মুহাররম ১৪৪২   ||   সেপ্টেম্বর ২০২০

দরসে হাদীস
পার্থিব জীবনে মুমিন

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ

عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا، قَالَ: أَخَذَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ بِمَنْكِبِي، فَقَالَ: كُنْ فِي الدّنْيَا كَأَنّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ.

وَكَانَ ابْنُ عُمَرَ، يَقُولُ: إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.

আজকের দরসে যে হাদীসটি পাঠ করেছি, তা একটি বিখ্যাত হাদীস। আমাদের অনেকেরই তা মুখস্থ আছে। অন্তত এর সরল ভাব ও মর্ম তো প্রায় সকলেরই জানা আছে।

হাদীসের ইমামগণ স্ব স্ব গ্রন্থে এই মোবারক হাদীসটি সংকলন করেছেন। আমি হাদীসটি পাঠ করেছি সহীহ বুখারী থেকে। ইমাম বুখারী রাহ. তাঁর ‘আলজামিউস সহীহ’ গ্রন্থের ‘কিতাবুর রিকাক’ বা রিকাক-অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। হাদীস নং ৬৪১৬

ইমাম বুখারী রাহ.-এর সহীহ বুখারীর সাথে আমরা পরিচিত, কিন্তু তাঁর ‘আলজামিউস সহীহ’ কোন্ গ্রন্থের নাম? আসলে ‘আলজামিউস সহীহ’ই হচ্ছে সহীহ বুখারী। কিতাবটির পুরো নাম বেশ লম্বা ও সুন্দর। ‘আলজামিউল মুস্নাদুস্ সহীহুল মুখতাসার মিন উমূরি রাসূলিল্লাহি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামা ওয়া সুনানিহী ওয়া আয়্যামিহী।’

নামটি খুবই সুন্দর এবং কিতাবের বৈশিষ্ট্য ও গোটা কিতাবে সংকলিত হাদীসসমূহের বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি-নির্দেশক। কিন্তু দীর্ঘ হওয়ায় তা চাপা পড়ে গেছে। সাধারণ আলাপ-আলোচনায় ‘সহীহ বুখারী’ (ইমাম বুখারীর আসসহীহ) নামটিই প্রসিদ্ধ। সহীহ বুখারীর আসল নামের অর্থ আমরা অন্য অবসরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।

এই কিতাবের একটি অধ্যায়ের নাম ‘কিতাবুর রিকাক’। হাদীস-ফিকহের আরবী গ্রন্থাবলিতে ব্যবহৃত সাধারণ পরিভাষায় ‘কিতাব’ অর্থ অধ্যায়। কোনো বড় বিষয়ের একেকটি মৌলিক অধ্যায়কে ‘কিতাব’ বলে অভিহিত করা হয়। যেমন  ইবাদতের ক্ষেত্রে কিতাবুস সালাত, কিতাবুয যাকাত, কিতাবুস সওম, কিতাবুল হজ¦ ইত্যাদি। এই শিরোনামগুলোর অর্থ যথাক্রমে সালাত-অধ্যায়, যাকাত-অধ্যায়, সওম-অধ্যায়, হজ¦-অধ্যায়।

হাদীসের কিতাবের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম ‘কিতাবুর রিকাক’ বা রিকাক-অধ্যায়।

রিকাক’ মানে কী? ‘রিকাক’ শব্দটি বড় ক্বফ দিয়ে। সঠিক উচ্চারণটি শুনে শিখতে হবে। শুধু বই পড়ে তা শেখা যাবে না। বইয়ে বড়জোর ‘ক’ বর্ণের নীচে একটি ব-ফলা যুক্ত করে ইশারা করা যাবে যে, উচ্চারণটি সাধারণ ‘ক’-এর উচ্চারণ নয়। কিন্তু সঠিক উচ্চারণটি শুনে শুনেই রপ্ত করতে হবে। যাইহোক ‘রিকাক’ ‘رقاق’ শব্দটি ‘رقيق’ (রকীক)-এর বহুবচন। رقيق মানে নরম, কোমল, মিহি। আরবী ভাষায় এ শব্দের ব্যবহার বস্তুর ক্ষেত্রেও হয়, ভাব ও অবস্থার ক্ষেত্রেও হয়। বস্তুর ক্ষেত্রে যেমন পাতলা ও মসৃণ কাপড়কে বলা হয়- ثوب رقيقএর বিপরীতে মোটা ও কর্কশ কাপড়কে বলে-ثوب صفيق

ভাব ও অবস্থার ক্ষেত্রে এ শব্দের ব্যবহারের উদাহরণ হচ্ছে قلب رقيق’ নরম মন। নরম মনের অধিকারী ব্যক্তিকে বলা হয়-رقيق القلبনরম মনের অধিকারী। অন্যদিকে কঠোর মনের ব্যক্তিকে বলে- قاسى القلبকুরআন মাজীদের অনেক জায়গায় قسوة القلب বা হৃদয়ের কাঠিন্যের নিন্দা করা হয়েছে। মুমিনকে তা থেকে বাঁচতে হবে।

হাদীসের কিতাবে ‘রিকাক-অধ্যায়ে’ ঐসকল হাদীস সংকলিত হয়, যা মুমিন হৃদয়ে ন¤্রতা ও আর্দ্রতা তৈরি করে। আল্লাহর ভয় ও আখিরাতমুখিতা তৈরি করে। দুনিয়ার স্বরূপ ও দুনিয়ার মোহ থেকে বাঁচার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। বিষয়টি কত প্রয়োজন! আমাদের অন্তর্জগতের পরিশুদ্ধির জন্য এই মোবারক হাদীসগুলো কতই না প্রভাবক! হাদীসের ইমামগণ ‘রিকাক’ শিরোনামে এবং এর কাছাকাছি অন্যান্য শিরোনামে এই  মোবারক হাদীসগুলো সংকলন করেছেন। আমাদের কর্তব্য, খুব আগ্রহ নিয়ে তা পাঠ করা এবং হৃদয়ের শুকনো ভমিকে সজীব করে তোলার চেষ্টা করা।

আমি সহীহ বুখারীর ‘কিতাবুর রিকাক’ থেকে যে হাদীসটি পাঠ করেছি তা বর্ণনা করেছেন বিখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন-

كُنْ فِي الدّنْيَا كَأَنّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ.

তুমি দুনিয়ায় থাক ভিনদেশীর মতো, অথবা পথিকজনের মতো।

ইবনে ওমর রা. বলতেন-

إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ، وَخُذْ مِنْ صِحّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.

তুমি সন্ধ্যায় পৌঁছুলে সকালের অপেক্ষায় থেকো না। আর সকালে পৌঁছুলে সন্ধ্যার অপেক্ষা কোরো না। তোমার অসুস্থতার জন্য সঞ্চয় নাও সুস্থতা থেকে। আর মৃত্যুর জন্য নাও জীবন থেকে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১৬

উপরের হাদীসে দুটো অংশ আছে : প্রথমটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী। আর দ্বিতীয়টি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর বাণী। হাদীস-শাস্ত্রের পরিভাষা-অনুসারে প্রথমটিকে বলা হবে ‘মারফ’ বর্ণনা। অর্থাৎ যে বর্ণনা নবী সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, কর্ম, সম্মতি কিংবা তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে।

আর দ্বিতীয় অংশটি, যাতে ইবনে ওমর রা.-এর বাণী উল্লেখিত হয়েছে, তাকে বলা হবে, ‘মাওকূফ’। অর্থাৎ যে বর্ণনা সাহাবী পর্যন্ত গিয়ে থেমে গেছে। অন্য ভাষায় বললে, যে বর্ণনায় কোনো সাহাবীর কথা, কাজ বা তার সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো কিছু উল্লেখিত হয়েছে। সাধারণভাবে ‘মাওকূফ’ শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এ শব্দের অন্য ব্যবহারও আছে, তবে তা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।

আমাদের হাদীসের ইমামগণ বর্ণনার ক্ষেত্রে এত সতর্ক ছিলেন যে, বর্ণনায় মারফ-মাওকূফের পার্থক্যও খুব যতেœর সাথে পরীক্ষা করতেন। তাদের নীতি এই ছিল যে, বর্ণনাটি উপর থেকে যেভাবে আসছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে। যা উপর থেকে সাহাবীর বাণী হিসেবে বর্ণিত হয়ে এসেছে তাকে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী হিসেবে বর্ণনা করা যাবে না। প্রত্যেক বর্ণনা আপনরূপে থাকতে হবে। এরপর সেই বর্ণনার বিষয়বস্তুর সূত্র-সন্ধান, অর্থাৎ সাহাবী এই কথাটি কোত্থেকে বলেছেন- তা আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হবে। সাহাবী যখন বলেছেন তা তো আল্লাহর রাসূলের কথাই হবে, কিংবা কথাটি তো খুব সুন্দর কথা, ধর্মীয় কথা, কাজেই একে আল্লাহর রাসূলের দিকে সম্বন্ধ করে দেওয়া যায়- এজাতীয় চিন্তা তাদের কাছে শাস্ত্রীয় অজ্ঞতা হিসেবে গণ্য ছিল। আর তাই মারফ-মাওকূফের পার্থক্য না করা ছিল তাঁদের দৃষ্টিতে অনেক বড় শাস্ত্রীয় দোষ।

সাহাবায়ে কেরামের ক্ষেত্রেই যখন এই কথা তখন অন্যদের কথা তো বলাই বাহুল্য। বস্তুত দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের ক্ষেত্রে আমাদের পূর্বসূরী মনীষীগণের এরকম সচেতনতা ও সতর্কতার কারণেই দ্বীন সংরক্ষিত থেকেছে এবং তা আমাদের কাছে অবিকৃত অবস্থায় পৌঁছেছে।

হাদীস শরীফের প্রথম অংশ

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধ ধরলেন এবং বললেন, ‘তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।

কাঁধে হাত দেওয়া স্নেহ ও আন্তরিকতা প্রকাশ করে। উপদেশ ও শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আন্তরিকতা ও কল্যাণকামিতার প্রকাশ থাকা বাঞ্ছনীয়। এতে তা অধিকতর ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রিয় সাহাবীকে আন্তরিকতার সাথে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা মুমিন-জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি। প্রিয় সাহাবীকে সম্বোধন করলেও এ শিক্ষা সকল মুমিনের জন্য-তুমি দুনিয়ায় থেকো ভিনদেশীর মতো অথবা পথিকজনের মতো।

ভিনদেশী বা পথিকজনের মতো হওয়ার অর্থ কী? হাদীসের ভাষ্যকারগণ এর ব্যাখ্যায় যা বলেছেন তার সারসংক্ষেপ হচ্ছে-

পৃথিবীর এই ঘর মানুষের স্থায়ী ঘর নয়। এখানে সে ক্ষণস্থায়ী, তাকে তার স্থায়ী ঘরে ফিরে যেতে হবে। জীবন যাপনের ক্ষেত্রে এই মহাসত্য স্মরণ রাখা তার কর্তব্য। এই সত্য স্মরণ রাখার যে প্রভাব তার চিন্তা ও কর্মে পড়বে তা নিম্নরূপ :

এক. মুমিন কিছুতেই দুনিয়ার ব্যাপারে মোহগ্রস্ত হবে না এবং দুনিয়াকেই তার স্থায়ী আবাস হিসেবে গ্রহণ করবে না। আর তাই আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এমন সবকিছু থেকে সে নিজেকে যতেœর সাথে দূরে সরিয়ে রাখবে।

সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার ইমাম নববী রাহ. এ হাদীসের ব্যাখ্যায় একথাটি এভাবে লিখেছেন-

مَعْنَى الْحَدِيثِ : لَا تَرْكَنْ إِلَى الدّنْيَا وَلَا تَتّخِذْهَا وَطَنًا، وَلَا تُحَدِّثْ نَفْسَكَ بِالْبَقَاءِ فِيهَا، وَلَا تَتَعَلّقْ مِنْهَا بِمَا لَا يَتَعَلّقُ بِهِ الْغَرِيبُ فِي غَيْرِ وَطَنِهِ.

দুই. দুনিয়ায় তার আগমনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে সচেতন থাকবে। মানুষ তো দুনিয়াতে ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তিপরায়ণতার জন্য আসেনি। সে এসেছে আল্লাহর বান্দা হয়ে, আল্লাহর হুকুম পালনের জন্য। দুনিয়ার জীবনে তার উপর অর্পিত দায়-দায়িত্ব পালন করে তাকে তার মালিকের কাছে ফিরে যেতে হবে।

সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এই হাদীসের ব্যাখ্যায় এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে উপরের কথাটি এভাবে বলেছেন-

...فَالْمَرْءُ فِي الدّنْيَا كَعَبْدٍ أَرْسَلَهُ سَيِّدُهُ فِي حَاجَةٍ إِلَى غَيْرِ بَلَدِهِ، فَشَأْنُهُ أَنْ يُبَادِرَ بِفِعْلِ مَا أُرْسِلَ فِيهِ، ثُمّ يَعُودَ إِلَى وَطَنِهِ، وَلَا يَتَعَلّقُ بِشَيْءٍ غَيْرِ مَا هُوَ فِيهِ.

তিন. আখিরাতের চিরস্থায়ী জীবনকে ভুলবে না। সর্বদা তা স্মৃতিতে জাগ্রত রাখবে। আখিরাতকে চিন্তা ও কর্মের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রয়োজনসমূহ পূরণ করবে। দুনিয়ার জীবনকে সে গ্রহণ করবে আখিরাতের জীবনের প্রস্তুতির সুযোগ ও অবসর হিসেবে।

ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. এক মনীষীর উদ্ধৃতিতে কথাটি এভাবে বলেছেন-

وَقَالَ غَيْرُهُ : الْمُرَادُ أَنْ يُنَزِّلَ الْمُؤْمِنُ نَفْسَهُ فِي الدّنْيَا مَنْزِلَةَ الْغَرِيبِ، فَلَا يَعْلَقُ قَلْبَهُ بِشَيْءٍ مِنْ بَلَدِ الْغُرْبَةِ، بَلْ قَلْبُهُ مُتَعَلِّقٌ بِوَطَنِهِ الّذِي يَرْجِعُ إِلَيْهِ، وَيَجْعَلُ إِقَامَتَهُ فِي الدّنْيَا لِيَقْضِيَ حَاجَتَهُ وَجِهَازَهُ لِلرّجُوعِ إِلَى وَطَنِهِ، وَهَذَا شَأْنُ الْغَرِيبِ، أَوْ يَكُونُ كَالْمُسَافِرِ لَا يَسْتَقِرّ فِي مَكَانٍ بِعَيْنِهِ، بَلْ هُوَ دَائِمُ السّيْرِ إِلَى بَلَدِ الْإِقَامَةِ.

এককথায় এ হাদীসটি হচ্ছে মানব-জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও শেষ গন্তব্য, দুনিয়ার জীবনের স্বরূপ ও ক্ষণস্থায়িত্ব এবং এইসকল কিছুর আলোকে দুনিয়াতে মুমিনের জীবন যাপনের পন্থা সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি।

লক্ষণীয় বিষয় এই যে, এ হাদীসে দুনিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করার কথা বলা হয়নি। তা স্বাভাবিকও নয়, মানুষের পক্ষে সম্ভবও নয়। হাদীস শরীফে দুনিয়ার বিষয়ে মোহগ্রস্ত না হওয়ার, হারাম ও অন্যায় থেকে বেঁচে থাকার, পার্থিব বৈধ কাজকর্মে সীমাতিরিক্ত মগ্ন না হওয়ার এবং আখিরাতের মুক্তি ও সাফল্যকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে শরীয়তের শিক্ষা ও বিধানের আলোকে জীবনযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এরও বিভিন্ন স্তর হতে পারে। উপরোক্ত হাদীস শরীফেও তাকওয়ার একাধিক স্তরের দিকে ইশারা আছে। ‘ভীনদেশী’ ও ‘পথিক মুসাফিরের’ মধ্যকার পার্থক্যটুকু হচ্ছে এই দুই স্তরের মধ্যকার পার্থক্য। উভয়ের লক্ষ্য ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য অভিন্ন হলেও পর্যায়গত কিছু পার্থক্যও আছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন ছিল এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পর্যায়ের। এক হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ-

مَا لِي وَلِلدّنْيَا، مَا أَنَا فِي الدّنْيَا إِلاّ كَرَاكِبٍ اسْتَظَلّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمّ رَاحَ وَتَرَكَهَا.

দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক? আমি তো দুনিয়াতে ঐ সওয়ারের মতো যে এক বৃক্ষের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে এরপর তা ছেড়ে চলে গিয়েছে। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৩৭৭

সাহাবায়ে কেরামের জীবনযাত্রা সাধারণভাবে ‘ভীনদেশী’ কিংবা ‘পথিক মুসাফির’- এই দুই পর্যায়ের কোনো এক পর্যায়েরই ছিল।

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর নসীহত

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেমন তাঁর প্রিয় সাহাবীকে উপদেশ দিয়েছেন তেমনি আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-ও তাঁর সাথে সংশ্লিষ্টদের নসীহত করেছেন। দ্বীনের ক্ষেত্রে পরস্পর নসীহত ও কল্যাণকামিতার ধারা অব্যাহত থাকা উচিত।

ইবনে ওমর রা.-এর উপদেশের মর্মবাণীও হচ্ছে, দুনিয়ার বিষয়ে নির্মোহ হওয়া এবং পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ করা।

إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ الصّبَاحَ، وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرِ المَسَاءَ.

সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের অপেক্ষা কোরো না, আর সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার অপেক্ষা কোরো না।’ অর্থাৎ পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশা ত্যাগ কর আর আখিরাতের সঞ্চয় যথাসম্ভব দ্রæত অর্জন কর।

পার্থিব আয়-উপার্জন ইত্যাদির ক্ষেত্রে লম্বা লম্বা প্রত্যাশা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে এ সত্যের উপলব্ধি খুবই কার্যকর যে, দুনিয়ার জীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। যে কোনো সময় মৃত্যু এসে হাজির হয়ে যেতে পারে। কাজেই পার্থিব ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রত্যাশার জালে জড়িয়ে যাওয়া যুক্তিযুক্ত নয়। অতএব পার্থিব ক্ষেত্রে ঝামেলা কমিয়ে আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে মনোনিবেশ করাই বাঞ্ছনীয়।

কবি বলেন-

نسير إلي الآجال في كل لحظة+ وأيامنا تطوى وهن مراحل

ولم أر مثل الموت حقا كأنه+ إذا ما تخطته الأماني باطل

وما أقبح التفريط في زمن الصبا+فكيف به والشيب للرأس شاعل

ترحل من الدينا بزاد من التقى+ فعمرك أيام وهن قلائل

অর্থাৎ প্রতি মুহূর্তে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই ‘নির্ধারিত সময়’-এর দিকে। জীবনের প্রতিটি দিন এই অগস্ত্যযাত্রারই একেকটি মঞ্জিল, যা একে একে পিছিয়ে যাচ্ছে।

মৃত্যুর মতো এমন অবধারিত সত্য আর দেখিনি, যা পার্থিব আশা-আকাক্সক্ষার ভীড়ে এমনই বিস্মৃত যে, তা যেন একেবারেই মিথ্যে।

জীবনের প্রভাতে শৈশবকালেও তো সময়ের অপচয় অগ্রহণযোগ্য, তাহলে প্রৌঢ়ত্বে যখন মাথার চুলে পাক ধরে- তখন তা কেমন?

কাজেই বন্ধু! সাবধান হও! পৃথিবী থেকে যখন যাবে, যেন তাকওয়ার সম্বল নিয়ে যেতে পার- সেই চিন্তা কর। পার্থিব জীবন তো অল্প কটি দিনই মাত্র।

আখিরাতের সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে উদ্যমী ও তৎপর হওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ইবনে ওমর রা. বলেছেন-

وَخُذْ مِنْ صِحّتِكَ لِمَرَضِكَ، وَمِنْ حَيَاتِكَ لِمَوْتِكَ.

অর্থাৎ ভালো কাজের ক্ষেত্রে অলসতা না করে বর্তমানকে কাজে লাগানো প্রয়োজন। কারণ একে তো জীবন ক্ষণস্থায়ী; যে কোনো সময় মৃত্যুর ডাক এসে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত জীবনের সময়টুকুও নির্ঝঞ্ঝাট-সক্ষমতার মধ্যে কাটবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই জীবন-যৌবন এবং সুস্থতা ও সক্ষমতার বিদ্যমান সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার কাম্য। যেন দিন শেষে অতীত সময়ের অপচয়ের জন্য আফসোস করতে না হয়।

اغتنم في الفراغ فضل ركوع+ عسى أن يكون موتك بغتة

كم صحيح مات من غير سقم+ ذهبت نفسه الصحيحة فلتة

অর্থাৎ অবসর সময়ে যদি একটি রুকুও বেশি করতে পার তাতে অবহেলা করো না/কে জানে, হঠাৎ কখন মৃত্যু এসে পড়ে/কত সুস্থ লোক রোগ-ব্যাধি ছাড়াই মারা গেছে/তার নিরোগ প্রাণ অকস্মাৎ উড়ে গেছে।

স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে এ বিষয়ে সচেতন করেছেন।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النّاسِ: الصِّحّةُ وَالفَرَاغُ.

দুটি নিয়ামত এমন আছে, যার ব্যাপারে বহু মানুষ লোকসান-গ্রস্ত : সুস্থতা ও অবসর। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে আছে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তিকে নসীহত করে বলেছেন-

اغْتَنِمْ خَمْسًا قَبْلَ خَمْسٍ: شَبَابَكَ قَبْلَ هِرَمِكَ، وَصِحّتَكَ قَبْلَ سَقَمِكَ، وَغِنَاءَكَ قَبْلَ فَقْرِكَ، وَفَرَاغَكَ قَبْلَ شُغْلِكَ، وَحَيَاتَكَ قَبْلَ مَوْتِكَ.

পাঁচটি বিষয়কে অপর পাঁচ বিষয়ের আগে গনীমত মনে করো :  তোমার যৌবনকে বার্ধক্য আসার আগে, তোমার সুস্থতাকে অসুস্থতা আসার আগে, তোমার সচ্ছলতাকে অসচ্ছলতা আসার আগে, তোমার অবসরকে ব্যস্ততা আসার আগে, আর তোমার জীবনকে মৃত্যু আসার আগে।  -আলমুসতাদরাক, হাকেম, হাদীস ৭৮৪৬

কাজেই কুরআন-সুন্নাহ্র নির্দেশনা অনুযায়ী সৎকর্মে মশগুল থাকার মাধ্যমে বিদ্যমান সময়-সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। সঠিক নিয়ত এবং সৎ ও উপযুক্ত কর্মের মাধ্যমেই মানুষের জীবন সাফল্যমণ্ডিত হয়। কবি বলেন-

إنا لنفرح بالأيام نقطعها+ وكل يوم مضى يدني من الأجل

فاعمل لنفسك قبل الموت مجتهدا+ فإنما الربح والخسران في العمل

আমাদের দিন কাটছে তাই আমরা আনন্দে মেতে উঠি/অথচ চলে যাওয়া প্রতিটি দিন আমাদের নিকটবর্তী করছে সেই নির্ধারিত সময়ের/মৃত্যু আসার আগেই নিজের কল্যাণে কর্ম-প্রয়াসে মগ্ন হও/দিন শেষে লাভ-লোকসান তো কর্মেরই নিরিখে।

مضى أمسك الماضي شهيدا معدِّلا+ واعقبه يوم عليك جديد

فإن كنت بالأمس اقترفت إساءة+ فثن بإحسان وأنت حميد

فيومك إن اعتبته عاد نفعه+ عليك وماضي الأمس ليس يعود

ولا ترجئ فعل الخير يوما إلى غدٍ+ لعل غدًا يأتي وأنت فقيد.

অর্থাৎ তোমার বিগত দিনটি ভালো-মন্দের সাক্ষী হয়ে চলে গেছে/এখন তার জায়গায় এসেছে একটি নতুন দিন। গতকাল যদি ত্রুটি বিচ্যুতি হয়ে থাকে আজ ভালো কাজের মাধ্যমে তার ক্ষতিপূরণ কর/যে দিন গেছে তা তো আর কিছুতেই আসবে না, তবে আজকের এই দিনটাকে যদি সন্তুষ্ট করতে পার তাহলে এর সুফল অবশ্যই পাবে/কাজেই আজ যে ভালো কাজ সম্ভব তা আগামীকালের জন্য রেখে দিও না/এমনও তো হতে পারে যে, আগামী কাল আসবে কিন্তু তুমি থাকবে না।

আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

 

advertisement