মুহাররম ১৪৩৯   ||   অক্টোবর ২০১৭

রোহিঙ্গা মজলুমানের মিছিল

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

বাংলাদেশ অভিমুখে আবারো শুরু হয়েছে মজলুম মুসলমানের ঢল। বাস্তুহারা, স্বজনহারা এই মজলুমানের মিছিলে রয়েছে হাজার হাজার নারী শিশু বৃদ্ধ। শত শত এতিম-বিধবার কথা চিন্তা করলেই বুক কেঁপে উঠছে। এরা শুধু প্রাণটি হাতের মুঠোয় নিয়ে ছুটে আসছে বাংলাদেশের দিকে। মিয়ানমারের মুসলমানদের বিরুদ্ধে এই জাতিগত নির্মূল অভিযান ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায় হয়ে থাকবে। এই ঘটনায় চিন্তা ও উপলব্ধির অনেক বিষয় আছে।

এক।

প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর এই অব্যাহত নিপীড়নের কারণ কী? বলাই বাহুল্য যে, এর প্রধান কারণ, এরা মুসলিম। মিয়ানমারের বৌদ্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কোনোভাবেই এদের বরদাশত করতে রাজি নয়। অল্প কিছু হিন্দুরও নির্যাতনের শিকার হবার কথা শোনা গেলেও ব্যাপক নির্যাতন মুসলমানদের উপরই হচ্ছে। লক্ষ করার বিষয় হচ্ছে, বিশেষ কোনো শ্রেণি-পেশার মুসলমান নয়, ব্যাপকভাবে সকল শ্রেণীর মুসলমানই নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এদের মধ্যে  যেমন আছেন হাফিয, আলিম ও দ্বীনদার মানুষ, তেমনি আছেন সাধারণ মুসলমান। শ্মশ্রুমণ্ডিত ইসলামী বেশভুষার লোকেরা যেমন আছেন তেমনি আছেন শ্মশ্রুহীন মুসলমান। বোরকাহীন নারী যেমন আছেন তেমনি আছেন বিপুল সংখ্যক বোরকা ও হিজাবাবৃত নারী। এককথায় সর্বস্তরের  ও সর্বশ্রেণির মুসলিম নর-নারী এই জুলুম-অত্যাচারের শিকার।

এখান থেকে এই বাস্তবতা আবারো প্রমাণ হল যে, অমুসলিমেরা যখন সাম্প্রদায়িক জিঘাংসা চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়ে যায় তখন তারা মুসলমানদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করে না। কার দাড়ি-টুপি আছে, আর কার নেই, কে মক্তব-মাদরাসায় পড়ছে, আর কে কলেজ-ভার্সিটিতে, কে জঙ্গিবাদী’ ‘মৌলবাদীমুসলমান আর কে মডার্ন-প্রগতিশীলমুসলিম-এসবের কোনো তোয়াক্কাই তারা তখন করে না। রোহিঙ্গা মুসলিমদের মিছিলের উপর নজর বুলিয়ে দেখুন, এই সত্য দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট দেখা যাবে। তাহলে আমরা মুসলিমেরা যে নিজেদের নানা পরিচয়ে বিভক্ত করে একে অপরের শত্রু হয়ে বসে আছি, তা কি বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে? এ যে কত বড় আত্মঘাতী নির্বুদ্ধিতা এই সব দৃষ্টান্তের  পরও কি তা আমাদের বুঝতে দেরি হওয়া উচিত।

যে দৃশ্য আজ আমরা মিয়ানমারে দেখছি এই একই দৃশ্য কি দেখা যায়নি উন্দুলুস ও বাগদাদে? বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায়? ইরাকে ও কাশ্মীরে? দূর অতীত থেকে নিকট অতীত এবং নিকট অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ দৃশ্যই তো বারবার দেখা যাচ্ছে। অমুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই মুসলমানদের উপর নির্বিচারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ইতিপূর্বে যে সকল মুসলিম অশিক্ষা-কুশিক্ষার কারণে  কিংবা ভীরুতা-হীনম্মন্যতার কারণে অমুসলিমদের মিত্রতায় আস্থা রেখেছিল তারাও জুলুম-অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি। ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি থেকে শিক্ষা নেওয়া অতি প্রয়োজন নয় কি?

কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা কত স্পষ্ট ভাষায় হুঁশিয়ার করেছেন এবং বিধান দান করেছেন-

لَا یَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُوْنَ الْكٰفِرِیْنَ اَوْلِیَآءَ مِنْ دُوْنِ الْمُؤْمِنِیْنَ  وَ مَنْ یَّفْعَلْ ذٰلِكَ فَلَیْسَ مِنَ اللهِ فِیْ شَیْءٍ اِلَّاۤ اَنْ تَتَّقُوْا مِنْهُمْ تُقٰىةً  وَ یُحَذِّرُكُمُ اللهُ نَفْسَهٗ  وَ اِلَی اللهِ الْمَصِیْرُ.

মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ছাড়া কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এইরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে হাঁ, তাদের নিকট থেকে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন ব্যতিক্রম। আর আল্লাহ তার নিজের সম্বন্ধে তোমাদের সাবধান করছেন এবং আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তন। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ২৮

এখন অতি প্রয়োজন সর্বস্তরের ও সর্বশ্রেণির মুসলিমের পরস্পর কাছাকাছি হওয়া এবং দ্বীনের সূত্রে একতাবদ্ধ হওয়া। পারলৌকিক জীবনের তো বটেই, পার্থিব জীবনেরও এটা এক বাস্তব প্রয়োজন, যে প্রয়োজনের নির্দেশনাই সত্য দ্বীন আমাদের দান করেছে।

দুই।

একতাবদ্ধ হওয়া মানে কোনো দল বা সংগঠনে শামিল হয়ে যাওয়া নয়। একতাবদ্ধ হওয়া মানে সকল মুসলিম আল্লাহপ্রদত্ত দ্বীনের অনুসারী হয়ে যাওয়া, তাওহীদ ও সুন্নাহকে অবলম্বন করা, শিরক ও বিদআত বর্জন করা, ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক জীবনে আল্লাহর হুকুম-আহকামের ফরমাবরদার হয়ে যাওয়া এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহমর্মী হওয়া ইত্যাদি। এই সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত দিয়ে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسّهَرِ وَالْحُمّى.

পরস্পর প্রীতি, মমতা ও হৃদ্যতায় মুমিনগণ যেন এক দেহ। এর এক অঙ্গে ব্যথা হলে গোটা দেহ জ¦র ও নিদ্রাহীনতার দ্বারা তার সমব্যথী হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৬

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِي حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللّهُ فِي حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً، فَرّجَ اللّهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ القِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللّهُ يَوْمَ القِيَامَةِ.

মুসলিম মুসলিমের ভাই। সে তার উপর জুলুম করে না এবং (জুলুমের মুখে) সমর্পণও করে না। আর যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে ব্যস্ত থাকে (স্বয়ং) আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে রত থাকেন। যে কোনো মুসলিমের একটি দুঃখ দূর করবে আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের একটি বিপদ মোচন করবেন। আর যে কোনো মুসলিমের দোষত্রুটি গোপন রাখবে কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪২; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮০

বাইরের প্ররোচনায় এখন তো মুসলিম সমাজের ভেতরেই এমন একটি শ্রেণি সৃষ্টি হয়েছে, যারা অমুসলিমের প্রতি উষ্ণ আর মুসলিমের প্রতি শীতল। আল্লাহ মাফ করুন, যেন মুসলিম পরিচয়টিই ঐশ্রেণির লোকের মনে আজ জাগিয়ে তুলছে অবজ্ঞা ও অবহেলা! মুসলিম নামধারী কারো জন্য এর চেয়ে বড় হীনতা ও দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে!

রোহিঙ্গা মুসলিমদের দিয়েই বিচার করুন, এই চরম ও ব্যাপক নির্যাতন অন্য কোনো জাতির বেলায় ঘটলে চিন্তা করা যায়, আঞ্চলিক ও বিশ্ব মিডিয়ায় এর কভারেজ কেমন হত। সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়গুলোর যুক্তি-তর্ক কত শানিত ও ক্ষুরধার হত, ভাষা ও উপস্থাপনা কত আবেগঘন হত। বাইরের মিডিয়া তো বটেই, আমাদের এই মুসলিমসমাজের মিডিয়াসমূহেরও ক্ষোভ ও আবেগ কোথায় গিয়ে পৌঁছত! কিন্তু  মিয়ানমারের নির্যাতিত মানুষগুলো শুধু মুসলিম হওয়ার কারণে মিডিয়ায় যা কিছু সংবাদ ও সংবাদ-বিশ্লেষণ আসছে, অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাতে শুধু অবসাদগ্রস্ততাই নয়, নানা তীর্যক ও অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারের অবতারণাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এসবের সাথে আছে রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রতি নানাভাবে বিরক্তি ও অবজ্ঞার প্রকাশ, যেন রোহিঙ্গা মানেই নিম্নশ্রেণির একটি জনগোষ্ঠী। নাউযু বিল্লাহ।

এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে, এই জনগোষ্ঠীটি দশকের পর দশক সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, স্বদেশে তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতিটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই সব কিছুর পরও বাংলাদেশ অভিমুখে  এখন রোহিঙ্গা মুসলিমদের যে মিছিল তা যারা দেখেছেন তাদের বুঝতে বাকি থাকেনি যে, এই মিছিলে রয়েছেন অনেক ভদ্র ঘরের নারী-পুরুষ। নারীদের অনেকেই বোরকাবৃতা। পায়ে জুতো নেই, কিন্তু হিজাব-নিকাব আছে। অনেক শিশুর পোষাক পরিচ্ছদ দেখেই বোঝা যায়, এরা সচ্ছল ও সম্ভ্রান্ত মা-বাবার সন্তান। কাজেই এই মজলুম জনগোষ্ঠীর প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলা নয়; এদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও সহানুভূতিশীল হওয়া যেমন ঈমানের দাবি, তেমনি বাস্তবতা ও মানবতারও দাবি। এই মানুষগুলো বর্তমান বর্ণবাদী বিশ্বসভ্যতার নির্মম শিকার। যে কোনো মুসলিম ভূখণ্ডের অধিবাসী যে কোনো সময় এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে যেতে পারে।

তিন।

মুসলিম উম্মাহর বর্তমান মাজলুমিয়্যাত থেকে আরো একটি বিষয়ে সচেতনতা অর্জন করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে, এই উম্মাহ একটি দাওয়াতী উম্মাহ। এই উম্মাহকে সৃষ্টিই করা হয়েছে সত্য দ্বীনের প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য। এই দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত থাকাই এর স্থিতি ও নিরাপত্তার জামিন। হয় এই উম্মাহ তার চারপাশকে আদর্শের আলোয় আলোকিত করবে নয়তো সাম্প্রদায়িকতা ও বর্বরতার অশুভ বিস্তার তাকেও গ্রাস করবে। কুরআন মাজীদের ইরশাদ-

كُنْتُمْ خَیْرَ اُمَّةٍ اُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَاْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَ تَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَ تُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ  وَ لَوْ اٰمَنَ اَهْلُ الْكِتٰبِ لَكَانَ خَیْرًا لَّهُمْ  مِنْهُمُ الْمُؤْمِنُوْنَ وَ اَكْثَرُهُمُ الْفٰسِقُوْنَ لَنْ یَّضُرُّوْكُمْ اِلَّاۤ اَذًی  وَ اِنْ یُّقَاتِلُوْكُمْ یُوَلُّوْكُمُ الْاَدْبَارَ  ثُمَّ لَا یُنْصَرُوْنَ.

 তোমরাই শ্রেষ্ঠ উম্মত, মানবজাতির জন্য তোমাদের আবির্ভাব। তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে, অসৎকাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখবে। কিতাবীগণ যদি ঈমান আনত তবে তা তাদের জন্য ভালো হত। তাদের কিছু সংখ্যক মুমিন আর অধিকাংশই সত্যত্যাগী। সামান্য ক্লেশ দেয়া ছাড়া ওরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। যদি ওরা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। অতপর ওরা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১১০-১১১

বিষয়টির এক গভীর উপমা হাদীস শরীফে রয়েছে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

مَثَلُ القَائِمِ عَلَى حُدُودِ اللّهِ وَالوَاقِعِ فِيهَا، كَمَثَلِ قَوْمٍ اسْتَهَمُوا عَلَى سَفِينَةٍ، فَأَصَابَ بَعْضُهُمْ أَعْلاَهَا وَبَعْضُهُمْ أَسْفَلَهَا، فَكَانَ الّذِينَ فِي أَسْفَلِهَا إِذَا اسْتَقَوْا مِنَ المَاءِ مَرّوا عَلَى مَنْ فَوْقَهُمْ، فَقَالُوا: لَوْ أَنّا خَرَقْنَا فِي نَصِيبِنَا خَرْقًا وَلَمْ نُؤْذِ مَنْ فَوْقَنَا، فَإِنْ يَتْرُكُوهُمْ وَمَا أَرَادُوا هَلَكُوا جَمِيعًا، وَإِنْ أَخَذُوا عَلَى أَيْدِيهِمْ نَجَوْا، وَنَجَوْا جَمِيعًا.

অর্থাৎ আল্লাহর সীমারেখা রক্ষাকারী ও তা লঙ্ঘনকারীর দৃষ্টান্ত হল, যেন এক কিশতীর কিছু আরোহী, যারা লটারির মাধ্যমে উপরে-নীচে ভাগ হয়ে অবস্থান করছে। নীচের তলায় অবস্থানকারীদের পানির জন্য ওপরের তলার লোকদের ওখানে যেতে হয়। তো এরা চিন্তা করল যে, আমরা যদি নীচে আমাদের অংশে একটি ছিদ্র করে নেই তাহলে (এখানেই পানি পাওয়া যাবে) ওপরের লোকদের বিরক্ত করতে হবে না। এখন (ওপরের লোকেরা) এদের বাধা না দিলে সকলেরই সলিল সমাধি ঘটবে আর বাধা দিলে সকলের প্রাণ বাঁচবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৯৩

আজ প্রত্যেক ভূখণ্ডের মুসলমানদের ভেবে দেখা উচিত যে, জীবন ও জগতের এই বিপদসংকুল ঝঞ্ঝাবিক্ষুদ্ধ সমুদ্রে আমরা যে কিশতীতে সওয়ার, তাতে আমাদের সহযাত্রীদের বোধ ও বিশ্বাস কী? চেতনা ও প্রবণতা কী? তারা যদি আমাদের সতীর্থনা হয়ে প্রতিপক্ষহয় তাহলে নিরাপদে এ সাগর পাড়ি দেয়া এবং মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছানো আমাদের সম্ভব হবে কি?

বিষয়টি শুধুই পার্থিব বিষয় নয়, পার্থিব ও পারলৌকিক বিষয়। মুসলিম উম্মাহ তার দাওয়াতী দায়িত্ব পালন করলে নিজেরাও যেমন অর্জন করবে দুনিয়া-আখিরাতের সফলতা ও নিরাপত্তা তেমনি নিশ্চিত হবে গোটা মানবতার শান্তি ও কল্যাণও।

চার।

ইসলামী দাওয়াত বিশেষ একটি বা দুটি কাজ কিংবা একটি বা দুটি কাজের একটি বা দুটি পন্থার নাম নয়। দাওয়াতী কর্মের তালিকা অনেক দীর্ঘ। অতপর ঐ কর্মসমূহ  সম্পাদনের পন্থা ও পদ্ধতিও দু-চারটি নয়। এই বিপুল কর্ম ও বিচিত্র কর্ম-পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা অর্জন করা অতি প্রয়োজন। একইসাথে দায়ীর সাধ্য ও সক্ষমতা এবং স্থান-কাল-পাত্র সম্পর্কে সঠিক উপলদ্ধিও সবিশেষ প্রয়োজন। এরপর এই সব  কিছুর নিরিখে উপযুক্ত কর্ম ও কর্মপদ্ধতি নির্ণয়  দাওয়াতী প্রজ্ঞা ও বসীরতেরই এক অতীব গুরুত্বপূর্ণ দিক।

মুশরিক-মুনাফিকদের দ্বারা মাগলুব ও মাকহূর অবস্থার কর্ম ও কর্মপদ্ধতি আর শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারী অবস্থার কর্ম ও কর্মপদ্ধতি সম্পূর্ণ এক হওয়া জরুরি নয়। প্রত্যেক অবস্থার করণীয় সঠিকভাবে সম্পন্ন করার দ্বারাই অবস্থার উন্নতি ঘটে এবং দাওয়াতের নতুন ও পরবর্তী ক্ষেত্র তৈরি হয়। ধৈর্য্য ও প্রজ্ঞার সাথে সময়ের কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পন্ন করার এবং দাওয়াতী পর্যায়ক্রম অনুসরণের আসলে কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত এবং দাওয়াহ সংক্রান্ত শরয়ী নীতি ও বিধানে এ বিষয়টি খুব স্পষ্টভাবে রয়েছে।

দাওয়াতের সাফল্য ও অগ্রগামিতার ক্ষেত্রে  যেমন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শরয়ী বিধি-বিধান সম্পর্কে পূর্ণ বসীরত তেমনি প্রয়োজন চারপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি ও শত্রুর কূটকৌশল সম্পর্কেও পূর্ণ সতর্কতা। আর উদ্ভূত প্রতিটি পরিস্থিতিকে দাওয়াতের স্বার্থে কাজে লাগানোর যোগ্যতা ও দক্ষতা।

রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর যে প্রকাশ্য নিপীড়ন এর সূত্রপাত ঘটানো হয়েছে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটাকে ছূতা বানিয়ে। গত বারের নির্যাতনের সূত্রপাতও ঘটেছিল এই রকমের একটি ঘটনার অজুহাতে। এই সামান্য অজুহাতকে পুঁজি করে মিয়ানমারের মগ সেনাবাহিনী আরাকান রাজ্যকে মুসলিমশূন্য করার মিশন বাস্তবায়িত করে চলেছে। এ যে চরম অন্যায়, একের অপরাধে সকলকে শাস্তি দেয়া যে স্পষ্ট জুলুম, এই সহজ কথাটিও যেন বর্তমান সভ্যজগৎ বিস্মৃত হয়েছে। আমরা যারা মুসলিম, যারা কুরআনের এই আয়াত বারবার তিলাওয়াত করে থাকি-

وَ لَا تَكْسِبُ كُلُّ نَفْسٍ اِلَّا عَلَیْهَا  وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی

প্রত্যেকে স্বীয় কৃতকর্মের জন্য দায়ী এবং কেউ অন্য কারো ভার গ্রহণ করবে না। -সূরা আনআম (৬) : ১৬৪

অন্তত তাদের তো এই কুরআনী নীতি বর্তমান সভ্যজগতের কর্ণগোচর করা কর্তব্য। অমুসলিম জাতি-গোষ্ঠীকে এই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন করার দায়িত্বও মুসলমানদেরই নিতে হবে যে, ইনসাফের এই নীতি শুধু ইসলামের নয়, পূর্ববর্তী নবীগণের শরীয়তেরও অংশ ছিল।

اَمْ لَمْ یُنَبَّاْ بِمَا فِیْ صُحُفِ مُوْسٰی وَ اِبْرٰهِیْمَ الَّذِیْ وَفّٰۤی اَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی وَ اَنْ لَّیْسَ لِلْاِنْسَانِ اِلَّا مَا سَعٰی.

তাকে কি অবগত করা হয়নি ঐ বিষয়ে যা আছে মূসার সহীফাসমূহে এবং ইবরাহীমেরও, যিনি পালন করেছিলেন তার দায়িত্ব? তা এই যে, কোনো বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। এবং এই যে, মানুষ তা-ই পাবে যা সে করবে...। -সূরা নাজম (৫৩) : ৩৬-৩৯

মুসনাদে আহমাদ, সুনানে আবু দাউদ ও সহীহ ইবনে হিব্বানসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে সহীহ সনদে আবু রিমছা রা.-এর এই ঘটনা বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি আমার বাবার সাথে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলাম। একপর্যায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাবাকে বললেন- ابنك هذا؟ এ কি তোমার পুত্র? বাবা বললেন- إي ورب الكعبةজী কাবার রবের কসম!নবীজী বললেন- حقًَا সত্যি!বাবা বললেন- أشهد بهআমি এর সাক্ষ্য দিচ্ছি।নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার বাবার মাঝে আমার সাদৃশ্য ও আমার ব্যাপারে বাবার কসম খাওয়া দেখে মুচকি হাসলেন এরপর বললেন-

أَمَا إِنّهُ لَا يَجْنِي عَلَيْكَ، وَلَا تَجْنِي عَلَيْهِ

(এবার তাহলে) শোনো তার অপরাধের দায় তোমার উপর আসবে না আর তোমার অপরাধের দায়ও তার উপর যাবে না।এরপর এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন-

وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى.

-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭১০৯; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২০৬; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস ৫৯৯৫

আল্লামা সিন্দী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় লিখেছেন যে, এর দ্বারা জাহেলী যুগে বাবার অপরাধের দায় সন্তানের উপর আর সন্তানের অপরাধের দায় বাবার উপর আসার যে প্রথা ছিল তা খণ্ডন করা হয়েছে। (দ্র. টীকা, মুসনাদে আহমাদ, তাহকীক শায়েখ শুয়াইব আরনাউত ১১/৬৮১

তো ইনসাফের এই নীতি আমরা জগদ্বাসীকে স্মরণ করিয়ে দিব। আমাদের না বলার তো কোনো কারণ নেই। অতীত ও বর্তমানে ইনসাফের এই নীতি আমরাই তো সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করেছি।

হিজরী দ্বিতীয় শতকের ঘটনা। ইসলাম তখন বিশ্বশক্তি। লেবানন অঞ্চলে একটি ঘটনা এই ঘটল যে, লেবাননের প্রশাসক আলী ইবনে আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে কিছু লেবাননী অমুসলিম বিদ্রোহ করল এবং নানা অরাজকতা আরম্ভ করল। তিনি এদের শক্তহাতে দমন করলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, এই গোটা গোষ্ঠীটিকে লেবানন থেকে সরিয়ে অন্যান্য অঞ্চলে বিক্ষিপ্ত করে দিবেন। ঐ সময় শাম অঞ্চলের ফকীহ ও মুজতাহিদ ছিলেন ইমাম আওযায়ী রাহ.। তিনি লেবাননের প্রশাসকের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে যে পত্র লিখেছিলেন তা ইমাম কাসিম ইবনে সাল্লাম রাহ. কিতাবুল আমওয়ালগ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। পত্রটির অনুবাদ নিম্নরূপ :

বিদ্রোহীদের সাথে সংশ্রবহীন সাধারণ লুবনানী আহলে যিম্মা (অমুসলিমদের) বহিষ্কারের বিষয়টি আমি জানতে পেরেছি। বিশেষ কিছু লোকের অপরাধে সকলকে শাস্তি দেওয়া এবং সকলকে দেশান্তরিত করা কীভাবে ন্যায়সঙ্গত হবে, যখন আল্লাহর বিধান হল-

اَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزْرَ اُخْرٰی.

(... কোনো বহনকারী অন্য কারো ভার বহন করবে না।)

এই বিধানই পালন করা উচিত এবং এরই কাছে থেমে যাওয়া কর্তব্য। এরপর যে আদেশ স্মরণ রাখা ও প্রতিপালিত হওয়ার সর্বাধিক হকদার তা আল্লাহর রাসূলের এই আদেশ-

أَلَا مَنْ ظَلَمَ مُعَاهِدًا، أَوِ انْتَقَصَهُ، أَوْ كَلّفَهُ فَوْقَ طَاقَتِهِ، أَوْ أَخَذَ مِنْهُ شَيْئًا بِغَيْرِ طِيبِ نَفْسٍ، فَأَنَا حَجِيجُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.

সাবধান! যে কোনো মুআহাদের উপর যুলুম করবে বা তার মর্যাদাহানী করবে, কিংবা সাধ্যের অধিক ভার আরোপ করবে অথবা তার আন্তরিক সম্মতি ছাড়া তার কোনো কিছু কবজা করবে আমি কিয়ামতের দিন তার বিরুদ্ধে ফরিয়াদী হব।

(সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩০৫২; সুনানে কুবরা, বায়হাকী, হাদীস ১৮৭৩১)

ইমাম আওযায়ী রাহ.-এর এই চিঠি পাওয়ার পর লেবাননের প্রশাসক তার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেন। -কিতাবুল আমওয়াল, কাসিম ইবনে সাল্লাম, বর্ণনা নং ৪৬৭

আজ দেশে দেশে, বিশেষত মুসলিম জনপদগুলোতে সভ্যতার দাবিদার জাতি-গোষ্ঠী কর্তৃক এই ইনসাফের নীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। অমুসলিমদের প্রতিও ইসলামের ন্যায় ও উদারতার যে ইতিহাস তার সাথে সর্বস্তরের মুসলমানের পরিচয় ঘটাতে হবে যাতে শত্রুর প্রচারণায় নিজেদের বাস্তব ইতিহাস ভুলে নিজেদের মাঝে বিভেদ-বিভক্তির শিকার না হয়। একই সাথে নিজেদের প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কেও গভীর বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা ও ইত্তিবায়ে শরীয়তের পরিচয় দিতে হবে।

এ দিকটিও শান্ত মনে ভেবে দেখার মতো। নাহি আনিল মুনকারের এমন কোনো পদক্ষেপ ইসলামী বিধানেও সমীচীন নয়, যার কারণে মুসলমানদের উপর  ব্যাপক জুলুম-অত্যাচার নেমে আসে এবং বিদ্যমান দাওয়াতী কর্মগুলোও স্থবির হয়ে পড়ে এবং যার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ তাদের মিশন বাস্তবায়নের সুযোগ পেয়ে যায়। এই সামগ্রিক ক্ষতিকে রোধ করার সক্ষমতা ছাড়া শুধু একটি বা দুটি বিচ্ছিন্ন পদক্ষেপের সক্ষমতা, বাস্তবতার নিরিখে সক্ষমতা বলে গণ্য হয় না। কাজেই দাওয়াতের ক্ষেত্রে পরিবেশ-পরিস্থিতি, সাধ্য ও সক্ষমতা এবং পরিণাম ও প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় রেখে অগ্রসর হওয়াই দাওয়াহ ও উম্মাহ উভয়ের জন্য কল্যাণকর।

তবে হাঁ, এর দ্বারা শত্রুর মিথ্যা প্রপাগান্ডা সম্পূর্ণ বন্ধ হবে এমন নয়, ওদের নির্জলা মিথ্যা থেকে আমরা বাঁচতে পারব না ঠিক, তবে এজাতীয় মিথ্যার প্রভাব অন্যদের উপর যেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না তেমনি এর জবাবও অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।

পাঁচ।

মূল বিষয়ে ফিরে আসি। হাজার হাজার বাস্তুহারা মুসলিম এখন বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের পাশে দাঁড়ানো এদেশের মুসলিমদের ঈমানী দায়িত্ব। এখন যেমন দরকার তাৎক্ষণিক অতি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা, তেমনি দরকার কিছু দীর্ঘমেয়াদী ব্যবস্থাও। আর এতে সরকার ও জনতা পরস্পর প্রতিপক্ষ না হয়ে একে অপরের সহযোগী হওয়া কাম্য। সরকারের পক্ষে যে পর্যায়ের সহযোগিতা সম্ভব, সাধারণ জনগণের দ্বারা তা সম্ভব নয়। আবার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের দ্বারা যা হতে পারে একা সরকারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনের আশু প্রয়োজনগুলোর মধ্যে রয়েছে তাদের ইজ্জত-আব্রুর নিরাপত্তা, মাথা গোঁজার ঠাঁই এবং অন্ন-বস্ত্র ও চিকিৎসার মতো অতি প্রয়োজনীয় বিষয়াদি। সাধারণ মুসলিম জনতার গভীর সহমর্মিতা তো সব সময়ই ছিল এবার সরকারের পক্ষ হতেও কিছুটা নমনীয় অবস্থানের কারণে জনগণের তরফ থেকে নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পৌঁছাবার আকুতি বেশ স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে। মসজিদে মসজিদে ইমাম ও খতীব ছাহেবান উল্লেখযোগ্য খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন ও দিচ্ছেন। মুসল্লীগণও ব্যাপকভাবে সাড়া দিয়েছেন। এটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমাদের দ্বীন তো মানবতার ও সহমর্মিতার সর্বোত্তম শিক্ষা দান করেছে। শুধু শিক্ষাই নয়, আমাদের বাস্তব ইতিহাস মানবতার এমন সব দৃষ্টান্তে সমুজ্জ্বল, যার নজির আজও পর্যন্ত কোনো জাতির পক্ষে পেশ করা সম্ভব হয়নি।

একবার মদিনায় একটি ব্যবসায়ী কাফেলা এল। কাফেলাটিতে কিছু নারী ও শিশু ছিল। ব্যবসার সামগ্রী তো ছিলই। তো হযরত ওমর রা. আব্দুর রহমান ইবনে আওফ রা.-কে বললেন, আপনি কি আজ রাতে এদের পাহারাদারি করতে রাজি? তিনি রাজি হলেন। এবার দুজনে এই ব্যবসায়ী দলটির পাহারাদারিতে নিয়োজিত হলেন।

এখানে একটু কথা বলে নেই। এই দুইজন সাহাবীকে তো আমরা সম্ভবত চিনি। প্রথম জন হলেন আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রা., যার নাম শুনলেও রোম ও পারস্যের সেনাপতিদের হৃদকম্পন শুরু হত। আর দ্বিতীয় জন হলেন ঐ মহান সাহাবী যিনি ছিলেন ঐ ছয় সদস্য বিশিষ্ট মজলিসে শূরার প্রধান, যাদের উপর আমীরুল মুমিনীন ওমর রা. তার পরবর্তী খলীফা নির্বাচনের গুরুভার অর্পণ করেছিলেন।

 তো এই দুইজন দীর্ঘ রাত পর্যন্ত নামায পড়লেন। গভীর রাতে ওমর রা. এক শিশুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে আগ্রসর হলেন এবং শিশুটির মাকে বললেন, আল্লাহকে ভয় কর এবং নিজ সন্তানের সাথে সদাচার কর। কিছুক্ষণ পর আবারো কান্নার আওয়াজ শুনে আবারো গিয়ে সতর্ক করলেন। রাতের শেষভাগে আবারো শিশুটির কান্না শুনে ওমর রা. ঐ মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, তুমি তো এক অপদার্থ মা। বারবার দেখছি রাতে শিশুটি স্থির হয়ে ঘুমাচ্ছে না। কী ব্যাপার? শিশুর মা ওমর রা.-কে চিনতেন না। তিনি বলে উঠলেন, ওহে আল্লাহর বান্দা! তুমি রাতভর আমাকে ভারি বিরক্ত করেছ! আমি এর দুধ ছাড়াচ্ছি। সে দুধ ছাড়তে চায় না তাই কাঁদে। ওমর রা. শিশুটির বয়স জিজ্ঞেস করলেন। দেখা গেল এখনও এর দুধ ছাড়ানোর সময় হয়নি। ওমর রা. এত আগে দুধ ছাড়াবার কারণ জিজ্ঞাসা করলে মা বলল- ‘আমীরুল মুমিনীন ওমর দুধ ছাড়ার আগে শিশুর ভাতা দেন না, তাই আগে আগেই দুধ ছাড়াচ্ছি!এ কথা শুনে হযরত ওমর রা. নির্বাক হয়ে গেলেন। ফজরের নামাযের ইমামতিতে তার কান্নার কারণে মুকতাদীদের তিলাওয়াত বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। সালাম ফেরাবার পর তিনি বলে উঠলেন, ‘হায়! ওমরের দুর্ভোগ! না জানি কত মুসলিম শিশুকে সে হত্যাকরেছে!এরপর এই ঘোষণার আদেশ দিলেন যে, কেউ যেন তার শিশুর সময়ের আগে দুধ না ছাড়ায়। আমি প্রত্যেক মুসলিম শিশুকে ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই ভাতা প্রদান করব। এরপর ইসলামী খিলাফতের প্রত্যেক অঞ্চলে তিনি এই ফরমান জারি করেন।

এই ঘটনার কয়েকটি বিষয় একটু মন দিয়ে  লক্ষ করুন :

এক. মদীনায় আগত একটি তিজারতী কাফেলার নিরাপত্তার ব্যাপারেও আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর রা. কেমন সচেতন ছিলেন যে, তিনি নিজে ও আরেক বড় সাহাবী এই কাফেলার পাহারাদারিতে রাত কাটিয়ে দিলেন!

দুই. একটি শিশুর ক্রন্দনকেও তিনি উপেক্ষা করেননি। বারবার খোঁজ নিয়েছেন ও সতর্ক করেছেন।

তিন. ক্রন্দনের কারণ উদ্ঘাটিত হওয়ার পর যখন নিজের সংশ্লিষ্টতা পেলেন তখন সরাসরি নিজেকে দায়ী করেছেন।

চার. মায়ের দুধ থেকে একটি মুসলিম শিশুর বঞ্চিত হওয়াকেও তিনি ছোটোখাটো ব্যাপার মনে করেননি।

পাঁচ. তিনি নিজেকে শুধু দায়ীই করেননি তৎক্ষণাৎ উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিয়েছেন।

প্রিয় পাঠক! এই ছিল আমাদের পরিচয়! এমনই ছিল আমাদের নেতৃত্ব, আমাদের দায়িত্ববোধ। এ ঘটনায় যেমন আছে একজন আদর্শ শাসকের পরিচয়, তেমনি আছে একজন সহৃদয় সচেতন মানুষের দৃষ্টান্ত। আজ যারা মুসলমানদের নেতৃত্বে আছেন তারা যেমন আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্তাব রা. থেকে শিক্ষা নিতে পারেন, তেমনি যারা আম জনতা আমরা শিক্ষা নিতে পারি আমাদের প্রিয় হযরত ওমর রা থেকে।

ছয়।

হযরত ওমর ফারূক রা.-এর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা তো এখন আরো প্রয়োজন। আমাদেরই অবহেলার কারণে উম্মাহর অবক্ষয় আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সাম্প্রতিক এই ঘটনাটিতেও একশ্রেণির লোকের সুযোগসন্ধানী মানসিকতার কিছু দুঃখজনক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে।

যে সকল মুসলিম নর-নারী মুশরিক বৌদ্ধদের দ্বারা চরমভাবে নিগৃহীত হয়ে শুধু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে আমাদের এই মুসলিম-সমাজে আশ্রয় নিয়েছেন, এরা যদি স্বজাতি মুসলমানদের দ্বারাও নির্যাতিত হন তাহলে এর চেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার আর কী হতে পারে? রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় গ্রহণ বাংলাদেশী মুসলিমদের জন্য এক বড় পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতেই হবে। এইসকল মাজলুম মুসলমানের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন।

কিছু লোক আছে, যারা হয়তো সরাসরি জুলুম করছে না, তবে বাড়তি কিছু মুনাফা হাসিলের চেষ্টা করছে। ঠেকাগ্রস্ত মানুষের কাছ থেকে মুনাফা লোটার যে প্রবণতা তা এই চরম বিপদগ্রস্ত মুসলিমদের উপরও প্রয়োগ করতে দেখা যাচ্ছে। এই মানুষগুলো একদিকে যেমন দালালদের মাধ্যমে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন তেমনি পথে পথে যে যেভাবে পারছে মুনাফা লোটার চেষ্টা করছে। একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত দেখুন, শাহপরির দ্বীপ হয়ে যে সকল রোহিঙ্গা কুতুপালং শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান হচ্ছে, এখানে যে জায়গাটুকুর সি এন জি ভাড়া ২০ থেকে ৩০ টাকা তা এদের কাছে থেকে নেয়া হচ্ছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। এখান থেকে অনুমান করে নিন আরো কতভাবে এরা শোষিত হতে পারে।

যে মুসলিম সিএনজি চালক তার সর্বহারা মুসলিম ভাই বোনের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে নিচ্ছেন তিনি এই টাকাটা খাবেন কীভাবে? নিজের স্ত্রী সন্তানকেইবা খাওয়াবেন কীভাবে? এই টাকায় প্রতিপালিত হওয়ার পরিণাম কি খুব সুখের হবে?

এটা তো আমাদের ঐতিহ্য নয়। এখানে মনে পড়ছে সালতানাতে ওছমানিয়ার এক বিখ্যাত নাবিক খাইরুদ্দীন বারবারোসার কথা। আল্লামা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন যে, গ্রানাডার পতনের পর তিনি তার নৌবহর আলজেরিয়ার উপকূলে নোঙ্গর করিয়ে রেখেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল, গ্রানাডার বিপর্যয়ের ফলে উন্দুলুসের মুসলমানেরা যে বর্বরতার শিকার হবেন তা থেকে তাদের রক্ষার চেষ্টা করা। তিনি এই নিপীড়িত মুসলমানদেরকে উন্দুলুস থেকে আলজেরিয়ায় স্থানান্তর করার ক্ষেত্রে জবরদস্ত খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। (জাহানে দীদাহ, পৃ. ১১২)

এই রকম নিঃস্বার্থ ও বলিষ্ঠ খিদমতের কিছু দৃষ্টান্ত কি আমাদের বাংলাদেশীদের দ্বারাও স্থাপিত হতে পারে না?

যাই হোক, সহযোগিতার ক্ষেত্র এখন অনেক বিস্তৃত। আল্লাহ যাকে ক্ষমতা দিয়েছেন, যার একটি ফোন, একটি আদেশ এই সর্বহারা মুসলমানদের অবস্থান নিরাপদ করতে পারে, তিনি যেন তা করেন। যার দুটো কথা বলার, দুকলম লেখার যোগ্যতা আছে তিনি যেন বলেন ও লেখেন। যে আল্লাহর বান্দা এদের এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারেন তিনি যেন তা খাওয়ান। যিনি একটু পথ দেখাতে পারেন তিনি যেন তা দেখান। যিনি একটি শান্ত¦নার বাণী শোনাতে পারেন, তিনি যেন তা শোনান। সবাই যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে ছোট-বড় সহমর্মিতা নিয়ে এই দুঃখী কাফেলার পাশে দাঁড়াই তাহলে তাদের দুঃখ বেদনা কিছুটা হলেও সহনীয় হয়ে উঠতে পারে।

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-

لَا تَحْقِرَنّ مِنَ الْمَعْرُوفِ شَيْئًا ولوأَنْ تَلْقَى أَخَاكَ بِوَجْهٍ طَلْقٍ.

তোমরা কোনো ভালো কাজকেই সামান্য মনে করো না। হোক তা আপন ভাইয়ের সাথে একটু হাসিমুখে সাক্ষাৎ।

-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬২৬

আর যার কিছুই করার যোগ্যতানেই তিনি যেন অন্তত কষ্ট দেয়া থেকে এবং দুর্ভোগ বাড়ানো থেকে বিরত থাকেন।

কবি বলেন-

قوت نيكى نہ دارى بد مكن * بر وجود خود ستم بے حد مكن

সাত।

এ তো গেল তাৎক্ষণিক পাশে দাঁড়ানো। বর্তমান আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে এটা ধরে নেয়া যায় যে, খুব শিগগির এদের স্বদেশে ফিরে যাওয়া হবে না। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে দশকের পর দশক মানবেতর জীবনযাপন করেছে এমন ব্যক্তির সংখ্যাও একেবারে কম নয়। তাহলে এটা একটা প্রজন্মের ব্যাপার। এই নির্বাসিত মুসলিম শিশু-কিশোর-তরুণের যদি শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা না হয় তাহলে এদের ভবিষ্যত কী? সহৃদয় চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ বিষয়টি নিয়ে ভাববেন আশা করি।

শরণার্থী শিবিরের এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে এদের শিক্ষা-দীক্ষা, প্রশিক্ষণ ও কর্ম-সংস্থানের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় কি না তা ভেবে দেখা অতি প্রয়োজন। এই নির্বাসিত মুসলিমদের জন্যও কি হতে পারে না এতিমখানা’, ‘বৃদ্ধনিবাস’, কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র ও বিধবা-পরিপোষণ কেন্দ্র? হতে পারে না কি মকতব-মাদরাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়? আমাদের ধর্মে এই সব বিষয়ে যেমন আছে গভীর ও বিস্তৃত শিক্ষা তেমনি আছে এর প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের উজ্জ্বল ইতিহাস।

হাদীসে এতিম-বিধবার ভার গ্রহণের যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে তা কার অজানা? এক হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-

أَنَا وَكَافِلُ اليَتِيمِ فِي الجَنّةِ هَكَذَا، وَقَالَ بِإِصْبَعَيْهِ السّبّابَةِ وَالوُسْطَى.

আমি এবং ইয়াতীমের ভরণ-পোষণকারী জান্নাতে এই রকম থাকব। এবং তিনি তাঁর তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল একসাথ করে দেখালেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০০৫

অন্য হাদীসে ইরশাদ হয়েছে-

السّاعِي عَلَى الْأَرْمَلَةِ وَالْمِسْكِينِ، كَالْمُجَاهِدِ فِي سَبِيلِ اللهِ - وَأَحْسِبُهُ قَالَ - وَكَالْقَائِمِ لَا يَفْتُرُ، وَكَالصَّائِمِ لَا يُفْطِرُ

বিধবা ও মিসকীনের প্রয়োজন পূরণে তৎপর ব্যক্তি আল্লাহর পথে জিহাদকারীর মতো। রাবী বলেন, আমার ধারণা তিনি আরো বলেছেন, ‘এবং রাতভর নিরলস ইবাদতকারী ও দিনভর অবিরাম রোযা পালনকারীর মতো।’-সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৮২; সহীহ বুখারী, হাদীস ৬০০৭

আট।

রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বারবার যে বিষয়টি আলোচনায় আসে তা হচ্ছে, এরা বাংলাদেশের জন্য  অনেক বড় চাপ। বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে কথাটা সম্পূর্ণ অমূলক নয়, তবে সঠিক নীতি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দ্বারা এই সমস্যার সমাধানই শুধু নয়, একে শক্তিতে পরিণত করাও সম্ভব। একটি জনগোষ্ঠী সমাজের জন্য চাপ ও বোঝা তখনই হয় যখন এরা থাকে কর্মহীন ও আদর্শহীন। যোগ্য ও আদর্শ মানবগোষ্ঠী কখনো সমাজের জন্য বোঝা নয়, বরং এরাই সমাজের শক্তি ও সম্পদ। আর তাই বোঝা বা চাপ  হওয়ার ব্যাপারটা শুধু অন্য ভূখণ্ড থেকে আগত শরণার্থীর দ্বারাই হয় না, দেশের নাগরিকও স্বদেশবাসীর জন্যে চাপ ও বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই বাস্তবতা কি আমরা প্রত্যক্ষ করছি না? তাহলে মূল কথা হচ্ছে, সঠিক শিক্ষা ও দক্ষ নেতৃত্ব। আলোচিত সমস্যার সমাধানও এর দ্বারাই করা সম্ভব।

এখন এই লক্ষ লক্ষ মুসলিমের উপযুক্ত শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা কীভাবে হতে পারে, এটি দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ ভেবে দেখতে পারেন।

দেশের দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনুমোদন থাকলে শরণার্থী শিবিরগুলোতে জাগতিক শিক্ষা ও দ্বীনী তালীমের মানসম্মত ব্যবস্থা করা অসম্ভব নয়। এই শরণার্থী মুসলিমদের মধ্যেই যারা আলেম তাদেরকে দ্বীনী তালীমের কাজে আর যারা জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত তাদেরকে জাগতিক শিক্ষার কাজে নিয়োজিত করা যেতে পারে। শুধু পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এটা এজন্যও দরকার যে, এই বিপুলসংখ্যক মানুষকে বেকার ফেলে রাখলে এদের বিপথগামিতার আশংকা বেড়ে যাবে। সহীহ দ্বীনী শিক্ষার মাধ্যমে যা রোধ করা সম্ভব।

এক্ষেত্রে একটি মহল থেকে প্রথমেই যে প্রপাগান্ডা উঠবে তা হচ্ছে, এর দ্বারা জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটতে পারে! বলাই বাহুল্য, এই বহুলচর্চিত তত্ত্ব এখন এতই প্রভাবক যে, শুধু এর মাধ্যমেই যে কোনো ভালো কাজ থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। অথচ কে না জানে যে, তথাকথিত জঙ্গিবাদসহ সব ধরনের জুলুম ও সন্ত্রাস প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হচ্ছে সহীহ দ্বীনী শিক্ষার বিস্তার। যাইহোক, এই বাস্তবতাটা সামনে রেখেই যদি নীতি নির্ধারকগণ দ্বীনী তালীমের বিস্তারের উদ্যোগ নেন, তাহলে এই বিপুলসংখ্যক মুসলিম এই  দেশ ও জাতির  জন্য বোঝা না হয়ে শক্তি ও সম্পদে পরিণত হতে পারে।

বর্তমান বর্ণবাদী সভ্যতায় দেশে দেশে শরণার্থীদের যে করুণ অবস্থা, এমনকি স্বজাতির শরণার্থীদের সাথেও যে অমানবিক আচরণ, তা ইসলামী যুগে ছিল অকল্পনীয়। ইসলামে তো অমুসলিম যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারেও এমন ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ এক জায়গায় কয়েদ করে না রেখে পরিবারে পরিবারে ছড়িয়ে দিয়ে শিক্ষা-দীক্ষা ও ভরণ-পোষণের সুব্যবস্থা- যার ফলে অসংখ্য অমুসলিম যুদ্ধবন্দীর শুধু ইসলাম গ্রহণই নয়, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে ঈর্ষণীয় আসন অধিকার করাও এক সাধারণ ধারায় পরিণত হয়েছিল। অথচ বর্তমান আধুনিকসমাজ-ব্যবস্থায় আযাদ-অভিজাত মানুষগুলোও শরণার্থী শিবিরের অবহেলা ও অমানবিকতার কারণে ভাগ্য-বিড়ম্বিত দাসের জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে থাকেন।

আমরা যারা মুসলিম, যাদের রয়েছে মজলুম মানবতাকে নবজীবনের সন্ধান দানের এবং কর্মময় জীবনে উত্তরণ ঘটাবার এক উজ্জ্বল ইতিহাস, তাদের তো বর্তমান জাহেলী ও বর্ণবাদী সভ্যতার অন্ধ অনুকরণে কোনো গৌরব নেই। আমাদের কর্তব্য আপন ইতিহাস-ঐতিহ্যের আলোকে জীবন ও জগতের বিদ্যমান সমস্যাগুলোর উদার, মানবিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সমাধান বের করা।

 

 

advertisement