নারীগণ নিজেদের উপর তাদের জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেবে। এটা হল, যুবতী নারীদের ক্ষেত্রে আর সূরা নূরের ষাট নং আয়াতে বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে জিলবাব-এর কিছু অংশ না ঝুলানোর অবকাশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ الْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَآءِ الّٰتِیْ لَا یَرْجُوْنَ نِكَاحًا فَلَیْسَ عَلَیْهِنَّ جُنَاحٌ اَنْ یَّضَعْنَ ثِیَابَهُنَّ غَیْرَ مُتَبَرِّجٰتٍۭ بِزِیْنَةٍ ؕ وَ اَنْ یَّسْتَعْفِفْنَ خَیْرٌ لَّهُنَّ

বৃদ্ধা নারী, যারা বিবাহের কোনো আশা রাখে না, যদি তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের (বাড়তি) কাপড় খুলে রাখে তাদের জন্য দোষ নেই। তবে এ থেকে বিরত থাকাই তাদের জন্য উত্তম।

তো এখানে যে কাপড়টি না পরার অবকাশ দেয়া হয়েছে, সেটি হল চেহারার উপর জিলবাব। অর্থাৎ, বৃদ্ধা নারীরা চেহারার উপর জিলবাব না দেওয়ার অবকাশ আছে। তবে, জিলবাব দেয়াটা তাদের জন্য উত্তম।

হাফসা বিনতে সীরীন অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন। তার নিকট ছাত্র-ছাত্রীরা পড়তে আসত। যৌবনে মুখে নেকাব তো পরতেনই, বৃদ্ধা হয়ে যাওয়ার পরও পরপুরুষের সামনে নেকাব পরতেন।

তার বৃদ্ধ বয়সের ঘটনা। তার বিশেষ ছাত্র অনেক বড় মুহাদ্দিস আসিম আলআহওয়াল বলেন, আমরা (ছাত্ররা) হাফসার কাছে যেতাম। তখন তিনি জিলবাব দিয়ে নেকাব পরে থাকতেন। আমরা তাকে বলতাম, আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি রহম করুন, আল্লাহ তাআলা তো আপনাদের ক্ষেত্রে এভাবে জিলবাব না পরার অবকাশ দিয়েছেন। এ বলে আমরা সূরা নূরের ষাট নং আয়াতটির শুরু অংশ অর্থাৎ-

وَ الْقَوَاعِدُ مِنَ النِّسَآءِ الّٰتِیْ لَا یَرْجُوْنَ نِكَاحًا فَلَیْسَ عَلَیْهِنَّ جُنَاحٌ اَنْ یَّضَعْنَ ثِیَابَهُنَّ غَیْرَ مُتَبَرِّجٰتٍۭ بِزِیْنَةٍ

পর্যন্ত পড়লাম। তিনি বলেন, এরপরে কী আছে? অর্থাৎ আয়াতের পরের অংশ পড়ো। আয়াতের পরের অংশে আছে-

وَ اَنْ یَّسْتَعْفِفْنَ خَیْرٌ لَّهُنَّ

অর্থাৎ তবে তাদের জন্যও জিলবাব পরা ভালো।

আমরা তা পড়লাম। তিনি বললেন, এটাই। আর এটাই হল হিজাবের প্রমাণ।

হাফসা বিনতে সীরীন বৃদ্ধা। বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে না দেয়ার যে অবকাশ দেয়া হয়েছে, তিনি তা গ্রহণ করেননি; বরং তিনি জিলবাব ঝুলিয়ে দেয়া যে উত্তম তাই গ্রহণ করেছেন এবং চেহারার উপর তা নেকাবের মতো করে ঝুলিয়ে দিয়েছেন। তাহলে বোঝা যায়, সূরা আহযাবে যে জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে, তা হল এভাবে নেকাবের মতো করে ঝুলিয়ে দেয়া।

হাফসার শেষ কথাটি লক্ষ করুন-

هو إثبات الجلباب.

এটাই জিলবাবের প্রমাণ। -সুনানে কুবরা, বায়হাকী ৭/৯৩

তাহলে বোঝা গেল, জিলবাব এভাবেই পরে।

এ ঘটনা থেকে আরো যেটা বোঝা যায় তা হল, সে যুগে মুসলিম নারীরা এভাবেই জিলবাব পরত।

সাঈদ ইবনে যুবায়ের রাহ.-এর তাফসীর

সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের অন্যতম আরেক ছাত্র তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে জুবায়ের। ইলম, আমল, প্রজ্ঞায় তিনি যুগশ্রেষ্ঠ তাবেয়ী ছিলেন। তিনি-

یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ

-এর ব্যাখ্যায় বলেন- 

يُسْدِلْنَ عَلَيْهِنّ مِنْ جَلابِيبِهِنّ وَهُوَ الْقِنَاعُ فَوْقَ الْخِمَارِ وَلا يَحِلّ لِمُسْلِمَةٍ أَنْ يَرَاهَا غَرِيبٌ إِلا أَنْ يَكُونَ عَلَيْهَا الْقِنَاعَ فَوْقَ الْخِمَارِ، وَقَدْ شَدّتْ بِهِ رَأْسَهَا وَنَحْرَهَا.

তারা নিজেদের উপর জিলবাবের কিছু অংশ ওড়নার উপর থেকে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দেবে। কোনো নারীর জন্য এটা বৈধ নয় যে, এভাবে ওড়নার উপর থেকে কাপড় ঝুলিয়ে দেয়া ছাড়া পরপুরুষ তাকে দেখবে। কাপড়টি দিয়ে সে তার মাথা ও গলা ভালোভাবে বেঁধে নেবে। -তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ১৩/ ১০৪

লক্ষ করি, তিনি বলেছেন, ওড়নার উপর থেকে চাদর ঝুলিয়ে দেবে। এরপর মাথা ও গলা বেঁধে নেবে। অর্থাৎ, চাদরটি মাথার উপর থেকে ঝুলিয়ে গলা পর্যন্ত আসবে। আর এতেই তো পুরো চেহারা ঢাকা হয়ে গেল।

সূরা আহযাব ও সূরা নূরের আয়াতদ্বয়ের মধ্যকার সম্পর্ক

সূরা আহযাবের আয়াত-

یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ

এর সাথে সূরা নূরের ষাট নং আয়াত সংযুক্ত। কেননা সূরা আহযাবের উক্ত আয়াতে নারীদের উপর জিলবাবের কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেয়ার আদেশ দেয়া হয়েছে আর সূরা নূরের ষাট নং আয়াতে বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে এ বিষয়ে ছাড় দেয়া হয়েছে। তাই উভয় আয়াত পরিষ্কার এবং একটি অপরটির সাথে সংযুক্ত। সে হিসেবে সূরা নূরের ষাট নং আয়াতের ব্যাখ্যা দেখলেও সূরা আহযাবের জিলবাব ঝুলিয়ে দেয়ার অর্থ কী- তা আরো ভালোভাবে বোঝা যাবে।

সূরা নূরের ৬০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা

সূরা নূরের ষাট নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, যে বৃদ্ধা নারীদের বিবাহের কোনো আশা নেই, তাদের জন্য এতে কোনো গোনাহ নেই যে, তারা নিজেদের (বাড়তি) কাপড় খুলে রাখবে; সৌন্দর্য প্রদর্শন ব্যতিরেকে। তারা সাবধানতা অবলম্বন করলে সেটাই তাদের পক্ষে শ্রেয়।

এ আয়াতে বলা হয়েছে, কাপড় খুলে রাখবে। কিন্তু এটা কোন্ কাপড়? এর ব্যাখ্যায় সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

وَهِيَ الْمَرْأَةُ، لَا جُنَاحَ عَلَيْهَا أَنْ تَجْلِسَ فِي بَيْتِهَا بِدِرْعٍ وَخِمَارٍ وَتَضَعَ عَنْهَا الْجِلْبَابَ مَا لَمْ تَتَبَرّجْ لِمَا يَكْرَهُ اللهُ.

বৃদ্ধা নারীর জন্য এতে গোনাহ নেই যে, সে তার ঘরে (গায়রে মাহরামদের সামনে) ওড়না ও জামা পরে থাকবে এবং জিলবাব রেখে দেবে সৌন্দর্য প্রকাশ ব্যতিরেকে। -তাফসীরে তবারী ১৭/৩৬০

অর্থাৎ বৃদ্ধারা জিলবাব রেখে দিয়ে ওড়না ও জামা পরে পরপুরুষের সামনে যেতে পারবে।

ওড়না পরার ক্ষেত্রে মুমিন নারীদের আদেশ দেয়া হয়েছে, সে যেন তা দিয়ে   মাথার সাথে সাথে বুকও ঢাকে। যেমন, সূরা নূরের ৩১ নং আয়াতে বলা হয়েছে। তো বৃদ্ধারা যদি ওড়না দিয়ে মাথা ও বুক ঢাকে আর জামা দিয়ে পুরো শরীর ঢাকে তাহলে বাকি থাকে শুধু চেহারা। আর তা ঢাকা হত জিলবাব দিয়ে; যা বৃদ্ধাদেরকে রেখে দেয়ার অবকাশ দেয়া হয়েছে। তবে যুবতীদের ক্ষেত্রে সেই অবকাশ নেই। অর্থাৎ তারা ওড়না দিয়ে মাথা ও বুক ঢাকল এবং জামা দিয়ে পুরো শরীর ঢাকল, কিন্তু চেহারা খুলে রাখল- এই অবস্থায় তারা পরপুরুষের সামনে যেতে পারবে না। তাদেরকে জিলবাব দিয়ে চেহারা ঢেকেই যেতে হবে। জিলবাব দিয়ে যদি চেহারা না ঢাকা হত তাহলে ওড়না আর জামা পরে যুবতীরাও তো পরপুরুষের সামনে যেতে পারত। তাহলে যুবতীদের জন্য জিলবাব আবশ্যক করার কী অর্থ রইল আর বৃদ্ধাদের জিলবাব রেখে দেয়াতে তাদের জন্য বিশেষ কী ছাড় থাকল?

বৃদ্ধাদের হুকুম সম্বলিত এ আয়াতের ব্যাখ্যায় জাসসাস রাহ. লেখেন-

وَفِي ذَلِكَ دَلِيلٌ عَلَى أَنّهُ إنّمَا أَبَاحَ لِلْعَجُوزِ وَضْعَ رِدَائِهَا بَيْنَ يَدَيْ الرِّجَالِ بَعْدَ أَنْ تَكُونَ مُغَطّاةَ الرّأْسِ، وَأَبَاحَ لَهَا بِذَلِكَ كَشْفَ وَجْهِهَا وَيَدِهَا؛ لِأَنّهَا لَا تُشْتَهَى.

এতে একথার প্রমাণ রয়েছে যে, বৃদ্ধাদের জন্য যে জিলবাব বা বড় চাদর রেখে দেয়ার অনুমতি আছে, তা মাথার চুল খোলা রেখে নয়, বরং তা ঢেকে। বৃদ্ধাদের জন্য তাদের চেহারা ও হাত খোলার বৈধতা আছে। কেননা তাদের প্রতি কামভাব তৈরি হয় না।  -আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৫/১৯৬

তো জাসসাসের কথায় স্পষ্ট এসেছে, বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে ছাড় হল শুধু চেহারার ক্ষেত্রে। তাহলে বোঝা গেল, যুবতীদের ক্ষেত্রে চেহারা খোলা রাখার বিষয়ে কোনো ছাড় নেই।

অতএব এ থেকেও প্রমাণিত হয়-

یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ

 (তারা তাদের উপর জিলবাবের কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেবে)- এর অর্থ হল, চেহারা ঢাকা।

নবীজী সাল্লাল্লাহু অলাইহি ওয়াসাল্লামের অন্যতম প্রিয় সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-ও এমন তাফসীর করেন। তিনি বৃদ্ধাদের হুকুম সংক্রান্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন-

يَضَعْنَ الْجِلْبَابَ وَلَا يَضَعْنَ الْخِمَارَ.

বৃদ্ধারা জিলবাব খুলে রাখতে পারবে। খিমার তথা ওড়না নয়। -তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ১০/৩০৫

অর্থাৎ মাথা ও বুকসহ পুরো শরীর খুলতে পারবে না। তবে চেহারা খুলতে পারবে, যা যুবতীরা পারবে না।

প্রখ্যাত মুফাসসির আবু সালেহ বলেন-

ليس عليهن جناح أن يضعن ثيابهن قال : تضع الجلباب وتقوم بين يدي الرجل في الدرع والخمار.

বৃদ্ধারা জিলবাব খুলে রাখতে পারবে, আর পরপুরুষের সামনে ওড়না ও জামা পরে যেতে পারবে। -তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ৯/১৩৮

প্রখ্যাত তাবেয়ী সায়ীদ ইবনে জুবায়ের রাহ.-ও একই কথা বলেছেন-

وهو الجلباب من فوق الخمار، فلا بأس أن يضعن عند غريب أو غيره بعد أن يكون عليها خمار صفيف.

বৃদ্ধাদের জন্য জিলবাব রেখে দিয়ে পরপুরুষের সামনে যেতে কোনো অসুবিধা নেই, যদি তার গায়ে ওড়না থাকে। অর্থৎ মাথা ও পুরো শরীর যদি ঢাকা থাকে। -তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ৯/১৩৮

প্রথম শতাব্দীর প্রখ্যাত মুফাসসির তাবেয়ী যাহহাক রাহ. বলেন-

وَهَذَا لِلْكَبِيرَةِ الّتِي قَدْ قَعَدَتْ عَنِ الْوَلَدِ، فَلَا يَضُرّهَا أَنْ لَا تجَلْببَ فَوْقَ الْخِمَارِ. وَأَمّا كُلّ امْرَأَةٍ مسْلمَةٍ حُرّةٍ، فَعَلَيْهَا إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ أَنْ تُدْنِيَ الْجِلْبَابَ عَلَى الْخِمَارِ. وَقَالَ اللهُ فِي سُورَةِ الْأَحْزَابِ: یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ ذٰلِكَ اَدْنٰۤی اَنْ یُّعْرَفْنَ فَلَا یُؤْذَیْنَ .

যেসব নারীদের সন্তান জন্মদানের বয়স শেষ হয়ে গেছে (অর্থাৎ বৃদ্ধা) তাদের জন্য ওড়নার উপর জিলবাব না পরায় অসুবিধা নেই। তবে প্রত্যেক মুসলিম আযাদ (যুবতী) নারীর ক্ষেত্রে বিধান হল, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তাদের জন্য আবশ্যক হল ওড়নার উপর থেকে জিলবাব ঝুলিয়ে দেয়া। আল্লাহ তাআলা সূরা আহযাবে বলেন, তারা নিজেদের উপর জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেবে।... -তাফসীরে তবারী ১৭/ ৩৬০

সূরা নূরের ষাট নং আয়াত অর্থাৎ বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে জিলবাব রেখে দেয়ার অবকাশের আয়াতের ব্যাখ্যা সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., ইবনে মাসউদ রা. এবং তাবেয়ী যাহহাক রাহ.-সহ যে কয়জনের বক্তব্য উপরে উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলো থেকেও স্পষ্ট হয়, সূরা আহযাবে যে বলা হয়েছে-

یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ

(তারা নিজেদের উপর তাদের জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেবে)- এর অর্থ হল, চেহারা ঢেকে জিলবাব পরিধান করা।

উল্লেখ্য, বৃদ্ধাদের ক্ষেত্রে কাপড় রেখে দেয়ার যে অবকাশ দেয়া হয়েছে, সে কাপড় যে জিলবাব, একথা আরো অনেক সাহাবী-তাবেয়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে।

যাইহোক, এ পর্যন্ত অনেক সাহাবী, তাবেয়ীন-এর বক্তব্য পেশ করা হল। সেগুলো দ্বারা প্রমাণিত হয়, সূরা নূরের ৫৯ নং আয়াতে যে বলা হয়েছে-

یُدْنِیْنَ عَلَیْهِنَّ مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ

 (তারা নিজেদের উপর তাদের জিলবাব-এর কিছু অংশ ঝুলিয়ে দেবে)- এর অর্থ হল চেহারা ঢেকে রাখা।

পরবর্তী মুফাসসিরগণের তাফসীর

এবার দেখি, এ বিষয়ে পরবর্তী মুফাসসিরগণ কী বলেন? তাদের বক্তব্যসমূহ থেকে কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হচ্ছে।

এক. এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে জারীর তবারী রাহ. বলেন-

يقول تعالى ذكره لنبيه محمد صلى الله عليه وسلم:ياٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ قُلْ لِّاَزْوَاجِكَ وَ بَنٰتِكَ وَ نِسَآءِ الْمُؤْمِنِیْنَ: لا يتشبهن بالإماء في لباسهن إذا هن خرجن من بيوتهن لحاجتهن، فكشفن شعورهن ووجوههن. ولكن ليدنين عليهن من جلابيبهن.

আল্লাহ তাআলা তার নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেনহে নবী, আপনি আপনার স্ত্রী, মেয়ে ও মুমিন নারীদের বলে দিন, তারা যখন তাদের প্রয়োজনে বের হবে, তখন যেন তাদের পোশাক পরিচ্ছদে বাদীদের সাদৃশ্য না হয় যে, তারা তাদের চুল ও চেহারা খোলা রাখবে; বরং তারা তাদের উপর বড় চাদর ঝুলিয়ে দেবে এবং চুল ও চেহারা ঢেকে নেবে। -তাফসীরে তবারী ২০/৩২৪

দুই. ইমাম আবু জাফর নাহহাস বলেন-

يرخين على وجوههن منه.

অর্থাৎ, তারা তাদের জিলবাবের কিছু অংশ নিজেদের  চেহারায় ঝুলিয়ে দেবে।

-রাবুল কুরআন ৩/৩২৫

তিন. প্রখ্যাত মুফাসসির আল্লামা যামাখশারী রাহ. বলেন-

ومعنى يُدْنِينَ عَلَيْهِنّ مِنْ جَلَابِيبِهِنّ يرخينها عليهنّ، ويغطين بها وجوههنّ وأعطافهنّ.

يقال: إذا زل الثوب عن وجه المرأة: أدني ثوبك على وجهك.

আয়াতের অর্থ হল, তারা নিজেদের উপর জিলবাব ঝুলিয়ে দেবে এবং চেহারা ঢেকে নেবে। -তাফসীরে কাশশাফ ৩/৫৬০

চার. আবু হাইয়ান রাহ. বলেন-

و"مِن" في: مِنْ جَلَابِیْبِهِنَّ للتبعيض، "عَلَیْهِنَّ" : شامل لجميع أجسادهن، أو "عَلَیْهِنَّ" : على وجوههن، لأن الذي كان يبدو منهن في الجاهلية هو الوجه.

অর্থাৎ জিলবাব ঝুলিয়ে দেয়া মানে, পুরো শরীর ঢেকে নেয়া। অথবা উদ্দেশ্য হল, চেহারা ঢাকা। কেননা, জাহেলী যুগে নারীদের চেহারাই খোলা থাকত। -আলবাহরুল মুহীত ৭/২৫০

পাঁচ. আল্লামা বায়যাবী রাহ. বলেন-

يغطين وجوههن وأبدانهن بملاحفهن إذا برزن لحاجة.

প্রয়োজনে ঘর থেকে বের হলে তারা তাদের চাদর দিয়ে নিজেদের চেহারা ও শরীর ঢেকে নেবে। -তাফসীরে বায়যাযী ৪/৩৮৬

ছয়. সামারকান্দী রাহ. বলেন-

يرخين الجلابيب على وجوههن.

এর অর্থ হল, তারা তাদের চেহারার উপর জিলবাব ঝুলিয়ে দেবে। -বাহরুল উলূম ৩/৬৯

সাত. আবুস সাউদ রাহ. বলেন-

يغطين بها وجوههن وأبدانهن إذا برزن لداعية من الدواعي.

কোনো প্রয়োজনে তারা ঘর থেকে বের হলে তাদের চেহারার উপর জিলবাব ঝুলিয়ে দেবে এবং তা দ্বারা তাদের চেহারা ও শরীর ঢেকে নেবে। -তাফসীরু আবিস সাঊদ ৭/ ১১৫

আট. সালাবী রাহ. বলেন-

أي يرخين أرديتهن وملاحفهن فيتقنّعن بها، ويغطّين وجوههن ورؤوسهن ليُعلم أنّهنّ حرائر فلا يُتعرّض لهنّ ولا يؤذين.

তারা তাদের চাদর বা ওড়না দিয়ে ঘোমটা পরে নেবে এবং মাথা ও চেহারা ঢেকে নেবে...। -আলকাশফু ওয়াল বায়ান ৮/৬৪

আপাতত এ কয়জন মুফাসসির-এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেই এ প্রসঙ্গ সমাপ্ত করছি। আশা করি এতটুকুই যথেষ্ট হবে। অন্যথায় আরো অনেক মুফাসসির-এর এধরনের বক্তব্য উল্লেখ করা যাবে। সেগুলো উল্লেখ করে প্রসঙ্গ দীর্ঘায়িত করার প্রয়োজন মনে করছি না। 

মোটকথা, সাহাবা, তাবেয়ীন ও পরবর্তী মুফাসসিরগণের বক্তব্য দ্বারা প্রমাণিত হল, কুরআনের আয়াতে জিলবাব ঝুলিয়ে দেয়ার অর্থ চেহারা ঢেকে রাখা।

বাস্তবতা হল, আয়াতটি চেহারা ঢাকার বিষয়ে একদম স্পষ্ট। উপরন্তু আমরা এর তাফসীরও পেয়ে গেলাম সাহাবা, তাবেয়ীন ও মুফাসসিরগণের বর্ণনায়।

 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement