মুহাররম ১৪২৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৭

রাশিনামা নয় চাই আলকুরআন
হৃদয়ে স্বপ্ন পুষেছি

মাওলানা যাইনুল আবিদীন

বিজ্ঞানের কাছে নিঃশর্ত সমর্পিতজনরা যখন অজ পাড়া গাঁয়ের রাহেলা বেগমদের মতো আঙ্গুল বোঝাই করে আংটি পরেন তখন বিস্মিত হতেই হয়। বিজ্ঞানের মান যাবে বলে যারা খোদার কালাম বুকে তুলে নিতে পারেনি, অদেখা সত্যকে মানতে হবে বলে যারা বিশ্ব জাহানের অধিপতির কাছে সমর্পিত হতে পারেনি তারাই যখন না দেখা রাশির ভয়ে বিশালায়তন রাশি ম্যাগাজিন ছড়িয়ে উবু হয়ে পড়ে থাকেন গভীর মগ্নতায় তখন সত্যিই ভেবে বিব্রত হই-এ কেমন তেলেসমাতি বৈপরীত্ব গো! বৈপরীত্ব হলেও বাস্তবতা এটাই, যারা আল্লাহ-খোদা মানে না, ধর্মের প্রতি যাদের সীমাহীন ভয়, বিজ্ঞানের প্রতি যাদের অতিরিক্ত শ্রদ্ধা, রাশি-ম্যাগাজিনের তারাই ক্রেতা, সংরক্ষক, পাঠক বরং পরমবিশ্বাসী ভক্ত।

মজার বিষয় হল আমাদের সমাজের যেসব তরুণ-তরুণী অতি আধুনিকতার জাত রক্ষার্থে ধর্ম-চিন্তার বারান্দা দিয়ে হাঁটে না, অনেকে তো ধর্মকে কুসংস্কার বলে তৃপ্তি পায় (নাউজুবিল্লাহ)-দেখি সেসব তরুণ-তরুণী বছরের শুরুতে রাশিচক্রের পত্রিকা একখানা কিনবেই। আর কেউ যদি জ্যোতিষীর দরবারে হাতপাতা অবস্থায় মডেল হতে পারে কোনো খ্যাত কিংবা অখ্যাত কাগজে তার রাশি আর ঠেকায় কে? জ্যোতিষীর দরবারে ভিখারির মত হাত পেতে বসার এই চিত্র যখন পত্রিকার পাতায় দেখি তখন আমার কাছে মনে হয় এ যেন এক অদৃশ্য শাস্তি বিধান। যারা সকল শক্তির উৎসসমগ্র জাহানের সৃষ্টিকর্তা প্রভুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারেনি আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ঠেলে দিয়েছেন ওই জ্যোতিষীর কাছে। অতঃপর মহান মনিবের দরবারে হাত না পাতার অপরাধে হাত পেতে বসে আছে মনিবের এক তুচ্ছ দাসের সমীপে। অনেকে তো ফুটপাতে দাঁড়ানো হস্তরেখাবিদ-ভাগ্যবিজ্ঞানীর কাছেও হাত পাততে দ্বিধা করে না। দ্বিধা করে না পোষা-বোকা টিয়ের কাছে ভাগ্যের ভবিষ্যত জানতে। দ্বিধা করে কেবল আল্লাহর দরবারে হাত পাততে। আল্লাহর কাছে নিজের ভবিষ্যতের কথা বলতে।

এরচেয়েও বড় হতাশার কথা হল, আমাদের সমাজে যারা মসজিদে এসে নামায পড়েন, বিশ্বাস করেন ভবিষ্যত সংবাদ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না তারাও যান জ্যোতিষীর কাছে। কেউ যায় অর্থের অর্থহীন আবেদনে আবার কেউ যায় দারিদ্র্যের তাড়া খেয়ে। অথচ পবিত্র ইসলামের দৃষ্টিতে যেমন হস্তরেখার আলোকে বর্ণিত ভবিষ্যদ্বাণীর কোনো ভিত্তি নেই এবং তার প্রতি বিশ্বাস রাখা বৈধ নয় তেমনি চোখের সামনে দাঁড়ানো বাস্তবতাও সমর্থন করে না এর সত্যতাকে। কারণ ওই রেখাবিদ মশায়ের ভবিষ্যদ্বাণী ও তার দেওয়া ফর্মুলাই যদি সংকট উত্তরণের সত্যপথ হত তাহলে ঝড়-বৃষ্টি-রোদে দাঁড়িয়ে আজীবন ভবিষ্যদ্বাণীর ফেরি করে বেড়াতে হত না এই ভাগ্য নির্দেশককে।

ইসলামের দৃষ্টিতে রাশিচক্র একটি ধোঁয়া। গণক জ্যোতিষীকে হাত দেখানো কঠিন পাপ। কোনো মানুষকে ক্ষতি করবার মত নিজস্ব কোনো ক্ষমতা গ্রহ-নক্ষত্র কেন কোনো মানুষেরও নেই। মানুষের ভাল-মন্দ সকল পরিণতি সম্পর্কে পরিপূর্ণরূপে জ্ঞাত আছেন কেবল আল্লাহ তাআলা। কল্যাণ কামনা কিংবা অকল্যাণ থেকে মুক্তির জন্য হাত পাততে হবে শুধু তাঁরই কাছে। তিনিই পারেন অনাকাঙ্খিত ভবিষ্যত ও ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করতে। অন্য কেউ কিংবা অন্য কিছু নয়।

লা, ইয়াকূত, যমরদ, আকীক আর ফিরোযা পাথরের দোহাই দিয়ে কঠিন বিপদ তো দূরের কথা এডিস মশা তাড়ানোও সম্ভব নয়। যদি সম্ভব হত তাহলে সবার আগে দেশের শঙ্কা ভয় আকাল আর দলের বিপদ কাটাবার জন্য দলীয় প্রতিটি সরকার ডজন ডজন জ্যেতিষী নিয়োগ করত। পাড়ায় পাড়ায় গড়ে উঠত জ্যেতিষী-স্কুল। চাষ হত আকীক আর ফিরোযা পাথরের। এত সহসা কুপোকাত হত না ধনী-ব্যবসায়ী বিত্তবানরা ত্রাসী ঘাতকের হাতে।

সারি সারি দেবতার মন জয় করে কাবু যে মুশরিক গোষ্ঠী মূলত তারাই ক্ষুদ্র ভগবান হিসাবে চাপিয়ে দিয়েছে আমাদের ধর্ম বিমুখ বন্ধুদের উপর বেগুনাহ কতিপয় পাথরকে, যে পাথরকে আজ তারা শ্রদ্ধায় বিশ্বাসে বরণ করে ঠিক সেভাবেই যেভাবে মুশরিকরা বরণ করে তাদের হাতের তৈরি মূর্তিকে। তাছাড়া বাণিজ্যের সস্তা পোস্টার আধুনিক তরুণ-তরুণীদের মডেলে অলঙ্কৃত রাশিনামা শখে কিংবা সংশয়ে তুলে নিয়ে যায় ঘরে। প্রথমত কুফরী বিষয় সম্বলিত এই পত্রিকা কেনাটাই নামিয়ে দেয় পাপের সহযোগী অপরাধীর কাতারে। শত স্বপ্ন আকাঙ্খা ও আশার আল্পনায় আঁকা নববর্ষে পদার্পণ করা হয় এ ধরনের প্রেস্টিজপূর্ণ আরও কত পাপ-পঙ্কের ভেতর দিয়ে!

বড় কথা হল, এই মাটির পৃথিবীতে আমরা কোনো উদ্দেশ্যেহীন সৃষ্টি নই। মাটির পৃথিবীকে সমূহ কল্যাণকর্মে আবাদ করে তোলার এক অপার্থিব লক্ষ্যে আমাদের আগমন। সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মাহ হিসাবে আমাদের কর্মপদ্ধতি, কর্মসূচী সবই সুচিন্তিত ও সুরক্ষিত। সবিশেষ পৃথিবীর সকল অন্যায় অবিচার ও অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতিকে জয় করে খোদার রাজত্ব প্রতিষ্ঠাই উম্মাহর দায়িত্ব। আর এই দায়িত্ব পালনে প্রথম সারির সৈনিক হিসাবে জীবন-মরন, সাধ-স্বপ্ন বাজি রেখে এগিয়ে যাবে উম্মাহর তাজাপ্রাণ তরুণেরা। যেভাবে তারা এগিয়ে গেছে যুগে যুগে নির্মাণে, সংস্কারে, প্রতিবাদে, প্রতিরোধে। জানি না কেন যেন আমার কাছে মনে হয় রাশির কুমন্ত্রণা দিয়ে সেই দীপ্ত কর্মমুখর তারুণ্যকে সংশয়ের ফাঁদে ফেলারই এক শয়তানী কৌশল এই রাশি কেন্দ্রিক রাশি রাশি আয়োজন। সুতরাং রাশির তৈরি ফাঁদের রশিতে পা দেওয়া নয়, প্রয়োজন নতুন বছরের এই সূচনাপর্বে আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ সমর্পণ। এই মুহূর্তে রাশি ফলের সংশয়পত্র কিংবা আকীক পাথর নয়, আমাদের হাত ধরে আমাদের কর্মে ও বিশ্বাসে উঠে আসুক চিরন্তন সফলতার বিশ্বস্ত রাহবার আলকুরআন।

 

 

advertisement