মুহাররম ১৪২৮   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৭

একটি ব্যতিক্রমী ইজতিমা

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

বর্তমান পৃথিবীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করার জন্য সংঘ, সংগঠন এবং সম্মেলনের কোনো অভাব নেই। দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এত বেশি সভা-সমাবেশ ও সম্মেলন নিয়মিতভাবে কিংবা কোনো কারণে তাৎক্ষণিকভাবে অনুষ্ঠিত হয় যার হিসাব রাখাও অসম্ভব। যদি এগুলোর উদ্দেশ্য অন্তত মানুষের পার্থিব কল্যাণ ও উপকার সাধনও হত, তবুও একটা কথা হত। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। এসব সম্মেলনের উদ্দেশ্যই হয়ে থাকে শক্তিমানের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং দুর্বলের ক্ষতি সাধন। যেখানে সম্মেলন ও সংঘবদ্ধতার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত কল্যাণের কাজে পরস্পর সহযোগিতা করা এবং অসহায় দুর্বলের সাহায্য করা সেখানে এসব সংগঠন ও সম্মেলনগুলোর উদ্দেশ্য হয়ে থাকে ঠিক এর উল্টো। অর্থাৎ শক্তিমান জালিমদের প্রতি সমর্থন প্রদান করা এবং দুর্বল নিপীড়িতদের অসহায়ত্বকে দীর্ঘায়িত করা। আর তা এমনই সুক্ষ্ম কৌশলে যে, নিপীড়িতজনের আহকরার কিংবা তার প্রতি কৃত অন্যায়কে অন্যায় হিসাবে অনুভব করারও পথ থাকবে না।

এটাই হল বর্তমান সময়ের সংঘ ও সংগঠনগুলোর কর্মনীতি। এসবের মধ্যে সৌভাগ্যবশত দুএকটি সংগঠন যদি এমন পাওয়া যায় যারা সেবামূলক মানসিকতা নিয়ে কাজ করে থাকে, তবে তাদেরও উদ্দেশ্য হয় কেবল মানুষের পার্থিব উন্নতি। অথচ এই উন্নতির সম্পর্ক শুধু মানুষের দেহের সঙ্গে। প্রশ্ন হয়, রক্ত-মাংসের এই দেহটাই কি মানুষ? তাহলে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য কী থাকল? মনুষ্যত্বই তো মানুষের বৈশিষ্ট্য। আজ বস্তুবাদী মানসিকতা এবং অর্থ ও পদের লালসা এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, প্রায় সকল মানুষই, বিশেষত ক্ষমতার মসনদে আসীন ব্যক্তিবর্গ মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশের এই মূল সমস্যাটির কথা একেবারে ভুলেই গেছেন। তাদের সকল চিন্তা-ভাবনা ও দৌড়-ঝাঁপ এই আসল সমস্যার বাইরেই আবর্তিত হয়। অথচ এই মনুষ্যত্বের সমস্যাই বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এই সমস্যার যথার্থ সমাধান হওয়া ছাড়া কোনো জাতীয় ও আর্ন্তজতিক সমস্যার সমাধান তো দূরের কথা, কোনো সমাজিক, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানও সম্ভব নয়।

আজ যদি কিছু সাহসী মানুষ এই মূল সমস্যার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন তবে তাদের আহ্বান অপরিচিত মনে হয়, তাদের কথাবার্তা আজব মনে করা হয় এবং তাদের ইজতিমা অর্থহীন ভাবা হয়। এ যেন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সেই বাণীটিরই বাস্তব রূপ-

بَدَأَ الْإِسْلَامُ غَرِيبًا، وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا، فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ  وهم الذين الَّذِينَ يُصْلِحُونَ إِذَا فَسَدَ النَّاسُ من سنتي من بعدي.

ইনসানিয়াতের সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অথচ সবচেয়ে সহজ ও সাদাসিধা কথাটি হল ইনসান যেন তার স্রষ্টাকে চেনে এবং সৃষ্টির প্রতি দয়া করতে শেখে।

ইনসানিয়াতের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল ইনসান তার অন্তরকে পবিত্র করে দিলওয়ালা হয়ে যায়।

তৃতীয় বৈশিষ্ট হল সুস্থ বুদ্ধির অধিকারী হওয়া। ক্ষণস্থায়ীকে চিরস্থায়ীর উপর প্রাধান্য দিয়ে ক্ষণস্থায়ীর জন্য চিরস্থায়ীকে বিসর্জন দেওয়ার নির্বুদ্ধিতা থেকে মুক্তি লাভ করা এবং ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের বিভিন্ন রহস্যাদি উন্মোচনের গর্বে আত্মহারা হয়ে কিংবা সীমাহীন গাফলত ও উদাসীনতায় নিজ সত্তা সম্পর্কেই বে-খবর থাকার লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করা।

ইনসানিয়াতের চতুর্থ বৈশিষ্ট হল ইনসান শরীফ ইনসান হবে এবং উন্নত চরিত্র ও উত্তম আখলাকের অধিকারী হবে।

পঞ্চম বিষয়টি হল, সে আমানতদার হবে এবং তার মধ্যে খালেক ও মাখলুক প্রত্যেকের আমানত আদায় করার মানসিকতা সৃষ্টি হবে। সকল পেরেশানী, যাকে প্রকৃত পক্ষেই পেরেশানী বলা যায়- তার সমাধান ইনসানকে ইনসানিয়াত শেখানোর মধ্যেই নিহিত রয়েছে। এই সাদাসিধে কথাটি বোঝাও ওইসব মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় যাদের আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এর শিক্ষার সঙ্গে জানাশোনাও নেই এবং জানার আগ্রহও নেই।  আম্বিয়া কেরাম আলাইহিমুস সালামের মধ্যে সর্বশেষে যিনি প্রেরিত হয়েছেন, তিনি হলেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ব্যাপকভাবে সকল মানুষের প্রতিই প্রেরিত হয়েছেন। স্থান-কাল-গোত্র ইত্যাদি সকল সীমাবদ্ধতার উর্দ্ধে তিনি সবার জন্যই রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর আনীত শিক্ষা ও নির্দেশনার সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়া ছাড়া এই বাস্তবতা উপলব্ধি করা অসম্ভব। এই বাস্তবতা তারাই উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন যারা ঈমানের স¤পদে সম্পদশালী। আর ঈমানের মিষ্টতায় যিনি যে পরিমাণ পরিতৃপ্ত তিনি ততটা গভীরভাবে এই উপলব্ধি করবেন। বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যাবে আজ যারা উন্নতি-অগ্রগতির সবচেয়ে বড় দাবিদার এবং মানবতার সিংহাসন যাদের অধিকারে তারাই সবচেয়ে বেশি মানবতাশূন্য। যারা নিজেরাই রিক্তহস্ত তারা আবার অন্যকে মানবতা শেখাবে কীভাবে?

এই বাস্তব সমস্যার একমাত্র সমাধানের ব্যাপারে যদি কোনো গোষ্ঠী চিন্তা-ভাবনা করে থাকে এবং সাধ্যমতো কিছু কাজ এ ব্যাপারে করে থাকে তবে  এই ঈমানওয়ালারাই করছে।

একমাত্র ঈমানওয়ালারাই দাওয়াত, তালীম, তাবলীগ, তারবিয়াত-তাযকিয়া, ওয়াজ-নসিহত, দ্বীনী মোযাকারার মাহফিল, সাধ্য অনুযায়ী সীমিত আকারে আমর বিলমারুফ, নাহি আনিল মুনকার এবং প্রয়োজনের মুহূর্তে সাধ্যমত জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহর মাধ্যমে পৃথিবীতে ইনসানিয়াতের সবক প্রচার প্রসারে যথাসাধ্য মশগুল রয়েছে। এটা ভিন্ন কথা যে, ঈমানওয়ালাদের ঈমানী অবস্থার দুর্বলতার কারণে এই খিদমতগুলো মানে ও পরিমাণে যথেষ্ট নয়। কিন্তু একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুক্তি ও উন্নতির চাবিকাঠি ঈমানওয়ালাদের ঈমানী তরক্কীর মধ্যেই নিহিত রয়েছে এবং পৃথিবীর ক্ষতিও ঈমানওয়ালাদের ঈমানী অবনতির কারণেই হয়েছে।

অবনতির এই যুগেও ব্যাপক দাওয়াতের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য খিদমত আল্লাহ তাআলা হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. (১৩০৩-১৩৬৩)-এর তাবলীগী জামাআতের মাধ্যমে নিচ্ছেন। এই কাজের রূহ হল বস্তুবাদী ও দুনিয়ার মোহগ্রস্ততার যে ব্যাধিতে কালেমা পাঠকারী মুসলিমগণও ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে রোগের অনুভূতি সৃষ্টি হওয়া অতঃপর রোগমুক্তির চিন্তা জাগ্রত হওয়া। তাবলীগী কর্মপদ্ধতিতে নিজের সংশোধনের কাজটি এমনভাবে করা হয় যে, এর সাথে সাথে অনুভূতিহীন মানুষের মধ্যেও দ্বীনের প্রয়োজনের অনুভূতি জাগ্রত করার মেহনত চলতে থাকে।

শরীয়ত দাওয়াতের নীতিমালা নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং এর মৌলিক বিধানসমূহও বাতলে দিয়েছে। এই নীতিমালা ও বিধানাবলির অনুসরণ করা প্রত্যেক দায়ী ও দাওয়াতী জামাআতের সার্বক্ষণিক কর্তব্য। এই সব নীতি ও বিধানের আওতার মধ্যে থেকে দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি স্থান, কাল ও পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন হতে পারে।

হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. কুরআন ও হাদীসের অনেক বড় মুহাক্কিক আলেম ছিলেন। তিনি ছিলেন হিন্দুস্তানের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ দুই দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্র-দারুল উলূম দেওবন্দ ও মাজাহিরুল উলূম সাহারানপুর মাদরাসার ফসল। তিনি কিতাব ও সুন্নাহ গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন। নবীচরিত ও সাহাবাচরিত ব্যাপকভাবে অধ্যয়নের পাশাপাশি তাঁদের জীবনের দাওয়াত অংশটি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন। পরবর্তী দায়ীগণের দাওয়াতের ইতিহাসও পড়েছেন। বড়দের সঙ্গে মশোয়ারা ও মতবিনিময় করেছেন। এরপর একটি কর্মপদ্ধতি প্রস্তুত করেছেন। কাজ আরম্ভ করে যতই সামনে অগ্রসর হয়েছেন ততই অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কাজের মধ্যে মজবুতী এসেছে। তাঁর ব্যথিত হৃদয়ের আহাজারি ও আল্লাহর বান্দাদের প্রতি তাঁর দরদ আল্লাহ তাআলা কবুল করেছেন। ফলে তাঁর কাজ পুষ্পিত ও পল্লবিত হয়েছে। আজ পর্যন্ত লক্ষ-কোটি মানুষ এই মেহনতের মাধ্যমে সিরাতে মুস্তাকীমের সন্ধান পেয়েছে। এরপর যে ব্যক্তি যে পরিমাণ উসূলের পাবন্দী করেছেন এবং হক্কানী উলামা মাশাইখের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত রেখেছেন তিনি তত বেশি উন্নতি করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, জিলাভিত্তিক দেশভিত্তিক তিনদিনের বাৎসরিক ইজতিমা। এই ইজতিমাগুলোতে মানুষকে তাজদীদে ঈমান তথা ঈমান পুনর্জীবিত করার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। সীরাতে নববী ও হায়াতে সাহাবার ঘটনাবলি শোনানো হয় এবং এই বিষয়টির উপর গুরুত্বের সঙ্গে জোর দেওয়া হয় যে, কিছু সময়ের জন্য দুনিয়ার ব্যস্ততা থেকে মুক্ত হয়ে মসজিদের পরিবেশে নেককারদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ঈমান ও আমলের সবক তাজা করা উচিত, যাতে দুনিয়ার ব্যস্ত-তার মাঝে থাকা অবস্থায়ও আল্লাহ তাআলার স্মরণ থেকে গাফেল না হওয়ার অনুশীলন হয়ে যায়। সময় বের করার জন্য তাশকীল করা হয়, যা এই কাজের প্রাণ।

এই ধরনের একটি ইজতিমা আমাদের দেশেও হয়ে থাকে, যা প্রতি বছরই যথানিয়মে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যা কেবল একটি দেশভিত্তিক ইজতিমার নয়; বরং বিশ্ব ইজতিমার রূপ গ্রহণ করেছে। এই ইজতিমাগুলো এবং এ ধরনের অন্যান্য দ্বীনী ইজতিমা, তা ইলম, আমল, দাওয়াত কিংবা ওয়াজ ও মোযাকারা যে লাইনেরই হোক না কেন সবগুলোর লক্ষ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সেই শিক্ষার বাস্তবায়ন যার প্রতিধ্বনি মুয়ায রা.-এর নিুোক্ত কথায় বিদ্যমান রয়েছে। তিনি তার সঙ্গীদের লক্ষ করে বলতেন اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنْ سَاعَةً আমাদের সঙ্গে বস কিছুক্ষণ ঈমান তাজা করি। -সহীহ বুখারী

এইসব ইজতিমায় অংশ গ্রহণকারীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিম্নোক্ত সুসংবাদের অন্তর্ভুক্ত হবে, যেখানে তিনি বলেছেন,

ليَبعثَنَّ اللَّهُ أقوامًا يَومَ القيامةِ في وجوهِهم النُّورُ على مَنابرِ اللُّؤلؤِ يغبِطُهم النّاسُ لَيسوا بأنبياءَ ولا شُهداءَ قيلَ: مَن هم؟ قالَ: هم المُتحابُّونَ في اللَّهِ مِن قبائلَ شتّى يجتَمِعونَ على ذِكرِ اللَّهِ يذكرونَهُ وفي حديث آخر: فينتقونَ أطايِبَ الكلامِ، كما يَنْتَقِي آكلُ التَّمْرِ أطايِبَهُ. رواه الطبرانى. كمافىالترغيب والترهيب‘  حديث ٢٢٤٠ و ٢٢٣٩ وقال في الأول: اسناده حسن وفى الثانى: اسناده مقارب لا بأس به.

আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন অনেক মানুষকে এমনভাবে উত্থিত করবেন যে, তাদের চেহারা নূরে ঝলমল করতে থাকবে এবং তারা মোতির মিম্বরে উপবিষ্ট থাকবে। তাদের এই মর্যাদা মানুষের মনে ঈর্ষা জাগ্রত করবে। অথচ তারা নবীও নন, শহীদও নন। বর্ণনাকারী বলেন, তখন এক গ্রাম্য আরবী ব্যক্তি দোজানু হয়ে বসল এবং বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ, তাদের পরিচয়  বলে দিন যাতে আমরা তাদের চিনতে পারি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তারা বিভিন্ন ভূখণ্ডের ও বিভিন্ন গোত্রের মানুষ, শুধু  আল্লাহর জন্যই পরষ্পর মহব্বত পোষণ করত এবং আল্লাহর স্মরণের জন্যই একত্র হয়ে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করত। অন্য বর্ণনায় এসছে, তখন তারা এমনভাবে উত্তম কথামালা আহরণ করে যেভাবে ফল অনুরাগী উত্তম ফল আহরণ করতে থাকে।

এই তবলীগী বিশ্ব ইজতিমার বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করলে অনেকগুলো শিক্ষণীয় বিষয় বের হয়ে আসে। যথা :

১. অসংখ্য সৌভাগ্যবান ব্যক্তি এমন থাকেন যারা এই তিন দিনের ইজতিমায় অংশগ্রহণ করেন। এরপর সেখান থেকেই চিল্লা, তিন চিল্লার জন্য বের হয়ে যান। এই সামান্য সময়ের মেহনতের মাধ্যমে তাদের জীবনে আমূল পরিবর্তন আসে। অন্তত এটুকু তো অবশ্যই হয়ে থাকে যে, তাদের মধ্যে নিজেদের সংশোধনের চিন্তা এবং ইবাদাত ও অন্যান্য জরুরি নেকআমলের জন্য সময় বের করার মানসিকতা সৃষ্টি হয়। এদের এই পরিবর্তন দেখে তাদের সঙ্গী ও সহকর্মীদের ঈর্ষা হওয়া উচিত, এবং এই চিন্তা আসা উচিত যে, আমরাও কেন তাদের মতো কিছু সময় বের করে নিজেদের জীবন ও কর্মকে সজ্জিত করছি না।

২. অনেক দ্বীনদার মানুষ তাদের পরিবারের কোনো সদস্য, কোনো আত্মীয়, কিংবা কোনো প্রতিবেশীর ব্যাপারে চিন্তিত থাকেন। তাদের কীভাবে দ্বীনদার বানানো যায় এর কোনো সহজ পদ্ধতি তারা খুজে পান না। তারা এই সহজ ব্যবস্থাটি পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। যদি বুঝিয়ে শুনিয়ে কোনোভাবে তাদেরকে এই কাজে বের করা যায় তবে এটা সমস্যার একটি সহজ সমাধান এবং পরীক্ষিত ব্যবস্থা।

৩. যাদের অন্তরে এই বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে যে, বাজেট ছাড়া কোনো বড় কাজ সম্পন্ন হতে পারে না এবং প্রচার-প্রচারণা ও আধুনিক প্রচার মাধ্যম ব্যবহার করা ছাড়া কোনো বৃহৎ ইজতিমায়ী কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়, তারা এই ইজতিমা থেকে শিক্ষা নিতে পারেন। কাজের মূল শর্ত ইখলাস, ইত্তেবায়ে সুন্নত, ইনাবত ইলাল্লাহ বা আল্লাহঅভিমূখী হওয়া আর আসল জিনিস হল, আল্লাহ তাআলার মদদ ও নুসরত। এটি হাসিল হলে অন্য সব উপকরণ মিন হাইছু লা ইয়াহতাসিবঅকল্পনীয়ভাবেই ব্যবস্থা হয়ে যায় এবং বিনা চাওয়ায় দ্বীনী উদ্দেশ্য হোক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে, অনেক মানুষ, অনেক রাজনৈতিক দল ও প্রতিষ্ঠান, বরং সর্বশ্রেণীর মানুষ ও ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ এর ব্যবস্থাপনাগত সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। যদিও যে সব ব্যক্তি বা দল এ ধরনের দ্বীনী কাজের সহযোগিতায় কোনো দুনিয়াবী উদ্দেশ্যে, বিশেষত রাজনৈতিক স্বার্থে অগ্রসর হয়, তাদের দুনিয়াও বরবাদ আখেরাতও বরবাদ।

৪. এত বড় ইজতিমার প্রস্তুতির জন্য স্বতঃস্ফূর্ত খেদমত প্রদানকারীদের পরিশ্রম ও আন্তরিকতা এবং এত বড় ইজতিমা শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকার অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে যদি ক্ষমতাসীন ব্যক্তিবর্গ চিন্তা ভাবনা করেন তবে তারা বুঝতে পারবেন, মানুষের অন্তরের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারাই আসল কর্তৃত্ব। আর এর একমাত্র পদ্ধতি ঈমান ও আমানত এবং ত্যাগ ও ন্যায়পরায়ণতা অর্জন করে ইনসান হওয়া এবং মানুষকে আল্লাহভীতির তালকীন করে তাদের মাঝে ইনসানিয়াতের রূহ ফুঁকে দেওয়া।

৫. সাধারণত মানুষ ইজতিমার বিশাল উপস্থিতি দ্বারা প্রভাবিত হয়। কেননা তারা বাহ্যদর্শনে অভ্যস্থ। কিন্তু কাজের সঙ্গে জড়িত প্রাজ্ঞজনদের দৃষ্টি থাকে অভ্যন্তরের দিকে। তারা বহ্যিক সংখ্যাধিক্য দেখেন না, দেখেন এর বৈশিষ্ট্য ও ফলাফল। তারা লক্ষ করেন, উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ এখান থেকে কী নিয়ে ফিরছেন। তাদের মধ্যে কতজন সময় লাগানোর জন্য তৈরি হলেন এবং সময় লাগানোর পর তাদের মধ্যে কী কী পরিবর্তন সূচিত হল। তাদের কর্ম, তাদের জীবন, তাদের লেনদেন, তাদের আকীদা এবং রুচি ও প্রকৃতি কতটুকু বিশুদ্ধ হল। দ্বীনের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার পর দ্বীনী বুঝ অর্জন করার জন্য তারা আলেমদের শরনাপন্ন হন কি না? সময় লাগানো অবস্থায় উসূলের পুরোপুরি পাবন্দী না করার কারণে তাদের মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে কি না এবং হয়ে থাকলে তার সংশোধনের কী পন্থা হতে পারে।

৬. যারা প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গের এই সব অনুভূতির মানদণ্ডে নিজেদেরকে বিচার করেন এবং কাজের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করতে থাকেন তারাই এই কাজের উপকারিতা লাভ করতে সক্ষম হন। এ জন্য এই কাজের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর মালফুযাত ও মাকতুবাত-এ উল্লেখিত নির্দেশনা ও নীতিমালা খুব বেশি বেশি চর্চা করা প্রয়োজন এবং তার সময়ের মত সফরে ইলম ও যিকিরের প্রতি খুব বেশি পরিমাণে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। ওয়াপেসীর পর কাজের সঙ্গে সর্ম্পক রাখার পাশাপাশি উলামায়ে কেরাম ও মাশায়েখে কেরামের সাহচর্য গ্রহণ করার প্রতিও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। হযরত রহ. এই বিষয়গুলোর প্রতি খুব তাকিদ করতেন।

অনেক মানুষ শুধু ইজতিমার মুনাজাতে অংশগ্রহণ করে থাকে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে,কোনো দ্বীনী মাজমায় এ ধরনের উপস্থিতিরও ছওয়াব ও উপকারিতা রয়েছে, কিন্তু আসল কাজ হল পুরো তিনদিন বা সম্ভাব্য বেশি থেকে বেশি সময় ওখানে নেককার ব্যক্তিদের সংস্পর্শে কাটানো এবং উলামায়ে কেরামের বয়ান শুনে কাজের হাকীকত বোঝার চেষ্টা করা এবং নিজের মধ্যে দ্বীনের তলব ও সংশোধনের পিপাসা সৃষ্টি করা।

যাদের ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, তারা ইজতিমায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণ করেন যদি বাস্তবতা তাই হয় তবে তাদের খেদমতে আরজ থাকবে তারা যেন নিয়ত শুদ্ধ করে তাওবার নিয়তে সেখানে শরিক হন। হতে পারে এই ওসিলায় আল্লাহ তাআলা তাদের অন্তরে হেদায়েত ঢেলে দিবেন। ফলে তাদের জীবন লক্ষ্যে পৌঁছবে এবং বেরা পার হবে। আল্লাহ তাআলা বস্তুবাদী মানসিকতার বিনাশ করুন। এই মানসিকতা ইসলামী ইবাদাত,নিদর্শন ও ইসলামী পরিভাষা ইত্যাদি সকল বিষয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে দাখিল করেছে। ফলে এখন অনেকের হজ্ব উমরা পালনও রাজনৈতিক হয়ে গেছে। বিভিন্ন দ্বীনী ইজতিমায় অংশ গ্রহণের উদ্দেশ্য রাজনৈতিক হচ্ছে এবং শহীদের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে এক নতুন প্রকার রাজনৈতিক শহীদও উদ্ভাবিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সকল মুসলমানকে ইখলাস, ঈমান, আমানত ও তাকওয়া নসীব করুন এবং দ্বীনের নিদর্শনাদি বরং যে কোনো দ্বীনী আমলকে দুনিয়াবী স্বার্থ হাসিলের মাধ্যম বানানোর মানসিকতা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।

 

 

advertisement