মুহাররম ১৪২৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৭

সুখী দাম্পত্যের ছবি

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালামের তালীম-তরবিয়তের কারণে পুরুষ সাহাবীদের মতো মহিলা সাহাবিয়াগণও সহজ সরল ও পবিত্র জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। জগতের সকল মানুষের মতো তাদেরও একটি পারিবারিক জীবন ছিল। তাতে সুখদুঃখ ছিল, হাসিকান্না, মান-অভিমান ছিল এবং যা কিছু  একটি সহজ স্বাভাবিক জীবনের অপরিহার্য অনুষঙ্গ তার সবকিছুই তাদের জীবনেও ছিল। আর এসব কিছুর সঙ্গে আল্লাহমুখিতা ও শরীয়তের আনুগত্যের প্রেরণাও তাদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। শুধু বিদ্যমান ছিল এটুকু বললে কম বলা হবে, তাদের সকল কর্ম ও  আচরণ এবং আবেগ ও অনুভূতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার নিয়ামক ছিল এই প্রেরণা। এই প্রেরণাই তাদের পারিবারিক জীবনে আস্থা  ও বিশ্বাস এবং প্রেম ও আনুরাগের বন্ধনকে মজবুত ও অটুট করে তুলেছিল। স্বামীর প্রতি অনুরাগ, স্বামীর খেদমত ও আনুগত্য এবং স্বামীর ধনসম্পদের ব্যাপারে দায়িত্বশীলতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁরা ইসলামের শিক্ষা থেকে অর্জন করেছিলেন।

বিশুদ্ধ আকীদা ও ইবাদত বন্দেগীর ব্যাপারে যত্নবান হওয়ার পাশাপাশি দাম্পত্য জীবনের এই অঙ্গিকারগুলো পূরণ করাও তাঁদের জীবনের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। এখানে কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হল,

স্বামীর প্রতি মুহাব্বত

হযরত যাইনাব রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কন্যা ছিলেন। তাঁর বিয়ে হয়েছিল আস ইবনে রাবী রা.-এর সঙ্গে। বদরের যুদ্ধের সময় ইনি অমুসলিম ছিলেন এবং অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে বন্দি হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে নীত হয়েছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ফিদ্ইয়া নিয়ে বন্দিদের মুক্ত করার সিদ্ধান্ত দিলেন তখন মক্কার লোকেরা মুক্তিপণ পরিশোধ করে তাদের বন্দীদের নিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় হযরত যাইনাব রা. তাঁর স্বামীর মুক্তিপণের জন্য তার গলার হারটি পেশ করলেন। এই হারটি হযরত খাদীজা রা.-এর ছিল। বিয়ের সময় তিনি এটি মেয়েকে দিয়েছিলেন। হারটি পেশ করা হলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনীন হযরত খাদীজার কথা স্বরণ করে খুবই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। এরপর সাহাবায়ে  কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করে আস ইবনে রাবীকে মুক্ত করে দিলেন এবং হারটিও কন্যাকে ফিরিয়ে দিলেন। -আবু দাউদ

হযরত হামনা রা.-এর স্বামী এক জিহাদে শহীদ হন। এ সংবাদ হামনা বিনতে জাহাশ রা.-এর নিকট পৌঁছলে তিনি চিৎকার করে কেঁদে ওঠেন। -ইবনে মাজাহ

হযরত উমর রা.-এর স্ত্রী আতেকা রা. রোযার দিনেও মহব্বতের কারণে স্বামীর মাথায় চুম্বন করতেন। -মুয়াত্তা মালেক

আতেকা রা. এর প্রথম স্বামী ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর। তিনি তায়েফের যুদ্ধে শহীদ হলে ফাতেমা রা. একটি আবেগপূর্ণ মর্সিয়া গেয়েছিলেন, যার একটি চরণ ছিল

فأليت لا تنفك عينى  حزينة عليك ولا ينفك جلدى أغبر

আমি কসম করেছি যে, তোমার বিচ্ছেদে আমার চক্ষু সর্বদা অশ্রুসজল থাকবে এবং আমার দেহ থাকবে ধুলিমলিন। পরে হযরত উমরের সাথে তার বিয়ে হয়। ওলীমার দাওয়াতে হযরত আলী রা. তাকে সেই পংক্তিটি স্মরণ  করিয়ে দিলে তিনি কাঁদতে আরম্ভ করেন। -উসদুল গাবাহ

 

স্বামীর খেদমত

স্বামীর খেদমত ও আনুগত্যকে তারা নিজেদের জন্য অসম্মানের ব্যাপার মনে করতেন না। ইসলাম তাদেরকে এই অশান্তির উৎস থেকে রক্ষা করেছে। তারা এটাকে নিজেদের দায়িত্ব মনে করতেন এবং অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এই দায়িত্ব পালন করতেন।

উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সর্বাধিক প্রিয় স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তারপরও তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে কোনো ত্রট্টটি করতেন না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  মিসওয়াক করার আগে তা ধুয়ে নেওয়া পছন্দ করতেন এবং এই কাজটি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. নিজেই করে দিতেন। -আবু দাউদ

একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি কম্বল গায়ে দিয়ে মসজিদে আসলেন। কম্বলের এক স্থানে একটু ময়লার দাগ ছিল। একজন সাহাবী সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা উম্মুল মুমিনীনের কাছে পাঠিয়ে দেন। উম্মুল মুমিনীন সেই জায়গাটি পরিষ্কার করে ধুয়ে শুকিয়ে কম্বলটি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ফেরৎ পাঠান। -আবু দাউদ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইহরাম বাঁধতেন এবং ইহরাম খুলতেন তখন উম্মুল মুমিনীন তাঁর শরীরে খুশবু লাগিয়ে দিতেন। -আবু দাউদ

যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাইতুল্লাহ শরীফে হাদীবা পশু পাঠাতেন তখন উম্মুল মুমিনীন রা. সে পশুর কিলাদা (গলাবন্ধ) পাঁকিয়ে দিতেন। -আবু দাউদ

তবুক যুদ্ধে অনুপস্থিতির কারণে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিলাল ইবনে উমাইয়া রা.-এর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন এবং এক পর্যায়ে সকল মুসলমানকে এবং তার স্ত্রীকেও তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন রাখার আদেশ দেন। হিলাল ইবনে উমাইয়া রা.-এর স্ত্রী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে আবেদন জানালেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তিনি বৃদ্ধ মানূষ এবং তার কাজকর্ম করে দেওয়ার কেউ নেই। এখন আমি যদি তার খিদমত করি তবে কি আপনি তা অপছন্দ করবেন? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে অনুমতি দিলেন। -বুখারী

স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ

স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যসম্পর্কে যে বিষয়টি খুব সুন্দর প্রভাব ফেলে তা হল, স্বামীর অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে স্ত্রীর দায়িত্বশীলতা। সাহাবায়ে কেরামের স্ত্রীগণ এব্যাপারে এতই যত্নবান ছিলেন যে, স্বামীর অর্থ-সম্পদ তো বটেই, স্বামীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনো বিষয়েই তারা স্বামীর বিনা অনুমতিতে হস্তক্ষেপ করাকে পছন্দ করতেন না।

হযরত আসমা রা. হযরত যুবাইর রা.-এর স্ত্রী ছিলেন।  একবার এক গরীব ব্যক্তি এসে আসমা রা. কে বললেন, মা, আমাকে আপনার ঘরের ছায়ায় বসে কিছু মালপত্র বিক্রি করার অনুমতি দিন। আসমা রা. অনুমতি দিতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু হযরত যুবাইর রা.-এর কাছে জিজ্ঞেস করা ছাড়া অনুমতি দেওয়া সমীচীন মনে করলেন না। তাই লোকটিকে বলে দিলেন, যখন যুবাইর রা. ঘরে থাকেন তখন তুমি আসবে। লোকটি পরে এসে আবার সেই আবেদন জানাল। ঘরে তখন হযরত যুবাইর রা. উপস্থিত ছিলেন। আসমা রা. বলতে লাগলেন, মদীনাতে বুঝি আর কোনো ঘর নেই? আমার ঘরের কাছে বসেই তোমার মালপত্র বিক্রি করার সাধ জেগেছে! হযরত যুবাইর রা. স্ত্রীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, একজন গরীব মানুষ যদি এখানে সামান্য কিছু বেচা-কেনা করে তাতে আর এমন কি অসুবিধা, তুমি এমন রাগ করছ কেন? আসমা রা. মনে মনে এটাই চাচ্ছিলেন। হযরত যুবাইর রা.-এর পক্ষ থেকে এ কথা শোনার পর তিনি তাকে অনুমতি দিয়ে দিলেন।

এই বৈশিষ্ট্য যদিও সকল সাহাবিয়াদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল, কিন্তু কুরাইশ বংশীয়া নারীদের বিশেষত্বের কথা খোদ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে উল্লেখ করেছেন, উদ্দেশ্য হল অন্যদেরও এব্যপারে উদ্বুদ্ধ করা। তিনি বলেছেন, কুরাইশের নারীগণ আরব নারীদের মধ্যে সর্বোত্তম। তারা সন্তানের প্রতি অধিক মমতাময়ী অধিক রক্ষণাবেক্ষণকারী। -মুসলিম

সাজসজ্জা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহিলা সাহাবীগণ সাজসজ্জাও করতেন। তবে তা হত পরিমিত এবং স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য। একদিন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা.-এর হাতে চাঁদির একটি  বালা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? উম্মুল মুমিনীন উত্তর দিলেন, আমি এটি এজন্য তৈরি করেছি যে, আপনার জন্য তা পরিধান করব। -আবু দাউদ

হযরত খাওলা রা. আতর বিক্রি করতেন। একদিন তিনি উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা.-এর কাছে এসে বললেন, আমি প্রতি রাতে সুগন্ধি ব্যবহার করে নববধুর মতো সাজগোজ করে শুধু আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য স্বামীর নিকটে যাই। কিন্তু তিনি আমার প্রতি ভ্রূক্ষেপ করেন না। আমি যতই তাকে নিজের দিকে ফেরাতে চাই তিনি ততই মুখ ঘুরিয়ে রাখেন। আয়েশা রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বিষয়টি জানালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাওলা রা.কে আদেশ দিলেন, স্বামীর আনুগত্য করতে থাক। অর্থাৎ এভাবেই একসময় তার অন্তর তোমার প্রতি আকৃষ্ট হবে। -উসদুল গাবাহ

অন্যদিকে সাহাবায়ে কেরামও আয় উপার্জন, ইবাদত-বন্দেগী এবং দাওয়াত ও জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর সকল ব্যস্ততা সত্ত্বেও তাদের স্ত্রীগণের প্রতি দায়িত্বশীল থাকতেন। স্বামী-স্ত্রীর স্বাভাবিক প্রীতি ও ভালোবাসার আভায় তাদের দাম্পত্য সমুজ্জল ছিল।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. সফরে ছিলেন। সেখান থেকে স্ত্রীর অসুস্থতার সংবাদ শুনে খুব দ্রুত ঘরে ফিরে আসেন। -বুখারী

সাহাবায়ে কেরাম হজ্ব থেকে ফিরে আসছিলেন। যুলহুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছলে মদীনার আনসারী শিশুরা তাদেরকে ইস্তিকবাল করার জন্য বের হয়ে আসল। সেই সাহাবীদের মধ্যে হযরত উসাইদ ইবনে হুজাইর রা.ও ছিলেন। গোত্রের শিশুরা তাকে তার স্ত্রীর ইন্তেকালের সংবাদ দিল। তিনি সেখানেই চাদরে মুখ ঢেকে ফেললেন এবং কেঁদে ফেললেন। উপস্থিত ব্যক্তিদের একজন তাকে বললেন, আপনি একজন প্রবীণ সাহাবী হয়ে এভাবে একজন নারীর জন্য কাঁদছেন? তিনি নিজেকে সামলে নিলেন এবং বলতে লাগলেন, আপনি ঠিকই বলেছেন। সাদ ইবনে মুয়ায রা. (আনসার নেতা) -এর ইন্তেকালের পর আর কারো জন্য এভাবে কাঁদা উচিত নয়।

মোটকথা এই পারস্পরিক আস্থা, ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতার ভিত্তিতে যে দাম্পত্য গড়ে ওঠে তাই একটি সুখী দাম্পত্যের ছবি হতে পারে। ইসলামের শিক্ষা ও নির্দেশনার ছাঁচে গড়ে ওঠা সাহাবায়ে কেরামের দাম্পত্যের মধ্যে সেই ছবিটিই মূর্ত হয়ে উঠেছিল।

 

 

advertisement