মুহাররম ১৪৪৩   ||   আগস্ট ২০২১

আহলে বাইতের দৃষ্টিতে মাতম
[শিয়াদের বর্ণনার আলোকে]

মাওলানা মুহাম্মাদ আবু সালেম

মুহাররম মাস সম্মানিত চার মাসের একটি। তার মধ্যে ১০ মুহাররম তথা আশুরার দিনটি আরো সম্মানিত ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিনে আল্লাহ হযরত মূসা আলাইহিস সালাম ও তাঁর সম্প্রদায়কে দরিয়ার বুকে রাস্তা বানিয়ে নিরাপদে পার করে দিয়েছিলেন। ফেরাউন ও তার বাহিনী এই রাস্তা দিয়ে তাদের ধাওয়া করে। আল্লাহর ইশারায় মাঝপথে দরিয়ার বুক জোড়া লেগে যায় এবং ফেরাউন দলবলসহ ধ্বংস হয়। এটি আল্লাহর অপার কুদরতের নিদর্শন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দিনে রোযা রাখতেন। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার আগে এ রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযার পর এ রোযাটি নফল হয়ে যায়। তবে সাধারণ নফলের চেয়ে এর গুরুত্ব বেশি।

৬১ হিজরীর এই দিনে হযরত হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু পরিবার-পরিজন ও সাথী-সঙ্গীদের নিয়ে কারবালার ময়দানে মর্মান্তিকভাবে শাহাদাত বরণ করেন। এটি তাঁর জন্য তো বড় মর্যাদার বিষয়। ন্যায় ও সত্যের জন্য এরকম তাৎপর্যপূর্ণ দিনে তিনি আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আমাদের জন্য অবশ্য তা মসিবত। আমরা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয় দৌহিত্রকে হারালাম। জান্নাতের এক সরদারকে হারালাম। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ বীর-মুজাহিদকে হারালাম...।

দুনিয়ার জীবন সর্বদা অনুকূল হয় না। মাঝেমধ্যে প্রতিকূলে বয়ে চলে। সুখ-দুঃখ, শান্তি-অশান্তি, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনার মধ্য দিয়েই আমাদের জীবনের গতিপ্রবাহ। দুনিয়াতে এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। তাই জীবনের এই অংশের জন্য ইসলামে রয়েছে সুস্পষ্ট, সুবিন্যস্ত ও সুনির্দিষ্ট শিক্ষা এবং নির্দেশনা।

ইসলামের এই শিক্ষার সারকথা হল, এ বিশ্বাস রাখা যে, বিপদ আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে। আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। আল্লাহর ফায়সালার উপর অভিযোগ না তোলা। তাঁর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়া। সবর করা। মাতম, হাত-পা আছড়ানো, বুক চাপড়ানো, চেহারা খামচানোসহ এজাতীয় সকল কর্মকা- থেকে বিরত থাকা।

কুরআন-হাদীসে বহু জায়গায় এ শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়; কুরআন ও সুন্নাহর পাতায় এ শিক্ষা সম্বলিত দুআও উল্লেখিত হয়েছে। এখানে শুধু একটি আয়াত এবং দুটি হাদীস উল্লেখ করছি।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে ইরশাদ করেন-

وَ لَا تَقُوْلُوْا لِمَنْ یُّقْتَلُ فِیْ سَبِیْلِ اللهِ اَمْوَاتٌ  بَلْ اَحْیَآءٌ وَّ لٰكِنْ لَّا تَشْعُرُوْن وَ لَنَبْلُوَنَّكُمْ بِشَیْءٍ مِّنَ الْخَوْفِ وَ الْجُوْعِ وَ نَقْصٍ مِّنَ الْاَمْوَالِ وَ الْاَنْفُسِ وَ الثَّمَرٰتِ  وَ بَشِّرِ الصّٰبِرِیْنَ الَّذِیْنَ اِذَاۤ اَصَابَتْهُمْ مُّصِیْبَة قَالُوْۤا اِنَّا لِلهِ وَ اِنَّاۤ اِلَیْهِ رٰجِعُوْنَ اُولٰٓىِٕكَ عَلَیْهِمْ صَلَوٰتٌ مِّنْ رَّبِّهِمْ وَ رَحْمَةٌ ۫ وَ اُولٰٓىِٕكَ هُمُ الْمُهْتَدُوْنَ.

যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তোমরা তাদের সম্পর্কে এ কথা বলো না যে, তারা মৃত; বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পার না। আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয় ও ক্ষুধা দ্বারা এবং জান-মাল ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। আপনি সুসংবাদ দিন ধৈর্যশীলদের, যারা তাদের কোনো মসিবত দেখা দিলে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব। এমন লোকদের উপরই রয়েছে তাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে করুণাসমূহ এবং তারাই সরল পথপ্রাপ্ত। -সূরা বাকারা (২) : ১৫৪-১৫৭

এ আয়াতে শাহাদাতের মত ঘটনায়ও ধৈর্যধারণের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। এ থেকে বোঝা গেল বিপদ ছোট হোক বা বড়, মর্মান্তিক হোক বা অমর্মান্তিক সর্বাবস্থায় সবর করতে হবে। বিপদের মর্মান্তিকতার কারণে অধৈর্য হওয়া যাবে না।

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

لَيْسَ مِنّا مَنْ لَطَمَ الخُدُودَ، وَشَقّ الجُيُوبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الجَاهِلِيَّةِ.

যে ব্যক্তি মুখে আঘাত করে, জামার বুক ছেঁড়ে এবং জাহেলী যুগের কথাবার্তা বলে সে আমাদের দলভুক্ত নয়। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৫

دَعَا بِدَعْوَى الجَاهِلِيَّةِ -এর ব্যাখ্যায় হাদীস ব্যাখ্যাকারগণ লিখেছেন, এটি ব্যাপক বিষয়। এর বিভিন্ন দিক আছে। একটি দিক হল, বিপদে বিলাপ করা, দুঃখ ও ধ্বংসকে ডাকা। যেমন একথা বলা, হে আমার দুঃখ, হে আমার ধ্বংস, হায়! আমি যদি ধ্বংস হয়ে যেতাম ইত্যাদি। দ্রষ্টব্য : ইকমালুল মুলিম বি ফাওয়াদি মুসলিম ১/৩৭৬; ইহকামুল আহকাম শরহু উমদাতিল আহকাম ৩৬১; ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার ৩/১৬৪

আবু মূসা আশআরী রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أَنَا بَرِيءٌ مِمّنْ حَلَقَ وَسَلَقَ وَخَرَقَ.

ঐ ব্যক্তির সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, যে (শোকে) মাথা মুণ্ডায়, বিলাপ করে, কাপড় ছেঁড়ে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৬৭; সহীহ বুখারী, হাদীস ১২৯৬

হাদীসদুটি থেকে স্পষ্ট যে, বিপদে বিলাপ করা, চেহারা খামচানো, কাপড় ছেঁড়া, দুঃখ ধ্বংসকে ডাকা এগুলো ইসলাম পরিপন্থী জাহেলী কাজ এবং তা সম্পূর্ণ হারাম ও পরিত্যাজ্য।

কুরআন ও সুন্নাহর এ শিক্ষা শিয়ারা যাদেরকে ইমাম মনে করে তাদের বক্তব্যেও স্পষ্টভাবে রয়েছে। যেমন আলী রা., হুসাইন রা., আলী ইবনে হুসাইন রাহ. প্রমুখ।১ শিয়াদের নিকট নির্ভরযোগ্য গ্রন্থাবলিতে তাদের সূত্রে বর্ণিত এ সম্পর্কিত অনেক হাদীসও রয়েছে। এখানে আমরা তাদের গ্রন্থাবলি থেকে কয়েকটি হাদীস এবং তাদের ইমামদের কিছু বক্তব্য পেশ করছি।

শিয়াদের গ্রন্থে বর্ণিত হাদীস

শিয়াদের সিকাতুল ইসলাম মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াকুব কুলাইনী (৩২৯ হি.) তার আলকাফী গ্রন্থে আবু আবদুল্লাহ (শিয়াদের ৬ষ্ঠ ইমাম জাফর সাদেক) থেকে বর্ণনা করেছেন, মক্কা বিজয়ের পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষদের বাইআত করেন। তারপর মহিলারা তাঁর কাছে বাইআত হওয়ার জন্য আসে। তখন আল্লাহ এ আয়াত নাযিল করেন-

یٰۤاَیُّهَا النَّبِیُّ اِذَا جَآءَكَ الْمُؤْمِنٰتُ یُبَایِعْنَكَ عَلٰۤی اَنْ لَّا یُشْرِكْنَ بِاللهِ شَیْـًٔا وَّ لَا یَسْرِقْنَ وَ لَا یَزْنِیْنَ وَ لَا یَقْتُلْنَ اَوْلَادَهُنَّ وَ لَا یَاْتِیْنَ بِبُهْتَانٍ یَّفْتَرِیْنَهٗ بَیْنَ اَیْدِیْهِنَّ وَ اَرْجُلِهِنَّ وَ لَا یَعْصِیْنَكَ فِیْ مَعْرُوْفٍ فَبَایِعْهُنَّ وَ اسْتَغْفِرْ لَهُنَّ الله اِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِیْمٌ.

[হে নবী! যখন মুমিন নারীরা আপনার কাছে এই মর্মে বাইআত হওয়ার জন্য আসে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কোনো কিছু শরীক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, তারা সজ্ঞানে কোনো অপবাদ রচনা করে রটাবে না এবং কোনো ভালো কাজে আপনার নাফরমানি করবে না, তখন আপনি তাদের বাইআত করুন এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। নিশ্চয় আল্লাহ অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। -সূরা মুমতাহিনা (৬০) : ১২]

অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই মর্মে নারীদের বাইআত করলেন। তখন উম্মে হাকীম জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল, এই مَعْرُوْفٍ কী জিনিস, যার ব্যাপারে আল্লাহ হুকুম করেছেন- আমরা যেন আপনার নাফরমানি না করি? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-

لا تلطمن خدا، ولا تخمشن وجها، ولا تنتفن شعرا، ولا تشققن جيبا، ولا تسودن ثوبا، ولا تدعين بويل.

তা হল তোমরা গাল থাপড়াবে না। চেহারা খামচাবে না। চুল উপড়াবে না। কাপড় ছিঁড়বে না। কালো কাপড় পরিধান করবে না। দুঃখ-ধ্বংসকে ডাকবে না। -আলকাফী, শিয়া পণ্ডিত কুলাইনী ৫/৩১৮

আরো দ্রষ্টব্য : তাফসীরে কুম্মী (শিয়া পণ্ডিত আলী ইবনে ইবরাহীম কুম্মী) ৩/১০৬৫; তাফসীরে সাফী, শিয়া মুফাসসির মওলা মুহসিন কাশানী ৭/১৭৪-৭৫; বিহারুল আনওয়ার, শিয়া পণ্ডিত বাকির মাজলিসী ২১/১৩৪; তাফসীরে নূরুস সাকালাইন, শিয়া মুফাসসির আবদ আলী ইবনে জুমুআ আলহুআইযী ৭/৩৪৬; মুসতাদরাকুল ওয়াসাইল, শিয়া পণ্ডিত মির্যা হুসাইন নূরী ৩/৩৩২

শিয়া পণ্ডিত বাকির মাজলিসী তার মিরআতুল উকূল গ্রন্থে এই বর্ণনাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। (দ্রষ্টব্য : মিরআতুল উকূল ২০/৩৫৮)

এ বর্ণনা থেকে স্পষ্ট যে, বিপদে গাল থাপড়ানো, চেহারা খামচানো, চুল উপড়ানো, কাপড় ছেঁড়া, কালো কাপড় পরিধান করা, দুঃখ-ধ্বংসকে ডাকা জায়েয নয়। এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কাজগুলো না করার মর্মে নারীদের বাইআত করেছেন। মহিলাদেরকে বিশেষভাবে এই মর্মে বাইআত করার কারণ হল তারাই এগুলো বেশি করে থাকে।

কুলাইনী তার আলকাফী গ্রন্থে আমর ইবনে আবিল মিকদাম থেকে বর্ণনা করেছেন, একদিন আবু জাফর আলাইহিস সালাম আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-

وَ لَا یَعْصِیْنَكَ فِیْ مَعْرُوْفٍ.

এ আয়াতের মর্ম কী জানো? আমি বললাম, জী না। তিনি বললেন-

إن رسول الله صلى الله عليه وسلم قال لفاطمة عليها السلام: إذا أنا مت فلا تخمشي عليّ وجهاً، ولا تنشري عليّ شعراً، ولا تنادي بالويل، ولا تقيمي عليّ نائحة. قال: ثم قال: هذا هو المعروف الذي قال الله عز وجل.

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাতেমা আলাইহাস সালামকে বলেছেন, আমি ইন্তেকাল করলে তুমি আমার জন্য মুখ চাপড়াবে না। চুল এলোমেলো করবে না। দুঃখ-ধ্বংসকে ডাকবে না। বিলাপ-মজলিস কায়েম করবে না। এরপর তিনি বলেন, এটাই হচ্ছে সেই مَعْرُوْف যার কথা আল্লাহ বলেছেন। -আলকাফী, শিয়া পণ্ডিত কুলাইনী ৫/৩১৮

আরো দ্রষ্টব্য : মাআনিল আখবার, শিয়া পণ্ডিত শায়েখ সদূক ২/৩১০-৩১১; বিহারুল আনওয়ার, শিয়া পণ্ডিত বাকির মাজলিসী ৭৯/৭৬; মুসতাদরাকুল ওয়াসাইল, শিয়া পণ্ডিত মির্যা হুসাইন নূরী ৩/৩৩৩

এ বর্ণনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যু শুধু হযরত ফাতেমা রা. নয়; গোটা মানবতার জন্য মসিবত। উম্মতের জীবনে এর চেয়ে বড় কোনো বিপদ নেই। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কলিজার টুকরোকে তাঁর মৃত্যুতে মুখ চাপড়াতে, চুল এলোমেলো করতে, দুঃখ-ধ্বংস ডাকতে, বিলাপ করতে নিষেধ করেছেন। এ থেকে বোঝা গেল কোনো বিপদে এবং কারো মৃত্যুতেই এসব কাজ করা বৈধ নয়।

শিয়া প-িত শায়েখ সদূক (৩৮১হি.) তার আলখিসাল গ্রন্থে আলী রা.-এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

أربعة لا تزال في أمتي إلى يوم القيامة: الفخر بالأحساب، والطعن في الأنساب، والاستسقاء بالنجوم، والنياحة، وإن النائحة إذا لم تتب قبل موتها تقوم يوم القيامة وعليها سربال من قطران ودرع من جرب.

চারটা কাজ আমার উম্মতের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। বংশ নিয়ে গর্ব করা। বংশ নিয়ে কটাক্ষ করা। নক্ষত্র দ্বারা পানি প্রার্থনা করা এবং মৃতের জন্য বিলাপ করা। বিলাপকারী যদি মৃত্যুর আগে তাওবা না করে তাহলে কিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উঠবে যে, তার গায়ে আলকাতরা ও  পাঁচড়ার পোষাক থাকবে। -আলখিসাল, শিয়া পণ্ডিত শায়েখ সদূক ২২৬

আরো দ্রষ্টব্য : বিহারুল আনওয়ার, শিয়া পণ্ডিত বাকির মাজলিসী ৭৯/৭৪

এ বর্ণনা থেকে তো পরিষ্কার যে, মায়্যেতের জন্য বিলাপ করা জাহেলী কাজ এবং এর জন্য কঠিন আযাব রয়েছে।

আলী রা.-এর বক্তব্য

আলী রা.-কে শিয়ারা তাদের প্রথম ও প্রধান ইমাম মনে করে। অনেক শিয়া তো তাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমকক্ষ ভাবে! তিনি ৪০ হিজরীতে শাহাদাত বরণ করেন।

শিয়া পণ্ডিত শরীফ রাযী (৪০৬ হি.) তার নাহজুল বালাগা গ্রন্থে আলী রা.-এর এ উক্তি উল্লেখ করেছেন-

أوصيكم بخمس لو ضربتم إليها آباط الإبل لكانت لذلك أهلا،... وعليكم بالصبر، فإن الصبر من الإيمان كالرأس من الجسد، ولا خير في جسد لا رأس معه، ولا في إيمان لا صبر معه.

আমি তোমাদেরকে পাঁচটি কাজের অসিয়ত করছি। এগুলো জানার জন্য দূরদূরান্তে সফর করলেও বৃথা যাবে না। (পর্যায়ক্রমে তিনি পাঁচটি উল্লেখ করেন। পঞ্চমটি হল) তোমরা সবরকে আঁকড়ে ধরবে। সবর ঈমানের জন্য তেমন, দেহের জন্য মাথা যেমন। মাথাবিহীন দেহ যেমন মূল্যহীন, তেমনি সবরবিহীন ঈমানের কোনো মূল্য নেই। -নাহজুল বালাগা, শিয়া পণ্ডিত শরীফ রাযী ৪৮২ (হিকমত নং ৮২)

আলী রা.-এর এ বক্তব্য থেকে অনুমেয়, মুমিনের জন্য সবর করার কত গুরুত্ব। সবরবিহীন ঈমানকে তিনি মাথাবিহীন দেহের সাথে তুলনা করেছেন।

শিয়া পণ্ডিত শরীফ রাযী নাহজুল বালাগা গ্রন্থে আলী রা. থেকে আরো উল্লেখ করেছেন-

ينزل الصبر على قدر المصيبة، ومن ضرب يده على فخذه عند مصيبته حبط عمله.

বিপদ অনুযায়ী (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সবর নসীব হয়। যে বিপদে (অধৈর্য হয়ে) নিজের ঊরু চাপড়ায় সে তার আমল নষ্ট করে ফেলল। -নাহজুল বালাগা, শিয়া পণ্ডিত শরীফ রাযী ৪৯৫ (হিকমত নং ১৪৪)

এ বক্তব্য থেকে বোঝা গেল, বিপদে অধৈর্য হওয়া, ঊরু চাপড়ানো অত্যন্ত ক্ষতিকর। এতে আমল নষ্ট হয়ে যায়।

শিয়া পণ্ডিত শরীফ রাযী নাহজুল বালাগা গ্রন্থে আরো উল্লেখ করেছেন, আলী রা. যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে শেষ গোসল করাচ্ছিলেন তখন বলেছিলেন-

بأبي أنت وأمي يا رسول الله! لقد انقطع بموتك ما لم ينقطع بموت غيرك، من النبوة والإنباء وأخبار السماء، خصصت حتى صرت مسليا عمن سواك، وعممت حتى صار الناس فيك سواء، ولو لا أنك أمرت بالصبر ونهيت عن الجزع لأنفدنا عليك ماء الشئون، ولكان الداء مماطلا، والكمد محالفا، وقلا لك، ولكنه ما لا يملك رده، ولا يستطاع دفعه، بأبي أنت وأمي! اذكرنا عند ربك، واجعلنا من بالك.

আপনার জন্য আমার পিতামাতা কোরবান হোক। আপনার মৃত্যুতে ওহী, নবুওত ও আসমানের খবর চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল, যা অন্য কারো মৃত্যুতে হয়নি। আপনি আমাদের জন্য সান্ত¡নার উৎস হয়ে গেছেন। আপনার শোকে সকল মানুষ ভারাক্রান্ত হবে। আপনি যদি সবরের আদেশ না করতেন এবং অধৈর্য থেকে নিষেধ না করতেন তাহলে আপনার জন্য আমরা অশ্রুর ঝর্ণা প্রবাহিত করতাম। তাতেও আমাদের ব্যথার উপশম হত না। আমাদের শোক নিবারণ হত না। আপনাকে হারানোর তুলনায় আমাদের যে কোনো শোক অতি নগণ্য। কিন্তু মৃত্যু তো অবধারিত ও অপ্রতিরুদ্ধ। আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক। আপনি আল্লাহর কাছে আমাদের কথা স্মরণ করবেন। -নাহজুল বালাগা, শিয়া পণ্ডিত শরীফ রাযী ৩৫৫ (খুতবা নং ২৩৫)

এ বক্তব্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ থেকে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত হয়-

১. উম্মাহর জীবনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর চেয়ে বড় কোনো মসিবত নেই। কারণ তাঁর মৃত্যুতে ওহী, নবুওত ও আসমানের খবর চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। যা অন্য কোনো নবীর মৃত্যুতে হয়নি।

২. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষা হল বিপদে সবর করা। অধৈর্য না হওয়া। তিনি সবরের আদেশ করেছেন এবং অধৈর্য হওয়া থেকে নিষেধ করেছেন।

৩. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ শিক্ষার কারণেই আলী রা. এত বড় মসিবতে সবর করেছেন। অধৈর্য হননি। বিলাপ করেননি।

হুসাইন রা.-এর বক্তব্য

হুসাইন রা.-কে শিয়ারা তাদের তৃতীয় ইমাম মনে করে। তাঁর শাহাদাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সম্প্রদায়টি আশুরার দিন মাতম-তাযিয়ার কুসংস্কার আবিষ্কার করেছে। দেখে নেওয়া যায় এ সম্পর্কে তিনি কী বলেন।

কূফাবাসী হুসাইন রা.-কে কূফা আগমনের জন্য বহু চিঠি লেখে। তাদের অনেক প্রতিনিধি দলও তাঁর কাছে আসে। তিনি কূফার অবস্থা সরেজমিনে যাচাইয়ের জন্য তাঁর আত্মীয় মুসলিম ইবনে আকীল রাহ.-কে প্রেরণ করেন। প্রেরণের সময় তাকে নির্দেশ দেন, পরিস্থিতি অনুকূল হলে যেন লোকদের কাছ থেকে তাঁর পক্ষে বাইআত গ্রহণ করে। মুসলিম ইবনে আকীল রাহ. কূফায় পৌঁছালে হাজার হাজার মানুষ বাইআত হয়। পরিস্থিতি অনুকূলে জানিয়ে তিনি হুসাইন রা.-কে পত্র লেখেন। পত্র পেয়ে হুসাইন রা. কূফা যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অনেক সাহাবী তাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের পরামর্শ দেন।

হুসাইন রা. এ পরামর্শ গ্রহণ না করে সপরিবারে সঙ্গীদের নিয়ে কূফার উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। পথে তিনি জানতে পারলেন, তাঁর প্রতিনিধি মুসলিম ইবনে আকীল ও সহযোগী হানী ইবনে উরওয়াকে ইবনে যিয়াদ হত্যা করেছে। তখন তিনি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে মক্কা ফিরে যাওয়ার চিন্তা করেন। তাঁর কোনো কোনো সঙ্গীও এরূপ পরামর্শ দেয়। কিন্তু মুসলিম ইবনে আকীল রাহ.-এর ভাইয়েরা বলল, আল্লাহর কসম, আমরা তার প্রতিশোধ নিব অথবা আমরাও তার মত নিহত হব। তখন হুসাইন রা. বললেন, তোমাদের পর আমার বেঁচে থাকাতে কোনো লাভ নেই। তিনি সামনে অগ্রসর হন।  পথে ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে প্রেরিত হুর ইবনে ইয়াযিদের বাহিনীর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। এ বাহিনী তাকে ইবনে যিয়াদের হাতে আত্মসমর্পণের কথা বলে। হুসাইন রা. তাতে রাজি না হয়ে মক্কা ফিরে যেতে চান। কিন্তু হুর-বাহিনী তাতে আপত্তি করে। হুসাইন রা. ভিন্ন পথ ধরে অগ্রসর হয়ে কারবালার প্রান্তে পৌঁছান। সেখানে তিনি ইবনে যিয়াদের পক্ষ থেকে পাঠানো উমর ইবনে সাদের বিশাল বাহিনীর মুখোমুখি হন। এ বাহিনীও তাকে ইবনে যিয়াদের হাতে আত্মসমর্পণের কথা বলে। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে মক্কা ফিরে যেতে চান। কিন্তু তারা তাতে বাধা দেয়। চতুর্দিক থেকে তাকে কোণঠাসা ও অবরুদ্ধ করে ফেলে এবং তাঁর সঙ্গে যুদ্ধের জন্য উদ্যত হয়। নিরস্ত্র ছোট্ট একটা দলের সাথে ৪-৫ হাজারের অস্ত্রসজ্জিত বাহিনীর যুদ্ধের পরিণতি কী হবে তা খুবই স্পষ্ট।

৬১ হিজরী ৯ মুহাররম অর্থাৎ হুসাইন রা.-এর শাহাদাতের আগের দিন সন্ধ্যার কথা। হুসাইন রা. শত্রু বাহিনী থেকে একদিনের সময় নিয়ে রাতটি নিবিড় ইবাদত-বন্দেগী ও দুআ-মুনাজাতে কাটান। পরিস্থিতি দেখে তাঁর বোন যয়নব বিনতে আলী অনুমান করেন, আগামীকাল তার ভাই হয়তো শহীদ হয়ে যাবেন। তিনি কান্নাকাটি শুরু করলেন। তখন হুসাইন রা. তাকে গুরুত্বপূর্ণ নসীহত করেছেন। নসীহতটি তাঁর পুত্র শিয়াদের চতুর্থ ইমাম খোদ যাইনুল আবিদীন রাহ. বর্ণনা করেছেন। ইয়াকুবী, মুফীদ, তবরাসী, মাজলিসী, আব্বাস আলকুম্মীসহ অনেক বড় বড় শিয়া পণ্ডিতগণ নিজেদের কিতাবে এটি উল্লেখ করেছেন।

যাইনুল আবিদীন রাহ. বলেন-

إني لجالس في تلك العشية التي قتل أبي في صبيحتها، وعندي عمتي زينب تمرضني، إذ اعتزل أبي في خباء له، وعنده جوين مولى أبي ذر الغفاري، وهو يعالج سيفه ويصلحه، وأبى يقول...

فأعادها مرتين أو ثلاثا حتى فهمتها وعرفت ما أراد، فخنقتني العبرة فرددتها ولزمت السكوت، وعلمت أن البلاء قد نزل، وأما عمتي فإنها سمعت ما سمعت وهي امرأة ومن شأن النساء الرقة والجزع، فلم تملك نفسها أن وثبت تجر ثوبها وإنها لحاسرة، حتى انتهت إليه فقالت: واثكلاه! ليت الموت أعدمتني الحياة، اليوم ماتت أمي فاطمة وأبي علي وأخي الحسن، يا خليفة الماضي وثمال الباقي، فنظر إليها الحسين عليه السلام فقال لها: يا أخية لا يذهبن حلمك الشيطان، وترقرقت عيناه بالدموع وقال: لو ترك القطا لنام، فقالت: يا ويلتاه! أفتغتصب نفسك اغتصابا؟! فذاك أقرح لقلبي وأشد على نفسي، ثم لطمت وجهها وهوت إلي جيبها فشقته وخرت مغشيا عليها.

فقام إليها الحسين عليه السلام فصب على وجهها الماء وقال لها: يا أختاه! اتقي الله وتعزي بعزاء الله، واعلمي أن أهل الأرض يموتون، وأهل السماء لا يبقون، وأن كل شيء هالك إلا وجه الله، الذي خلق الخلق بقدرته، ويبعث الخلق ويعودون، وهو فرد وحده، أبي خير مني، وأمي خير مني، وأخي خير مني، ولي ولكل مسلم برسول الله صلى الله عليه وآله أسوة، فعزاها بهذا ونحوه وقال لها: يا أخية! إني أقسمت فأبري قسمي، لا تشقي علي جيبا، ولا تخمشي علي وجها، ولا تدعي علي بالويل والثبور، إذا أنا هلكت.

সন্ধ্যায় আমি বসেছিলাম। ফুফু যয়নব আমার সেবা করছিলেন। হঠাৎ আমার পিতা তার তাঁবুতে চলে গেলেন। জুআইন তরবারি মেরামত করছিল আর আমার পিতা কবিতা আবৃত্তি করছিলেন...।

কবিতাটি তিনি দুই-তিনবার আবৃত্তি করেছেন। আমি কবিতাটির মর্ম ও তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছি। আমার দম বন্ধ হয়ে এল। আমি বুঝে ফেললাম, বিপদ এসে গেছে। আমার ফুফুও কবিতাগুলো শুনেছেন। নারীরা কোমল ও আবেগপ্রবণ। ফুফু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। অস্থির হয়ে কাপড় টেনে আমার পিতার কাছে গিয়ে বললেন, হায়! আমার যদি মৃত্যু হয়ে যেত! আমার মা ফাতেমা, পিতা আলী, ভাই হাসান দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। এখন আপনিই অতীতদের জানেশীন এবং বর্তমানদের রাহবর। হুসাইন আলাইহিস সালাম তার দিকে তাকিয়ে বললেন, হে বোন! শয়তান যেন তোমার হিলম (সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা) ছিনিয়ে না নেয়। হুসাইন আলাইহিস সালামের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরল। তিনি বললেন, শিকারি যদি কাতাকে (এক প্রকার পাখি) ছেড়ে দেয় তাহলে সে আরামে ঘুমায়। ফুফু বললেন, হায়! আপনাকে কি শেষ করে ফেলা হবে? এটা আমার জন্য বড় পীড়াদায়ক। এ কথা বলে তিনি তার চেহারায় থাপ্পড় মারলেন। কাপড় ছিঁড়ে ফেললেন এবং বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন।

হুসাইন আলাইহিস সালাম তার কাছে গিয়ে চেহারায় পানি ঢাললেন এবং বললেন, হে আমার বোন, তুমি আল্লাহকে ভয় কর। তার বিধান অনুযায়ী সান্ত¡না গ্রহণ কর। জেনে রাখ জমিনবাসী মৃত্যুবরণ করবে। আসমানবাসী অবশিষ্ট থাকবে না। সব ধ্বংস হয়ে যাবে। একমাত্র আল্লাহ বেঁচে থাকবেন, যিনি নিজ কুদরত দ্বারা মাখলুক সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর আবার জীবিত করবেন। আমার পিতা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার মা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার ভাই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার জন্য, সকল মুসলমানের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদর্শ। এভাবে তিনি সান্ত¡না দিয়ে বলেছেন, হে আমার বোন, আমি তোমাকে শপথ দিয়ে বলছি, তুমি আমার শপথ পূরণ করবে। আমি মৃত্যুবরণ করলে তুমি আমার জন্য কাপড় ছিঁড়বে না। চেহারা চাপড়াবে না। দুঃখ ধ্বংসকে ডাকবে না। -আলইরশাদ, শিয়া পণ্ডিত মুফীদ ২/৯৩-৯৪; ইলামুল ওয়ারা বি আলামিল হুদা, শিয়া পণ্ডিত ফযল ইবনে হাসান তবরাসী ১/৪৫৬-৪৫৭; বিহারুল আনওয়ার, শিয়া পণ্ডিত বাকির মাজলিসী ৪৫/২; মুনতাহাল আমাল, শিয়া পণ্ডিত আব্বাস আলকুম্মী ১/৪৮০-৮১; হায়াতুল ইমাম হুসাইন, শিয়া লেখক বাকির শরীফ ৩/১৭৮-১৭৯; তারিখুল ইয়াকুবী ২/২১৬-১৭

হুসাইন রা.-এর এ বক্তব্য থেকে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়-

১. যে কোনো বিপদে সকলের জন্য করণীয় হল আল্লাহর ফায়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা। ধৈর্যধারণ করা এবং শান্ত থাকার চেষ্টা করা।

২. কাপড় ছেঁড়া, চেহারায় চাপড়ানোদুঃখ-ধ্বংসকে ডাকা ইত্যাদি শয়তানী কর্মকা- এবং সম্পূর্ণ হারাম।

পাঠক লক্ষ্য করেছেন, তাঁর বোন যখন হায়-হুতাশ ও মৃত্যু কামনা করছিল তখন তিনি বোনের উদ্দেশে বলেছেন-

يا أخية لا يذهبن حلمك الشيطان.

হে বোন! শয়তান যেন তোমার হিলম (সহনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা) ছিনিয়ে না নেয়। এ থেকে বোঝা যায় এ ধরনের কাজ শয়তানের প্ররোচনায় হয় এবং এগুলো শয়তানী কাজ।

৩. এ কাজগুলো এত জঘন্য যে, তিনি বোনকে শপথ দিয়ে তা থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, সেই শপথ পূরণেরও অনুরোধ জানিয়েছেন-

يا أخية! إني أقسمت فأبري قسمي، لا تشقي علي جيبا، ولا تخمشي علي وجها، ولا تدعي علي بالويل والثبور، إذا أنا هلكت.

হে আমার বোন, আমি তোমাকে শপথ দিয়ে বলছি, তুমি আমার শপথ পূরণ করবে। আমি মৃত্যুবরণ করলে তুমি আমার জন্য কাপড় ছিঁড়বে না। চেহারা চাপড়াবে না। দুঃখ-ধ্বংসকে ডাকবে না।

৪. এ কাজগুলো তিনি কেন, তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ তাঁর পিতা-মাতা-ভাই এমনকি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুতেও বৈধ নয়। এগুলো যদি কারো মৃত্যুতে বৈধ হত তবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুতেই বৈধ হত। এদিকে ইঙ্গিত করেই তিনি বলেছেন-

أبي خير مني، وأمي خير مني، وأخي خير مني، ولي ولكل مسلم برسول الله صلى الله عليه وآله أسوة.

আমার পিতা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার মা আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার ভাই আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। আমার জন্য, সকল মুসলমানের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদর্শ।

এবার চিন্তা করুন, শিয়ারা ভ্রান্তির কোন্ অথৈ সাগরে নিমজ্জিত। যার দৃষ্টিতে এ কাজগুলো শয়তানী কর্মকা- ও সম্পূর্ণ হারাম, যিনি শাহাদাতের আগের রাতে পরিবারের লোকদের সামনে শপথ দিয়ে এগুলো থেকে বিরত থাকার কথা বলেছেন, তাঁর শাহাদাতের ঘটনা কেন্দ্র করেই তাঁর শপথপূর্ণ নিষিদ্ধ কাজগুলো করা হয়। ইমামের প্রতি এর চেয়ে বড় ধৃষ্টতা বা অকৃজ্ঞতা অথবা না-ইনসাফি আর কী হতে পারে?!

শিয়া পণ্ডিত জাফর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে কুলাওয়াই আলকুম্মী (৩৬৮ হি.) তার কামিলুয যিয়ারাত গ্রন্থে মুহাম্মাদ ইবনে আলী (শিয়াদের ৫ম ইমাম বাকির) থেকে বর্ণনা করেছেন, হুসাইন আলাইহিস সালাম যখন মদীনা থেকে চলে যাওয়ার দৃঢ় সংকল্প করলেন তখন বনী আবদুল মুত্তালিবের মহিলারা বিলাপের জন্য জড়ো হল। হুসাইন আলাইহিস সালাম তাদের কাছে গিয়ে বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলছি, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি করে এ কাজ করো না। সমবেত মহিলারা বলল, তাহলে আমরা আর কার জন্য বিলাপ-আহাজারি করব?

عن محمد بن علي قال لما هم الحسين عليه السلام بالشخوص من المدينة أقبلت نساء بني عبد المطلب، فاجتمعن للنياحة، حتى مشى فيهن الحسين عليه السلام فقال: أنشدكن الله أن تبدين هذا الأمر معصية لله ولرسوله، فقالت له نساء بني عبد الملطب: فلمن نستبقي النياحة والبكاء؟

-কামিলুয যিয়ারাত, শিয়া পণ্ডিত জাফর ইবনে মুহাম্মাদ ইবনে কুলাওয়াই আলকুম্মী ১৯৫

আরো দ্রষ্টব্য : জামিউ আহাদীসিশ শিয়াশিয়া পণ্ডিত হুসাইন আলবুরুজেরদীর তত্ত্বাবধানে রচিত ৩/৬৩৩

এটা সম্ভবত ওই সময়ের কথা, যখন ইয়াযিদের মদীনার গভর্নরের কাছে বাইআত হওয়ার জন্য হুসাইন রা.-কে বলা হচ্ছিল। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে তিনি মদীনা ছেড়ে চলে যান। হুসাইন রা.-এর মত মানুষ মদীনা ছেড়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে মদীনার মানুষের জন্য একটি মসিবত। তাই বনী আবদুল মুত্তালিবের মহিলারা এই মসিবতে বিলাপ করার জন্য জড়ো হয়। কিন্তু হুসাইন রা. তাদের নিষেধ করেছেন। তাঁর নিষেধের ভাষা থেকে স্পষ্ট যে, বিলাপ করলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানি হয়।

আলী ইবনে হুসাইন রাহ.-এর বক্তব্য

তিনি হলেন হুসাইন রা.-এর একমাত্র পুত্র, যিনি কারবালার মর্মান্তিক ঘটনায় রক্ষা পেয়েছেন। তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন। তাঁর বয়স ছিল তখন ২৩ বছরের মত। তাঁর ডাকনাম হল যাইনুল আবিদীন। শিয়াদের নিকট তিনি সাজ্জাদ উপাধিতে বেশি প্রসিদ্ধ। শিয়ারা তাকে তাদের চতুর্থ ইমাম মনে করে। তিনি ৯৪/৯৫ হিজরীতে মদীনায় ইন্তেকাল করেন।

শিয়া পণ্ডিত কুলাইনী আলকাফী গ্রন্থে আবু হামযা সোমালী থেকে বর্ণনা করেছেন, আলী ইবনে হুসাইন বলেছেন-

الصبر والرضا عن الله رأس طاعة الله، ومن صبر ورضي عن الله فيما قضى عليه فيما أحب أو كره، لم يقض الله عز وجل له فيما أحب أو كره إلا ما هو خير له

আল্লাহর আনুগত্যের মূল হচ্ছে সবর করা এবং আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা। যে পছন্দ-অপছন্দ সব বিষয়ে সবর করবে আল্লাহ তার জন্য সর্বদা কল্যাণের ফায়সালা করবেন। -আলকাফী, শিয়া পণ্ডিত কুলাইনী ২/৪৯-৫০

শিয়া পণ্ডিত বাকির মাজলিসী তার মিরআতুল উকূল গ্রন্থে এ বর্ণনাকে ‘সহীহ’ বলেছেন। (দ্রষ্টব্য : মিরআতুল উকূল ৮/২)

যাইনুল আবিদীন রাহ.-এর এ বক্তব্য থেকে বোঝা গেল, পছন্দ-অপছন্দ সকল অবস্থায় করণীয় হল, সবর করা এবং আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা।

শিয়া পণ্ডিতগণের উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহ থেকে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, বিপদ-মসিবতের ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহ যে শিক্ষা প্রদান করেছে, আহলে বাইতের মহান পুরুষগণও সেই শিক্ষার উপরই ছিলেন। তাঁরাও বিপদে ধৈর্যধারণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। বুক চাপড়ানো, চেহারা খামচানো, কাপড় ছিঁড়ে ফেলা, কালো কাপড় পরিধান করা, হায়-হুতাশ করা প্রভৃতি কর্মকা- থেকে নিষেধ করেছেন এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন জনের সামনে নিষেধ করেছেন। বিশেষত হুসাইন রা. পরিবারের লোকদের সামনে শপথ দিয়ে এ ধরনের কার্যকলাপ না করার জন্য বলেছেন। তাই এই নিষেধাজ্ঞাকে ‘তাকিয়া’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।

সুতরাং শিয়াদের অন্তরে যদি সত্যিই আহলে বাইত ও হুসাইন রা.-এর মহব্বত থাকে তাহলে তাদের জন্য বাঞ্ছণীয়, হুসাইন রা.-এর শাহাদাতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিলাপ, বুক চাপড়ানো, মুখ খামচানো, কাপড় ছেঁড়া, কালো কাপড় পরিধান করা, হায়-হুতাশ করা ইত্যাদি গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকা এবং সুন্দর সবরের পরিচয় দেওয়া। এছাড়া হুসাইন রা. এবং আহলে বাইতের প্রতি ভালবাসার দাবি অসার। হ

 

 

advertisement