কুরআন মাজীদের নাম-পরিচয়
আলকিতাব নামের তাৎপর্য
কুরআন মাজীদের দ্বিতীয় প্রসিদ্ধ নাম ‘আলকিতাব’। এই নামের তাৎপর্য কী- তা বোঝার জন্য আরবী ভাষায় এই শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ এবং এর ব্যবহারিক অর্থ জানা দরকার।
كتاب ‘কিতাব’ শব্দের মূল ধাতু হচ্ছে- কাফ, তা, বা। এই ধাতুর মূল অর্থ- একটি জিনিসকে আরেকটির সাথে কিংবা একটি জিনিসের একাংশকে আরেকাংশের সাথে বাঁধা ও যুক্ত করা। যেমন আরবীতে বলা হয়, كتبت السقاء ‘মশকের মুখ বাঁধলাম’। এরপর এই ধাতুর শব্দ লেখা বা লিপিবদ্ধ করা অর্থে ব্যবহার হওয়া শুরু করে। কারণ লেখার মাধ্যমে লিপি বা বর্ণমালাকে পরস্পরে যুক্ত করা হয়। সারকথা, এই ধাতুর শব্দ লিপিবদ্ধ করা অর্থেই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত। ইসলামপূর্ব প্রচীনকাল থেকেই এই ধাতুটি লিপিবদ্ধ করা অর্থে সুপরিচিত।
(দ্র. মাকাইসুল লুগাহ ৮৮৫; লিসানুল আরব ১৩/১৭; আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন, পৃ. ৬৯৯; লুগাতুল কুরআন, আবদুর রশীদ নুমানী ৫/১৪০; বাসায়িরু যাবিত তাময়ীয ১/ ৮৩)
কিতাব শব্দরূপটির অর্থ ও ব্যবহার
এই শব্দটি দু’ভাবে ব্যবহৃত হয় :
এক. ‘লেখা’ বা ‘লিপিবদ্ধ করা’ অর্থে, ‘মাসদার’ বা ক্রিয়ামূলরূপে ব্যবহৃত হয়।
দুই. ‘লিপিবদ্ধ’ বা ‘লিখিত’ অর্থে, اسم المفعول বা কর্মবাচক পদরূপে ব্যবহৃত হয়।
এই দ্বিতীয় অর্থের প্রয়োগক্ষেত্র অনেক ব্যাপক। কারণ আরবী ভাষায় ‘কিতাব’ শুধু গ্রন্থ ও পুস্তক নয়; বরং ক্ষুদ্র পরিসরের কোনো লিপি, কিংবা রচনা, যেমন, চিঠিপত্র বা দু-চার লাইনের কোনো লেখাকে যেমন ‘কিতাব’ বলা হয় তেমনি সংক্ষিপ্ত বা দীর্ঘ কলেবরের কোনো গ্রন্থকেও ‘কিতাব’ বলা হয়। এমনকি লেখা হয়েছে বা লেখা হবে এরকম কোনো আলোচ্য বিষয়বস্তুকেও নির্দেশ করার ক্ষেত্রে কিতাব শব্দটি প্রযোজ্য হয়। আমরা এখানে কুরআন মাজীদ থেকে কিছু প্রয়োগবাক্য উদ্ধৃত করছি-
১। সূরা নামলের ২৮ নং আয়াতে সুলাইমান আ.-এর কথা উদ্ধৃতি করা হয়েছে-
اِذْهَبْ بِّكِتٰبِیْ هٰذَا فَاَلْقِهْ اِلَیْهِمْ ثُمَّ تَوَلَّ عَنْهُمْ فَانْظُرْ مَا ذَا یَرْجِعُوْنَ.
(আমার এ চিঠি নিয়ে যাও। এটি তাদের সামনে ফেলে দিবে তারপর তাদের থেকে সরে যাবে এবং লক্ষ করবে তারা এর জবাবে কী করে।)
২। সূরা হিজরের ৪ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَاۤ اَهْلَكْنَا مِنْ قَرْیَةٍ اِلَّا وَ لَهَا كِتَابٌ مَّعْلُوْمٌ.
(আমি যে জনপদকেই ধ্বংস করেছি, তার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট লিখিত সময়কাল ছিল।)
৩। সূরা বায়্যিনাহ্র ২-৩ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
رَسُوْلٌ مِّنَ اللهِ یَتْلُوْا صُحُفًا مُّطَهَّرَةً، فِیْهَا كُتُبٌ قَیِّمَةٌ.
(আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন রাসূল, যিনি পাঠ করবেন পবিত্র পাতাসমূহ, যাতে লিপিবদ্ধ আছে সত্য-সঠিক বিষয়াবলি।)
৪। সূরা আনকাবূতের ৪৮ নং আয়াতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَا كُنْتَ تَتْلُوْا مِنْ قَبْلِهٖ مِنْ كِتٰبٍ وَّ لَا تَخُطُّهٗ بِیَمِیْنِكَ اِذًا لَّارْتَابَ الْمُبْطِلُوْنَ.
(তুমি তো এর আগে কোনো লেখা পড়নি এবং নিজ হাতে কোনো কিতাব লেখওনি। সে রকম কিছু হলে ভ্রান্তপথ অবলম্বনকারীরা সন্দেহ করতে পারত।)
৫। সূরা আনআমের ৭ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ لَوْ نَزَّلْنَا عَلَیْكَ كِتٰبًا فِیْ قِرْطَاسٍ فَلَمَسُوْهُ بِاَیْدِیْهِمْ لَقَالَ الَّذِیْنَ كَفَرُوْۤا اِنْ هٰذَاۤ اِلَّا سِحْرٌ مُّبِیْنٌ.
(এবং আমি যদি তোমার প্রতি কাগজে লিখিত কোনো কিতাব নাযিল করতাম অতঃপর তারা তা নিজ হাতে স্পর্শ করে দেখত, তবুও তাদের মধ্যে যারা কুফরি অবলম্বন করেছে তারা বলত, এটা স্পষ্ট জাদু ছাড়া আর কিছুই নয়।)
এই শব্দের অন্যান্য ব্যবহারিক অর্থ
كتاب এবং এই ধাতুর বিভিন্ন শব্দরূপ ‘লেখা’ ছাড়াও ফয়সালা করা, হুকুম দেয়া, স্থির করা, নির্ধারণ করা এবং ফরয ও আবশ্যক করা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। অনেক ভাষাবিদের মতে উপরোক্ত অর্থগুলো ‘লেখা’ অর্থেরই রূপক বা ব্যঞ্জণার্থ। কারণ লেখার জন্য কোনো বস্তু বা কাগজের পাতায় বর্ণমালা অঙ্কিত করার মাঝে এবং কোনো বিষয়কে লেখার ভাষায় গ্রন্থিত করার মাঝে বিষয়টিকে সুদৃঢ় ও সুস্থির করার ভাব নিহিত রয়েছে। তাই রূপকার্থে ‘কিতাবুন’ ও তা থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন শব্দরূপ নির্ধারণ করা, আবশ্যক করা, স্থির করা এবং বদ্ধমূল করার অর্থেও প্রযোজ্য হয়। তাই এই ধাতুর বিভিন্ন শব্দ খোদ কুরআন কারীমেও আল্লাহ তাআলা কর্তৃক হুকুম প্রদান, ফরয করা, ভাগ্য নির্ধারণ করা, ওহী প্রেরণ করা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ লক্ষ করুন-
১. সূরা বাকারার ১৮৩ নং আয়াতের শুরুতে আছে-
كُتِبَ عَلَیْكُمُ الصِّیَامُ.
(তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে।)
২. সূরা নিসার ২৪ নং আয়াতে আছে-
كِتٰبَ اللهِ عَلَیْكُمْ.
(এসব তোমাদের প্রতি আল্লাহর ফরয বিধান।)
৩. সূরা নিসার ৭৭ নং আয়াতে আছে-
وَ قَالُوْا رَبَّنَا لِمَ كَتَبْتَ عَلَیْنَا الْقِتَالَ.
(তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি কেন আমাদের প্রতি কিতাল ফরয করলেন।)
(দ্র. আলমুফরাদাত ফী গরীবিল কুরআন, পৃ. ৬৯৯; বাসায়িরু যাবিত তাময়ীয, ফায়রুযাবাদী ৪/৩৩২; আসাসুল বালাগাহ, যামাখশারী, পৃ. ৫৩৫; লুগাতুল কুরআন, আবদুর রশীদ নুমানী ৫/১৪০)
‘আলকিতাব’ শব্দের কুরআনী পরিভাষা
সাধারণ পরিভাষায় তো যে কোনো বই-পুস্তককে আরবীতে ‘কিতাব’ বলা হয়। তবে কুরআন মাজীদে কিতাব শব্দটি ব্যাপক আভিধানিক অর্থে এবং রূপকার্থে ব্যবহৃত হওয়ার পাশাপাশি আরো কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন-
১। ‘লাওহে মাহফুয’ অর্থে। যেমন সূরা আনআমের ৩৮ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
مَا فَرَّطْنَا فِی الْكِتٰبِ مِنْ شَیْءٍ.
[আমি কিতাবে (লাওহে মাহফুযে) কিছুমাত্র ত্রুটি রাখিনি।]
এবং সূরা রা‘দের ৩৯ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
یَمْحُوا اللهُ مَا یَشَآءُ وَ یُثْبِتُ وَ عِنْدَهٗۤ اُمُّ الْكِتٰبِ.
[আল্লাহ যা চান (অর্থাৎ যে বিধানকে ইচ্ছা করেন) রহিত করে দেন এবং যা চান বলবৎ রাখেন। সমস্ত কিতাবের যা মূল তা তাঁরই কাছে।’]
উক্ত আয়াতে ‘সমস্ত কিতাবের মূল’ দ্বারা লওহে মাহফুয বোঝানো হয়েছে।
২। ‘তাকদীরের লিখন’ অর্থে। যেমন সূরা আনফালের ৬৮ নং আয়াত এবং সূরা বনী ইসরাঈলের ৫৮ নং আয়াত।
৩। ‘আমলনামা’ অর্থে। যেমন সূরা কাহফের ৪৯ নং আয়াত।
৪। ‘আল্লাহ তাআলা কর্তৃক সুনির্ধারিত অনাদি বিধান’ অর্থে। যেমন সূরা আলে ইমরানের ১৪৫ নং আয়াতে এবং সূরা রা‘দের ৩৮ নং আয়াতে।
৫। আল্লাহ তাআলার পাক কালাম ও বাণী, যার ভাষা ও বক্তব্য উভয়টি তিনি তাঁর রাসূলদের উপর ফিরিশতাদের মাধ্যমে ওহী আকারে আসমান থেকে নাযিল করেছেন। এটি কুরআনের একটি পরিভাষা। এই পারিভাষিক অর্থে পূর্ববর্তী নবীদের উপর অবতীর্ণ আসমানী কিতাবসমূহকেও কুরআন মাজীদে ‘কিতাব’ নামে অভিহিত করা হয়েছে।
আমরা অনেকসময় দেখে থাকি, একটি শব্দ তার বিভিন্ন অর্থের মধ্য থেকে একটি পূর্ণতম ও শ্রেষ্ঠতম অর্থের সাথে বিশিষ্ট হয়ে যায়। তদ্রূপ এখানে ‘আলকিতাব’ শব্দটি দ্বীন ও শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তাআলার কালাম ও কিতাবের সাথে বিশিষ্ট। এটি দ্বীন ও শরীয়তের প্রাচীন পরিভাষা। কারণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব সৃষ্টির শুরু লগ্ন থেকে মানুষের হেদায়েত ও সংশোধনের জন্য সর্বযুগে দুটি ধারা জারি রেখেছেন :
এক. আল্লাহর কালাম অর্থাৎ আসমানী কিতাবসমূহের ধারা।
দুই. সেই কিতাবের শিক্ষক ও প্রশিক্ষক নবী-রাসূলদের সুন্নাহ ও উসওয়াহ।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে উপরোক্ত দুটি ধারা সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন-
كَانَ النَّاسُ اُمَّةً وَّاحِدَةً فَبَعَثَ اللهُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیْنَ وَ مُنْذِرِیْنَ وَ اَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ لِیَحْكُمَ بَیْنَ النَّاسِ فِیْمَا اخْتَلَفُوْا فِیْهِ .
(শুরুতে) সমস্ত মানুষ একই দ্বীনের অনুসারী ছিল। তারপর (যখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল তখন) আল্লাহ নবীদের পাঠালেন। যারা (সত্যপন্থীদের) সুসংবাদ শুনাত ও (মিথ্যাশ্রয়ীদেরকে) ভীতি প্রদর্শন করত। আর তাদের সাথে সত্য সম্বলিত কিতাব নাযিল করলেন, যাতে তারা মানুষের মধ্যে সেইসব বিষয়ের মীমাংসা করে দেয়, যা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল। -সূরা বাকারা (২) : ২১৩
উপরোক্ত দুটি ধারাই হচ্ছে আসমানী দ্বীন ও শরীয়তের সর্বোচ্চ প্রামাণ্য উৎস। এ সম্পর্কে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-
قُلْ اَرَءَیْتُمْ مَّا تَدْعُوْنَ مِنْ دُوْنِ اللهِ اَرُوْنِیْ مَا ذَا خَلَقُوْا مِنَ الْاَرْضِ اَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِی السَّمٰوٰتِ اِیْتُوْنِیْ بِكِتٰبٍ مِّنْ قَبْلِ هٰذَاۤ اَوْ اَثٰرَةٍ مِّنْ عِلْمٍ اِنْ كُنْتُمْ صٰدِقِیْنَ.
(আপনি বলুন, আচ্ছা বল তো, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের ডাক, আমাকে দেখাও তো ওরা পৃথিবীতে কী সৃষ্টি করেছে? অথবা আকাশম-লীতে ওদের কি কোনো অংশ আছে? তোমরা আমার নিকট নিয়ে আস এর পূর্বের কোনো কিতাব অথবা পরম্পরাগত কোনো জ্ঞান, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।) -সূরা আহকাফ (৪৬) : ৪
পরম্পরাগত কোনো জ্ঞান বলে দ্বীন ও শরীয়তের দ্বিতীয় ধারাটির প্রতিই ইশারা করা হয়েছে। অর্থাৎ নবীর হাদীস ও সুন্নাহ, যা তাঁর থেকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা পরম্পরায় প্রমাণিত। যাহোক, দ্বীন ও শরীয়তের সর্বোচ্চ প্রামাণ্য প্রথম উৎসটির একটি পারিভাষিক নাম হচ্ছে আলকিতাব, যা সরাসরি আল্লাহ তাআলার কালাম ও বাণী। আলকুরআন ও পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহ যে সরাসরি আল্লাহ তাআলার কালাম এ কথার যেসব অকাট্য প্রমাণ খোদ কুরআন মজীদে রয়েছে তার একটি হল, এসব কিতাবকে আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে (كلام الله) কালামুল্লাহ (كلامي) কালামী এবং (كلمات) কালিমাত শব্দ দ্বারা ভূষিত করেছেন। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি আয়াত এখানে উল্লেখ করছি।
১। সূরা বাকারার ৭৫ নং আয়াত-
اَفَتَطْمَعُوْنَ اَنْ یُّؤْمِنُوْا لَكُمْ وَ قَدْ كَانَ فَرِیْقٌ مِّنْهُمْ یَسْمَعُوْنَ كَلٰمَ اللّٰهِ ثُمَّ یُحَرِّفُوْنَهٗ مِنْۢ بَعْدِ مَا عَقَلُوْهُ وَ هُمْ یَعْلَمُوْنَ.
উক্ত আয়াতে কালামুল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য, তাওরাত, যা হযরত মূসা আ.-এর উপর নাযিল হয়েছিল।
২। সূরা তাওবার ৬ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اِنْ اَحَدٌ مِّنَ الْمُشْرِكِیْنَ اسْتَجَارَكَ فَاَجِرْهُ حَتّٰی یَسْمَعَ كَلٰمَ اللهِ ثُمَّ اَبْلِغْهُ مَاْمَنَهٗ ذٰلِكَ بِاَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا یَعْلَمُوْنَ.
উক্ত আয়াতে কালামুল্লাহ দ্বারা উদ্দেশ্য হল আলকুরআনুল কারীম।
৩। সূরা কাহফের ২৭ নং আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
وَ اتْلُ مَاۤ اُوْحِیَ اِلَیْكَ مِنْ كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمٰتِهٖ وَ لَنْ تَجِدَ مِنْ دُوْنِهٖ مُلْتَحَدًا.
[(হে নবী!) তোমার কাছে তোমার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে যে ওহী পাঠানো হয়েছে, তা পড়ে শোনাও। এমন কেউ নেই, যে তাঁর বাণী পরিবর্তন করতে পারে এবং তুমি তাঁকে ছাড়া অন্য কোনও আশ্রয়স্থল পাবে না কখনওই।]
‘আলকিতাব’ নামের তাৎপর্য
এক. কুরআনে কারীমের সত্তরের বেশি আয়াতে কুরআনের জন্য ‘কিতাব’ নামটি ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি প্রথম যেখানে কুরআনের পরিচয় পেশ করা হয়েছে সেখানে কিতাব শব্দ দ্বারাই কুরআনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সূরা বাকারার শুরুতে আছে-
الٓمّٓ ذٰلِكَ الْكِتٰبُ لَا رَیْبَ فِیْهِ هُدًی لِّلْمُتَّقِیْنَ.
[আলিফ-লাম-মীম। এই (মহান) কিতাবে কোনো সন্দেহ নেই।]
উক্ত আয়াতের ذٰلِكَ الْكِتٰبُ শব্দযুগল লক্ষণীয়, এর শাব্দিক অনুবাদ-‘ঐ কিতাবটি’। ‘ঐ’ অর্থে শব্দটি দূরবর্তী বস্তুকে নির্দেশ করে। স্থানগত বিচারে দূরে অবস্থিত বস্তুকে যেমন নির্দেশ করে, তেমনি মর্যাদায় অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থিত বস্তুকেও বুঝায়। এখানে ذٰلِكَ শব্দটি নির্দেশিত বস্তু মর্যদায় অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থিত-এই ভাব ব্যক্ত করছে। এরপর দেখুন- ‘আলকিতাব’ শব্দটি বিশিষ্টতাজ্ঞাপক আলিফ-লাম সহ কোনোরূপ বিশেষণ ছাড়া নিঃশর্তভাবে উল্লিখিত হয়েছে। তার মানে এই শব্দকাঠামোটি বিশিষ্টতা ও পূর্ণাঙ্গতার ভাব প্রকাশ করছে। যেন এটাই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কিতাব, আর অন্যসব কিতাব তার তুলনায় অপূর্ণাঙ্গ। তাই ذٰلِكَ الْكِتٰبُ শব্দযুগলের বাংলা ভাবানুবাদ ‘এই মহান ও পূর্ণাঙ্গ কিতাব’ হবে। আসলে পুরো ভাব শুধু শাব্দিক তরজমায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অনেক মুফাসসির এই ‘আলকিতাব’ শব্দের মর্ম নিম্নোক্ত ভাষায় বর্ণনা করেছেন-
ومعناه : أن ذلك الكتاب هو الكتاب الكامل كأن ما عداه من الكتب في مقابلته ناقص، وأنه الذي يستأهل أن يسمى كتابا كما تقول : هو الرجل أي الكامل في الرجولية الجامع لما يكون في الرجال من مرضيات الخصال.
অর্থাৎ এই কিতাবটিই একমাত্র পূর্ণাঙ্গ কিতাব। যেন এর মোকাবেলায় অন্য সকল কিতাব অপূর্ণাঙ্গ। এটিই একমাত্র কিতাব নামের উপযুক্ত। যেমন আরবীতে বলা হয়- هو الرجل ‘তিনিই একমাত্র পুরুষ’ অর্থাৎ তিনি পূর্ণাঙ্গ পুরুষ, তার মধ্যে পুরুষত্বের সকল উৎকৃষ্ট গুণের সমাবেশ ঘটেছে। (দ্রষ্টব্য : আলকাশশাফ, যামাখশারী ১/১১১-১১২; তাফসীর আবিস সাউদ ১/৩৫-৩৬; নাজমুদ দুরার ১/৭৯)
প্রকৃত অর্থেই কুরআন হল এক অতুলনীয়, অনবদ্য ও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ, কারণ কুরআন কারো রচনা নয়। এটা আল্লাহ তাআলার পাক কালাম। কোনো মাখলুকের বাণী নয়। এর শব্দ ও অর্থ উভয়টাই আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় রাসূলের উপর ফিরিশতা হযরত জিবরীল আ.-এর মাধ্যমে ওহী আকারে আসমান থেকে নাযিল করেছেন।
কুরআনে কারীম সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ, এর মাধ্যমে নবুওত ও রিসালাত এবং আসমানী গ্রন্থ পরম্পরার সুসমাপ্তি ঘটেছে। সুতরাং এর জন্য কোনো সংযোজন বা সম্পূরকের প্রয়োজন নেই। কুরআন মাজীদের বিধান ও শিক্ষা চিরন্তন ও শাশ্বত এবং বিশ্বজনীন, যা বিশেষ স্থান বা কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয়। কিংবা বিশেষ শ্রেণী ও জনগোষ্ঠীর জন্যও প্রদত্ত নয়; বরং স্থান-কাল নির্বিশেষে গোটা মানবজাতির জন্য তা অবশ্যগ্রহণীয় ও অপরিহার্যরূপে অনুসরণীয়। সুতরাং এই কুরআন সব ধরনের পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও রহিতকরণ থেকে এবং স্থান ও কালের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। এ কিতাব যেহেতু সামগ্রিক বিচারে শতকরা একশ ভাগ পরিপূর্ণ, তাই এতে কোনো পরিমার্জন এবং পরিশিষ্টের প্রয়োজন নেই। ইরশাদ হয়েছে-
اَلْیَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِیْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَیْكُمْ نِعْمَتِیْ وَ رَضِیْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِیْنًا .
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের উপর আমার নিআমত পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে (চির দিনের জন্য) পছন্দ করে নিলাম। -সূরা মায়েদা (৫) : ৩
একমাত্র কুরআন ছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে যত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে, সেগুলোর কোনোটিই আল্লাহর কালাম বা কিতাব নয়। অবশ্য বর্তমানের অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থ সরাসরি আল্লাহর কালাম ও কিতাব হওয়ার দাবি নিজেও করেনি এবং তার অনুসারীরাও করেনি এবং তা করা সম্ভবও নয়। কুরআনের পূর্বে আল্লাহ তাআলা অন্যান্য নবী-রাসূলদের প্রতি যেসব কিতাব নাযিল করেছিলেন, যেমন, তাওরাত, যাবূর ও ইনজীল এগুলোর কোনোটিই এখন আর অবশিষ্ট নেই। আছে শুধু নাম। ভিন্ন ভাষায় অনুবাদের কারণে যে ভাষায় এসব কিতাব নাযিল হয়েছিল সেই মূল ভাষা তো অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তো এসব কিতাব শব্দগত ও অর্থগত নানা বিকৃতির শিকার হয়েছে। আর এসব কিতাবের যেসব কপি এখন তার অনুসারীদের কাছে রয়েছে, সেসব তো নবীদের প্রতি নাযিলকৃত কিতাব নয়।
সুতরাং কুরআন মাজীদই এখন একমাত্র সত্য আসমানী কিতাব। কুরআনের মাধ্যমেই সত্য-মিথ্যা নির্ণীত হবে। কুরআনই পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবের স্মৃতি সংরক্ষণ করেছে। পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের চিরন্তন শিক্ষা ও নির্দেশাবলি নিজের মাঝে শামিল করে নিয়েছে। কুরআনে কারীম একইসাথে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের সমর্থক ও সংরক্ষক। সেগুলো আসমানী কিতাব হওয়ার বিষয়টিকে কুরআন সমর্থন করে আবার এ কিতাবগুলোতে কৃত বিকৃতকারীদের বিকৃতি নির্দেশ করে দিয়ে সেগুলোর মৌলিক শিক্ষা ও হেদায়াতের সংরক্ষণ করে। পূর্ববর্তী শরীয়তের সাময়িক বিধানাবলি কুরআনী শরীয়তের মাধ্যমে মানসূখ ও রহিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেছেন-
وَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ مُصَدِّقًا لِّمَا بَیْنَ یَدَیْهِ مِنَ الْكِتٰبِ وَ مُهَیْمِنًا عَلَیْهِ فَاحْكُمْ بَیْنَهُمْ بِمَاۤ اَنْزَلَ اللهُ وَ لَا تَتَّبِعْ اَهْوَآءَهُمْ عَمَّا جَآءَكَ مِنَ الْحَقِّ لِكُلٍّ جَعَلْنَا مِنْكُمْ شِرْعَةً وَّ مِنْهَاجًا وَ لَوْ شَآءَ اللهُ لَجَعَلَكُمْ اُمَّةً وَّاحِدَةً وَّ لٰكِنْ لِّیَبْلُوَكُمْ فِیْ مَاۤ اٰتٰىكُمْ فَاسْتَبِقُوا الْخَیْرٰتِ.
এবং আমি তোমার প্রতি সত্য সম্বলিত কিতাব নাযিল করেছি। তার পূর্বের কিতাবসমূহের সত্যায়নকারী ও সংরক্ষকরূপে। সুতরাং তাদের মধ্যে সেই (বিধান) অনুসারেই বিচার কর, যা আল্লাহ নাযিল করেছেন। আর তোমার নিকট যে সত্য এসেছে তা ছেড়ে তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না। তোমাদের মধ্যে প্রত্যেক (উম্মত)-এর জন্য আমি এক (পৃথক) শরীয়ত ও পথ নির্ধারণ করেছি। আল্লাহ চাইলে তোমাদের সকলকে একই উম্মত বানিয়ে দিতেন। কিন্তু (পৃথক শরীয়ত এজন্য দিয়েছেন) যাতে তিনি তোমাদেরকে যা কিছু দিয়েছেন তা দ্বারা তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন। সুতরাং তোমরা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা কর। -সূরা মায়েদা (৫) : ৪৮
দুই. কালাম ও বাণী হওয়া যেমন কুরআনের বৈশিষ্ট্য তেমনি লিপিবদ্ধ হওয়াও কুরআনের বৈশিষ্ট্য। তাই কুরআন মাজীদ যেমন আল্লাহ তাআলার কালাম ও বাণী তেমনি তা তাঁর পক্ষ থেকে সুসংহতভাবে যথারীতি লিপিবদ্ধ ও সুসংরক্ষিত আসমানী কিতাব। তাই আল্লাহ তাআলা কুরআনকে তাঁর নিজের কিতাব হিসেবে অভিহিত করেছেন। এ সংক্রান্ত কুরআনে কারীমের কিছু আয়াত পাঠ করুন-
১. সূরা ফাতিরের ২৯ নং আয়াত-
اِنَّ الَّذِیْنَ یَتْلُوْنَ كِتٰبَ اللهِ وَ اَقَامُوا الصَّلٰوةَ وَ اَنْفَقُوْا مِمَّا رَزَقْنٰهُمْ سِرًّا وَّ عَلَانِیَةً یَّرْجُوْنَ تِجَارَةً لَّنْ تَبُوْرَ.
২. সূরা ইবরাহীমের ১ নং আয়াত-
الٓرٰ ۫ كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوْرِ بِاِذْنِ رَبِّهِمْ اِلٰی صِرَاطِ الْعَزِیْزِ الْحَمِیْدِ.
৩. সূরা কাহফের ২৭ নং আয়াত-
وَ اتْلُ مَاۤ اُوْحِیَ اِلَیْكَ مِنْ كِتَابِ رَبِّكَ لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمٰتِهٖ وَ لَنْ تَجِدَ مِنْ دُوْنِهٖ مُلْتَحَدًا.
৪. সূরা সাজদার ২ নং আয়াত-
تَنْزِیْلُ الْكِتٰبِ لَا رَیْبَ فِیْهِ مِنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল করার বহু আগে থেকেই এই কুরআন ও আলকিতাব লওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ রয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
اِنَّهٗ لَقُرْاٰنٌ كَرِیْمٌ فِیْ كِتٰبٍ مَّكْنُوْنٍ لَّا یَمَسُّهٗۤ اِلَّا الْمُطَهَّرُوْنَ تَنْزِیْلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعٰلَمِیْنَ.
নিশ্চয়ই এটা অতি সম্মানিত কুরআন, যা এক সুরক্ষিত কিতাবে (পূর্ব থেকেই) লিপিবদ্ধ আছে। একে স্পর্শ করে কেবল তারাই, যারা অত্যন্ত পবিত্র। এটা জগৎসমূহের প্রতিপালকের পক্ষ হতে অল্প অল্প করে অবতারিত। -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৭৭-৮০
সুরা আবাসা ১৩-১৬ আয়াতে ইরশাদ করেছেন-
فِیْ صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ، مَّرْفُوْعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ، بِاَیْدِیْ سَفَرَةٍ،كِرَامٍۭ بَرَرَةٍ.
[এটা লিপিবদ্ধ আছে এমন সহীফাসমূহে, যা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। উচ্চস্তরের, অতি পবিত্র। এমন লিপিকারদের হাতে (লিপিবদ্ধ), যারা অতি মর্যাদাসম্পন্ন, পুণ্যবান।]
সূরা বুরূজ ২১-২২ নং আয়াতে ইরশাদ করেছেন-
بَلْ هُوَ قُرْاٰنٌ مَّجِیْدٌ، فِیْ لَوْحٍ مَّحْفُوْظٍ.
(বরং এটা অতি সম্মানিত কুরআন, যা লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ।)
তিন. চিন্তা ও কল্পনার জগতে অবস্থিত নিরেট ভাব ও মর্মকে কিতাব বা গ্রন্থ বলা হয় না। ভাব ও মর্ম যখন শব্দ ও বাক্য কাঠামো দ্বারা লিখিতরূপে গ্রন্থিত হয় তখনই তাকে কিতাব বা গ্রন্থ ও পুস্তক বলা হয়। সুতরাং কুরআনে কারীম আল্লাহ তাআলার কিতাব হওয়ার অনিবার্য দাবি হচ্ছে, এর শব্দমালা ফিরিশতা বা নবীর নয়, বরং শব্দ ও মর্ম উভয়ই আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী মারফত নাযিলকৃত।
চার. পূর্ণ কুরআন মাজীদ যদিও একসাথে লিপিবদ্ধ মুসহাফ আকারে নাযিল হয়নি; বরং কিছু কিছু করে পর্যায়ক্রমে ২৩ বছরে নাযিল হয়েছে। কিন্তু কিতাব ও গ্রন্থ হওয়া যেহেতু কুরআনের বৈশিষ্ট্য তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই কুরআনে কারীমের আয়াতসমূহকে বিশেষভাবে লিখে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। ফলে পুরো কুরআনে কারীমেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন পত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। অনেক সাহাবীও নিজেদের উদ্যেগে তিলাওয়াত ও সংরক্ষণের জন্য কুরআনকে নিজেদের কাছে লিখে রেখেছেন।
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তত্ত্বাবধানে যা লেখা হয়েছিল তা সামনে রেখেই হযরত আবূ বকর রা.-এর খেলাফত আমলে সুবিন্যস্ত গ্রন্থাকারে কুরআনের মুসহাফ সংকলিত হয়। এরপর হযরত উছমান রা.-এর খেলাফত আমলে পুনরায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তত্ত্বাবধানে যা লেখা হয়েছিল তা সামনে রেখে এবং হযরত আবূ বকর রা.-এর তত্ত্বাবধানে যে মুসহাফ তৈরি করা হয়েছিল তা সামনে রেখে কুরআনের অকেন কপি তৈরি করা হয় এবং মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় তা পাঠানো হয়।
পাঁচ. কুরআন মাজীদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি পূর্ণাঙ্গরূপে একবারেই নাযিল করা হয়নি; বরং অল্প অল্প করে প্রায় তেইশ বছরে তা নাযিল করা হয়েছে। কিন্তু এই পর্যায়ক্রমিক অবতারণ শুরু হওয়ার পূর্বে দুনিয়ার প্রথম আসমানে একসাথে নাযিল হয়েছে এবং এরও অনেক পূর্বে আসমানের লওহে মাহফুযে একত্রে বিন্যস্ত কিতাবরূপে লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ কারণে কুরআনে কারীমকে যদিও বিশেষ হেকমতের কারণে প্রয়োজন অনুসারে অল্প অল্প করে নাযিল করা হয়েছে, কিন্তু নাযিল হওয়ার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলার নির্দেশ এবং নির্দেশনায় নাযিলের তারতীব থেকে ভিন্ন তারতীবে কুরআনের আয়াত ও সূরাসমূহকে বিন্যস্ত করেছেন। অতঃপর এই বিন্যাস অনুযায়ী তিনি নিজে নামাযেও পড়তেন। অন্যান্য সময় কুরআন মাজীদ তিলাওয়াতও করতেন। এই বিন্যাস অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরাম কুরআন মাজীদ মুখস্থ করতেন। কাজেই কুরআনের বর্তমান বিন্যাস একটি প্রমাণিত ঐতিহাসিক সত্য। যেদিন কুরআন মাজীদের অবতারণ সম্পূর্ণ হয়ে যায় সেদিন তার বিন্যাসও সম্পূর্ণ হয়ে যায়। যে মহান সত্তা এই কুরআন নাযিল করেছেন তিনি এটি বিন্যস্তও করেছেন। যাঁর উপর এটি নাযিল করেছিলেন তাঁরই মাধ্যমে এটি বিন্যস্ত করান। এর মধ্যে অনুপ্রবেশ বা হস্তক্ষেপ করার অধিকার ও ক্ষমতা কারো ছিল না। সুতরাং কুরআনে কারীমের বর্তমান বিন্যাস রক্ষা করা জরুরি।
ছয়. আল্লাহ তাআলার পাক কালামের ‘আলকুরআন’ ও ‘আলকিতাব’- এ নামদুটির মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কুরআনের হক হল, কুরআনকে সিনায় ধারণ করে এবং মুখে পঠন-পাঠনের মাধ্যমে সংরক্ষিত করা হবে, তেমনি লিপিবদ্ধ আকারে সংরক্ষিত করা হবে। তাই রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন নাযিলের শুরু থেকেই যেমন নিজে কুরআনের হিফ্য ও তিলাওয়াত করেন এবং সাহাবীদেরকেও হেফয ও তিলাওয়াত করান, তেমনি তা লিপিবদ্ধ আকারে সংরক্ষিত করার বিশেষ ব্যবস্থা করেন, যা অকাট্য দলীলসমূহ দ্বারা প্রমাণিত।
‘আলকুরআন’ ও ‘আলকিতাব’- নামদুটির মাঝে এই ইজমায়ী (সর্ববাদীসম্মত) সিদ্ধান্তের প্রতিও ইঙ্গিত রয়েছে যে, কুরআনের নস তথা পাঠ নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেই পঠনরীতিকে অনুসরণ করতে হবে, যা কুরআনের অসংখ্য হাফেয ও কারীদের হিফ্য ও কিরাতের পরম্পরায় স্বীকৃত। তেমনি সেই রসমুল খত-লিখনরীতি অনুসরণ করতে হবে, যা সাহাবায়ে কেরামের কাছে সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকৃত হয়েছে এবং আজ অবধি প্রজন্ম পরম্পরায় সন্দেহাতীতভাবে সুরক্ষিত রয়েছে। (দ্রষ্টব্য : আননাবাউল আযীম, শাইখ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দাররায, পৃ. ১৩)
সাত. কুরআন মাজীদ যথার্থভাবে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ, সুবিন্যস্ত ও সুসংরক্ষিত আসমানী গ্রন্থ। এ মহান গ্রন্থ অন্যান্য ধর্মের ইলহামী গ্রন্থের মতো নয় যে, ধর্ম প্রবর্তকের স্মৃতিতে শুধু বিষয় ও ভাব সংরক্ষিত ছিল আর তাদের কাছ থেকে একেক বর্ণনাকারী একেক অংশ একেক রকম বর্ণনা করেছেন। এরপর কয়েক শতাব্দী পরে সংকলন ও গ্রন্থনার পালা শুরু হলে ভাষা ও শব্দগত বিশুদ্ধতা তো দূরের কথা, স্বয়ং ভাব ও বিষয়বস্তুই বিকৃতির শিকার হয় এবং আসমানী কিতাবের নাম ধারণ করলেও আল্লাহ মালূম তার বিন্যাস ও রচনায় কত শত মানুষের লেখনী ও মস্তিষ্ক কাজ করেছে। সাক্ষী-সাবুদের ঝামেলা বাদ দিন, এক্ষেত্রে নিছক দাবির পর্যায়েও তো দুনিয়ার কোনো ইলহামী কিতাব কুরআনের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। বর্তমান তাওরাত, ইনজীল, যবুর, বেদ ইত্যাদি কোনো ধর্মগ্রন্থেরই এমন দাবি নেই যে, তার অক্ষর-শব্দ সমেত আসমান থেকে নাযিলকৃত কিতাব। এমনকি অনুসারীরাও তাদের ধর্মগ্রন্থকে অনুরূপভাবে পেশ করে না। এই শাব্দিক অবতারণের দাবিদার একমাত্র কুরআন মাজীদ।
আট. কুরআন কোনো মাখলুকের রচিত কিতাব নয়। কুরআন হল স্বয়ং আল্লাহ তাআলার পাক কালাম ও সিফাত। কুরআন হল كلام معجز অক্ষমকারী কালাম, যার সমতুল্য ছোট্ট একটি সূরাও তৈরি করা সম্ভব নয়। জিন ও ইনসান মিলেও যদি চেষ্টা করে তবুও নয়। কুরআনের ভাষা খাঁটি আরবী ভাষা। কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরআনের বর্ণনাভঙ্গী আরবী কালাম ও সাহিত্যের প্রচলিত যতগুলো প্রকার রয়েছে তার বর্ণনাভঙ্গী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।
বর্ণনাভঙ্গী সাধারণত তিন প্রকার হয়ে থাকে। ১. খেতাবী তথা ভাষণ ও বক্তৃতার ভঙ্গী। ২. আদবী তথা সাহিত্যিক রচনার ভঙ্গী। ৩. ইলমী তথা জ্ঞানভিত্তিক গবেষণাধর্মী রচনার রীতি।
আমরা জানি, এই তিনটি বর্ণনাশৈলীর অঙ্গন সম্পূর্ণ আলাদা, একই লেখাতে এই তিনটি শৈলী একত্র করা সম্ভব নয়। কিন্তু কুরআন কারীম এই সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে। কেননা কুরআন কারীমে একইসঙ্গে এই তিনটি বর্ণনাশৈলী বহমান। জ্ঞান ও বাস্তবসম্মত বর্ণনার বস্তুনিষ্ঠতা, ভাষণের জোরালো ও দৃপ্ত উপস্থাপনা এবং সাহিত্যের রস ও মিষ্টতার ভারসাম্যপূর্ণ মিশেল কুরআনের প্রতিটি আয়াতে ছড়িয়ে আছে। এটি কুরআনের ইজায ও অলৌকিকত্বের একটি বড় দিক। এ প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনে হাজার হায়তামী রাহ. সুন্দর বলেছেন-
ومنها : (أي وجوه إعجاز القرآن) خروجه عن جنس كلام العرب نظما ونثرا، خطبا وشعرا، ورجزا وسجعا، فلا يدخل في شيء منها مع كون ألفاظه وحروفه من جنس كلامهم، ومن ثم لم يهتدوا بمثله حتى يأتوا به. (الفتح المبين بشرح الأربعين ص : ৯১، ومن صحاح الأحاديث القدسية للشيخ محمد عوامة ص ১৭)
অর্থাৎ কুরআনের একটি ইজায হল, কুরআনের ভাষা ও শব্দমালা আরবী হওয়া সত্ত্বেও আরবী কালামের যতগুলো প্রকার রয়েছে তা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আরবী সাধারণ গদ্য ও পদ্য, বক্তৃতা ও কবিতা এবং বিশেষ ছন্দে গাঁথা পদ্য ও অন্তমিলযুক্ত গদ্য- কোনোটির ছাঁচেই কুরআনকে ফেলা যায় না। এজন্যই তো আরবরা কুরআনের সমতুল্য কোনো কিছুই তৈরি করতে পারেনি।
বস্তুত অনন্যতা-ই কুরআনের বৈশিষ্ট্য এবং কুরআনের তুলনা কুরআন নিজেই।
নয়. আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উম্মী বানিয়েছেন। তিনি প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে কারো কাছে লেখাপড়া শেখেননি। এমনকি যখন ফিরিশতা জিবরীল আ. আল্লাহর কিতাব কুরআনের প্রথম ওহী নিয়ে তাঁর কাছে আগমন করলেন এবং তাঁকে পড়তে বললেন, তখন তিনি বললেন-
ما أنا بقارئ.
(আমি তো পড়তে জানি না।)
এমতাবস্থায় তাঁর পক্ষে উচ্চ সাহিত্য গুণসম্পন্ন সুসংহত ও সুবিন্যস্ত অলৌকিক কিতাব পেশ করা সাক্ষাৎ একটি বিরাট মুজিযা। যা একথাই প্রমাণ করে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য রাসূল এবং তাঁর প্রতি নাযিলকৃত কুরআন আল্লাহর কিতাব।
আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে ইরশাদ করেছেন-
وَ كَذٰلِكَ اَنْزَلْنَاۤ اِلَیْكَ الْكِتٰبَ فَالَّذِیْنَ اٰتَیْنٰهُمُ الْكِتٰبَ یُؤْمِنُوْنَ بِهٖ وَ مِنْ هٰۤؤُلَآءِ مَنْ یُّؤْمِنُ بِهٖ وَ مَا یَجْحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا الْكٰفِرُوْنَ وَ مَا كُنْتَ تَتْلُوْا مِنْ قَبْلِهٖ مِنْ كِتٰبٍ وَّ لَا تَخُطُّهٗ بِیَمِیْنِكَ اِذًا لَّارْتَابَ الْمُبْطِلُوْنَ بَلْ هُوَ اٰیٰتٌۢ بَیِّنٰتٌ فِیْ صُدُوْرِ الَّذِیْنَ اُوْتُوا الْعِلْمَ وَ مَا یَجْحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا الظّٰلِمُوْنَ وَ قَالُوْا لَوْ لَاۤ اُنْزِلَ عَلَیْهِ اٰیٰتٌ مِّنْ رَّبِّهٖ قُلْ اِنَّمَا الْاٰیٰتُ عِنْدَ اللهِ وَ اِنَّمَاۤ اَنَا نَذِیْرٌ مُّبِیْنٌ اَوَ لَمْ یَكْفِهِمْ اَنَّاۤ اَنْزَلْنَا عَلَیْكَ الْكِتٰبَ یُتْلٰی عَلَیْهِمْ اِنَّ فِیْ ذٰلِكَ لَرَحْمَةً وَّ ذِكْرٰی لِقَوْمٍ یُّؤْمِنُوْنَ۠.
(হে রাসূল!) এভাবেই আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি। সুতরাং যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা এতে ঈমান আনে এবং তাদের (অর্থাৎ মূর্তিপূজকদের) মধ্যেও কেউ কেউ এতে ঈমান আনছে। বস্তুত আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে কেবল কাফেররাই। তুমি তো এর আগে কোনো লেখা পড়নি এবং নিজ হাতে কোনো কিছু লেখওনি। সেরকম কিছু হলে বাতিলপন্থীরা সন্দেহ করতে পারত। প্রকৃতপক্ষে কুরআন এমন নির্দেশনাবলির সমষ্টি, যা জ্ঞানপ্রাপ্তদের অন্তরে সম্পূর্ণ সুস্পষ্ট। আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে কেবল জালেমগণই। তারা বলে, তার প্রতি (অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রতি) তার প্রতিপালকের পক্ষ হতে কেন নিদর্শনাবলি অবতীর্ণ করা হল না? (হে রাসূল! তাদেরকে) বল, নিদর্শনাবলি তো আল্লাহরই কাছে। আমি একজন স্পষ্ট সতর্ককারীমাত্র। তবে কি তাদের জন্য এটা (অর্থাৎ এই নিদর্শন) যথেষ্ট নয় যে, আমি তোমার প্রতি কিতাব নাযিল করেছি, যা তাদেরকে পড়ে শোনানো হচ্ছে? নিশ্চয়ই যেসমস্ত লোক বিশ্বাস করে তাদের জন্য এতে রয়েছে রহমত ও উপদেশ। -সূরা আনকাবূত (২৯) : ৪৭-৫১
দশ. قرآن ও كتاب শব্দের মূল বুৎপত্তিগত অর্থ একত্রকরণ ও সংকলন-এ কথা আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। এই সংকলন ও একত্রকরণের অর্থটি কুরআনের মাঝে পূর্ণমাত্রায় রয়েছে। কেননা কুরআনে কারীম হচ্ছে এক শত চৌদ্দটি সূরা এবং ছয় সহস্রাধিক আয়াতের সংকলন। বিচিত্র জ্ঞান ও তত্ত্বের সংকলন। তাই তো এতে আমরা দেখতে পাই, আকীদা-বিশ্বাস সম্পর্কিত বিষয়াবলি, নৈতিক বিধি-নির্দেশ, শরীয়তের বিধান, দাওয়াত, উপদেশ, সতর্কবাণী, ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাস ও আমলের সমালোচনা-পর্যালোচনা, যুক্তি-প্রমাণ, ঐতিহাসিক কাহিনী ও প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনের প্রতি ইঙ্গিত, পৃথিবী ও আকাশের গঠন আকৃতি, মানুষ সৃষ্টির প্রক্রিয়া এবং বিশ্বজগতের নিদর্শনসমূহের আলোচনা প্রভৃতি আরো অনেক বিষয়ের সমাহার। তদ্রূপ কুরআনে কারীমে পূর্ববর্তী আসমানী কিতাবসমূহের শাশ্বত ও চিরন্তন শিক্ষাসমূহের সংকলন ও সংরক্ষণ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআন হল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সামগ্রিক সংকলন ও উৎস। (দ্র : জামালুল কুররা ওয়া কামালুল ইকরা, আলামুদ্দীন সাখাবী ১/২৮-৩১; আননাবাউল আযীম, ড. মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ দাররায পৃ. ১২-১৩ )
আমাদের প্রতি আলকিতাবের দাবি
১. আল্লাহর কিতাবের সর্বপ্রথম দাবি হচ্ছে, এর প্রতি ঈমান আনা। অর্থাৎ এই কিতাব নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর অবতীর্ণ আল্লাহ তাআলার হক ও সত্য কিতাব- একথা মনেপ্রাণে বিশ^াস করা। এমনিভাবে এই কিতাবের প্রতিটি কথাই হক ও সত্য- একথাও পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করা। এই ঈমান পূর্ণ কিতাবের প্রতি থাকা জরুরি। কেউ যদি কিতাবের কিছু অংশ বিশ^াস করে আর কিছু অংশকে অস্বীকার করে তবে তার ঈমান গ্রহণযোগ্য নয়। তাই খোদ এই কিতাবে ইরশাদ হয়েছে-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اٰمِنُوْا بِاللهِ وَ رَسُوْلِهٖ وَ الْكِتٰبِ الَّذِیْ نَزَّلَ عَلٰی رَسُوْلِهٖ وَ الْكِتٰبِ الَّذِیْۤ اَنْزَلَ مِنْ قَبْلُ وَ مَنْ یَّكْفُرْ بِاللهِ وَ مَلٰٓىِٕكَتِهٖ وَ كُتُبِهٖ وَ رُسُلِهٖ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلٰلًۢا بَعِیْدًا.
হে মুমিনগণ! ঈমান রাখ আল্লাহর প্রতি, তাঁর রাসূলের প্রতি, যে কিতাব তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন তার প্রতি এবং যে কিতাব তার আগে নাযিল করেছেন তার প্রতি। যে ব্যক্তি আল্লাহকে, তাঁর ফিরিশতাগণকে, তাঁর কিতাবসমূহকে, তাঁর রাসূলগণকে এবং পরকালকে অস্বীকার করে, সে বহু দূরের ভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। -সূরা নিসা (৪) : ১৩৬
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-
اَفَتُؤْمِنُوْنَ بِبَعْضِ الْكِتٰبِ وَ تَكْفُرُوْنَ بِبَعْضٍ فَمَا جَزَآءُ مَنْ یَّفْعَلُ ذٰلِكَ مِنْكُمْ اِلَّا خِزْیٌ فِی الْحَیٰوةِ الدُّنْیَا وَ یَوْمَ الْقِیٰمَةِ یُرَدُّوْنَ اِلٰۤی اَشَدِّ الْعَذَابِ وَ مَا اللهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُوْنَ.
...তবে কি তোমরা কিতাবের (অর্থাৎ তাওরাতের) কিছু অংশে ঈমান রাখ এবং কিছু অংশ অস্বীকার কর? তাহলে বল, তোমাদের মধ্যে যারা এরূপ করে তাদের শাস্তি এ ছাড়া আর কী হতে পারে যে, পার্থিব জীবনে তাদের জন্য থাকবে লাঞ্ছনা আর কিয়ামতের দিন তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হবে কঠিনতর আযাবের দিকে? তোমরা যা-কিছু কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে উদাসীন নন। -সূরা বাকারা (২) : ৮৫
২. মানুষের প্রতি এই কিতাবের দাবি হল, এর আয়াতসমূহের মধ্যে ‘তাদাব্বুর’ ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে এর বার্তা ও শিক্ষা অনুধাবনের চেষ্টা করা। ইরশাদ হয়েছে-
كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ مُبٰرَكٌ لِّیَدَّبَّرُوْۤا اٰیٰتِهٖ وَ لِیَتَذَكَّرَ اُولُوا الْاَلْبَابِ.
(হে রাসূল!) এটি এক বরকতময় কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষ এর আয়াতের মধ্যে চিন্তা করে এবং যাতে বোধসম্পন্ন ব্যক্তিগণ উপদেশ গ্রহণ করে। -সূরা ছদ (৩৮) : ২৯
৩. এতে বর্ণিত হেদায়েত ও নির্দেশনা বাস্তব জীবনে অনুসরণ করা। ইরশাদ হয়েছে-
وَ هٰذَا كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ مُبٰرَكٌ فَاتَّبِعُوْهُ وَ اتَّقُوْا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ.
(এমনিভাবে) এটা এক বরকতপূর্ণ কিতাব, যা আমি নাযিল করেছি। সুতরাং এর অনুসরণ কর ও তাকওয়া অবলম্বন কর, যাতে তোমাদের প্রতি রহমত বর্ষিত হয়। -সূরা আনআম (৬) : ১৫৫
৪. ভক্তি ও মহব্বতের সাথে এই কিতাব তিলাওয়াত করা। এ সম্বন্ধে খোদ এই কিতাবে ইরশাদ হয়েছে-
اَلَّذِیْنَ اٰتَیْنٰهُمُ الْكِتٰبَ یَتْلُوْنَهٗ حَقَّ تِلَاوَتِهٖ اُولٰٓىِٕكَ یُؤْمِنُوْنَ بِهٖ وَ مَنْ یَّكْفُرْ بِهٖ فَاُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْخٰسِرُوْنَ.
যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা যখন তা তিলাওয়াত করে, যেভাবে তিলাওয়াত করা উচিত, তখন তারাই তার প্রতি (প্রকৃত) ঈমান রাখে। আর যারা তা অস্বীকার করে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত লোক। -সূরা বাকারা (২) : ১২১; আরো দেখুন, সূরা ফাতিরের ২৯-৩০ নং আয়াত।
৫. আল্লাহর কিতাবকে দ্বীনের সকল বিষয়ে ফয়সাল ও সিদ্ধান্তদাতারূপে গ্রহণ করা। ইরশাদ হয়েছে-
كَانَ النَّاسُ اُمَّةً وَّاحِدَةً فَبَعَثَ اللهُ النَّبِیّٖنَ مُبَشِّرِیْنَ وَ مُنْذِرِیْنَ وَ اَنْزَلَ مَعَهُمُ الْكِتٰبَ بِالْحَقِّ لِیَحْكُمَ بَیْنَ النَّاسِ فِیْمَا اخْتَلَفُوْا فِیْهِ.
(শুরুতে) সমস্ত মানুষ একই দ্বীনের অনুসারী ছিল। তারপর (যখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল তখন) আল্লাহ নবী পাঠালেন, (সত্যপন্থীদের জন্য) সুসংবাদদাতা ও (মিথ্যাশ্রয়ীদের জন্য) ভীতি প্রদর্শনকারীরূপে। আর তাদের সাথে সত্যসম্বলিত কিতাব নাযিল করলেন, যাতে তা মানুষের মধ্যে সেইসব বিষয়ে মীমাংসা করে দেয়, যা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ ছিল। -সূরা বাকারা (২) : ২১৩; আরো দেখুন, সূরা নিসার ১০৫ নং আয়াত।
৬. আমাদের উপর এই মহান কিতাবের অন্যতম হক হল, অন্তরে এর প্রতি মহব্বত ও ভালবাসা পোষণ করা এবং এর তাজীম ও সম্মান করা। কারণ এ কিতাব সাধারণ কোনো কিতাব নয়; মহামহিম রাব্বুল আলামীনের কালাম ও কিতাব, আহসানুল হাদীস-সবচেয়ে সুন্দর বাণী, আসদাকুল কালাম-সর্বাধিক সত্যবাণী এবং আফযালুল কালাম-সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বাণী।
এই কিতাবের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অন্যতম একটি দিক হল, পূর্ণ পবিত্র অবস্থায় একে সúর্শ করা; অপবিত্র অবস্থায় কিংবা বিনা অযুতে একে স্পর্শ না করা। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
اِنَّهٗ لَقُرْاٰنٌ كَرِیْمٌ، فِیْ كِتٰبٍ مَّكْنُوْنٍ، لَّا یَمَسُّهٗۤ اِلَّا الْمُطَهَّرُوْنَ.
নিশ্চয়ই এটা অতি সম্মানিত কুরআন, যা এক সুরক্ষিত কিতাবে (পূর্ব থেকেই) লিপিবদ্ধ আছে। একে স্পর্শ করে কেবল তারাই, যারা অত্যন্ত পবিত্র। -সূরা ওয়াকেয়া (৫৬) : ৭৭-৭৯
এছাড়াও একাধিক সূত্রে রাসূল সাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই বাণী বর্ণিত হয়েছে-
أن لا يمس القرآن إلا طاهر
পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ যেন কুরআন স্পর্শ না করে। -আলমুয়াত্তা, ইমাম মালেক, পৃ. ১৮৫; আলমারাসীল, আবু দাউদ, হাদীস ৯৪ ; আলমুজামুল কাবীর, তবারানী ১২/২৪২, হাদীস ১৩২১৭
আর তাই মুসালিম উম্মাহ্র ফকীহগণ একমত যে, অপবিত্র অবস্থায় এবং বিনা অযুতে কুরআনের মুসহাফ স্পর্শ করা নিষেধ। -আলইস্তিযকার, ইবনু আব্দিল বার, ৮/১০
কিতাবের প্রতি ঈমান আনার প্রভাব ও সুফল
আল্লাহ তাআলার কিতাবের প্রতি ঈমান আনার অর্থ হল, তাঁর কথা ও ওহীকে সত্য বলে বিশ^াস করা এবং তাঁর পূর্ণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতি ঈমান আনা। অর্থাৎ মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে কোনোরূপ হেদায়েত ও নির্দেশনা না দিয়ে অন্ধকারে ছেড়ে দেননি; বরং তিনি তাদেরকে আলোর দিশারীরূপে কিতাব দান করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-
كِتٰبٌ اَنْزَلْنٰهُ اِلَیْكَ لِتُخْرِجَ النَّاسَ مِنَ الظُّلُمٰتِ اِلَی النُّوْرِ بِاِذْنِ رَبِّهِمْ اِلٰی صِرَاطِ الْعَزِیْزِ الْحَمِیْدِ.
এটি এক কিতাব, যা তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের প্রতিপালকের নির্দেশক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর ভেতর নিয়ে আসতে পার। অর্থাৎ, সেই সত্তার পথে, যার ক্ষমতা সকলের উপর প্রবল এবং যিনি সমস্ত প্রশংসার উপযুক্ত। -সূরা ইবরাহীম (১৪) : ১
সুতরাং যারা আল্লাহর কিতাবকে অস্বীকার করে তারা মূলত আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে এবং তাঁর সুউচ্চ শান ও মর্যাদাকে অবিশ^াস করে। তাই কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
وَ مَا قَدَرُوا اللهَ حَقَّ قَدْرِهٖۤ اِذْ قَالُوْا مَاۤ اَنْزَلَ اللهُ عَلٰی بَشَرٍ مِّنْ شَیْءٍ.
তারা (কাফিরগণ) আল্লাহর যথার্থ মর্যাদা উপলব্ধি করেনি, যখন তারা বলেছে, আল্লাহ কোনও মানুষের প্রতি কিছু নাযিল করেননি। -সূরা আনআম (৬) : ৯১
বস্তুত মানব জীবনে আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান আনার বড় সুফল হল, এর মধ্য দিয়ে মানুষ এমন এক অবলম্বন হাতে পায়, যার দ্বারা সে নিজের উদ্বেগ ও পেরেশানিকে দূর করতে পারে, হেদায়েত ও সফলতার পথ চিনতে পারে এবং সে নিজে জানতে পারে ও পাঠ করতে পারে বরবাদি ও বিপর্যয় থেকে মুক্তির উপায়।
বরং মুমিন বান্দা এই মহান কিতাব তিলাওয়াতের মাধ্যমে সেই মহান সত্তার রহমত ও দয়া দিলের মধ্যে উপলব্ধি করতে থাকে, যিনি তার সাথে এই কিতাবের মাধ্যমে নির্জনে কথা বলেন, তাকে উপদেশ দেন এবং তাকে রক্ষা করেন কুপ্রবৃত্তির হাত থেকে।
সারকথা, এই মহাগ্রন্থ আলকিতাবই হল মানবজাতীর জন্য অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের ‘আলবালাগুল মুবিন’-সুস্পষ্ট বার্তা। হ