সফর ১৪৪২   ||   অক্টোবর ২০২০

মসিবতের চেয়ে নিআমতের পরীক্ষা বেশি কঠিন

মাওলানা ইমরান হুসাইন

বনী আদমের আসল আবাস জান্নাত। কিছু দিনের জন্য তাদের দুনিয়ায় পাঠানো হয়েছে। আবার আমাদেরকে জান্নাতে যেতে হবে। তবে এমনিতেই নয়, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে। 

দুনিয়া দারুল ইমতিহান-পরীক্ষার ক্ষেত্র। ভালো ও মন্দ, ফুল ও কাঁটার মিলনেই দুনিয়া। আনন্দ ও বেদনা, আলো ও অন্ধকার এখানে পাশাপাশি অবস্থান করে। মানুষের জীবনে কখনো সুখ আর সুখ, প্রাচুর্য আর প্রাচুর্য এবং কখনো বা দুঃখ-দুর্দশায় জর্জরিত হয়ে পড়ে জীবন। এ উভয় আবস্থা মিলেই মানুষের জীবন।

স্বাভাবিকভাবে আমরা দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক, অভাব-অনটন ইত্যাদিকেই কেবল আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা মনে করি। কিন্তু বাস্তবতা হল, দুঃখ-দুর্দশা, রোগ-শোক ইত্যাদি অনাকাক্সিক্ষত ও অপ্রীতিকর অবস্থা যেমন পরীক্ষা তেমনি সুখ-শান্তি, সম্পদ-প্রাচুর্য, আরাম-আয়েশ, স্বস্তি-সুস্থতা ইত্যাদি কাক্সিক্ষত ও প্রীতিকর অবস্থাও পরীক্ষার বিষয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনে কারীমে এবিষয়ে আমাদের সচেতন করেছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَ نَبْلُوْكُمْ بِالشَّرِّ وَ الْخَیْرِ فِتْنَةً .

আর আমি মন্দ ও ভালো দিয়ে তোমাদের পরীক্ষা করি। -সূরা আম্বিয়া (২১) : ৩৫

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম রাহ. বলেন, অর্থাৎ তোমরা যেসব বিষয় পছন্দ কর (যেমন, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, স্বস্তি-সুস্থতা, ধন-ঐশ্বর্য ইত্যাদি) এবং যা কিছু অপছন্দ কর (যেমন দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটন, রোগ-শোক ইত্যাদি) সবই পরীক্ষা।   উদ্দেশ্য- যাচাই করা যে, তোমরা পছন্দ ও কাক্সিক্ষত বিষয়ের শোকর কর কি না এবং অপছন্দ ও অনাকাক্সিক্ষত অবস্থায় সবর কর কি না। -তাফসীরে তবারী ১৪/৪৪০

ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, অর্থাৎ আমি কখনো তোমাদের উপর বিপদ-আপদ নাযিল করি এবং কখনো নিআমতরাজি দান করি। উদ্দেশ্য হল পরীক্ষা করা যে, নিআমত পেয়ে কে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে, আর কে অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে। এবং দুঃখ-কষ্টে কে সবর করে, আর কে নিরাশ হয়ে যায়। -তাফসীরে ইবনে কাসীর ৫/৩৪২

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-

مِنْهُمُ الصّٰلِحُوْنَ وَ مِنْهُمْ دُوْنَ ذٰلِكَ ؗ وَ بَلَوْنٰهُمْ بِالْحَسَنٰتِ وَ السَّیِّاٰتِ لَعَلَّهُمْ یَرْجِعُوْنَ.

তাদের মধ্যে কতক ছিল সৎকর্মশীল এবং কতক অন্য রকম। আমি তাদেরকে ভালো ও মন্দ অবস্থা দ্বারা পরীক্ষা করেছি, যাতে তারা (সঠিক পথের দিকে) ফিরে আসে। -সূরা আরাফ (৭) : ১৬৮

ইবনে জারীর তবারী রাহ. বলেন, এই আয়াতে হাসানাতবা ভালো অবস্থা দ্বারা উদ্দেশ্য- সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ ও সচ্ছলতা। আর সায়্যিআতবা মন্দ অবস্থা দ্বারা উদ্দেশ্য- দুঃখ-কষ্ট, বালা-মসিবত ও দরিদ্রতা। -তাফসীরে তবারী ১৩/২০৮-২০৯

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যে মানুষকে সুখ ও দুঃখ, বিপদ ও স্বস্তি, সুস্থতা ও অসুস্থতা, অভাব ও সচ্ছলতা ইত্যাদি বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত অবস্থা দিয়েছেন, এর উদ্দেশ্য- মানুষকে পরীক্ষা করা।

কারো জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও প্রাচুর্যে ঘেরা, কেউবা দুঃখ-দুর্দশায় ন্যুব্জ; কিন্তু পরীক্ষার ভেতর আছে সকলেই এবং সব অবস্থা-ই পরীক্ষার অবস্থা। রোগ-শোক, দৈন্য-দুর্দশা যে পরীক্ষা, মানুষ সাধারণত তা বোঝে। তাই এসব হালতে মানুষ সবর করার চেষ্টা করে। একে-অপরকে সবরের নসীহত করে। মানুষের দিল-মন তখন কিছুটা হলেও আল্লাহর দিকে রুজু হয়। এমনকি কাফের-মুশরিকরাও বড় বড় মসিবতের সময় আল্লাহকে ডাকতে শুরু করে। আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اِذَا غَشِیَهُمْ مَّوْجٌ كَالظُّلَلِ دَعَوُا اللهَ مُخْلِصِیْنَ لَهُ الدِّیْنَ  فَلَمَّا نَجّٰىهُمْ اِلَی الْبَرِّ فَمِنْهُمْ مُّقْتَصِدٌ  وَ مَا یَجْحَدُ بِاٰیٰتِنَاۤ اِلَّا كُلُّ خَتَّارٍ كَفُوْرٍ.

তরঙ্গমালা যখন তাদেরকে আচ্ছন্ন করে মেঘচ্ছায়ার মত তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তাঁর আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে। এরপর তিনি যখন তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে নিয়ে আসেন তখন তাদের কিছুসংখ্যক সরল পথে থাকে। (অবশিষ্ট সকলে পুনরায় শিরকে লিপ্ত হয়) আমার আয়াতসমূহ অস্বীকার করে কেবল এমন লোক, যে ঘোর বিশ্বাসঘাতক, চরম অকৃতজ্ঞ। -সূরা লুকমান (৩১) : ৩২

এর বিপরীত সুখ-শান্তি, ধন-সম্পদ, স্বস্তি-সুস্থতা ইত্যাদি নিআমত যে পরীক্ষার বস্তু, সাধারণত আমরা তা বুঝি না। বুঝলেও এসব নিআমতের কদর করি না। এর শোকর আদায়ের চেষ্টা করি না। অথচ আল-কুরআন কত চমৎকার শৈলী এবং কত বৈচিত্র্যপূর্ণ পদ্ধতিতে আমাদেরকে নিআমত ও প্রাপ্তির পরীক্ষার কথা স্মরণ করিয়েছে! ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّا جَعَلْنَا مَا عَلَی الْاَرْضِ زِیْنَةً لَّهَا لِنَبْلُوَهُمْ اَیُّهُمْ اَحْسَنُ عَمَلًا.

ভূপৃষ্ঠে যা কিছু আছে আমি সেগুলোকে তার জন্য শোভাকর বানিয়েছি, মানুষকে এ বিষয়ে পরীক্ষা করার জন্য যে, কে তাদের মধ্যে ভালো কাজ করে। -সূরা কাহ্ফ  (১৮) : ৭

অর্থাৎ পৃথিবীতে যত শোভা ও সৌন্দর্য, আরাম-আয়েশের যত উপকরণ, সবই পরীক্ষার বস্তু। এর মাধ্যমে যাচাই করা হবে- কে দুনিয়ার সৌন্দর্যে মাতোয়ারা হয়ে আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায়, আর কে এসব নিআমতকে আল্লাহ তাআলার হুকুমমত ব্যবহার করে নিজের জন্য আখেরাতের পুঁজি সঞ্চয় করে।

আমার প্রতি আল্লাহর যত দান ও ইহসান সবই আমার জন্য পরীক্ষা। আমার আকল বুদ্ধি বিদ্যা স্বাস্থ্য পরীক্ষার বস্তু। আমার হাত পা নাক কান চোখ যবান ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরীক্ষার জিনিস। সুখ-শান্তি, পদ-পদবী, অর্থ-সম্পদ, মান-মর্যাদা পরীক্ষার ক্ষেত্র। আল্লাহ তাআলা ফরমান-

اَلَمْ نَجْعَلْ لَّهٗ عَیْنَیْنِ ، وَ لِسَانًا وَّ شَفَتَیْنِ.

আমি কি তাকে (মানুষকে) দেইনি দুটি চোখ? এবং একটি জিহŸা ও দুটি ঠোঁট। -সূরা বালাদ (৯০) : ৮ ও ৯

অন্যত্র আল্লাহ তাআলা বলেন-

وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّمَاۤ اَمْوَالُكُمْ وَ اَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ  وَّ اَنَّ اللهَ عِنْدَهٗۤ اَجْرٌ عَظِیْمٌ۠.

জেনে রেখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর আল্লাহরই নিকট রয়েছে মহা পুরস্কার। -সূরা আনফাল (৮) : ২৮

এমনকি স্বামী ও স্ত্রীও একে অপরের জন্য পরীক্ষার বিষয়। হাদীস শরীফে এসেছে, বান্দা যখন আল্লাহ তাআলার সাথে সাক্ষাৎ করবে তখন আল্লাহ তাআলা তাকে বলবেন-

أَيْ فُلْ أَلَمْ أُكْرِمْكَ، وَأُسَوِّدْكَ، وَأُزَوِّجْكَ، وَأُسَخِّرْ لَكَ الْخَيْلَ وَالْإِبِلَ، وَأَذَرْكَ تَرْأَسُ وَتَرْبَعُ؟

হে অমুক! আমি কি তোমাকে সম্মান দান করিনি? আমি কি তোমাকে নেতা বানাইনি? আমি কি তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করিনি? আমি কি উট-ঘোড়া তোমার বশীভূত করিনি? আমি কি তোমাকে এই সুযোগ দিইনি যে, তুমি নেতৃত্ব দিবে এবং যুদ্ধলব্দ সম্পদের এক-চতুর্থাংশ গ্রহণ করে প্রাচুর্যের মাঝে জীবনযাপন করবে? -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৬৮

মোটকথা, আমার পুরো জীবনটাই পরীক্ষার ভেতর। সবসময় এবং সব হালতে আমি পরীক্ষারত। ভালো ও বাঞ্ছিত বিষয় যেমন পরীক্ষা, মন্দ ও অবাঞ্ছিত বিষয়ও পরীক্ষা। আর আল্লাহ তাআলা যত নিআমত দিয়েছেন সবকিছুর জন্যেই আমাকে জবাবদিহি করতে হবে। হিসাব দিতে হবে, এসব বিষয় কী কাজে, কোন্ পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়েছে! কুরআন মাজীদের ঘোষণা-

ثُمَّ لَتُسْـَٔلُنَّ یَوْمَىِٕذٍ عَنِ النَّعِیْمِ.

অতঃপর অবশ্যই সেদিন তোমাদেরকে নিআমতরাজি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। -সূরা তাকাসুর (১০২) : ৮

অর্থাৎ কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা প্রশ্ন করবেন, আমি দুনিয়াতে যাহেরী ও বাতেনী, দৈহিক ও আত্মিক এবং ছোট ও বড় যেসব নিআমত তোমাদেরকে দান করেছিলাম তোমরা এর কী হক আদায় করেছিলে? নিআমতদাতাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কতটুকু চেষ্টা করেছিলে?

আরেক আয়াতের বর্ণনা-

اِنَّ السَّمْعَ وَ الْبَصَرَ وَ الْفُؤَادَ كُلُّ اُولٰٓىِٕكَ كَانَ عَنْهُ مَسْـُٔوْلًا.

নিশ্চয় কান, চোখ ও অন্তর এর প্রতিটি সম্পর্কে (তোমাদের) জিজ্ঞেস করা হবে। -সূরা বনী ইসরাঈন (১৭) : ৩৬

হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে-

لاَ تَزُولُ قَدَمَا عَبْدٍ يَوْمَ القِيَامَةِ حَتّى يُسْأَلَ عَنْ عُمُرِهِ فِيمَا أَفْنَاهُ، وَعَنْ عِلْمِهِ فِيمَ فَعَلَ، وَعَنْ مَالِهِ مِنْ أَيْنَ اكْتَسَبَهُ وَفِيمَ أَنْفَقَهُ، وَعَنْ جِسْمِهِ فِيمَ أَبْلاَهُ.

কিয়ামতের দিন কোনো বান্দার পা ততক্ষণ পর্যন্ত নড়তে পারবে না, যতক্ষণ না তাকে (চারটি বিষয়ে) প্রশ্ন করা হবে, (এবং সে সেগুলোর যথাযত জবাব দেবে) ১. তার জীবন কোন্ কাজে ব্যয় করেছে। ২. তার ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে। ৩. তার সম্পদ কীভাবে অর্জন করেছে, আর কোন্ পথে খরচ করেছে। ৪. এবং তার শরীর (দৈহিক শক্তি) কোন্ কাজে নিঃশেষ করেছে।  -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫৮৪

সুতরাং যে যত বেশি নিআমতের অধিকারী তার দায়িত্ব তত বেশি, তার জবাবদিহি তত কঠিন। তাই সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্যে উল্লসিত হওয়ার সুযোগ নেই। হযরত আলী রা. বলেন-

يَا ابْن آدم لَا تفرح بالغنى وَلَا تقنط بالفقر وَلَا تحزن بالبلاء وَلَا تفرح بالرخاء فَإِن الذّهَب يجرّب بالنّار

হে আদমের বেটা! তুমি ধনাঢ্যতায় খুশি হয়ো না। দরিদ্রতায় হতাশ হয়ো না। বিপদ-মসিবতে পেরেশান হয়ো না। এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে উৎফুল্ল (উন্মত্ত) হয়ো না। কেননা স্বর্ণ আগুন দিয়ে পরখ করা হয়। -রিসালাতুল মুস্তারশিদীন, পৃ. ৮৫

বরং দুঃখ-কষ্ট ও অপ্রাপ্তির পরীক্ষার চেয়ে সুখ-শান্তি ও প্রাপ্তির পরীক্ষা আরো বেশি কঠিন। বালা-মসিবতের সময় দিল যতটা আল্লাহমুখী হয়, আরাম-আয়েশের সময় ততটা হয় না। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

وَاللهِ لاَ الْفَقْرَ أَخْشى عَلَيْكُمْ، وَلكِنْ أَخْشى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا، وَتُهْلِكَكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ.

তোমাদের ব্যাপারে দরিদ্রতার আশঙ্কা করি না। বরং আমার আশঙ্কা হয়, তোমাদের উপর অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্য হবে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের হয়েছিল। আর তোমরা প্রতিযোগিতা শুরু করবে, যেমন তারা করেছিল। তখন দুনিয়া তোমাদেরকে ধ্বংস করবে, যেমন তাদেরকে ধ্বংস করেছে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৫৮

অপর বর্ণনায় এসেছে-

وَتُلْهِيَكُمْ كَمَا أَلْهَتْهُمْ.

তখন দুনিয়া তোমাদেরকে (আখেরাত থেকে) গাফেল করে দেবে যেমন তাদেরকে করেছিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪২৫

বনী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তির ঘটনা তো প্রসিদ্ধই- যাদের একজন ছিল অন্ধ, অপরজন কুষ্ঠরোগী ও তৃতীয়জনের মাথায় টাক। তাদেরকে আল্লাহ তাআলা এসব রোগ দূর করে সুস্থতা ও সচ্ছলতা দান করলেন। এরপর পরীক্ষা করার জন্য মানুষরূপে একজন ফিরিশতা পাঠালেন। তখন অন্ধ লোকটি নিআমতের শোকর করেছিল। ফলে আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। আর বাকি দুজন অকৃতজ্ঞ হয়েছিল। ফলে আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৪৬৪

সুতরাং বোঝা গেল, সুখ-শান্তি, ধন-ঐশ্বর্য ও অন্যান্য ভালো অবস্থার  হক আদায় করে শোকর করা কঠিন। নিআমতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন, বিধায় এ পরীক্ষায় অধিকাংশ মানুষ সফল হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِعْمَلُوْۤا اٰلَ دَاوٗدَ شُكْرًا  وَ قَلِیْلٌ مِّنْ عِبَادِیَ الشَّكُوْر.

হে দাঊদের পরিবার! তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনার্থে কাজ কর। আমার বান্দাদের মাঝে শোকরগুযার লোক অল্পই। -সূরা সাবা (৩৪) : ১৩

আল্লামা মাজদুদ্দীন ফায়রুযাবাদী রাহ. বলেন, আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের কখনো পরীক্ষা করেন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দ্বারা, যাতে তারা শোকর করে। কখনো পরীক্ষা করেন দুঃখ-দৈন্য দিয়ে, যাতে তারা সবর করে। অতএব নিআমত ও মসিবত উভয়টাই পরীক্ষা। মসিবত আসলে সবর করতে হবে, আর নিআমত পেলে শোকর করতে হবে। তবে নিআমতের হক আদায় করে শোকর করার চেয়ে মসিবতে সবর করা সহজ। সুতরাং মসিবতের পরীক্ষার তুলনায় সুখ-শান্তির পরীক্ষা কঠিন। এজন্যেই তো হযরত উমর রা. বলেছেন-

بُلِيْنَا بِالضّرّاءِ فَصَبَرْنَا، وَبُلِيْنَا بِالسّراءِ فَلَمْ نَصْبِرْ.

আমাদের উপর বিপদের পরীক্ষা এসেছিল। তখন আমরা সবর করেছি। কিন্তু যখন আমাদের উপর সুখের পরীক্ষা এল তখন আমরা ছবর (শোকর) করতে পারিনি।

হযরত আলী রা. বলেছেন-

من وُسِّعَ عَلَيْهِ دُنْيَاهُ، فَلَمْ يَعْلَمْ أَنَّه قَدْ مُكِرَ به، فَهُوَ مَخْدُوْعٌ فِيْ عَقْلِه.

যাকে সচ্ছলতা দান করা হয়েছে, আর  সে বুঝতে পারেনি যে, তাকে পরীক্ষায় ফেলা হয়েছে তাহলে সে আত্মপ্রবঞ্চনার শিকার। -বাসাইরু যাবিত তামঈয ফী লাতাইফিল কিতাবিল আযীয ২/২৭৪-২৭৫ : রিসালাতুল মুস্তারশিদীন, (টীকা) পৃ. ৮৫-৮৯  

তাই সুখ ও সৌন্দর্য, জ্ঞান ও বুদ্ধি, পদ ও মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও স্বস্তি ইত্যাদি নিআমতের ব্যাপারে খুব সচেতন থাকতে হবে। নিআমত পেয়ে নিআতমতদাতাকে ভোলা যাবে না। আখেরাত সম্পর্কে গাফেল হওয়া যাবে না। অন্যথায় নিআমতের পরীক্ষায় আমি ব্যর্থ হয়ে যাব এবং এসব শান্তি ও প্রাপ্তি আমার জন্য ধ্বংস ও বরবাদি ডেকে আনবে এবং আমার পরিণাম বিনাশ করে দেবে।

মানুষ সবচেবেশি মহব্বত করে স্ত্রী ও সন্তানকে। তাদেরকে নিয়েই তার যত কল্পনা ও পরিকল্পনা। তাদের জন্যেই তার জীবন ও যৌবন সে তিলে তিলে ক্ষয় করে। এমন ভালবাসার মানুষগুলো ও তাদের ভালবাসার ক্ষেত্রগুলো পরীক্ষার বিষয়। এরা এবং এদের ভালবাসা যেন আল্লাহর হুকুম পালন এবং তাঁর সন্তুষ্টি লাভের পথে বাধা হতে না পারে- এ বিষয়ে যেন আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক হতে পারি- এজন্য আল্লাহ আমাদের এভাবে সতর্ক করেছেনে-

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلَادِكُمْ عَدُوًّا لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ .

হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কতক স্ত্রী ও কতক সন্তান তোমাদের শত্রæসুতরাং তোমরা তাদের সম্পর্কে সচেতন থাকো। -সূরা তাগাবুন (৬৪) : ১৪

তো যে স্ত্রী ও সন্তানের জন্য এত মহব্বত, যাদের জন্য মরণপণ এত সংগ্রাম, তারাই শত্রæতে পরিণত হতে পারে, যদি তাদের ভালবাসায় নিজের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করা হয়, আল্লাহর হক বা বান্দার হক নষ্ট করা হয়। আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন।

সুতরাং আত্মিক, দৈহিক, আর্থিক, ছোট, বড়, আল্লাহ যাকে যে নিআমত দান করেছেন সে নিআমতের শোকর করতে হবে এবং তা আল্লাহর হুকুমমত ব্যবহার করতে হবে।

যাকে আল্লাহ তাআলা বিদ্যা-বুদ্ধির নিআমত দান করেছেন তাকে ঐ জ্ঞান ও বিদ্যার হক ও দাবি কী- তা জেনে সেগুলো আদায় করার চেষ্টা করতে হবে।

যাকে আল্লাহ স্বাস্থ্য-সুস্থতা ও রূপ-গঠনের নিআমত দান করেছেন তাকে এর শোকর আদায়ের ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। এই নিআমত যেন তাকে অহংকারী না বানাতে পারে এবং যারা এ নিআমত পায়নি তাদের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব যেন পয়দা না হয়, সে ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।

তেমনি ইলম ও বিদ্যা অর্জন করে গর্বিত হওয়া যাবে না। যাকে আল্লাহ ইলমের ক্ষেত্রে তার মত মর্যাদা দান করেননি তার প্রতি যেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও অহংকারের আচরণ না হয়। এবং ইলম অনুযায়ী আমল থেকে গাফেল না হয়।

যে সুখ-শান্তি ও অর্থ-প্রাচুর্যের নিআমত পেয়েছে, সে যেন নিআমতের দাতাকে না ভোলে। আখেরাত থেকে গাফেল না হয়। শান্তি ও প্রাচুর্যের নিআমত পেয়ে খুশিতে মাতোয়ারা না হয়। এবং আরাম-আয়েশ ও  বিলাসিতায় মত্ত না হয়।

ঈমানদার পরকাল সম্পর্কে উদাসীন হতে পারে না এবং আয়েশ-বিলাসে মত্ত হতে পারে না। মুআয রা.-কে গভর্নর মনোনীত করে ইয়ামানে প্রেরণের সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছেন-

إِيّاكَ وَالتّنَعّمَ؛ فَإِنّ عِبَادَ اللهِ لَيْسُوا بِالْمُتَنَعِّمِينَ .

খবরদার! বিলাসিতার ধারে-কাছেও যাবে না। আল্লাহর বান্দাগণ কখনো বিলাসী হতে পারে না। -মুসনাদে আহমদ, হাদীস ২২১০৫

বিলাসিতা ও আরাম-আয়েশের কথা যেহেতু এসে গেছে সেহেতু এ সম্পর্কে আরেকটি কথা আলোচনা করা সঙ্গত মনে হচ্ছে। তা হল, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থের প্রাচুর্যে উল্লসিত হয়ে আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতায় মত্ত হওয়া খুব মন্দ স্বভাব। কেননা আয়েশ-বিলাস আলসেমির জন্ম দেয়, অহমিকায় লিপ্ত করে, পরকাল  থেকে উদাসীন করে এবং পাপাচারের দ্বার উন্মুক্ত করে। এমনকি কখনো কখনো কুফর পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

وَإِذَا أَرَدْنَا أَنْ نُهْلِكَ قَرْيَةً أَمَرْنَا مُتْرَفِيهَا فَفَسَقُوا فِيهَا فَحَقَّ عَلَيْهَا الْقَوْلُ فَدَمَّرْنَاهَا تَدْمِيرًا .

যখন কোনো জনপদকে ধ্বংস করার ইচ্ছা করি তখন তাদের বিত্তবান লোকদেরকে (ঈমান ও আনুগত্যের) হুকুম দিই, কিন্তু তারা তাতে নাফরমানী করে, ফলে তাদের সম্পর্কে (পূর্ব নির্ধারিত) কথা সাব্যস্ত হয়ে যায় এবং আমি তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলি। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ১৬

অর্থাৎ কোনো সম্প্রদায় যখন নিজেদের অযোগ্যতা ও অপকর্মের কারণে ধ্বংসের উপযোগী হয়ে যায় তখন তাদেরকে আরাম-আয়েশের উপকরণ আরো বাড়িয়ে দিই এবং তাদেরকে ঈমান ও আনুগত্যের হুকুম করি। কিন্তু তারা আমার আনুগত্য করে না, আখেরাত নিয়ে ফিকির করে না। বরং এসব নিআমত পেয়ে তাদের উল্লাস ও অহমিকা আরো বেড়ে যায় এবং পাপ-পঙ্কিলতার মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়। তখন তাদের উপর আমার আযাব নেমে আসে, যা অবাধ্যদের জন্য পূর্ব থেকে নির্ধারিত।

সূরা ওয়াকিয়ায় পরকালে কাফেরদের যে শাস্তি দেওয়া হবে- এর কিছু বিবরণ দিয়ে শাস্তির কারণ হিসাবে তিনটা বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে- আয়েশ-বিলাস, কুফর-শিরক ও পুনরুত্থান অস্বীকার। ইরশাদ হয়েছে-

اِنَّهُمْ كَانُوْا قَبْلَ ذٰلِكَ مُتْرَفِیْنَ وَ كَانُوْا یُصِرُّوْنَ عَلَی الْحِنْثِ الْعَظِیْمِ وَ كَانُوْا یَقُوْلُوْنَ  اَىِٕذَا مِتْنَا وَ كُنَّا تُرَابًا وَّ عِظَامًا ءَاِنَّا لَمَبْعُوْثُوْنَ.

ইতিপূর্বে তারা ছিল আরাম-আয়েশের ভেতর। অতি বড় পাপের (কুফর ও শিরকের) উপর তারা অনড় থাকত। এবং বলত, আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও অস্থিতে পরিণত হব, তখনও কি আমাদেরকে পুনরায় জীবিত করা হবে? এবং আমাদের বাপ-দাদাদেরকেও, যারা পূর্বে গত হয়ে গেছে? -সূরা ওয়াকিয়া (৫৬) : ৪৫-৪৮

এখানে পরকালে কাফের ও মুশরিকদের যে শাস্তি দেওয়া হবে এর কারণ হিসাবে প্রথমে আয়েশ-বিলাসকে উল্লেখ করা হয়েছে। এরপর কুফর-শিরক ও পুনরুত্থান অস্বীকারের বিষয় বিবৃত হয়েছে। অথচ সৌখিনতা ও বিলাসিতা তো জাহান্নামী হওয়ার মূল কারণ নয়। জাহান্নামে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে কুফর ও শিরক। এরপরও পরকালের আযাবের কারণ হিসাবে সৌখিনতাকে উল্লেখ করা হয়েছে এবং প্রথম কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কাফেররা নিআমত পেয়ে ভোগ-বিলাস ও সৌখিনতায় মত্ত হয়েছিল। আর এ বিলাস-মত্ততা তাদেরকে আরো বেশি কুফর ও শিরকে লিপ্ত করেছিল। তাই প্রকারান্তরে সৌখিনতা ও বিলাসিতা জাহান্নামের শাস্তি ভোগের এক বড় কারণ।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতের ব্যাপারে অর্থ-সম্পদের প্রাচুর্যের  কারণে ফেতনার যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উপরের আলোচনায় তার বাস্তবতা সামনে এসেছে। ধন-ঐশ্বর্য, সুখ-প্রাচুর্য যে মানুষকে আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতায় মত্ত করে পরকাল থেকে উদাসীনতা সৃষ্টি করে এবং ঈমান-আমলে অবক্ষয় নিয়ে আসে তা বোঝার জন্য বনী ইসরাঈলের ঘটনা এবং কুরআনের বিবরণ দেখার প্রয়োজন নেই। এমনকি আরববিশ্ব ও অন্যান্য উন্নত মুসলিম বিশে^র দিকে তাকানোরও দরকার নেই। আপনার আশপাশে নযর বুলালেই দেখতে পাবেন যে, বিত্তবান ও সুখী-সচ্ছল বিলাসীরা কীভাবে দুনিয়ার জীবন ও ভোগ-বিলাসে বিভোর হয়ে আত্মবিস্মৃতির শিকার হচ্ছে, নিআমতদাতাকে ভুলে যাচ্ছে! তাদের ঈমান-আমলে কীভাবে পচন ধরছে, আখলাক-চরিত্রে ধ্বস নামছে!

তাদের অবস্থা দেখে মনে হবে, তারা যেন ঐ কাফের সম্প্রদায়ের প্রতিচ্ছবি, যাদের আড়ম্বরপূর্ণ বাড়ি-ঘর ও ভোগ-বিলাসের বিবরণ দিয়ে আল্লাহ তাআলা তাদের  অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে-

لَعَلَّكُمْ تَخْلُدُونَ .

যেন তোমরা (পৃথিবীতে) চিরজীবী হয়ে থাকবে। -সূরা শুআরা (২৬) : ১২৯

সুতরাং ভোগ-বিলাস, আরাম-আয়েশ ও সৌখিনতায় ডুবে যাওয়া মুমিনের শান নয়, কাফেরের স্বভাব, পাপাচারের দ্বার এবং জাহান্নামে যাওয়ার কারণ।

মোটকথা, আল্লাহ তাআলা -যাহেরী-বাতেনী, ছোট-বড়- যত নিআমত দান করেছেন ঐ নিআমতের শোকর করব। এর হক ও দাবিগুলো জেনে সেসব আদায় করার চেষ্টা করব। এভাবে যদি আমরা কষ্ট-ক্লেশ, বিপদ-মসিবত ইত্যাদি প্রতিকূল ও অবাঞ্ছিত অবস্থায় সবর করি এবং সুখ-শান্তি, স্বস্তি-সুস্থতা ইত্যাদি অনুকূল ও বাঞ্ছিত অবস্থায় শোকর করি তাহলে নিআমত ও মসিবত সবই আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে, আখেরাতের পাথেয় হবে এবং মর্তবা বুলন্দির কারণ হবে। মুমিন এমনই হয়- এটিই বাঙময় হয়েছে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ বাণীতে-

عَجَبًا لِأَمْرِ الْمُؤْمِنِ، إِنّ أَمْرَهُ كُلّهُ خَيْرٌ، وَلَيْسَ ذَاكَ لِأَحَدٍ إِلّا لِلْمُؤْمِنِ، إِنْ أَصَابَتْهُ سَرّاءُ شَكَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ، وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرّاءُ صَبَرَ، فَكَانَ خَيْرًا لَهُ.

ঈমানদারের অবস্থা কী অপূর্ব! তার সবকিছুই তার জন্য কল্যাণকর। আর এ শুধু মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য। যদি সে সুখ-সচ্ছলতা পায় তাহলে শোকর করে, ফলে তা তার জন্য কল্যাণের হয়। আর যদি দুঃখ-অনটনের শিকার হয় তাহলে সবর করে, ফলে তা-ও তার জন্য কল্যাণের হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৯৯৯

 

আল্লাহ তাআলা আপন রহমতে সকল মুমিন-মুসলিমকে মসিবত ও নিআমতের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করুন। সমস্ত খায়ের ও কল্যাণ দান করুন এবং সকল শার ও অকল্যাণ থেকে হেফাযত করুন- আমীন।

 

 

advertisement