শাওয়াল ১৪৩১   ||   অক্টোবর ২০১০

উম্মাহ : পশ্চিমা মিডিয়ার গরু মেরে চামড়া দান

খসরূ খান

ন্তর্জাতিক মিডিয়াই বলি আর পশ্চিমা মিডিয়াই বলি, এর একটি বৈশিষ্ট্য প্রায় অবধারিত। মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্কের যেকোনো ইস্যুতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও ধূর্ত প্রক্রিয়ায় হলেও এসব মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বের নজির ফুটে ওঠে। খোলাখুলি ভঙ্গিতে যখন নিরপেক্ষতার চাদর সরিয়ে ফেলে তখন তো বোঝাই যায়, শব্দ ও উপস্থাপন-কৌশলে যখন চালাকির আশ্রয় নেয় তখন সাদা চোখে ততটা ধরা পড়ে না। অবশ্য তখনও একটু লক্ষ্য  করলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অতীতেও এ বিষয়টি আমরা আলোচনা করেছি। নতুন একটি প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে। এ প্রসঙ্গে গত ৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি রিপোর্টের ভাষা দেখা যেতে পারে।

রিপোর্টটির সূত্র হচ্ছে রয়টার্স। কথিত আছে, রয়টার্সসহ পৃথিবীবিখ্যাত বহু সংবাদসংস্থার বড় নিয়ন্ত্রণ ইহুদী পুঁজিপতিদের হাতে। ওই রিপোর্টের শিরোনাম হল : জেরুজালেম ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত ইসরাইলের। তিন প্যারার ওই রিপোর্টের প্রথম প্যারাটি দেখুন : শান্তি আলোচনায় জেরুজালেমের কিছু অংশ ফিলিস্তিনিদের কাছে হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক ইসরাইল। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এহুদ বারাক বুধবার এ কথা বলেন। ওয়াশিংটনে ইসরাইল-ফিলিস্তিন সরাসরি শান্তি আলোচনা শুরুর আগ মুহূর্তে বারাক এ ইঙ্গিত দিলেন। ইসরাইলের হারেৎজ পত্রিকায় বারাক বলেন, পশ্চিম জেরুজালেম এবং আশপাশের ২ লাখ জনবসতিপূর্ণ ১২টি ইহুদি এলাকা ইসরাইলের থাকবে। আর পূর্ব জেরুজালেমের আরবঅংশ, যেখানে প্রায় আড়াই লাখ ফিলিস্তিনির বাস, তা ফিলিস্তিনিদের দিয়ে দেওয়া হবে।

ইসরাইল আর ইসরাইল ও আমেরিকা মনোনীত ফিলিস্তিন-প্রতিনিধিদের মাঝে সংঘটিত এসব কথিত শান্তিআলোচনা সম্পর্কে অনেক বিশ্লেষকেরই মন্তব্য হল, এগুলো হচ্ছে বছর বছর ধরে চলতে থাকা ধারাবাহিক নাটকের একেকটি পর্ব। চমৎকার সাজানো মঞ্চ, সুন্দর কিছু ডায়লগ আর ঝকঝকা তকতকা কিছু ফটো-ফুটেজের বাইরে এসবের কোনোই সুফল দেখা যায় না। জেরুজালেমের কোনো অংশ আদৌ ফিলিস্তিনিরা ফিরে পাবেন কি না এ সংশয় নিরসনের কোনো উপায় এসব আলোচনায় থাকে না। এসব শান্তিআলোচনার কলা-কুশিলবরা কোনো দিনই শান্তির কোনো দিগন্তে যেতে ইচ্ছুক কি না, জানার কোনো ব্যবস্থাও নেই। তবুও এ আলোচনায় সে প্রসঙ্গটির দিকে যাওয়ার ইচ্ছা স্থগিত থাকল। শান্তিআলোচনা নামক নাটকের অন্তঃসারশূন্য ডায়লগের রিপোর্টগুলোই পশ্চিমা মিডিয়া কীভাবে করছে সেটি আমরা দেখতে চাই।

শিরোনাম ছিল : জেরুজালেম ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত ইসরাইলের। প্রশ্ন হচ্ছে, ইসরাইল যদি জেরুজালেমের কোনো অংশ ফিলিস্তিনিদের ফিরিয়ে দেওয়ার ইঙ্গিতও দেয় সেটিকে কি তার ছাড় দেওয়া শব্দে উপস্থাপন করার সুযোগ আছে? জেরুজালেম তো  বোমা, কামান, বন্দুকের জোরে ইসরাইল দখল করেছিল ১৯৬৭ সালের আকস্মিক আগ্রাসী যুদ্ধে। সেখানে বলা উচিত ছিল : দখল করা জেরুজালেমের কিছু অংশ ইসরাইল ফিরিয়ে দিতে চায় ফিলিস্তিনিদের কিংবা এ ধরনের কোনো বাক্য। রিপোর্টের শুরুতেই বলা হয়েছে-জেরুজালেমের কিছু অংশ ফিলিস্তিনিদের কাছে হস্তান্তর করতে ইচ্ছুক ইসরাইল। একই প্রশ্ন এখানেও আসে। উপস্থাপনভঙ্গিতে মনে হয় ইসরাইল নিজের জায়গাজমি উদারভাবে ফিলিস্তিনিদের হস্তান্তর করছে। জেরুজালেমের কিছু অংশ ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার মতো কিছু হলে তো সেটা হবে ফিরিয়ে দেওয়া, নিরেট স্তন্তর এখানে প্রযোজ্য হতে পারে না। প্যারার শেষ বাক্যে বলা হয়েছে-আর পূর্বজেরুজালেমের আরব-অংশ, যেখানে প্রায় আড়াই লাখ ফিলিস্তিনিদের বাস, তা ফিলিস্তিনিদের দিয়ে দেওয়া হবে। শব্দ দেখুন-দিয়ে দেওয়া হবে। পুরো জেরুজালেম জোরপূর্বক দখল করল ইসরাইলিরা  আর আজ সে জেরুজালেমের পূর্বাঞ্চলের আরবঅংশ ফিরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেই পশ্চিমা মিডিয়া বলল-দিয়ে দেওয়া হবে। যেন ইসরাইলের তালুক     ফিলিস্তিনীদের দিয়ে দিচ্ছে আর কি! গৃহস্থের গরু চুরি করে গোশত খেয়ে চোর সে গরুর চামড়াটি গৃহস্থকে ফেরত দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে-এ বাক্যটি পশ্চিমা মিডিয়ার ভাষায় বললে বলতে হবে-নিহত গরুর চামড়াটি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে গৃহস্থকে উপহার দিতে চাচ্ছেন চোর। রিপোর্টে আগের ঘটনার কোনো জের থাকবে না। যেন চামড়া ফেরত পাওয়াটা গৃহস্থের একটি মস্ত বড় প্রাপ্তি আর চামড়া দেওয়াটা চোরের এক বিশাল ছাড় কিংবা দান ও মহানুভবতা! মুসলিম-অমুসলিম সম্পর্ক ও দ্বন্দ্বে পশ্চিমা মিডিয়ার ভাষায় ও বর্ণনায় চোর হয়ে যায় মহানুভব। গৃহস্থ বেচারা চোরের দান ও ছাড়ের কারণে চামড়া পেয়ে ধন্য হয়।

পশ্চিমা মিডিয়া পরিবেশিত সংবাদের ক্ষেত্রে এ দেশের উভয় ধারার (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক) মিডিয়াই আক্ষরিক অনুবাদের পদ্ধতিই অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুশীলন করে থাকে। নিজস্ব ইতিহাসজ্ঞান, ন্যূনতম ন্যায়ানুগ বিশ্লেষণ আর সৎ পর্যবেক্ষণের ধার কেউ ধারতে চান না। সেজন্যই ইসলাম ও মুসলিম সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে পশ্চিমা মিডিয়ার সরবরাহ করা খবরের নেটে ঢাকা নগ্নতা সম্পর্কে সচেতন থাকা সবার জন্যই দরকারি, সবার জন্যই মঙ্গলজনক।

 

advertisement