মুহাররম ১৪৩৯   ||   অক্টোবর ২০১৭

বার্মার আরাকান রাজ্য  ও রোহিঙ্গা জাতির ইতিহাস : আমাদের কর্তব্য

মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী

ভাগ্যদুর্বিপাকে বার্মা তথা মায়ানমারের দখলে চলে যাওয়া আরাকান তথা রাখাইন রাজ্যটি আসলে একটি স্বতন্ত্র দেশ এবং রোহিঙ্গা বা আরাকানীরা একটি স্বতন্ত্র জাতি। ৩৯৮ মাইল দীর্ঘ এবং ৬০-৩০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এ রাজ্যটি অনেকটা ফিলিস্তিন, গাজা উপত্যকা বা আমাদের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সমুদ্র তীরবর্তী উপকূলতুল্য। বার্মার সাথে বলতে গেলে এর কোনো প্রাকৃতিক সংযোগও নেই। একটি বিশাল পর্বতমালা একে প্রাকৃতিকভাবে বার্মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। বরং ভৌগলিক অবস্থান, ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিতে এরা বাংলাদেশ ও বাঙালীদের কাছাকাছি। বোঁচা নাকের মঙ্গোলীয় বার্মিজদের সাথে তাদের কোনো মিলও নেই।

রাখাইন রাজ্যের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় পঁয়ত্রিশ লাখ। তার মধ্যে প্রায় পনের লাখ মুসলমান রোহিঙ্গা, অল্প কিছুসংখ্যক বাঙালী হিন্দুও রয়েছে। অবশিষ্টরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এদের অধিকাংশই ভারতবর্ষে অর্থ তথা বর্ণহিন্দুদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে আরাকানে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছিল। অবশ্য এদের মধ্যে মূল বার্মা থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অভিবাসিত প্রচুর বার্মিজ বৌদ্ধও রয়েছে।

ভারতবর্ষে মোগল শাসনামলে এই জাতিটি ডজন খানেক বৌদ্ধ রাজা কর্তৃক শাসিত হলেও এরা মোগল শাসকদের দ্বারা প্রভাবান্বিত ও তাদের আশীর্বাদপুষ্ট ছিল। ঐ রাজাদের প্রত্যেকেরই ফার্সী মুসলমান নামের পরিচিতি ছিল। আরাকানের রাজদরবারে মুসলমান এবং হিন্দুদেরও সমান কদর ছিল। বাংলা কাব্যের আদিপর্বের শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল, দৌলত কাজী, ‘নবীবংশগ্রন্থখ্যাত সিলিটের সৈয়দ সুলতান ও তাঁর ভাই সৈয়দ মূসা আরাকান রাজসভার অলংকারস্বরূপ ছিলেন। ১৮৩৫ সালের দিকে বৃটিশদের বার্মা অধিকারের পর বার্মা ও আরাকানবাসীরা ভারতবর্ষবাসীদের মত বৃটিশ রাজত্বের প্রজা ছিল।

রোহিঙ্গাদের আদি পুরুষরা হচ্ছেন আরব মুসলিম বণিক। কথিত আছে, আরাকানের সমুদ্রোপকূলে তাঁদের জাহাজডুবি হলে রহম রহমবলে তাঁরা বাঁচানোর জন্য আহ্বান করেছিলেন তাই স্থানীয়রা তাদের রোহিঙ্গা নামকরণ করে (যদিও রোহিঙ্গা নামকরণের কারণ হিসেবে বিভিন্ন বক্তব্য পাওয়া যায়) এ দেশে বিয়েশাদী করে তাঁরা স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং এভাবে একটি মুসলিম জনপদ গড়ে উঠে।

একসময় আরাকান রাজ্যটি আমাদের চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে আমাদের পূর্ব দিকে অবস্থিত আসাম প্রদেশের পাঁচটি কোণ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সুতরাং সে যুগে এ দেশ থেকে ও দেশে যাওয়া বা ঐ দেশ থেকে নাগরিকদের এ দেশে বিচরণ এবং নিজেদের সুবিধামত অভিবাসন গ্রহণেও কোনো বাধা-নিষেধ ছিল না। তাই ঘন জঙ্গলাকীর্ণ আরাকান থেকে বৌদ্ধ মগরা আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলিতেই অভিবাসনের উৎকৃষ্ট স্থান রূপে বেছে নেয়। তাদের এই স্থানান্তরের কারণে আরাকান রাজ্য আরো বেশি জঙ্গলাকীর্ণ ও অনাবাদী বিচরণভূমি হয়ে উঠে। তাই ব্রিটিশ সরকার চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও আমাদের দ্বীপাঞ্চল থেকে প্রচুর সংখ্যক লোক নিয়ে আরাকান রাজ্যটিকে সুজলা-সুফলা করে তোলার প্রয়াস পায়।

অনুরূপ আসামের জঙ্গলাকীর্ণ বিশাল এলাকায়ও বাঙ্গালী দরিদ্র প্রজারা অভিবাসিত হয়। আমাদের সিলেট বিভাগও যেহেতু আসামেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাই এরূপ অভিবাসন প্রক্রিয়ায় প্রচুর বাঙালী কৃষক পরিবার সিলেট, সুনামগঞ্জ, জয়ন্তিপুর এলাকায় অভিবাসিত হয়, যারা এখনো সিলেট অঞ্চলে আবাদীনামে অভিহিত হয়ে থাকেন। এদের দ্বারা জঙ্গলগুলো আবাদ হয়েছে, কৃষিযোগ্য হয়েছে। দেশের ফসল উৎপাদন বেড়েছে। ফলে আমাদের মত আরাকান রাজ্যও এদের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের ফলে সুজল-সুফলা হয়েছে। এমনকি একই প্রদেশভুক্ত হওয়ার কারণে অপেক্ষাকৃত সুখী-সমৃদ্ধ সিলেট জেলা (বর্তমানে বিভাগ) থেকেও প্রচুর লোক আসামে অভিবাসিত হয়েছেন। আসামের কাছাড়, শিলচর, হাইলাকান্দি, গোয়ালপাড়া, নোয়াগাঁও ও দরং জেলায় প্রচুর বাংলা ভাষাভাষি মুসলমানের বাস এবং আসামের রাজ্যসভায় এদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্বও রয়েছে।

আরাকান তথা বৃহত্তর মায়ানমারের স্বাধীনতা আন্দোলনে বার্মিজ শক্তির স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ অং সানের সাথে প্রচুরসংখ্যক মুসলমান নেতাও ছিলেন, যারা অং সানের মন্ত্রীসভায়ও স্থান পেয়েছিলেন। এদেশের অনেক বড় বড় আলেম মাওলানা যফর আহমাদ উছমানী রাহ., মুফতী দীন মোহাম্মাদ খান রাহ., পাকিস্তানী পীর তায়্যিব শাহ্র পিতা মওলানা সায়্যিদ আহমাদ রাহ. প্রমুখ সুদীর্ঘকাল ধরে রেঙ্গুনে ছিলেন। রেঙ্গুন থেকে প্রকাশিত উর্দু মাসিক ইস্তেকলালআমার নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে। ১৭৮৩ সালের দিকে বার্মা আরাকান আক্রমণ করে দখল করে মাত্র ৪২ বছরের জন্য তাদেরকে আয়ত্বে রাখতে  পেরেছিল। তার পরই বৃটিশরা তা দখল করে নিয়েছিল।

আমাদের বৃটিশ শাসন থেকে মুক্তি ও পূর্ব পাকিস্তানরূপে বিশ্বের মানচিত্রে আত্মপ্রকাশের পর মাত্র মাস ছয়েকের মধ্যেই ১৯৪৮ সালে বৃটিশ সরকার বার্মাকে স্বাধীনতা প্রদান করে। এতদঞ্চলের বৃটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষ ও বার্মার জনগণের যৌথ নাগরিকত্বের যুগও শেষ হয়ে যায়। নাগরিকত্ব ভারতীয়, পাকিস্তানী ও বার্মিজ তিনভাগে ভাগ হয়ে যায়। এ সময় আরাকানের রোহিঙ্গারা তাদের আরাকান রাজ্যকে আমাদের তথা পূর্ব পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। বিশাল উচুঁ পর্বতমালার দ্বারা বার্মা থেকে বিচ্ছিন্ন, তাদের কৃষ্টি কালচার থেকে দূরবর্তী অথচ ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয়ভাবে আমাদের বাঙালীদের কাছাকাছি একটি জাতিসত্তার জন্যে এটাই ছিল খুব স্বাভাবিক। কিন্তু এখানেও বৃটিশ বেনিয়ারা একটা ঝগড়া লাগিয়ে দিয়ে ঠিক কাশ্মীরের মুসলিম জনগণের মত আরাকানী ও রোহিঙ্গাদেরকেও একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। তারা ঠিক করে দেয়, আপাতত তা বার্মার অংশরূপেই থাকবে। পরবর্তী দশ বছরে বার্মিজ শাসনের অভিজ্ঞতা তাদের কাছে সুখকর বিবেচিত না হলে গণভোটের মাধ্যমে আরাকানীরা তাদের ভাগ্যনির্ধারনের অধিকার লাভ করবে। সে হিসেবে ১৯৫৮ সালে তাদের সে গণভোট ও জাতীয়তা নির্ধারণের অধিকার লাভের অঙ্গীকার ছিল। এ সময় কায়েদে আজম মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ পাক গভর্ণর জেনারেল হিসাবে অংসানের সাথে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ব্যাপারে আলাপ করলে অংসান তাকে তাদের নিরাপত্তার আশ্বাসও দিয়েছিলেন। মুজাহিদদের আক্রমণে দিশেহারা ভারত যেমন জাতিসংঘে নালিশ জানিয়ে পরবর্তীতে গণভোটের অধিকার প্রদান করে কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেবে বলে অঙ্গীকার করে আপাততকাশ্মীরকে ভারতভুক্তই রাখে তেমনি বৃটিশ শাসকদের মাধ্যমে বার্মাও রোহিঙ্গা জাতি ও আরাকানবাসীদেরকে ১৯৫৮ সালে গণভোট প্রদানের অঙ্গীকার দিয়ে তাদের শাসনাধীন রেখে দেয়।

ততক্ষণে পাকিস্তানে যেমন আইয়ুবের সামরিক শাসনের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র মুলতবী বা পরিত্যাজ্য হয়ে যায় তেমনি বার্মায়ও জেনারেল নে-উইন সামরিক শাসন জারি করে পূর্বের অঙ্গীকার থেকে ফিরে যায়। আরাকান তাদের বর্বর শাসনের অধীনেই রয়ে যায়। বার্মা তারপর আর সামরিক জান্তার স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত হতে পারেনি। ফলে সে শাসনতান্ত্রিক গণভোটও কোনোদিন অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। আরাকানী মুসলিম রোহিঙ্গাদের তাই শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে মুক্ত হওয়ার সুযোগ আসেনি।

আরাকানী জাতি কিন্তু তা সাদরে গ্রহণ করে নেয়নি। জেনারেল কাসিম রেজভী নামক একজন দুঃসাহসী নেতার অভ্যুদয় ঘটে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আরাকান যেমন ধর্মনিরপেক্ষভাবে শাসিত হচ্ছিল, তেমনি কাসিম রেজাও ধর্মনিরপেক্ষ নীতিতে তার প্রধান পরামর্শক করেছিলেন একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লোককে।  আরাকানের মুফতীয়ে আযম মাওলানা মুফতী মোহাম্মাদ  হোসেন আকিয়াবী রাহ., যিনি ১৯৪৬ পর্যন্ত আমাদের ঢাকার বড় কাটারা মাদরাসার মুদাররিস এবং আমাদের হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর একজন খলীফা ছিলেন, তিনিই আমাকে এসব তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি প্রায়ই হজ্বে যাওয়ার আগে ঢাকায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করে যেতেন এবং ১৯৯৬ সালে আমার তাঁর সাথে একত্রে হজ্ব করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মাস দুয়েক আমরা মক্কা শরীফে অবস্থান করে সেখানকার আরাকানী মুসলমানদের অবস্থা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আকিয়াবে নিজের জন্মভূমির ভবিষ্যত অনিশ্চিত বিবেচনা করে এই দূরদর্শী আলেম বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনেও একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করে সেখানেও পারিবারিক বাসস্থান গড়ে তুলেছিলেন। কয়েক বছর পূর্বে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, রেঙ্গুনে মুসলমানদের প্রতি বিদ্বেষের সেই ভাবটা নেই, যা আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে রেখেছে।

দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল যে, জেনারেল কাসিম রেজা শুধু রাখাইনই নয় রাজধানী রেঙ্গুনকে পর্যন্ত তটস্থ করে রেখেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাঁর সে সংগ্রামের মূল্যায়ন না করে তাকে নিছক একজন সন্ত্রাসী ও লুটতরাজকারী বলে বিবেচনা করে কক্সবাজার এলাকায় আসলে তাকে গ্রেফতার করে সে রোহিঙ্গা মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনটিকে স্তব্ধ করে দেয়। জেনারেল কাসিম রেজা ১৯৫৩ সালের দিকে কক্সবাজারের কারাগারেই ইন্তেকাল করেন।

মোদ্দাকথা, ১৯৬২ সালে জেনারেল নে-উইনের সামরিক শাসন জারি এবং সমাজতান্ত্রিক গজব নাযিল হওয়া পর্যন্ত বার্মা একটি সমৃদ্ধ ও সম্পদ-উদ্বৃত্ত রাষ্ট্র ছিল। আমরা আমাদের ছোটবেলায় বার্মা থেকে আমদানীকৃত উৎকৃষ্ট মানের চালের ভাত খেয়েছি। দুনিয়ার কুলি মজুর ও সর্বহারাদের রাজত্ব কায়েমের আপাতমধুর শ্লোগান দিয়ে বার্মা সরকার তখন সমাজতান্ত্রিক নিয়মে রাষ্ট্রের তাবৎ সম্পদ কুক্ষিগত করে নেয়। ভূমি মালিকরা সর্বহারা মজুরে পরিণত হয়। তারা উৎপাদন স্পৃহা হারিয়ে ফেলে। দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয় এবং তাদেরকেও তখন বিদেশনির্ভর    হয়ে পড়তে হয়। সমাজতান্ত্রিক বৃহৎ প্রতিবেশী চীন তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে গোটা বার্মাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলে। এটাই হচ্ছে একটি সমৃদ্ধ দেশের দেখতে দেখতে ভূখানাঙার দেশে পরিণত হওয়ার বাস্তব ইতিহাস।

সমাজতান্ত্রিক অভিশাপে জর্জরিত জনগণ তাদের বাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকার হারাল। সামরিক শাসন তাদের ভাগ্যলিপি হয়ে দাঁড়াল। আজ পর্যন্ত তারা সেই জাঁতাকলেই পিষ্ট হচ্ছে। জাতির প্রথম সারির স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বর্তমানে এ অপকর্মটি সহজসাধ্য ছিল না বিবেচনায় অং সানসহ ১৭ জন মন্ত্রীকে হত্যা করে সে পথ সুগম করা হয়, যা আমাদের প্রায় অজানাই রয়ে গেছে। একটি অভাবগ্রস্ত জাতির মধ্যে হিংসা ও হানাহানি একটি অনিবার্য অনুষঙ্গও বটে।

শান, কাচিং, রোহিঙ্গা প্রত্যেকটি জাতিসত্তাই এখন বার্মিজদের তথা তাদের সেনাবাহিনীরূপী ডাকাতদের নৃশংসতার শিকার। একমাত্র গোঁড়া বৌদ্ধরা ছাড়া অপর সকলেই নির্যাতিত। প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর হাজার হাজার লোক বার্মিজ সৈন্যদের হাতে অহরহ নিহত হচ্ছে। সমাজতান্ত্রিক শাসনের লৌহপ্রাচীর ডিঙ্গিয়ে সকল সংবাদ সবসময় বহির্বিশ্বের লোক জানতে পারে না। তা সত্ত্বেও বিশ্ব মিডিয়ায় এ জাতীয় সংবাদ কম প্রচারিত হয়নি।

ঐ নিগৃহীত জাতি-সত্তাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক নিগৃহীত হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা। পনেরো লাখ রোহিঙ্গা মুসলিমের মধ্যে আট লাখ ইতিমধ্যে বাংলাদেশে এসে বসবাস করছে। গত তিন সপ্তাহে চার লাখের মত রোহিঙ্গা নারী শিশু ও বৃদ্ধ লোক জল ও স্থলপথে বাংলাদেশে এসে ঢুকে পড়েছে। এক লাখ রয়েছে মালয়েশিয়ায়। পাকিস্তানের করাচীতেও বেশ কয়েক হাজার রোহিঙ্গা বহু পূর্ব থেকেই অবস্থান করছে। সৌদী আরবে এদের সংখ্যা চার লাখের কম হবে না। মক্কা শরীফের চতুর্দিকের পাহাড় পর্বতে এবং জেদ্দার পাশ্ববর্তী এলাকাসমূহে প্রচুর সংখ্যায় এরা বসবাস করেন। আমার সেসব এলাকা দেখার সুযোগ হয়েছে।

আরাকান রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের অসৎ উদ্দেশ্যে ১৯৮২ সালে তাদের রাষ্ট্র নাগরিক-পরিচিতি কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদেরকে বিদেশাগত তথা বাঙালী বলে অভিহিত করে ভোটাধিকার বঞ্চিত করা হয়। তারপর শুরু হয় তাদেরকে বিতাড়ণের ঘৃণ্য অভিশাপ।  প্রেসিডেন্ট এরশাদ ও বি এন পি  শাসনামলে বেশ কয়েকবারই লাখো লাখো রোহিঙ্গা মুসিলমকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়। কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় সাবেক সরকারগুলো ১০/২০ হাজার করে এবং একবার সর্বাধিক আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের স্বদেশে ফেরৎ পাঠাতে সক্ষম হয়।

এবারও হাজার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বার্মিজদের সামরিক অভিযানে বাধ্য হয়ে আগতদের আগমন ঠেকিয়ে রাখা যায়নি।

কয়েক লাখ লোক ইতিমধ্যে প্রাণ নিয়ে এদেশে ঢুকেছে, যাদের প্রায় সবাই নারী, বৃদ্ধ ও শিশু। সহস্রাধিক লোক ইতিমধ্যে শহীদ হয়েছেন। শতাধিক লাশ নাফ নদী দিয়ে এবং সাগর উপকূলে ভেসে এসেছে। অনেক নারী বার্মিজ জান্তা এবং উপপন্থী বৌদ্ধ গুণ্ডাদের হাতে ধর্ষিত ও খুন হয়েছেন, অনেক গর্ভবর্তী নারী কোনোমতে এপারে এসে সন্তান প্রসব করেছেন। গুলিবিদ্ধ শতাধিক লোক কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যাদের মধ্যে কয়েকজন মারাও গেছেন।

এতসব সত্ত্বেও আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের দাবিদারের কাউকেই এতকাল তেমন উৎকণ্ঠিত মনে হয়নি। আমরা যথারীতি ঈদ উৎসব পালন করেছি। রোহিঙ্গা মুসলিমদের অবতরণস্থলের অনেকটা নিকটবর্তী চট্টগ্রামে বাংলাদেশ-অষ্ট্রেলিয়াক্রিকেট খেলা উপভোগ করেছি। এমনকি ঘটা করে বিভিন্ন ওপেনিং সিরিমনী তথা উদ্বোধনী উৎসবও চালিয়ে যাচ্ছি; যেন তেমন কিছু ঘটেইনি। চক্ষুলজ্জায় কিছু কিছু বুদ্ধিজীবি টিভি টকশোগুলোতে লিপ-সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন। দুনিয়ার দুঃখী মজুরদের ত্রাণকর্তা হওয়ার দাবিদার ও শ্লোগানধারী সমাজতান্ত্রিকনেতারা তাদের সমাজতান্ত্রিক গজবে সর্বস্বহারা ও প্রাণশঙ্কায় আগত খোলা আকাশের নীচে এসে জমায়েত হওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের পাশে গিয়ে কেউ দাঁড়াচ্ছেন না বরং তাতে নিরব সমর্থন দিয়ে তারা সে দৃশ্য যেন উপভোগ করে চলেছেন! সহস্রাধিক নিহত মুসলিম রোহিঙ্গার সাথে সাথে মাত্র ৮৬ জন হিন্দু বাঙালী নিহত হওয়ার পর আমাদের পরম বন্ধুরাষ্ট্রভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বার্মা সফর করে সেখানকার সামরিক জান্তার সাথে মুসলিম নিগ্রহের বিষয়ে একাত্মতা ঘোষণা করে এসেছেন! সমাজতান্ত্রিক চীন ও রাশিয়া স্পষ্ট ঘোষণা দিচ্ছে, জাতিসংঘের অধিবেশনে মানবতাবিরোধী অপরাধের হোতা বার্মার নিন্দা করা যাবে না। তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব আসলে তারা অমানবিক ভুতুড়ে শক্তি প্রয়োগ করে ভেটোদেবে।

উপরোক্ত বক্তব্য ও সংবাদগুলো এতই বহুল প্রচারিত যে, কোনো বরাত দেয়ার প্রয়োজন নেই। এ বাস্তব অবস্থাটা গোটা বিশ্ব চরম উৎকণ্ঠার সাথে প্রত্যক্ষ করছে। সুদূরের তুরস্ক, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় চরম উৎকণ্ঠা উদ্বেগ বিরাজ করছে। তুর্কী ফার্স্টলেডি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরেজমিনে গিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে রিলিফ বিতরণ করেছেন। মালয়েশিয়া প্রথমে জাহাজভর্তি রিলিফ সামগ্রী আরাকানে পাঠিয়েছে এবং এখন বিমানযোগে সাহায্য সামগ্রী নিয়ে আসছে। আমাদের জাতির ত্রাণকর্তা কেউ কি  সে কাজটি করেছেন বলে  কেউ দুর্নাম করতে পারবে?

ওআইসি নামক মুসলিম বিশ্বের মাতব্বর সংস্থাটি বিজ্ঞানেরবিষয়ে ২০ জন রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মেলন আহ্বান করে আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে সেখানে বৈজ্ঞানিকবক্তব্য রাখার জন্যে আমন্ত্রণ জানিয়েছে, যাতে বিশ্ববাসীদের সম্মুখে এ কথাটি দিবালোকের মত স্পষ্ট হয়ে যায় যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের জাতিগত ধ্বংস ও বাংলাদেশে নির্বাসন বাংলাদেশ বা উম্মাহরজন্যে কোনো মাথাব্যথার কারণই নয়! একটি জাতি ও একটি উম্মাহর অনুভূতিহীনতা ও আত্মমর্যাদা বিলোপের এর চাইতে ঘৃণ্যতম দৃশ্য আর কী হতে পারে? নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ হাদীসখানাই বারবার মনে পড়ছে-

إِذَا لَمْ تَسْتَحْيِ فَاصْنَعْ مَا شِئْتَ

যখন হায়া-শরম বিসর্জন দিয়েছ, তখন তুমি যা-ইচ্ছে করতে পার। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৮৪

হে আল্লাহ! এ জাতিকে সুবুদ্ধি, বিবেক ও আত্মমর্যাদা দান কর!

জাতীয়ভাবে আমাদের করণীয়

মুসলিম উম্মাহর একটি স্বাধীন সংগ্রামী ও তৃতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার অধিকারী জাতি হিসেবে আমাদের বিশাল দায়িত্বও রয়েছে। একে তো মুসলমান ভাই হিসাবে একটি মুসলিম জাতিসত্তা রক্ষার গুরুদায়িত্ব। তদুপরি এ আগুনের হলকাটা যখন ঠিক আমাদের মাথার উপর এসে পড়েছে, আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্যে যা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমাদের উন্নয়নশীল জাতিসত্তাকে যা অসাড় করে দিতে পারে, এমন অবস্থায় কোনো স্বাধীনচেতা ও দায়িত্বশীল নাগরিক কোনো মতেই উদ্বেগমুক্ত থাকতে পারে না। ইসলামী চিন্তাচেতনা দূরের কথা, মানবিক মূল্যবোধও যাদের মধ্যে নেই তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমাদের চলবে না। পূর্ণ জাতীয় শক্তি নিয়ে আমাদেরকে এ বিশাল চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হবে। আমাদের মাওলানা ভাসানী বিশ্বের নিপীড়িত সকল মানুষের নেতারূপে মযলুম জননেতা রূপে বিশ্বব্যাপী নন্দিত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মুখেও আমরা সে আহ্বান বারবার শুনেছি। সুতরাং কেবল বাঙালী জাতিসত্তাই না, পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলে নিপীড়ন-নির্যাতনের এরূপ স্টীমরোলার চললে আল্লাহর সৈনিক ও মানবতার যোদ্ধারূপে আমাদেরকে সোচ্চার হতে হবে।  এক্ষেত্রে যখন আমরা নিজেরা সাক্ষাৎ-বিপদের মুখে পড়েছি, তখন আমরা কোনো মতেই চুপ করে থাকতে পারি না।

সর্ব নিকটবর্তী প্রতিবেশী এবং বিপন্ন রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল হিসাবে আমাদেরকেও আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। মানবিক দায়িত্বের সাথে সাথে এটা আমাদের একটা পবিত্র ধর্মীয় দায়িত্বও বটে।

ধর্মের প্রসঙ্গটি উঠলেই অনেকে বিব্রত হয়ে নাক সিটকায়। তাদেরকে আমাদের জিজ্ঞাসা, রোহিঙ্গারা যদি মুসলমান না হয়ে খ্রিস্টান বা হিন্দু ধর্মের অনুসারী হতো তাহলে খ্রিস্টীয় জগৎ বা হিন্দু ভারত কি চুপ করে থাকতো?

কোথায় মোমেনশাহীর কোন্ গ্রামে স্থানীয় রাজনৈতিক দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা সামান্য একটি ঘটনা ঘটলে হিন্দু ভারত কি রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের সরকারের কাছে প্রতিবাদ জানায়নি? কেবল ধর্মীয় সহানুভূতির কারণেই কি খ্রিস্টীয় জগৎ মাত্র পাঁচ লাখ লোক অধ্যুষিত পূর্বতিমুরকে পৃথক খ্রিস্টানরাষ্ট্রের জন্যে ছেড়ে দিতে ইন্দোনেশিয়ার মত বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রকে বাধ্য করেনি? দক্ষিণ সুদানে কি একই ইতিহাসের পূনরাবৃত্তি ঘটেনি? তাহলে পনেরো লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বা প্রায় এক কোটি মুসলিম অধ্যুষিত নির্যাতিত নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত কাশ্মীরী মুসলমানদের স্বপক্ষে কথা বলতে আমরা কেন এত হীনম্মন্যতার শিকার হই?

আমরা মুসলিম উম্মাহর প্রায় ৭০/৭১টি রাষ্ট্র কেন তাদের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার স্বীকৃতি ও স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবিতে সোচ্চার হতে পারব না?

১. আমাদের কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে একটি মুহূর্ত মাত্র দেরী না করে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠান খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। একা সরকারের পক্ষে এ দায়িত্ব পালন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ সময় যদি কেউ নিজেকে বা তার দলটিকে কেবল জাতির ত্রাণকর্তা বলে জাহির করে আর সকলকে উপেক্ষা করেন, তবে পরবর্তী সকল অনিষ্টের জন্য তিনি বা তার দলই জাতির কাছে দায়ী থাকবেন। মনে রাখতে হবে, এটি কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নয়, এটি একটি জাতীয় ও মানবিক ইস্যু। প্রত্যেকটি নাগরিকের এ ব্যাপারে দায়িত্ব পালন ও মতামত প্রকাশের অধিকার অবশ্যই থাকতে হবে।

২. ঢাকায় অবস্থিত সমস্ত আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিবর্গ এবং বৈদেশিক রাষ্ট্রদূতদেরকে টেকনাফে নিয়ে গিয়ে স্বচক্ষে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। যাতে করে তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ সরকার ও জাতিকে এ ব্যাপারে অবহিত করতে পারেন।

৩. পাকিস্তানে যেমন কাশ্মীর বিষয়ক মন্ত্রণালয় রয়েছে এখানেও আমাদের রোহিঙ্গা বিষয়ক একটি স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব ও দল-কানা নীতির ঊর্ধ্বে উঠে এ ব্যাপারে সবচাইতে কার্যকর ব্যক্তিত্বকে দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।

৪. যুদ্ধের জন্যে না হলেও অন্তত আমরা যে সজাগ ও সক্ষম তা বুঝাবার জন্যে হলেও কক্সবাজার ও বঙ্গোপসাগরে আমাদের একটি সমরিক মহড়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য, এরই মধ্যে মায়ানমার বাহিনীর হেলিকপ্টার সতের বার আমাদের আকাশ সীমানা লঙ্ঘনের ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করেছে এবং রোহিঙ্গাদের আসার পর তারা সীমান্তের খুবই কাছাকাছি স্থানে মাইন পুঁতে রেখে ঐ এলাকাকে বিপদসঙ্কুল করে তুলেছে। এরূপ কোনো অপতৎপরতা দেখা মাত্র আমাদের পক্ষ থেকে নির্দ্বিধায় গুলি চালিয়ে ওদেরকে ঐ অপকর্ম থেকে বিরত রাখতে হবে। নিজেদের জাগ্রত থাকার প্রমাণ দিতে হবে।

৫. অবিলম্বে জাতিসংঘ ও ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা জাতিসত্তা নিধনের জন্যে মায়ানমারকে দায়ী করে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে এবং এতে যেন মুসলিমবিদ্বেষী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো ভেটো না দেয়, সে ব্যাপারে তাদেরকে কূটনৈতিকভাবে চাপ দিয়ে বা বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিরত রাখতে হবে।

৬. আমরা যদি এ জাতীয় উদ্যোগগুলো সার্থকভাবে গ্রহণ করতে ব্যর্থ হই, তাহলে মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা যুবকদেরকে তাদের স্বদেশ উদ্ধার এবং স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে কেউ বিরত রাখতে পারবে না।

৭. বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ত্রাণ শিবিরে নারীদেরকে কুটির শিল্প জাতীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভরতার এবং যুবকদেরকে উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করে যোগ্য মানব সম্পদরূপে গড়ে তুলতে হবে।

৮. জাতিসংঘ যদি কাশ্মীর ও ফিলিস্তীনের মুসলমানদের মত এক্ষেত্রেও বে-ঈমানী ও মোনাফেকী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে তা ত্যাগ করে একটি স্বতন্ত্র মুসলিম জাতিসংঘ গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর আগেই মধ্যপ্রাচ্যের তাবেদারীপ্রিয় ধনী রাষ্ট্রগুলোর সমস্ত সম্পদ বৈরী রাষ্ট্রগুলো থেকে প্রত্যাহার করে নিতে হবে এবং তাদেরকে তেল যোগান বন্ধ করতে হবে।

আমার বিশ্বাস সর্বদলীয় জাতীয় অধিবেশনে এবং ওআইসি সম্মেলনে এসব ব্যাপারে যথোপযুক্ত সমাধান অবশ্যই বেরিয়ে আসবে। তাবেদারীমুক্ত স্বাধীন মুসলিম নেতৃত্বই কেবল উগ্র সাম্প্রদায়িক  চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে পারে।

কূটনৈতিক দরাদরির একটি ক্ষেত্র

এখানে বার্মার সাথে কূটনৈতিক দরকষাকষির আমাদের একটি চমৎকার ক্ষেত্রও রয়েছে, যা আন্তর্জাতিক বিশ্বও অগ্রাহ্য করতে পারবে না।

আমাদের বাঙালী মুসলমানদের একটি বিরাট জামাত যেখানে বৃটিশ আমল থেকে প্রায় দুই আড়াই শ বছর পূর্বে আরাকানে গিয়েছে, তেমনি সে দেশের তথা রাখাইন রাজ্যের মগরাও আমাদের  পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাসমূহে এসে অভিবাসন গ্রহণ করেছে। তারা বার্মিজদের সমজাতীয় ও সমধর্মীয়, সমভাষী লোক। এখন কেবলমাত্র ধর্ম ও নৃতাত্বিক ও কৃষ্টিগত কারণে যদি রাখাইন রাজ্য তথা বৃহত্তর মায়ানমারের বাংগালী বংশোদ্ভুত ও মুসলমানরা নাগরিকত্বের অযোগ্য- এ যুক্তটি মেনে নেয়া যায় তাহলে একই যুক্তিতে আমাদের দেশে বসতকারী প্রায় দশ লাখ মগ ও বৌদ্ধ এ দেশের নাগরিকত্বের অযোগ্য হয়ে পড়ে এবং এই যুক্তিতে মায়ানমারকে সে দায়িত্বটি অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। আমরা গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ওদেরকে এখানে জামাই আদরে রাখব। আর তাদেরকে স্বতন্ত্র স্বাধীন আরেকটি পূর্বতিমুর রাজ্য গড়ার পথ খুলে দেব। আর আমাদের সমজাতীয়, সমধর্মীয়  ও কাছাকাছি ভাষার লোক হওয়ায় রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমরা নির্যাতিত হবে, বিতাড়িত হবে- এ হতে পারে না। বিশ্ব দরবারেও আমাদের কূটনৈতিকরা এ যুক্তিটা তুলে ধরতে পারেন। মায়ানমারের সামরিক-জান্তা নিয়ন্ত্রিত সরকার যদি এ যুক্তি মেনে নেয়, তাহলে আর কোনো নতুন দেন দরবারের প্রয়োজনই থাকে না। বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানীগুণী ও কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বগণ  তথা সরকার বিবেচনা করবেন- এ দাবিটি রইল।

এ বার্তাটি দিয়ে এখানকার বৌদ্ধ ভিক্ষু ও তাদের রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় একটি প্রতিনিধিদলও মায়ানমারে সরকারীভাবে পাঠানো যেতে পারে।

 

 

advertisement