আলকুরআনে ইহসান ও মুহসিন
মুমিনের জীবনে সবচেয়ে প্রার্থনীয় বিষয় আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। মুমিনের সকল লক্ষ্যের মূল লক্ষ্য আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি। কারণ দুনিয়া-আখেরাতের সফলতা ও মুক্তি এর উপরই নির্ভরশীল।
আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহ- তিনি কুরআন মাজীদে তাঁর পছন্দনীয় আমল ও গুণের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, এগুলো যারা অর্জন করবে, তিনি তাদের ভালবাসবেন। সেসব গুণের মধ্যে একটি বিশেষ গুণ হল ‘ইহসান’। আর এই গুণের অধিকারীকে বলা হয় মুহসিন। ইহসান আল্লাহ তাআলার অতি পছন্দনীয় একটি গুণ। তিনি বলেন-
وَ اَحْسِنُوْا اِنَّ اللهَ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.
তোমরা ইহসান অবলম্বন কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ইহসান অবলম্বনকারীদের ভালবাসেন। -সূরা বাকারা (২) : ১৯৫
আরো বলেন-
اِنَّ اللهَ مَعَ الَّذِیْنَ اتَّقَوْا وَّ الَّذِیْنَ هُمْ مُّحْسِنُوْنَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরই সাথী, যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা ইহসানের অধিকারী হয়। -সূরা নাহ্ল (১৬) : ১২৮
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে মুহসিনদের আরও অনেক ফযীলত ও পুরস্কার ঘোষণা করেছেন। তন্মধ্যে একটি হল, এই কুরআন মুহসিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত, সেইসঙ্গে সুসংবাদও। ইরশাদ হয়েছে-
تِلْكَ اٰیٰتُ الْكِتٰبِ الْحَكِیْمِ، هُدًی وَّ رَحْمَةً لِّلْمُحْسِنِیْنَ.
এগুলো হেকমতপূর্ণ কিতাবের আয়াত। যা মুহসিনদের জন্য হেদায়েত ও রহমত। -সূরা লুকমান (৩১) : ২-৩
وَ هٰذَا كِتٰبٌ مُّصَدِّقٌ لِّسَانًا عَرَبِیًّا لِّیُنْذِرَ الَّذِیْنَ ظَلَمُوْا وَ بُشْرٰی لِلْمُحْسِنِیْنَ.
আর এটি (অর্থাৎ কুরআন) আরবী ভাষায় অবতীর্ণ কিতাব, যা (পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহকে) সত্য বলে সাক্ষ্য দেয়, যাতে তা যালেমদের সতর্ক করে এবং মুহসিনদের জন্য হয় সুসংবাদ। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১২
ইহসান আল্লাহ তাআলার গুণ
ইহসান মূলত আল্লাহ তাআলার অতি মহান একটি গুণ। হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-
إِنّ اللهَ مُحْسِنٌ يُحِبّ الْإِحْسَانَ إِلَى كُلِّ شَيْءٍ...
আল্লাহ তাআলা মুহসিন; তিনি সবকিছুতে ইহসান পছন্দ করেন।... -মুসান্নাফে আবদুর রাযযাক, হাদীস ৮৬০৩
কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
الَّذِیْۤ اَحْسَنَ كُلَّ شَیْءٍ خَلَقَهٗ.
তিনি যেসব বস্তু সৃষ্টি করেছেন, তার প্রত্যেকটিকে করেছেন ইহসানমণ্ডিত। -সূরা সাজদা (৩২) : ৭
ইহসান সকল নবী-রাসূলের বৈশিষ্ট্য
সেজন্য আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্ঠ বান্দা নবী-রাসূলগণ ছিলেন সবচেয়ে বড় মুহসিন। তাঁদের সকলের মাঝে ইহসানের গুণ সর্বোচ্চ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। কুরআন মাজীদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নবীগণের প্রশংসায় বহুবার মুহসিন শব্দ উল্লেখ করেছেন। যেমন সূরা আনআমে বলেছেন-
وَ تِلْكَ حُجَّتُنَاۤ اٰتَیْنٰهَاۤ اِبْرٰهِیْمَ عَلٰی قَوْمِهٖ ، نَرْفَعُ دَرَجٰتٍ مَّنْ نَّشَآءُ ، اِنَّ رَبَّكَ حَكِیْمٌ عَلِیْمٌ، وَ وَهَبْنَا لَهٗۤ اِسْحٰقَ وَ یَعْقُوْبَ ، كُلًّا هَدَیْنَا ، وَ نُوْحًا هَدَیْنَا مِنْ قَبْلُ وَ مِنْ ذُرِّیَّتِهٖ دَاوٗدَ وَ سُلَیْمٰنَ وَ اَیُّوْبَ وَ یُوْسُفَ وَ مُوْسٰی وَ هٰرُوْنَ وَ كَذٰلِكَ نَجْزِی الْمُحْسِنِیْنَ.
এটা ছিল আমার দলীল, যা আমি ইবরাহীমকে দান করেছিলাম তার কওমের মোকাবেলায়। আমি যাকে ইচ্ছা উচ্চ মর্যাদা দান করি। নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ।
আমি ইবরাহীমকে দান করেছিলাম ইসহাক(-এর মত পুত্র) ও ইয়াকুব (-এর মত পৌত্র)। তাদের প্রত্যেককে আমি হেদায়েত দান করেছিলাম। আর নূহকে আমি আগেই হেদায়েত দিয়েছিলাম এবং তার বংশধরদের মধ্যে দাউদ, সুলায়মান, আইয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারূনকেও। এভাবেই আমি মুহসিনদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। -সূরা আনআম (৬) : ৮৩-৮৪
এমনিভাবে সূরা ইউসুফ, কাসাস ও সাফফাতেও হযরত নূহ আ., হযরত ইবরাহীম আ., হযরত মূসা আ., হযরত হারূন আ., হযরত ইউসুফ আ. ও হযরত ইলইয়াস আ.-কে মুহসিন বলে প্রশংসা করেছেন।
আর সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তো আল্লাহ তাআলা তাঁর সন্তুষ্টি প্রত্যাশীদের জন্য ‘উসওয়াতুন হাসানা’ তথা উত্তম আদর্শ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অতএব ইহসানের ক্ষেত্রেও উত্তম আদর্শ হলেন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর আবির্ভাবের পর তাঁর শিক্ষা ও আদর্শ ব্যতীত মুহসিন হওয়া সম্ভব নয়।
ইহসান অর্থ
ইহসান অত্যন্ত ব্যাপক ও গভীর অর্থবহ একটি শব্দ। হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২ হি.) রাহ. সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে বলেন-
قَوْلُهُ الْإِحْسَانُ هُوَ مَصْدَرٌ تَقُولُ أَحْسَنَ يُحْسِنُ إِحْسَانًا وَيَتَعَدّى بِنَفْسِهِ وَبِغَيْرِهِ تَقُولُ أَحْسَنْتُ كَذَا إِذَا أَتْقَنْتَهُ وَأَحْسَنْتُ إِلَى فُلَانٍ إِذَا أَوْصَلْتَ إِلَيْهِ النّفْعَ.
অর্থাৎ ইহসানের দুই অর্থ :
এক. কাউকে উপকার পৌঁছানো।
দুই. কোনো কাজ যথাযথভাবে সুন্দরভাবে ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়া। -ফাতহুল বারী, খ- ০১ পৃষ্ঠা ১৪৬, হাদীস ৫০-এর অধীনে
কুরআন-সুন্নাহ্য় ইহসান শব্দটি উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। তবে দ্বিতীয় অর্থে শব্দটি অধিক ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ কোনো কাজ সুন্দর করা ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দেয়া।
এখানে লক্ষণীয় হল, হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. দ্বিতীয় অর্থের জন্য প্রতিশব্দ উল্লেখ করেছেন ইতকান (إتقان)। এই ইতকান শব্দটিও কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলার প্রশংসায় ব্যবহৃত হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ تَرَی الْجِبَالَ تَحْسَبُهَا جَامِدَةً وَّ هِیَ تَمُرُّ مَرَّ السَّحَابِ صُنْعَ اللهِ الَّذِیْۤ اَتْقَنَ كُلَّ شَیْءٍ اِنَّهٗ خَبِیْرٌۢ بِمَا تَفْعَلُوْنَ.
তোমরা পাহাড়কে দেখে মনে কর তা আপন স্থানে স্থির, অথচ তা সঞ্চরণ করে, যেমন সঞ্চরণ করে মেঘমালা। এসবই আল্লাহর কর্ম-কুশলতা, যিনি সকল বস্তু সুদৃঢ়ভাবে সৃষ্টি করেছেন। নিশ্চয়ই তোমরা যা-কিছু কর তিনি তা সম্যক অবহিত। -সূরা নামল (২৭) : ৮৮
যাহোক ইহসান ও ইতকান উভয়টিরই মূলকথা হল, সুন্দরভাবে, সুচারুরূপে ও নিখুঁতভাবে কাজ আঞ্জাম দেয়া।
কোনো কাজ ইহসানমণ্ডিত হওয়ার জন্য শর্ত
কোনো কাজ ইহসানমণ্ডিত হওয়ার জন্য নিম্নোক্ত শর্তগুলো বিদ্যমান থাকা জরুরি-
ক. কাজটি অবশ্যই হারাম, মাকরূহ বা বেদআতী কাজ না হতে হবে। কারণ কোনো হারাম, মাকরূহ বা বেদআতী কাজ দিয়ে ইহসান হাসিল হতে পারে না। বরং সেটি অবশ্যই কোনো নেককাজ বা অন্তত কোনো মুবাহ (বৈধ) বিষয় হতে হবে।
খ. কাজটি যেনতেনভাবে করা যাবে না। বরং সেটিকে সঠিক ও ত্রুটিমুক্ত রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। অন্তত ফরয-ওয়াজিব পর্যায়ের বিষয়গুলো পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে হবে। কারণ এটা ইহসানের প্রথম ধাপ, যেটা ছাড়া ইহসান হতেই পারে না। সেজন্য প্রথমে ফরয-ওয়াজিব পর্যায়ের বিষয়গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। এরপর কাজটিকে সুন্দর থেকে সুন্দরতম করার জন্য শরীয়তে আরো যেসব বিধান ও বিষয় রয়েছে সেগুলোর প্রতি যত্নবান হতে হবে।
গ. কাজটি করতে গিয়ে অন্য কোনো গোনাহ বা অপছন্দনীয় কাজে লিপ্ত হওয়া যাবে না এবং শরীয়তের অন্য কোনো বিধান লংঘন করা যাবে না।
এই শর্তগুলো পাওয়া গেলে বোঝা যাবে, কাজটি ইহসানের প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছে। এগুলোর কোনও একটি অনুপস্থিত থাকলে ইহসান হাসিল হবে না।
মুহসিন হওয়ার জন্য শর্ত
অনুরূপভাবে কোনো ব্যক্তি মুহসিন হওয়ার জন্যও কিছু শর্ত রয়েছে। যেমন-
ক. ঈমানদার হওয়া এবং আকীদা বিশুদ্ধ হওয়া।
ঈমান যদি না থাকে এবং আকীদা যদি সহীহ না হয়, যত ভালো কাজই করুক সে কখনো মুহসিন হতে পারবে না।
ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْاَخْسَرِیْنَ اَعْمَالًا،اَلَّذِیْنَ ضَلَّ سَعْیُهُمْ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ هُمْ یَحْسَبُوْنَ اَنَّهُمْ یُحْسِنُوْنَ صُنْعًا،اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْا بِاٰیٰتِ رَبِّهِمْ وَ لِقَآىِٕهٖ فَحَبِطَتْ اَعْمَالُهُمْ فَلَا نُقِیْمُ لَهُمْ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ وَزْنًا.
(হে নবী!) আপনি বলুন, আমি কি তোমাদেরকে বলে দেব, কর্মে কারা সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত? তারা সেইসব লোক, পার্থিব জীবনে যাদের সমস্ত দৌড়-ঝাঁপ সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে অথচ তারা মনে করে, তারা খুবই ভাল কাজ করছে। এরাই সেইসব লোক, যারা নিজ প্রতিপালকের আয়াতসমূহ ও তাঁর সামনে উপস্থিতির বিষয়টিকে অস্বীকার করে। ফলে তাদের যাবতীয় কর্ম নিষ্ফল হয়ে গেছে। আমি কিয়ামতের দিন তাদের কোনো ওজন গণ্য করব না। -সূরা কাহ্ফ (১৮) : ১০৩-১০৫
অতএব মুহসিন হওয়ার জন্য প্রথম শর্ত হল, ঈমানদার হওয়া এবং সহীহ আকীদার অধিকারী হওয়া।
খ. শরীয়তের সকল আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে চলা।
গ. আল্লাহর নাফরমান না হওয়া। কারণ একই ব্যক্তি একইসঙ্গে নাফরমান আবার মুহসিন হতে পারে না। ইরশাদ হয়েছে-
وَ لِلهِ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الْاَرْضِ لِیَجْزِیَ الَّذِیْنَ اَسَآءُوْا بِمَا عَمِلُوْا وَ یَجْزِیَ الَّذِیْنَ اَحْسَنُوْا بِالْحُسْنٰی،اَلَّذِیْنَ یَجْتَنِبُوْنَ كَبٰٓىِٕرَ الْاِثْمِ وَ الْفَوَاحِشَ اِلَّا اللَّمَمَ اِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ .
যা-কিছু আকাশম-লীতে ও যা-কিছু পৃথিবীতে আছে তা আল্লাহরই। সুতরাং যারা মন্দ কাজ করেছে, তিনি তাদেরকেও তাদের কাজের প্রতিফল দেবেন এবং যারা ইহসান অবলম্বন করেছে অর্থাৎ ভালো কাজ করেছে তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দান করবেন। সেইসব লোককে, যারা বড়-বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে, অবশ্য কদাচিৎ পদস্খলন হলে ভিন্ন কথা। নিশ্চয়ই আপনার প্রতিপালকের ক্ষমা অপরিসীম। -সূরা নাজম (৫৩) : ৩১-৩২
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, এক-দুটি ভালো কাজ করে কিংবা এক-দুবার গুনাহ থেকে বিরত থেকে মুহসিন হওয়া যায় না। মুহসিন হওয়ার জন্য ভালো ও নেক কাজ করে যেতে হয়। শরীয়তের সকল আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে হয় এবং সব ধরনের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে তাঁর মুহসিন বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ الَّذِیْنَ جَاهَدُوْا فِیْنَا لَنَهْدِیَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَ اِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِیْنَ.
যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে উপনীত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদের সঙ্গে আছেন। -সূরা আনকাবুত (২৯) : ৬৯
ইহসান সম্পর্কে তিনটি মৌলিক হাদীস
কুরআন মাজীদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইহসানের যে আদেশ করেছেন, তার বিশ্লেষণ ও বাস্তব প্রয়োগ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস ও সুন্নাহ্য় উল্লেখিত ও পরিস্ফুট হয়েছে। তাই ইহসান সম্পর্কিত মৌলিক তিনটি হাদীস উল্লেখ করা হল-
১. শাদ্দাদ ইবনে আওস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنّ اللهَ كَتَبَ الْإِحْسَانَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ، فَإِذَا قَتَلْتُمْ فَأَحْسِنُوا الْقِتْلَةَ، وَإِذَا ذَبَحْتُمْ فَأَحْسِنُوا الذّبْحَ، وَلْيُحِدّ أَحَدُكُمْ شَفْرَتَهُ، فَلْيُرِحْ ذَبِيحَتَهُ.
আল্লাহ তাআলা সবকিছুর উপর ইহসানকে অবধারিত করেছেন। অতএব তোমরা (হত্যার উপযুক্ত কাউকে) হত্যা করলে সুন্দরভাবে হত্যা কর এবং (কোনো পশু) জবাই করলে সুন্দরভাবে জবাই কর। জবাইকারী যেন তার ছুরি ধার করে নেয় এবং জবাইয়ের পশুকে শান্তি দেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৫৫
২. উমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধ হাদীস, যা ‘হাদীসে জিবরীল’ নামে পরিচিত। তাতে রয়েছে- একদা সাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বসা ছিলেন। এমন সময় জিবরীল আলাইহিস সালাম মানুষের আকৃতিতে এলেন। সাহাবায়ে কেরামের কেউ তাঁকে চিনতে পারেননি। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে বসলেন এবং তাঁর হাঁটুর সঙ্গে হাঁটু মিলিয়ে দিলেন। এরপর তাঁকে দ্বীন সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। একটি প্রশ্ন করলেন ইহসান সম্পর্কে। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنّهُ يَرَاكَ.
ইহসান এই যে, তুমি আল্লাহর ইবাদত এমনভাবে করবে, যেন তুমি তাঁকে দেখছ। যদি তুমি তাঁকে নাও দেখ, তবে তিনি তো তোমাকে অবশ্যই দেখছেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮
৩. উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-
إِنّ اللهَ يُحِبُّ إِذَا عَمِلَ أَحَدُكُمْ عَمَلًا أَنْ يُتْقِنَهُ.
(وفي إسناده "مصعب بن ثابت"، قال في "التقريب" : "لين الحديث وكان عابدا"، ولحديثه هذا شواهد كما نرى.)
আল্লাহ তাআলা ভালবাসেন- তোমাদের কেউ যখন কোনো কাজ করে, সে যেন তা নিখুঁতভাবে করে। -মুসনাদে আবু ইয়ালা, খ. ০৪, পৃ. ২৫৩, হাদীস ৪৩৬৯
এই হাদীসগুলো থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় জানতে পারি-
ক. সবার প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ
এটি ইহসানের মৌলিক একটি দিক।
খ. ইবাদতের মাঝে ইখলাস পয়দা করা এবং আল্লাহর ধ্যান-খেয়াল অন্তরে জাগ্রত রাখা
এটি ইবাদত সংশ্লিষ্ট ইহসানের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। এর গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য এটুকুই যথেষ্ট যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আ.-এর প্রশ্নের জবাবে ইহসানের এই দিকটিই তুলে ধরেছেন।
এর দ্বারা অন্তরে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব, মহত্ত্ব, মর্যাদা ও ভয় জাগ্রত হয়। ফলে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা, আমলে ইখলাস পয়দা করা এবং সুন্দর ও সুচারুরূপে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করা এবং ইহসানের অন্যান্য দিক আঞ্জাম দেয়া সহজ হয়।
এই হাদীসে বিশেষভাবে ইবাদতের কথা বলা হয়েছে যে, ইবাদতে এই ধ্যান-খেয়াল জাগ্রত রাখবে। কেননা জীবনের মূল উদ্দেশ্যই তো আল্লাহ তাআলার ইবাদত। তবে এই বিধান শুধু ইবাদতের নয়; জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের। তাই সর্বাবস্থায় অন্তরে এই চিন্তা জাগ্রত রাখবে। চেষ্টা করবে, এটা যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কুরআন মাজীদে আমাদেরকে এই নির্দেশনাই দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে-
وَ هُوَ مَعَكُمْ اَیْنَ مَا كُنْتُمْ وَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ.
তোমরা যেখানেই থাক, তিনি তোমাদের সাথে আছেন এবং তোমরা যা-কিছুই কর, তিনি তা দেখেন। -সূরা হাদীদ (৫৭) : ৪
আরো ইরশাদ হয়েছে-
اَلَمْ تَرَ اَنَّ اللهَ یَعْلَمُ مَا فِی السَّمٰوٰتِ وَ مَا فِی الْاَرْضِ مَا یَكُوْنُ مِنْ نَّجْوٰی ثَلٰثَةٍ اِلَّا هُوَ رَابِعُهُمْ وَ لَا خَمْسَةٍ اِلَّا هُوَ سَادِسُهُمْ وَ لَاۤ اَدْنٰی مِنْ ذٰلِكَ وَ لَاۤ اَكْثَرَ اِلَّا هُوَ مَعَهُمْ اَیْنَ مَا كَانُوْا ثُمَّ یُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوْا یَوْمَ الْقِیٰمَةِ اِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَیْءٍ عَلِیْمٌ.
তুমি কি দেখনি আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আল্লাহ জানেন? কখনও তিনজনের মধ্যে এমন কোনও গোপন কথা হয় না, যাতে চতুর্থ জন হিসেবে তিনি না থাকেন। এবং কখনও পাঁচ জনের মধ্যে এমন কোনও গোপন কথা হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি না থাকেন। এমনিভাবে তারা এর কম হোক বা বেশি, তারা যেখানেই থাকুক, আল্লাহ তাদের সঙ্গে থাকেন। অতঃপর কিয়ামতের দিন তিনি তাদেরকে অবহিত করবেন- তারা যা কিছু করত। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বজ্ঞ। -সূরা মুজাদালা (৫৮) : ৭
এ ধরনের আরো অনেক আয়াত কুরআন মাজীদে আছে। এগুলো নিয়ে যদি আমরা চিন্তা-ভাবনা করি এবং মোরাকাবা অব্যাহত রাখি তাহলে ইনশাআল্লাহ একসময় তা আমাদের অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যাবে এবং এর ফায়দা ও বরকত আমাদের জীবনে উপলব্ধি করব। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন- আমীন।
গ. সাধারণ কাজ-কর্মও সুন্দরভাবে করা
শুধু ইবাদত নয়; বরং জীবনের প্রয়োজনে যেসব সাধারণ কাজ-কর্ম করা হয় সেগুলোও সুন্দরভাবে আঞ্জাম দেয়া- এটি ইহসানের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক।
হাদীস ও সীরাত অধ্যয়নকারী সকলেই এটি অনুধাবন করেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সাধারণ কাজ-কর্মও কতটা গুরুত্বের সঙ্গে ও সুচারুরূপে আঞ্জাম দিতেন। অলসতা উদাসীনতা ও যেনতেনভাবে কাজ করা এগুলো তাঁর পবিত্র সীরাতের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাই আমাদের উস্তাযগণ বলে থাকেন, ‘সকল ইবাদতে ইহসান ও সমস্ত কাজে ইতকান রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ সুন্নত।’
ঘ. ইহসান অবলম্বন করা ফরয
প্রথম হাদীসে আছে, আল্লাহ তাআলা ইহসানকে অবধারিত করেছেন। কুরআন মাজীদেও আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে ইহসান অবলম্বনের আদেশ করেছেন। তার মানে তাকওয়া অবলম্বন করা যেমন ফরয, ইহসান অবলম্বন করাও ফরয। ইমাম কুরতুবী (৬৭১ হি) রাহ. তাঁর তাফসীর গ্রন্থে লেখেন-
وَمَعْنَى" عَلَى الْمُحْسِنِينَ" وَ" عَلَى الْمُتّقِينَ" أَيْ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ، إِذْ لَيْسَ لِأَحَدٍ أَنْ يَقُولَ: لَسْتُ بِمُحْسِنٍ وَلَا مُتّقٍ، وَالنّاسُ مَأْمُورُونَ بِأَنْ يَكُونُوا جَمِيعًا مُحْسِنِينَ مُتّقِينَ.
অর্থাৎ কুরআন মাজীদে যে ইরশাদ হয়েছে- ‘মুহসিনদের কর্তব্য’ ‘মুত্তাকীদের কর্তব্য’, এর দ্বারা মূলত উদ্দেশ্য- মুমিনদের কর্তব্য। কেননা কারও জন্য একথা বলার সুযোগ নেই যে, আমি তো মুহসিন বা মুত্তাকী নই। (সুতরাং এই কাজ আমার উপর আবশ্যক নয়।) কারণ সকল মানুষকেই আদেশ করা হয়েছে, তারা যেন মুহসিন ও মুত্তাকী হয়। -তাফসীরে কুরতুবী, খ. ৩ পৃ. ২০৩
ঙ. প্রত্যেক বিষয়ের ইহসান সেই বিষয় অনুযায়ী
প্রথম হাদীস থেকে আরেকটি বিষয় আমরা জানতে পারি। সেটি হল, প্রত্যেক বিষয়ের ইহসান হবে সেই বিষয় অনুযায়ী। হাদীসে উদাহরণস্বরূপ বা প্রসঙ্গক্রমে জবাই ও কতলের বিষয়ে বলা হয়েছে। নতুবা সকল বিষয়েই সেই বিষয়ের উপযোগী ইহসানের বিধান রয়েছে।
হাফেয ইবনে রজব (৭৯৫ হি.) রাহ. ‘জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম’ গ্রন্থে এই হাদীসের ব্যাখ্যায় দ্বীনের কিছু মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলোর ফরয ও ওয়াজিব পর্যায়ের ইহসান কীভাবে অর্জিত হবে সেদিকে ইঙ্গিত করেছেন। যেমন-
ক. হারাম ও নিষিদ্ধ বস্তু বর্জন শরীয়তের একটি ফরয হুকুম। এক্ষেত্রে ইহসান হাসিলের উপায় হল, হারাম ও নিষিদ্ধ জিনিস থেকে বিরত থাকা এবং প্রকাশ্য-গোপন সবধরনের গোনাহ থেকে বেঁচে থাকা। হারাম জিনিসের ক্ষেত্রে এই পর্যায়ের ইহসান অর্জন করা ফরয।
খ. বালা-মসিবতের ক্ষেত্রে ফরয পর্যায়ের ইহসান হল, তাকদীরের প্রতি কোনোরূপ অসন্তুষ্টি বা বিরক্তি প্রকাশ না করে সবর করা। এটা এ বিষয়ের ইহসানের সর্বনিম্ন স্তর, যা হাসিল করা ফরয। এর চেয়ে উপরের স্তর হল ‘রিযা বিলকাযা’। অর্থাৎ তাকদীরের যে কোনো ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। কুরআন-হাদীসে উভয় প্রকারেরই ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। (দ্র. জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম, খ. ১, পৃ. ৩৬৫-৩৬৮)
গ. মুআমালা-মুআশারার ক্ষেত্রে ইহসানের ফরয পর্যায় হল, সকলের সকল হক যথাযথভাবে আদায় করে দেয়া।
ঘ. কোনো ব্যক্তি, সমাজ বা রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধান বা পরিচালনার ভার থাকলে সে সম্পর্কিত সকল দায়িত্ব পরিপূর্ণরূপে আদায় করা। এটা এ বিষয়ের ফরয ইহসান।
ঙ. কোনো প্রাণী জবাই ও হত্যার ক্ষেত্রে ইহসান হল, সহজ পন্থায় ও দ্রুততম সময়ে প্রাণ বের করে দেয়া এবং অযথা কষ্ট না দেয়া। -জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম খ. ১, পৃ. ২৮১
কুরআন মাজীদে বর্ণিত মুহসিনদের কিছু বৈশিষ্ট্য
কুরআন মাজীদে মুহসিনদের অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত আছে। সেগুলোর কোনোটি ফরয আবার কোনোটি নফল, তবে আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য এবং ঈমানী যিন্দেগী গঠনের জন্য সেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। নিম্নে সেরকম কিছু গুণের কথা আলোচনা করা হল।
১. ঈমান আনা, সালাত কায়েম করা ও যাকাত দেয়া
ইরশাদ হয়েছে-
تِلْكَ اٰیٰتُ الْكِتٰبِ الْحَكِیْمِ هُدًی وَّ رَحْمَةً لِّلْمُحْسِنِیْنَ الَّذِیْنَ یُقِیْمُوْنَ الصَّلٰوةَ وَ یُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ هُمْ بِالْاٰخِرَةِ هُمْ یُوْقِنُوْنَ.
এগুলো হেকমতপূর্ণ কিতাবের আয়াত- যা ইহসান অবলম্বনকারীদের জন্য হেদায়েত ও রহমতস্বরূপ। যারা সালাত কায়েম করে, যাকাত দেয় এবং আখেরাতের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস রাখে। -সূরা লুকমান (৩১) : ২-৪
২. তাওহীদ, ইখলাস এবং সকল আমলে শরীয়ত ও সুন্নতের অনুসরণ
আমল কবুল হওয়ার জন্য এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَنْ اَحْسَنُ دِیْنًا مِّمَّنْ اَسْلَمَ وَجْهَهٗ لِلهِ وَ هُوَ مُحْسِنٌ وَّ اتَّبَعَ مِلَّةَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا.
তার চেয়ে উত্তম দ্বীন আর কার হতে পারে, যে (তার গোটা অস্তিত্বসহ) নিজ চেহারাকে আল্লাহর সম্মুখে অবনত করেছে, সেইসঙ্গে সে (তার আমলে) ইহসান অবলম্বনকারী এবং একনিষ্ঠ ইবরাহীমের দ্বীন অনুসরণ করেছে। -সূরা নিসা (৪) : ১২৫
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাসীর (৭৭৪ হি.) রাহ. বলেন-
ثُمّ قَالَ تَعَالَى: "وَ مَنْ اَحْسَنُ دِیْنًا مِّمَّنْ اَسْلَمَ وَجْهَهٗ لِلهِ" أَخْلَصَ الْعَمَلَ لِرَبِّهِ عَزّ وَجَلّ، فَعَمِلَ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا. "وَ هُوَ مُحْسِنٌ" أَيِ: اتّبَعَ فِي عَمَلِهِ مَا شَرَعَهُ اللهُ لَهُ، وَمَا أَرْسَلَ بِهِ رَسُولَهُ مِنَ الْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ، وَهَذَانَ الشّرْطَانِ لَا يَصِحّ عَمَلُ عَامِلٍ بِدُونِهِمَا، أَيْ: يَكُونُ خَالِصًا صَوَابًا، وَالْخَالِصُ أَنْ يَكُونَ لِلهِ، وَالصّوَابُ أَنْ يَكُونَ مُتّبِعًا لِلشّرِيعَةِ فيصح ظاهره بالمتابعة، وباطنه بالإخلاص، فمتى فَقَدَ الْعَمَلُ أَحَدَ هَذَيْنِ الشّرْطَيْنِ فَسَدَ. فَمَنْ فقد الإخلاص كان منافقًا، وهم الذين يراءون النّاسَ، وَمَنْ فَقَدَ الْمُتَابَعَةَ كَانَ ضَالّا جَاهِلًا. وَمَتَى جَمَعَهُمَا فَهُوَ عَمَلُ الْمُؤْمِنِينَ: الَّذِیْنَ نَتَقَبَّلُ عَنْهُمْ اَحْسَنَ مَا عَمِلُوْا وَ نَتَجَاوَزُ عَنْ سَیِّاٰتِهِمْ.
অর্থাৎ وَ مَنْ اَحْسَنُ دِیْنًا مِّمَّنْ اَسْلَمَ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে সওয়াবের প্রত্যাশায় একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্যই ইবাদত করে।
আর وَهُوَ مُحْسِنٌ দ্বারা উদ্দেশ্য, যে তার আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত শরীয়ত এবং তাঁর রাসূলকে যে হেদায়েত ও দ্বীনে হক দিয়ে পাঠিয়েছেন, তার অনুসরণ করে।
আমল কবুল হওয়ার জন্য এই দুই শর্ত অপরিহার্য। এই দুই শর্ত ছাড়া কোনো আমলকারীর আমল কবুল হবে না। অর্থাৎ আমলটা খালেস হতে হবে এবং সঠিক হতে হবে। খালেস বলতে একমাত্র আল্লাহর জন্য হওয়া আর সঠিক বলতে শরীয়ত মোতাবেক হওয়া। আমলের বাহ্যিক দিকটা শুদ্ধ হবে শরীয়ত অনুসরণের মাধ্যমে আর ভেতরের দিকটা ঠিক হবে ইখলাসের দ্বারা। এই দুই শর্তের কোনো এক শর্ত না পাওয়া গেলে আমল বরবাদ। ইখলাস না পাওয়া গেলে সেটা হবে মুনাফিকের অবস্থা, যাদের অভ্যাস হল, তারা মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করে। আর শরীয়তের অনুসরণ না করলে সে হবে পথভ্রষ্ট ও মূর্খ। উভয় শর্ত একসঙ্গে হলে সেটা হবে মুমিনদের আমল, যাদের সম্পর্কে কুরআনের সুসংবাদ এই-
اُولٰٓىِٕكَ الَّذِیْنَ نَتَقَبَّلُ عَنْهُمْ اَحْسَنَ مَا عَمِلُوْا وَ نَتَجَاوَزُ عَنْ سَیِّاٰتِهِمْ فِیْۤ اَصْحٰبِ الْجَنَّةِ وَعْدَ الصِّدْقِ الَّذِیْ كَانُوْا یُوْعَدُوْنَ.
[এরাই তারা, আমি যাদের উৎকৃষ্ট কাজসমূহ কবুল করব এবং তাদের মন্দ কাজসমূহ ক্ষমা করব। (ফলে) তারা জান্নাতবাসীদের অন্তর্ভুক্ত হবে, তাদেরকে যে সত্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হত তার বদৌলতে। -সূরা আহকাফ (৪৬) : ১৬] -তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ১, পৃ. ৮৫০
৩. নিষ্ঠার সঙ্গে সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ
ইরশাদ হয়েছে-
وَ السّٰبِقُوْنَ الْاَوَّلُوْنَ مِنَ الْمُهٰجِرِیْنَ وَ الْاَنْصَارِ وَ الَّذِیْنَ اتَّبَعُوْهُمْ بِاِحْسَانٍ رَّضِیَ اللهُ عَنْهُمْ وَ رَضُوْا عَنْهُ وَ اَعَدَّ لَهُمْ جَنّٰتٍ تَجْرِیْ تَحْتَهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَاۤ اَبَدًا ذٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ.
মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা ঈমানে প্রথমে অগ্রগামী এবং যারা নিষ্ঠার সঙ্গে তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ তাদের সকলের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। -সূরা তাওবা (০৯) : ১০
সাহাবায়ে কেরাম হলেন সেই মহাসৌভাগ্যবান জামাত, যাঁরা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কুরআন শিক্ষা করেছেন এবং দ্বীন ও শরীয়তের ইলম হাসিল করেছেন। তাঁদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি আল্লাহ তাআলার তত্ত্বাবধানে ও তাঁর ওহীর সাহায্যে প্রস্তুত করেছেন। তাঁরা হলেন কুরআন এবং দ্বীন-শরীয়তের প্রথম ধারক-বাহক ও প্রথম সাক্ষী। তাঁদের ঈমান আমল ও দ্বীনের পথে অক্লান্ত মেহনত-মুজাহাদায় সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের প্রশংসা করেছেন এবং তাঁদেরকে হেদায়েতের মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
فَاِنْ اٰمَنُوْا بِمِثْلِ مَاۤ اٰمَنْتُمْ بِهٖ فَقَدِ اهْتَدَوْا.
অতঃপর তারাও যদি সে রকম ঈমান আনে, যেমন তোমরা ঈমান এনেছ, তবে তারা সঠিক পথ পেয়ে যাবে। -সূরা বাকারা (০২) : ১৩৭
হাদীস শরীফেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণের আদেশ করেছেন। বিশেষভাবে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন।
সূরা তাওবার এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা অগ্রগামী তাঁদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট। তেমনিভাবে যারা ইহসানের সাথে তথা নিষ্ঠার সঙ্গে এঁদের অনুসরণ করে তাদের প্রতিও তিনি সন্তুষ্ট।
সেজন্য ইহসানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, খোলাফায়ে রাশেদীন, মুহাজির-আনসার সহ সকল সাহাবীর প্রতি অন্তরে মহব্বত রাখা এবং তাঁদের সুন্নাহ ও আদর্শকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করা।
৪. হকের অনুসরণ
এটি মুহসিনদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য। হকের অনুসরণে তারা কখনো পিছপা হয় না। এমনকি সেটা তাদের পূর্বেকার চিন্তা-চেতনা ও নীতি-আদর্শের বিপরীত হলেও। মুহসিন ব্যক্তি সর্বদা সত্য ও সঠিক বিষয়ের সন্ধানে থাকে। সঠিক ও সত্য বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে তা গ্রহণ করে নেয়।
কুরআন মাজীদে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কতিপয় সৌভাগ্যবান ব্যক্তির আলোচনা করেন, যারা ইতিপূর্বে নাসারা ছিল, অতঃপর কুরআন শ্রবণ করে তাদের অন্তর বিগলিত হয়ে যায়, চোখ থেকে অশ্রু প্রবাহিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র সত্যধর্ম ইসলাম কবুল করে নেয়। ইরশাদ হয়েছে-
وَ اِذَا سَمِعُوْا مَاۤ اُنْزِلَ اِلَی الرَّسُوْلِ تَرٰۤی اَعْیُنَهُمْ تَفِیْضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوْا مِنَ الْحَقِّ یَقُوْلُوْنَ رَبَّنَاۤ اٰمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشّٰهِدِیْنَ وَ مَا لَنَا لَا نُؤْمِنُ بِاللهِ وَ مَا جَآءَنَا مِنَ الْحَقِّ وَ نَطْمَعُ اَنْ یُّدْخِلَنَا رَبُّنَا مَعَ الْقَوْمِ الصّٰلِحِیْنَ فَاَثَابَهُمُ اللهُ بِمَا قَالُوْا جَنّٰتٍ تَجْرِیْ مِنْ تَحْتِهَا الْاَنْهٰرُ خٰلِدِیْنَ فِیْهَا وَ ذٰلِكَ جَزَآءُ الْمُحْسِنِیْنَ.
এবং রাসূলের প্রতি যে কালাম নাযিল হয়েছে তারা যখন তা শোনে তখন দেখবে তাদের চোখসমূহকে, তা থেকে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে, যেহেতু তারা সত্য চিনে ফেলেছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি। সুতরাং সাক্ষ্যদাতাদের সাথে আমাদের নামও লিখে নিন।
আর আমরা আল্লাহ এবং যে সত্য আমাদের প্রতি নাযিল হয়েছে তাতে কেন ঈমান আনব না, অথচ আমরা প্রত্যাশা করি, আমাদের প্রতিপালক আমাদেরকে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত করবেন?
সুতরাং তাদের একথার কারণে আল্লাহ তাদেরকে এমন জান্নাত দান করবেন, যার তলদেশে নহর প্রবহমান থাকবে। তাতে তারা সর্বদা থাকবে। এটাই ইহসান অবলম্বনকারীদের প্রতিদান। -সূরা মায়িদা (৫) : ৮৩-৮৫
আমাদের জীবনেও কখনো আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে থাকি। উদাহরণস্বরূপ দ্বীনের কোনো বিষয়ে আমি যেটা জানতাম সেটা ভুল ছিল কিংবা সে বিষয়ে আমার চিন্তা-চেতনা ও আবেগ-অনুভূতি সঠিক ছিল না। এরপর উলামায়ে কেরামের সংশোধনীর মাধ্যমে যখন সঠিক বিষয়টি আমার সামনে স্পষ্ট হল তখন সেটা গ্রহণ করা আমার জন্য আবশ্যক। আমি যদি পেছনের ভুল ছেড়ে হক বিষয়টি গ্রহণ করতে পারি, বোঝা যাবে- আল্লাহর মেহেরবানীতে মুহসিনদের গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য আমার মধ্যে বিদ্যমান আছে। অন্যথায় প্রমাণিত হবে, আমার ঈমানই পূর্ণাঙ্গ হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট ফকীহ তাবেয়ী হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান (১২০ হি.) রাহ.-এর বাণী স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখার মত। তিনি বলেন-
إِنِّي أَنْ أَكُوْنَ تَابعاً فِي الحَقِّ، خَيْرٌ مِنْ أَنْ أَكُوْنَ رَأْساً فِي البَاطِلِ.
হকের একজন সাধারণ অনুসারী হওয়া আমার জন্য বাতিলের প্রধান হওয়া অপেক্ষা অনেক উত্তম। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ইমাম যাহাবী, খ. ৫, পৃ. ২৩৩
৫. তাকওয়া অবলম্বন করা ও সবর করা
এটি ইহসান অবলম্বনকারীদের অনেক বড় বৈশিষ্ট্য। মুমিনের জীবনে কত হালত আসে! অভাব-অনটন, দুঃখ-দুর্দশা, বালা-মসিবত, পরীক্ষা! সর্বাবস্থায় তার কর্তব্য হল তাকওয়া অবলম্বন করা ও সবর করা। হযরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের জীবনে কত বালা-মসিবত ও দুঃখ-দুর্দশা এসেছিল। কিন্তু তিনি সর্বদা সবর করেছেন এবং তাকওয়া অবলম্বন করেছেন। পরিশেষে আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমস্ত বিপদাপদ থেকে উদ্ধার করেন, তাঁর কাছে তাঁর পরিবার-পরিজনকে ফিরিয়ে দেন। সেই সঙ্গে তাঁকে দুনিয়াবী পদমর্যাদার সর্বোচ্চ শিখরেও আসীন করেন। যখন তাঁর ভাইয়েরা তাঁকে তাঁর বিশাল মর্যাদায় সমাসীন দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেল তখন তিনি তাদের বললেন-
قَدْ مَنَّ اللهُ عَلَیْنَا اِنَّهٗ مَنْ یَّتَّقِ وَ یَصْبِرْ فَاِنَّ اللهَ لَا یُضِیْعُ اَجْرَ الْمُحْسِنِیْنَ.
আল্লাহ আমাদের প্রতি বড়ই অনুগ্রহ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন ও ধৈর্য ধারণ করে, আল্লাহ সেরূপ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান নষ্ট করেন না। -সূরা ইউসুফ (১২) : ৯০
৬. কবীরা গুনাহ ও অশ্লীল কাজকর্ম থেকে বেঁচে থাকা
ইরশাদ হয়েছে-
وَ یَجْزِیَ الَّذِیْنَ اَحْسَنُوْا بِالْحُسْنٰی اَلَّذِیْنَ یَجْتَنِبُوْنَ كَبٰٓىِٕرَ الْاِثْمِ وَ الْفَوَاحِشَ اِلَّا اللَّمَمَ .
এবং যারা ইহসান অবলম্বন করেছে তাদেরকে তিনি উত্তম প্রতিদান দান করবেন। যারা বড় বড় গুনাহ ও অশ্লীল কাজ থেকে বেঁচে থাকে, অবশ্য কদাচিৎ পদস্খলন হলে ভিন্ন কথা। -সূরা নাজম (৫৩) : ৩১-৩২
উল্লেখ্য, কোনো সগীরা গুনাহ বারবার করতে থাকলে সেটা বড় গুনাহ হয়ে যায়। তাই সগীরা গুনাহ থেকেও বিরত থাকার চেষ্টা করতে হবে। ইমাম ইবনে রজব রাহ. বলেন-
فَالْمُحْسِنُ: هُوَ مَنْ لَا يَأْتِي بِكَبِيرَةٍ إِلّا نَادِرًا ثُمّ يَتُوبُ مِنْهَا، وَمَنْ إِذَا أَتَى بِصَغِيرَةٍ كَانَتْ مَغْمُورَةً فِي حَسَنَاتِهِ الْمُكَفِّرَةِ لَهَا، وَلَابُدّ أَنْ لا يَكُونَ مُصِرّا عَلَيْهَا، كَمَا قَالَ تَعَالَى: وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ. وَرُوِيَ عَنِ ابْنِ عَبّاسٍ أَنّهُ قَالَ: لَا صَغِيرَةَ مَعَ الْإِصْرَارِ، وَلَا كَبِيرَةَ مَعَ الِاسْتِغْفَارِ.
মুহসিন হল সে, যে কবিরা গুনাহে লিপ্ত হয় না। কখনো হয়ে গেলে তওবা করে ফেলে। আর সগীরা গুনাহ করলে সেটা তার নেক আমলসমূহের মাধ্যমে মাফ হয়ে যায়। তবে বারবার সেই গুনাহ করা যাবে না। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ لَمْ یُصِرُّوْا عَلٰی مَا فَعَلُوْا وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ .
[আর তারা জেনেশুনে তাদের মন্দ কৃতকর্মে অবিচল থাকে না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৫]
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, কোনো সগীরা গুনাহ বারবার করতে থাকলে সেটা আর সগীরা থাকে না। আর কোনো কবীরা গুনাহ থেকে খাঁটি তওবা করলে সেটা আর থাকে না; মুছে যায়। -জামিউল উলূমি ওয়াল হিকাম খ. ১, পৃ. ৩৩৫
৭. সচ্ছল ও অসচ্ছল উভয় অবস্থায় নেককাজে খরচ করা, রাগ দমন করা ও ক্ষমা করা
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ سَارِعُوْۤا اِلٰی مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَ جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمٰوٰتُ وَ الْاَرْضُ اُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِیْنَ الَّذِیْنَ یُنْفِقُوْنَ فِی السَّرَّآءِ وَ الضَّرَّآءِ وَ الْكٰظِمِیْنَ الْغَیْظَ وَ الْعَافِیْنَ عَنِ النَّاسِ وَ اللهُ یُحِبُّ الْمُحْسِنِیْنَ.
এবং নিজ প্রতিপালকের পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও সেই জান্নাত লাভের জন্য একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হও, যার প্রশস্ততা আকাশম-লী ও পৃথিবীতুল্য। তা সেই মুত্তাকীদের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে, যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল অবস্থায় (আল্লাহর জন্য অর্থ) ব্যয় করে এবং যারা নিজের ক্রোধ হজম করতে ও মানুষকে ক্ষমা করতে অভ্যস্ত। আল্লাহ এরূপ পুণ্যবানদের ভালবাসেন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৩৩-১৩৪
৮. ‘অনুগ্রহ কর, যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন’
ইরশাদ হয়েছে-
وَ ابْتَغِ فِیْمَاۤ اٰتٰىكَ اللهُ الدَّارَ الْاٰخِرَةَ وَ لَا تَنْسَ نَصِیْبَكَ مِنَ الدُّنْیَا وَ اَحْسِنْ كَمَاۤ اَحْسَنَ اللهُ اِلَیْكَ وَ لَا تَبْغِ الْفَسَادَ فِی الْاَرْضِ اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ الْمُفْسِدِیْنَ.
আল্লাহ তোমাকে যা-কিছু দিয়েছেন তার মাধ্যমে আখেরাতের নিবাস লাভের চেষ্টা কর এবং দুনিয়া থেকেও নিজ হিস্যা অগ্রাহ্য করো না। আল্লাহ যেমন তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, তেমনি তুমিও (অন্যদের প্রতি) অনুগ্রহ কর। আর পৃথিবীতে ফাসাদ বিস্তারের চেষ্টা করো না। জেনে রেখ, আল্লাহ ফাসাদ বিস্তারকারীদের পছন্দ করেন না। -সূরা কাসাস (২৮) : ৭৭
৯. পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি সদ্ব্যবহার
আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَ اعْبُدُوا اللهَ وَ لَا تُشْرِكُوْا بِهٖ شَیْـًٔا وَّ بِالْوَالِدَیْنِ اِحْسَانًا وَّ بِذِی الْقُرْبٰی وَ الْیَتٰمٰی وَ الْمَسٰكِیْنِ وَ الْجَارِ ذِی الْقُرْبٰی وَ الْجَارِ الْجُنُبِ وَ الصَّاحِبِ بِالْجَنْۢبِ وَ ابْنِ السَّبِیْلِ وَ مَا مَلَكَتْ اَیْمَانُكُمْ اِنَّ اللهَ لَا یُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُوْرَا.
তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার কর। আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গে বসা (বা দাঁড়ানো) ব্যক্তি, পথচারী এবং নিজের দাস-দাসীর প্রতিও (সদ্ব্যবহার কর)। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনও দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না। -সূরা নিসা (৪) : ৩৬.
১০. আদলের পাশাপাশি ইহসানসুলভ আচরণ করা
ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّ اللهَ یَاْمُرُ بِالْعَدْلِ وَ الْاِحْسَانِ وَ اِیْتَآئِ ذِی الْقُرْبٰی وَ یَنْهٰی عَنِ الْفَحْشَآءِ وَ الْمُنْكَرِ وَ الْبَغْیِ یَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنَ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল, ইহসান এবং আত্মীয়-স্বজনকে (তাদের হক) প্রদানের হুকুম দেন। আর অশ্লীলতা, মন্দ কাজ ও যুলুম করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। -সূরা নাহল (১৬) : ৯০
যুলুমের বিপরীত হল আদল ও ইহসান। তবে ইহসান আদলের উপরের স্তর। আদলের প্রতিশব্দ ইনসাফ। অর্থ সমতা বিধান করা। উদাহরণস্বরূপ কোনো কিছু বণ্টনের ক্ষেত্রে কেউ যদি সকল হকদারকে তাদের অংশ ঠিক-ঠিকভাবে বুঝিয়ে দেয় আর নিজের অংশও পরিপূর্ণরূপে আদায় করে নেয় তাহলে এটাকে বলে আদল ও ইনসাফ। আর যদি প্রত্যেককে তাদের অংশ যথাযথভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পাশাপাশি নিজের অংশ থেকেও কিছু দান করে তাহলে সেটা ইহসান। আর অন্যের অংশ থেকে জবরদখল করলে সেটা হবে যুলুম।
অনুরূপভাবে কেউ যদি আমার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে, আমি তার বদলা নিতে পারি। তবে বদলা নিতে গিয়ে একচুল পরিমাণ বাড়াবাড়ি করা যাবে না। করলে সেটা যুলুম হবে। আর চাইলে আমি তাকে ক্ষমাও করে দিতে পারি। সেটা হবে ইহসান।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যুলুমের বিপরীতে আদল ও ইহসানের আদেশ করেন। অর্থাৎ সর্বদা যুলুম থেকে বেঁচে থাকা, ইনসাফ বজায় রাখা এবং সম্ভব হলে ইহসানসুলভ আচরণ করা আর সেটাই অধিক উত্তম।
ইহসানসুলভ আচরণের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমা ও প্রতিদানের আশা করতে পারে এবং এটাই সর্বোত্তম চরিত্র। ইরশাদ হয়েছে-
وَ جَزٰٓؤُا سَیِّئَةٍ سَیِّئَةٌ مِّثْلُهَا فَمَنْ عَفَا وَ اَصْلَحَ فَاَجْرُهٗ عَلَی اللهِ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الظّٰلِمِیْنَ، وَ لَمَنِ انْتَصَرَ بَعْدَ ظُلْمِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ مَا عَلَیْهِمْ مِّنْ سَبِیْلٍ، اِنَّمَا السَّبِیْلُ عَلَی الَّذِیْنَ یَظْلِمُوْنَ النَّاسَ وَ یَبْغُوْنَ فِی الْاَرْضِ بِغَیْرِ الْحَقِّ اُولٰٓىِٕكَ لَهُمْ عَذَابٌ اَلِیْمٌ، وَ لَمَنْ صَبَرَ وَ غَفَرَ اِنَّ ذٰلِكَ لَمِنْ عَزْمِ الْاُمُوْرِ.
মন্দের বদলা অনুরূপ মন্দ। তবে যে ক্ষমা করে দেয় ও সংশোধনের চেষ্টা করে, তার সওয়াব আল্লাহর যিম্মায়। নিশ্চয়ই তিনি যালেমদেরকে পছন্দ করেন না। যারা নিজেদের উপর যুলুম হওয়ার পর (সমপরিমাণ) বদলা নেয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ তো তাদের বিরুদ্ধে, যারা মানুষের উপর যুলুম করে ও পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহ করে বেড়ায়। এরূপ লোকদের জন্য আছে যন্ত্রণাময় শাস্তি। প্রকৃতপক্ষে যে সবর অবলম্বন করে ও ক্ষমা প্রদর্শন করে, তো এটা অবশ্যই অত্যন্ত হিম্মতের কাজ। -সূরা শূরা (৪২) : ৪০-৪৩ (দ্র. তাফসীরে ইবনে কাসীর , খ. ০২, পৃ. ৯০৩)
১১. তাহাজ্জুদ এবং শেষরাতে ইসতিগফার
আল্লাহ তাআলা বলেন-
اِنَّ الْمُتَّقِیْنَ فِیْ جَنّٰتٍ وَّ عُیُوْنٍ، اٰخِذِیْنَ مَاۤ اٰتٰىهُمْ رَبُّهُمْ اِنَّهُمْ كَانُوْا قَبْلَ ذٰلِكَ مُحْسِنِیْنَ، كَانُوْا قَلِیْلًا مِّنَ الَّیْلِ مَا یَهْجَعُوْنَ، وَ بِالْاَسْحَارِ هُمْ یَسْتَغْفِرُوْنَ، وَ فِیْۤ اَمْوَالِهِمْ حَقٌّ لِّلسَّآىِٕلِ وَ الْمَحْرُوْمِ.
মুত্তাকীগণ অবশ্যই উদ্যানরাজি ও প্রস্রবণসমূহের ভেতর থাকবে। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে যা-কিছু দেবেন, তারা তা উপভোগ করতে থাকবে। তারা তো এর আগেই মুহসিন (সৎকর্মশীল) ছিল। তারা রাতের অল্প সময়ই ঘুমাত এবং তারা সাহরীর সময় ইসতিগফার করত। তাদের ধন-সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতের (যথারীতি) হক থাকত। -সূরা যারিয়াত (৫১) : ১৫-১৯
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট তাবেয়ী যায়দ ইবনে আসলাম (১৩৬ হি.) রাহ.-এর একটি বাণী স্মরণে রাখার মত। এক ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞেস করল, একটি বৈশিষ্ট্য এমন, যেটি আমি আমাদের মাঝে (সচরাচর) পাই না। আল্লাহ তাআলা কিছু লোক সম্পর্কে বলেছেন-
كَانُوْا قَلِیْلًا مِّنَ الَّیْلِ مَا یَهْجَعُوْنَ.
‘তারা রাতের অল্প সময়ই ঘুমাত।’
অথচ আমরা তো রাতের অল্প সময়ই জাগরণ করি। যায়দ ইবনে আসলাম রাহ. বললেন-
طُوبَى لِمَنْ رَقَدَ إِذَا نَعَسَ، وَاتّقَى اللهَ إِذَا اسْتَيْقَظَ.
সে ব্যক্তি বড় উত্তম, যে ঘুম আসলে শুয়ে পড়ে আর জাগ্রত হলে আল্লাহকে ভয় করে। (তাফসীরে তবারী, খ. ২১, পৃ. ৫০৯; তাফসীরে ইবনে কাসীর, খ. ০৪, পৃ. ৩৬০)
১২. দ্বীনের পথে চেষ্টারত থাকা এবং কখনো হতাশ হয়ে পিছিয়ে না পড়া
ইরশাদ হয়েছে-
وَ الَّذِیْنَ جَاهَدُوْا فِیْنَا لَنَهْدِیَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَ اِنَّ اللهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِیْنَ.
যারা আমার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টা চালায়, আমি তাদেরকে অবশ্যই আমার পথে উপনীত করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ মুহসিনদের সঙ্গে আছেন। -সূরা আনকাবুত (২৯) : ৬৯
১৩. ওযর ও অপারগতার দরুন আমল না করতে পারলেও নিয়তের মাধ্যমে মুহসিনদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়
ইরশাদ হয়েছে-
لَیْسَ عَلَی الضُّعَفَآءِ وَ لَا عَلَی الْمَرْضٰی وَ لَا عَلَی الَّذِیْنَ لَا یَجِدُوْنَ مَا یُنْفِقُوْنَ حَرَجٌ اِذَا نَصَحُوْا لِلهِ وَ رَسُوْلِهٖ مَا عَلَی الْمُحْسِنِیْنَ مِنْ سَبِیْلٍ وَ اللهُ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.
দুর্বল লোকদের (জিহাদে না যাওয়াতে) কোনও গুনাহ নেই এবং পীড়িত ও সেই সকল লোকেরও নয়, যাদের কাছে খরচ করার মত কিছু নেই, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি অকৃত্রিম থাকে। মুহসিনদের সম্পর্কে কোনও অভিযোগ নেই। আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা তাওবা (৯) : ৯১
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেন, আমরা এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। এ সময় তিনি বলেন-
إِنّ بِالْمَدِينَةِ لَرِجَالًا مَا سِرْتُمْ مَسِيرًا، وَلَا قَطَعْتُمْ وَادِيًا، إِلّا كَانُوا مَعَكُمْ، حَبَسَهُمُ الْمَرَضُ. وفي رواية: إلا شركوكم في الأجر.
মদীনায় একদল লোক রয়ে গেছে। তোমরা যে কোনো পথেই চল এবং যে কোনো উপত্যকাই অতিক্রম কর, তাতে তারা তোমাদের সঙ্গে আছে। রোগ তাদেরকে আটকে রেখেছে। অপর এক বর্ণনায় আছে, প্রতিদানে তারা তোমাদের অংশীদার হবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯১১
এখানে মুহসিনদের অল্প কয়েকটি বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হল। কুরআনে মুহসিনদের আরো অনেক বৈশিষ্ট্যের কথা বর্ণিত আছে। এই সকল বৈশিষ্ট্যের ইলম আমাদেরকে হাসিল করতে হবে এবং সেগুলো নিজেদের মধ্যে ধারণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে ইহসান হাসিলের তাওফীক দান করুন এবং তাঁর মুহসিন বান্দাদের মধ্যে আমাদের শামিল করে নিন-আমীন।
وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.