সফর ১৪৪৪   ||   সেপ্টেম্বর ২০২২

মাআরিফুল কুরআন
দুই বন্ধুর দুই অমর কীর্তি

মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী ইবনে মাওলানা ইয়াসীন রাহমাতুল্লাহি আলাইহিমা ১৩১৪ হিজরীতে (১৮৯৭ ঈ.) জন্মগ্রহণ করেন। জীবনের সুদীর্ঘকাল দারুল উলূম দেওবন্দেই কাটিয়েছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে মুরব্বিদের পরামর্শ ও নির্দেশনায় এবং সেখানকার দ্বীনী প্রয়োজনে পাকিস্তানে চলে যান। পরবর্তীতে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের মুফতীয়ে আযম।

পাকিস্তানে যাওয়ার পরে রেডিও পাকিস্তান’-এর পীড়াপীড়িতে ১৩৭৩ হিজরী (১৯৫৪ ঈ.) থেকে মাআরিফুল কুরআন নামে সাপ্তাহিক দরস দিতে শুরু করেন। রেডিওতে ধারাবাহিক সব আয়াতের তাফসীর করতেন না। বিষয়ভিত্তিক নির্বাচিত আয়াতের তাফসীর করতেন। এই দরস দেওয়ার কারণে রেডিও পাকিস্তানথেকে তিনি কোনো সম্মানী গ্রহণ করতেন না। সকলের অনুরোধে সেই দরসগুলো লিখিতভাবে প্রচারও করা হত।

এই দরস ১৩৮৪ হিজরী (১৯৬৪ ঈ.) পর্যন্ত প্রায় এগারো বছর চালু ছিল। এই এগারো বছরে তের পারা অর্থাৎ সূরা ইবরাহীমের শেষ পর্যন্ত তাফসীর হয়েছিল। তারপর এটি বন্ধ হয়ে যায়। তখন সবাই অনুরোধ করে, এতদিনে যতটুকু হয়েছে, সেগুলো এবং মাঝখান থেকে ছুটে যাওয়া আয়াতগুলো পূর্র্ণ করে গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করা হোক। মুফতী শফী রাহ. সেই কাজ শুরু করেন। কিন্তু কিছুদিন পরে নানান ব্যস্ততার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।

১৩৮৮ হিজরীতে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় বিছানায় শুয়ে শুয়ে পুনরায় তাফসীরের কাজ শুরু করেন। সুস্থ হওয়ার পরে কিছুদিন রাজনৈতিক ময়দানে ব্যস্ত ছিলেন। এ ব্যস্ততা শেষ হলে আবার তাফসীরের কাজ শুরু করেন। এভাবে চলতে চলতে ১৩৯০ হিজরীতে পূর্বের তের পারা এবং অতিরিক্ত আরও দুই পারার তাফসীর লেখা শেষ হয়। ১৩৯১ হিজরীর মধ্যে কুরআনের চতুর্থ মনযিল তথা ১৯ পারার সূরা ফুরকানের শেষ পর্যন্ত লেখা হয়। পঞ্চম ও ষষ্ঠ মনযিলের তাফসীর তিনি আগেই থানভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশে আহকামুল কুরআন নামে লিখেছিলেন।

থানভী রাহ. শেষ বয়সে আহকামুল কুরআনের ওপর কিতাব লিখতে চেয়েছিলেন। তখন দ্রুত কাজ হওয়ার জন্য তিনি কয়েকজনকে এ দায়িত্ব ভাগ করে দেন। মুফতী শফী রাহ.-কে পঞ্চম ও ষষ্ঠ মনযিলের অংশটুকু দিয়েছিলেন। এর কিছু অংশ তিনি হযরত থানভী রাহ.-এর জীবদ্দশায়ই লিখেছিলেন। বাকিটা থানভী রাহ.-এর ইনতেকালের পরে পূর্ণ করেছিলেন। সেটা আরবী ভাষায় লেখা ছিল।

এ সময়ে এসে তিনি তাই পঞ্চম ও ষষ্ঠ মনযিল রেখে সপ্তম মনযিল তথা সূরা কফ থেকে তাফসীর শুরু করেন। সেবছর অর্থাৎ ১৩৯১ হিজরীতেই সপ্তম মনযিলের তাফসীর শেষ হয়ে যায়। এরপর পঞ্চম ও ষষ্ঠ মনযিল তথা সূরা শুআরা থেকে সূরা হুজুরাতের তাফসীরও পুনরায় শুরু করলেন। এর মধ্যে তিনটি সূরা তথা সূরা ছ্বাদ, সাফ্ফাত ও যুখরুফের তাফসীর সুযোগ্য পুত্র মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমকে দিয়ে লেখান এবং নিজে সম্পাদনা করে দেন।

মাত্র দেড় পারা বাকি থাকতে ১৩৯২ হিজরীতে (১৯৭২ ঈ.) আবার ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিন মাস পরে সুস্থ হয়ে উঠলেও দুর্বলতার কারণে অল্প অল্প করে কাজ করতেন। এভাবে ধীরে ধীরে ২১ শাবান ১৩৯২ হিজরীতে আল্লাহ পাকের অশেষ মেহেরবানিতে তাফসীর লেখা শেষ হয়।

১৩৮৮ হিজরীতে এক কঠিন রোগের সময় এই কাজ শুরু হয়। পাঁচ বছর পরে ১৩৯২ হিজরীতে আরেক কঠিন অসুস্থতার পর সমাপ্ত হয়। এর চার বছর পরে ১৩৯৬ হিজরীতে (১৯৭৬ ঈ.) পাকিস্তানের মুফতীয়ে আযম এবং দারুল উলূম দেওবন্দ ও খানকায়ে আশরাফিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. ইনতেকাল করেন।

তাঁর তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন তিন অংশে বিভক্ত। প্রথমত কুরআনের সরল উর্দূ অনুবাদ। এ অনুবাদ মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী রহমাতুল্লাহি আলাইহির অনুবাদ (তরজমা শাইখুল হিন্দ) থেকে নেওয়া। দ্বিতীয়ত খুলাসা তাফসীর বা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাসহ অনুবাদ। এ খুলাসা তাফসীর থানভী রাহ.-এর বয়ানুল কুরআন থেকে নেওয়া। তৃতীয়ত খুলাসা তাফসীরের পরে মাআরিফ ও মাসায়িল অংশ, এটি মুফতী শফী রাহ.-এর নিজের লেখা। ইদারাতুল মাআরিফ করাচি থেকে প্রকাশিত এ তাফসীরের সংস্করণটি মোট আট খণ্ড। 

মাআরিফুল কুরআনের শুরুতে তাঁর সুযোগ্য পুত্র মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের উলূমুল কুরআন বিষয়ে সুদীর্ঘ ভূমিকা রয়েছে। প্রথমে লেখার পরে ভূমিকা অনেক বড় হয়ে যায়। তারপর সেটাকে কেবল মাআরিফুল কুরআন মুতালাআর জন্য প্রয়োজনীয় আলোচনায় সংক্ষেপ করে এখানে যুক্ত করে দেওয়া হয়। আর বিস্তারিত লেখাটি মাওলানা তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসেবে উলূমুল কুরআন নামে প্রকাশিত হয়।     

আলেম ও গায়রে আলেম সকলের জন্যই এ তাফসীর-গ্রন্থ অত্যন্ত উপকারী। আলেমগণ তো মূল কিতাবই পড়তে পারবেন। আর গায়রে আলেমগণ এর বাংলা অনুবাদ পড়তে পারেন। তবে অনুবাদগ্রন্থ কোনো আলেমকে দেখিয়ে এবং তার পরামর্শে পড়া উচিত। কুরআন কারীমের সহীহ ব্যাখ্যা ও আয়াত সংশ্লিষ্ট মাসায়েল ছাড়াও দ্বীন ও শরীয়তের সঠিক বোধ ফিকির ও মেযাজ হাসিলের জন্য এই কিতাব সকলেরই পড়া উচিত। 

২.

দারুল উলূম দেওবন্দ ও খানকায়ে আশরাফিয়ার আরেক সন্তান মাওলানা ইদরীস ইবনে হাফেয মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল কান্ধলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহিমা ১৩১৭ হিজরীতে (১৮৯৯ ঈ.) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মুফতী শফী রাহ.-এর সহপাঠী ও বন্ধু ছিলেন। দারুল উলূম দেওবন্দের শাইখুত তাফসীর এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানে জামিয়া আশরাফিয়া লাহোরের শাইখুত তাফসীর ও শাইখুল হাদীস ছিলেন।

মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ. ১৩৬০ হিজরীতে তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন লেখা শুরু করেন। ধীরে ধীরে চলতে চলতে ১৩৮২ হিজরীতে সূরা নিসার তাফসীর শেষ করেন। ১৩৯৪ হিজরীতে (১৯৭৪ ঈ.) ইনতেকালের আগে এই সুদীর্ঘ চৌত্রিশ বছরে তেইশ পারার সূরা সাফ্ফাত-এর শেষ পর্যন্ত তাফসীর লেখতে পেরেছিলেন। এরপর তাঁর ইনতেকাল হয়ে যায়।

এরপরে শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া কান্ধলভী রহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশে ইদরীস কান্ধলভী রাহ.-এর ছেলে মাওলানা মালেক কান্ধলভী রাহ. পিতার মাআরিফুল কুরআনের তাকমিলা সূরা ছ্বদ থেকে লেখা শুরু করেন। ১৪০৭ হিজরীতে (১৯৮৬ ঈ.) তাকমিলা লেখা শেষ হয়।

মাআরিফুল কুরআনের মাকতাবা উসমানিয়া থেকে প্রকাশিত সংস্করণটি মোট সাত খণ্ড। এর প্রথম পাঁচ খণ্ড (সূরা সাফ্ফাতের শেষ পর্যন্ত) হযরত মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ.-এর লেখা আর বাকি দুই খণ্ড তার ছেলে মাওলানা মালেক কান্ধলভী রাহ.-এর লেখা তাকমিলায়ে মাআরিফুল কুরআন। মালেক কান্ধলভী রাহ. ১৪০৯ হিজরীতে (১৯৮৮ ঈ.) ইনতেকাল করেন।

৩.

মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ. এবং মুফতী শফী রাহ. উভয়েই জীবনের শেষ দিকে পাকিস্তানে ছিলেন। উভয়ের মধ্যে খুব যোগাযোগ ছিল। চিঠিপত্র আদান-প্রদান হত। তাঁরা দুজনেই ইলমী পরিবারের সন্তান ছিলেন। ইদরীস কান্ধলভী রাহ.-এর বাবা মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল রাহ ছিলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মাক্কী রাহ.-এর খলীফা। মুফতী শফী রাহ.-এর বাবা মাওলানা ইয়াসীন সাহেব রাহ. ছিলেন হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-এর মুরীদ এবং হযরত থানভী রাহ.-এর সহপাঠী।

মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ. মাআরিফুল কুরআন লেখার সময় তাঁর কাছে মুফতী শফী রাহ.-এর মাআরিফুল কুরআনের যেই অংশ প্রকাশিত হত, সেটা থাকত। ১৩৯২ হিজরীতে মুফতী শফী রাহ.-এর মাআরিফুল কুরআন পূর্ণ লেখা হলে তা ইদরীস কান্ধলভী রাহ.-এর কাছে পাঠালেন, তিনি তা দেখে খুব আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করলেন। সেটা আলবালাগ পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। ইদরীস কান্ধলভী রাহ. তখন মুফতী শফী রাহ.-এর কাছে চিঠি লেখে এটাও জানিয়েছিলেন, ‘আপনার সব তাসনীফ আমি দুই কপি করে সংগ্রহ করে রাখি।

কেউ একজন ইদরীস কান্ধলভী রাহ.-কে জিজ্ঞেস করেছিল, মুফতী শফী রাহ. তো মাআরিফুল কুরআন নামে তাফসীর লিখেছেন। আপনিও একই নামে লেখছেন কেন? উত্তরে তিনি বললেন, তিনি আর আমি তো ভিন্ন নই।

বয়সে মাওলানা ইদরীস কান্ধলভী রাহ. মুফতী শফী রাহ. থেকে দুবছরের ছোট ছিলেন। তবে দুনিয়া থেকে তিনি মুফতী শফী রাহ.-এর (১৯৭৬ ঈ.) দুবছর আগেই (১৯৭৪ ঈ.) বিদায় নিয়েছেন।

এই দুই বন্ধুপ্রতীম মহান ব্যক্তিত্বের উভয় মাআরিফুল কুরআনই সর্বস্তরের উলামায়ে কেরামের কাছে ব্যাপক সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য। এ উভয় তাফসীর আকাবির আসলাফের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার ভাণ্ডার। তালিবে ইলম ভাইদের এ কিতাবদুটি বিশেষত মুফতী শফী রাহ.-এর মাআরিফুল কুরআন মুতালাআয় রাখা খুব জরুরি। হ

 

 

advertisement