রবিউল আউয়াল ১৪৪৩   ||   অক্টোবর ২০২১

মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী রাহ.
এক মুহসিন উস্তাযের চলে যাওয়া

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

জন্ম : আনুমানিক ১৩৬২ হি./১৯৪৩ ঈ.<br>

ওফাত : ২৯ মুহাররম ১৪৪৩ হি./৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ঈ.

আমি যে বছর হাটহাজারী মাদরাসায় দাওরায়ে হাদীস পড়ি সে বছর কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার কারণে মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছিল। বার্ষিক পরীক্ষা নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বিলম্বে শাওয়াল মাসে অনুষ্ঠিত হয়। মশওয়ারা ছিল, পড়াশোনার জন্য করাচি যাওয়ার। উস্তাযে মুআযযাম হযরত মাওলানা আব্দুল আজীজ রাহ. পরামর্শ দিয়েছিলেন, জামিয়া আল্লামা বানূরী টাউন করাচিতে ভর্তি হতে। দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা দিয়ে আল্লাহর নাম নিয়ে করাচির উদ্দেশে রওয়ানা দেই। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র। হযরাতুল উস্তায মাওলানা আব্দুল আজীজ রাহ. তাযকিয়া-প্রশংসাপত্র লিখে দিয়েছিলেন।

আমি যখন করাচি গিয়ে পৌঁছি তখন মাদরাসার ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়ে মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। নতুন দেশ, নতুন শহর এবং অচেনা পরিবেশ হলেও এখানে পরিচিত হওয়ার মতো একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর কারণে দূর দেশ থেকে অসময়ে গিয়েও বানূরী টাউনের মতো মর্যাদাশীল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পেরেছিলাম; তিনি হলেন, হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী ছাহেব; যাঁর জানাযা পড়তে যাচ্ছি আমি, আমার জামাতা ও সন্তানেরা।

হুজুর ইন্তেকাল করেছেন বেলা ১১টা ২০ মিনিটে। মৃত্যুর কিছুক্ষণের মধ্যে সংবাদ পাই। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হে আল্লাহ, আমরা তোমারই তরে, তোমারই কাছে ফিরে যাব।

إِنَّ الْعَيْنَ تَدْمَعُ، وَالْقَلْبَ يَحْزَنُ، وَلاَ نَقُولُ إِلاَّ مَا يَرْضَى رَبُّنَا، وَإِنَّا بِفِرَاقِكَ لَمَحْزُونُونَ.

অন্তর ব্যথিত হয়, চোখ অশ্রুসজল হয়। আমাদের প্রতিপালকের সন্তুষ্টির বাইরে কোনো শব্দ আমরা উচ্চারণ করব না। আমরা আপনার বিচ্ছেদে বেদনাহত।

ব্যথা-বেদনা মানবিক দুর্বলতা। নিজের মুহসিন উস্তাযের বিদায়ের পর সে বেদনা কতটুকু চেপে রাখা যায়। অজান্তেই বারবার মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল, ‘আমার হুজুর চলে গেছেন, আমার হুজুর চলে গেছেন। মেয়েরা হয়তো বাবার বেদনাটা ভালো উপলব্ধি করতে পারে। বাসায় ফেরার পর আমার শোকার্ত চেহারার দিকে ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে ছিল আমার মেয়ে। সংক্ষিপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।

***

কুমিল্লা থেকে মুহিব্বুল্লাহ আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। মুহিব্বুল্লাহ বলল, আব্বা! চাটগামী ছাহেব হুজুরকে নিয়ে কিছু স্মৃতিচারণা করুন।

বলতে শুরু করি, আমি যখন বানূরী টাউনে গিয়ে পৌঁছি তখন ভর্তির সময় শেষ হয়ে দরস শুরু হয়ে গেছে। মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী ছাহেব ছিলেন ইফতা বিভাগের নায়েব। তিনি জিরি মাদরাসায় আমার বড় মামার সহপাঠী। আমি যখন মাদরাসায় পৌঁছি তখন তিনি মসজিদে ছিলেন। মাদরাসার কাছেই উসমানিয়া মসজিদের ইমাম ও খতীব তিনি।  মসজিদটি অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। মুসল্লীরা ছিল বিত্তবান শ্রেণির। হুজুর সাদামাটা বয়ান করতেন। সুরের বিষয়ই ছিল না। তবুও মুসল্লীরা ছিল তাঁর ভক্ত। আর তিনি ছিলেন মুসল্লিদের থেকে বেনিয়ায। কেবল মসজিদ নয় সবখানেই হুজুর জীবন যাপন করেছেন নির্মুখাপেক্ষী হয়ে। আমি হুজুরের সঙ্গে গিয়ে মসজিদে দেখা করি। পরিচয় দিতেই খুব খাতির করলেন। বললেন, আসতে এত দেরি হল কেন?

কারণ খুলে বললাম। কিছুই বললেন না। কুরবানীর পূর্বমুহূর্ত। মুহতামিম হযরত মুফতী আহমাদুর রহমান ছাহেব হজ্বে। ইফতা বিভাগের প্রধান মুফতী ওলী হাসান টোংকী ছাহেবও হজ্বে। তাই কুরবানীর আগে ভর্তির কোনো কাজ ছিল না। আমি মাদরাসায় থাকি। কিছু কিছু পড়াশোনা করি। আর হুজুরের কাছে আসা-যাওয়া করি। মাঝে মাঝে হুজুরের বাজার-সদাই করে দিই। এভাবে ঈদুল আযহা গেল।

হজ্বের অল্প কয়েকদিন পরেই হযরত মুফতী ওলী হাসান টোংকী ছাহেব ফিরে আসেন। চাটগামী ছাহেব হুজুর আমাকে একটি দরখাস্ত লিখতে বললেন। আমি দরখাস্ত লিখে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র যুক্ত করে দিই। হুজুর দরখাস্ত নিয়ে ওলী হাসান টোংকী ছাহেবের কাছে যেতে বললেন। তিনি কাগজপত্র উল্টে দেখেন, কোনো কিতাবে পঞ্চাশ নম্বর, কোনো কিতাবে বায়ান্ন, কোনো কিতাবে আটচল্লিশ। বললেন, নাম্বার তো দেখছি কম!

দারুল ইফতায় টোংকী ছাহেবের পাশের আসনটাই ছিল চাটগামী ছাহেবের। তিনি বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন- ঐ মাদরাসায় সর্বোচ্চ নাম্বার পঞ্চাশ।

একথা শুনে দরখাস্তের মধ্যে টোংকী ছাহেব লিখে দিলেন-

ان کے نمبرات اعلی ہیں،  فارم دینے کی سفارش ہے۔

তার নাম্বার বেশ ভালো। ফর্ম দেওয়ার সুপারিশ করছি।

এবার হুজুর বললেন, হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ মুখতার ছাহেবের কাছে যেতে। তিনি তখন নায়েবে মুহতামিম। বেশ কড়া মানুষ। ইতিমধ্যে তাঁর সম্পর্কে জানা হয়ে গেছে। মুহতামিম সাহেব তখনও ফেরেননি। ইফতা বিভাগের ভর্তি কোটা পূর্ণ হয়ে গেছে আরো আগেই। দাওরায়ে হাদীসে কিছু কোটা বাকি আছে। এসব কারণে আমার সঙ্গী রাজশাহীর মাওলানা হামীদুর রহমান দাওরায়ে হাদীসেই আবার ভর্তি হয়ে গেলেন। মাওলানা হাবিবুল্লাহ মুখতার ছাহেবের কাছে যেতে হবে শুনে মনে হল, ইফতায় বুঝি আর ভর্তি হওয়া হল না।

নাযেমে দারুল ইকামাহ ছিলেন মাওলানা ওলী দরবেশ ছাহেব। জাতিতে পাঠান। তিনি ইফতা বিভাগের ছাত্রাবাসের জিম্মাদার। তিনি আগেই নায়েবে মুহতামিম ছাহেবকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ছাত্রাবাসে জায়গা নেই। আমি দরখাস্ত নিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ভাই আমাদের এখানে তো জায়গা নেই।

তিনি মুফতী ছাহেবের সুপারিশ এবং টোংকী ছাহেবের মতামত দেখে সরাসরি না করেননি। বললেন জায়গা না থাকার কথা।

আমি চাটগামী ছাহেবের কাছে এসে বললাম। চাটগামী ছাহেব ছিলেন নিয়মের মানুষ। নিয়মের বাইরে কিছু করতেন না। কোনো কিছুতেই কারো মুখাপেক্ষী হতেন না। চলতেন বেনিয়াযভাবে। তাঁর স্বভাব ও আচরিত জীবনের বাইরে গিয়ে তিনি আমার জন্য সুপারিশ করেছিলেন। তিনি দরখাস্তে লিখে দিলেন, এখনো ছাত্রাবাসে জায়গা আছে।

ব্যাপারটি ছিল, কিছু পুরোনো ছাত্র ভর্তি না হয়েই ফতোয়া বিভাগের ছাত্রাবাসে অবস্থান করছিল। চাটগামী ছাহেব এ বিষয়টি জানতেন। তাই তিনি এ কথা লিখে দিলেন। দরখাস্ত দিয়ে আবার পাঠালেন নায়েবে মুহতামিম ছাহেবের কাছে। তিনি দরখাস্তে হুজুরের লেখা দেখে হয়তো অবাকই হয়েছিলেন। এবার জায়গা থাকার কথা ওলী দরবেশ ছাহেবের কাছ থেকে লিখিত আনতে বললেন।

চাটগামী ছাহেবের কাছে এলে তিনি ওলী দরবেশ ছাহেবের কাছে পাঠালেন। ওলী দরবেশ ছাহেবের কাছে দরখাস্ত দিলাম। তিনি একবার দরখাস্ত দেখেন আরেকবার আমার দিকে তাকান। সামনে থাকা একজনের দিকে চোখের ইশারায় বললেন, এই হুজুর (চাটগামী ছাহেব) এসব লিখেছেন! ওলী দরবেশ ছাহেব আসন দেবেন বলে নিশ্চিত করলেন। এভাবে আমার ভর্তির বাধাও দূর হয়ে গেল।

বড় মুফতী ছাহেব আমাকে ফিকহের উপর একটি প্রবন্ধ লিখতে বললেন। প্রবন্ধ লিখে হুজুরকে দিলাম। হুজুর দেখে টোংকী ছাহেবকে জমা দিতে বললেন। টোংকী ছাহেব কয়েক সেকেন্ডে এক পৃষ্ঠা পড়ে ফেলতেন। আমার প্রবন্ধও হুজুর পৃষ্ঠা উল্টে দেখে নিলেন। চাটগামী ছাহেব হুজুর নিজ আসন থেকে বললেন, ঠিক আছে।

এরপর ভর্তির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে ফিকহ বিভাগের ছাত্র হয়ে গেলাম। দুটি বছর হুজুরের খুব কাছেই কাটালাম।

***

হুজুর বেশ বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন। ফিকহ ও ফতোয়ার ক্ষেত্রে এ বিচক্ষণতা কাজে লাগাতেন। পাকিস্তানে এলাইস মোটর নামে নতুন এক কোম্পানি বাজারে এল। প্রতিষ্ঠানটিতে কিছু আলেমও বিনিয়োগ করেছিলেন। এই কোম্পানিতে বিনিয়োগের শর্ত ছিল, এখানে কেবলই হালাল টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। কোম্পানির পরিচালকেরা ছিলেন হাজ্বী সাহেব মানুষ। অনেকেই এই কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা জায়েয বলে ফতোয়া দেন। কিন্তু চাটগামী ছাহেব এর পক্ষে ফতোয়া দেননি। তিনি এতে অর্থও জমা রাখেননি। তিনি বলেছেন, এখানে বিনিয়োগ জায়েয হবে না। ব্যবসা জায়েয হওয়ার জন্য যেসব শর্ত আছে তার মধ্যে একটি শর্ত এখানে অবর্তমান। তাই এখানে অর্থ লগ্নি করা জায়েয নেই। পরবর্তীতে প্রতিষ্ঠানটি মানুষের হাজার কোটি রুপি নিয়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল। যেমনটা আজকাল এদেশে ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, সিরাজগঞ্জ শপ, নিরাপদ ডটকম, এহসান গ্রুপ ইত্যাদিরা করেছে।

হুজুর ছিলেন শরীয়তের একনিষ্ঠ পাবন্দ ও সাদাসিধে দুনিয়াবিমুখ মানুষ। হুজুরের দুনিয়াবিমুখতার দরুন বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও হুজুরকে সবাই সমীহ করে চলত।

তৎকালীন মুফতী আযম পাকিস্তান মুফতী ওলী হাসান টোংকী রাহ.-এর  ওফাতের পর মজলিসে শূরা ও তালীমীর সর্বসম্মতিক্রমে চাটগামী ছাহেবকেই প্রধান মুফতী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি এ পদ অলঙ্কৃত করে রাখেন। বাংলাদেশে তাঁর ফিরে আসার প্রক্রিয়াটাও বেশ শিক্ষণীয়। তাঁর জীবনীকাররা হয়তো সে বিষয়ে আলোচনা করবেন।

প্যারালাইসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে টানা ১৫ দিন তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। অসুস্থতার দরুন মাদরাসার বেতন নিতে অস্বীকার করেন। বললেন, ‘আমি তো আর আগের মতো মাদরাসার কাজ করতে পারছি না।যদিও তিনি হাসাপাতাল থেকে ফিরে বাসায় বসে কিছু কিছু ফতোয়া দেখার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। তখন মুহতামিম সাহেব নিজে এসে জোর করে হুজুরের হাতে বেতন তুলে দিয়ে বললেন, ‘আপনি তো কোনো কাজ না করেই বেতন নিতে পারেন। পঁচিশ বছর ধরে আপনি বানূরী টাউনের যে অসামান্য খেদমত করেছেন তার কোনো তুলনাই হয় না। তাছাড়া এখনও তো প্রতিদিন কিছু কিছু ফতোয়া দেখছেন। দয়া করে আপনি বেতন নেওয়া বন্ধ করবেন না। আরও কোনো ধরনের খরচের প্রয়োজন হলে আমাদের জানাবেন। ইনশাআল্লাহ আমরা ব্যবস্থা করব।

হুজুর দুটি বিয়ে করেছিলেন। দুই স্ত্রীর মধ্যে তিনি চমৎকার ভারসাম্য রক্ষা করেছিলেন। মাওলানা নাফিসের আম্মা ছিলেন হুজুরের প্রথম আহলিয়া। তিনি জিরি মাদরাসার মুহতামিম মুফতী নুরুল হক ছাহেবের কন্যা। দেশ ছেড়ে পরিবার-পরিজন ফেলে পাকিস্তানে থাকতে প্রথম আহলিয়ার কষ্ট হচ্ছিল। তাই তিনি আর পাকিস্তান ফিরতে চাচ্ছিলেন না। পাকিস্তানে একা থাকা হুজুরের কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তাই আরেক বিবাহ করে স্ত্রীকে পাকিস্তান নিয়ে যান। দ্বিতীয় বিয়ের কিছুদিন পর হুজুর একদিন মুচকি মুচকি হেসে বলছিলেন, নাফিসের আম্মাও তো এখন আসতে চাচ্ছেন।

আহ কত সরলপ্রাণ মানুষ ছিলেন! তারপর প্রথম আহলিয়াকেও পাকিস্তান নিয়ে আসেন। দুই স্ত্রীর জন্য আলাদা বাসার ব্যবস্থা করেন।

***

জানাযা হবে রাত এগারোটায়। আমরা যখন গিয়ে হাটহাজারী পৌঁছলাম তখন প্রায় দশটা বাজে। ইতিমধ্যেই পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য। মাদরাসার সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, মারকাযুদ দাওয়াহর খিররিজ মাওলানা ত্বহা দানিশ, মাওলানা আব্দুন নাফে, মাওলানা মাহদী নিযাম প্রমুখ। প্রথম দুজন এখন পটিয়া মাদরাসার শিক্ষক। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হল তৃতীয় তলার মেহমানখানায়। সেখানে মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব পূর্ব থেকেই ছিলেন। এখানে অনেক পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হল। এদের মধ্যে ছিলেন, সহপাঠী, ছাত্র, জীবনে কখনো দেখা না হওয়া শুভানুধ্যায়ীরা। মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেবের কাছে শুনলাম, চাটগামী হুযুর সুস্থই ছিলেন। কালও কর্মব্যস্ত দিন কাটিয়েছেন। মজলিসে শূরায় তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে মুহতামিম ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এ খবর জানানোর আগেই তিনি এ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন।

রাত ঠিক এগারোটায় জানাযার কাতার দাঁড়িয়ে গেল। হাটহাজারী মাদরাসার সামনে দিয়ে যে রোডটি খাগড়াছড়ির দিকে চলে গেছে তা মাদরাসার পশ্চিম দিকে। প্রচুর জনসমাগমের কারণে জানাযার খাটিয়া রোডের অপর পাশে রাখা হয়। সেখান থেকে কাতার শুরু হয়ে পেছনের দিকে আসতে আসতে মাদরাসার মাঠে এসে শেষ হয়। মাদরাসার মাঠ পূর্ণ হয়ে মানুষ সিঁড়ি, বারান্দা, কামরা পর্যন্ত সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। নামাযের আগে বিশিষ্টজনেরা বক্তব্য দেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন হুজুরের ছেলেও। সবার বক্তব্যের মধ্যেই হুজুরের সাদাসিধে জীবন ও দুনিয়াবিমুখতার কথা উঠে আসে। হযরত মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী ছাহেব দা. বা. জানাযার নামাযে ইমামতি করেন।

জানাযা শেষ হল। সমাপ্ত হল এক পরকালমুখী মানুষকে পরকালের পথে বিদায় দেওয়ার মিলনমেলা। নামায শেষে মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। মাকবারায় গিয়ে যিয়ারত করলাম। তিনি আরও এক দিন চট্টগ্রামে থাকবেন। মানুষের ভিড় ঠেলে এগুচ্ছি। এক তালিবে ইলম এসে নিজেকে চাটগামী ছাহেবের ছাত্র বলে পরিচয় দিল। বলল, আপনার আলোচনা এলে হুজুর খুব খুশি হতেন... এরপর আরও কিছু বলল। যেগুলো পাঠকের সামনে না বলে নিজের হৃদয়ে সুপ্ত রাখাই শ্রেয়।

হযরত মুফতী আব্দুস সালাম চাটগামী রাহ. ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও ফিকহের গভীর মুতালাআর মানুষ। পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনী প্রতিষ্ঠান জামিআতুল উলূমিল ইসলামিয়া আল্লামা বানূরী টাউনে আততাখাসসুস ফিল ফিকহিল ইসলামীতে অধ্যয়ন শেষে তাঁর অসাধারণ যোগ্যতা দেখেই মুহতামিম ও প্রতিষ্ঠাতা হযরত মাওলানা ইউসুফ বানূরী রাহ. তাঁকে নিজ মাদরাসায় উস্তায হিসেবে নিয়োগ দেন। এ প্রতিষ্ঠানে তিনি দরসে হাদীস দিয়েছেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত হযরত মুফতী ওলী হাসান টোংকী ছাহেবের নায়েব হিসেবে দারুল ইফতায় কাজ করেছেন। এ দারুল ইফতা ছিল তখন সেদেশের মারজাউল খাস ওয়াল আম। একসময় তিনি এর প্রধানও নিযুক্ত হন, যা ছিল অনেক বড় মর্যাদার সুবিশাল দায়িত্ব। আগেই বলা হয়েছে, তাঁর অসাধারণ বিভিন্ন মানবিক গুণাবলি ও ফিকহী যোগ্যতার কারণে সকলেই বিশেষভাবে ইজ্জত করত।

মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর শুরুর সময় যে কজন বুযুর্গ এর মুশীর ও মুরব্বী ছিলেন হুযুর তাঁদের অন্যতম। আমাদের দুই ভাইকে সবসময় স্নেহের নজরেই দেখতেন। মারকাযের হযরতপুর প্রাঙ্গণে আসার ইচ্ছাও ব্যক্ত করেছিলেন; যা আর হয়ে উঠল না। একবার দেখা হওয়ার পর বললেন, আপনারা রাজধানীতে বসে আছেন আর মানুষ বিভিন্ন আলেমের নাম ব্যবহার করে ইসলামের নামে সুদের ব্যবসা করছে। এ নিয়ে কাজ করা দরকার। হুযুরের ইশারা ছিল, ইসলামী ব্যাংকগুলোর দিকে।

আমি আরয করলাম, ‘উস্তাদজী! আমি আলকাউসারের পাতায় ব্যাংকগুলোর শরীয়া পরিপালনে গাফলতি নিয়ে দুই কিস্তিতে কিছু লিখেছি। শুনে খুশি হলেন এবং আরো কাজ করার তাগিদ দিলেন।

চাটগামী হুজুর আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। দুনিয়ার সবচেয়ে বাস্তব ব্যাপারগুলোর একটি হল মৃত্যু। এ বাস্তবতার মুখোমুখি সবাইকেই হতে হবে। তাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকাই হল শ্রেয়তর কাজ। হে আল্লাহ আমাদেরকে মৃত্যুর জন্য সদা প্রস্তুত থাকার তাওফীক দান করুন। আমার মুহসিন এই উস্তাযকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। আমাদেরকে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement