জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪২   ||   জানুয়ারি ২০২১

আমল কবুলের কয়েকটি শর্ত

মাওলানা শিব্বীর আহমদ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ¦উপলক্ষে তখন মক্কা মুকাররমায় অবস্থান করছিলেন। একদিন তিনি অসুস্থ সাহাবী সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.-কে দেখতে গেলেন। হযরত সা‘দ রা. এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, যার ফলে তিনি মৃত্যুর আশঙ্কা করছিলেন। তিনি ছিলেন প্রচুর সম্পদের অধিকারী। তার মৃত্যুর পর ওয়ারিস হওয়ার মতো ছিল তার একটি মাত্র কন্যা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাকে দেখতে গেলেন, তিনি তাঁকে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমার যে কী কষ্ট হচ্ছে, তা তো আপনি দেখতেই পাচ্ছেন। মনে হচ্ছে আর বাঁচব না। আমার প্রচুর সম্পদ রয়েছে। অথচ আমার একটি মাত্র মেয়ে ছাড়া আমার ওয়ারিস হওয়ার আর কেউ নেই। এমতাবস্থায় আমি কি আমার সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ সদকা করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, তবে আমি অর্ধেক দান করে দিই? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবারও বললেন, না। এবারে তিনি জানতে চাইলেন, তবে এক তৃতীয়াংশ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এক তৃতীয়াংশই তো অনেক। এরপর বললেন-

إِنَّكَ أَنْ تَذَرَ وَرَثَتَكَ أَغْنِيَاءَ خَيْرٌ مِنْ أَنْ تَذَرَهُمْ عَالَةً يَتَكَفَّفُونَ النَّاسَ وَلَسْتَ تُنْفِقُ نَفَقَةً تَبْتَغِي بِهَا وَجْهَ اللهِ إِلاَّ أُجِرْتَ بِهَا حَتّى اللّقْمَةَ تَجْعَلُهَا فِي فِي امْرَأَتِكَ.

সন্দেহ নেই, তোমার ওয়ারিসদেরকে তুমি যদি এমন অভাবীরূপে রেখে যাও, যার ফলে তারা মানুষের কাছে হাত পাতবে, এ অবস্থার তুলনায় তাদেরকে তুমি সচ্ছলরূপে রেখে যাওয়া অনেক ভালো। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশায় তুমি যা কিছুই ব্যয়  করবে, তোমাকে এর প্রতিফল দেয়া হবে, এমনকি তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে যে লোকমাটি তুলে দাও সেজন্যেও তুমি পুরস্কার পাবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪০৯

এ হাদীসে আমরা দেখতে পাই :

এক. দানসদকার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ আমলেও ভারসাম্য রক্ষা করতে বলছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! পবিত্র কুরআন ও হাদীসের কত জায়গায় কতভাবে এ দানসদকার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে! অথচ সাহাবী সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. যখন তার সম্পদের অধিকাংশ—তিন ভাগের দুই ভাগ সদকা করে দিতে চাইলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাতে অনুমতি দিলেন না। প্রত্যাখ্যাত হল অর্ধেক সম্পদ দান করে দেয়ার প্রস্তাবও। অবশেষে এক তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করার অনুমতি দিলেন আর বলে দিলেন—এতটুকুই অনেক! হযরত সাদ রা.-এর যে এর পেছনে নিজের মেয়েকে ঠকানোর মতো কোনো মন্দ উদ্দেশ্য ছিল না—তা বলাবাহুল্য। মন্দ উদ্দেশ্য থাকলে তিনি বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে উপস্থাপন করতেন না। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করার পরও যা থাকবে, এক মেয়ের জন্যে অতটুকুই অনেক। বোঝা যাচ্ছে, একটি আমল আল্লাহ তাআলার নিকট মাকবুল ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য কেবল নিয়তের শুদ্ধতাই যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয় বিশুদ্ধ নিয়তের পাশাপাশি আমলটি নেক ও সুন্দর হওয়াও। এজন্যে বরং জরুরি—বিশুদ্ধ নিয়ত ও সুন্দর আমলের পাশাপাশি আমলের পদ্ধতিটিও সুন্দর হওয়াসুন্নাহসম্মত ও শরীয়তের নির্দেশিত পন্থায়  হওয়া। এ তিনের মিশেলেই আমলটি আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য হবে। প্রিয় সাহাবী অসুস্থতার তীব্রতায় যখন মৃত্যুর আশঙ্কা করছিলেন, সে মুহূর্তে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবেই তাকে একটি ভালো আমলের সুন্দর পদ্ধতি নির্দেশ করেছিলেন। তিনি তাকে বলেছিলেন, দান করতে চাইলে করো, তবে তা তোমার সম্পদের এক তৃতীয়াংশের বেশি নয়। ইসলামী শরীয়তে মৃত্যুকালে সম্পদ দান করা কিংবা মৃত্যুপরবর্তী সময়ের জন্যে ওসিয়ত করার ক্ষেত্রে এটাই স্বীকৃত পন্থা—ওসিয়ত বা দান করতে হবে রেখে যাওয়া সম্পদের  অনধিক এক তৃতীয়াংশ। বাকিটুকু রেখে যেতে হবে ওয়ারিসদের জন্য।

দুই. নিয়ত যখন বিশুদ্ধ হয়, বাহ্যত মামুলি বিষয়ও হয়ে ওঠে অনেক মূল্যবান। হাদীসে দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা হয়েছে স্ত্রীর মুখে খাবারের লোকমা তুলে দেয়ার কথা। এক বিবেচনায় এটা এমন আর কী কাজ! আবার স্ত্রীর খাবারের ব্যবস্থা করা, তার পোশাকাশাক ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা—এসব তো স্বামীর স্বাভাবিক দায়িত্বের অংশ। স্বামী যখন নিজের কাঁধে অর্পিত সে দায়িত্বটুকু পালন করছে আর ভাবছে এর মধ্য দিয়ে আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের কথা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্যমতে, তার এ কাজটুকুও পুরস্কারযোগ্য!

নিয়তের বিশুদ্ধতায় বাহ্যত একটি তুচ্ছ কাজ যেমন ফযীলতে-মর্যাদায় মূল্যবান হয়ে উঠতে পারে, তেমনি দৃশ্যত অনেক মূল্যবান কাজও নিয়তের অশুদ্ধতায় হয়ে পড়তে পারে মূল্যহীন। এর দৃষ্টান্তও বর্ণিত হয়েছে হাদীস শরীফে। হাদীসটি বিখ্যাত এবং বহুল চর্চিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন—

إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّةِ وَإِنَّمَا لاِمْرِئٍ مَا نَوَى فَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ فَهِجْرَتُهُ إِلَى اللهِ وَرَسُولِهِ وَمَنْ كَانَتْ هِجْرَتُهُ لِدُنْيَا يُصِيبُهَا أَوِ امْرَأَةٍ يَتَزَوَّجُهَا فَهِجْرَتُهُ إِلَى مَا هَاجَرَ إِلَيْهِ.

সকল আমল নিয়ত অনুসারেই মূল্যায়িত হয়। আর প্রত্যেকে তা-ই পাবে, যা সে নিয়ত করেছে। ফলে যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে (অর্থাৎ তাঁদের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে) হিজরত করে, তার হিজরত আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে হয়েছে বলেই বিবেচিত হবে। আর যে হিজরত করে, পার্থিব কোনো বিষয় হাসিল করার জন্য, কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার লক্ষ্যে, তার হিজরতের মধ্য দিয়ে সে কেবল তার উদ্দিষ্ট বিষয়ই হাসিল করতে পারবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯০৭

হিজরত মানে স্বদেশ ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। এ চলে যাওয়াটা সাময়িক নয়, স্থায়ী। মক্কার কাফেরদের অত্যাচারে মুসলমানরা যখন অতিষ্ঠ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন অনুসারী মুসলমানদের নিয়ে আল্লাহর হুকুমে মদীনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন। এ হিজরত ছিল তখন ঈমানের মানদণ্ডসামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও যারা তখন হিজরত না করে মক্কাতেই অবস্থান করছিল, তাদের সম্পর্কে নাজিল হয়েছিল পবিত্র কুরআনের এ সতর্কবাণী—

اِنَّ الَّذِیْنَ تَوَفّٰىهُمُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ ظَالِمِیْۤ اَنْفُسِهِمْ قَالُوْا فِیْمَ كُنْتُمْ  قَالُوْا كُنَّا مُسْتَضْعَفِیْنَ فِی الْاَرْضِ    قَالُوْۤا اَلَمْ تَكُنْ اَرْضُ اللهِ وَاسِعَةً فَتُهَاجِرُوْا فِیْهَا فَاُولٰٓىِٕكَ مَاْوٰىهُمْ جَهَنَّمُ وَ سَآءَتْ مَصِیْرًا.

সত্যি, নিজেদের ওপর জুলুমরত অবস্থায় ফেরেশতারা যাদের মৃত্যু ঘটায় (তাদেরকে) তারা বলে, তোমরা কী অবস্থায় ছিলে? তারা বলে, আমরা পৃথিবীতে অসহায় ছিলাম। তারা বলে, আল্লাহর পৃথিবী কি প্রশস্ত ছিল না যে, তোমরা তাতে হিজরত করবে? এদের আশ্রয়স্থল জাহান্নাম, তা এক নিকৃষ্ট গন্তব্যস্থল! -সূরা নিসা (৪) : ৯৭ [দ্রষ্টব্য : তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন]

অষ্টম হিজরী সনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মক্কা বিজয় করেন, তখন হিজরতের এ আবশ্যিকতা রহিত হয়ে যায়। কিন্তু এর আগে যখন মুমিনদের জন্য মক্কা থেকে হিজরত করা জরুরি ছিল, উপরোক্ত আয়াতের বর্ণনা মোতাবেক হিজরত না করার শাস্তি অনিবার্য জাহান্নাম, তখন মুসলমানদের একজন হিজরত করেছিলেন ‘উম্মে কায়েস’ নাম্মী এক নারীকে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। এতে সে পরিচিত হয়ে পড়ে ‘মুহাজিরে উম্মে কায়েস’ নামে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ হাদীসে এমন হিজরত সম্পর্কেই বলেছেন—পার্থিব কোনো উদ্দেশ্যে কিংবা কোনো নারীকে বিয়ে করার মানসে যে হিজরত করবে, তার হিজরত আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সহায়ক হবে না, এ হিজরত ইসলামের জন্যে হিজরত হয়েছে বলে বিবেচিত হবে না, এ হিজরতের মধ্য দিয়ে সে কেবল তা-ই পাবে, যা সে নিয়ত করেছে।

এ হচ্ছে নিয়তের কারিশমা। নিয়তের শুদ্ধতা যেন এক পরশপাথর। এর সংস্পর্শে লোহা পরিণত হয় স্বর্ণ-হীরা-মনিমুক্তায়, তুচ্ছ কোনো আমলও হয়ে ওঠে মহামূল্যবান, ফযীলতে-মর্যাদায় ভাস্বর। আর এ শুদ্ধতায় যখন ঘাটতি থাকে, মূল্যবান আমলও মূল্য হারাতে থাকে। এ ঘাটতি যে পরিমাণে হয়, আমলের মূল্যও ততটাই কমতে থাকে। সোনা হয়ে যায় মাটি, এমনকি আরও তুচ্ছ!

নিয়তের শুদ্ধতার পাশাপাশি কর্মপদ্ধতির শুদ্ধতাও যে জরুরি—এ প্রসঙ্গে আরেকটি উদাহরণ দিই। তিন সাহাবী একদিন গেলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাড়িতে। তারা জানতে চাইলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন ইবাদত করেন? তাদেরকে যখন বিষয়টি জানানো হল, তখন তাদের দৃষ্টিতে ইবাদতের সে পরিমাণ যেন কম মনে হল। তারা তখন নিজেরাই বলাবলি করল—তিনি তো আল্লাহর রাসূল! তাঁর আগের-পরের সকল গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তাঁর সঙ্গে কি আর আমাদের তুলনা চলে?! এরপর তাদের একজন বলল, এখন থেকে আমি সারারাত কেবলই নামায আদায় করব। আরেকজন বলল, আমি সারাবছর রোযা রাখব। তৃতীয়জন বলল, আমি কখনোই বিয়ে করব না। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপস্থিত হলেন। তাদেরকে তিনি বললেন-

أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللهِ إِنِّي لأَخْشَاكُمْ لِلهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ لَكِنِّي أَصُومُ وَأُفْطِرُ وَأُصَلِّي وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوّجُ النِّسَاءَ فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِي فَلَيْسَ مِنِّي.

তোমরাই তো এমন এমন কথা বলছিলে, তাই না? শোনো, আল্লাহর কসম, আমিই তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করি, তোমাদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বড় মুত্তাকী। অথচ আমি রোযা রাখি, রোযা ছাড়ি, (রাতে) নামায পড়ি, আবার ঘুমাই, আমি বিয়েও করি। তাই যে আমার সুন্নত থেকে বিমুখ হয় সে আমার দলভুক্ত নয়! -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫০৬৩

হাদীসের বর্ণনায় কোনো জটিলতা নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে তিনজন সাহাবীকে এখানে তাঁর সুন্নত থেকে বিমুখ হওয়ার বিষয়ে সতর্ক করেছেন তারা কেউই কোনো মন্দ চিন্তা বা ইচ্ছা করেননি। তারা একটু বেশি পরিমাণে ইবাদতই করতে চেয়েছিলেন। ইবাদতের মধ্যে নিজেদের সবটুকু সাধ্য বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আর এক্ষেত্রে নিজেরা যেভাবে ভালো মনে করেছেন সেভাবেই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতিকে শুধরে দিয়েছেন। সংক্ষিপ্ত এ কথায় তাদেরকে তিনি এ বার্তা দিয়েছেন—তোমাদের মধ্য থেকে আমিই সর্বাধিক আল্লাহভীরু, তা সত্তে¡ও আমি সারাবছর লাগাতার রোযা রাখি না, সারারাত জেগে কেবলই নামায পড়ি না, আমি মাঝেমধ্যে রোযা ছেড়ে দিই, রাতে আমি বিছানায় যাই, আমি বিয়েশাদিও করেছি, অন্যসব মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনই আমি যাপন করি। তাই আল্লাহকে পেতে চাইলে, আমার দলভুক্ত থাকতে চাইলে তোমাদের সামনেও একই পথ। অধিক পরিমাণে ইবাদত করার জন্যে বিয়ে না করা, নফল নামায পড়তে গিয়ে রাতে কখনোই না ঘুমানো, নফল রোযা বছরের কোনো দিনই বাদ না দেয়া। ইত্যাদি আমার পথ নয়।

এ হচ্ছে নিয়তের বিশুদ্ধতার পাশাপাশি যথার্থ কর্মপদ্ধতির অনিবার্যতার কথা। এ দুয়ের মাঝে আরেকটি বিষয়ও অপরিহার্য—সহীহ আমল। অর্থাৎ বিশুদ্ধ নিয়তে সহীহ আমলটি বিশুদ্ধ পদ্ধতিতে করতে হবে।

একটি আমল বাহ্যত যত সুন্দরই হোক, তা যদি শরীয়তসমর্থিত না হয়, তবে তা কখনোই আল্লাহর দরবারে গৃহীত হতে পারে না। শরিয়তপরিপন্থী কোনো আমল যদি চূড়ান্ত ইখলাস ও নিয়তের বিশুদ্ধতার সঙ্গে করা হয়, আল্লাহর কাছে তা গ্রহণযোগ্য নয়। এমন আমল হতে পারে দুই ধরনের। এক. যেখানে সরাসরি শরীয়তের বিরুদ্ধাচরণ করা হয়, স্পষ্ট কোনো পাপ বা নাফরমানিতে যদি কেউ জড়িয়ে পড়ে, এগুলো যে প্রত্যাখ্যাত, এটা নিয়ে কারও কোনো সংশয় থাকার কথা নয়উদাহরণস্বরূপ এখানে কুফর-শিরক ও এ ধরনের পাপের কথা বলা যায়।

দুই. যেখানে মূল কাজটি শরীয়তসমর্থিত হলেও অবস্থা ও পরিবেশের সঙ্গে মিলে তা শরীয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ হয়ে পড়ে। যেমন, মৃত কারও স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বলন। ঘরের অন্ধকার দূর করার জন্যে যে কেউ মোমবাতি জ্বালাতেই পারে। মোমবাতি জ্বালানো কোনো দূষণীয় কাজ নয়। কিন্তু অন্ধকার দূর করার পরিবর্তে মোমবাতি জ্বালিয়ে যখন মৃত কাউকে স্মরণ করার রেওয়াজ পালিত হয় তখন তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। যেসব রেওয়াজের শরয়ী ভিত্তি নেই, সেসব ক্ষেত্রে একই কথা।  আবার শরীয়তের কোনো নির্দেশনা ও ভিত্তি ছাড়াই যদি কেউ কোনো কাজকে সওয়াবের কাজ মনে করে এবং তা পালন করে, তবে তাও পরিত্যাজ্য। এমনকি একটি বৈধ কাজকে যখন কোনোরূপ দলীল-প্রমাণ ছাড়াই বিশেষ আমল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় তখন এ ভিত্তিহীনতার কারণে সে বৈধ কাজটিও অবৈধ হয়ে যায়। মৃতব্যক্তির জন্যে ঈসালে সওয়াব একটি প্রমাণিত বিষয়। এটি কেবল বৈধই নয়, শরীয়তের দৃষ্টিতে তা কাক্সিক্ষতও। কিন্তু এ ঈসালে সওয়াবের জন্যে যখন কোনো দিনক্ষণ নির্ধারিত করে নেয়া হয়, শরীয়তের নির্দেশনা অগ্রাহ্য করে কুরআন খতম আর দুআদরূদের আয়োজন করা হয়, ‘মেজবানি’র আয়োজন করা হয়, এগুলো তখন আর বৈধ থাকে না। এসব কাজকে আমরা বিদআত বলে থাকি। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ.

যে কেউ আমাদের দ্বীনে এমন কিছু যোগ করে, যা এতে ছিল না, সেসবই প্রত্যাখ্যাত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৬৯৭

মোটকথা, যে কোনো আমল আল্লাহ পাকের দরবারে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে চাইলে এ তিনটি বিষয় অপরিহার্য—নিয়তের বিশুদ্ধতা, আমলের বিশুদ্ধতা এবং কর্মপদ্ধতির বিশুদ্ধতা। পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকেও কোনো কাজের গ্রহণযোগ্যতার জন্যে সে কাজের শুদ্ধতা এবং এর শুদ্ধ কর্মপদ্ধতি অনিবার্য। এর কোনো একটি ছুটে গেলে কাক্সিক্ষত ফল হাসিল করা যায় না। আর আল্লাহ তাআলা যেহেতু অন্তর্যামী, তিনি আমাদের মনের কোণে লুকায়িত ভাবনাটুকুও জানেন, সঙ্গত কারণেই তাঁর দরবারে গৃহীত হওয়ার জন্যে নিয়তের শুদ্ধতা অনিবার্য। হ

 

 

advertisement