জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪২   ||   জানুয়ারি ২০২১

জুনায়েদ বাগদাদী রাহ.
সাধনামগ্ন জীবনের রূপ

মাওলানা মুহাম্মাদ তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

জুনায়েদ বিন মুহাম্মাদ আলবাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি। উপনাম আবুল কাসিম।  ২২০ হিজরীর দিকে তিনি বাগদাদে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা কাঁচের সামগ্রী বিক্রি করতেন বলে তাঁর এক পরিচয় ছিল ‘কাওয়ারীরী’ বা কাঁচওয়ালা। এছাড়া তাঁর নিজের ছিল কাপড়ের দোকান। সে হিসাবে তাঁর আরেক পরিচয় ‘আলখায্যায’ বা কাপড় বিক্রেতা।

জগদ্বিখ্যাত সূফি মনীষী হযরত সারী সাকাতী রাহ. ছিলেন তাঁর মামা। ছোটবেলা থেকেই তিনি মামার সযত্নসান্নিধ্য পেয়েছেন। ফলে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছেন শৈশবেই।

একবারের ঘটনা। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স তখন সাত বছর। মামা সারী সাকাতীর সামনে খেলছিলাম। তাঁর পাশে তখন কয়েকজন মানুষ। তারা কথা বলছিল শোকর প্রসঙ্গে। মামা সেখানে আমাকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, শোকর কাকে বলে?

আমি বললাম, ‘আল্লাহর কোনো নিআমতকে তাঁর নাফরমানিতে ব্যবহার না করা।’

উত্তর শুনে মামা বললেন, আমার ভয় হচ্ছে, এই আশ্চর্য প্রজ্ঞা-প্রতিভা তোমাকে না আবার কোনো পরীক্ষায় ফেলে দেয়।

হযরত জুনায়েদ বলেন, মামার এই মন্তব্যে সেদিন আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। -সিফাতুস সফওয়া, খ. ২, পৃ. ২৫১-২৫২

সাত বছরের বালকের মুখে শোকরের এই মর্মসমৃদ্ধ পরিচয় যেমন সুদূর ইঙ্গিত বহন করে, তেমনি অবাক করে হযরত সারী সাকাতী রাহ.-এর এই মন্তব্য।

মূলত আধ্যাত্মিক সাধনার পরিবেশ এবং মামার নেক দৃষ্টি ও তত্ত¡াবধান ছোটবেলা থেকেই তাঁকে মারিফাতের জ্ঞানে সিঞ্চিত করেছে।

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রাহ. ইলমে মারিফাতের সঙ্গে ইলমুল ফিকহেও ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী। ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর শিষ্য আবু সাওর রাহ.-এর কাছে তিনি ফিকহ পড়েছেন। এরপর তাঁর মজলিসে ফতোয়া প্রদানের দায়িত্বও পালন করেছেন। সে সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র বিশ বছর। -আররিসালাতুল কুশাইরিয়্যাহ, পৃ. ৪৩০

অসাধারণ মেধা প্রতিভা ও যোগ্যতার সঙ্গে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী। লোকসমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করতেন। হযরত সারী সাকাতী রাহ. তাঁকে বয়ান করতে বললে তিনি কিছুতেই সম্মত হতেন না। মানুষের সামনে কথা বলতে তাঁর খুব সংকোচ হত। তিনি বলেন, বয়ানের জন্য নিজেকে আমার কোনোভাবেই উপয্ক্তু মনে হত না। তখন একবার জুমার রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে স্বপ্নে দেখলাম। তিনি আমাকে বললেন, ‘তুমি মানুষের উদ্দেশে বয়ান কর।’ আমার ঘুম ভেঙে গেল। সকাল হওয়ার আগেই ছুটে গেলাম মামার কাছে। দরজার কড়া নাড়তেই মামা বললেন, আমার কথা তো শুনলে না, এখন তো বলা হয়েছে নাকি! -ওয়াফাইয়াতুল আ‘ইয়ান, খ. ১, পৃ. ৩৪৭

তাসাওউফ সাধনায় তিনি হযরত সারী সাকাতী রাহ. ছাড়াও সান্নিধ্য লাভ করেছেন সুবিখ্যাত সূফী মনীষী হযরত হারিস মুহাসিবী রাহ.-এর। মূলত তাসাওউফ শাস্ত্রে এই দুই মনীষীই তাঁর শিক্ষক। তবে সেকালের অনেক বুযুর্গ ব্যক্তির সোহবত লাভ করেছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-

সাধক মনীষীদের চারটি তবাকা আমি পেয়েছি। তাঁদের প্রত্যেক তবাকায় ছিল ত্রিশজন করে। মুহাসিবী ও তাঁর তবাকা। হাসান মাসূহী ও তাঁর তবাকা। সারী সাকাতী ও তাঁর তবাকা এবং ইবনুল কুরাইবী ও তাঁর তবাকা। -ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন, খ. ২, পৃ. ২৮০

[উল্লেখ্য, তবাকার বাংলা তরজমা ‘শ্রেণি’ করা যায়। তবে তবাকার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে পরিভাষায়।]

হযরত জাফর আলখুলদী রাহ. বলেন, জুনায়েদ যেমন তাসাওউফের উচ্চস্তরে উন্নীত, তেমনি অগাধ ইলমের অধিকারী। যদি তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান দেখ তাহলে ইলমের চেয়ে তা বেশি মনে করবে। আবার যদি তাঁর ইলম দেখ তাহলে দেখবে তা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশি। -সিফাতুস সফওয়া, খ. ২, পৃ. ২৫১

বিখ্যাত তর্কশাস্ত্রবিদ আবুল কাসিম আলকাবী বলেন, তোমাদের এক শায়েখকে আমি দেখেছি বাগদাদে। তার নাম জুনায়েদ। আমার দুই চোখ ইতিপূর্বে তাঁর মত আর কাউকে দেখেনি। সাহিত্যিকরা তাঁর মজলিসে বসে আছে শব্দ-বাক্যের লোভে। দার্শনিকরা আছে সূ² বিষয়াদির জ্ঞান লাভ করতে। কবিরা আছে ভাষা সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। আর তার্কিকরা তাঁর বিপুল জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে উপকৃত হওয়ার আশায়। -শাযারাতুয যাহাব, খ.  ২, পৃ. ২২৯

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রাহ. বলতেন, আমাদের ইলম কুরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে যুক্ত। যে ব্যক্তি কুরআন মুখস্থ করেনি, হাদীস লেখেনি, ফিকহ অর্জন করেনি সে অনুসরণযোগ্য নয়। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, খ. ১১ পৃ. ১৫৪

পেশায় তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী। বাজারে তাঁর কাপড়ের দোকান ছিল। কিন্তু ব্যবসা তাঁকে ইবাদত-যিকির থেকে বিমুখ করতে পারেনি। -সিফাতুস সফওয়া, খ. ২, পৃ. ২৫২

তিনি ত্রিশ বার হজ্ব করেছেন। প্রত্যেকবারই সফর করেছেন একা এবং পায়ে হেঁটে। -ওয়াফাইয়াতুল আ‘ইয়ান, খ. ১, পৃ. ৩৪৭

আবুল হাসান আলমাহলাবী একবার তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এত জ্ঞান ও মর্যাদা লাভ করলেন কীভাবে?

তিনি বললেন, ত্রিশ বছর ওখানে আল্লাহর সামনে বসে থেকে। একথা বলে তাঁর ঘরের একটি জায়গার দিকে ইশারা করলেন।

মূলত নির্জনে আল্লাহ তাআলার ইবাদত, ফরয নামাযের সঙ্গে বেশি পরিমাণে নফল নামায, তিলাওয়াত, যিকির ও মনীষীদের সান্নিধ্য তাঁকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সহায়তা করেছে। এ প্রসঙ্গে একবার তিনি বলেন, তাসাওউফ আমরা এমনিতেই হাসিল করিনি। ক্ষুধার যন্ত্রণা, দুনিয়াবিমুখতা, প্রিয় ও আনন্দের বিষয় পরিত্যাগের মাধ্যমে তা অর্জন করেছি। -সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, খ. ১১, পৃ. ১৫৫

একবারের ঘটনা। তিনি বলেন, আমি বাগদাদের শূনীযিয়া মসজিদে বসা। সেখানে আরো অনেক মানুষ। একটি জানাযার জন্য অপেক্ষা করছি। এমন সময় একজন ভিক্ষুককে দেখলাম, চেহারায় ইবাদতের ছাপ। মনে মনে বললাম, হায় যদি সে নিজের উপার্জনের উদ্দেশে কিছু করত!

সেই রাতে দৈনন্দিন ইবাদত, নামায, তিলাওয়াত ইত্যাদি করতে খুব কষ্ট হল। পুরো রাত জেগে বসে কাটালাম। এক পর্যায়ে খুব ঘুম পেল। স্বপ্নে সেই ভিক্ষুককে দেখলাম, লোকজন তাকে দস্তরখানে করে নিয়ে এসেছে। বলছে, খাও; এর গোশত খাও। তার গীবত তো করেছ।

আমি বললাম, গীবত করিনি তো। কেবল মনে মনে সেই কথা বলেছিলাম। তখন আমাকে বলা হল, তোমার কাছ থেকে এমনটিও তো শোভনীয় নয়। -তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা, খ. ২, পৃ. ২৬৩

বন্ধু যেমন বন্ধুর সামান্য অনাকাক্সিক্ষত আচরণেই মন খারাপ করে, তেমনি আল্লাহর ওলীদের বেলায় সামান্য ভুলও জটিল হয়ে যায়। সেজন্য আল্লাহ তাঁদেরকে ছোট্ট ভুলেও সতর্ক করেন। কখনো শাস্তি দেন। এটা তাঁর ভালবাসা ও মহব্বতেরই প্রকাশ।

হযরত জুনায়েদ বাগদাদী রাহ.-এর আমল, ইবাদত ও তাকওয়া-পরহেযগারির আশ্চর্য অনেক ঘটনা পাওয়া যায় জীবনীগ্রন্থগুলোতে। তাঁর কারামত ও বুযুর্গির ঘটনাও পাওয়া যায় অনেক। তবে নির্ভরযোগ্যতার বিষয় চিন্তা করে সবকিছু এখানে উল্লেখ করা হল না। আসলে আল্লাহর ওলীদের সবচে বড় গুণ হল, খোদাভীতি। তাঁদের জীবন ও কর্ম থেকে এই গুণের সবক নিতে পারলেই আমরা লাভবান হব বেশি।

জগদ্বিখ্যাত এই মনীষী ২৯৭ হিজরীতে বাগদাদেই ইনতিকাল করেন। মামা সারী সাকাতীর পাশে শূনীযিয়া মসজিদের প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়। 

আবু মুহাম্মাদ আলহারীরী রাহ. বলেন, ইনতিকালের সময় আমি জুনায়েদের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সেটি ছিল জুমার দিন। তিনি কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন।

আমি বললাম, হে আবুল কাসিম! নিজের প্রতি রহম করুন। (অর্থাৎ তিলাওয়াত করতে তো আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে। সেজন্য একটু শান্ত হোন)।

তিনি বললেন, হে আবু মুহাম্মাদ! এই মুহূর্তে আমার চেয়ে বেশি তিলাওয়াতের প্রয়োজন এমন আর কাউকে দেখছি না। এখন তো আমার আমলনামা গোটানো হচ্ছে।

তখন তিনি এক খতম তিলাওয়াত করে নতুন আরেক খতম শুরু করেছিলেন। সূরা বাকারার সত্তর আয়াত তিলাওয়াত করার পরই (২৯৭ হিজরীতে) এই ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। -ওয়াফায়াতুল আইয়ান, খণ্ড : ২ পৃষ্ঠা : ৩৪৮

আবু জাফর আলখুলদী রাহ. বলেন, ইনতিকালের পর তাঁকে একদিন স্বপ্নে দেখলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ আপনার সঙ্গে কী আচরণ করেছেন?

তিনি বললেন-

طَاحَتْ تِلْكَ الْإشَارَاتُ وَغَابَتْ تِلْكَ الْعِبَارَاتُ وَفَنِيَتْ تِلْكَ الْعُلُوْمُ وَنَفِدَتْ تِلْكَ الرّسُوْمُ وَمَا نَفَعَنَا إِلّا رُكَيْعَات كُنّا نَرْكَعُهَا فِى السّحرِ.

সেইসব ইশারা মিটে গেছে, বাক্যাবলী সব হারিয়ে গেছে, জ্ঞান-বিদ্যা উধাও হয়ে গেছে, অদৃশ্য হয়ে গেছে সব কীর্তি ও কর্ম, কেবল উপকার করেছে শেষরাতের রাকাতগুলো। -তাবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা, খ. ২, পৃ. ২৬৭

 

 

advertisement