যিলকদ ১৪৪২   ||   জুন ২০২১

প্রদীপ থেকে প্রদীপ জ্বলে

হাসসান বিন ইমদাদ

আজকে আব্বু আমাকে দুটি কিতাব থেকে দুটি ঘটনা পড়তে দিলেন। ঘটনাদুটি অনেক সুন্দর। একটি হল, হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রাহ.-এর ঘটনা। আরেকটি ইমাম আবু ইউসুফ রাহ.-এর ঘটনা। ঘটনাদুটি আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। কারণ সেখানে শিক্ষা গ্রহণের অনেক কিছু আছে। চলো ঘটনাদুটি শুনি।

হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রাহ.। ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর শ্রদ্ধেয় উস্তায।

তিনি অনেক বড় আলেম ও ফকীহ। কিন্তু তিনি এমনিতেই এত বড় ফকীহ হয়ে যাননি। এজন্য তাকে বেশ মেহনত-পরিশ্রম করতে হয়েছে। তিনি উস্তাযের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। তা তাঁকে অনেক এগিয়ে নিয়েছে।

তাঁর উস্তায হযরত ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.; তিনি মনেপ্রাণে এই উস্তাযের খেদমত করতেন। তবে তার পিতা এটা পছন্দ করতেন না।

একদিন ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. হাম্মাদ রাহ.-কে একটি থলে ও এক দিরহাম দিয়ে বাজারে পাঠালেন। ঘটনাক্রমে পথে পিতার সাথে দেখা হয়ে গেল। তখন পিতা আবু সুলাইমান খুব রাগান্বিত হলেন। ব্যাগটি ছুড়ে মারলেন এবং খুব ধমকালেন। কিন্তু এরপরও হাম্মাদ তার উস্তাযের খেদমত এবং তার সাহচর্য গ্রহণে অটল থাকলেন।

তাঁর এই ত্যাগের বদৌলতে ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর  মৃত্যুর পর হাদীস ও ফিক্হ-অন্বেষী ছাত্ররা ভিড় জমাতে লাগল তাঁর দরজায়।

একদিন রাতে কিছু তালিবে ইলম কড়া নাড়ল আবু সুলাইমানের বাড়িতে। তখন আবু সুলাইমান মোমবাতি নিয়ে বের হলেন। আগত ছাত্ররা বলল, আমরা আপনাকে নয় আপনার ছেলেকে খুঁজছি। তখন তিনি হাম্মাদের কাছে গিয়ে বললেন, ওঠো, তাদের কাছে যাও, নিশ্চয় বাজারের থলে তোমাকে তাদের পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে।

এই হাম্মাদ রাহ.-এর ছাত্র হলেন, ইমামে আযম আবু হানীফা রাহ.। তিনিও তাঁর উস্তায হাম্মাদ রাহ.-এর একান্ত সাহচর্য গ্রহণ করেছিলেন। মনেপ্রাণে খেদমত করতেন উস্তাযের। খুব ছোট ছোট বিষয়েও খেদমত করার চেষ্টা করতেন। হাম্মাদ রাহ.-এর বোন বলেন, নোমান (আবু হানীফা) সর্বক্ষণ আমাদের ঘরের দরজায় পড়ে থাকতেন, আমাদের তুলা ধুনতেন, সবজী কিনতেন এছাড়াও অন্যান্য কাজ করে দিতেন।

কেউ এসে মাসআলা জিজ্ঞেস করলে তিনি উত্তর দিতেন ঠিকই, কিন্তু বলতেন, অপেক্ষা কর। এরপর ভিতরে গিয়ে হাম্মাদকে জিজ্ঞেস করতেন; তিনি যা বলতেন, ফিরে এসে আগত ব্যক্তিকে তা জানাতেন।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়; এ আবু হানীফা রাহ.-এর একান্ত ছাত্র ইমাম আবু ইউসুফ রাহ.। তিনি হানাফী মাযহাবের বড় তিন ইমামের একজন। তিনিও অনেক বড় আলেম ও ফকীহ ছিলেন এবং তৎকালীন সময়ে মুসলিম বিশে^র প্রধান কাযী (বিচারক) ছিলেন।

তাঁর ছাত্রজীবনে তাঁর পিতা খুবই দরিদ্র ছিলেন। পরিবারের জীবিকার জন্য তাকে বেশ হিমশিম খেতে হত। তাই তিনি ছেলেকে পড়াশোনা করাতে পারতেন না। তিনি চাইতেন, ছেলে কামাই-রোজগার করুক। কিন্তু বালক আবু ইউসুফ নাছোড়বান্দা। তিনি নিজেই বলেন, আমি খুব দরিদ্র হয়েও আবু হানীফা রাহ.-এর মজলিসে বসতাম। হাদীস-ফিক্হ অধ্যয়ন করতাম। একদিন আমি আবু হানীফার দরসে বসে আছি, হঠাৎ আমার পিতা আমাকে নিতে আসলেন। আমি দরস থেকে উঠে গেলাম। বাবা বললেন, হে ছেলে! তুমি আবু হানীফার মজলিসে পড়ে থেকো না, তার রুটি তো সর্বদা প্রস্তুত থাকে আর তুমি তো দরিদ্র; তোমার উপার্জন করে চলতে হবে। তখন আমি আমার পিতার কথাকে প্রধান্য দিলাম এবং পড়া-লেখার শত আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও চলে এলাম এবং কাজে লেগে গেলাম।

একদিন আবু হানীফা রাহ. আমাকে তাঁর মজলিসে খুঁজলেন এবং সাথীদের কাছে আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। আমি সঙ্গীদের থেকে নিয়মিত মজলিসের খোঁজ-খবর রাখতে থাকলাম।

কিছুদিন পর আমি যখন তাঁর মজলিসে গেলাম তিনি বললেন, তুমি কোথায় ছিলে, মজলিসে আস না কেন? আমি আমার পিতার আদেশের এবং আমার কামাই-রোজগারের প্রয়োজনের কথা বললাম। তিনি একটি থলে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, নাও এ দ্বারা তোমার প্রয়োজন পূরণ কর। এরপর আমি খুলে দেখি তাতে একশত দিরহাম রয়েছে। তারপর তিনি বললেন, প্রতিদিন মজলিসে উপস্থিত থাকবে আর এগুলো ফুরিয়ে গেলে জানাবে। তখন থেকে আমি তাঁর মজলিসে পড়ে থাকতাম।

কিছুদিন পর তিনি আরেকটি থলে দিলেন। এভাবে তিনি সর্বদা আমার খোঁজ রাখতেন। আমি কখনো তাঁকে মুদ্রা ফুরিয়ে যাওয়ার কথা জানাতাম না। তারপরও কীভাবে যেন তিনি জেনে যেতেন। এভাবে একপর্যায়ে আমি  সচ্ছল হয়ে গেলাম।

(দ্র. ফিকহু আহলিল ইরাক ওয়া হাদীসুহুম, ৪৭-৪৮; তারীখে বাগদাদ ২২/২২০)

তাহলে চলো বন্ধুরা! আজ থেকে আমরাও উস্তাযের খেদমত করতে চেষ্টা করি। ইলমের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করি। আমরাও চেষ্টা করি তাঁদের মতো হতে। হ

 

 

advertisement