যিলকদ ১৪৩১   ||   নভেম্বর - ২০১০

সংবিধান সংশোধন : কিছু কথা - ২

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

গত এক মাসে সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ায় আরো এক ধাপ অগ্রসর হয়েছে ক্ষমতাসীন সরকার। এরই মধ্যে তারা হাইকোর্টের রায় ও আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ ও সংশোধনের আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং প্রকাশিত তথ্যমতে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অর্থাৎ বহুল বিতর্কিত একটি বিষয়ের দুই মতের একটিকে গ্রহণ করে সে পথে অগ্রসর হয়েছেন তারা।

বিতর্কিত বিষয়টি হচ্ছে, সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার আদালতের না সংসদের এবং আদালতের রায়ের পর সংবিধান আপনা আপনি সংশোধিত হয়ে গেছে নাকি তা সংসদের মাধ্যমে করতে হবে। বাহাত্তরের সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন এবং আইনমন্ত্রী শফিক আহমদসহ অল্প কয়েকজন ছাড়া সংশ্লিষ্ট প্রায় সকলের মতই হচ্ছে, সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করতে হবে সংসদের মাধ্যমে। দেশের দুই প্রধান দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মহাসচিবগণও সংবিধান সংশোধনে সংসদের সার্বভৌমত্বের পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। তথাপি গত কয়েক দিনে সরকার তার অবস্থান বদলে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিতর্কিত বিষয়টিকে সংবিধানে পুনর্বহালের ব্যাপারে সরকার আদালতের উপর ভর করেই চলতে চায়। সংসদের মাধ্যমে কাজটি করলে জনগণের বিরাগভাজন হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে সম্ভবত এই ধারণা থেকেই তারা তা করতে চাইছেন। কিন্তু রায়ের আলোকে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ হয়ে গেলে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির কাজ কী থাকবে এবং তার লক্ষ্য ও কর্মপরিধিই বা কী হবে, তা কিন্তু এখনো জনগণ জানতে পারেনি।

সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধন বিষয়ে মৌলিকভাবে দুটি বিষয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন : ১. একটি রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়ন ও সংশোধনের প্রক্রিয়া কী হবে ২. কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কী কী উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধন করা উচিত এবং সংবিধানে কোন কোন বিষয়গুলো স্থান পাওয়া উচিত।

উপরোক্ত বিষয় দুটির ইসলামী নীতিমালা তথা শরীয়তের আলোকে কথা বললে তা হবে একরকম আর প্রচলিত পদ্ধতিতে এর বিশ্লেষণ হবে ভিন্নধর্মী। যেহেতু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশের শতকরা ৯০ ভাগ লোক মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও এখানে শরীয়ার বিধান চালু নেই এবং আমাদের সংবিধানও সে আলোকে প্রণিত হয়নি তাই আমরা চলমান পরিসি'তি সামনে নিয়ে এ বিষয়ে কথা বলছি। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে সংবিধানের প্রয়োজনীয়তা ও মূলনীতি এবং আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি সম্পর্কে আলকাউসারের পাতায় ভবিষ্যতে পৃথক প্রবন্ধ ছাপানোর চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

আমাদের বাংলাদেশীদের (হাইকোর্ট বিভাগ বাঙ্গালিত্বে ফিরিয়ে নিলেও আপিল বিভাগের সংশোধনীতে জাতীয়তা বাংলাদেশীই থেকে গেছে।) অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হচ্ছে আমরা অতি দ্রুত সংবিধান প্রণয়ন ও তা কয়েক মিনিটে সংশোধন করে ফেলতে  সিদ্ধহস্ত। আবার জনগণের মনে না আসা কথাও তাদের অন-র থেকে খুব ভালোভাবে বুঝে ফেলতে পারি। তবে তা একেক সময় একেক রকম এবং একেক নেতার একেক রকম। আবার কখনো বা একই নেতা ৩৮  বছর আগে এক অবস্থানে এবং ৩৮ বছর পর চিন্তা ও যুক্তির অন্য অবস্থানে।

তা না হলে স্বাধীনতার পর অতি অল্প সময়ে ভারতে গিয়ে আমাদের সংবিধান তৈরি হত না এবং ২৫ বছরেরও বেশি আগে তৈরি হওয়া ভারতীয় সংবিধানের মৌলনীতিগুলো আমাদেরকে ধার করতে হত না। যদি এই দুই দেশের সংবিধানের একই প্রকার মূলনীতি হতে হয় তবে বৃটিশদের চলে যাওয়ার পর দুটি রাষ্ট্র হওয়ার কী প্রয়োজন ছিল এবং এদেশীয় নেতৃবৃন্দ ও জনগণ বিভক্ত ভারতের পক্ষেইবা গেলেন কেন?

বাহাত্তরের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে আত্মনিয়োগে বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও      ধর্মনিরপেক্ষতা। ৫ম সংশোধনীতে তা সংশোধিত হয়েছে এভাবে-জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মনিয়োগে ও বীর শহীদদেরকে প্রাণোৎসর্গ করতে উদ্ধুদ্ধ করেছিল সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হবে।

দেখা গেল যে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ কী কী উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে হয়েছে তা নির্ণয় করতে গিয়ে এবং সংবিধানে তা উল্লেখ করতে গিয়ে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছেন। আবার তারা যেনতেন নেতা নন। একপক্ষে আছে বাংলাদেশের প্রথম আইনমন্ত্রীর মতো ব্যক্তিবর্গ, অন্য পক্ষে রয়েছে খোদ স্বাধীনতার ঘোষক (মতান্তরে ঘোষণাপত্রের পাঠক) এবং মুক্তিযুদ্ধের এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার-এর মতো ব্যক্তিবর্গ। আবার আরেকজন বড় আইনজ্ঞ ও রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বাহাত্তর-এর সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে থেকেও ভিন্নমতের কারণে তাতে স্বাক্ষর করেননি। এখন কিন্তু তিনিই আবার বাহাত্তর-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার পক্ষে জোরালো কথা বলছেন। অথচ তখন সুরঞ্জিত বাবু এবং তার দল ন্যাপ-এর নেতারা (যাদের মধ্যে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও রয়েছেন।) দস্তুরমতো প্রচারপত্র বিলি করে বাহাত্তর-এর খসড়া সংবিধানের কঠোর সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সকল দলই ঐ সংবিধানের বিরোধিতা করেছিল। অর্থাৎ প্রথম সংবিধান প্রণয়নের সময় সাধারণ জনগণ তো দূরে থাক তখনকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে পর্যন্তস্থায় নেওয়া হয়নি।

এরপর সে সংবিধান প্রণেতারাই ১৯৭৫ সালে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তাতে কুঠারাঘাত করেছিলেন। বদলে ফেলেছিলেন এর মৌলিক কাঠামোগুলো। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সংসদে ঐ সংশোধনী পাশ করা হয়েছিল। মোটকথা, পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে সংবিধান প্রণয়ন ও এর সংশোধনী প্রক্রিয়ায় পক্ষ-বিপক্ষ ও দলমত নির্বিশেষে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া হলেও আমাদের দেশে কখনো তা করা হয়নি। এ কারণেই অনেক উদ্ভট কথাকেও জনগণের নামে চালিয়ে দিয়ে সেটিকে সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ দলীলের অংশই শুধু নয়; বরং মূলনীতিও বানিয়ে ফেলা যায় এ দেশে।

এরই একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হল ধর্মনিরপেক্ষতা।ক্ষমতাসীন দলের (বরং বলা দরকার জোটের) অতি উৎসাহী যেসকল লোক বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন তাদের মতলব অন্য কিছুই নয়। তারা চাচ্ছেন, শুধুই                ধর্মনিরপেক্ষতাশব্দটির পুনর্বহাল। কারণ ঐ সংবিধানের মৌল কাঠামো তো তারাই শেষ করে দিয়েছেন। সেখানে ছিল গণতন্ত্রের কথা। তারা চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে চালু করেছেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা। সেখানে ছিল সমাজতন্ত্রের কথা। আর বর্তমান সরকার অর্থনীতিতে পাকা-পোক্ত পুঁজিবাদী। তা হলে আর কীসের উদ্দেশ্যে বাহাত্তর-এর সংবিধানের জন্য এত মায়াকান্না? তাদের অনেকেই এ ব্যাপারে রাখঢাক না করেই ধর্মনিরপেক্ষতার কথাই বড় করে বলছেন।

এখন প্রশ্ন হল, বাহাত্তরের সংবিধানে যে বলা হয়, বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ ধর্মনিরপেক্ষতার উদ্দেশ্যে মুক্তিসংগ্রামে নেমে প্রাণোৎসর্গ করেছেন এর রচয়িতাগণ তা বুঝলেন কীভাবে? ঐতিহাসিক ৬ দফা, ৭০ এর নির্বাচন, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণসমূহে বিশেষত মার্চের ভাষণের কোনো জায়গায় কি এ শব্দটির উচ্চারণ ছিল? নিশ্চয় নয়; বরং তখনকার এবং পরবর্তী পরিসি'তি থেকে এর উল্টোটাই প্রমাণিত হয়। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম মাস মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব তো বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বকথা বলার পর ইনশাআল্লাহশব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন, যা ইসলাম ধর্মের একটি বিশেষ নীতিগত শব্দ। ভবিষ্যতের কোনো অঙ্গিকারের ক্ষেত্রে বিশ্বাসের সাথে যা ব্যবহার করতে হয়। বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাগণ বা তাদেরকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা ও সমর্থন দানকারী সাধারণ জনগণকে কি কখনো জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, তারা          ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য লড়াই করেছেন কি না? পাকিস্তানের সাথে কি ধর্ম নিয়ে আমাদের কোনো দ্বন্দ্ব ছিল, নাকি  পাকিস্তানের শাসকগণ ইসলামী শরীয়া মেনে চলত? তা না হলে কেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানে সংযোজন করা হল এবং কেনই বা আবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সে অবাস্তব ও মিথ্যা কথাটিকে এখন সংবিধানের অংশ বানানো হচ্ছে?

স্বাধীনতার সময়ের মানুষজন তো এখনকার সময়ের লোকদের থেকে অনেক বেশি ধার্মিক ছিলেন। তখন প্রকাশ্য গুনাহর উপায়-উপকরণও কম ছিল। আকাশ-সংস্কৃতির আগ্রাসনও ছিল না। তাদের কথা বাদই থাক, সাহস থাকলে সরকার এখনকার বাংলাদেশের জনগণের মধ্যেই জরিপ বা গণভোট করে দেখুন-এদেশের কতভাগ লোক ধর্মনিরপেক্ষতা চায়। যদি এই সাহস থাকত তাহলে ক্ষমতাসীনরা সংসদের মাধ্যমেই এ বিষয়টিকে পুনঃস্থাপিত করে নিজেদের কৃতিত্ব জাহির করতে পারত। আদালতের রায়ের উপর ভর করে তড়িঘড়ি সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করে তা পুনঃস্থাপিত করার প্রয়োজন হত না।

প্রশ্ন হতে পারে যে, আমাদের দেশে তো আর শরীয়া আইন নেই। মানুষের তৈরি আইনেই দেশ চলে থাকে, তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে থাকলে সমস্যা কোথায়। এর জবাব হল, সমস্যা দুই জায়গায় : ১. একটি সম্পূর্ণ অবাস্তব বিষয়কে বীর মুক্তিযোদ্ধাগণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের উদ্দেশ্য হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা তারা কখনো চাননি এবং স্বাধীনতাসংগ্রামের লক্ষ্যউদ্দেশ্যের মধ্যে কখনো তা ছিল না। ২. এর হীন উদ্দেশ্য মূলত আরো অনেক গভীরে। আদালতের রায় পাওয়ার পর মুষ্টিমেয় মতলববাজরা অবশ্য তা ভিতরে ধরে রাখতে পারেননি। তারা বলতে শুরু করেছেন, এ রায়ের ফলে দেশে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। নির্বাচনকমিশনের কর্তব্য হল ঐ দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা। কিছু দিনের মধ্যেই জাতি দেখতে পেল আরেকটি উচ্চ মহলের রায়, যাতে বলা হল, কোনো মহিলাকে বোরকা পরিধান করতে কেউ বাধ্য করতে পারবে না। কারণ উচ্চ আদালতের রায়ের পর দেশে এখন ধর্মনিরপেক্ষতা এসে গেছে তাই ধর্মীয় বিষয়ে কাউকে বাধ্য করা যাবে না।

যে সকল ধার্মিক ব্যক্তি সরলমনে বা অন্য কোনো কারণে                   ধর্মনিরপেক্ষতাকে একটি কথার কথা ভেবে থাকেন বা বলে থাকেন এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতা এক নয় এমন গালগল্পে বিশ্বাস করে থাকেন তাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য ঐ এক বোরকা বিষয়ক ফরমানই যথেষ্ট হওয়া উচিত। এবং এটি এ বিষয়ক পদক্ষেপের শেষ নয়, শুরু মাত্র। আদালতের রায়ের উপর ভর করে যদি সংবিধান স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংশোধিত হয়ে যায় তবে মুসলমানদের ঈমান-আমল এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ধ্বংসের জন্য বোরকার মতো রায় একের পর এক আসতেই থাকবে। কারণ       ধর্মনিরপেক্ষতা তো সংবিধানের মৌলিভিত্তি স্বরূপ দলীল হিসেবে থাকছেই। ক্ষমতাসীনদেরকেও বলা যাবে না যে, আপনারা তো বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন বানাবেন না, এখন তাহলে কী হচ্ছে? কারণ তারা জবাবে বলতে পারবেন, আসলে বিষয়টি তো আদালতের, আমরা তো কিছুই করিনি। আর আদালতের রায়ের উপর আমল না করলে তো আবার অবমাননাহয়ে যায়, সুতরাং আমরা বাধ্য। আমরা দায়ী নই।

আচ্ছা গত ৩০ বছর যে বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল না তাতে কি দেশ ৭৪, ‘৭৫ সালের অবস্থা থেকে পিছিয়ে গেছে? এর মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রায় ৭ বছর এবং কয়েকটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন বছরেরও অধিককাল দেশ শাসন করেছে। তারা কি কোনো পর্যায়ে রাষ্ট্র ও জনগণের উন্নয়নে ধর্মনিরপেক্ষতার অভাব অনুভব করেছেন? এ ত্রিশ বছরে কি সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা নেই-এ দোহাই দিয়ে কোনো সংখ্যালঘু ধর্মের নাগরিককে রাষ্ট্র বা আইন, সরকার বা আদালত কোনো রকম ক্ষতি বা নির্যাতন করতে পেরেছে? এসবের উত্তর যদি   নাই হয় তা হলে কেন আবার               ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য এত তোড়জোড়। কেন দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ বড় বড় আইনজ্ঞ ও  সংবিধান বিশেষজ্ঞের মতকে উপেক্ষা করে সংসদে বিল না এনে আদালতের রায়কেই স্বয়ংক্রিয় সংবিধান সংশোধনরূপে মেনে নেওয়া হচ্ছে?

এর কারণ একটু আগেই উল্লেখ করেছি। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলটির বড় সীমাবদ্ধতা এখানেই। এর মূল নেতা- নেত্রী (সাবেক ও বর্তমান) কথাবার্তা এবং অনেক ক্ষেত্রে চাল-চলনে ধর্মের ব্যাপারে যত উদারতাই প্রদর্শন করুন না কেন, তাদের দলে ঘাপটি মেরে থাকা মুষ্টিমেয় কিছু লোক বরাবরই বিতর্কিত কথাবার্তা ও কাজকর্ম দ্বারা দলটিকে অজনপ্রিয় করে তুলে থাকে। এ মুষ্টিমেয় শ্রেণীর মূল চালিকা শক্তি হয়ে থাকে সমমনা বলে পরিচিত অতি ক্ষুদ্র কিছু রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রী এবং তথাকথিত প্রগতিশীল কয়েকজন বুদ্ধিজীবী। যে কেউ নজর দিলেই দেখতে পাবেন যে, তড়িঘড়ি সংবিধান সংশোধনের জন্য কাদের আগ্রহ বেশি। নৌকা প্রতীক নিয়ে এক, দুজন করে নির্বাচিত হওয়া ভিন্ন দলের সংসদ সদস্যদের, নাকি দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন পাওয়া মূল আওয়ামী লীগারদের, সংসদ সদস্য হয়ে মন্ত্রী হয়ে গেছেন এমন ব্যক্তিদের, নাকি সংসদ সদস্য না হয়েও অন্য কারণে মন্ত্রী হয়ে গেছেন এমন ব্যক্তিদের। কাদের অবাঞ্চিত উক্তি ও কর্মকাণ্ড বারবার আওয়ামী লীগ সরকারকে ধার্মিক জনগোষ্ঠির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে থাকে, তা একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই সহজে অনুমেয় হবে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে স্থান পাওয়া রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিল করা হবে না। যদি তাই হয়, তাহলে ধর্ম নিরপেক্ষতা সংবিধানে স্থান পায় কী করে? আদালত রায় দিয়েছেন ধর্ম নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনার, সে রায়ের ব্যাপারে তো আর বিরূপ মন্তব্য করা যাবে না। কিন্তু জননেন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী তো গণতান্ত্রিক নেত্রী, তাঁর কথার তো সমালোচনা করা বৈধ। প্রশ্ন হল, ধর্ম নিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এক সাথে চলতে পারে কি না?

আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, কোনোক্রমেই আমাদের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতাফিরিয়ে আনা উচিত হবে না। এমনকি যদি আদালতের রায়ের কারণে কারো কারো মত অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা পুন:স্থাপিত হয়েও গিয়ে থাকে তবুও বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অধিকারী সরকারের কর্তব্য হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তা বাতিল করে দেওয়া। মনে রাখতে হবে যে, ভবিষ্যতে মুষ্টিমেয় মোসাহেব লোকের ভোটে তারা ক্ষমতায় আসতে পারবেন না। পুনরায় ক্ষমতায় যেতে হলেও তাদেরকে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। যাদের অধিকাংশই স্বভাবত ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। এছাড়া এ শব্দটির সুযোগে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল ষড়যন্ত্র করে বা না বুঝেই এমন সব কথা বা কাজ করে বসবে (বোরকা এর একটি ছোট উদাহরণ মাত্র।) যা দেশে অসি'তিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। রাষ্ট্রের বড় বড় প্রতিষ্ঠান এবং উচ্চ মর্যাদার ও পদের লোকদের উপর জনগণের অনাস্থা বাড়াতে পারে, যা প্রকারান্তরে দেশ ও জনগণের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হবে। নির্বাচনী ইশতিহারে ক্ষমতায় গেলে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোনো আইন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে বিশাল শ্রেণীর আস্থা অর্জনের চেষ্টা করা হয়েছিল অবাঞ্চিত ও বিতর্কিত ধর্ম নিরপেক্ষতাঐ একই শ্রেণীর বিরাগভাজন করবে ক্ষমতাসীন দলকে। সুতরাং দলের ও দেশের মূল নেতৃত্বকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিত হবে।

যদি কেউ ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা রাষ্ট্রের অন্যান্য ধর্মের লোকদের স্বার্থ রক্ষার সৎ উদ্দেশ্যে বলে থাকেন তাহলে তা এই দেশে ইতিমধ্যেই আছে। এখানে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু জনগণও নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করছেন। যুগ যুগ থেকে মুসলমানদের সাথে তাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছে। এর জন্য ধর্ম নিরপেক্ষতাশব্দ সংবিধানে যোগ করার প্রয়োজন না আগে ছিল, না বর্তমানে আছে। দেশে শরীয়া আইন থাকলে তো ধর্ম নিরপেক্ষতা বা রাষ্ট্র ধর্মের কোনো প্রশ্নই আসত না। কারণ শরীয়া আইনে সংখ্যালঘুদের পরিপূর্ণ ধর্মীয়, মানবিক ও নাগরিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা আছে।

আরেকটি কথা। সংবিধানের মূলনীতিতে গণতন্ত্রের কথাও আছে। আমাদের দেশের নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের মালিক বলা হয়েছে জনগণকে। তা হলে কয়েকজন নেতা-নেত্রীর কথায় বা কোনো ব্যক্তি বিশেষের রায়ে জনগণকে আস্থায় না এনে সংবিধানের মূলনীতি সহজেই রচনা বা পরিবর্তন করে ফেললে গণতন্ত্র থাকল কোথায়? দেশের নাম প্রজাতন্ত্র এবং জনগণকে তার মালিক বলে লাভ হল কি?

আমরা মনে করি, সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহথাকা এবং রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামথাকা যতটুকু জরুরি তার চেয়েও বেশি জরুরি বিতর্কিত ও অপ্রয়োজনীয় ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সংবিধানে স্থান না দেওয়া। এ ব্যাপারেও যে কোনো ভুলের খেসারত দিবে ক্ষমতাসীন দল, চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে রাষ্ট্র ও জনগণ। আর তাতে খুশি হবে মুষ্টিমেয় কিছু চিহ্নিত ব্যক্তি।

 

advertisement