রবিউল আউয়াল ১৪৪৩   ||   অক্টোবর ২০২১

আকাবিরের ইয়াদগার
হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী রাহ.

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

গত ২৯ মুহাররম ১৪৪৩ হিজরী মোতাবেক ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈসায়ী রোজ বুধবার আনুমানিক সকাল এগারোটায় আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে গেলেন শাইখুল মাশায়েখ হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী রাহ.। আলেম তালেবে ইলমগণকে এতীম করে আপন ঠিকানায় চলে গেলেন আকাবিরের ইয়াদগার এই বুযুর্গ মনীষী। রব্বে কারীম তাঁর দারাজাত বুলন্দ করুন। জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।

হযরতের ছাহেবযাদাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী তাঁর জন্ম আনুমানিক ১৯৪৩ ঈসায়ীতে। সে অনুযায়ী হিজরী সন হয় আনুমানিক ১৩৬২ হিজরী।

হযরত মুফতী ছাহেব রাহ.-এর মকতবের শিক্ষা শেষে পিতার ইচ্ছা ছিল, স্কুলে প্রাইমারি পর্যন্ত পড়ে মাদরাসায় পড়াশুনা করবেন। স্কুলে হযরতের মন বসেনি। ঘরেই বাবার কাছে ছিলেন। কিছুদিন পর নিজেই আনওয়ারা থানাধীন মাদরাসায়ে হোসাইনিয়া বোয়ালিয়াতে (জাদীদ) ভর্তি হন। নাহবেমীর জামাত পর্যন্ত পড়ার পর হযরত মাওলানা হারুন বাবুনগরী রাহ. তাঁকে নিজ মাদরাসা আযীযুল উলূম বাবুনগরে নিয়ে যান। চার বছর সেখানে পড়াশুনা করেন। এর পরের জামাতগুলো থেকে নিয়ে দাওরা পর্যন্ত জিরি মাদরাসায় পড়েন। তিনি যে মাদরাসায়ই ছিলেন তাঁর প্রতি আসাতেযায়ে কেরাম ও মুরব্বীগণের বিশেষ নেক দৃষ্টি ছিল।

আমার বড় মামা মাওলানা মাহমুদুল হাসান ছাহেব জিরি মাদরাসায় তাঁর সহপাঠী ছিলেন। হযরত মুফতী ছাহেবের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলেই তিনি মামার তাযকেরা-স্মরণ করতেন।

জিরি মাদরাসার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হযরত মাওলানা মুফতী নূরুল হক রাহ.-এর সঙ্গে হযরতের গভীর সম্পর্ক ছিল। মুফতী ছাহেব হযরতকে নিজ সন্তানের চেয়েও বেশি মহব্বত করতেন। পরবর্তীতে হযরতকে জামাতাও বানিয়েছেন। মুফতী ছাহেবের পরামর্শে তিনি জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউনে যান। সঙ্গে করে মুফতী ছাহেবের দেওয়া একটি চিঠিও নিয়ে যান।

সেখানে কিছুদিন উলূমুল হাদীস বিভাগে, এরপর হযরত বানূরী রাহ.-এর পরামর্শে আততাখাসসুস ফিল ইফতায় সময় লাগান। সেখানেও হযরত জামিয়ার আকাবিরদের নেকদৃষ্টি অর্জন করতে সক্ষম হন। হযরত বানূরী রাহ. তাঁকে নিজের কাছেই রেখে দেন। মাদরাসায় দরস এবং দারুল ইফতার কিছু যিম্মাদারি তাঁকে সোপর্দ করেন।

শিক্ষকতার শুরুর দিকে বানূরী রাহ.-এর পরামর্শে হাওয়া বদলের উদ্দেশ্যে দুমাসের জন্য লাহোরে গিয়েছিলেন। এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্বারী শাকের সাহেব রাহ.-এর কাছে কুরআনে কারীমের মশক করেন। তাজবীদ এবং ফাওয়ায়েদে মাক্কিয়্যার পাঠ গ্রহণ করেন।

সেখান থেকে ফেরার পর বানূরী টাউন মাদরাসা সংলগ্ন মসজিদে উসমানীতে ইমামত ও খেতাবতের খেদমতেও যুক্ত হন। করাচি থেকে দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত এই খেদমতে তিনি নিরত ছিলেন।

আমার মতে হযরত মুফতী ছাহেব রাহ.-এর যিন্দেগীর সবচেয়ে বড় সফলতা হল, তিনি জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউনের মতো ঐতিহ্যবাহী, কেন্দ্রীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বহু বছর যাবৎ দারুল ইফতার যিম্মাদার ছিলেন। মুফতী ওলী হাসান টোংকী রাহ.-এর ওফাতের পর তিনিই দারুল ইফতার প্রধান ছিলেন। পরবর্তীতে কিছু ওজরের কারণে মাদরাসা কর্তৃপক্ষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেশে ফিরে আসতে হলে এদেশের ঐতিহ্যবাহী ও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান দারুল উলূম হাটহাজারীতে হাদীস ও ফিকহের খেদমতে যুক্ত হন। এখানে তাঁকে মুফতীয়ে আযমহিসেবে বরণ করা হয়। খালেস ইলমী ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও প্রতিষ্ঠানের মজবুরি-বাধ্যবাধকতার কারণে একসময় তাঁকে পরিচালনা পরিষদের খেদমত আঞ্জাম দিতে হয়েছে। কুদরতের কারিশমা, তাঁর ইন্তেকালের দিন দারুল উলূমে মজলিসে শূরার সভা চলছিল। সদস্যদের সর্বসম্মতিতে তাঁকে দারুল উলূমের মুহতামিম পদে নিযুক্ত করা হয়। চলমান সভায় আগমনের জন্য তাঁর কাছে যখন দরখাস্ত পাঠানো হয়, ততক্ষণে তিনি আখেরাতের সফরে রওয়ানা হয়ে গেছেন।

ইনতিকালের আগে দীর্ঘদিন হযরত মাশাআল্লাহ সুস্থই ছিলেন। খুবই উদ্যমের সঙ্গে ইলমী ও ইনতেযামী কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলেন। আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত সময়েই তিনি ইন্তেকাল করেন। হযরতকে আল্লাহ তাআলা ভরপুর মাগফিরাত করুন! তাঁর সদাকাতে জারিয়া কিয়ামত পর্যন্ত জারি রাখুন। তাঁর নেক সন্তানদেরকে আখেরাতেও তাঁর জন্য চক্ষু শীতলতার উপকরণ করুন।

হযরতের শাগরিদ তো প্রায় সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে আছেন। বাংলাদেশেও যারা ফিকহ-ফতোয়ার খেদমত করছেন, তাদের অনেকেই হযরতের শাগরিদ। মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকার আততাখাসসুস ফিল ফিকহি ওয়াল ইফতা বিভাগের মুশরিফ ও দারুল ইফতার রঈস হযরত মাওলানা মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ছাহেব তাঁর বিশিষ্ট ও প্রিয় শাগরিদ। দারুল উলূম হাটহাজারীর মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ছাহেবও বানূরী টাউনে তাঁর ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় শাগরিদ ছিলেন। জামিয়া রাহমানিয়া মোহাম্মাদপুর সাতমসজিদ মাদরাসা (যার প্রতিষ্ঠাতা শাইখ, হযরত শাইখুল হাদীস আল্লামা আজীজুল হক রাহ.)-এর মুহাদ্দিস ও মুফতী, বহু আরবী কিতাবের রচয়িতা হযরত মাওলানা মুফতী হিফযুর রহমান ছাহেব কুমিল্লায়ীও হযরত মুফতী ছাহেব রাহ.-এর খাস শাগরিদ। জামিয়াতুল আবরার রহমানিয়ার উস্তায হযরত মাওলানা মুফতী ইবরাহীম হাসান ছাহেবও হযরতের বিশিষ্ট শাগরিদ।

প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আমি হযরতের শাগরিদ হতে না পারলেও তাঁর থেকে এবং তাঁর কুতুবখানা থেকে অনেক অনেক উপকৃত হয়েছি। আর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ যে, হযরত আমাকে শাগরিদদের মতোই মহব্বত করতেন। একসময় হযরত আমাকে স্নেহ করে মৌলভী মুখতাসারবলে স্মরণ করতেন।

হযরত রাহ.-এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য এই ছিল, তিনি হযরত বানূরী রাহ., হযরত মুফতী ওলী হাসান টোংকী রাহ., হযরত মাওলানা ইদরীস মিরাঠী রাহ.-এর মতো আকাবিরের প্রিয়পাত্র ও আস্থাভাজন ছিলেন।

মুফতী ছাহেব রাহ.-এর স্বহস্তে লিখিত ফতোয়ার সংখ্যা তো অনেক। তাঁর তাসহীহ ও দস্তখতকৃত ফতোয়াও অগণিত। তাঁর স্বহস্তে ও কিছুটা সবিস্তারে লেখা ফতোয়াসমগ্র জাওয়াহিরুল ফাতাওয়ানামে প্রকাশিত হয়েছে। পুরো সমগ্রই মাশাআল্লাহ সুন্দর! তন্মধ্যে নিম্নোক্ত দুটি ফতোয়া যা সতন্ত্র পুস্তিকা হতে পারে- দিন-রাত অস্বাভাবিক লম্বা হয় এমন শহরে সালাতের বিধানএবং আদালতের শরীয়াহ বিরোধী সিদ্ধান্তের সমালোচনা আদালত অবমাননা নয়’- এ দুটি ফতোয়া আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে।

হযরতের রচিত ও সংকলিত কিতাবও মাশাআল্লাহ অনেক। যা দ্বারা আলহামদু লিল্লাহ ব্যাপকভাবে মানুষ উপকৃত হচ্ছে। হযরতের কিতাব ইসলামী মায়ীশত কে বুনয়াদী উসূলমাশাআল্লাহ বিষয়বস্তুর দিক থেকে মজবুত এবং মৌলিক কিতাব।

আশা করি, জামিয়া বানূরী টাউন এবং দারুল উলূম হাটহাজারীতে হযরতের জীবনীর উপর বিশদ কাজ হবে। ইতিমধ্যে হযরতের ছাহেবযাদাগণ এই খোশখবরিও শুনিয়েছেন, হযরতের জীবদ্দশাতেই হযরতের জীবনীর উপর একটি কিতাব প্রস্তুত হয়েছে। ইন্তেকালের পূর্বে হযরত তা শুনেও শেষ করেছেন। আশা করি, এই কিতাব আমাদের জন্য নকশে দাওয়ামও পথের দিশারী হয়ে থাকবে।

পরিশেষে কওমী মাদরাসার একটি বৈশিষ্ট্য, যা জনৈক জেনারেল শিক্ষিত ভাইয়ের অনুভূতিতেও এসেছে। সম্ভবত হযরত মুফতী ছাহেবের জানাযা দেখে বা শুনে কথাটি তিনি লিখেছিলেন। ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে লেখা তার সে কথাটি সংরক্ষণের প্রেরণা থেকে এখানে উদ্ধৃত করা সংগত মনে করছি-

মাদরাসা শিক্ষকদের জানাযার ছবিগুলো দেখলে মনে হয় তাদের শিক্ষকতাই সার্থক। ফেসবুকে দেখি, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলে দলে তাদের ছাত্ররা আবাবিল পাখির মত ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসে। এক বেলার মধ্যেই জানাযা হয়ে ওঠে মহাসমাবেশের জায়গা!

নেই কোনো পারিশ্রমিক বা ওস্তাদকে খুশি করে পার্থিব কিছু অর্জনের জায়গা! শুধু শ্রদ্ধা আর গুরুভক্তির এ এক অনন্য ধারা! এ ধারা একদিনে তৈরি হয় না। একজন ওস্তাদের ঘামের গন্ধও ছাত্রের চেনা থাকে!

বিপরীতে, এ করোনাকালে বহু গুণী ও প্রথিতযশা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক গত হয়েছেন। অনেক দূরের তো দূরের কথা, হয়তো একই শহরে চাকরি করছে কোন ডেস্কে। কিন্তু তার ছাত্ররা অন্যান্য আট দশ দিনের মতোই ঘুরছে!

ব্যক্তিগতভাবে আমি কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়েছি। শিক্ষা জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের কত শিক্ষক গত হয়েছেন। আমি কজনের জানাযায় উপস্থিত হয়েছি? আমার মত একই অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই! একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হয়ে অনেকটা নিশ্চিত যে, এইরকম জনাকীর্ণ জানাযা কপালে জুটবে না। সবার লোভ সব জায়গায় না, সবার লাভও সব জায়গায় না! শিক্ষকের জন্য শিক্ষার্থীদের অশ্রুজল অমূল্য এক জিনিস; এটা এমনেই অর্জন করা যায় না, এমনিতে আসেও না!

আমরা স্কুলে পড়েছি, কিন্তু জানি না, মাদরাসার এই শিক্ষার্থীদের পড়ানো হয়েছে কি না- কবি কাজী কাদের নেওয়াজ-এর শিক্ষাগুরুর মর্যাদা কবিতাটি? কিন্তু এই দৃশ্য আমাকে মনে করিয়ে দেয় বাদশা আলমগীরের গলায় সেই লাইনটি- আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির’!

বি. দ্র. একটা জানাযা দিয়ে শিক্ষকতার সারাজীবনের অর্জনকে খাটো করছি না, কিন্তু নিজ ব্রেইন চাইল্ডের কাঁধে চড়ে বা তাদের ধ্বনিতে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার লোভ সামলানোও অপ্রত্যাশিত না! প্রচলিত পড়াশোনায় কোথাও একটা মিসিং লিংক আছে। জেনারেল ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে আত্মার বন্ধনটা কোথায় জানি একটু স্যালো’!

লেখক : ফখরুল ইসলাম হিমেল

সহকারী অধ্যাপক, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ঢাকা।১

আমাকে লেখাটির সন্ধান দিয়েছেন আদীব হুজুর হযরত মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ দা. বা.।

فجزاه الله عني وعن أولادنا وطلابنا خيرَ الجزاء.

আল্লাহ তাআলা হযরত মুফতী ছাহেবকে জান্নাতুল ফিরদাউসে সুউচ্চ মাকাম দান করুন। তাঁর পরিবার-পরিজনকে সবরে জামীলের তাওফীক দান করুন। তাঁর সদকায়ে জারিয়াগুলোকে স্থায়িত্ব ও পূর্ণাঙ্গতা দান করুন। আমাদের মধ্যে আকাবিরের যোগ্য উত্তসূরির ধারা অব্যাহত রাখুন- আমীন।

 

-আরযগুযার, বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

১২-২-১৪৪৩হি./২০-৯-২০২১ঈ. সোমবার

পুনশ্চ : প্রবন্ধে উল্লেখকৃত তথ্যাবলির কিছু তো আমার নিজের জানাশোনা, কিছু অংশ হযরত রাহ.-এর ছাহেবযাদাদের থেকে গৃহীত। হাটহাজারীতে তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জাযায়ে খায়ের দান করুন- আমীন। হ

 

 

advertisement