রবিউল আউয়াল ১৪৪৪   ||   অক্টোবর ২০২২

কুরআনের ভাষায়
হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াত

মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালাম। খলীলুল্লাহ, আল্লাহর বন্ধু। তিনি ছিলেন আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাসী এবং একনিষ্ঠ মুসলিম। ইরশাদ হয়েছে-

مَا كَانَ اِبْرٰهِیْمُ یَهُوْدِیًّا وَّ لَا نَصْرَانِیًّا وَّ لٰكِنْ كَانَ حَنِیْفًا مُّسْلِمًا ؕ وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ

ইবরাহীম ইহুদীও ছিল না এবং খ্রিস্টানও নয়; বরং সে তো একনিষ্ঠ মুসলিম ছিল। সে কখনও শিরককারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ৬৭

আল্লাহ তাআলার কাছে তিনি দুআও করেছিলেন যেন তাঁরই আনুগত্যে নতশীর ও সমর্পিত হতে পারেন। বলেছিলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে আপনার একান্ত অনুগত বানিয়ে নিন। [সূরা বাকারা (২) : ১২৮]

অন্যত্র আরও ইরশাদ হয়েছে-

اِذْ قَالَ لَهٗ رَبُّهٗۤ اَسْلِمْ ۙ قَالَ اَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعٰلَمِیْنَ۝۱۳۱ وَ وَصّٰی بِهَاۤ اِبْرٰهٖمُ بَنِیْهِ وَ یَعْقُوْبُ ؕ یٰبَنِیَّ اِنَّ اللّٰهَ اصْطَفٰی لَكُمُ الدِّیْنَ فَلَا تَمُوْتُنَّ اِلَّا وَ اَنْتُمْ مُّسْلِمُوْنَ

যখন তাঁর প্রতিপালক তাঁকে বললেন, আনুগত্যে নতশির হও, তখন সে (সঙ্গে সঙ্গে) বলল, আমি রাব্বুল আলামীনের (প্রতিটি হুকুমের) সামনে মাথা নত করলাম। ইবরাহীম তাঁর সন্তানদেরকে এ কথারই অসিয়ত করল এবং ইয়াকুবও (তাঁর সন্তানদেরকে) যে, হে আমার পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য এ দ্বীন মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমাদের মৃত্যু যেন এ অবস্থায়ই আসে, যখন তোমরা মুসলিম থাকবে। -সূরা বাকারা (২) : ১৩১-১৩২

উল্লেখ্য, পূর্ববর্তী নবী-রাসূলগণ এবং তাঁদের উম্মতসমূহের মধ্যে যারা আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান এনেছিলেন, তারা সকলেই মুসলিম ছিলেন। মুসলিম অর্থ আত্মসমর্পণকারী। কিন্তু কোনো সম্প্রদায়ের নাম মুসলিম ছিল না। আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে কেবল এই উম্মতের নামই মুসলিম রেখেছেন।

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় মূর্তিপূজা করত। তিনি নবুওত লাভ করার আগেই বুঝতেন, এগুলো কিছুতেই উপাস্য হতে পারে না। যারা নিজেরাই সৃষ্ট, তারা কীভাবে স্রষ্টা হতে পারে! সম্প্রদায়ের লোকেরা নিশ্চয়ই বিভ্রান্তিতে পড়ে আছে। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَقَدْ اٰتَیْنَاۤ اِبْرٰهِیْمَ رُشْدَهٗ مِنْ قَبْلُ وَ كُنَّا بِهٖ عٰلِمِیْنَۚ۝۵۱ اِذْ قَالَ لِاَبِیْهِ وَ قَوْمِهٖ مَا هٰذِهِ التَّمَاثِیْلُ الَّتِیْۤ اَنْتُمْ لَهَا عٰكِفُوْنَ۝۵۲ قَالُوْا وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا لَهَا عٰبِدِیْنَ۝۵۳ قَالَ لَقَدْ كُنْتُمْ اَنْتُمْ وَ اٰبَآؤُكُمْ فِیْ ضَلٰلٍ مُّبِیْنٍ۝۵۴ قَالُوْۤا اَجِئْتَنَا بِالْحَقِّ اَمْ اَنْتَ مِنَ اللّٰعِبِیْنَ۝۵۵ قَالَ بَلْ رَّبُّكُمْ رَبُّ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ الَّذِیْ فَطَرَهُنَّ ۖؗ وَ اَنَا عَلٰی ذٰلِكُمْ مِّنَ الشّٰهِدِیْنَ

এর আগে আমি ইবরাহীমকে দিয়েছিলাম তার (উপযুক্ত) বুদ্ধিমত্তা। আমি তার সম্পর্কে পরিপূর্ণ অবগত ছিলাম। সেই সময়কে স্মরণ কর, যখন সে নিজ পিতা ও নিজ সম্প্রদায়কে বলেছিল, এই মূর্তিগুলি কী, যার সামনে তোমরা ধরনা দিয়ে বসে থাকো? তারা বলল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এদের পূজা করতে দেখেছি। ইবরাহীম বলল, প্রকৃতপক্ষে তোমরা নিজেরা এবং তোমাদের বাপ-দাদাগণ স্পষ্ট বিভ্রান্তিতে লিপ্ত রয়েছে। তারা বলল, তুমি কি আমাদের কাছে সত্য নিয়ে এসেছ, না আমাদের সাথে পরিহাস করছ? ইবরাহীম বলল, না, তোমাদের প্রতিপালক তো তিনিই, যিনি আকাশম-লী ও পৃথিবীর মালিক, যিনি এদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং আমি এ বিষয়ে সাক্ষ্য দান করছি। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৫১-৫৬

তারপর আল্লাহ তাআলা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে নবুওত দান করলেন। নিজ সম্প্রদায়কে ঈমানের দিকে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। তিনি উম্মতকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে ডাক দিলেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اِبْرٰهِیْمَ اِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ اعْبُدُوا اللّٰهَ وَ اتَّقُوْهُ ؕ ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ

আমি ইবরাহীমকে পাঠালাম, যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলেছিল, আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁকে ভয় কর। এটাই তোমাদের পক্ষে শ্রেয়, যদি তোমরা জ্ঞান রাখ। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ১৬

নবুওত লাভ করে তিনি আল্লাহ তাআলার দ্বীন প্রচারে লেগে গেলেন। নিজ সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা এসব কীসের উপাসনা করছ? তোমরাই তো এগুলো বানিয়েছ। এরা নিজেদেরই কোনো উপকার করতে পারে না। তোমাদের উপকার করবে কীভাবে? বরং তিনিই তোমাদের রব, যিনি তোমাদেরকেসহ এই আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন। তোমরা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে পড়ে আছ। কুরআন কারীমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে তাঁর কওমের কথোপকথন বিশদভাবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

اِذْ قَالَ لِاَبِیْهِ وَ قَوْمِهٖ مَا تَعْبُدُوْنَ۝۷۰ قَالُوْا نَعْبُدُ اَصْنَامًا فَنَظَلُّ لَهَا عٰكِفِیْنَ۝۷۱ قَالَ هَلْ یَسْمَعُوْنَكُمْ اِذْ تَدْعُوْنَۙ۝۷۲ اَوْ یَنْفَعُوْنَكُمْ اَوْ یَضُرُّوْنَ۝۷۳ قَالُوْا بَلْ وَجَدْنَاۤ اٰبَآءَنَا كَذٰلِكَ یَفْعَلُوْنَ۝۷۴ قَالَ اَفَرَءَیْتُمْ مَّا كُنْتُمْ تَعْبُدُوْنَۙ۝۷۵ اَنْتُمْ وَ اٰبَآؤُكُمُ الْاَقْدَمُوْنَؗۖ۝۷۶ فَاِنَّهُمْ عَدُوٌّ لِّیْۤ اِلَّا رَبَّ الْعٰلَمِیْنَۙ۝۷۷ الَّذِیْ خَلَقَنِیْ فَهُوَ یَهْدِیْنِۙ۝۷۸ وَ الَّذِیْ هُوَ یُطْعِمُنِیْ وَ یَسْقِیْنِۙ۝۷۹ وَ اِذَا مَرِضْتُ فَهُوَ یَشْفِیْنِ۪ۙ۝۸۰ وَ الَّذِیْ یُمِیْتُنِیْ ثُمَّ یُحْیِیْنِۙ۝۸۱ وَ الَّذِیْۤ اَطْمَعُ اَنْ یَّغْفِرَ لِیْ خَطِیْٓـَٔتِیْ یَوْمَ الدِّیْنِ

যখন সে তার পিতা ও সম্প্রদায়কে বলল, তোমরা কীসের ইবাদত কর। তারা বলল, আমরা প্রতিমাদের ইবাদত করি এবং তাদেরই সামনে ধরনা দিয়ে থাকি। ইবরাহীম বলল, তোমরা যখন তাদেরকে ডাক, তখন তারা কি তোমাদের কথা শোনে? কিংবা তারা কি তোমাদের কোনো উপকার বা ক্ষতি করতে পারে? তারা বলল, আসল কথা হল, আমরা আমাদের বাপ-দাদাদেরকে এমনই করতে দেখেছি। ইবরাহীম বলল, তোমরা কি কখনও গভীরভাবে লক্ষ করে দেখছ, তোমরা কীসের ইবাদত করছ? তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদাগণ? এরা সব আমার শত্রু, এক রাব্বুল আলামীন ছাড়া। যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তারপর তিনিই আমার পথপ্রদর্শন করেন। আমাকে খাওয়ান ও পান করান। আমি যখন পীড়িত হই, তিনিই আমাকে সুস্থতা দান করেন। যিনি আমার মৃত্যু ঘটাবেন, পুনরায় আমাকে জীবিত করবেন। যার কাছে আমি আশা রাখি, হিসাব-নিকাশের দিন তিনি আমার অপরাধসমূহ ক্ষমা করবেন। -সূরা শুআরা (২৬) : ৭০-৮২

আরও ইরশাদ হয়েছে-

قَالَ اَفَتَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ مَا لَا یَنْفَعُكُمْ شَیْـًٔا وَّ لَا یَضُرُّكُمْؕ۝۶۶ اُفٍّ لَّكُمْ وَ لِمَا تَعْبُدُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللّٰهِ ؕ اَفَلَا تَعْقِلُوْنَ

সে বলল, তবে কি তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে এমন কিছুর উপাসনা করছ, যা তোমাদের কিছু উপকারও করতে পারে না এবং তোমাদের ক্ষতিও করতে পারে না? আফসোস তোমাদের প্রতি এবং আল্লাহকে ছেড়ে যাদের ইবাদত করছ তাদেরও প্রতি। তোমাদের কি এতটুকু বোধও নেই? -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৬৬-৬৭

কুরআন কারীমে আরও বেশ কয়েক জায়গায় হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সাথে তাঁর উম্মতের কী কথাবার্তা হয়েছিল, তা বর্ণিত হয়েছে।

ঈমানের দিকে দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এমন এক পন্থা অবলম্বন করলেন, যা বেশি প্রভাবক। তিনি তাদেরকে সহজ সাধারণ এবং সুস্পষ্ট ও বাস্তববাদী কিছু প্রশ্ন করে তাদের কাছেই এর জবাব চাইলেন। বললেন, তোমরা তাদেরকে ডাকলে তারা কি শুনতে পারে? তারা কি তোমাদের উপকার করতে পারে? কীভাবে করবে! তারা তো নিজেদেরই উপকার করতে পারে না।

মানুষ উপকার-অপকার ইত্যাদি বাস্তব অনুগ্রহ বেশি মনে রাখে। এ বিষয়টি তিনি দাওয়াতে তুলে ধরলেন। সেইসঙ্গে মূর্তিগুলোর প্রকৃত অবস্থা কী, সেগুলো কতটা অক্ষম এবং সেগুলোর অসারতা তুলে ধরলেন। এটা এমন এক পন্থা, যা মানুষের চিন্তা জগতে আলোড়ন তোলার পাশাপাশি অধিক কার্যকর ও ফলপ্রসূ।

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর পিতাকে ঈমানের দিকে দাওয়াত দিতে গিয়ে বললেন-

اِذْ قَالَ لِاَبِیْهِ یٰۤاَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا یَسْمَعُ وَ لَا یُبْصِرُ وَ لَا یُغْنِیْ عَنْكَ شَیْـًٔا۝۴۲ یٰۤاَبَتِ اِنِّیْ قَدْ جَآءَنِیْ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَمْ یَاْتِكَ فَاتَّبِعْنِیْۤ اَهْدِكَ صِرَاطًا سَوِیًّا۝۴۳ یٰۤاَبَتِ لَا تَعْبُدِ الشَّیْطٰنَ ؕ اِنَّ الشَّیْطٰنَ كَانَ لِلرَّحْمٰنِ عَصِیًّا۝۴۴ یٰۤاَبَتِ اِنِّیْۤ اَخَافُ اَنْ یَّمَسَّكَ عَذَابٌ مِّنَ الرَّحْمٰنِ فَتَكُوْنَ لِلشَّیْطٰنِ وَلِیًّا

স্মরণ কর, যখন সে নিজ পিতাকে বলেছিল, বাবা! আপনি এমন জিনিসের ইবাদত কেন করেন, যা কিছু শোনে না, দেখে না এবং আপনার কোনো কাজও করতে পারে না? বাবা! আমার নিকট এমন এক জ্ঞান এসেছে, যা আপনার কাছে আসেনি। কাজেই আপনি আমার কথা শুনুন, আমি আপনাকে সরল পথ বাতলে দেব। বাবা! শয়তানের ইবাদত করবেন না। নিশ্চয়ই শয়তান দয়াময়ের অবাধ্য। বাবা! আমার আশঙ্কা দয়াময়ের পক্ষ থেকে কোনো শাস্তি আপনাকে স্পর্শ করবে। ফলে আপনি শয়তানের সঙ্গী হয়ে যাবেন। -সূরা মারইয়াম (১৯) : ৪২-৪৫

মূর্তিপূজার অসারতা তুলে ধরার পর আরও বললেন, বাবা! আমি যা জানি, আপনি তা জানেন না। আমার কাছে সঠিক জ্ঞান এসেছে। আপনি আমার কথা শুনুন, আমি আপনাকে সরল সঠিক পথ দেখাব। হেদায়েত ও মুক্তির পথ দেখাব। কিন্তু পিতা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিল না। বরং বলল, ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে বিমুখ? তুমি যদি নিবৃত্ত না হও, তাহলে আমি তোমাকে পাথর নিক্ষেপ করব। আরও বলল, তুমি আমার থেকে দূরে চলে যাও। পিতা ঈমানের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করায় ইবরাহীম আলাইহিস সালাম রাগ করলেন না। বরং আরও দরদের সাথে বললেন, ঠিক আছে, আমি বিদায় নিচ্ছি। তবে আমি আপনাদের জন্য আমার রবের কাছে দুআ করব।

তাঁর সম্প্রদায়ের যারা তারকারাজি ও চাঁদ-সূর্যের উপাসনা করত, তিনি তাদেরকে এগুলোর উদয়াস্ত দেখিয়ে বললেন, যেগুলো নিজেরাই অন্যের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং এক নির্দিষ্ট সময় ও বলয়ে আবদ্ধ সেগুলো কীভাবে উপাস্য হতে পারে! তোমরা যা করছ তা শিরক। আমি তোমাদের শিরক থেকে মুক্ত। যিনি এই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন, আমি একনিষ্ঠভাবে তাঁরই অভিমুখী। 

ইবরাহীম আলাইহিস সালাম নিজ সম্প্রদায়কে আল্লাহ তাআলার দিকে দাওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি একথাও ঘোষণা করেছিলেন, আল্লাহকে ছাড়া তোমরা যাদের উপাসনা কর, আমি সেগুলোকে অস্বীকার করি। সেগুলোর সঙ্গে আমার শত্রুতা। আমি শুধু তাঁরই ইবাদত করব, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন এবং হেদায়েত দান করেছেন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরাও এক আল্লাহর ইবাদত না করবে, ততক্ষণ তোমাদের সঙ্গে আমার কোনো সখ্য নেই। কুরআনে এক জায়গায় বলা হয়েছে, ইবরাহীমের সঙ্গে সম্পর্কের তারাই বেশি হকদার, যারা ইবরাহীম এবং এই শেষ নবীর অনুসরণ করে ঈমান আনবে।

ইবরাহীম আলাইহিস সালামের কওম প্রথমে তার কথা অস্বীকার করে বলল, তুমি কি আমাদের কাছে সত্য নিয়ে এসেছ, না পরিহাস করছ? কিন্তু পরে তারা তাঁর কথার সত্যতা ও বাস্তবতা বুঝতে পেরে নির্বাক হতে বাধ্য হল।

একপর্যায়ে বাদশাহর কানেও ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতের কথা পৌঁছল। তখন বাদশাহর সাথে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যে কথা হয়েছিল, কুরআনে তা ইরশাদ হয়েছে এভাবে-

اَلَمْ تَرَ اِلَی الَّذِیْ حَآجَّ اِبْرٰهٖمَ فِیْ رَبِّهٖۤ اَنْ اٰتٰىهُ اللّٰهُ الْمُلْكَ ۘ اِذْ قَالَ اِبْرٰهٖمُ رَبِّیَ الَّذِیْ یُحْیٖ وَ یُمِیْتُ ۙ قَالَ اَنَا اُحْیٖ وَ اُمِیْتُ ؕ قَالَ اِبْرٰهٖمُ فَاِنَّ اللّٰهَ یَاْتِیْ بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَاْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِیْ كَفَرَ ؕ وَ اللّٰهُ لَا یَهْدِی الْقَوْمَ الظّٰلِمِیْنَۚ

তোমরা কি সেই ব্যক্তির অবস্থা চিন্তা করেছ, যাকে আল্লাহ রাজত্ব দান করার কারণে সে নিজ প্রতিপালকের (অস্তিত্ব) সম্পর্কে ইবরাহীমের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়? যখন ইবরাহীম বলল, আমার প্রতিপালক তিনিই, যিনি জীবনও দান করেন এবং মৃত্যুও!  তখন  সে  বলতে লাগল, আমিও জীবন দিই এবং মৃত্যু ঘটাই! ইবরাহীম বলল, আচ্ছা! তাহলে আল্লাহ তো সূর্যকে পূর্ব থেকে উদিত করেন, তুমি তা পশ্চিম থেকে উদিত কর তো! এ কথায় সে কাফির নিরুত্তর হয়ে গেল। আর আল্লাহ (এরূপ) জালিমদেরকে হেদায়েত করেন না। -সূরা বাকারা (২) : ২৫৮

বাদশাহ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে বলল, তুমি যে মাবুদের কথা বলছ, তার পক্ষে প্রমাণ পেশ কর। তিনি বললেন, আমার রব জীবন ও মৃত্যু দান করেন। বাদশাহ বলল, আমিও জীবন ও মৃত্যু দান করতে পারি। এই বলে সে দুজনকে ডেকে তাদের একজনকে হত্যা করল, আর অপরজনকে ছেড়ে দিল। যদিও বাদশাহর এ কাজ জীবন ও মৃত্যু দান নয়। ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তার অযৌক্তিক দাবি ও প্রমাণ খণ্ডন করে এখানেই তাকে লা-জবাব করে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এ নিয়ে কথা না বলে বরং এমন একটি বিষয় পেশ করলেন, যাতে সে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি বললেন, আমার রব পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত করেন, তুমি পশ্চিম দিক থেকে উদিত করে দেখাও। এবার বাদশাহ পুরোপুরি নিরুত্তর ও সম্পূর্ণ পরাজিত হয়ে গেল।  

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় যদিও তাঁর দাওয়াতের পদ্ধতির কাছে পরাস্ত ও নিরুত্তর হল, কিন্তু তারা ঈমান গ্রহণে ইচ্ছুক ছিল না। বরং নিজেদের ভ্রষ্টতায় অটল থেকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বিরূদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। নিজেদের এবং উপাস্যদের লজ্জা ও অন্তসারশূন্যতা ঢাকার জন্য ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে অগ্নিকুণ্ডকে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের জন্য ঠাণ্ডা ও শান্তিদায়ক বানিয়ে দিলেন। তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হয়েও নিরাপদে বের হয়ে এলেন।

এভাবেই কুরআনে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতের পদ্ধতি সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।

ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের পদ্ধতি এক অনন্য আদর্শ। একজন নিতান্ত সাধারণ মানুষও তাঁর দাওয়াত থেকে আসল সত্যতা অনায়াসেই বুঝতে পারবে।

তিনি সাধারণ কথাবার্তায় এমন বাস্তব ও পরিস্ফুট বিষয়গুলো উপস্থাপন করলেন, যা তাদের জন্য অধিক বোধগম্য এবং বেশি প্রভাবক।

যদিও তাঁর সম্প্রদায় ঈমান গ্রহণ করেনি, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কারণ তারা বাপ-দাদার মতবাদ ছেড়ে ঈমান গ্রহণ করতে ইচ্ছুকই ছিল না। এটা তাদের নেতিবাচক মানসিকতা এবং দুর্ভাগ্য। 

আল্লাহ ও রাসূলের প্রতি ঈমানের দাওয়াত দেওয়ার ক্ষেত্রে সবচে ফলপ্রসূ উপায় এটাই; এমন পন্থায় উপস্থাপন করা, যা অধিক বোধগম্য এবং বেশি প্রভাবক। দাঈদের জন্য ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতের পদ্ধতিতে এটি অন্যতম বড় শিক্ষা। 

আরেকটি বড় শিক্ষা হল, তিনি কখনো নিজ সম্প্রদায়ের উপর অভিসম্পাত করেননি। তাঁর সম্প্রদায় নিজেদের উপাস্যদের অক্ষমতা স্বীকার করেও ঈমান আনবে না বলে গোঁ ধরেছিল। উপরন্তু তাঁরা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়ার ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। তবুও তিনি তাদের বিরুদ্ধে কোনো বদদুআ করলেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনেও এ বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। আরবের কাফেররা তাঁকে যারপরনাই কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু একবারের জন্য তিনি তাদেরকে অভিশাপ দেননি।

হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতে আরেকটি শিক্ষা হল, তাঁর ধৈর্য। দীর্ঘ সময়ব্যাপী তিনি নিজ সম্প্রদায়কে এক আল্লাহর ইবাদতের দাওয়াত দিলেন, কিন্তু প্রায় সকলেই তাঁর দাওয়াত কবুল করল না। তবুও তিনি ধৈর্য ধরে দাওয়াত দিয়ে গেছেন। বিরক্ত হননি। দাওয়াত এমনই এক কাজ, যাতে প্রচ- ধৈর্য এবং আপন কাজে নিরন্তর অবিচলতা আবশ্যক। 

চতুর্থ আরেকটি বিষয় হল, হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ভাষা ও ব্যবহারের শালিনতা ও শিষ্টতা। পিতাকে দাওয়াত দেওয়ার সময় তাঁর উপস্থাপনা দেখুন। কী মধুর সম্ভাষণ! কতই না কল্যাণকামিতার প্রকাশ! ওদিকে তাঁর সম্প্রদায় নিজেদের কুফুরিতে অটল। উপরন্তু তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তবুও তাঁর কোনো কটূক্তি নেই। ক্ষোভ নেই। কেমন দরদমাখা ভাষায় তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন। দাঈদের এ এক অত্যাবশ্যকীয় গুণ।

এ ছাড়া ইবরাহীম আলাইহিস সালামের দাওয়াতে দাঈদের জন্য আরও অনেক শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তাআলা সবিস্তারে কুরআন কারীমে তাঁর দাওয়াতের কথা তুলে ধরেছেন। যার অনুসরণ আমাদের দাওয়াতকে আরও কার্যকর ও ফলপ্রসূ করবে। সেইসঙ্গে কুরআন কারীমে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের যেসব গুণাবলি বর্ণনা করা হয়েছে, তাও নিজেদের মধ্যে ধারণ করা জরুরি।

তিনি ছিলেন সর্বদা আল্লাহ অভিমুখী। কুরআন কারীমে তাঁর বহু দুআ বর্ণিত হয়েছে। তাঁর ছিল সবধরনের শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ অন্তর। স্বভাবে অতিশয় সহনশীল এবং অধিক আল্লাহভীত ছিলেন। দাঈদের মধ্যে এসকল গুণ থাকা অত্যন্ত জরুরি। 

সর্বোপরি সকল মুসলমানের জন্যই মুসলিম মিল্লাতের পিতা খলীলুল্লাহ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ব্যক্তিসত্তায় রয়েছে অনন্য আদর্শ। আল্লাহ তাআলার হুকুমের সম্মুখে তিনি থাকতেন সদা অনুগত ও সর্বোচ্চ সমর্পিত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে হযরত ইবরাহীম আলাআহিস সালাম তাঁর বংশধরের মধ্যে যেমন আত্মসমর্পিত এক উম্মত প্রেরণের দুআ করেছিলেন, তেমন উম্মত হওয়ার তাওফীক দান করুন।

 

 

advertisement