যিলকদ ১৪৪২   ||   জুন ২০২১

নবীজীর হাদিয়া

ছাদিক আতফাল

সালমান, খালেদ, হাসান। একই ক্লাসের ছাত্র ওরা। মেধা-প্রতিভায় কেউ কারো কম নয়। পরীক্ষায় কে কার থেকে বেশি নাম্বার পাবেÑ এ নিয়েও বেশ প্রতিযোগিতা হয় ওদের মাঝে। বক্তৃতা-বিতর্ক, মেধা খাটাও কুইজ, সাধারণ জ্ঞানসহ যাবতীয় প্রতিযোগিতায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয় ওদের মাঝে। অবশ্য যোগ্যতার বিচারে সালমান খানিকটা এগিয়ে। কিন্তু পরীক্ষার নাম্বারে কেন যেন সে একটু পিছিয়ে থাকে।

পরীক্ষার বেশি বাকি নেই। সালমান গেল ইমাম সাহেব হুযুরের কাছে দুআ নিতে। হুযুর দুআ করে দিলেন। বললেন, ভালোভাবে প্রস্তুতি নিবে। আল্লাহর উপর ভরসা করে পরীক্ষা দেবে। আল্লাহ তোমাকে কামিয়াব করবেন। আর একটা আমল শিখিয়ে দিলেন; বললেন, আমলটা বেশি বেশি করবে।

আজ পরীক্ষা। অন্যবারের মতো সালমানকে আজ বসে বসে কলম চিবাতে হচ্ছে না। কোন্ প্রশ্ন আগে লিখবে, কীভাবে লেখা শুরু করবেÑ এ নিয়ে আজ তেমন ভাবনা নেই তার। বিসমিল্লাহ বলে লেখা শুরু করল সালমান। তরতর করে লিখে চলেছে সে। আজ যেন সে ভিন্ন কিছু অনুভব করছে।

তৃতীয় ঘণ্টার শেষ বেল পড়তেই সালমানের খাতা গোছানো শেষ। অন্য সময় শেষ মুহূর্তে এসে তার হাঁসফাস লেগে যেত। ছুটে যেত দুই-চার নাম্বারের উত্তর। আর তাতেই পিছিয়ে পড়ত সে।

পরীক্ষার ফলাফল দেখে তো সবাই হতবাক। এবার সালমান নাম্বারে সবাইকে ছাড়িয়ে।

আরে, সালমান এবার এত নাম্বার পেল কী করে! এর রহস্য কী? আমাদের তা বের করতেই হবে, বলল খালেদ। সবাই ঘিরে ধরল সালমানকে।

Ñবলো না সালমান, এবারের পরীক্ষায় তুমি কীভাবে এত ভালো করলে?

: না, তেমন কিছুই না। ভালো করে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম, এই আর কী! এটা ওটা বলে এড়িয়ে যেতে চাইল সালমান। কিন্তু খালেদ আর হাসান কি এতো সস্তায় ছেড়ে দেওয়ার! ঠেসে ধরল সালমানকে।

Ñঠিক ঠিক বলো সালমান! লুকোচুরি করে আজ পার পাবে না। প্রস্তুতি তো আমরাও নিয়েছি। কিন্তু তুমি এত বেশি নাম্বার পেলে কীভাবে, সেটা বলো। তা-ও কিনা এবারের পরীক্ষায়! এবার তো প্রশ্ন অনেক কঠিন এসেছে। বল আমাদের, এর রহস্যটা কী!

বাধ্য হয়ে সালমান মুখ খুললÑ

: দোস্ত! তোমরা ঠিকই ধরতে পেরেছ। এবার অন্য কিছু ঘটেছে। পরীক্ষার আগ দিয়ে আমি ইমাম সাহেব হুযুরের কাছে দুআ চাইতে গিয়েছিলাম। হুযুর আমাকে আমল শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তাআলা হয়ত সেই ওসিলায় এমন ভালো ফলাফল দান করেছেন।

Ñতাহলে বলো, কী সেই আমল? খালেদের জিজ্ঞাসা।

Ñআমরা সরাসরি হুযুরের কাছ থেকেই আমলটা শিখে নিই নাÑ বলল হাসান।

Ñসালমান! তাহলে আমাদেরকে হুযুরের কাছে নিয়ে চল। বলে তারা রওয়ানা হল মসজিদের দিকে।

আসরের পর। ইমাম সাহেব মসজিদের আঙিনায় পায়চারি করছেন। হাতে তাসবীহ। মুখে যিকির। হুযুরের সাথে সালাম-মুসাফাহার পর্ব সেরে নিয়ে আদবের সাথে জিজ্ঞাসা করল হাসানÑ হুযুর! আপনি সালমানকে কী আমল শিখিয়ে দিয়েছেন, ও এবার এত ভালো  করল?

: মানে? ইমাম সাহেব বুঝে উঠতে পারলেন না হাসানের কথা।

Ñহুযুর! আল্লাহর মেহেরবানী, আপনার শেখানো আমলে আমার পরীক্ষা এবার অনেক ভালো হয়েছে, আলহামদু লিল্লাহ! বলল সালমান।

: মাশাআল্লাহ। খুব ভালো খবর!

Ñখালেদ, হাসান সেই আমলটাই আপনার থেকে শিখতে এসেছে।

: ও আচ্ছা, সেই কথা!

আমি তো সালমানকে বিশেষ কোনো আমল শিখাইনি। আমি কেবল তাকে বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়তে বলেছি। কারণ, দরূদ শরীফের আমলের দ্বারা আল্লাহর রহমত লাভ হয়। আর কারো সাথে যদি আল্লাহর রহমত থাকে তার জন্য সবকিছু সহজ হয়ে যায়।

আল্লাহ পাকের রহমত লাভের একটি বড় মাধ্যম হচ্ছে দরূদ শরীফ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি কেউ দরূদ পাঠ করলে আল্লাহ পাক তার প্রতি অনেক খুশি হন। তখন সে আল্লাহ পাকের রহমতের পাত্র হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনÑ

مَنْ صَلّى عَلَيّ وَاحِدَةً صَلّى الله عَلَيْهِ عَشْرًا.

যে আমার প্রতি একবার দরূদ পাঠ করে আল্লাহ পাক তার প্রতি দশবার রহমত ও করুণা বর্ষণ করেন। Ñসহীহ মুসলিম, হাদীস ৪০৮

এছাড়াও দরূদের রয়েছে আরো অনেক ফযীলত। দরূদ পাঠের মাধ্যমে আমাদের গোনাহ মাফ হয় এবং যেসকল বিষয় নিয়ে আমরা খুব চিন্তা-পেরেশানীতে থাকি সেই পেরেশানী আল্লাহ দূর করে দেন। যেমন পরীক্ষা নিয়ে আমরা চিন্তিত থাকিÑ কেমন হবে পরীক্ষা? ফলাফল কেমন হবে? আমরা যদি বেশি বেশি দরূদ পড়ি তাহলে ইনশাআল্লাহ আল্লাহ আমাদের এ পেরেশানীও দূর করে দেবেন।

নবীজীর একজন সাহাবী ছিলেন হযরত উবাই ইবনে কাব রা.। তিনি দুআর মধ্যে বেশি বেশি দরূদ শরীফ পাঠ করতেন। এ সম্পর্কে একবার তিনি নবীজীকে জিজ্ঞাসা করলেনÑ ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার দুআর কতটুকু অংশ দরূদ পাঠ করব?... একপর্যায়ে সাহাবী বললেন, আমি আমার পুরো দুআতেই দরূদ পাঠ করব। তখন নবীজী বললেনÑ

إِذًا تُكْفَى هَمّكَ، وَيُغْفَرُ لَكَ ذَنْبُكَ.

তাহলে তো তোমার চিন্তা-পেরেশানী দূর হবে এবং গোনাহ মাফ হবে। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৭

তাই আমরাও যদি বেশি বেশি দরূদ শরীফ পাঠ করি আল্লাহ তাআলা আমাদেরও চিন্তা-পেরেশানী দূর করে দেবেন। রহমত দান করবেন। তখন কাজ সহজ হয়ে যাবে।

তো আমি সালমানকে সে কথাই বলেছিলামÑ ভালোভাবে প্রস্তুতি নেবে আর বেশি বেশি দরূদ শরীফের আমল করবে।

Ñহুযুর! জাযাকাল্লাহু খাইরান। আমাদেরকে সুন্দর একটি আমল বলে  দেওয়ার জন্যে। দয়া করে কি আমাদেরকে শিখিয়ে দেবেনÑ কোন্ দরূদ শরীফটা পড়ব, বলল খালেদ।

হাসান বলল, আমলের পদ্ধতিটাও যদি বলে দিতেন!

: তোমরা হয়ত ভাবছ, এটা বড় কোনো আমল বা এর জন্য বিশাল আয়োজন করতে হয়!

Ñহুযুর! যত আয়োজন করতে হয় হোক; আমরা প্রস্তুত।

: না না, দরূদ শরীফের আমল খুবই সহজ একটি আমল। তবে এর ফায়দা অনেক। আমরা নামাযের শেষ বৈঠকে যে দরূদ পড়ি একে বলা হয় দরূদে ইবরাহীমী। এ দরূদটিই আমরা পড়তে পারি। এটা তো সবারই মুখস্থ আছে, তাই না! সালমান শোনাও তো দেখি দরূদ শরীফটা!

সালমান শোনাতে আরম্ভ করল :

اللّهُمّ صَلِّ عَلَى مُحَمّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمّدٍ، كَمَا صَلّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ، إِنّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللّهُمّ بَارِكْ عَلَى مُحَمّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمّدٍ، كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ، وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنّكَ حَمِيدٌ مَجِيد.

: মাশাআল্লাহ, সালমান দেখি খুব সহীহ-শুদ্ধভাবে দরূদ শিখেছে।

শোনো, সাহাবায়ে কেরামের নিকট এ দরূদের বিশেষ মর্যাদা ছিল। নবীজীর একজন সাহাবী ছিলেন হযরত কাব ইবনে উজরাহ রা.। তার সাথে সাক্ষাৎ হল আবদুর রহমান ইবনে আবী লাইলা রাহ.-এর। তিনি ছিলেন অনেক বড় তাবেয়ী। তখন হযরত কাব রা. হযরত আবদুর রহমান ইবনে আবী লাইলাকে বললেন, আমি কি তোমাকে একটি হাদিয়া দেব, যে হাদিয়া নবীজী আমাকে দিয়েছেন? এ শুনে তো তিনি খুশিতে বাগবাগ। নবীজী থেকে প্রাপ্ত হাদিয়া কে আবার হাতছাড়া করতে চায়! বললেন, অবশ্যই অবশ্যই। আমি সে হাদিয়ার জন্য কোরবান!

হযরত কাব রা. বললেন, আমরা একবার নবীজীর নিকট জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনাকে তো সালাম নিবেদন করি। কিন্তু আপনার প্রতি দরূদ পেশ করতে পারি কীভাবে? তখন নবীজী বললেন, তোমরা এই দরূদ পড়Ñ

اللّهُمّ صَلِّ عَلَى مُحَمّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمّدٍ، كَمَا...

(সালমান মাত্র যে দরূদ শোনাল।) (দ্রষ্টব্য : সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৭৭০)

Ñআলহামদু লিল্লাহ, হুযুর! আমরা তো সবাই এ দরূদ পারি। আমরাও আজ আপনার কাছ থেকে নবীজীর হাদিয়ালাভ করলাম। আপনাকে অনেক অনেক শুকরিয়া।

এটা কখন কীভাবে পড়তে হবে? জিজ্ঞাসা করল হাসান।

: যখন যত পার পড়তে থাক। যত পড়বে তত লাভ।

শুধু এটি নয়; হাদীস শরীফে আরো অনেক দরূদ বর্ণিত হয়েছে। আমরা সেগুলোও মুখস্থ করতে পারি।

Ñহুযুর! আমাদেরকে ছোট কোনো দরূদ শিখিয়ে দেবেন! তাহলে সবসময় পড়তে পারব।

: হাঁ, আমরা নবীজীর নাম বললে বা শুনলে সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলি কিংবা বলি, আলাইহিস সালাতু ওয়াস সালামÑ এটাও দরূদ। এটা পড়লেও দরূদ পড়া হয়।

সালমান, খালেদ, হাসান সমস্বরে বলে উঠল, হুযুর দুআ করবেন, এখন থেকে অবশ্যই আমরা বেশি বেশি দরূদ শরীফ পড়ব, ইনশাআল্লাহ।

হুযুর বললেন, আল্লাহ আমাকে, তোমাদেরকে এবং সবাইকে নবীজীর শানে বেশি বেশি দরূদ পাঠ করার তাওফীক দান করুনÑ আমীন। হ

 

 

advertisement