রবিউল আউয়াল ১৪৪৩   ||   অক্টোবর ২০২১

ই-ভ্যালির পর এবার এহসান গ্রুপ
চলছে জনগণের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার মহোৎসব
দায় কার, কোন্ পথে প্রতিকার

সাম্প্রতিক সময়ে সরকার আর্থিক প্রতারণার দায়ে তিনটি সংস্থার দায়িত্বশীলদের গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে দুটি সংস্থা হচ্ছে ই-কমার্স ভিত্তিক। অন্যটি আর্থিক সংস্থা। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-ভ্যালি এবং ই-অরেঞ্জ-এর দায়িত্বশীলগণ এখন জেলে রয়েছেন। তবে এর আগেই তারা হাতিয়ে নিয়েছেন জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা। ই-ভ্যালি সম্পর্কে আমরা সাম্প্রতিক সময়ে (মুহাররম ১৪৪৩ হি./আগস্ট ২০২১ ঈ.) মাসিক আলকাউসারের পাতায় আলোচনা করেছি।

এরও আগে, যখন ই-ভ্যালি সারা দেশে অস্বাভাবিক কর্মকা- শুরু করে তখনই কারবারটির শরঈ বিশ্লেষণ এবং অর্থনীতির দিক থেকে এর ভঙ্গুরতার কথা তুলে ধরা হয়েছিল। নিশ্চিতভাবেই বোঝা যাচ্ছিল যে, গণমানুষের পাওনা বুঝিয়ে না দিয়েই একসময় এটি ধ্বংসের মুখে পতিত হবে।

এরপর অনেক হাঁক-ডাক শোনা গেলেও এবং সাময়িক কিছু সাড়া জাগালেও তাদের পরিণতি সেদিকেই এগিয়েছে। বিগত কয়েক মাস থেকে ই-ভ্যালির বিরুদ্ধে মিছিল-আন্দোলনের কথা শোনা যাচ্ছিল। তারা মানুষের দেওয়া টাকা বা এর বিপরীতে পণ্য- কিছুই বুঝিয়ে দিচ্ছিল না। কিন্তু কিছু অজানা কারণে ই-ভ্যালির মালিকদেরকে আটক করতে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছিল।

যাইহোক, শেষ পর্যন্ত এখন তারা জেলে। কিন্তু তাদেরকে অর্থ দিয়ে যারা প্রতারিত হয়েছেন সেই লোকদের কী হবে, তা এখনো অস্পষ্ট। দৃশ্যত এই টাকাগুলো ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ই-ভ্যালির প্রতারণাপূর্ণ ধামাকা কারবার এবং রাতারাতি বড়লোক হয়ে যাওয়ার ম্যাজিক দেখে এ ধরনের আরো বহু প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠতে শুরু করেছিল। প্রতারিত লক্ষ লক্ষ মানুষের আহাজারি আর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার মুখে এখন হয়ত তাদের নাকে লাগাম পড়বে।

এদিকে দক্ষিণ বাংলা অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা প্রতারণার দায়ে গ্রেফতার হয়েছেন এহসান গ্রুপ নামক একটি সংস্থার কর্ণধার ও তার সহযোগীরা। বলা হচ্ছে, তিনি নাকি একজন মাওলানা সাহেবও বটে। তারা আবার ব্যবসা করত ইসলামী শরীয়াহর সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে।

এদেশে ব্যবসার নাম করে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে গণমানুষের টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এগুলোই প্রথম নয়। এর আগেও যুবক, সেবক, ডেসটিনিসহ আরো বহু গোষ্ঠী ও সংস্থা সাধারণ লোকজনের হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। সেগুলো বন্ধ হয়ে গেলেও প্রতারিত লোকজন তাদের টাকা ফেরত পায়নি।

আজকের সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমরা এ ধরনের অস্বাভাবিক ও প্রতারণামূলক প্রতিষ্ঠান কীভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠার সুযোগ পায় এবং এ থেকে প্রতিকারের কী উপায়, তা নিয়ে দু-একটি কথা আরয করব।

কীভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠে

বিগত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় যা দেখা গেছে, দুটি পন্থায় এ ধরনের ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানগুলো রাতারাতি এক শ্রেণীর লোকজনের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়।

এক. লোভনীয় বিজ্ঞাপন।

দুই. অস্বাভাবিক কমিশন।

কারো কারো ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় যোগ হয়ে থাকে। তা হচ্ছে, অন্যায়ভাবে ইসলামের নাম ব্যবহার।

এর মধ্যে প্রথমটি অর্থাৎ বড় বড় অফারের বিজ্ঞাপন দেয়ার প্রবণতা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত ভুঁইফোঁড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো এই অপকৌশল বেছে নিয়েছে। ৭০-৮০% ডিসকাউন্ট দেওয়া, ১০০%, ১৫০% ক্যাশব্যাক দেওয়া- এজাতীয় অস্বাভাবিক ও অসম্ভব লোভনীয় অফারের বিজ্ঞাপন তারা প্রচার করেছে অহরহ। অফলাইন এবং অনলাইন উভয়ক্ষেত্রেই।

বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে তারা এমনসব জায়গা বেছে নিয়েছে, যেগুলো স্পর্শকাতর। যেসব জায়গায় বিজ্ঞাপন দেয়ার পর একশ্রেণির লোকের হয়ত একটু বেশিই আস্থা অর্জিত হয়। যেমন, বিমানবন্দরের ট্রলিতে নিজেদের বিজ্ঞাপন সেঁটে দেয়া, সরকার নিয়ন্ত্রিত কোনো টুর্নামেন্টের টাইটেল স্পন্সর হওয়া ইত্যাদি।

আজকে যেসব পত্রিকা ই-ভ্যালির নৈরাজ্য নিয়ে এবং তাদের প্রতারণাগুলোর ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রতিবেদন লিখছে তাদের অনেকের অনলাইন ভার্সনগুলো ই-ভ্যালির বিজ্ঞাপনে ভরপুর ছিল দীর্ঘদিন পর্যন্ত। প্রকারান্তরে এরাই সুযোগ করে দিয়েছে ই-ভ্যালিকে তাদের প্রতারণার ফাঁদ পাতার।

শুধু ই-ভ্যালিই নয়, এজাতীয় বহু প্রতিষ্ঠান এখনও বিদ্যমান রয়েছে। ক্লিক করে টাকা কামানো, ভিডিও দেখে টাকা কামানো, রেফার করে টাকা কামানো, আরো কত প্রকারের ফন্দি তৈরি হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। যার ফলে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ জনগণ। কলুষিত হচ্ছে সমাজব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে এ ধরনের ব্যবসাগুলো যেমন নাজায়েয তেমনি এদের খদদের হওয়া বা সদস্য হওয়া ও শরীয়া পরিপন্থি গর্হিত কাজ।

কমিশন বাণিজ্য

রাতারাতি মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়ে বড়লোক বনে যাওয়ার একটি সহজ পন্থা হচ্ছে, কমিশন বাণিজ্য। বিশেষত আমাদের মতো দেশে, যেখানে কর্তৃপক্ষীয় নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত দুর্বল এবং একশ্রেণির লোকের লোভ-লালসার পরিমাণ অনেক বেশি...।

এখানে কমিশন বাণিজ্য বলে বোঝানো উদ্দেশ্য ঐসব কারবার, যেখানে অর্থ খাটানো হয় কম; এর বিপরীতে দুষ্টুমি বুদ্ধি খাটিয়ে গণমানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সংস্থাকে যারা টাকা এনে দেবে তাদের জন্য ঘোষণা করা হয় মোটা অংকের কমিশন। যা ২০%-৩০% পর্যন্তও হয়ে থাকে। ক্ষেত্রবিশেষে আরো বেশি। আর মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে তো কমিশনের এই ধারা বহু স্তর পর্যন্ত চলতে থাকে। এরপর আর সংস্থার মূল ব্যক্তিদের টাকা জোগাড়ের জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হয় না। তারা বরং বড় বড় কথা বলেই সময় কাটায় ও বিলাসী জীবনযাপন করে। যা করার তা দালাল তথা এজেন্টরাই করে। তারা মানুষকে বড় বড় লোভ দেখিয়ে ভুল-ভাল বুঝিয়ে মোটা অংকের টাকা বিনিয়োগের নাম করে নিয়ে আসে। আর সে টাকার একটা মোটা অংশ তাদের পকেটে যায় কমিশনের নামে।

এই কমিশন বাণিজ্যের অস্ত্রটি মূলত মাল্টিলেভেল-ওয়ালাদের হাতিয়ার হলেও এর উপর ভিত্তি করেই চলছে ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, বিভিন্ন মাল্টিপারপাস সোসাইটি এবং ইসলামের নামে পরিচালিত হওয়ার দাবিদার এক শ্রেণির সোসাইটি ও সংস্থা।

যেহেতু এসব সংস্থায় মানুষের দেয়া টাকার একটি বড় অংশই দালাল ও এজেন্টদের পকেটে চলে যায় এবং আরো একটি বড় অংশ তারা ব্যয় করে থাকে লোক দেখানো ফুটানি করতে গিয়ে- অফিস খরচ, উপঢৌকন ও গিফটের নামে ব্যয় করে। যার মাধ্যমে প্রভাবশালীদের সমর্থন নিয়ে তারা দীর্ঘদিন টিকে থাকার সুযোগ পায়। কিন্তু একটি সময় পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিশেষত কমিশন আদায়ের সাথে সাথে যখন নিজেরাও দুহাতে তসরুপ করতে শুরু করে সাধারণ মানুষের টাকা।

এই হল কমিশন বাণিজ্যের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র।

প্রসঙ্গ : ইসলামের নামে ব্যবসা

ব্যবসাবাণিজ্য ইসলামে শুধু জায়েযই নয়; বরং একটি প্রশংসনীয় পেশাও বটে। স্বয়ং আমাদের রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওত-পূর্ব সময়ে আমানতদারির সাথে দীর্ঘদিন পর্যন্ত সফল ব্যবসা করেছেন। সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। কুরআনে কারীমে ব্যবসার কথা এসেছে বিভিন্ন জায়গায়। বলা হয়েছে-

وَ اَحَلَّ اللٰهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا .

আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৫

তবে ইসলাম শুধু ব্যবসাকে হালাল বলেই ক্ষান্ত হয়নি; বরং এর জন্য দিয়েছে বহু নীতিমালা। পালনীয় এবং বর্জনীয় অনেক শর্তাবলি। যেগুলোর ব্যত্যয় ঘটলে হালাল পণ্যের ব্যবসাও অবৈধ হয়ে যায়।

পুঁজিবাদের এই যুগে অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিত্তিই হচ্ছে সুদ এবং অন্যান্য অবৈধ পন্থা। সেক্ষেত্রে ইসলামী শরীয়তের বিধি-বিধান মেনে ব্যবসা করলে তা অবশ্যই উৎসাহ পাবার হকদার এবং প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু ইসলামের নামে ব্যবসা ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান খুলে যদি যথাযথ শরীয়াহ পালন না করা হয়; বিনিয়োগ গ্রহণ, অর্থব্যয়, ব্যবসা পরিচালনা ও বিভিন্ন চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি ক্ষেত্রে যদি শরীয়াহর নীতিমালা যথাযথভাবে না মানা হয় তাহলে সেটি হবে দ্বিগুণ গর্হিত কাজ। কারণ, এক্ষেত্রে কারবারটি অবৈধ হওয়ার পাশাপশি এতে ইসলামের নাম ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। তাছাড়া এ ধরনের ব্যবসার পতন তো অবশ্যম্ভাবীই থাকে, তো যখন নিজেদের অসাধু নীতির কারণেই এর পতন ঘটে এবং মানুষের টাকা ফিরিয়ে দেয়া না যায় তখন ইসলামের বদনাম হয়।

আমাদের জানামতে, ইসলামের নামে বিভিন্ন সোসাইটি-সংস্থা করার হিড়িক পড়েছিল ১৫/২০ বছর আগে। তখন কমিশন ভিত্তিক অসংখ্য সোসাইটি-সমিতি গজিয়ে উঠেছিল। এদের কোনো কোনোটি দেশব্যাপীও ছড়িয়ে পড়েছিল। সুদভিত্তিক মাইক্রোক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর মোকাবিলার কথা বলে এরা অনেক আলেম-ওলামাকেও ধোঁকায় ফেলেছিল। এদের সবার উদ্দেশ্য অসৎ ছিল এমনটিও নয়সৎ উদ্দেশ্যেই মাঠে নেমেছিলেন তবে পদ্ধতি প্রায় সকলেরই গলদ ছিল।

ঐ সময় বহু তলাবা ও ওলামা এসব কাজে জড়িত হয়ে গিয়েছিল।  তা দেখে তৎকালীন বেফাকুল মাদারিসের মুফতী বোর্ড (যেটি তখন বেফাকের একটি স্বীকৃত মুফতী বোর্ড ছিল, যেখানে বড় বড় মাদরাসাগুলোর দারুল ইফতার মুফতীগণ সদস্য ছিলেন) এ নিয়ে তাহকীক করার ফয়সালা করেন। এবং সকল পক্ষের সাথে আলোচনা-পর্যালোচনা করে দীর্ঘ গবেষণার পর একটি ফতোয়া তৈরি হয়। যেখানে এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কারবারকে না-জায়েয আখ্যা দেওয়া হয়। মাসিক আলকাউসারের শাবান-রমযান ১৪২৯হি./ আগস্ট ২০০৮ঈ. সংখ্যায় পুরো ফতোয়াটি ছাপা হয়। ঐ ফতোয়ার সাথে একটি দীর্ঘ ভূমিকাও সংযুক্ত হয়। যেখানে এইসকল ব্যবসার শুধু শরয়ী দৃষ্টিতে ক্ষতি ও আপত্তির দিকগুলোই নয়; বরং সাধারণ অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিচারেও যে এগুলো  ভঙ্গুর প্রকৃতির- তা স্পষ্ট করে দেওয়া হয়।

বেফাকের ফতোয়া প্রচারের পর থেকেই সাধারণ মানুষ সচেতন হতে শুরু করে। আলকাউসারে লেখা ভূমিকার অনুমান সত্য প্রমাণিত হয়। অর্থনৈতিকভাবে এ সংস্থাগুলোর বেশিরভাগই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়। মানুষের বিনিয়োগের অর্থ ফেরত দিতে না পারায় বহু প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকাদ্দমা হয়। শুধু তাই নয়, মধ্যস্থতাকারী অনেক এজেন্ট আলেম-ওলামা এবং সংশ্লিষ্ট সাধারণ লোকজনও ব্যাপক হয়রানির শিকার হন।

যে সংস্থাগুলো তখন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল এহসান এসবাংলাদেশ। যাদের কারবারকে তখন স্পষ্টভাবেই নাজায়েয বলা হয়েছিল। সেই এহসান এসথেকে ভাগ হয়ে পরবর্তীতে দক্ষিণ বাংলায় গঠিত হয় কথিত এহসান গ্রুপ। যার কর্ণধাররা বর্তমানে জেলে।

প্রতিকার

এদেশে তো এধরনের ঘটনা নতুন নয়। যুগ যুগ থেকেই আমরা দেখে আসছি যে, বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে চলে যায়। কিন্তু চোখের সামনে এমন ঠকবাজির ঘটনা অহরহ ঘটতে দেখেও সরকারের কর্তাব্যক্তিদের টনক নড়ে না। যখন সব নিয়ে গায়েব হয়ে যায় আর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলো মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে অথবা ক্ষোভে উত্তাল হয়ে রাস্তায় নেমে আসে তখনই কেবল কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসে। এবারও তাই হচ্ছে। কিন্তু স্থায়ী সমাধানের কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে বলে মনে হয় না। তাই ভবিষ্যতে এ ধরনের কা- থেকে বাঁচার জন্য কী করা উচিত- এ বিষয়ে আমরা দুটি কথা বলতে চাই।

১. যথাযথ নিয়ন্ত্রণ

সবাই বোঝেন, একটা কিছু ঘটে যাওয়ার পর তার পিছনে দৌড়ানোর চেয়ে এমন ঘটনা যেন না ঘটে, ঘটতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়াটাই হল বুদ্ধিমানের কাজ। আমাদের দেশে এই যে কা-গুলো আমরা দেখছি, আগেও যাদেরকে দেখেছি মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, এখনো যাদেরকে ধরা  হয়েছে এবং যেসব কার্যকলাপের জন্য তাদেরকে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে- এসব কিছু এরা অনেকটা প্রকাশ্যেই করেছে। বলতে গেলে প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে। অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে, প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে তারা করেছে। এবং প্রকারান্তরে মিডিয়াগুলো তাদের সঙ্গ ও সমর্থন দিয়েছে। কারণ মিডিয়াগুলোতেই তো তাদের বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়েছে...! এক্ষেত্রে সরকারি মিডিয়াও পিছিয়ে ছিল না।

আমরা আগেই বলেছি, ই-ভ্যালির মত প্রতিষ্ঠানকে সরকারি বড় বড় কাজে এমনকি বিভিন্ন টুর্নামেন্টেও টাইটেল স্পন্সর করা হয়েছে। এখনো দেখা যাচ্ছে, আলেশা মার্ট নামক একটি প্রতিষ্ঠানকে এমন কাজ দেওয়া হয়েছে, যাদের অবস্থাও ভিন্ন রকম নয়। এর মানে হল, সরকারের অন্তত কিছু লোকের সাথে এদের দহরম-মহরম ছিল। তাই নিয়ন্ত্রণ তো দূরের কথা, উল্টো এরা কর্তাব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন পেয়েছে।

সম্প্রতি আমরা দেশের দুটো উচ্চ জায়গা থেকেও এ ধরনের কথা শুনেছি। প্রথমে উচ্চ আদালত এবং পরবর্তীতে দেশের  রাষ্ট্রপতি নিজে জোর তাগিদ দিয়েছেন যে, ভবিষ্যতে মানুষের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার আগেই যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। উচ্চ আদালত তো প্রশ্নই রেখেছেন যে, গণমানুষের অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার পর ব্যবস্থা নিলে কী-ই বা লাভ? সরকার আগে কোথায় ছিল? সরকারি উকিল এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পেরেছেন বলে জানা যায়নি।

এর মধ্যে বাণিজ্যমন্ত্রী মুন্সি সাহেবের মুখে কিন্তু শোনা যাচ্ছে অন্য সুর। যদিও অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, এই প্রতারণাগুলোর প্রাথমিক দায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রী  একেক সময় একেক কথা বলছেন। তিনি দায় তো নেবেনই না; বরং গ্রেফতারকৃতদেরকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে ওকালতি করছেন। বলেছেন, ওদেরকে আটকে রেখে কী লাভ? ছেড়ে দিয়ে যদি ওদের কারবার চালানো যায় এবং মানুষের টাকা কিছু কিছু করে ফেরত দেওয়া যায়...।

আবার আরেক সময় বলেছেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হবে না; বরং তাদের জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে এবং কঠোর আইন করা হবে।

সাধারণ মানুষের প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে কি দেশে আইন কম আছে? তারা যেভাবে মানুষের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে- আইনে কি এগুলোর কোনো সুযোগ আছে? আইন তো আগে থেকেই আছে!  সেটা বাস্তবায়ন হলে তো এমন কিছু হতেই পারতো না ! ঘটতেই পারতো না...! আসলে সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু গোষ্ঠীর সমর্থন ছাড়া যে কোনো সেক্টর থেকেই মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়- তা অভিজ্ঞজন মাত্রই বোঝেন।

আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণ যথাযথ হয়, বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে যদি যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ আনা হয় এবং কোনো ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার বিজ্ঞাপন প্রচার বা তাকে টাইটেল স্পন্সর করা না হয়, সরকারের বড় বড় ব্যক্তিদের সাথে যদি এইসব লোকদের ওঠাবসা না করতে দেওয়া হয় তাহলে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যতে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার মোটেই সুযোগ পাবে না। ব্যাংক সেক্টর, শেয়ারবাজারসহ সকল ক্ষেত্রেই এই কথা প্রযোজ্য।

তাহলে মূল কথা হচ্ছে, নিয়ন্ত্রণ। হাজার হাজার কোটি টাকা শেষ করে ফেলার পর তদন্ত কমিটি গঠন এবং এর হোতাদেরকে কিছুদিন কারারুদ্ধ করে রাখা- এটা কখনোই সমাধান নয়। এর সাথে সাথে কঠোর শাস্তি বাস্তবায়নেরও নজির থাকা দরকার। শুধু আইন দিয়ে আমাদের মতো দেশে এ ধরনের কার্যকলাপ বন্ধ করা সম্ভব নয়।

২. সচেতনতা

এ ধরনের প্রতারণাপূর্ণ ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানগুলো গজিয়ে উঠতেই পারত না যদি আমরা সাধারণ মানুষ সচেতন হতাম। মানুষের সচেনতার অভাবেই তারা সফলতা পায়। এক্ষেত্রে মোক্ষম যে বিষয়টি কাজ করে তা হল অতি লোভ। সস্তায় পাওয়ার নেশা। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন।

আমরা যখন দেখি, কোনো পণ্যে ৭০-৮০% ছাড়ের ঘোষণা, ১০০-১৫০% ক্যাশব্যাক দেওয়া হবে অথবা কাউকে বিনিয়োগ এনে দিলে বিশাল অংকের কমিশনের কথা শুনি তখন হুমড়ি খেয়ে পড়ি। একটিবারের জন্যও চিন্তা করে দেখি না, এটি কি রূপকথা না বাস্তবতা? এত সস্তায় লোকটা ভালো জিনিস দেয় কীভাবে? এদের বাপ-দাদার কী সোনা-হীরার খনি আছে যে, চাইলে মানুষকে শ’-দেড়শপার্সেন্ট ক্যাশব্যাক দিতে থাকবে? অথবা ৩০-৪০% কমিশন দিয়েও ব্যবসা চালিয়ে রাখতে পারবে।

সুতরাং লোভ সংবরণ করা অতি জরুরি। সাথে যুক্তিবাদী হওয়াও দরকার। গণমানুষ যদি যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে এবং যে কোনো অপপ্রচার ও অপবিজ্ঞাপনে সাড়া দেওয়া থেকে বিরত থাকে তাহলে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই পারবে না।

প্রসঙ্গ : ইসলামের নামে ব্যবসা

যেহেতু সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেফতার হওয়া লোকদের মধ্যে ইসলামের নামধারী একটি গ্রুপও আছে তাই এ বিষয়ে দু-একটি কথা আরয করতে চাই। প্রথম কথা হচ্ছে, আমরা আগেও বলেছি, ইসলামের নাম ব্যবহার করলেই কোনো প্রতিষ্ঠান ইসলামী হয়ে যায় না। বরং কোনো প্রতিষ্ঠান ইসলামী হওয়ার জন্য এর বিনিয়োগ নীতি, ক্রয়-বিক্রয়ের শর্তাবলি এবং অন্যান্য লেনদেন ও অফিস পরিচালনা পদ্ধতিসহ যাবতীয় কার্যক্রম ইসলামী শরীয়ার উসূল ও যাওয়াবেত (নীতিমালা ও ধারা) মোতাবেক হওয়া আবশ্যক। বহু প্রতিষ্ঠান এমন রয়েছে, যারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, ইসলামের নাম ব্যবহার করে প্রচার-প্রচারণা চালায়, অথচ তাদের গোড়াতেই গলদ। মানুষের কাছ থেকে টাকা আহরণ করে তারা ব্যবসা করে। সেখানেই থাকে শরীয়া পরিপন্থি বিভিন্ন কমিশনের আয়োজন। টাকা সংগ্রহের প্রক্রিয়া ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনাসহ তাদের বহু কাজেই শরীয়া নীতিমালার বালাই থাকে না।

এখানে আরেকটি বিষয় খুব ভালো করে বুঝে নেয়া উচিত এবং সবসময় মনে রাখা কর্তব্য। তা এই যে, কোনো কারবার কেবল সুদমুক্ত হলেই তা ইসলামী হয়ে যায় না। সুদমুক্ত তো হতেই হবে। তাছাড়া সেটা শরীয়া অনুমোদিত কোনো না কোনো আকদের আওতায় পড়াও আবশ্যক। নতুবা সেটা ফুকাহায়ে কেরামের ভাষ্য অনুযায়ী কুরআনে কারীমে বর্ণিত আল আকলু বিল বাতিল’ (অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ ভক্ষণ)-এর অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত হবে। (এ বিষয়ে বিস্তারিত ও তথ্যভিত্তিক আলোচনা পড়, ‘আহকামুল কুরআন, জাসসাস২/১৭১) এই ব্যাপারটি বুঝে নিলে শুধু ইসলামীবা শরীয়া মোতাবেককিংবা সুদমুক্তএসকল শব্দবন্ধ দেখে প্রতারিত হবার ভয় থাকবে না।

ইসলাম ইস্যুতে আজ আমাদের অনেক বেশি সচেতন ও সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। যেন আমাদের অজ্ঞতা বা সরলতার সুযোগ নিয়ে ইসলামের নাম ব্যবহার করে কেউ আমাদের ধোঁকায় ফেলতে না পারে। এ প্রসঙ্গে আমরা সম্মানিত আলেম-ওলামা এবং ওয়ায়েজদের প্রতিও সবিনয় আরয রাখতে চাই (যেহেতু সম্প্রতি বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে) তারা যেন ইসলামের নামধারী কোনো প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে বাস্তবে যাচাই করা ছাড়া শুধু মৌখিক কথায় বা কাগজপত্রের ভিত্তিতে কাউকে ন্যূনতম সমর্থনও প্রদান না করেন। তাদের কথাবার্তা, চালচলন বা ওঠাবসাতে এ ধরনের কোনো গলদ প্রতিষ্ঠান সমর্থন পেলে তাদের প্রতি আস্থা রাখার কারণে শুধু গণমানুষই প্রতারিত হবে না; বরং ভবিষ্যতে তাদের ইমেজ তথা মানমর্যাদাও হুমকির মুখে পড়বে। যার ফলশ্রুতিতে বদনাম হবে আলেম-ওলামার এবং সেইসাথে ইসলামের।

আমরা বিভিন্ন ব্যাংক, বীমা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও প্রত্যক্ষ করে থাকি। দীর্ঘদিন থেকে ফতোয়া বিভাগে কাজ করার সুবাদে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেনকারী ব্যবসায়ী মানুষজনের সাথে ওঠাবসাও কম হয়নি। সংশ্লিষ্ট মহল নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, এদেশে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বেলাতেই মুখের কথা ও কাগজপত্রের নীতিমালা আর বাস্তবতার মধ্যে পার্থক্য অনেক। অনেকেই তাদের বিনিয়োগ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমলীভাবে (কার্যত) শরীয়া নীতিমালা পরিপালন করেন না। ইসলামের শ্লোগান ব্যবহার করেন কেবলই ব্যবসার স্বার্থে। তাদের অনেকেই শরীয়া কাউন্সিল, শরীয়া এডভাইজরী বোর্ড এ  জাতীয় বিভিন্ন ফোরাম থাকে। কিন্তু কটি প্রতিষ্ঠানের শরীয়া এডভাইজারগণ তাদের বাস্তব কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করেন বা শরঈ বিষয়গুলো যথাযথ পালন করার পদক্ষেপ নেন তা ভুক্তভোগীর কাছে প্রশ্ন হয়েই থেকে যায়।

তাই ইসলামের নামে যারাই ব্যবসা করুক তাদের আদ্যোপান্ত এবং বাস্তব কার্যক্রমের তদারকি না করে তাদেরকে যে কোনো প্রকার সমর্থন দিয়ে দেয়া ধ্বংসাত্মক কাজ বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে হেফাযত করুন। হ

 

advertisement