শাবান-রমযান ১৪৪২   ||   মার্চ-এপ্রিল ২০২১

আততিবইয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন
একটি নাম দুটি কথা

আমাদের পূর্ববর্তী মনীষীদের দ্বীনী প্রজ্ঞা এত গভীর ছিল যে, মাঝেমাঝে অভিভত হয়ে যেতে হয়। তাদের রচনা-গবেষণায় এ প্রজ্ঞার ছাপ তো খুবই স্পষ্ট রচনাবলীর নাম ও শিরোনাম থেকেও ফিক্রে মুতাওয়ারাছ বা যুগ যুগ থেকে মনীষী-সমাজে প্রতিষ্ঠিত নীতি ও চিন্তারও সাক্ষাৎ মেলে। আসলে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির ছোট ছোট বিষয়েও প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটে। এখন এ কথাগুলো বলছি ইমাম নববী রাহ.-এর একটি পুস্তিকা আত তিবইয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআনসামনে নিয়ে। নামটির নিখুঁত বাংলা তরজমা কী হতে পারে? জবাবটা হয়তো খুব সহজ হবে না। কারণ, সাদামাটা এ নামটিতে তিবইয়ান’, ‘আদাবহামালাতুল কুরআন এ তিন শব্দের আরবী ভাষায় যে গভীর আবেদন তা অন্য কোনো ভাষায় তুলে আনা বেশ দুরূহ ব্যাপার। তাই এ ত্রি-রত্নের নিখুঁত ও প্রাণবন্ত তরজমার বিষয়ে অক্ষমতা স্বীকার করে নিয়ে আমি শুধু এ নামের পিছনের চিন্তাটি সম্পর্কে দু-একটি কথা আরজ করতে চাই।

এ নামের মধ্যে কুরআনে কারীমের ছাত্র-শিক্ষক ও সকল পর্যায়ের চর্চাকারীর জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা আছে। কুরআনে কারীমের সাথে সম্পর্কের মর্যাদা এবং এ মর্যাদার দাবি রক্ষার্থে কুরআনে কারীমের চর্চাকারীকে যে উন্নত স্বভাব ও ব্যক্তিত্বের, মার্জিত ও পরিশীলিত আচার-ব্যবহারের অধিকারী হতে হয়Ñ এ নামে তার দিকেই ইশারা আছে।

আরবী ভাষায় আদাবশব্দটি স্বভাব ও আচরণ দুক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। বাস্তবেও স্বভাব-চরিত্র ও আচার-আচরণ বিষয়দুটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভদ্র ও মার্জিত আচরণের জন্য ভালো স্বভাব-চরিত্রের প্রয়োজন আবার উন্নত স্বভাব-চরিত্র গঠিত হওয়ার জন্য ভদ্র ও মার্জিত আচরণের চর্চা অব্যাহত রাখা অপরিহার্য। একারণে সালাফের আদব-শীর্ষক রচনাবলীতে স্বভাবআচরণদুই বিষয়েই আলোচনা থাকে।

প্রত্যেক মুমিনকে ইসলামী আদাব-আখলাক অর্জন করতে হবে। কেননা মুমিন এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ বিশেষণ, যার সাথে হীন স্বভাব ও নীচু আচরণ কিছুতেই খাপ খায় না। তাই মুমিননামে যিনি অভিহিত হবেন তাকে অবশ্যই উত্তম আদব-আখলাকের অধিকারী হতে হবে। এটি এ মর্যাদাপূর্ণ উপাধির দাবি এবং একটি সাধারণ ও সর্বজনীন বিষয়। বর্তমান সময়েরও অনেক আরব দায়ী লেখকদের মধ্যে এই চিন্তার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। তাদের অনেকেই شخصية المسلم মুসলিম-ব্যক্তিত্ববা কাছাকাছি শিরোনামে বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। সেসকল গ্রন্থে ইসলামী আদব-আখলাক বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে দ্বীনী বিবেচনায় আমাদের সর্বপ্রথম ও সবচেয়ে বিস্তৃত যে উপাধিÑ মুমিন, তারই দাবি, উন্নত স্বভাব-চরিত্র ও ভদ্র আচার-ব্যবহার; তাহলে এর পরের আরো যে বিশেষায়িত উপাধিগুলো আছে, সেগুলোর কথা তো বলাই বাহুল্য।

আসলে এটা একটা স্বীকৃত ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয় যে, দ্বীনী-দুনিয়াবি যে কোনো মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্ক, দায়িত্ব বা পদ-পদবিরই কিছু শর্ত ও আদব থাকে, যা ঐ দায়িত্ব বা পদ-পদবীর অধিকারী ব্যক্তিকে আয়ত্ব করতে হয়, অনুসরণ করতে হয়। আরবী ভাষায় আদবশব্দের এধরনের অনেক ব্যবহার আছে। যেমন আদাবুল কাযী’ ‘আদাবুল মুফতীইত্যাদি।

এ ধরনের একটি ব্যবহার, বরং বলুন এ শ্রেণির উচ্চতম ব্যবহারটি হচ্ছেÑ

آداب حملة القران.

আলকুরআনের ধারক-বাহকগণের আদব-আখলাক।

তাহলে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে যে, এ নামের গভীর দাওয়াতটি হচ্ছে, আলকুরআনের ইলম অতি মূল্যবান সম্পদ। কারণ তা ইলমে ওহী। এই ইলমের সাথে সংশ্লিষ্টতা অতিমর্যাদার বিষয়। আর তাই এই মর্যাদার উপযোগী আদব-আখলাক সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং তা অর্জনে সচেষ্ট হওয়া কাম্য। ইলমে ওহীর অন্বেষী প্রতিটি অন্তর এই চেতনায় উজ্জীবিত থাকতে হবে।

মানুষের মন-মস্তিষ্ক হচ্ছে ইলমের পাত্র। নূরানী ইলমের জন্য পাত্রও নূরানী হওয়া চাই। কাজেই যে মন-মস্তিষ্ক আসমানী নূর ধারণ করবে তা অবশ্যই পবিত্র ও নির্মল হতে হবে। অন্তর যখন পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হবে তখন কাজ-কর্ম, আচার-আচরণও মার্জিত পরিশীলিত হবে। হৃদয় ও কলব সম্পর্কেই তো হাদীস শরীফের ইরশাদÑ

إِذَا صَلَحَتْ صَلَحَ الْجَسَدُ كُلّهُ، وَإِذَا فَسَدَتْ فَسَدَ الْجَسَدُ كُلّهُ.

যখন তা সুস্থ হয় গোটা দেহ সুস্থ হয়। আর যখন তা বিনষ্ট হয় তখন গোটা দেহ বিনষ্ট হয়।

তাই ইলমে ওহীর বাহক ও অন্বেষীকে অন্তর্জগতের পরিশুদ্ধি ও স্বভাব-চরিত্রের পরিশীলনের ব্যাপারে যতœবান হতে হবে। একইসাথে ভদ্র ও মার্জিত আচার-ব্যবহারেরও অধিকারী হতে হবে। এটি ইলমে ওহীর উচ্চ মর্যাদার দাবি।

আমাদের সালাফ ও পূর্বসূরীদের মাঝে এই মর্যাদার অনুভূতি পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিল। এটা তাঁদের দ্বীনী প্রজ্ঞারই একটি দিক।

তাঁদের জীবন ও কর্মে এই অনুভূতির প্রকাশও ছিল বিচিত্র। জীবনের বিভিন্ন পর্বে, জীবনযাত্রার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পরিস্থিতিতে তা প্রোজ্জ্বলরূপে প্রকাশিত ছিল। কখনো তা ছিল মধ্য দুপুরের গনগনে সূর্যের মতো প্রখর ও তেজস্বী। কখনো পূর্ণিমার চাঁদের মতো কোমল ও দৃষ্টিনন্দন। তাঁদের জীবনের সেইসব গল্প পড়লে বা শুনলে কখনো চোখে পানি আসে, কখনো বুকের শিরা-উপশিরায় তপ্ত খুন ঝলকে ওঠে।

ইলমে ওহীর মর্যাদা ও মাহাত্ম্যে তারা নিজেরা যেমন উজ্জীবিত ছিলেন পরবর্তীদের মাঝেও তা সঞ্চারিত করার চেষ্টা করে গেছেন। তাই দেখি, সালাফের রেখে যাওয়া রচনাবলীর এক বিরাট অংশ আলো করে আছে ইলমে ওহীর মর্যাদা ও মাহাত্ম্য, ইলম-অন্বেষণের আদব, ইলমে ওহীর ধারক-বাহকদের কাম্য উন্নত ব্যক্তিত্ব ও গুণাবলির বর্ণনা। এ বর্ণনার পরতে পরতে জীবন্ত হয়ে আছে তাঁদের হৃদয়ের স্পন্দন, আত্মার ধ্বনি, তাঁদের জীবনাদর্শ, হিরকখণ্ডের মতো দ্যুতিময় জীবনের খÐ Ð ঘটনা ও অনুষঙ্গ।

চলুন, ইলমে ওহীর প্রধান তিন শাস্ত্রÑ উলূমুল কুরআন, উলূমুল হাদীস ও উলূমুল ফিক্হ থেকে আমরা এ বিষয়ে একটু ধারণা নেয়ার চেষ্টা করি।

উলূমুল কুরআন বিষয়ে প্রচীন গ্রন্থসমূহের একটি হচ্ছে ইমাম আবু উবাইদ আল-কাসিম ইবনু সাল্লাম রাহ. (মৃত্যু ২২৪হি.) কৃত فضائل القرآن গ্রন্থের সূচনা কুরআন হামালাতুল কুরআনের মর্যাদার আলোচনা দিয়ে। এরপর তাঁর শিরোনামÑ

جُمْلَةُ أَبْوَابِ قُرّاءِ الْقُرْآنِ وَنُعُوتِهِمْ وَأَخْلَاقِهِمْ.

অর্থাৎ কুরআন পাঠকারী ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলি বিষয়ক পরিচ্ছেদসমূহ।

এখানে আবওয়াববা পরিচ্ছেদসমূহকথাটি বিশষভাবে লক্ষণীয়; উদ্দেশ্য হচ্ছে, এখানে আলোচ্য বিষয়ে একটি পরিচ্ছেদ নয়। অনেকগুলো পরিচ্ছেদ আছে। বলা যায়, ইমাম আবু উবাইদ রাহ. আবওয়াবশব্দটি কিতাববা অধ্যায়অর্থে ব্যবহার করেছেন।

এরকম চারটি শিরোনাম তাঁর কিতাবে আছে। অন্য ভাষায় বললে তিনি কিতাবটিকে প্রধান চার অধ্যায়ে বিন্যস্ত করেছেন। যার মধ্যে পূর্ণ একটি অধ্যায় হামালাতুল কুরআনের আদব-আখলাক সম্পর্কে।

এ অধ্যায়ের বাববা পরিচ্ছেদ-সংখ্যা ২৩টি। (পরিচ্ছেদ নং ৯ থেকে পরিচ্ছেদ নং ৩১ পর্যন্ত।) সবগুলো পরিচ্ছেদেরই আলাদা শিরোনাম আছে এবং সবগুলো শিরোনামই উল্লেখ করার মতো। তবে সংক্ষেপে নমুনা হিসেবে কয়েকটিমাত্র শিরোনাম উল্লেখ করছি।

بَابُ حَامِلِ الْقُرْآنِ وَمَا يَجِبُ عَلَيْهِ أَنْ يَأْخُذَ بِهِ مِنْ أَدَبِ الْقُرْآنِ.

পরিচ্ছেদ : কুরআনের বাহক তার কুরআনের আদব আবলম্বনের অপরিহার্যতা।

بَابُ مَا يُسْتَحَبّ لِحَامِلِ الْقُرْآنِ مِنْ إِكْرَامِ الْقُرْآنِ وَتَعْظِيمِهِ وَتَنْزِيهِهِ.

পরিচ্ছেদ : কুরআনের প্রতি হামিলুল কুরআনের সম্মান সম্ভ্রম প্রকাশ এবং কুরআনের মর্যাদাহানীকর সবকিছু থেকে বিরত থাকার কাম্যতা।

بَابُ مَا يُؤْمَرُ بِهِ حَامِلُ الْقُرْآنِ مِنْ تِلَاوَتِهِ بِالْقِرَاءَةِ وَالْقِيَامِ بِهِ فِي الصّلَاةِ.

পরিচ্ছেদ : হামিলুল কুরআনের কুরআন তিলাওয়াতে এবং কুরআনের শিক্ষা বিধান পালনে আদিষ্ট হওয়া।

بَابُ مَا يُسْتَحَبّ لِقَارِئِ الْقُرْآنِ مِنَ الْبُكَاءِ عِنْدَ الْقِرَاءَةِ فِي صَلَاةٍ وَغَيْرِ صَلَاةٍ وَمَا فِي ذَلِكَ.

পরিচ্ছেদ : সালাতে সালাতের বাইরে তিলাওয়াতের সময় কুরআন তিলাওয়াতকারীর ক্রন্দন মুস্তাহাব হওয়া এবং এতদসংক্রান্ত বিষয়সমূহ।

بَابُ مَا يُسْتَحَبّ لِلْقَارِئِ إِذَا مَرّ فِي قِرَاءَتِهِ بِذِكْرِ الْجَنّةِ مِنَ الْمَسْأَلَةِ، وَبِذِكْرِ النَّارِ مِنَ التّعَوّذِ.

পরিচ্ছেদ : কুরআন পাঠকারী যখন জান্নাতের বর্ণনা পাঠ করেন তখন জান্নাতের দুআ আর যখন জাহান্নামের বর্ণনা পাঠ করবেন তখন জাহান্নাম থেকে আশ্রয় চাওয়ার কাম্যতা।

بَابُ مَا يُسْتَحَبّ لِقَارِئِ الْقُرْآنِ مِنْ تَكْرَارِ الْآيَةِ وَترْدَادِهَا.

পরিচ্ছেদ : কুরআন পাঠকারীর উচিতÑ একটি আয়াত বারবার পড়া।

بَابُ مَا يُسْتَحَبّ لِقَارِئِ الْقُرْآنِ مِنَ الْجَوَابِ عِنْدَ الْآيَةِ وَالشّهَادَةِ لَهَا.

পরিচ্ছেদ : কুরআন পাঠকারীর উচিতÑ আয়াতের জবাব দেয়া এবং সাক্ষ্য দেওয়া।

بَابُ مَا يُسْتَحَبّ لِقَارِئِ الْقُرْآنِ مِنَ التّرَسّلِ فِي قِرَاءَتِهِ وَالتّرْتِيلِ وَالتّدَبّرِ.

পরিচ্ছেদ : কুরআন পাঠকারীর উচিতÑ ধীরে ধীরে তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করা চিন্তা-ভাবনা করা।

بَابُ الْقَارِئِ يَجْهَرُ عَلَى أَصْحَابِهِ بِالْقُرْآنِ فَيُؤْذِيهُمْ بِذَلِكَ.

পরিচ্ছেদ : কুরআনের পাঠক যদি সাথীদের কাছে উচ্চস্বরে কুরআন পাঠ করে, যদ্বারা তাদের কষ্ট হয়।

بَابُ الْقَارِئِ يُحَافِظُ عَلَى جُزْئِهِ وَوِرْدِهِ مِنَ الْقُرْآنِ بِاللّيْلِ وَالنّهَارِ فِي صَلَاةٍ أَوْ غَيْرِ صَلَاةٍ.

পরিচ্ছেদ : কুরআনের পাঠক তার দিন-রাতের, সালাত সালাতের বাইরের কুরআন-তিলাওয়াতের অযীফা নিয়মিত আদায়ে সচেষ্ট থাকবে।

بَابُ مَا يُكْرَهُ لِلْقَارِئِ مِنَ الْمُبَاهَاةِ بِالْقُرْآنِ وَالتّعَمّقِ فِي إِقَامَةِ حُرُوفِهِ وَتَعْلِيمِهِ غَيْرَ أَهْلِهِ.

পরিচ্ছেদ : কুরআনের পাঠকারীর জন্য অনুচিত, গর্ব-অহংকারে লিপ্ত হওয়া, কুরআনের বর্ণমালার উচ্চারণে বাড়াবাড়ি করা, অনুপযুক্ত লোককে কুরআন শিক্ষা দেওয়া।

এই কয়েকটি শিরোনাম থেকেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, ইমাম আবু উবাইদ রাহ. এ কিতাবে হামিলীনে কুরআনের আদব-আখলাক-প্রসঙ্গটি কত গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছেন। উপরের প্রত্যেকটি শিরোনামের অধীনে হাদীস-আছার সনদের সাথে উদ্ধৃত হয়েছে।

উপরোক্ত শিরোনামগুলো থেকে আরো বোঝা যাচ্ছে যে, এখানে দুধরনের আদবই উল্লেখিত হয়েছে : এক. চালচলনের সাধারণ আদব। আর দুই. কুরআনের সাথে পালনীয় আদব।

হামিলীনে কুরআনকে যেমন কুরআনের সাথে আদব রক্ষা করতে হয় তেমনি জীবনযাত্রার সকল ক্ষেত্রে হামিলুল কুরআনসুলভ আদব-আখলাকের অধিকারী হতে হয়। এটি কুরআনের সাথে তার সম্পর্কের দাবি।

ইমাম আবু উবাইদ আলকাসিম ইব্ন সাল্লাম রাহ.-এর কিতাবটিকে নমুনা হিসেবে উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, হামিলীনে কুরআনের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে স্বতন্ত্র গ্রন্থ বা গ্রন্থের স্বতন্ত্র অধ্যায়ে রচনা ও আলোচনার ধারাও যে কত প্রাচীন তা তুলে ধরা। বিষয়টি সালাফের মুতাওয়ারাছফিকরের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর এমনটি হওয়াই স্বাভাবিক। কেননা তা কুরআন-সুন্নাহর শিক্ষা-নির্দেশনারই এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা তাদের বাণী ও রচনায় প্রোজ্জ্বলভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

তাফসীর, হাদীস, ফিকহ, উলূমুল কুরআন, উলূমুল হাদীস, উলূমুল ফিকহ প্রভৃতি শাস্ত্রের মনীষীগণের বিশিষ্টতা ও বিশেষজ্ঞতার ক্ষেত্র এবং তাদের রচনা ও সংকলনের বিষয়বস্তু ও বিন্যাসগত পার্থক্য ও বৈচিত্র্য সত্তে¡ও উপরোক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে অসাধারণ ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। এর গোড়ার কারণটি হচ্ছে ইসলামী ফন ও শাস্ত্রসমূহে নাম, শিরোনাম, বিষয়বস্তু ও উপস্থাপনাগত পার্থক্য থাকলেও সবগুলো শাস্ত্র কুরআন-সুন্নাহকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত এবং বিভিন্ন দিক থেকে তা কুরআন-সুন্নাহর উলূম ও মাআরিফ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিরই সংকলক, উপস্থাপক, ভাষ্যকার। কাজেই ইলমে ওয়াহীর মর্যাদা ও এর ধারক-বাহকগণের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলির আলোচনা সব শাস্ত্রেই প্রাসঙ্গিক। একারণে উলূমুল কুরআন হোক বা উলূমুল হাদীস, সব শাস্ত্রেই আলোচ্য বিষয়টি আমাদের মনীষীগণ প্রাসঙ্গিক মনে করেছেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আলোচনা করেছেন।

উলূমুল কুরআন বিষয়ে একটি গ্রন্থের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে । এবার উলূমুল হাদীস বিষয়ে একটি উদাহরণ দেখুন :

উলূমুল হাদীস সংক্রান্ত একটি প্রাচীন গ্রন্থ কাযী হাসান ইবনু আব্দির রহমান (মৃত্যু : ৩৬০ হিজরী) কৃতÑ

المحدث الفاصل بين الراوي والواعي

এ কিতাবে মৌলিকভাবে হাদীস-শাস্ত্রের নীতিমালা সংকলিত হলেও এর অনেক শিরোনাম সরাসরি আদব-সংক্রান্ত।

এ কিতাবের আলোচনাও শুরু হয়েছে হাদীস ও হাদীস বর্ণনাকারীদের মর্যাদার আলোচনার মধ্য দিয়ে। গ্রন্থকার তালিবানে ইলমে ওয়াহীকে উৎসাহিত করেছেনÑ তারা যেন পবিত্র সুন্নাহকে ধারণ করা ও তার অর্থ-মর্ম সঠিকভাবে বোঝার ব্যাপারে যতœবান হন। কারণ এই মহান ইলমের চর্চায় আত্মনিয়োগকারীদের মর্যাদা অনেক। এ প্রসঙ্গে তাঁর শিরোনামÑ

باب فضل الناقل لسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم

বাব : আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ বর্ণনাকারীগণের মর্যাদা।

باب الطالب لسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم

বাব : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ-অন্বেষীগণ।

باب النية في طلب الحديث

বাব : হাদীস-অন্বেষণে নিয়ত

باب أوصاف الطالب وسنة وآداب الطلب.

বাব : হাদীস-অন্বেষীর গুণাবলী, হাদীস-অন্বেষণের পন্থা আদব।

চার শিরোনামে রামাহুরমুযী রাহ. কুরআন মাজীদের অনেক আয়াত, হাদীস শরীফ আহলে ইলমের বাণী উদ্ধৃত করেছেন।

তাঁর আরেকটি শিরোনামÑ

القول في فضل من جمع بين الرواية والدراية

হাদীস ফিকহ উভয় শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জনকারীর মর্যাদা।

আরেকটি শিরোনামÑ

القول فيمن يستحق الأخذ عنه

অর্থাৎ কার কাছ থেকে (হাদীস) গ্রহণ করা যাবে।

এরপর বিভিন্ন শিরোনামে তাঁর আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, হিফযে হাদীসের গুরুত্ব, অনুপযুক্ত কারো কাছে হাদীস বর্ণনা না করা, হাদীসের সাথে সালাফের আদব রক্ষার বিভিন্ন দিক যেমন, নিয়ত ছাড়া হাদীস বর্ণনা করতে পছন্দ না করা, রাস্তায় চলার সময় হাদীস বর্ণনা অপছন্দ করা, রেওয়ায়েতের মজলিসে অজুর সাথে বসা ইত্যাদি। এরকম বহু শিরোনাম ও তথ্য এ গ্রন্থে সন্নিবেশিত হয়েছে।

উলূমুল হাদীস বিষয়ে বিখ্যাত মুহাদ্দিস আহমদ ইবনে আলী ইবনে ছাবিত আলখতীবুল বাগদাদী রাহ. (৪৬৩ হি.) লিখিত একটি গ্রন্থের নামÑ

الجامع لأخلاق الراوي وآداب السامع

গ্রন্থের নামের মধ্যেই দুটো শব্দ আছে : أخلاق الراوي হাদীস বর্ণনাকারী (শায়খ উস্তাদ)-এর আখলাক এবং آداب السامع অর্থাৎ হাদীস শ্রবণকারী (ছাত্র তালিবে ইলম)-এর আদব। নাম থেকেই গ্রন্থের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

খতীব বাগদাদী রাহ. তারীখ, তারাজিম, ইলালসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর সকল রচনাকে বিষয়ভিত্তিক বিন্যাসে বিন্যস্ত করা হলে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হবে ফকীহ মুহাদ্দিসের মর্যাদা কাম্য গুণাবলী। প্রসঙ্গে তাঁর একটি গ্রন্থের নাম شرف أصحاب الحديث আসহাবুল হাদীসের মর্যাদা। আরেকটি গ্রন্থÑ اقتضاء العلم العمل ইলমের দাবি আমল। আরেকটি গ্রন্থÑ الفقيه والمتفقه ফকীহ ফিকহ-অন্বেষী।

এছাড়া উলূমুল হাদীস বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থÑ الكفاية في علم الرواية -এও আদব-আখলাক সংক্রান্ত অনেক শিরোনাম প্রচুর আলোচনা আছে।

খতীব বাগদাদী রাহ.-এর

الجامع لأخلاق الراوي وآداب السامع.

গ্রন্থে মিকার পর প্রথম শিরোনামটি হচ্ছেÑ

باب النية في طلب الحديث

বাব : হাদীস-অন্বেষণে নিয়ত।

এরপর একটি শিরোনাম যা সরাসরি আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পৃক্তÑ

باب ذكر ما ينبغي للراوي والسامع أن يتميزا به من الأخلاق الشريفة

বাব : হাদীস বর্ণনাকারী (শায়খ) হাদীস শ্রবণকারী (তালিবে ইলম)-কে যে উন্নত আখলাকে বিশিষ্ট হতে হবে।

এরপর অন্যান্য প্রসঙ্গের পর একটি অধ্যায়ের শিরোনামÑ

باب آداب الطلب

বাব : (হাদীস) অন্বেষণের আদব।

অধ্যায়ে মোট চারটি শিরোনাম আছে। শিরোনামগুলো বেশ কৌতুহল উদ্দীপক।

البكور إلى مجالس المحدث

মুহাদ্দিসের মজলিসে সকাল সকাল যাওয়া।

مشي الطالب على تؤدة من غير عجلة

ছোটাছুটি না করে তালিবে ইলমের শান্তভাবে হেঁটে যাওয়া।

استعماله السمت وحسن الهدي

সুন্দর মার্জিত ভাব-ভঙ্গি অবলম্বন করা।

تشمير ثيابه وبذاذته في الهيئة

হালকা, অনাড়ম্বর বেশভষা অবলম্বন করা।

এরপরের অধ্যায়Ñ

باب الاستئذان على المحدث

বাব : হাদীস বর্ণনাকারী (শায়খের) কাছে অনুমতি চাওয়া।

এর অধীনের কিছু শিরোনামÑ

كيفية الوقوف على باب المحدث للاستئذان

অনুমতি চাওয়ার সময় মুহাদ্দিসের দরজায় কীভাবে দাঁড়াবে।

جواز طرق الباب وصفته.

দরজায় নক করার বৈধতা তার পদ্ধতি।

لفظ الاستئذان وتعريف الطالب نفسه.

অনুমতি চাওয়ার শব্দ এবং তালিবে ইলম নিজের পরিচয় দেওয়া।

فضل إفشاء السلام والقدر المستحب من رفع الصوت به.

সালামের প্রসার ঘটানোর ফযীলত এবং কেমন আওয়াজে সালাম দেওয়া কাম্য।

إذا استأذن الطالب فأمر بالانتظار أين يقعد.

তালিবের অনুমতি প্রার্থনার পর অপেক্ষা করতে বলা হলে কোথায় বসবে?

انتهاء الاستئذان الى ثلاث والانصراف بعدها لمن لم يؤذن له.

অনুমতি প্রার্থনা তিনবার, (এর মধ্যে) অনুমতি দেওয়া না হলে ফিরে যাওয়া।

এর পরের পরিচ্ছেদÑ

أدب الدخول على المحدث.

মুহাদ্দিসের কাছে প্রবেশের আদব।

এর অধীনের কিছু শিরোনাম হচ্ছেÑ

تقديم الأكابر في الدخول.

প্রবেশে বড়দের অগ্রাধিকার দেওয়া।

كراهة تسليم الخاصة.

(অন্যদের থেকে আলাদা করে) বিশেষ কাউকে সালাম দেওয়ার অপছন্দনীয়তা।

جلوس الطالب حيث ينتهي به المجلس والنهي عن تخطي الرقاب.

মজলিস যেখানে শেষ হয় সেখানে বসা, অন্যদের ঘাড় ডিঙ্গানোর অপছন্দনীয়তা।

الكراهة له أن يقيم رجلا ويجلس مكانه.

তালিবের জন্য কোনো ব্যক্তিকে উঠিয়ে তার জায়গায় বসার অপছন্দনীয়তা।

كراهة القعود في موضع من قام وهو يريد العود إلى المجلس.

কেউ পুনরায় ফিরে আসার ইচ্ছা নিয়ে উঠে গেলে তার জায়গায় বসা অপছন্দনীয় হওয়া।

 

الاستحباب للطالب أن يسلم على أهل المجلس إذا أراد الانصراف قبلهم.

মজলিসের উপস্থিতিকে সালাম করা মুস্তাহাব যখন তালিব তাদের আগে মজলিস ত্যাগ করার ইচ্ছা করে।

উপরের প্রত্যেকটি বিষয়ই আচরণবিধি নির্দেশ করছে।

এর পরের অধ্যায়Ñ

تعظيم المحدث وتبجيله.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়খের) প্রতি সম্মান সম্ভ্রম প্রদর্শন।

এর অধীনের কিছু শিরোনামÑ

هيبة الطالب للمحدث.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়েখের) প্রতি তালিবের শ্রদ্ধা সম্ভ্রমবোধ।

جواز القيام للمحدث.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়েখের) জন্য উঠে দাঁড়ানোর বৈধতা।

الأخذ بركاب المحدث.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়েখের) সওয়ারীর পা-দানী ধরা।

تقبيل يد المحدث ورأسه وعينيه.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়েখের) হাতে মাথায় দুই চোখে চুম্বন করা।

الاعتراف بحق المحدث.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়েখের) হক স্বীকার করা।

توقير مجلس الحديث.

হাদীসের মজলিসের ভাবমর্যাদা রক্ষা করা।

এরপরের অধ্যায়গুলোও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। সবগুলো তো এখানে উল্লেখ করা কঠিন। কিন্তু একটি অধ্যায়ের কথা না বললেই নয়। এর শিরোনামÑ

باب : الترغيب في إعارة الكتب وذم من سلك في ذلك طريق البخل والامتناع.

কিতাব ধার দেওয়ার তারগীব আর বিষয়ে কার্পণ্য অবলম্বনকারীর নিন্দা।

এর অধীনে দুটো শিরোনামÑ

كراهة حبس الكتب المستعارة عن أصحابها وما جاء في الأمر بتعجيل ردها إلى أربابها.

ধার নেয়া কিতাব আটকে রাখার অপছন্দনীয়তা এবং মালিকের কাছে তা দ্রæ ফেরত দেয়ার নির্দেশ।

شكر المستعير للمعير.

ধারে কিতাব গ্রহীতার দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।

বলুন, আমাদের সালাফ আচরণবিধির কোন্ অংশটা অনুক্ত রেখেছেন?

পাঠকের হয়তো ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটছে, তারপরও আরেকটু সময় নিয়ে নিচ্ছি। কারণ পর্যন্ত শিরোনামগুলো মৌলিকভাবে তালিবে ইলমের উদ্দেশে ছিল। শায়খের আদব-আখলাক সংক্রান্ত বেশ কিছু অধ্যায় এবং প্রচুর শিরোনামও কিতাবে আছে। এরকম একটি অধ্যায়ের শিরোনামÑ

ذكر أخلاق الراوي وآدابه وما ينببعي له استعماله مع أتباعه وأصحابه.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়েখের) আদব-আখলাকের বর্ণনা এবং সঙ্গী অনুসারীদের সাথে যা তার অবলম্বন করা কাম্য।

এরকম আরেকটি শিরোনামÑ

باب : توقير المحدث طلبة العلم وأخذه نفسه بحسن الاحتمال لهم والحلم.

ইলমের তালিবগণের প্রতি হাদীস বর্ণনাকারী শায়খের মর্যাদাপূর্ণ আচরণ এবং তাদের বিষয়ে সহনশীলতা সহিষ্ণুতার নীতি গ্রহণ।

باب : إصلاح المحدث هيئته وأخذه لرواية الحديث زينته.

হাদীস বর্ণনাকারী (শায়খ) আপন বেশভুষাকে পরিপাটি করা এবং হাদীস বর্ণনার জন্য সজ্জা গ্রহণ করা।

খতীব বাগদাদীর সমসাময়িক আরেকজন ইমাম ছিলেন ইমাম ইবনু আব্দিল বার রাহ. খতীব বাগদাদী ছিলেন পূবের, আর ইবনু আব্দিল বার পশ্চিমের। দুজনের মৃত্যুও একই বছর ৪৬৩ হিজরীতে। খতীব বাগদাদীরÑ

الجامع لأخلاق الراوي وآداب السامع.

-এর মতো ইবনু আব্দিল বার রাহ.-এর অনন্য গ্রন্থÑ

جامع بيان العلم وفضله وما ينبغي في روايته وحمله.

বোদ্ধা গবেষকদের অনেকেই খতীব বাগদাদীর কিতাবটির চেয়ে ইবনে আব্দিল বার রাহ.-এর গ্রন্থকে বিভিন্ন দিক থেকে অগ্রগণ্য করেন। এখানে ইবনু আব্দিল বার রাহ.-এর গ্রন্থ থেকেও কিছু নমুনা পেশ করা যেত; খতীব বাগদাদী রাহ.-এর কিতাব থেকে উদ্ধৃত নমুনাগুলোর চেয়ে সেগুলো হয়তো আরো আকর্ষণীয় হত, কিন্তু পাঠকবৃন্দের ধৈর্য্যরে উপর আর অত্যাচার না করে প্রসঙ্গটি শেষ করতে চাই। আগেই বলেছি কিতাবটির নামÑ

جامع بيان العلم وفضله وما ينبغي في روايته وحمله.

অর্থাৎ ইলমের পরিচয় মর্যাদা এবং তা ধারণ বর্ণনায় অনুসরণীয় নীতি-আদর্শ সংক্রান্ত বর্ণনা সংকলন।

দেখা যাচ্ছে, মাশরিক থেকে মাগরিব সব স্থানের সব কালের হামিলীনে ইলম যে বিষয়টিকে খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছেন তা হচ্ছে آداب حملة العلم হামিলীনে ইলমের আদব-আখলাক।

প্রতি যুগের সালাফে সালেহীনের এই ধারাবাহিকতারই এক মূল্যবান আংটা ইমাম নববী রাহ. রচিতÑ

التبيان في آداب حملة القرآن

ইমাম নববী রাহ. সপ্তম হিজরী শতকের বিখ্যাত মনীষী। আখলাকু হামালাতিল কুরআন বিষয়ে তাঁর আগেও অনেকে আলাদা গ্রন্থ রচনা করেছেন শিরোনামে প্রাচীন কিতাবসমূহের একটি হচ্ছে ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন ইবন আবদিল্লাহু আল আজুররী রাহ. (মৃত্যু : ৩৬০ হি.)-এর বিখ্যাত গ্রন্থÑ

أخلاق حملة القرآن.

কিতাবের শিরোনাম থেকেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে।

ইমাম আজুররী রাহ. কিতাবে কুরআনে কারীমের ফযীলত, কুরআন শেখা তিলাওয়াতের ফযীলত আলোচনার পাশাপাশি চর্চাকারীর সদগুণাবলী সম্পর্কে, যা তাদের অর্জন করতে হবে এবং মন্দ স্বভাব আচরণ সম্পর্কে, যা থেকে তাদের মুক্ত থাকতে হবেÑ বিস্তারিত হৃদয়গ্রাহী আলোচনা করেছেন। কুরআন শেখা শেখানোর আদব, কুরআন তিলাওয়াতের আদব প্রাসঙ্গিক অনেক বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।

কিতাবটিও মনীষী ইমামগণের কাছে সমাদৃত ছিল। তাঁরা এখান থেকে নকল করেছেন এবং এর উদ্ধৃতি দিয়েছেন। কিতাবটির মুহাক্কিক . গানিম কাদদূরী আলহামাদ লেখেনÑ

كما أن عددا من العلماء السابقين نقلوا من الكتاب وصرحوا باسم الكتاب واسم مؤلفه أو اسم المؤلف فقط، مثل الخطيب في تاريخ بغداد (/১৯৫) وعلم الدين السخاوي في جمال القراء (/১১৪-১২০) والسيوطي في الإتقان (/২৯৯) وشمس الدين السخاوي في المقاصد الحسنة ص ২৮৯...

ইমাম আজুররী রাহ.-এর আরেকটি কিতাবÑأخلاق العلماء পরবর্তী মনীষী ব্যক্তিগণ কিতাব থেকেও প্রচুর তথ্য বর্ণনা স্ব স্ব গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন। কিতাবটি শায়েখ ইসমাঈল ইবনে মুহাম্মাদ আনসারী রাহ.-এর সম্পাদনা টীকাসহ সৌদী আরবের

رئاسة إدارة البحوث العلمية والإفتاء والإرشاد.

থেকে প্রকাশিত হয়েছে। মিকায় শায়খ আনসারী বলেনÑ

وقد اعتنى الحافظ أبو نعيم في الحلية بذكر كثير من روايات الآجري فيه كما اعتنى الخطيب البغدادي في كتاب الفقيه والمتفقه بذلك، وذكر الحافظ ابن عبد البر في جامع بيان العلم وفضله بعض رواياته، فدل هذا الاعتناء من هؤلاء الأئمة أبي نعيم والخطيب وابن عبد البر على مكانة هذا الكتاب ومؤلفه عندهم...

উলামায়ে সালাফের এই মোবারক ধারারই একটি উত্তম নমুনা ইমাম ইয়াহইয়া ইবন শরফ আননাবাবী রাহ. (মৃত্যু : ৬৭৬ হি.) কৃত التبيان في آداب حملة القرآن

ইমাম নববী রাহ.-এর অন্যান্য গ্রন্থের মতো কিতাবটিও উলামা-সুলাহামহলে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উদ্ধৃতি-গ্রন্থ হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।

স্বয়ং ইমাম নববী রাহ. তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থে কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। শাফেয়ী মাযহাবের ফিকহের উপর তার বিখ্যাত রচনা المجوع - একাধিক জায়গায় তিনি কিতাবের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। আলমাজমূগ্রন্থের তহারাতঅধ্যায়ে জুনুব, হাইয মুহদিস ব্যক্তির কুরআন পাঠ শীর্ষক এক পরিচ্ছেদে (/১৬৯ শামিলা) তিনি বলেনÑ

وهذا الفصل من المهمات التي يتأكد لطالب الآخرة معرفتها وقد جمعت في هذا كتابا لطيفا وهو التبيان في آداب حملة القرآن وأنا أشير هنا إلى جمل من مقاصده ...

গ্রন্থেরই আরেক জায়গায় কিরাআতে মুতাওয়াতিরা কিরাআতে শাযযাহর মতো একান্ত শাস্ত্রীয় প্রসঙ্গেও আততিবয়ানের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। (দ্র. আলমাজমূ /৩৯২ শামিলা)

তাঁর আরেক মূল্যবান গ্রন্থ আলআযকার’-এও বিভিন্ন জায়গায় আততিবয়ানের উদ্ধৃতি আছে।

তাঁর পরে যেসকল মনীষী প্রসঙ্গে লিখেছেন সাধারণত তারাও কিতাবকে সামনে রেখেছেন এবং এর তথ্য আলোচনা স্ব স্ব গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন।

বর্তমানের বিভিন্ন ফিকহী মওসূআতেও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কিতাবের উদ্ধৃতি ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়।

এই মাকবুল গ্রন্থ, যা আমাদের উলামায়ে সালাফের মোবারক রচনাধারার এক উজ্জ্বল স্মারক, যুগ যুগ ধরে অসংখ্য মানুষ যা থেকে আলো গ্রহণ করেছেন আমরাও যেন তা থেকে উপকৃত হতে পারি। জীবন কর্মের জন্য কিছু পাথেয় সংগ্রহ করতে পারাই হচ্ছে সব কথার শেষ কথা।

আল্লাহ তাআলা নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে কুরআন-সুন্নাহর আদব-আখলাকের আলোকে জীবন কর্মকে আলোকিত করার এবং আমাদের রাব্বানী উলামা-মাশায়েখের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলার তাওফীক দান করুনÑ আমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

وصلى الله تعالى على خير خلقه محمد وعلى آله وأصحابه أجمعين، آمين.

 

 

 

advertisement