শাওয়াল ১৪৪৩   ||   মে ২০২২

অতুলনীয় কুরআন

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى.

কায়রো ইউনিভার্সিটির ইসলামিক হিস্ট্রি এন্ড সিভিলাইজেশনের প্রফেসর ড. আহমাদ শালাবী কুরআন কারীম সম্পর্কে তার নিজের একটি অভিজ্ঞতা এভাবে আলোচনা করেছেন- ক্যাম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে আমার এক সহপাঠী আমাকে বলেছিল, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বল এবং প্রমাণ কর যে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে।

আমি বললাম, তুমি আমার কাছে  কঠিন কিছু চাওনি, সহজ একটি বিষয়ই চেয়েছ। তুমি আরব হলে আমি তোমার সামনে কুরআন রেখে দিতাম। তুমি নিজেই এর ভাষা ও মর্মের অলৌকিকত্ব বুঝতে পারতে। কুরআনই তোমাকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাতের উপর ঈমান আনতে বাধ্য করত, যেভাবে তা বহু আরবকে বাধ্য করেছে। তবে নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত শুধু আরবের জন্য নয়, তা (সকল ভাষার) সমগ্র মানবতার জন্য। তাই সমগ্র মানবতার জন্যই তাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে। শোনো-

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মী ছিলেন। লেখা-পড়া জানতেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ مَا كُنْتَ تَتْلُوْا مِنْ قَبْلِهٖ مِنْ كِتٰبٍ وَّ لَا تَخُطُّهٗ بِیَمِیْنِكَ اِذًا لَّارْتَابَ الْمُبْطِلُوْنَ.

আর আপনি এই কিতাবের আগে কোনো কিতাব পড়েননি এবং নিজ হাতে কোনো কিতাব লিখতেও পারতেন না। এমন হলে তো এই অসত্যের পূজারীরা কিছু সন্দেহ পোষণ করতে পারত। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৮

তাঁর পরিবারে-সমাজে তেমন কোনো বিদ্যাচর্চা ছিল না। কিন্তু তিনি মীরাছ বা মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ বণ্টনের এমন এক ব্যবস্থা নিয়ে এলেন, যা চৌদ্দ শ বছর পর্যন্ত কার্যকর ও প্রাণবন্ত রয়েছে। ভবিষ্যতেও এমনটাই থাকবে। এই ব্যবস্থা আরব উপদ্বীপের সীমানা অতিক্রম করে দিকে দিকে বিভিন্ন ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে, বহু সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে এর সংঘর্ষ হয়েছে, মানবরচিত বহু ব্যবস্থার সাথে একে বারবার তুলনা করা হয়েছে, কিন্তু সবক্ষেত্রেই এ ব্যবস্থাটাই শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত হয়েছে। ভবিষ্যতেও এমনটাই হবে। এই ব্যবস্থাটাকে তুমি ইংল্যান্ডের ব্যবস্থার সাথে তুলনা করে দেখতে পার, যা বড় পুত্রকে সমুদয় সম্পদ দিয়ে অন্য সকল পুত্র-কন্যাকে বঞ্চিত করে। হল্যান্ডের ব্যবস্থার সাথে তুলনা করতে পার, যা অর্ধেক সম্পদ স্ত্রীকে দেয়, অবশিষ্ট অর্ধেক পুত্র-কন্যা ও স্ত্রীর মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে। ঐসকল ব্যবস্থার সাথেও তুলনা করতে পার, যা শুধু পুত্রদেরকেই দেয়, কন্যাদেরকে কিছুই দেয় না, যেমনটা আরবের বহু গোত্রে এবং উত্তর আফ্রিকার বহু অধিবাসীর মধ্যে প্রচলিত ছিল। ঐ ব্যবস্থার সাথেও তুলনা করতে পার, যা সমুদয় মীরাছ খালাতো বোনকে দিয়ে দেয়। ইন্দোনেশিয়ার কোনো কোনো এলাকায় এটা আছে। এভাবে নতুন-পুরাতন বিভিন্ন ব্যবস্থার সাথে একে তুলনা করলে স্পষ্ট দেখতে পাবে, ঐসকল ব্যবস্থার চেয়ে ইসলামের ব্যবস্থাটাই শ্রেষ্ঠ।...

এটা শুধু একটা দৃষ্টান্ত। এই উম্মী নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এরকম অপ্রতিদ্বন্দ্বী বহু ব্যবস্থা- দাম্পত্য-ব্যবস্থা, তালাক-ব্যবস্থা, ইবাদত-ব্যবস্থা, রাষ্ট্র-ব্যবস্থা, অর্থ-ব্যবস্থা, যুদ্ধ-নীতি, যুদ্ধ-পরবতীর্ পরিস্থিতির নীতিমালা, মুসলিম-সমাজে অমুসলিমদের কর্তব্য-অধিকার সংক্রান্ত নীতিমালা এরকম জীবনের সকল ক্ষেত্রের সর্বোত্তম ব্যবস্থা নিয়ে এসেছেন। তিনি আল্লাহ তাআলা সম্পর্কেও স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, যা নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানববুদ্ধি দোদুল্যমান ছিল। তিনি আল্লাহ তাআলার সুস্পষ্ট পরিচয় দান করেছেন। তিনি এই দৃশ্য জগতের পরের জগৎসমূহের ব্যাপারেও পরিষ্কার সংবাদ দান করেছেন।

এ পর্যন্ত বলে আমি আমার সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কী মনে হয়, এসব সেই উম্মী নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) নিজের মতামত?

ও কিছু বলার আগেই আমাদের আরেক সহপাঠী, যে আমার এতক্ষণের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল বলে উঠল, এসব যদি মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) মতামত হয় তাহলে তিনি মানুষ নন। এসকল নীতি ও ব্যবস্থা তো অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও অতি উন্নত যোগ্যতার অধিকারী বহুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মাধ্যমেও প্রণীত হওয়া সম্ভব নয়, তা যত উপায়-উপকরণই তাদেরকে সরবরাহ করা হোক!

আমি প্রথমজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমার কী ধারণা?

সে বলল, আমিও একমত। হাঁ, আমিও বলি, যত প্রতিভাবান লোকই হোক- উপরের এতসব বিচিত্র বিষয়ের সবগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য, কোনো একটি বিষয়েও এ রকমের ব্যবস্থা উদ্ভাবন করা কিছুতেই সম্ভব নয়।

এরপর ড. শালাবী লেখেন-

واعتنق هذا الزميل الإسلام، وسمى نفسه محمدا تيمنا بالرجل الذي جاء هذا الخير على يديه.

আমার সঙ্গীটি ইসলাম কবুল করেন এবং যে উম্মী নবী (ফিদাহু আবী ওয়া উম্মী) এসব কল্যাণপূর্ণ ব্যবস্থা নিয়ে আগমন করেছেন বরকতের জন্য তাঁর নামেই নিজের নাম রাখেন মুহাম্মাদ-মুকারানাতুল আদইয়ান (৩), আলইসলাম, পৃ. ৬২-৬৩

কুরআন মাজীদ একসাথে অবতীর্ণ হয়নি, অল্প অল্প করে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে অবতীর্ণ হয়েছে। কিন্তু অভাবনীয় ব্যাপার এই যে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অবতীর্ণ হওয়া আয়াতগুলোতেই মানবজীবনের সকল বিভাগের জন্য সর্বজনীন, সর্বকালীন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবস্থাসমূহ পূর্ণতা লাভ করেছে, যা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে, এই কালাম সেই সর্বজ্ঞানী মহান সত্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ, যাঁর জ্ঞানের সামনে স্থান-কালের কোনো তফাৎ নেই। তিনি তাঁর বাণী ও বিধান প্রয়োজন মতো নাযিল করেছেন আর সব স্ব স্ব স্থানে ছকে ছকে মিলে গেছে। বিধি-ব্যবস্থার অবতারণ সম্পন্ন হওয়ার পর ঘোষণা করে দিয়েছেন-

اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا .

আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিআমত পরিপূর্ণ করলাম আর ইসলামকে তোমাদের ধর্মরূপে পছন্দ করলাম। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩

কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কুরআন মাজীদ শুধু বিধি-ব্যবস্থার গ্রন্থ নয়, এতে যেমন বিধান আছে, তেমনি আছে বৃত্তান্ত, উপমা, প্রতিশ্রম্নতি, হুঁশিয়ারি এবং আরো অনেক কিছু। আছে অসাধারণ শব্দ-চয়ন, অনন্য বাক্য-বিন্যাস, অপূর্ব ধ্বনিমাধুর্য, অতুলনীয় ছন্দময়তা। কিন্তু এই সকল অতুলনীয়তা সত্ত্বেও এর ভাষা অতি সহজ-সরল, সজীব-প্রাণবন্ত, একান্ত আপনার। ছোট একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে সুবিধা হবে :

বিখ্যাত আরবী অভিধানবিদ ইমাম আসমায়ী রাহ. এক বেদুঈন মেয়ের মুখে কয়েকটি পংক্তি শুনে খুব মুগ্ধ হন। তিনি তার প্রতিভায় বিস্ময় প্রকাশ করলে মেয়েটি বলে ওঠে- আক্ষেপ আপনার প্রতি। আল্লাহ তাআলার এই বাণীর তুলনায় আমার এই পংক্তিগুলোর কী মান হতে পারে? একথা বলে মেয়েটি তিলাওয়াত করল-

وَ اَوْحَیْنَاۤ اِلٰۤی اُمِّ مُوْسٰۤی اَنْ اَرْضِعِیْهِ  فَاِذَا خِفْتِ عَلَیْهِ فَاَلْقِیْهِ فِی الْیَمِّ وَ لَا تَخَافِیْ وَ لَا تَحْزَنِیْ  اِنَّا رَآدُّوْهُ اِلَیْكِ وَ جَاعِلُوْهُ مِنَ الْمُرْسَلِیْنَ.

আর আমি মূসার মায়ের অন্তরে একথা ঢেলে দিলাম যে, তুমি ওকে স্তন্য দান কর। যখন তার (প্রাণের) আশঙ্কা করবে তখন তাকে নদীতে ফেলে দেবে। ভয় করো না, দুঃখও করো না। আমি অবশ্যই তাকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেব এবং তাকে রাসূলদের একজন বানাব। -সূরা কাসাস (২৮) : ০৭

আয়াতটি তিলাওয়াত করে মেয়েটি বলল, দেখুন, সংক্ষিপ্ত একটি আয়াত, (কত সহজ-সরল কথা) কিন্তু এতে দুটি আদেশ, দুটি নিষেধ, দুটি সংবাদ ও দুটি প্রতিশ্রম্নতি আছে!

ইমাম আসমায়ী রাহ. বলেন, আমি মেয়েটির কবিতা শুনে যতটা না বিস্মিত হয়েছিলাম তার উপলব্ধির পরিচয় পেয়ে তার চেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম। -তাফসীরে কুরতুবী ১৩/২৫২

দেখুন, সহজ-সরল একটি কথার মধ্যেও কী অদ্ভুত সামঞ্জস্য :

আদেশ দুটি হচ্ছে : ওকে স্তন্য দান কর’; এবং ‘...তখন তাকে নদীতে ফেলে দেবে

নিষেধ দুটি হচ্ছে : ভয় করো না’, ‘দুঃখও করো না

সংবাদ দুটি হচ্ছে : ঢেলে দিলাম’, আশঙ্কা করবে

আর প্রতিশ্রম্নতি দুটি হচ্ছে : ওকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবতাকে রাসূলদের একজন বানাব

এই অদ্ভুত সামঞ্জস্যপূর্ণ শব্দ-বাক্যের কাঠামো ও মাধুর্যপূর্ণ ভাষার মধ্যেই দেয়া হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবতার জন্য সর্বশেষ ও চূড়ান্ত জীবন-ব্যবস্থা।

সেই জীবন-ব্যবস্থাও এত সহজ-স্বাভাবিকভাবে মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে যে, অসংখ্য মানুষ নিজেও টের পায়নি, কীভাবে কুরআন মাজীদের স্পর্শে কোন্ কোন্ মরণব্যাধি থেকে সে আরোগ্য লাভ করেছে।

চলুন খুবই সাদামাটা একটি ঘটনা আলোচনা করা যাক। ঘটনাটি হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর নিজের। তিনি লেখেন- আমি সাহারানপুর যাচ্ছিলাম। থানাভবন স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠেছি। এক নতুন আগন্তুক মৌলভী সাহেব ট্রেন থেকে নামলেন। তিনি দিল্লী থেকে আমার সাথেই সাক্ষাতের জন্য এসেছেন। বিষয়টি জানার পর বললাম, ‘আমি তো এখন সফরে যাচ্ছি, আপনার ইচ্ছা হলে সাহারানপুর পর্যন্ত আমার সাথে যেতে পারেন। ট্রেনে কথা হবে। টিকেট নিয়ে নিন।কিন্তু সময় ছিল না। তিনি টিকেট নিতে পারলেন না। গার্ডকে বলে ট্রেনে উঠে পড়লেন। যখন ট্রেন নানূতা স্টেশনে পৌঁছল- এটা থানাভবনের পরের স্টেশন- আমি তাকে বললাম, এখন গার্ডের কাছে যান এবং তাকে টাকা দিয়ে রশীদ নিয়ে নিন। সামনের জন্যও টিকেট কেটে ফেলুন। গার্ড তাকে বলল, থানাভবন (থেকে নানূতা) পর্যন্তের ভাড়া মাফ করে দিচ্ছি, এরপর নানূতা থেকে সাহারানপুরের টিকেট দিয়ে দিল।

মৌলভী সাহেব আমার কাছে এসে যখন ঘটনাটা জানালেন আমি বললাম, এটা তো না-জায়েয হয়েছে। গার্ড তো গাড়ির মালিক নয়... সে রেলওয়ের একজন কর্মচারীমাত্র। তার তো মাফ করার অধিকার নেই। আপনার উপর এই ভাড়াটা ঋণ হয়ে থাকছে, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে অবশ্যই আদায় করতে হবে, কিন্তু এখন তো গার্ডের কাছ থেকে এর রশীদ নেয়ার সুযোগ নেই। কাজেই আপনি পরে এই পরিমাণ অর্থের টিকেট কিনে তা ছিঁড়ে ফেলবেন। এভাবে রেলওয়েতে আপনার ভাড়া পৌঁছে যাবে।

ঐসময় এক ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু ভদ্রলোকও গাড়িতে ছিলেন। আগাগোড়া গোটা বিষয়টা লক্ষ্য করে তিনি বললেন, জনাব, আমি আমার একটি দুর্বলতা আপনাদের কাছে প্রকাশ করছি। যখন গার্ড তাকে বলল, নানূতা পর্যন্ত ভাড়া মাফ করে দিয়েছি, আমি মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলাম যে, এক গরীব বেচারার কিছু উপকার হল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, আমার খুশি হওয়াটা ঠিক ছিল না। আমি তো একটি অনৈতিক বিষয়ে খুশি হয়েছিলাম। ন্যায়ের কথা তো সেটাই, যা আপনি বলেছেন।

এই ঘটনা উল্লেখ করে হাকীমুল উম্মত বলেন-

میں کہتا ہوں کہ یہ تو ایک چھوٹی سی بات ہے، یہ تو اسلام کی ادنی جھلک ہے، اگر اہل انصاف ہمارے پاس چند روز رہیں تو ان کو اسلام کی بڑی بڑی خوبیاں معلوم ہونگی.

আমি বলি, এটা তো খুব সামান্য একটি ব্যাপার ছিল। এ তো ইসলামের খুব সামান্য একটি ঝলক মাত্র। ন্যায়নিষ্ঠ লোকেরা যদি আমাদের কাছে কিছুদিন থাকেন তাহলে তারা ইসলামের বড় বড় সৌন্দর্য সম্পর্কে জানতে পারবেন। -খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত (মাহাসিনে ইসলাম), খ. ৮, পৃ. ৫৪-৫৫

এভাবেই যুগে যুগে ইসলাম অসংখ্য মানুষের চিন্তা ও কর্মকে ন্যায়ের ছাঁচে গঠিত করেছে। প্রাত্যহিক জীবনের ছোট ছোট বিষয়েও ন্যায়-অন্যায়ের মাঝে পার্থক্যকারী স্বচ্ছ মানদণ্ড দান করেছে, যা চিন্তা ও কর্মকে নিখুঁতভাবে বিন্যস্ত করে, ভাষা ও ভূখণ্ডের সব সীমানা অতিক্রম করে কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবতার সম্পূর্ণ জীবনের সকল খুঁটিনাটি পর্যন্ত যে দ্বীন এমন সহজ-স্বাভাবিক ও সুনিপুণ উপায়ে বিন্যস্ত করে তা কুরআন কারীমের দ্বীন। এর অলৌকিকত্ব দিবালোকের মতো স্পষ্ট।

মুফাক্কিরে ইসলাম হযরত মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. কুরআন মাজীদের ইজায নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, কুরআন মাজীদের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বড় মুজিযা হচ্ছে ইসলামী শরীয়ত। তিনি লেখেন-

۔۔۔اس سے زیادہ انسان کو اپنے خالق سے مربوط کرنے والا،  اور اس کی زندگی میں للہیت اور روحانیت پیدا کرنے والا،  ان تمام گمراہیوں اور بے اعتدالیوں سے دور رکھنے والا، جس میں مذہبی قومیں مبتلا ہوئیں اور مبتلا ہیں کوئی ہدایت نامہ انسانی تصور کی گرفت میں نہیں آ سکتا ۔ اسی طرح اس نے انسان کی اس زندگی کے لیے ایک آسمانی اخلاقی و مدنی دستور عطا کیا، جو دنیا میں بہترین اخلاقی و اجتماعی نتائج پیدا کرنے کا ذمہ دار ہے، اور اس نے پیدا کرکے دکھلا ئے، جو کسی اور طریقہ پر آج تک ظہور پذیر نہیں ہوئے۔ وہ اجتماع انسانی کے ان تمام مسائل و مشکلات کو جو آج تک پیش آئے یا قیامت تک پیش آ سکتے ہیں اپنے معجزانہ طریق پر ذرا ذرا سے اشارات سے حل کر دیتا ہے۔ وہ ایسے اصول و کلیات عطا کرتا ہے جن کی بنیاد پر ہر زمانہ میں دنیا کا بہترین معاشرہ قائم کیا جاسکتا ہے اور ہر جگہ حیات انسانی کی نئی تنظیم ہو سکتی ہے۔

মানুষকে তার স্রষ্টার সাথে এর চেয়ে বেশি সম্পৃক্তকারী, তার জীবনে লিল্লাহিয়্যাত ও রূহানিয়্যাত সৃষ্টিকারী, ঐসকল বিচ্যুতি ও প্রান্তিকতা থেকে সুরক্ষা দানকারী, যাতে বহু ধর্ম-গোষ্ঠী নিপতিত হয়েছে ও হয়ে আছে, দুসরা কোনো হেদায়েতগ্রন্থ মানুষের কল্পনাতেও আসতে পারে না।

কুরআন কারীম মানুষের জীবনের জন্য এমন এক আল্লাহপ্রদত্ত, চারিত্রিক ও সামাজিক ব্যবস্থা দান করেছে, যা পার্থিব জীবনে সর্বোত্তম নৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সৃষ্টিতে সক্ষম এবং তা সৃষ্টি করে দেখিয়েছেও, যা আজ পর্যন্ত অন্য কোনো উপায়ে সম্ভব হয়নি।

কুরআন মানব-সমাজের ঐসকল প্রয়োজন ও সমস্যা, যা আজ পর্যন্ত উদ্ভূত হয়েছে বা ভবিষ্যতে কিয়ামত পর্যন্ত উদ্ভূত হবে, তা অলৌকিক উপায়ে সংক্ষিপ্ত ইশারার মধ্য দিয়েই সমাধান করে দেয়। কুরআন এমন মৌলনীতি দান করে, যার ভিত্তিতে প্রত্যেক যুগে পৃথিবীর সর্বোত্তম সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব এবং সম্ভব সকল অঞ্চলে মনুষ্য-জীবনকে নতুন বিন্যাসে বিন্যস্ত করা। -মুতালাআয়ে কুরআনকে উসূল ও মাবাদী, পৃ. ৪৯-৫০

কুরআনের ইজায অর্থাৎ তা মানবীয় সক্ষমতার ঊর্ধ্বের আল্লাহর কালাম হওয়ার বহু দিক ও দলীল যেমন মুসলিম মনীষীগণ আলোচনা করেছেন, অমুসলিম পণ্ডিতেরাও বিভিন্ন প্রসঙ্গে স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন। এইসকল শাস্ত্রীয় ও জ্ঞানগত উপলব্ধির সাথে সাথে হৃদয়গত উপলব্ধির সৌভাগ্যও অসংখ্য মানুষের হয়ে থাকে। আল্লাহর কালামের মহা ঐশ্বর্য ভাণ্ডারের সামনে এসে সবারই নিজেকে অতি দীন, হীন, রিক্ত, ভিখারীই মনে হবে। শুধু একটি উপলব্ধি আলোচনা করেই আমার লেখাটি শেষ করব।

এই উপমহাদেশের বিখ্যাত মনীষী লেখক হযরত মাওলানা মানযূর নুমানী রাহ., যিনি দ্বীনী দাওয়াতের বিভিন্ন অঙ্গনে বহু খেদমত করে গেছেন, কুরআন কারীমের শিক্ষা সংক্রান্ত তাঁর অনবদ্য গ্রন্থ- قرآن آپ سے کیا کہتاہے -এর ভূমিকায় কুরআন কারীম সম্পর্কে তাঁর অনুভূতি এভাবে ব্যক্ত করেছেন-

یہ واقعہ ہے جس کے اظہار میں  ذرہ برابر بھی انکسار اور   تکلف  کو دخل نہیں ہے،  کہ اس ناچیز  نے  قرآن مجید کو موضوع بناکر کبھی کو ئی خاص طالب علمانہ محنت نہیں کی،  اور اس ليے علوم قرآن میں مجھے کسی قسم کا اور کسی درجہ کا امتیاز اور تخصص حاصل نہیں ہے،  بلکہ پرانے عربی مدرسوں کے عام طالب علموں اور تعلیم یافتوں کی طرح  قرآن مجید کا بس ترجمہ اور سادہ مطلب سمجھ لیتا ہوں، اور جب توفیق ہوتی ہے تو سمجھ کر تلاوت کرنےکی کوشش کرتا  ہوں- اور یہ بھی بلا شبہ اللہ تعالی کی بہت بڑی نعمت ہے- لیکن اس سے بڑا  انعام اس رب کریم کا اس عاجز بندہ پر یہ ہے کہ تلاوت کے وقت کبھی کبھی دل کو تأثر و تذکر کی دولت بھی نصیب ہو جاتی ہے،  اور اس کی یہ برکت ہے کہ قرآن مجید کا کلامِ الٰہی ہونا میرے ليے ایک بالکل محسوس حقیقت ہے،گویا جس طرح کسی میٹھی یا  نمکین چیز کے کھاتے وقت اپنی زبان وتالو کے احساس کی بنا پر مجھے اس کی شیرینی یا نمکینی کا یقینی علم حاصل ہوجاتا ہے، الحمد للہ بالکل اسی طرح قرآن مجید کی تلاوت  کے وقت کبھی میرے قلب کا جو تأثر اور احساس ہوتاہے، مجھے اس سے  قرآن پاک کے کلامِ الٰہی ہونے کا قطعی یقین حاصل ہوتا ہے، ان دونوں یقینون میں میرے ليے کوئی فرق نہیں ہے، ان میں سے کوئی یقین بھی میرے لیے فکری  اور استدلالی نہیں ہے. فالحمد لله على ذلك حمدا كثيرا طيبا مباركا فيه.

যে সত্য প্রকাশে কোনো প্রকারের বিনয় বা লৌকিকতার প্রভাব নেই, তা এই যে, এই অধম কখনো কুরআন মাজীদকে আলাদা গবেষণার বিষয় বানিয়ে বিশেষ ছাত্রসুলভ পরিশ্রম করেনি। এজন্য উলূমুল কুরআন বিষয়ে আমার কোনো পর্যায়ের বিশেষজ্ঞতা নেই। বরং প্রাচীন ধারার আরবী মাদরাসার সাধারণ ছাত্রদের মতোই কুরআন মাজীদের সহজ-সরল অর্থ-মর্ম বুঝতে পারি এবং যখন তাওফীক হয় বুঝে বুঝে তিলাওয়াত করার চেষ্টা করি- নিঃসন্দেহে এটুকুও আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত- কিন্তু অক্ষম বান্দার প্রতি দয়ালু রবের এক বড় দান এই যে, তিলাওয়াতের সময় অন্তরে কখনো কখনো স্মরণ ও নমরতার দৌলতও নসিব হয়। এরই বরকত যে, কুরআন মাজীদ আল্লাহর কালাম হওয়া আমার কাছে এক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতাকোনো মিষ্টি বা নোনতা জিনিস খাওয়ার সময় জিহ্বা ও তালুর অনুভূতির সাহায্যে সেই বস্তুর মিষ্টতা বা নোনা স্বাদ যেমন নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করি আলহামদু লিল্লাহ ঠিক একইরকম কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতের সময়ও কখনো কখনো অন্তরে যে উপলব্ধি জাগে তা থেকে কুরআন পাক আল্লাহ তাআলার কালাম হওয়া নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি। এ দুই জ্ঞান ও উপলব্ধিতে আমার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। এ দুয়ের কোনোটাই আমার চিন্তা-ভাবনা ও যুক্তি-প্রমাণপ্রসূত নয়- এই মহা নিআমতের উপর আল্লাহ তাআলার প্রশংসা, প্রভূত ও বরকতময় প্রশংসা।-কুরআন আপ সে ক্যায়া কাহতা হ্যায়, পৃ. ১৪

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকেও এই মহা সম্পদ নসীব করুন- আমীন।

 

 

advertisement