যিলহজ্ব ১৪২৭   ||   জানুয়ারি ২০০৭

কাজে একাগ্রতাই সফলতার সোপান

ইসহাক ওবায়দী

দিল্লীর এক ব্যবসায়ী হাজী সাহেবের সঙ্গে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর খুব মহব্বতের সম্পর্ক ছিল। তার দোকানের এক কর্মচারীর সঙ্গেও হযরতের মহব্বত ছিল। একসময় হাজী সাহেব উক্ত কর্মচারীকে চাকরি থেকে বিদায় করে দিল। কর্মচারী হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ.-এর খেদমতে তাকে বিদায় করে দেওয়ার কথা জানালেন। একদিন সাক্ষাতে হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহ. হাজী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, অমুককে বিদায় করলেন কেন? হাজী সাহেব উত্তরে বললেন, হযরত, লোকটি খুব ভাল ও বিশ্বাসী, কাজের মধ্যে যথেষ্ট সততা রাখেন। কিন্তু ইদানীং তিনি বাজারে আমার এই একই পণ্যের আরেকটি দোকান খুলে বসেছেন, যা তার ছেলেকে দিয়ে করান। ফলে তিনি থাকেন আমার দোকানেই, কিন্তু তার মন থাকে ছেলের দোকানে। তিনি বেচা-কেনা করেন আমার এখানেই কিন্তু সারাক্ষণ চিন্তা করেন ওই দোকানের উন্নতির। আমি দেখলাম, এতে আমার দোকানের ক্ষতি হবে, তাই তাকে বিদায় করে দিলাম। হাজী সাহেবের কথা শুনে হযরত চমকিত হয়ে বলে উঠলেন, তুমি তো আমাকে استخلاص (একাগ্রতা) শেখালে। এরই নাম استخلاص বা একাগ্রতা। এখলাস এক জিনিস, এস্তেখলাস অন্য জিনিস। এখলাস হল লিল্লাহিয়াতের নাম আর এস্তেখলাস হল কোন কাজকে নিজের মনে করে ওই কাজের হয়েই কাজ করার নাম। কোন কাজের সফলতার জন্য এখলাস থাকাই যথেষ্ট নয়; বরং এস্তেখলাসেরও প্রয়োজন রয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার করণীয় কাজে তন-মন সর্বস্ব ডুবিয়ে দিয়ে একান্ত একাগ্রতার সাথে ওই কাজটি না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ওই কাজে সফলতা আসবে না। এখলাস থাকলে সওয়াব পাওয়া যাবে বটে, কিন্তু সফলতা নাও আসতে পারে। সফলতা লাভ করতে হলে কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে হবে। দিনে রাতে শয়নে স্বপনে প্রতি মুহূর্তে, ওই কাজের এক মহা ফিকির থাকতে হবে। তবেই সফল হওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ।

দ্বীনের বহুবিধ খেদমতের মধ্যে আমরা যে যে কাজেই থাকি না কেন, তা যদি এখলাস ও এস্তেখলাসের সাথে করতে পারতাম তাহলে আমাদের ওই সমস্ত খেদমত কাক্সিক্ষত মনজিলে পেঁৗছতে পারত। আমাদের অধিকাংশ খেদমতেই এস্তেখলাস তো দূরের কথা, অনেক ক্ষেত্রে এখলাসেরও অভাব থাকে। অথচ আমরা সবাই দ্রুত ফলাফলের আশায় বসে থাকি। অনেক সময় দেখা যায়, যিনি মাদ্রাসার খেদমতে নিয়োজিত আছেন, মূল কাজরূপে এই খেদমতকে নিয়েছেন, তিনি আরো অনেক খেদমতেই লিপ্ত থাকেন। ফলে দেখা যায়, তার সব কটি খেদমতই অসমাপ্ত থেকে যায়।

দ্বীনের লাইনে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছার হাজারো পথ রয়েছে। যেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই আমাদের মূল উদ্দেশ্য, তাই আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে আমরা যদি যে কোন একটি দ্বীনী খেদমতকে আঁকড়ে পরে থাকতাম, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে যদি ওই কাজের স্বপ্নই শুধু দেখতাম, তাহলে মনে হয় আমাদের সফলতা দ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে এগিয়ে আসত। আমাদের মূল কাজ একটাই হওয়া চাই। বাকি সব কাজে সহায়তামূলক আচরণ রেখে যার যার মূল কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে এখলাসের সাথে এস্তেখলাসের সংযোগ ঘটায় কাজের যথাযথ ফল লাভ করা সহজ হবে।

আমি حب جاه و حب مال (সম্মানের লোভ ও সম্পদের লোভ)-এর কথা বাদ দিয়ে নেহায়েত مخلصين (নেকনিয়তি)-দের কথাও বলতে পারি, যাদের যথেষ্ট এখলাস থাকা সত্ত্বেও এস্তেখলাসের অভাবে কাজে সফলতার মুখ দেখা যায়নি।

তালীম, তাবলীগ ও সিয়াসাত সবই দ্বীনি খেদমত, যার কাছে যেটা দালিলিকভাবে প্রাধান্য পেয়ে আসছে আমরা যেন সেই খেদমতেই আত্মনিয়োগ করি, সেই খেদমতের হয়েই যেন কাজ করি, অন্যটাকে সমর্থন পর্যায়ে রাখি।

মানুষ অত্যন্ত দুর্বল প্রাণী। এক ব্যক্তির পক্ষে অনেকগুলো কাজ আঞ্জাম দেওয়া সত্যিই এযুগে কঠিন ব্যাপার। বিশেষ করে নূরে নবুওয়াতের যমানা থেকে দূরে বহু দূরে অবস্থান করার কারণে এই দুর্বলতা আরো শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। নবুওয়াতের সোহবতের বরকতে যা সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে অনেকটা ছিল না বললেই চলে।

আসুন! আমরা আমাদের যাবতীয় খেদমতের মধ্যে এখলাসের পাশাপাশি এস্তেখলাসও পয়দা করি।

 

 

advertisement