যিলকদ ১৪৪৩   ||   জুন ২০২২

সৌজন্য সাক্ষাতেও চাই সচেতনতা

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

দুনিয়ার এ জীবনে কতজনের সঙ্গে কতভাবে পরিচয় হয়! সে পরিচয় কখনো ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। সৃষ্টি হয় হৃদ্যতা, আন্তরিকতা। ঘনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতার পেছনে কখনো কাজ করে আত্মীয়তার বাঁধন, কখনো প্রতিবেশী। সেখানে নতুন করে পরিচয়ের কিছু থাকে না। তবুও আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সমান থাকে না। এ ঘনিষ্ঠতার দাবিতেই আমরা একে-অন্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাই। সহজ কথায় একে বলা যায় সৌজন্য সাক্ষাৎ। এ সাক্ষাৎ আগের ঘনিষ্ঠতায় যোগ করে নতুন মাত্রা। বৃদ্ধি পায় আন্তরিকতা। মুসলিম সমাজে এ আন্তরিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। তা কেবলই এ দুনিয়ার জীবনে নয়, বরং দুনিয়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে পরকালের অনন্ত অসীম জীবনেও পারস্পরিক হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা বয়ে আনবে অনিঃশেষ সফলতা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী-

لاَ تُؤْمِنُوا حَتّى تَحَابّوا.

যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের পারস্পরিক ভালবাসা সৃষ্টি না হবে, ততক্ষণ তোমরা মুমিন হতে পারবে না! -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৪

যত্ন নিতে হয় সবকিছুরই। অযতেœ অবহেলায় লোহায় যেমন মরিচা পড়ে, ক্ষয় হতে হতে একপর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, পারস্পরিক সম্পর্কও এমনই। এখানেও যত্ন নিতে হয়। পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ায় নিয়মিত পানি ঢালতে হয়। তবেই টিকে থাকবে এ সম্পর্ক, হৃদ্যতা ও আন্তরিকতা। শুধু টিকেই থাকবে না, বরং সঠিক পরিচর্যায় একটি ছোট চারাগাছ যেভাবে বিশালাকার বৃক্ষে পরিণত হয়, পারস্পরিক এ হৃদ্যতাও এভাবেই বেড়ে উঠবে- চারাগাছ থেকে বৃক্ষের আকারে। এ যত্ন ও পরিচর্যারই একটি উপায়- সৌজন্য সাক্ষাৎ।

উপরোক্ত হাদীসে আমরা দেখতে পাই- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, পারস্পরিক ভালবাসা না থাকলে মুমিন হওয়া যাবে না। এ কথা ঠিক- যদি কেউ মুমিনদের সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক না রাখে, তবে এ জন্যে তাকে কাফের বলে দেয়া যাবে না। কিন্তু এ-ও অনস্বীকার্য- পারস্পরিক এ ঘনিষ্ঠতা মুমিনের কাছে ঈমানের দাবি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের বলেছেন- ভাই ভাই। এ ভ্রাতৃত্বের পেছনে রয়েছে ঈমান। ঈমানী এ ভ্রাতৃত্ব শক্তিতে ছাড়িয়ে যায় রক্তের সম্পর্ককেও। কথা হল, যে ভ্রাতৃত্বের এত শক্তি, এত মর্যাদা, ঈমানের দাবিদার হওয়ার পরও কেউ যদি এ ভ্রাতৃত্বের কদর না করে, মুমিন ভাইদের প্রতি পোষণ না করে ভালবাসা, তার দাবি তবে সত্য হয় কী করে? ঈমান তার পরিপূর্ণ নয়। সম্পর্কের দাবি রক্ষা করে পারস্পরিক সাক্ষাৎ তাই কেবলই আন্তরিকতার প্রকাশ নয়, নয় শুধু সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার মাধ্যমও; এ সাক্ষাৎ আমাদের ঈমানের দাবি পূরণ করার পথে এক বড় সহায়ক।

হাদীসে স্পষ্টই বর্ণিত হয়েছে এ সাক্ষাতের ফযীলতের কথা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক লোক তার এক ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিলসে ভাই থাকত আরেক এলাকায়। আল্লাহ তখন তার যাত্রাপথে একজন ফেরেশতা দাঁড় করিয়ে রাখলেন। লোকটি যখন ফেরেশতার কাছে এল, ফেরেশতা তাকে বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ?

সে জানাল, আমি এ এলাকায় আমার এক ভাইয়ের কাছে যাচ্ছি।

ফেরেশতা প্রশ্ন করল, তার কাছে তোমার কোনো পাওনা আছে, যা তুমি আনতে যাচ্ছ?

সে বলল, না, তেমন কিছু নয়, তবে আমি তাকে আল্লাহ তাআলার জন্য ভালবাসি। ফেরেশতা তখন বলল-

فَإِنِّى رَسُولُ اللهِ إِلَيْكَ بِأَنّ اللهَ قَدْ أَحَبّكَ كَمَا أَحْبَبْتَهُ فِيهِ.

শোনো, আমি তোমার কাছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে এ বার্তা নিয়ে এসেছি- তুমি যেমন তাঁর সন্তুষ্টির জন্যে তোমার ভাইকে ভালবাস, তিনিও তেমনি তোমাকে ভালবাসেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৬৭

পুরস্কারটি কত বিশাল- ভাবা যায়! মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালবাসা! তিনি আহকামুল হাকিমীন, তিনি মালিকুল মুলক। এমন সত্তা যদি কাউকে ভালবাসে, তো তার আর কী-ইবা লাগে! দুনিয়া-আখেরাতের কোনো সংকটই তার পথ রোধ করে দাঁড়াতে পারবে না। আল্লাহ যে তাকে ভালবাসেন! তিনি যাকে ভালবাসেন, তাকে তো তিনি সব রকম সংকট থেকে উদ্ধার করবেনই। তার জীবনকে তিনি নানামুখী নিআমতে করে তুলবেন সমৃদ্ধ। তবে কথা একটাই। এ মহান প্রাপ্তির জন্যে একটাই শর্ত- ভালবাসাটি হতে হবে নিরেট আল্লাহ তাআলার জন্য, দুনিয়ার কোনো প্রাপ্তি এখানে উদ্দেশ্য হতে পারবে না। তবেই মিলবে এ পুরস্কার।

পুরস্কার হিসেবে যে আল্লাহর ভালবাসা পাবে, সে যে ভালো থাকবে, জান্নাতে যাবে- তা সহজেই অনুমেয়। এরপরও প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জানিয়েছেন-

مَنْ عَادَ مَرِيضًا أَوْ زَارَ أَخًا لَهُ فِي اللهِ نَادَاهُ مُنَادٍ أَنْ طِبْتَ وَطَابَ مَمْشَاكَ وَتَبَوّأْتَ مِنَ الجَنّةِ مَنْزِلاً.

যে ব্যক্তি কোনো রোগী দেখতে যায়, কিংবা আল্লাহর জন্যই ভালবাসে এমন কোনো ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যায়, একজন আহ্বানকারী তাকে ডেকে ডেকে বলে, তুমি সুন্দর হও, তোমার যাত্রা সুন্দর হোক আর জান্নাতে তোমার জন্যে নির্ধারিত হয়ে যাক একটি বাড়ি! -জামে তিরমিযী, হাদীস ২০০৮

সম্পর্ক রক্ষাকারী এ সৌজন্য সাক্ষাতেও প্রয়োজন সচেতনতা। অসতর্ক সাক্ষাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। মেহমান হয়ে দাঁড়াতে পারে মসিবতের কারণ। আদব-শিষ্টাচার ও সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা তাই অনস্বীকার্য।

বনু তামীমের কিছু লোক একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এল। নবীজী তখন বাড়িতে। আদব-শিষ্টাচার তাদের জানা ছিল না। তারা এসে তাই ঘরের পেছন থেকে ডাকতে লাগল- মুহাম্মাদ! আমাদের কাছে বেরিয়ে আসুন! নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ডাক শুনে বেরিয়ে এলেন। মহান রাব্বুল আলামীন তখন পবিত্র কুরআনের আয়াত নাযিল করে আমাদের জানিয়ে দিলেন সাক্ষাতের কিছু আদব, কিছু শিষ্টাচার। কুরআনের ভাষায়-

اِنَّ الَّذِیْنَ یُنَادُوْنَكَ مِنْ وَّرَآءِ الْحُجُرٰتِ اَكْثَرُهُمْ لَا یَعْقِلُوْنَ، وَ لَوْ اَنَّهُمْ صَبَرُوْا حَتّٰی تَخْرُجَ اِلَیْهِمْ لَكَانَ خَیْرًا لَّهُمْ،   وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.

যারা ঘরের পেছন থেকে তোমাকে ডেকেছে, সন্দেহ নেই, তাদের অধিকাংশই বোঝে না। তুমি তাদের কাছে বেরিয়ে আসা পর্যন্ত তারা যদি সবরের সঙ্গে অপেক্ষা করত, তবে তা তাদের জন্যে অবশ্যই কল্যাণকর হত। তবে আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, দয়ালু। -সূরা হুজুরাত  (৪৯) : ৪-৫

বনু তামীমের এ ঘটনা এবং এ প্রেক্ষিতে নাযিল হওয়া দুটি আয়াত থেকে আমরা এ শিক্ষা পাই- যে কোনো সময় যে কারও সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যে যাওয়া যাবে না। যে কোনো সময় গিয়ে কারও বাড়ির বাইরে থেকে তাকে ডাকা যাবে না। অসময়ে করা যাবে না করাঘাতও। কেউ যখন বাড়ির ভেতরে থাকে, তো সেখানকার জগৎটা একান্তই তার নিজস্ব। যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা, বাড়িতে তিনি বিশ্রামে থাকতে পারেন, বাড়িতে কোনো রোগী থাকতে পারে এবং তিনি সে রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারেন, একান্তই নিজস্ব কোনো কাজে মশগুল থাকতে পারেন, স্ত্রী-ছেলেমেয়েদের নিয়ে সময় কাটাতে পারেন। এখানে হস্তক্ষেপ করা কিংবা বিঘœ ঘটানোর অধিকার নেই কারও। তাই সাক্ষাৎ করতে হবে সাক্ষাতের সময়ে। নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হতে না পারলে অপেক্ষায় থাকতে হবে- তিনি কখন স্বাভাবিক রুটিন অনুসারে বেরিয়ে আসেন; তখন তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।

সৌজন্য সাক্ষাতের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এর ফল পাওয়া যাবে দুনিয়া-আখেরাতের সর্বত্র। কিন্তু এক পক্ষের অসতর্কতায় অপর পক্ষ যদি কষ্ট অনুভব করেন, তখন এতে কাক্সিক্ষত ফল অর্জিত হবে না। যে মেহমানের আগমনে মেজবানের কষ্ট হয়, সে মেহমানের সাক্ষাৎ থেকে মনে মনে মুক্তি কামনা করাও মেজবানের জন্যে বিচিত্র নয়। তাই সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য এসে কাউকে অহেতুক কষ্টে ফেলা যাবে না। প্রসঙ্গত নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ হাদীসটিও এখানে উল্লেখযোগ্য-

الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ.

মুসলিম তো সেই, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১০

সাক্ষাৎপ্রার্থী ও দর্শনার্থীদের জন্য যার নির্ধারিত সময় রয়েছে, তার সঙ্গে সেসময়ই সাক্ষাৎ করা উচিত। এজন্য আগে থেকে কোনো অনুমতির প্রয়োজন হয় না। তবে যার এমন কোনো নির্ধারিত সময় নেই, তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে আগেই সময় নেয়া উচিত। তিনি যে সময় দেবেন, সে সময়েই যাওয়া উচিত। যে কোনো সময় কারও দরজায় করাঘাত করে তাকে বিব্রত কিংবা বিরক্ত করা উচিত নয়। অনেকসময় এমনও হয়, দূরে কোনো এলাকায় যাওয়ার পর সেখানকার কোনো আত্মীয় কিংবা বড় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাতের প্রসঙ্গ সামনে আসে। সেখানেও যতটা সম্ভব আগে জানিয়ে যাওয়া উচিত। একেবারেই অপ্রস্তুত অবস্থায় কারও দরজায় হাজির হয়ে যাওয়া সমীচীন নয়।

অসময়ে কারও সাক্ষাতে যাওয়া তার কষ্টের কারণও হতে পারে। কাজের মানুষ যারা, তারা তো তাদের সময়গুলো কোনো না কোনো কাজেই কাটায়। তাই যে কোনো সময় তার কাছে গিয়ে উঠলে তার ঐ সময়ের নির্ধারিত কাজে ব্যাঘাত ঘটবে, সন্দেহ নেই। হতে পারে- সময়টা তার বিশ্রামের জন্য নির্ধারিত। সাক্ষাতের সৌজন্য রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্রামের সময়টা তিনি কাটিয়ে দিলেন কথা বলে। কিন্তু বিশ্রাম না করার রেশ হয়তো তার থেকে যাবে অনেকক্ষণ। এমনও হতে পারে- ঘরের সকলেই বিশ্রামে। সময়টাও বিশ্রামেরই। এমন মুহূর্তে কেউ এসে কলিংবেল টিপল। এতে যে একবার ঘুম ভাঙল, পরে আর ঘুম এল না চোখে। এর রেশ কাটতেও লেগে যেতে পারে অনেক সময়। সাক্ষাতের সময় নির্ধারণেও তাই সতর্কতা জরুরি।

অনুমতি গ্রহণের আরেক প্রসঙ্গ- ঘরে প্রবেশের আগে অনুমতি নেয়া। আগে থেকে জানিয়ে এলেও ঘরে প্রবেশের আগে অবশ্যই অনুমতি নিয়ে নিতে হবে। এ নির্দেশ সরাসরি পবিত্র কুরআনের। এখানে এসেছে ঘরের লোকদের সালাম দেয়ার কথাও। লক্ষ করুন-

یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْا لَا تَدْخُلُوْا بُیُوْتًا غَیْرَ بُیُوْتِكُمْ حَتّٰی تَسْتَاْنِسُوْا وَ تُسَلِّمُوْا عَلٰۤی اَهْلِهَا  ذٰلِكُمْ خَیْرٌ لَّكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ.

হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারও ঘরে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা অনুমতি গ্রহণ কর এবং তাদেরকে সালাম দাও। এ পন্থাই তোমাদের জন্যে শ্রেয়। আশা করা যায়, তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে। -সূরা নূর (২৪) : ২৭

ঘরে প্রবেশের আগে এ অনুমতি গ্রহণ উচিতপর্যায়ের কোনো বিধান নয়, এটা জরুরি। এ অনুমতি গ্রহণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা বোঝার জন্য এ হাদীসটি লক্ষ করুন-

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যখন আমার মায়ের কাছে যাই, তখনো কি আমাকে অনুমতি নিতে হবে?

তিনি উত্তর দিলেন : হাঁ, নিতে হবে।

লোকটি বলল, আমি ঘরে তার সঙ্গেই থাকি। তবুও আমাকে অনুমতি নিতে হবে?

নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে যাবে।

লোকটি এবার বলল, আমি যে তার সেবাযত্নও করে থাকি!

এরপর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, তবুও তুমি অনুমতি নাও। তুমি কি তাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতে চাও?

সে বলল, না।

তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে অনুমতি নাও। -মুয়াত্তা ইমাম মালেক, হাদীস ১৭২৯

নিজের ঘরে কে কখন কোন্ অবস্থায় থাকে- তা তো বাইরে থেকে বলা যাবে না। তাই অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে আগে, যেন অপ্রস্তুত কোনো অবস্থায় মেজবান-মেহমান কাউকেই বিব্রত হতে না হয়।

অনুমতি নেয়ার পদ্ধতি কী হবে- উপরের আয়াতে তা-ও বলে দেয়া হয়েছে। নিয়ম হচ্ছে, বাইরে থেকেই সালাম দেবে। এ সালামটাই অনুমতি প্রার্থনা। যদি মনে হয়, ভেতরে সালামের আওয়াজ পৌঁছবে না, তবে করাঘাত করবে। কলিংবেল থাকলে তাও টেপা যেতে পারে। এরপর কেউ সামনে এলে তাকে সালাম দেবে।

এ হচ্ছে অনুমতি প্রার্থনা প্রসঙ্গ। অনুমতি চাওয়ার পর যদি অনুমতি দেয়া না হয়, কিংবা সালামের কোনো উত্তরই না আসে, তবে ফিরে যেতে হবে সেখান থেকে। ভেতরে কেউ নেই ভেবে অন্য কারও থাকার ঘরে অনুমতি ছাড়া প্রবেশের সুযোগ নেই। এমন তো হতেই পারে- ঘরে কেউ আছে, কিন্তু সে বাইরের কারও আওয়াজ শুনছে না কিংবা কাউকে তখন সে অনুমতি দিতে চাইছে না। তাই যদি ঘরে প্রবেশের অনুমতি না আসে কিংবা ফিরে যেতে বলা হয়, তখন প্রসন্ন মনেই ফিরে যেতে হবে। পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা-

فَاِنْ لَّمْ تَجِدُوْا فِیْهَاۤ اَحَدًا فَلَا تَدْخُلُوْهَا حَتّٰی یُؤْذَنَ لَكُمْ  وَ اِنْ قِیْلَ لَكُمُ ارْجِعُوْا فَارْجِعُوْا هُوَ اَزْكٰی لَكُمْ.

তোমরা যদি তাতে কাউকে না পাও, তবুও তাতে প্রবেশ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের অনুমতি দেয়া না হয়। যদি তোমাদের বলা হয়- তোমরা ফিরে যাও, তবে ফিরে যেও। এটাই তোমাদের জন্যে উৎকৃষ্ট পন্থা। -সূরা নূর (২৪) : ২৮

সাক্ষাৎ করতে এসে অহেতুক এত দীর্ঘ সময় নেয়া যাবে না, যা সাক্ষাৎদাতার জন্য বিরক্তি কিংবা কষ্টের কারণ হয়। কষ্ট তো কাউকেই দেয়া যায় না। আর এখানে সাক্ষাৎটা সৌজন্যের। সৌজন্যের সাক্ষাৎ যদি কষ্ট নিয়ে আসে, তবে তা আর কতটুকু ফলদায়ক হবে? যদি দীর্ঘ কথা বলার প্রয়োজন হয়, তবে আগেই অনুমতি নেয়া উচিত। সময় নিয়ে আসা উচিত। সর্বোপরি পরিবেশ-পরিস্থিতি সামনে রেখেই আলোচনা শুরু করতে হবে। যিনি সাক্ষাৎদাতা, মেহমানের আদব ও ভদ্রতা রক্ষা করতে গিয়ে তিনি তো সয়ে যাচ্ছেন, আর সাক্ষাৎপ্রার্থী একের পর এক নানা কথা বলেই যাচ্ছে- এটা চরম অশিষ্টাচার। এ বিষয়েও সতর্কতা জরুরি। বর্তমান সময়ে মানুষের নানা কাজকর্ম যেমন আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে, এর পাশাপাশি কাজের পরিমাণও যেন বেড়ে গেছে অনেক গুণ। চারদিকে কেবলই ব্যস্ততার আক্ষেপ। প্রত্যেকেই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই সৌজন্য সাক্ষাতে এসে দীর্ঘ সময় না নেয়া এখনকার বাস্তবতায় আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক।

প্রযুক্তির উন্নতিতে পারস্পরিক যোগাযোগ এখন আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে এসেছে। যেতে চাইলে সহজেই কোথাও যাওয়া যায়। আবার আধুনিক যোগাযোগমাধ্যম ফোনের মধ্য দিয়েও মেটানো যায় সৌজন্য সাক্ষাতের অনেকটা চাহিদা। তবে সাক্ষাতের যাবতীয় আদব ও শিষ্টাচার লক্ষ রাখতে হবে ফোন করার ক্ষেত্রেও। সৌজন্য রক্ষা করতে গিয়ে কাউকে বিরক্ত করা যাবে না, কারও কষ্টের কারণ হওয়া যাবে না, কারও সময় নষ্ট করা যাবে না, বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানো যাবে না। ফোনে দীর্ঘ সময় না নেয়ার বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষ রাখতে হবে। অনেকসময় এমন হয়- একজন জরুরি কোনো কাজে ব্যস্ত, এমনসময় অপর পাশ থেকে ফোন করে কেউ তার সঙ্গে বলে যাচ্ছে একের পর এক অপ্রয়োজনীয় কিংবা না বললেও চলে এমন কথা। অথচ সে একবারও ভেবে দেখার প্রয়োজন মনে করেনি- যার সঙ্গে কথা বলছি তিনি কোনো জরুরি কাজে ছিলেন কি না।

মনে রাখতে হবে, মুসলমানের সাক্ষাৎ কেবলই সাক্ষাৎ নয়। এর মধ্য দিয়ে যেমন আন্তরিকতা ও ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়, তেমনি সমৃদ্ধি আসে দুনিয়া-আখেরাত সর্বক্ষেত্রে। পারস্পরিক দেখাসাক্ষাতে কিংবা ফোনে কথাবার্তায় যখন নিজেদের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করে, এতে একদিকে একে-অন্যের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার সুযোগ হয়, এর পাশাপাশি মুমিনের পারস্পরিক কথাবার্তায় বিভিন্নরকম দুআও উচ্চারিত হয়। আর মুমিনমাত্রই এ দুআকে গনিমত মনে করে। একজনের ভালো কোনো সংবাদ শুনে আরেকজন তার জন্যে বরকতের দুআ করে, কষ্টের কথা শুনলে বিপদমুক্তির দুআ করে এবং সান্ত¡না দিয়ে ধৈর্যধারণের শক্তি যোগায়। এভাবেই সৌজন্য সাক্ষাতের মতো ছোট বিষয়ও হয়ে ওঠে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, নানাবিধ কল্যাণে ভরপুর। তবে সাক্ষাৎ ও যোগাযোগের এ কল্যাণ লাভ করতে হলে এর আদব ও শিষ্টাচারগুলো লক্ষ রাখতেই হবে, দিতে হবে সচেতনতার পরিচয়। এর কোনো বিকল্প নেই।

 

 

advertisement