যিলকদ ১৪৪৩   ||   জুন ২০২২

কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতের গুরুত্ব ও ফযীলত

মুহাম্মাদ আশিক বিল্লাহ তানভীর

মাত্র এক মাস হল কুরআন নাযিলের মাস রমযানুল মুবারক গত  হয়েছে। এ মাসে মুমিন মাত্রই কুরআনের সাথে এক অকৃত্রিম স্বর্গীয় সখ্যতা গড়ে উঠেছে। দিনের সিয়াম, রাতের কিয়াম, তারাবীহ-তাহাজ্জুদ, যিকির-তিলাওয়াত ও অন্যান্য নেক আমলের মাধ্যমে প্রাণবন্ত হয়েছে তার ঈমানী যিন্দেগী। সজীবতা ফিরে পেয়েছে তার ঈমানী চেতনা।

বস্তুত রমযানকে ঘিরে কুরআন মাজীদের সাথে একজন মুমিনের সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। কুরআনের নূরে স্নাত হয় তার দেহমন। আল্লাহ তাআলা কুরআনের সাথে   মুমিনের সম্পর্কের চিত্রায়ণ করেছেন অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিমায়-

اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِیْنَ اِذَا ذُكِرَ اللهُ وَ جِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَ اِذَا تُلِیَتْ عَلَیْهِمْ اٰیٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِیْمَانًا وَّ عَلٰی رَبِّهِمْ یَتَوَكَّلُوْنَ.

মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করা হয় তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে। -সূরা আনফাল (০৮) : ০২

রমযানে একজন মুমিন বান্দা তাকওয়ার যে চর্চা করেছে তা বছরব্যাপী অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন কুরআনের সাথে এই সেতুবন্ধন অটুট ও অক্ষুণ্ন রাখা।  পবিত্র রমযানুল মুবারকের ওসিলায় কুরআনের সাথে আমাদের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার প্রধান একটি উপলক্ষ্য হচ্ছে তিলাওয়াতে কুরআন। বছরজুড়ে যদি আমরা তিলাওয়াতের এ ধারা অব্যাহত রাখি, পাশাপাশি যদি জাগরূক থাকে কুরআনের বার্তা ও বিধানের উপলব্ধি তাহলে আমাদের ঈমানী নূর আরো উদ্দীপ্ত হবে, কলব যিন্দা থাকবে এবং তাকওয়ার সোপান বেয়ে আল্লাহর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি লাভের একটি কার্যকরি মাধ্যম সাব্যস্ত হবে, ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّ الَّذِیْنَ یَتْلُوْنَ كِتٰبَ اللهِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً یَّرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ، لِیُوَفِّیَهُمْ اُجُوْرَهُمْ وَ یَزِیْدَهُمْ مِّنْ فَضْلِهٖ  اِنَّهٗ غَفُوْرٌ شَكُوْرٌ  .

যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি তা থেকে (সৎকাজে) ব্যয় করে গোপনে ও প্রকাশ্যে, তারা এমন ব্যবসার আশাবাদী, যা কখনও লোকসান হয় না, যাতে আল্লাহ তাদেরকে তাদের পূর্ণ প্রতিফল দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরও বেশি দান করেন। নিশ্চয়ই তিনি অতি ক্ষমাশীল, অত্যন্ত গুণগ্রাহী। -সূরা ফাতির (৩৫) : ২৯-৩০

কারো কারো কথা ও কাজ থেকে মনে হয়, তিলাওয়াত শুধু রমযানের জন্য। না, এমনটি কখনই নয়। কুরআনের তিলাওয়াত গোটা বছরের জন্য, সারা জীবনের জন্য। কুরআন-সুন্নাহ্য় তিলাওয়াতে কুরআনকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবং এর জন্য ঘোষণা করা হয়েছে নানাবিধ ফযীলত। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা এমনই কিছু উদ্ধৃতি উল্লেখ করব, ইনশাআল্লাহ।

নবীজী নিজেও তিলাওয়াত করতেন এবং সাহাবীদের থেকেও তিলাওয়াত শুনতেন

নবীজী অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করতেন। হাদীস ও সীরাতের কিতাবে এর বিশদ বিবরণ পাওয়া যায়। নামাযে, নামাযের বাইরে, রাতের আঁধারে, দিনের আলোতে সর্বাবস্থায় তিনি তিলাওয়াত করতেন। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, নামাযে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নবীজী এত দীর্ঘ সময় তিলাওয়াত করতেন যে, তাঁর পা মুবারক ফুলে যেত। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮১৯, ২৮২০)

রমযান মাসে হযরত জিবরীল আ.-কে নবীজী পূর্ণ কুরআন শোনাতেন এবং জিবরীল আ. থেকেও পূর্ণ কুরআন শুনতেন। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৬)

রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে নিজে তিলাওয়াত করতেন তেমনি সাহাবীদের থেকেও তিলাওয়াত শুনতেন। একবার নবীজী আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে বললেন, তুমি আমাকে একটু তিলাওয়াত করে শোনাও তো। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আপনাকে তিলাওয়াত শোনাব, আপনার উপরই তো কুরআন নাযিল হয়েছে! নবীজী বললেন, আমার মনে চাচ্ছে, কারো থেকে একটু তিলাওয়াত শুনি! এ শুনে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সূরা নিসা তিলাওয়াত করতে শুরু করলেন। পড়তে পড়তে যখন এ আয়াত পর্যন্ত আসলেন-

فَكَیْفَ اِذَا جِئْنَا مِنْ كُلِّ اُمَّةٍۭ بِشَهِیْدٍ وَّ جِئْنَا بِكَ عَلٰی هٰۤؤُلَآءِ شَهِیْدًا.

[সুতরাং (তারা ভেবে দেখুক) সেই দিন (তাদের অবস্থা) কেমন হবে, যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং (হে নবী), আমি তোমাকে ওইসব লোকের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে উপস্থিত করব? -সূরা নিসা (০৪) : ৪১]

এতটুকু তিলাওয়াত করার পর নবীজী বললেন, ঠিক আছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, নবীজী থামতে বলার পর আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখি, তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৫৫, ৪৫৮২, ৫০৪৯)

যারা তিলাওয়াত করে তাদেরকে আল্লাহর রহমত আচ্ছাদিত করে নেয়

কুরআন মাজীদ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র কালাম। যারা আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত করে, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা তথা তাদাব্বুর-তাফাক্কুর করে, কুরআন থেকে হেদায়েত গ্রহণ করে, কুরআন শিক্ষা দেয় এবং পারস্পরিক কুরআনের চর্চা করে আল্লাহ তাদের প্রতি অত্যন্ত খুশি হন। তাদের উপর বিশেষ রহমত বর্ষণ করেন, তাদের অন্তরে প্রশান্তি ঢেলে দেন এবং তাদের মর্তবা বুলন্দ করতে থাকেন। আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

...وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ، يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ، إِلّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمِ السّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمُ الرّحْمَةُ وَحَفّتْهُمُ الْمَلَائِكَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ.

...আর যারা আল্লাহর ঘরে একত্র হয়ে আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে এবং পারস্পরিক কুরআনের চর্চা করে, তাদের প্রতি সাকীনাতথা এক প্রকার বিশেষ প্রশান্তি বর্ষিত হয়, রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং আল্লাহ তাঁর কাছের ফিরিশতাদের মাঝে তাদের আলোচনা করেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯

আল্লাহ আমাদেরকে সেই মোবারক কাফেলায় শরীক করে নিন- আমীন।

কুরআন তিলাওয়াত : যার প্রতি হরফে রয়েছে দশ নেকী

কুরআন কারীমের তিলাওয়াতে রয়েছে বহুবিধ কল্যাণ ও উপকারিতা। জাগতিক, পারলৌকিক, বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক। পৃথিবীর বুকে কুরআন কারীম একমাত্র কিতাব, যার তিলাওয়াতে রয়েছে হরফে হরফে নেকী। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ.

যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পড়ল তার জন্য রয়েছে একটি নেকী। আর একটি নেকী দশ নেকী সমতুল্য। নবীজী বলেন, আমি বলছি না যে, আলিফ লাম মীম- একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১০

অতএব আলিফ লাম মীম তিলাওয়াত করলে কমপক্ষে ত্রিশ নেকী লাভ হবে, ইনশাআল্লাহ। লক্ষ করার বিষয় হল, নবীজী দৃষ্টান্ত স্বরূপ আলিম লাম মীম উল্লেখ করেছেন। আর এটি এমন এক শব্দ, যার অর্থ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। বুঝা গেল, কুরআন মাজীদের অর্থ না বুঝে পড়লেও রয়েছে অনেক সওয়াব, অনেক ফায়দা। আর যদি কেউ বুঝে বুঝে উপলব্ধির সাথে কুরআন তিলাওয়াত করে তাহলে আল্লাহ তাকে আরো কত দেবেন, তা তো আল্লাহ পাকই ভালো জানেন!

কুরআন তিলাওয়াতের ফযীলতের বিষয়টি হাদীসের এ বিবরণ থেকেও সুন্দর বুঝে আসে-

উকবা ইবনে আমের রা. বলেন, একবার আমরা সুফফায় অবস্থান করছিলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সামনে এলেন। বললেন, আচ্ছা বল তো, কেউ বুতহান অথবা আকীকে গিয়ে উঁচু কুঁজ বিশিষ্ট দুটি উটনী নিয়ে আসবে। কারো উপর জুলুম করে নয়। কোনো অপরাধ করে নয়। কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে নয়খুবই ন্যায়সঙ্গতভাবে। তোমাদের কে আছে এমনটি চাইবে? সাহাবীগণ বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এরকম হলে তো আমাদের সবাই তা চাইবে। নবীজী বললেন, মসজিদে গিয়ে ইলম শেখা অথবা কুরআনের দুটি আয়াত পড়া, সেই দুই উটনী অপেক্ষা উত্তম। তিন আয়াত পড়া তিন উটনী থেকে উত্তম। চার আয়াত পড়া চার উটনী থেকে উত্তম। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮০৩)

তৎকালীন আরবে উঁচু কুঁজ বিশিষ্ট উটনী ছিল অনেক মূল্যবান সম্পদ। নবীজী পার্থিব এ মূল্যবান সম্পদের তুলনা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন পরকালীন বিবেচনায় কুরআনের একেকটি আয়াত পড়া-শেখা কত গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত।

উত্তমভাবে কুরআন তিলাওয়াতকারীগণ থাকবেন সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে

মুমিন হিসাবে সকলের কর্তব্য হচ্ছে সহীহ শুদ্ধভাবে উত্তমরূপে কুরআন কারীম তিলাওয়াত করা। আর এর রয়েছে অনেক বড় ফযীলতও। আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

الْمَاهِرُ بِالْقُرْآنِ مَعَ السّفَرَةِ الْكِرَامِ الْبَرَرَةِ، وَالّذِي يَقْرَأُ الْقُرْآنَ وَيَتَتَعْتَعُ فِيهِ، وَهُوَ عَلَيْهِ شَاقّ، لَهُ أَجْرَانِ.

যারা উত্তমরূপে কুরআন পড়বে তারা থাকবে অনুগত সম্মানিত ফিরিশতাদের সাথে। আর যে কুরআন পড়তে গিয়ে আটকে আটকে যায় এবং কষ্ট হয়, তার জন্য রয়েছে দ্বিগুণ সওয়াব। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৯৮

নবীজীর এ হাদীসটি একদিকে যেভাবে তিলাওয়াতে পারদর্শী ব্যক্তিদের জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী তেমনি কুরআন পড়তে যাদের কষ্ট হয়, মুখে আটকে আটকে যায়, তাদের জন্যও এ বাণী আশা সঞ্চারক এবং উৎসাহব্যঞ্জক। এ ধরনের ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী দ্বিগুণ সওয়াব। তিলাওয়াতের সওয়াব এবং তিলাওয়াতের জন্য যে কষ্ট হয় সেই কষ্টের সওয়াব। তাই যারা এখনো সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত শিখিনি, সাবলীল তিলাওয়াত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি, তাদের হতোদ্যম হওয়ার কিছু নেই। আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে এবং দ্বিগুণ সওয়াব  প্রাপ্তির আশায়  মেহনত ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। আর এভাবে চেষ্টা করতে করতে যখন তিলাওয়াত সাবলীল হয়ে যাবে তখন তো কথাই নেই- আল্লাহর নেককার ফিরিশতাদের সঙ্গী হবে, ইনশাআল্লাহ।

তিলাওয়াতকারীদের জন্য কুরআন সুপারিশ করবে

যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে কুরআন কারীমকে নিজের সঙ্গী বানাবে কিয়ামতের দিন কুরআন তাকে ভুলবে না। কিয়ামতের সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে কুরআন তাকে সঙ্গ দেবে এবং তার জন্য সুপারিশ করবে। আবু উমামা বাহেলী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

اقْرَؤُوا الْقُرْآنَ فَإِنّهُ يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لأَصْحَابِهِ.

তোমরা কুরআন পড়। কেননা কিয়ামতের দিন কুরআন তার ছাহিবেরজন্য সুপারিশ করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮০৪

কুরআনের ছাহিব কে? মুহাদ্দিসীনে কেরাম বলেন, ‘ছাহিবে কুরআনবলা হয় ওই ব্যক্তিকে, যিনি কুরআন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকেন। কুরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকেন। কুরআনের হেদায়েত ও বার্তাগুলো গ্রহণ করেন। কুরআনের বিধানগুলো আমলে নেন। কুরআনের হিফয করেন। মোটকথা  কুরআনই থাকে তার জীবনের আরাধনা। (দ্রষ্টব্য : কূতুল মুগতাযী আলা জামিইত তিরমিযী ২/৭৩২)

অতএব আমাদের কুরআনের ছাহিববা কুরআনওয়ালা হওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। আর কুরআনের ছাহিব হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ হচ্ছে ইহতিমামের সাথে তিলাওয়াত করা। আল্লাহ আমাদের এমন তিলাওয়াতের তাওফীক দান করুন, যার মাধ্যমে আমরা ছাহিবে কুরআন’-এর মাঝে পরিগণিত হব- আমীন।

কিয়ামতের দিন ছাহিবে কুরআনকে দেওয়া হবে বিশেষ মর্যাদা

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দুনিয়ার জীবনে যেভাবে ছাহিবে কুরআন বান্দাদের সম্মানিত করে থাকেন তেমনি আখেরাতেও তাদেরকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করবেন। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

يُقَالُ - يَعْنِي لِصَاحِبِ الْقُرْآنِ -: اقْرَأْ وَارْتَقِ وَرَتِّلْ كَمَا كُنْتَ تُرَتِّلُ فِي الدّنْيَا، فَإِنّ مَنْزِلَتَكَ عِنْدَ آخِرِ آيَةٍ تَقْرَأُ بِهَا.

(কেয়ামতের দিন) ছাহিবে কুরআনকে বলা হবে, তুমি তিলাওয়াত করতে থাক এবং (উপরের দিকে) চড়তে থাক। তুমি উত্তমরূপে তিলাওয়াত করতে থাক যেভাবে দুনিয়াতে সুন্দরভাবে তিলাওয়াত করতে। কেননা তুমি যতটুকু পর্যন্ত পড়বে সেখানে হবে তোমার ঠিকানা। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১৪; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৭৯৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৪৬৪

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

يَجِيءُ القُرْآنُ يَوْمَ القِيَامَةِ فَيَقُولُ: يَا رَبِّ حَلِّهِ، فَيُلْبَسُ تَاجَ الكَرَامَةِ، ثُمّ يَقُولُ: يَا رَبِّ زِدْهُ، فَيُلْبَسُ حُلّةَ الكَرَامَةِ، ثُمّ يَقُولُ: يَا رَبِّ ارْضَ عَنْهُ، فَيَرْضَى عَنْهُ، فَيُقَالُ لَهُ: اقْرَأْ وَارْقَ، وَيُزَادُ بِكُلِّ آيَةٍ حَسَنَةً.

قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ.

কিয়ামতের দিন (ছাহিবে কুরআনের সুপারিশের জন্য) কুরআন আগমন করবে। সে বলবে, ইয়া রব! আপনি তার পোশাকের ব্যবস্থা করুন। তখন তাকে সম্মানের মুকুট পরানো হবে। এরপর কুরআন আবার বলবে, ইয়া রব! তাকে আরো সম্মানিত করুন। তখন তাকে সম্মানের পোশাক পরানো হবে। এরপর কুরআন বলবে, ইয়া রব! আপনি তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান। তখন আল্লাহ  তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন। তখন সেই ছাহিবে কুরআনকে বলা হবে, তুমি কুরআন পড়তে থাক আর (জান্নাতের সমুন্নত প্রাসাদে) চড়তে থাক। প্রতিটি আয়াতের বিনিময়ে তাকে কল্যাণ দেওয়া হবে। -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১৫

কুরআন তিলাওয়াতকারী : যার প্রতি ঈর্ষান্বিত হওয়া কাম্য

সচেতন ব্যক্তি মাত্রই যেকোনো কল্যাণ লাভে ঈপ্সিত থাকে। একজন সচেতন মুমিনের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। অপরের ভালো দেখে সে তার ধ্বংস কামনা করে না; বরং সে অনুপ্রেরণা লাভ করে এবং এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা নেয়। আবু হুরায়রা রা. বলেন, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

لاَ حَسَدَ إِلّا فِي اثْنَتَيْنِ: رَجُلٌ عَلّمَهُ اللهُ القُرْآنَ، فَهُوَ يَتْلُوهُ آنَاءَ اللّيْلِ، وَآنَاءَ النّهَارِ، فَسَمِعَهُ جَارٌ لَهُ، فَقَالَ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ مَا أُوتِيَ فُلاَنٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ مَا يَعْمَلُ، وَرَجُلٌ آتَاهُ اللهُ مَالًا فَهُوَ يُهْلِكُهُ فِي الحَقِّ، فَقَالَ رَجُلٌ: لَيْتَنِي أُوتِيتُ مِثْلَ مَا أُوتِيَ فُلاَنٌ، فَعَمِلْتُ مِثْلَ مَا يَعْمَلُ.

কারো সাথেই হিংসা নয়, তবে দুজন এর ব্যতিক্রম। প্রথমজন হল, আল্লাহ একজনকে কুরআন শেখার তাওফীক দিয়েছেন। ফলে সে তা দিন-রাত তিলাওয়াত করে। তার প্রতিবেশী তা শুনতে পেয়ে আফসোস করে বলল, হায় সে যেমন কুরআন পড়ে আমি যদি তেমন পারতাম, তাহলে তো তার মতো আমিও আমল করতাম!

অপরজন হল, আল্লাহ একজনকে সম্পদ  দিয়েছেন। সেগুলো সে ন্যায়ের পথে খরচ করে। তা দেখে একজন বলল, হায় আমারও যদি তার মতো সম্পদ থাকত তাহলে আমিও তার মতো খরচ করতে পারতাম। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২৬, ৪৭৩৮

কুরআন মাজীদ এত মহিয়ান নিআমত যে, আল্লাহ যাকে এ নিআমত দান করেন আর এর শুকরিয়া আদায় স্বরূপ দিবারাত্রি তা তিলাওয়াত করে- এমন ব্যক্তি ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হয়। আর এমন ব্যক্তিকে দেখে অনুপ্রাণিত হতে স্বয়ং নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উৎসাহিত করছেন।

প্রতি মাসে চাই কমপক্ষে একবার কুরআন খতম করা

মুমিনের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় নির্ধারিত থাকবে কুরআন তিলাওয়াত ও তাফাক্কুর-তাদাব্বুরের (কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও তা থেকে উপদেশ গ্রহণের) জন্য। দিনের সূচনা তিলাওয়াতের মাধ্যমে হলে তো আরো ভালো কথা। এটা বরকতের ব্যাপারও বটেতবে যাইহোক প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ তিলাওয়াত রুটিনে থাকা চাই।

সবচে সুন্দর হয় যদি মাসে অন্তত একটি খতম করা যায়। আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. বলেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাসে একবার খতম করতে বলেছেন। তিনি বলেন, আমি বললাম, আমি এরচে বেশি পারব। নবীজী বললেন, তাহলে বিশ দিনে খতম করো। তিনি বললেন, আমি আরো বেশি পড়তে পারব। নবীজী বললেন, তাহলে সাত দিনে খতম করো। এরচে বেশি পড়তে যেয়ো না। (দ্রষ্টব্য : সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫৯; সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭৬৭, ৫০৫৪)

এজন্য সাহাবায়ে কেরাম সাধারণত সাত দিনে কুরআন খতম করতেন। তবে কম হিম্মতওয়ালাদের জন্য নবীজী সহজ করে বলেছেন মাসে একবার খতম করতে। কাজেই আমরা যদি প্রতিদিন অন্তত এক পারা তিলাওয়াতের অভ্যাস গড়ে তুলি তাহলে সহজেই মাসে এক খতম হয়ে যায়। আর এই এক পারা একসাথে পড়াও জরুরি না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের আগে-পরে অল্প অল্প করে তিলাওয়াত করলেও তো এক পারা তিলাওয়াত হয়ে যায়।

প্রতিদিন কত সময় তো কত কাজে কেটে যায়! অপ্রয়োজনীয় কত ব্যস্ততায়ও তো চলে যায় কত সময়! কিন্তু তিলাওয়াতের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমলের জন্য বের হয় না কিছু সময়। আসলে  প্রয়োজন শুধু একটু সদিচ্ছা ও পরিকল্পনা। আল্লাহ আমাদের তাওফীক নসীব করুন- আমীন।

যে তিলাওয়াত করে আর যে করে না তাদের দৃষ্টান্ত

নেককার-বদকার সবার জন্যই আল্লাহর কালাম। যে নিয়মিত তিলাওয়াত করে, যে করে না সবার জন্যই কুরআন। আমি চেষ্টা করব তিলাওয়াতকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে, বরং আমার চেষ্টা থাকবে ছাহিবে কুরআনহওয়ার। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুই শ্রেণিকে উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

যে ব্যক্তি কুরআন পড়ে (এবং সে অনুযায়ী আমল করে) সে উতরুজ্জা ফলের মতো, যার স্বাদও ভালো ঘ্রাণও সুন্দর। আর যে কুরআন পড়ে না সে খেজুরের মতো। যার স্বাদ ভালো, তবে কোনো ঘ্রাণ নেই। আর যে বদকার ব্যক্তি কুরআন পড়ে সে রায়হানা সুগন্ধির মতো, যার ঘ্রাণ তো মোহনীয়, তবে স্বাদ তিক্ত। আর যে বদকার ব্যক্তি কুরআন পড়ে না সে হানযালা ফলের মতো, যার স্বাদও তেতো, আবার কোনো সুবাসও নেই। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০২০

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

تَعَلّمُوا القُرْآنَ فَاقْرَءُوهُ وَأَقْرِئُوهُ، فَإِنّ مَثَلَ القُرْآنِ لِمَنْ تَعَلَّمَهُ فَقَرَأَهُ وَقَامَ بِهِ كَمَثَلِ جِرَابٍ مَحْشُوٍّ مِسْكًا يَفُوحُ بِرِيحِهِ كُلّ مَكَانٍ وَمَثَلُ مَنْ تَعَلّمَهُ فَيَرْقُدُ وَهُوَ فِي جَوْفِهِ كَمَثَلِ جِرَابٍ أُ وكِئَ عَلَى مِسْكٍ.

তোমরা কুরআন শেখ। অতঃপর তা পড় এবং পড়াও। কেননা যে ব্যক্তি কুরআন শিখল এরপর তা পড়ল এবং  রাতে (তাহাজ্জুদের) নামাযে তা তিলাওয়াত করল, সে ব্যক্তি এমন পাত্রের মতো, যা মেশক আম্বর দিয়ে পূর্ণ, যা সর্বত্র সুগন্ধি ছড়ায়। আর যে ব্যক্তি কুরআন শিখে শুয়ে থাকল এ ব্যক্তি এমন পাত্রের ন্যায়, যা মেশক ভরে সেলাই করে দেওয়া হয়েছে। (ফলে তা থেকে আর সুগন্ধি বিকরিত হয় না।) -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৮৭৬

এ হল কুরআন শিখে তিলাওয়াত করা আর না করার পার্থক্য। তিলাওয়াতে কুরআন কারীম এমন এক আমল, যার মাধ্যমে কুরআনের সাথে সম্পর্কের সূচনা হয়। এর মাধ্যমে কালামুল্লাহর সুবাস বিকরিত হয়। ঘ্রাণে ঘ্রাণে তা শুভ্র-সতেজ করে তোলে মুমিনের দেহমন। আলোড়িত করে তার মন-মনন। কাজেই কুরআন শিখে তা না পড়া অনেক বড় অপরাধ। আর একজন ঈমানদার বান্দা, যে আল্লাহ ও রাসূল এবং আখেরাতের প্রতি বিশ^াস রাখে, এমন ব্যক্তি আল্লাহর কালাম সহীহ-শুদ্ধ তিলাওয়াত করতে পারবে না, তা তো কল্পনাই করা যায় না।

আফসোসের বিষয় হল, যেই মুসলমানের ঘর কুরআন তিলাওয়াতের সুমধুর ধ্বনিতে গুঞ্জরিত হওয়ার কথা ছিল সেখানে অনেক ঘর এমন পাওয়া যায় যেখানে পুরো বছর কুরআন শরীফ কেবলই আলমারির শোভা হয়ে থাকে। রমযান এলে আবার মনে পড়ে কালামুল্লাহর কথা। এটা অত্যন্ত আপত্তির বিষয়। মুমিনের জীবন তো আবর্তিত হবে কুরআনকে ঘিরে। কুরআন থেকে সে আলো গ্রহণ করবে। সে আলোতে পথ দেখবে। তবেই তো গন্তব্যের দেখা মিলবে! তাই আসুন, কুরআনের আরো ঘনিষ্ঠ হই। পরিবার পরিজন, সন্তান সন্ততি, আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও অধীনস্তসহ সবাইকে কুরআনের কাছে থেকে কাছে আনার ফিকির করি। আল্লাহ তাআলা আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement