যিলকদ ১৪৪৩   ||   জুন ২০২২

সততার সম্মান আল্লাহ রাখেন

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

একদিকে হাজার কোটি টাকা নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার খবর, আরেকদিকে রেলওয়ের একজন সাধারণ ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষকের অসাধারণ সাহস ও সততার গল্প সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়ে উঠেছিল এই মে মাসের শুরুর দিকে ঈদুল ফিতরের পর পর। প্রভাবশালী লোকজনের আত্মীয়স্বজনকে জরিমানা করা, চাকরিচ্যুতি, এরপর গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে লাখো মানুষের প্রতিবাদ ও সমর্থনের পথ বেয়ে আবার চাকরিতে ফিরে আসা- তিন-চারদিনের এই আনন্দ-বেদনার পর্বটি আর্থিক অবক্ষয়ের পঙ্কিলতার মধ্যে বড় আশা জাগিয়েছে। সরকারি চাকরির সাধারণ একটি স্তরে এমন সততার ঘটনা আর্থিক অবক্ষয়ের এই নানামুখী পঙ্কিলতার মধ্যে ঈমানদারী ও সততার একটি উজ্জ্বল পাঠ হয়ে উঠেছে।

ঘটনাটি ছিল গত ৫ মে রাতের। খুলনা থেকে ঢাকাগামী ট্রেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসে রেলমন্ত্রীর শ্বশুরবাড়ির দিকের তিন নিকটাত্মীয় বিনা টিকিটে ট্রেনে উঠেছিলেন। টিকিট ছাড়াই তাঁরা গিয়ে বসেছিলেন একটি কেবিনে। ভ্রাম্যমাণ টিকিট পরীক্ষক টিটিই শফিকুল ইসলাম তার দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে টিকিট পরীক্ষা করতে আসেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি টিকিটবিহীন তিন যাত্রীর টিকিট জরিমানাসহ কেটে দিয়ে চলে যান। এতটুকুই ছিল টিটিই-র দায়িত্ব পালনের ঘটনা। কিন্তু পরদিনই মোবাইল ফোনে ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার ফোনে তাকে জানানো হয় যে, রেলওয়ের চাকরি থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তবে বরখাস্তের কারণ হিসেবে এই ঘটনা কিংবা বাস্তব কারণ উল্লেখ না করে বরং বলা হয়, যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও অসদাচরণের কারণে তাকে রেলওয়ে থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

দুই.

এই ঘটনাটি প্রথম পর্যায়ে ছিল ব্যক্তিগত ঘটনা। সৎ টিটিই শফিকুল ইসলামের জন্য অনেক বেদনা ও কষ্টের। কিন্তু এদেশের সরকারি চাকরির পিচ্ছিল ও অসততাপূর্ণ নানান হাতছানি ও জোরাজুরির মধ্যে এটি কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ছিল না। উপরে-নিচে ক্ষমতা ও অসততা এখন এতটাই বেহায়া স্তর অতিক্রম করেছে যে, সৎ থাকার কারণে এবং প্রভাবশালীদের সঙ্গে সৎ অধিকার ও নিয়ম রক্ষার কারণে বিপদেপড়াটা খুব স্বাভাবিক ও সঙ্গত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু মন খারাপ করা এই ঘটনাটির খবর প্রথমে গণমাধ্যমে আসে এবং পরে সেই নিউজের সূত্র ধরে সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবে রেলমন্ত্রী, তার আত্মীয় এবং আরো বৃহত্তর পরিসরে মন্ত্রী ও তাদের আত্মীয়স্বজনের অবাধে সরকারি সম্পদ ব্যবহারের বিষয়ে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে। মন্ত্রী ও ক্ষমতাবান লোকদের লোভ ও জেদের কারণে সরকারি বিভিন্ন সেক্টরে বহু সৎ মানুষের যে কষ্ট ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়- এসব প্রসঙ্গও ব্যাপকভাবে আলোচনায় চলে আসে।

নিন্দা-সমালোচনা, প্রতিবাদের একপর্যায়ে রেলমন্ত্রী নিজে সাংবাদিক সম্মেলন করে টিটিই শফিকুল ইসলামকে চাকরিতে পুনর্বহালের কথা ঘোষণা করেন। মন্ত্রী প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে সাংবাদিকদের বলেন, টিটিইর বিরুদ্ধে রেলওয়ে কর্মকর্তাদের ফোন করেছিলেন তার স্ত্রী। আর টিকিটবিহীন যাত্রীরা ছিল তার স্ত্রীর ভাগ্নে ও ভাই। তাদের অসন্তোষের কারণেই চাকরি হারাতে হয়েছিল শফিকুল ইসলামকে।

তিন.

এই ঘটনায় ব্যক্তি শফিকুল ইসলামের চেয়েও দেশবাসীর আবেগ ও ভালবাসার জায়গাটি দখল করেছিল রেলওয়ের একজন অস্বচ্ছল অথচ সৎ-সাহসী টিকিট পরীক্ষকের সততার ঘটনাটি; আর একইসঙ্গে ক্ষমতাসীন মন্ত্রীর পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে অহংকারপূর্ণ জুলুমের ঘটনাটিও সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ক্ষমতার অপব্যবহার ও অসততার ফলে দেশজুড়ে নানারকম বিপর্যয়ের খবর ভাসছে। দুর্নীতি, লুটপাট ও ক্ষমতার অবাধ চর্চার বিভিন্ন বিষয় মানুষের আলোচনায়। পিকে হালদারসহ লুটপাটকারী চক্রের টাকা পাচারের কাহিনী  শুনতে শুনতে মানুষের মন ভারাক্রান্ত। বাজারে জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। শ্রীলংকার আর্থিক দুর্যোগের কালো ছায়া তাড়া করছে দেশের মানুষকে, মানুষের মন ও মস্তিষ্ককে।

ক্ষমতার চেয়ার ব্যবহার করে অনেক রকম অন্যায়-অসততার কথা জানলেও এ ঘটনাটিতে বেশিরভাগ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। একদিক থেকে শেষ পর্যন্ত এ ঘটনাটি সাধারণ মানুষের মনে সান্ত¡না ও স্বস্তি এনে দিয়েছে। অপরদিক থেকে ক্ষমতার অসৎ ও অন্যায় চর্চা এখানে একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে। আমর বিল মারুফ ও নাহি আনিল মুনকারের যে শ্বাশ্বত বোধ ও অনুভূতি তা এ ঘটনায় ব্যাপকভাবে উজ্জ্বল ও উচ্চারিত হয়েছে।

চার.

শফিকুল ইসলামকে প্রথমে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছিল রেলমন্ত্রীর সদ্য বিবাহিতা (প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর) স্ত্রীর ফোন-নির্দেশে। জরিমানা দিয়ে টিকিট কাটার কারণে তিনি তার ভাগ্নে ও মামাতো ভাইদের অপমান মেনে নিতে পারেননি। তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। রেল বিভাগের কর্মকর্তারাও মন্ত্রীর স্ত্রীর কথায় একজন সৎ প্রশংসিত কর্মীকে বরখাস্ত করেছিল কোনো চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই। ক্ষমতার অনৈতিক চর্চার কতটা বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে দেশে- এ ঘটনায় সেটা স্পষ্ট হয়েছে। মন্ত্রীর শক্তিতে তার স্ত্রী, তার স্ত্রীর ভাগ্নে-ভাইয়েরা পর্যন্ত অবৈধ সুবিধা ও ক্ষমতা প্রয়োগে পারঙ্গম হয়ে উঠেছে। আরেকটি ব্যাপার হল, এ ঘটনায় দেখা গেছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এবং সেখানে কর্মরত কর্মী-কর্মকর্তাদের কী পরিমাণ আজ্ঞাবহ গৃহকর্মীর দৃষ্টিতে মন্ত্রীর পরিবারের লোকেরা দেখে অভ্যস্ত হতে পারে- তার একটি নমুনা পাওয়া গেছে। পুরো মন্ত্রণালয়ের সব সেবা ও সুবিধা যেন তাদের একচ্ছত্র পারিবারিক জমিদারি- এমন অনুশীলন প্রকট হয়ে উঠেছে। এ বিষয়গুলো শুধু এ ঘটনার সঙ্গে এবং এ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়, আগেও এমন চিত্র দেখা গেছে। এটা হচ্ছে অবৈধ ক্ষমতা ও সুবিধা চর্চার একটি কুৎসিত দিক।

অবশেষে সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ব্যাপক প্রতিক্রিয়া-প্রতিবাদের কারণে এখানে ক্ষমতাকে নতি স্বীকার করতে হয়। অবশ্য বিভাগীয় তদন্তে আলোচিত টিটিই শফিকুল ইসলাম নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। অপরদিকে মন্ত্রীর স্ত্রী ও তার ভাগ্নেদের ক্ষমতা চর্চার জন্য কারো বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। টিটিইকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে দিয়েই পারিবারিক ক্ষমতা চর্চার অন্যান্য অপরাধ ও দায়ের বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছে।

পাঁচ.

বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানা গেছে, আলোচিত টিটিই শফিকুল ইসলাম ঝিনাইদহের একটি সৎ দ্বীনদার ও সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের মানুষ। তাকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনার দিনই তিনি প্রায় ৫০ হাজার টাকার মতো জরিমানা আদায় করেছেন। তার এলাকা ও পরিচিতজনদের সবাই তার প্রশংসা করেছে। এসব সৎ দ্বীনদার মানুষ কেবলমাত্র রেলওয়ে নয়, সরকারের সব কয়টি বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের জন্য অত্যন্ত দরকারি ও উপকারী মানুষ। অসৎ ক্ষমতাওয়ালারা বিভিন্ন বিভাগে এসব মানুষকে কাজহীনকোণঠাসামানুষে পরিণত করে রাখে। অথচ এসব মানুষ সক্রিয় থাকলে, তাদের সততা ও আমানতদারীর সাথে কাজ করতে দিলে শুধু তিনি নিজে উপকৃত হবেন এমন নয়, বরং ওই বিভাগ ও দেশ উপকৃত হবে। অসাধুতা ও অনিয়ম যাদের নীতি ও চর্চায় থাকে তারা এই উপকারের বিষয়গুলো দেখতে পারে না। এভাবেই রেলওয়ে, বেসামরিক বিমান, খাদ্যখাতসহ বহু সেবাখাতে দুর্নীতি ও দুর্বল সেবাতে সয়লাব। অথচ উপরে-নিচে সৎ লোকদের সততার সঙ্গে কাজ করতে দিলে এসব বিভাগের চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠত।

সরকারি-বেসরকারি বহু বিভাগে, নাগরিক স্বার্থ ও সেবার অঙ্গনে যারা সততার সঙ্গে চলেন ও চলতে চান তাদের জন্য প্রথম অনুকরণীয় দ্বীন ও শরীয়তের নীতিগত নির্দেশনা ও দায়িত্বগত স্বচ্ছতার প্রেরণা। মন্দ বিষয়কে রুখে দেওয়া ও প্রতিহত করা প্রত্যেক মুসলমানের করণীয়। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ رَأَى مِنْكُمْ مُنْكَرًا فَلْيُغَيِّرْهُ بِيَدِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِلِسَانِهِ، فَإِنْ لَمْ يَسْتَطِعْ فَبِقَلْبِهِ، وَذَلِكَ أَضْعَفُ الْإِيمَانِ.

তোমাদের মধ্যে যে কোনো অন্যায় দেখবে, সে নিজ হাতে সেটি পরিবর্তন করবে। যদি তাতে সক্ষম না হয় তবে মুখে পরিবর্তন করবে। যদি তাতেও সক্ষম না হয় তাহলে অন্তরে সেই মন্দ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা পোষণ করবে। এবং এটিই সবচেয়ে দুর্বল ঈমান। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৮

সততার পুরস্কার আল্লাহ তাআলা আখেরাতে অবশ্যই দেবেন। হালাল উপার্জন জীবন ও ইবাদতের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জুলুম ও অসাধুতা অপূরণীয় ক্ষতির কারণ। অপরদিকে সৎভাবে চলতে চাওয়া পেশাজীবীদের একটি নগদ পুরস্কার হল, জীবনের স্বস্তি এবং মানুষের অন্তরের সম্মান। অসৎভাবে কোটি টাকা কামাই করেও কেউ এ স্বস্তি ও সম্মান অর্জন করতে পারে না। গরীব সৎ টিটিই শফিকুল ইসলামের পক্ষ হয়ে ক্ষমতার সঙ্গে লড়ার কেউ ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা কোটি মানুষকে তার জীবিকা ও ইজ্জতের জন্য লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়েছেন। শক্তিমান মন্ত্রী ও তার লোকজনকে লজ্জা পেতে হয়েছে, নতি স্বীকার করতে হয়েছে। সততার সম্মান আল্লাহ দেন, সততার পুরস্কার আল্লাহ দেন।

 

 

advertisement