শাওয়াল ১৪৪১   ||   জুন ২০২০

বাজেট ২০২০-২০২১ : গতানুগতিকতার বৃত্তেই আবদ্ধ

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

বাজেট নিয়ে আগে প্রায় নিয়মিত আলোচনা করতে চেষ্টা করে এসেছি। গত কয়েক বছর ধরে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা ও মন্তব্য করতে উৎসাহ জাগে না। কারণ সাম্প্রতিক বাজেটগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় গতানুগতিক। এ নিয়ে আলোচনা করতে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করার দরকার হয় না। নির্ধারিত কিছু বিষয়ই ঘুরে ফিরে আসে। এতে বাজেট পেশ হওয়ার আগেই সাধারণ সচেতন যে কেউ বলে দিতে পারে- বাজেটের ধরন ও বৈশিষ্ট্য কেমন হচ্ছে। সেই বিশাল আকারের বাজেট। ঘাটতি অনেক বেশি। প্রাক্কলিত আয়ের চেয়ে খরচের খাত বেশি। প্রবৃদ্ধি দেখানো হয় বেশি আর মূল্যস্ফীতি কম। ভ্যাটের আওতা বাড়ানো হয়। বরাবরের মতো কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। গতানুগতিক এইসব বৈশিষ্ট্য ও ধারা-ই বাজেটে ফুটে ওঠে। নতুন কোনো বৈশিষ্ট্য কিংবা নতুন কোনো উদ্যোগের বার্তা এখনকার বাজেটগুলোতে সাধারণত পাওয়া যায় না।

বাজেটে জনকল্যাণমূলক পরিবর্তনের কোনো আভাস থাকে না। যথারীতি কিছু খাতে দাম বাড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিছু ঋণ বাড়িয়ে তোলা হয়, বিশাল পরিমাণ অংক ঘাটতি রেখে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ মানুষের উপকার হয়- এমন কোনো পরিবর্তনমূলক সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না। আমাদের মতো অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে বছরের পর বছর এভাবেই চলতে থাকে। কোনো নতুনত্ব নেই, কোনো অভিনবত্ব নেই। এজন্য নতুন করে বাজেট নিয়ে আলোচনা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না, উৎসাহও জাগে না। তবুও যেহেতু আমাদের বন্ধু-শুভার্থী অনেকেই চান বাজেট নিয়ে কয়েকটি কথা বলি, সেজন্যই এবারের বাজেট নিয়ে এই আলোচনার অবতারণা।

২০২০-২০২১ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেট বর্তমান অর্থমন্ত্রীর পেশ করা দ্বিতীয় বাজেট। এর আগে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেব বহু বছর বাজেট পেশ করেছেন। তখন বর্তমান অর্থমন্ত্রী ছিলেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। আবদুল মুহিত সাহেবের বাজেট পেশ করার পর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইস্যুতে এই দুজনের মাঝে কিছু খুনসুটির দৃশ্য আমাদের চোখে পড়ত। আগের অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনরত বর্তমান অর্থমন্ত্রী কখনো কখনো ভিন্ন মত পোষণ করতেন। সেসব খবর গণমাধ্যমে আসত। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বাজেট পেশের ক্ষেত্রে সাবেক অর্থমন্ত্রী যে পথে হেঁটেছেন, বর্তমান অর্থমন্ত্রীও সেই পথে হাঁটছেন বলে মনে হচ্ছে। আগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্নমত প্রকাশ করলেও আগের অর্থমন্ত্রীর ছক থেকে তিনি বের হতে পারছেন বলে মনে হচ্ছে না।

বিশাল ঘাটতি বাজেট থেকে বাড়ছে ঋণ ও সুদের বোঝা

প্রথমেই দেখুন, এবারের বাজেটের আকারটা কী! বাজেট মানে রাষ্ট্রের আগামী বছরের খরচের প্রাক্কলন। এটা এবার প্রস্তাব করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশের জন্য বিশাল আকারের বাজেট। পত্র পত্রিকায় এসেছে, ১৯৭৪ সনে এদেশে বাজেটের আকার ছিল (সম্ভবত) ৯৯৫ কোটি টাকা; অর্থাৎ ১০০০ কোটি টাকার চেয়েও কম। ৪৫ বছরে সেখান থেকে বাড়তে বাড়তে আমাদের বাজেট এখন এসে দাঁড়িয়েছে এ জায়গায়। এটা খুব সমস্যাপূর্ণ কোনো ব্যাপার হত না, যদি সে মোতাবেক আয় থাকত। দেশে খরচের খাত অনেক বেড়েছে। বাস্তবেই যদি রাষ্ট্রের ব্যাপক আয় থাকে, তাহলে এই আকারের বাজেটে বড় কোনো অসুবিধা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু এখন যেটা ঘটছে, সেটা হল খরচের চিন্তা আগে করা হচ্ছে, আয়ের চিন্তা পরে। এ ব্যাপারটা বেশ আগে থেকেই করা হচ্ছে। এবার অর্থমন্ত্রী এ বিষয়ে একদম খোলাখুলি বলেই দিয়েছেন।

এখানে প্রাসঙ্গিক কারণেই একটি অন্য কথা বলি। যে কোনো ব্যক্তি বা পরিবারের ক্ষেত্রে আয় ও খরচের চিন্তাটা কী হওয়া উচিত। আদর্শ চিন্তা বা পরিকল্পনা আমরা কোন্টাকে বলব। আগে আয়ের চিন্তা করা এবং সেই আয় অনুযায়ী খরচের পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু এখনকার বাজেটগুলোতে ব্যয়ের চিন্তাটাকে করা হচ্ছে আগে, পরে আয়ের নানান উপায় নিয়ে পরিকল্পনা পেশ করা হচ্ছে। এজন্য টাকা সংগ্রহের প্রয়োজনে নানান দিকে হাতরাতেও হচ্ছে। আমরা আগে দেখেছি, বিদেশি অনুদান সংগ্রহের জন্য বৈঠক হত, সেখানে নানারকম শর্ত আরোপ, দর-কষাকষি হত এবং নাকানি-চুবানি খেতে হত। এখনো আমরা এ দৃশ্যগুলো দেখছি। আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, অন্যান্য দাতাসংস্থা ঋণ বা অনুদান দেওয়ার সময় নানারকম শর্ত দিয়ে রাখছে। রাষ্ট্রকে তাদের সেসব শর্ত মেনেই অর্থ সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এতে করে আর্থিক বিভিন্ন জটিল চক্রে পড়ে যাচ্ছে দেশ।

আয়ের চেয়ে ব্যয়ের প্রাক্কলন যে কীভাবে কতটা বেশি হচ্ছে, দেখা যাক। এবার বাজেট উপস্থাপন পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী মহোদয় বলেই ফেললেন, ‘আয়ের চিন্তা করিনি, আগে ব্যয়ের চিন্তা করেছি।এবার প্রাক্কলিত ব্যয় হচ্ছে, ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা নাগরিকদের দেওয়া কর ইত্যাদি থেকে আয় হবে বলে ধরা হয়েছে। বাকি ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা থেকে যাচ্ছে ঘাটতি বাজেট হিসেবে। অর্থাৎ প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা কীভাবে আয় হবে-এর নিয়মতান্ত্রিক কোনো উপায় নেই। এটাই ঘাটতি বাজেট।

এই প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেট আসবে সরকারি-বেসরকারি এবং দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণের মাধ্যমে। সে ঋণের সঙ্গে যুক্ত থাকবে সুদ। ঘাটতি বাজেটের কিছু টাকা আসবে অনুদান হিসেবে। ঘাটতি বাজেটের চরিত্র এটাই। এইসব খাত থেকেই টাকাটা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে।

বাজেটে প্রাক্কলন ব্যয় বাড়ছে। এবারের বাজেটেও অনেক বেড়েছে। বাড়ছে ঘাটতি বাজেটও। এই ঘাটতি বাড়ার ক্ষতি কী? এ কারণে কোথায় কোথায় অসুবিধা তৈরি হতে পারে? এর প্রধান উত্তর হল, এই ঋণের সঙ্গে সুদ জড়িয়ে আছে। ঘাটতি বাজেট বাড়ার মানে হল, রাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ বাড়া এবং তার সঙ্গে সুদ বৃদ্ধি হওয়া। এ কারণে মাথাপিছু ঋণ বাড়ছে এবং এ কারণেই রাষ্ট্রকে প্রতি বছর বিশাল অংকের সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।

ঘাটতি বাজেটের খেসারত কোথায় কীভাবে দিতে হচ্ছে!

এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে বরাদ্দের প্রধান বা এক নম্বর খাত হল জনপ্রশাসন খাত। অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ বরাদ্দের অংক। এ বরাদ্দের হার ১৮.০৭ শতাংশ। এর পরের খাতটিই হল, সুদ পরিশোধের খাত। এটি এবারের বাজেটে দ্বিতীয় প্রধান খাত। আগে কোনো কোনো বছর এটি ছিল এক নম্বর খাত। এবছর এ খাতে বরাদ্দের হার ১৮.০১ শতাংশ। টাকার অংকে ৬৩ হাজার ৮০১ কোটি টাকা।

আমরা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের নাগরিক। সুদ পরিশোধের জন্য আমাদের রাষ্ট্র এই বিশাল অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করছে, এটা কি আমরা কল্পনা করতে পারি? অথচ বাস্তবে এটাই ঘটছে। নির্বাচন এলে আমাদের দেশের সরকারি দল-বিরোধী দল সবাই প্রতিশ্রুতির ভাষায় বলতে থাকে-বিজয়ী হলে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন করা হবে না।পক্ষান্তরে দেশে সুদের মতো কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কত কত নীতি ও বিধি প্রচলিত আছে, তা নিয়ে এসব দলের কেউ চিন্তা করে দেখেছে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্তা ব্যক্তিত্ব, বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং দেশে কাজ করা বিভিন্ন পর্যায়ের থিংকট্যাংক সুদের এই বিশালতা এবং এর ভয়াবহতা নিয়ে প্রয়োজনীয় বিকল্পের ভাবনা ভাবছেন বলে শোনা যায় না। অথচ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-

یَمْحَقُ اللهُ الرِّبٰوا

[আল্লাহ তাআলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৬]

প্রকৃত কথা হল, সুদ দেওয়া-নেওয়ার চিন্তা না ছাড়লে ব্যক্তির জীবনে, প্রতিষ্ঠানে কিংবা রাষ্ট্রে কল্যাণ আসতে পারে না। বাস্তবেও আমরা সে দৃশ্যই দেখছি।

এত বিশাল আকারের বাজেট আমাদের দেশে পাশ হচ্ছে, কিন্তু আমরা কি কোনো কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত হতে পেরেছি? গড়ে টাকা বেড়ে যাওয়া, কিছু লোকের ধনী কিংবা অতি ধনী হয়ে যাওয়ার সঙ্গে কি কল্যাণরাষ্ট্রের কোনো সম্পর্ক আছে? বিশাল খরচ, ঘাটতি বাজেট এবং সুদের পাহাড় মাথায় নিয়ে কোনো কল্যাণরাষ্ট্রের কল্পনা করা যায় না। ভাবনার বিষয় হচ্ছে, এ পরিস্থিতির মধ্যে আমরা আবদ্ধ হয়ে আছি কেন? সুদের জালে কেন ফেঁসে থাকছে আমাদের দেশ? এর প্রধান কারণ হল, ঘাটতি বাজেট। রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের যা আয়, তার চেয়ে ব্যয়ের প্রাক্কলন এবং ব্যয়ের পরিমাণ বেশি বলেই ঘাটতি বাজেটের প্রয়োজন হয়। আর বাজেটের এই ঘাটতি পূরণের জন্য সুদের ভিত্তিতে ঋণ নিতে হয়। একারণেই রাষ্ট্র সুদের ভয়ঙ্কর চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।

ঘাটতি বাজেটের জন্য সুদভিত্তিক ঋণ সংগ্রহের অন্য একটি খেসারতও আছে। অনেকেই সেই খেসারতের প্রসঙ্গ তুলে ধরছেন। বাজেটের ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার যে ঋণ নিয়ে থাকে, সেটা দেশি ব্যাংক হলে সরকারের জন্য সুবিধা হয়। বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে অনেক রকম ঝামেলা পোহাতে হয়। দেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ফলে চাহিবামাত্রই এখান থেকে ঋণ পেয়ে যায় সরকার। এবার ঘাটতি বাজেটের জন্য দেশি ব্যাংকগুলো থেকে প্রাক্কলিত ঋণ গ্রহণের অংকটা হল, ৮৪ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। দেশি ব্যাংকগুলো থেকে এই বিশাল পরিমাণ অর্থের ঋণ সংগ্রহের ফলে ব্যাংকগুলোর ওপর বড় রকম একটি চাপ পড়বে। এই চাপের জেরটাও গিয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপর।

ব্যাংকগুলো থেকে সরকার বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে গেলে প্রথম চাপটি গিয়ে পড়ে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর। ব্যাংকগুলো থেকে সাধারণ মানুষের টাকা চলে যায় সরকারের কোষাগারে। ব্যাংকে সাধারণত টাকা জমা রাখে সাধারণ পর্যায়ের মানুষেরা, যাদের কোনো বড় ব্যবসা বা কারবার নেই। কেউ ৫০০, কেউ ১০০০, কেউ এক লাখ, কেউ দুই লাখ টাকা ব্যাংকে জমা করে রাখে। কারো পেনশনের টাকা, কারো ক্ষুদ্র সঞ্চয় কিংবা জমি বিক্রির টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রাখে। বড় ব্যবসায়ী কিংবা বিত্তবান লোকেরা ব্যাংকে টাকা ফেলে রাখে না। তারা বরং ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিয়ে যায়। ব্যাংকের এই টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ হয়। কখনো শিল্পে, কখনো কৃষিতে, কখনো অবকাঠামো নির্মাণে এবং কখনো ক্ষুদ্র মাঝারি ব্যবসার বিস্তৃতিতে। ব্যাংকের এইসব টাকা সরকারের তহবিলে চলে গেলে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, বাধাপ্রাপ্ত হয়, উৎপাদন ও আর্থিক বিকাশ ব্যাহত হয়। ব্যাংকের টাকায় টান পড়ে যায়, তারল্য সংকট সৃষ্টি হয়। এর ফল ভোগ করতে হয় আবার সাধারণ মানুষকেই। ঘাটতি বাজেট পূরণে ব্যাংক-ঋণ সংগ্রহের এটি অন্যতম খেসারত।

ঘাটতি বাজেট পূরণের আরেকটি পদক্ষেপ নেওয়া হয় বিদেশী অনুদান সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। এবারের বাজেটে অনুদানের প্রাক্কলন হল, ৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। এই অনুদান সংগ্রহ করতে গিয়ে বিদেশীদের কত রকম শর্ত এবং চাপিয়ে দেওয়া অপমান যে মেনে নিতে হয় তা বলে শেষ করা যাবে না। এসব অনুদান স্বেচ্ছায় দেওয়া কোনো স্বতঃস্ফূর্ত দান নয়; করোনা সংকটসহ বিভিন্ন দুর্যোগে যেমন অসহায় মানুষকে সহায়তা দানকারী মানুষেরা নিরবে, শর্তহীনভাবে ঘরে-ঘরে দানের অঙ্ক পৌঁছে দিয়ে আসে, বিদেশি অনুদানের ধরনটা এমন নয়; বরং এসব অনুদানের সঙ্গে থাকে নানা রকম শর্ত, চাপ এবং সম্মান ও মর্যাদা খোয়ানোর মতো বহু অনুষঙ্গ।

অনুদানের পাশাপাশি ঘাটতি বাজেট পূরণে বিদেশি ঋণের ওপরও নির্ভরতা কাজ করে। এবারের বাজেটে বিদেশি ঋণের প্রাক্কলন হল, ৭৬ হাজার চার কোটি টাকা। এসব ঋণের সঙ্গেও শর্তের পাহাড় জড়িয়ে থাকে। অনেকেরই মনে থাকবে, কয়েক বছর আগে পার্শ্ববর্তী একটি দেশ আমাদের দেশকে কিছু ঋণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। পরবর্তীতে বহু রকম শর্তের কথা সামনে চলে এসেছে। দেখা গেছে, তাদের দেওয়া ঋণের অর্থে এদেশে অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী তাদের দেশ থেকেই কেনার শর্ত দেওয়া আছে। শর্ত দেওয়া আছে, কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রকৌশলী ও কর্মী তাদের দেশ থেকেই নিতে হবে। অর্থাৎ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শর্তের বেড়াজালে পড়ে তাদের দেওয়া ঋণের বড় অংশ তাদেরকেই দিয়ে আসতে হবে, সাথে সুদের বোঝা তো আছেই। বিদেশি ঋণগুলোর অবস্থা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকমই। এজন্যই নিজস্ব আয়ের চেয়ে ব্যয়ের চিন্তা বেশি করাটা বাস্তবানুগ কোনো চিন্তা নয়।

আয়ের চেয়ে খরচের খাত বেশি ধরলে বাজেটে যে ঘাটতি হয়, দেখা যাচ্ছে, সে কারণে সুদের বিশাল চাপের মধ্যে পড়তে হয়। বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে শর্তের নানান বেড়াজালে আবদ্ধ হতে হয়। দেশী ব্যাংকগুলোর আর্থিক গতি ও স্বাচ্ছন্দ্য ব্যাহত করতে হয়। কিন্তু তারপরও বাজেট ঘোষণা ও পাশের সময় আমরা গতানুগতিক এই সংকট থেকে উত্তরণের কোনো বার্তা খুঁজে পাই না। এমন কোনো ভাবনার উদ্ভাস দেখি না যে, আমাদের যতটুকু আয়ের প্রাক্কলন রয়েছে, সে অনুপাতেই ব্যয়ের হিসাব ধরা হবে। এ বছর কর ইত্যাদি স্বাভাবিক ও নিজস্ব উৎস থেকে আয়ের প্রাক্কলন হল, ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। ব্যয়ের প্রাক্কলন এই অঙ্কের সঙ্গে মিল রেখে ধার্য করলে সেটাই হত বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ পদক্ষেপ ও সিদ্ধান্ত। কিন্তু ঘাটতি বাজেটের হাতছানি উপেক্ষা করে এজাতীয় সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে এখন আর দেখা যায় না।

প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় এবং বৈষম্যের অমীমাংসিত অঙ্ক

এবারের বিশাল আকারের বাজেট এবং এর অন্তর্গত অবস্থা নিয়ে কৌতুহল-উদ্দীপক ও মজাদার বিভিন্ন কথা শোনা যাচ্ছে। জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করার পর একটি সংবাদপত্র শিরোনাম করেছে-করোনার মন্দায় কল্পনার বাজেট।আবার আরেকটি সংবাদপত্র শিরোনাম দাঁড় করিয়েছে-করোনা ক্ষান্ত করতে পারেনি অর্থমন্ত্রীর উচ্চাশা। বাজেট পেশের পর দেশের গণমাধ্যমগুলোর এজাতীয় শিরোনাম প্রয়োগে বোঝা যায়, দেশের আর্থিক অবস্থার বাস্তবতার সঙ্গে বাজেটের বিবরণ ও প্রাক্কলনে বেশ কিছু অসামঞ্জস্য রয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকের কাছেই বাজেটের বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রাকে আশ্চর্যজনকও মনে হয়েছে। হিসাবের জাদুকরি অঙ্কে এমন অনেক কিছুই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, বাস্তবে যার সম্ভাব্যতা বেশ দুরূহ।

এবারের বাজেটে প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন ধরা হয়েছে, ৮.০২ শতাংশ। অথচ বিদেশীরা জিডিপি-প্রবৃদ্ধি নামের যেসব  জাদুকরি অঙ্ক ও তত্ত্ব এদেশের মানুষকে শিখিয়েছে, তারাই বলছে আগামী বছর বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার হতে পারে ১ শতাংশ কিংবা ২ শতাংশ। গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। প্রবৃদ্ধির হার উপরের দিকে যাওয়া এখন বেশ দুরূহ ব্যাপার। তারপরও এখানে হারটা দেখানো হয়েছে অনেক বেশি। অনেকেই মনে করেন, এটা করা হয়েছে গত বছরের থেকে প্রবৃদ্ধির হার বেশি দেখানোর জন্য। অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বোঝানোর জন্য একটা ঊর্ধ্বমুখী হার দেখাতে হয়, সেটাই এতে দেখানো হয়েছে।

অপরদিকে মূল্যস্ফীতি দেখানো হয়েছে মাত্র ৫.০৪ শতাংশ। অথচ সবাই জানেন, প্রতি বছর কীভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়, আগের বছরের তুলনায় পরের বছর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হার দেখে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস ছুটে যায়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস, ওষুধপত্র এবং জরুরি জীবনোপকরণের মূল্য বৃদ্ধির হার মাত্র ৫% থাকে, নাকি এটা ১০% -এর চেয়েও বেশি বেড়ে যায়- নাগরিক মাত্রই জানেন। কিন্তু হিসাবের ফাঁকফোকর ধরে একটা হার দেখানো হয়। বাস্তবের সঙ্গে না মিললেও এই অঙ্কটাই চর্চায় চলে আসে। এটা হচ্ছে হিসাবের জাদুকরি। সাধারণের বোধগম্যের বাইরের বিষয়। বাস্তব জীবনে মূল্যস্ফীতির চাপে জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠলেও বাজেটের অংকে সেটা থাকে মাত্র পাঁচ বা সাড়ে পাঁচ ভাগ।

একই রকম ঘটনা ঘটে থাকে মাথাপিছু আয় দেখানোর ক্ষেত্রেও। এটাও অঙ্কের খেলা। দেখানো হয় অনেক বেশি, কোটি কোটি নাগরিকের জীবনের সঙ্গে যার কোনো মিল পাওয়া যায় না। যেমন, চলতি বছরের মাথাপিছু আয় ২১৭৩ ডলার। সামনের বছর ধরা হয়েছে ২৩২৬ ডলার। এক ডলার যদি ধরা হয় ৮৬ টাকা। তার মানে বছরে প্রতি জন নাগরিকের মাথাপিছু আয় ২ লাখ টাকা। বিরাট একটি অঙ্ক। অথচ বাস্তব চিত্রটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। মাথাপিছু আয় তো দূরের কথা, লক্ষ করলে দেখা যাবে, দেশের বেশিরভাগ পরিবারের মাথাপিছু আয়ও দুই লাখ টাকা পর্যন্ত যায় না। অথচ মাথাপিছু আয়ের এই মায়াজাল বসিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বিত্তবানদের পাড়া ছাড়া অন্য যেকোনো বসতি বা মহল্লায় গেলেই মাথাপিছু আয়ের এই অংকের ফাঁকটা চোখে পড়বে এবং এটা বোঝার জন্য হিসাববিজ্ঞান জানা কোনো লোকের দরকার পড়বে না, নিয়মিত সংসার চালাতে হয়, এমন যেকোনো মানুষ নিজে থেকেই বিষয়টা অনুভব করতে পারবে।

মাথাপিছু আয় যদি দুই লাখ টাকা হয়, ৫ জনের একটি পরিবারের আয় হওয়ার কথা ১০ লাখ টাকা, ১০ জনের পরিবারের ২০ লাখ টাকা। অথচ দেশে কয়েক কোটি এমন পরিবার পাওয়া যাবে, যাদের পরিবার প্রতি আয়ও দুই-তিন লাখ হবে না। তাহলে মাথাপিছু আয়ের এই হিসাব দিয়ে কী হবে!

বরং বলা যেতে পারে, মাথাপিছু আয়ের এই অঙ্ক থেকে এই সমাজে বিরাজমান বৈষম্যের চেহারাটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা যেহেতু অনুমাননির্ভর, তাই এই হিসাবটাকে পুরোপুরি সঠিক যদি আমরা না-ও ধরি, বাস্তব অঙ্কটাকে এর কাছাকাছি মনে করি, তবুও বুঝতে পারা যায়, মাথাপিছু আয়ের এই টাকাগুলো আসলে কত শতাংশ লোকের হাতে জমে আছে। শতকরা ১ ভাগ অথবা ২ ভাগ লোকের হাতে আটকে আছে দেশের বেশিরভাগ টাকা। অনেকে মনে করেন, প্রায় সব টাকাই তাদের হাতে। তারাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে।

এ পরিস্থিতিতে সাধারণ জনগণের মাথাপিছু আয়ের একটি বিশাল অংক নিয়ে কী লাভ! মাথাপিছু আয় নামের এই জাদুকরি অংকটা কি তাদের জন্য পরিহাস নয়? অথচ বাজেট আলোচনা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রগুলোতে এই মাথাপিছু আয়-এর কথা বলেই দাবি করা হয় আমাদের দেশ এখন মধ্যম আয়ের স্তরে আছে, কিছুদিনের মধ্যেই উন্নত আয়ের দেশে পরিণত হবে। যদিও নাগরিকদের বিশাল ও প্রধান অংশটির জীবনের সঙ্গে এইসব হিসাব মেলে না। প্রশ্ন হচ্ছে, মাথাপিছু আয়ের হিসাবটা তবে আসলে কী? এটা কার কার হচ্ছে? এ আয়টা হচ্ছে মূলত ১ অথবা ২ ভাগ বিত্তবান নাগরিকের। তাদের সম্পদের স্তুপটাকেই গড়ে সব গরিব নাগরিকের সঙ্গে মিলিয়ে হিসাবটা দাঁড় করানো হচ্ছে। সমাজের বিরাজমান দারিদ্র্য ও বৈষম্য দেখলে এটা যে কোনো সচেতন মানুষই বুঝতে পারবেন। হিসাব-নিকাশ করতে পারার মতো আলাদা যোগ্যতা দরকার হবে না।

আসলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে ধন-সম্পদ পুঞ্জীভূত হওয়া এবং বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের সঙ্গে বৈষম্যের অবস্থা দাঁড়িয়ে যাওয়া, আর এরপরও মাথাপিছু আয়ের নামে প্রবঞ্চনা ও সান্ত¡নার একটা অংক দাঁড় করিয়ে মানুষকে প্রবোধ দেওয়া- এগুলো হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার একেকটি উল্টো দিক, একেকটি ক্ষতিকর ক্ষেত্র। অথচ এসব ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান কত সুন্দর। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

كَیْ لَا یَكُوْنَ دُوْلَةًۢ بَیْنَ الْاَغْنِیَآءِ مِنْكُمْ.

[যেন তোমাদের মধ্য থেকে শুধু বিত্তবানদের মাঝেই সম্পদ আবর্তিত না হতে থাকে। -সূরা হাশর (৫৯) : ৭]

ইসলাম জাদুকরি হিসাবের পথে হাঁটে না; বরং সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণের বাস্তব পদ্ধতি প্রচলন করে, নির্দেশনা দেয়। ইসলামী অর্থব্যবস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, ধনী-গরিবের তফাত থাকতে পারে, কিন্তু বিশাল বৈষম্য থাকতে পারে না। অল্প কিছু বিত্তবান মানুষের বিশাল অর্থের স্তুপকে গড় হিসাব করে মাথাপিছু আয় দেখিয়ে ফাঁপা উন্নয়নের চিত্র দাঁড় করানো যেতে পারে, কিন্তু সম্পদ বিকেন্দ্রীকরণ না করলে প্রকৃত অর্থে মাথাপিছু কিংবা ব্যক্তিপিছু স্বচ্ছলতা আসার পথ তৈরি হয় না। বরং বৈষম্য বাড়তে থাকে। ইসলাম এর বিপরীত কথাটাই মানুষকে শেখায়।

মাথাপিছু আয় এবং বৈষম্যের এ চিত্রের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হওয়ায় এখানে এ বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার মনে করছি যে, বাজেটের প্রধান আয় নাগরিকদের প্রদেয় যে কর থেকে আসে, সেই কর দেশের ধনী-গরিব সব শ্রেণীর মানুষই পরিশোধ করে থাকে। অনেকের ধারণা, কর দেয় শুধু বড়লোকেরা। এ ধারণা সঠিক নয়। বরং দেশের সব নাগরিক, এমনকি একজন ভিখিরি পর্যন্তও কর পরিশোধ করে থাকে। এক মোবাইল ফোনের কথাই ধরুন। এ খাতে সাড়ে ৩৩ শতাংশ কর ধার্য হয়েছে। এখন মোবাইল ফোন সবাই ব্যবহার করে। সবাইকেই এ কর পরিশোধ করতে হচ্ছে। একজন ভিখিরি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে দুই টাকা ঋণ করে দুইটা ট্যাবলেট কিনলে সেখানেও তাকে কর (মূল্য সংযোজন) পরিশোধ করতে হয়। অথচ রাষ্ট্রের সুযোগ সুবিধার দিক থেকে এই দরিদ্র মানুষদের বঞ্চনার পরিমাণটা বেশি।

নাগরিকদের কাছ থেকে টেক্স বা কর কয়েকভাবে আদায় করা হয়। সরাসরি আরোপিত কর, রিটার্ন জমা দিয়ে কর আদায়, কর্পোরেট কর, আমদানি পণ্যে সারচার্জ, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হয় ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর। ছোট-বড় বেশিরভাগ পণ্য ও সেবার সঙ্গে জড়িয়ে আছে এটি, যা ধনী-গরিব সকলকেই আদায় করতে হয়। অপরদিকে কর্পোরেট কর কিংবা শিল্প ও শিল্পপতিদের ওপর আরোপিত করের বোঝাও বেশিরভাগ সময় সাধারণ জনগণের ওপরই পড়ে। কারণ উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে করের অর্থ যোগ করে তারা পণ্য বাজারে ছাড়ে। সেই পণ্যের ভোক্তা হয়ে থাকে আবার ধনী-গরিব সাধারণ জনগণ।

তবে এবারের বাজেটে ব্যক্তি শ্রেণির আয়কর আদায়ের মাত্রাটা একটু বাড়ানো হয়েছে। গত বছর বার্ষিক আড়াই লাখ টাকা আয় করলেই কর দিতে হত, এবছর সে লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছে ৩ লাখ টাকা। করমুক্ত আয়সীমা ৫০ হাজার টাকা বাড়ানোর কারণে সাধুবাদ জানাই, কিন্তু বাস্তবতার দাবি হল, করমুক্ত আয়সীমা বার্ষিক অন্তত ৬ লাখ টাকা হওয়া উচিত। তাহলে কিছুটা স্বস্তির কারণ হতে পারে। একটি পরিবারের ভরণপোষণ, বাসা ভাড়া, সন্তানদের লেখাপড়া, চিকিৎসা ইত্যাদি খাতে ওই পরিবারের কর্তার মাসে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েই যায়। করমুক্ত আয়সীমা এ আঙ্গিকে হলে বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী সেটা অধিকতর বাস্তবসম্মত ও স্বস্তিদায়ক হত।

জনপ্রশাসন খাতের বর্ধিত ব্যয় এবং ঘুষ ও উপঢৌকন প্রসঙ্গ

২০২০-২০২১ সনের প্রস্তাবিত বাজেটে যথারীতি প্রধান ও এক নাম্বার বরাদ্দের খাতটি হল, জনপ্রশাসন। অর্থাৎ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের খাত। এবার মোট বাজেটের ১৮.০৭ শতাংশ এ খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে। এটি একটি বিশাল বরাদ্দ। সম্প্রতি সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর কারণে এ খাতের বরাদ্দ প্রতি বছর বাড়ছে। অনেকে এ খাতের বিশাল বরাদ্দ নিয়ে আপত্তি করতে চান না- বিশেষ একটি আশাবাদের কারণে। তারা মনে করেন, বেতন-ভাতা বাড়লে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অবৈধ পথে আয়-রোজগার বন্ধ করে দেবে। ঘুষ ছাড়াই সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জনগণ সেবা পাবে। উন্নয়নমূলক কাজেও ঘুষ ও উৎকোচের জন্য অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হবে না। কিন্তু এ আশাবাদের কোনো বাস্তব চিত্র দেখতে পাওয়া যায় না।

বছর আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। এরপর থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা কাজকর্মে ঘুষ লেনদেনের পরিমাণ কতটা কমেছে? দুর্নীতির মাত্রা আদৌ কি নিচের দিকে গিয়েছে? অফিস-আদালতে মানুষ কোনো কাজের জন্য গেলে ঘুষ ছাড়া নির্বিঘেœ কতটুকু কাজ করতে পারে? কত জায়গায় পারে? বিদ্যুৎ, পানি, স্বাস্থ্য, জমি রেজিস্ট্রি, জমির খাজনা পরিশোধ- কোন্ জায়গায় কজন ব্যক্তি ঘুষ ছাড়া তার কাজটি সম্পন্ন করে আসতে পারেন? প্রায় সবাই জানে, জমি রেজিস্ট্রি করতে গেলে বাড়তি ১ পার্সেন্ট, দেড় পার্সেন্ট টাকা কোথায় কাকে দিতে হয়। এ পরিস্থিতি প্রায় সব সেক্টরে, সব ক্ষেত্রে, সব খাতে। ঘাটে ঘাটে দুর্নীতি। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে লাফিয়ে লাফিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে লাভটা কী হয়? বেতন বাড়ালে ঘুষ কমবে- যারা এমন আশাবাদ লালন করেছিলেন, তাদের সে আশাবাদ সামান্য পরিমাণেও পূরণ হচ্ছে বলে মনে হয় না। অথচ বরাদ্দকৃত বাজেটের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ এ খাতে ব্যয় করা হচ্ছে! বিশাল ঘাটতি বাজেটের চাপ মাথার উপর নেওয়ার পেছনে এই খাতেরও বড় একটি ভূমিকা আছে।

অবশ্য আমরা একথা খুশি ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গেই বলব যে, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এমন অনেকেই রয়েছেন, যারা সৎ; অসৎ পথে তারা কোনোভাবেই পা বাড়ান না। আমরা তাদেরকে মোবারকবাদ জানাই। আল্লাহ তাআলা তাদের সততার পুরস্কার দেবেন। কিন্তু জনপ্রশাসনে এমন সৎ লোকের সংখ্যা কত? কত শতাংশ লোক সৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করেন? হার হিসেব করলে তারা সংখ্যালঘুই হবেন। জনপ্রশাসনে সৎ লোক যে সংখ্যালঘু, এটা বোঝার জন্য নির্দিষ্ট প্রমাণ- দলীলের প্রয়োজন নেই। যে কেউ সরকারি অফিসে কোনো কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করতে গেলেই সেটা হাড়ে হাড়ে অনুভব করবেন। মুষ্টিমেয় কিছু সৎ মানুষের জন্য পুরো সেক্টরের বেতন বাড়িয়ে নাগরিকদের ওপর বাড়তি করের চাপ এবং দেশের ঋণের বোঝা বাড়ানোর কী মানে আছে? দরকার মনে করলে সৎ লোকদের অন্যভাবে পুরস্কৃত করুন। আর অসৎ লোকদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। ঢালাওভাবে অসততা চলতে দিয়ে এবং সবার বেতন বাড়িয়ে দিয়ে দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ নেওয়ার কোনো মানে আছে বলে মনে হয় না।

ইসলামের বিধান ও ইতিহাসে দেখা যায়, সরকারি কাজে নিযুক্ত মানুষদের সততার বিষয়ে কঠোর নজরদারি বজায় রাখা হয়েছে। হাদীসের কিতাবগুলো দেখলে এর উজ্জ্বল নজির পাওয়া যায়। অসততার সুযোগ তো দূরের কথা, সামান্যতম সন্দেহজনক কিছু হলেও সেখানে কঠোরতা আরোপ করা হয়েছে। এমনকি সরকারি দায়িত্বে নিযুক্ত ব্যক্তিদেরকে দেওয়া সাধারণ মানুষের হাদিয়া বা উপঢৌকনকেও রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে বলা হয়েছে। অথচ আমাদের সমাজে উঁচু পদের সরকারি কর্মকর্তা ও সরকারের মন্ত্রীদের হাতে দামি দামি জিনিসপত্র উপঢৌকন হিসেবে আসার কথা শোনা যায়। এসব দামি জিনিসপত্র নিয়ে জনসমক্ষে কেউ কোনো প্রশ্ন করলে উচ্চপদের কর্তা কিংবা মন্ত্রী মহোদয় উত্তর দেন, এটা আমার উপার্জন নয়, মানুষের দেওয়া উপহার। সরকারি চেয়ারে বসে জনগণের কাছ থেকে পাওয়া এসব উপহার চেয়ারের বাইরে থাকলে তারা পান না কেন? এ থেকে বোঝা যায়, সরকারি কাজে উঁচু পদে বসে থাকা ব্যক্তিদেরকে দেওয়া এসব উপহার আসলে কতটা উপহারএবং কতটা কাজ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য উৎকোচ

অথচ ইসলামের প্রথম যুগের ইতিহাস দেখুন।  একজন সম্মানিত সাহাবী রাষ্ট্রীয় ফান্ডের জন্য সাদাকাতের অর্থ উত্তোলন করতে গেলেন। এত বড় একজন সাহাবীকে স্থানীয় মানুষ নিজেদের মধ্যে পেয়ে আনন্দিত হল এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারে প্রদত্ত অর্থের পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবেও তাকে কিছু উপহার দিল। এটা তাঁর জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু মদীনায় ফিরে যখন তিনি একটি অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিলেন এবং আরেকটি অংশের ব্যাপারে বললেন যে, এটি তার জন্য মানুষের দেওয়া উপহার, তখন সে উপহারের সম্পদ উপহার হিসেবে গণ্য করা হল না; বরং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেন যে, পুরো সম্পদই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাবে। এর কোনো অংশ হাদিয়া/উপঢৌকন হিসেবে গণ্য হবে না। এমনকি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তুমি যদি ঘরে বসে থাকতে তাহলে কি এই উপহার পেতে!’ (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৯৭৯)

আমাদের সমাজে বর্তমানে এর উল্টো চিত্র বিদ্যমান। আমি কোনো এক সরকারের কথা বলছি না। সব আমলেই উপহার, উপঢৌকন আর উৎকোচ মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের উঁচু পদে বসে যারা উপঢৌকনগ্রহণ করে, তাদেরকে বাধা দিতে উদ্যোগী হই না। ফলে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে ঘুষ-উৎকোচের বাজার থাকে জমজমাট। এজন্যই আমরা বলে থাকি, রাষ্ট্রের বোঝা বাড়িয়ে বেতন বৃদ্ধি করা এবং এর সঙ্গে ঘুষ-উৎকোচের দরজা খুলে রাখলে কোনো ফায়দা তো নেই- ই, উল্টো দ্বিগুণ ক্ষতি। বেতন বাড়ানো হল, দুর্নীতি কমল না, রাষ্ট্র বা জনগণের কী উপকার হল! অথচ দায়িত্বশীলদের মধ্যে এ নিয়ে যেন কোনো ভাবনাই নেই। সরকারি দায়িত্বে নিযুক্ত সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততা রক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্রের কঠোর পদক্ষেপ আমরা প্রত্যাশা করি। বেতন বৃদ্ধি কিংবা বর্ধিত বেতনের দাবি পূরণ করতে গিয়ে ঋণ করে বাজেটের আকার বড় করার পর সততা রক্ষার এই কঠোরতা আরো বেশি প্রত্যাশিত এবং আরো বেশি প্রাসঙ্গিক।

সামাজিক নিরাপত্তা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্যখাতে আরো নজর দিন

বাজেট নিয়ে আলোচনা ও বিশ্লেষণে গেলে ইতিবাচক ও নেতিবাচক- দুই আঙ্গিকের অনেক কথা সামনে চলে আসে। আলোচনা আর বাড়াতে চাই না। প্রয়োজনীয় দু-একটি প্রসঙ্গে কিছু কথা বলে এ আলোচনা শেষ করতে চাই।

বাজেটে বরাদ্দের একটি খাত হল, সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণ। এটা বাজেটের একটা নিয়মতান্ত্রিক খাত। এ খাতটির প্রতি যেভাবে যতটুকু মনোযোগ দেওয়া উচিত, আমাদের বাজেট প্রস্তাবনায় যথাযথভাবে সেটা পরিলক্ষিত হয় না। এবারের বাজেটে এ খাতে গত বছরের তুলনায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। এটা ভালো দিক কিন্তু এই বর্ধিত বরাদ্দ এ খাতের জন্য যথেষ্ট কি না সেটাও বিবেচনাযোগ্য ব্যাপার। এবার করোনা সংকট শুরু হওয়ার পর কর্মবঞ্চিত দিনমজুর ও অসহায় সাধারণ মানুষের মাঝে প্রথমেই নানা দিক থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে বেসরকারি পর্যায় থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। পরবর্তী সময়ে সরকারি উদ্যোগে সাহায্য-সহযোগিতা বিতরণের সংবাদ আমরা পেয়েছি। এক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের নানারকম দুর্নীতি, চাল চুরির ঘটনা সামনে এলেও, আমরা সরকারি এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। একসময়ে জাতীয় উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হত না, এখন সরকার নিচ্ছে। আগে এজাতীয় সহযোগিতার আওতা কম ছিল, এখন এর আওতা বাড়ছে। এটাকেও আমরা ভালোই বলব। তবে এরপরও কথা থেকে যায়।

নাগরিকদের প্রতি এজাতীয় সহযোগিতামূলক কিংবা সামাজিক নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপের পরিধিটা কতটুকু- এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অভাবী, অনাথ, অসহায় সকল নাগরিক এই সহযোগিতামূলক পদক্ষেপের আওতায় পড়েছেন, নাকি অল্প কিছুসংখ্যক মানুষ সুবিধাটা পাচ্ছেন।

আরেকটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হল, যারা সরকারি উদ্যোগের এজাতীয় সহযোগিতা পাচ্ছেন তারা কি প্রকৃত হকদার, নাকি অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত হকদাররা বঞ্চিত হচ্ছেন আর নানা রকম পরিচিতি ও সম্পর্ক থাকায় কিছু সচ্ছল মানুষেরাও এর সুবিধাগুলো হাতিয়ে নিচ্ছেন। করোনা সংকটকালে সরকারি সহযোগিতা বিতরণের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমে এমন বেশ কিছু অভিযোগ উঠতে দেখা গেছে।

ইসলাম কী বলে?

আমরা ইসলামের বিধি-বিধান এবং এর সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। অসহায় দরিদ্র নাগরিকদের ভরণপোষণ, বাসস্থান ও জীবন নির্বাহের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামের নীতি হল, অসহায়দের কোনো অংশের নয়; বরং রাষ্ট্রের কর্তব্য  অসহায় মানুষের শতভাগ দায়িত্ব গ্রহণ করা। প্রথম যুগ থেকে ইসলামী রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে এ নীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইরশাদ হল-

مَنْ تَرَكَ مَالًا فَلِوَرَثَتِهِ، وَمَنْ تَرَكَ دَيْنًا أَوْ ضَيَاعًا فَعَلَيّ وَإِلَيّ.

(মৃত্যুকালে কেউ যদি কোনো সম্পদ রেখে যায় তাহলে সেটা তার উত্তরাধিকারীরা পাবে, আর কেউ যদি কোনো ঋণ অথবা অসহায় সন্তান (পরিবার) রেখে যায়, তাহলে তার দায়িত্ব আমার অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর। -সুনানে ইবে মাজাহ, হাদীস ২৪১৬

এর মানে হচ্ছে, অভাবগ্রস্ত মানুষের বিপন্নতার দায় ও বোঝা রাষ্ট্র বহন করবে। সমাজে বসবাসরত দরিদ্র তালাকপ্রাপ্তা, বিধবা নারী, গরিব, এতিম, সম্পদহীন মানুষ, কর্মক্ষমতা-শূন্য ও আয়-রোজগারহীন মানুষের ভরণপোষণ, বাসস্থান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ রাষ্ট্র সরবরাহ করবে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং এ শ্রেণির প্রতিটি মানুষকেই এ সেবা পৌঁছাতে হবে।

আমরা তো এখন শুনতে পাই, আমরা এখন আর গরিব রাষ্ট্র নই, ধনী হয়ে গেছি। গড় আয় অনেক বেশি। এ অবস্থায় আমাদের মতো রাষ্ট্রের উচিত সামাজিক নিরাপত্তার আওতা পরিপূর্ণ করে তোলা। একজন অভাবী নাগরিকও যেন অসহায় অবস্থায় না থাকে- সে ব্যবস্থাপনা বার্ষিক বাজেট বা রাষ্ট্রীয় অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে থাকা উচিত। কিন্তু এ জায়গাটায় আমরা একটি ফাঁকা দৃশ্য দেখি। একদিকে মাথাপিছু আয় ও গড় আয়ের কথা খুব বড় করে বলা হয়। অপরদিকে দরিদ্র শ্রেণি অসহায় অবস্থায় দিন পার করতে বাধ্য হয়। কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের চিত্র এমন হতে পারে না।

কল্যাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল, অসহায় দরিদ্র নাগরিকদের পৃষ্ঠপোষকতার শতভাগ দায়িত্ব নেওয়া। সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণ খাতটি সেখানে আংশিক ও বাছাইকৃত হতে পারবে না। ইসলাম এ শিক্ষাই দেয় যে, প্রয়োজনসম্পন্ন প্রতি জন মানুষ রাষ্ট্রের কাছ থেকে সহযোগিতা পাবে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতে অপচয় কমিয়ে মিতব্যয়িতার চর্চা করা গেলে এজাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ খুব সহজ ব্যাপার। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন কাজের উপলক্ষে অপচয়ের পেছনে শত শত কোটি টাকা খরচ হয় বলে শোনা যায়। বিদেশ সফর এজাতীয় অপচয়ের একটি বড় উদাহরণ। প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখা যায়, কোনো দেশ থেকে একটি মানচিত্র আনার প্রয়োজনে একদল প্রতিনিধি সেখানে চলে যাচ্ছে। দেশে একটি খামার প্রতিষ্ঠা করার নমুনা দেখার জন্য বিদেশের কোনো খামার দেখতে চলে যাচ্ছে বড় আরেকটি প্রতিনিধিদল। সদলবলে ছোটখাটো উপলক্ষে বিদেশ সফরসহ সরকারি বিভিন্ন খাতে নানারকম অপচয়ের যেসব ঘটনা সামনে আসে এগুলো বন্ধ হলে জনকল্যাণের তহবিল বা বরাদ্দ আরো বড় করা যেতে পারে। এছাড়া প্রকল্পসমূহের বিশাল অপচয় তো রয়েছেই।

অপচয় ও বিলাসিতা বন্ধ করে নাগরিক-বান্ধব খরচের খাতকে উৎসাহিত করা দরকার। কথায় বলে-কোম্পানি কা মাল দরিয়া মে ডাল। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন খাতে আমরা প্রবচনটির প্রয়োগ দেখি। এজাতীয় ধ্বংসাত্মক অপচয় বন্ধ করে মিতব্যয়িতার চর্চা বাড়ালে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কমে যেত এবং জনকল্যাণে বেশি ব্যয় করা যেত। অথচ বাস্তবে ঘটছে উল্টোটা। অপ্রয়োজনীয় খাতে বছর বছর প্রাক্কলন বাড়ছে, ঘাটতি বাড়ছে, রাষ্ট্রের নাভিশ্বাস ছুটছে।

প্রসঙ্গ : নৈতিকতা

নৈতিক উন্নয়ন খাত রাষ্ট্রের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ের জনগণকে নৈতিক শিক্ষায় উদ্দীপ্ত করতে পারলে রাষ্ট্রেরই কল্যাণ। কিন্তু বাজেট বরাদ্দের সময় এ খাতের বিশেষ বিকাশ ও প্রাধান্য দেখা যায় না। একসময় দেশের বিভিন্ন বাহিনীর কর্মীদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ করা হত। যাদের মাধ্যমে তারা ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে সততা, নৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের শিক্ষাও পেত। শিক্ষার বিস্তার এবং এ শিক্ষার মধ্য দিয়ে নৈতিকতার উন্নয়ন রাষ্ট্রের পুরো ব্যবস্থাপনার মধ্যেই দরকার। আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত, শিশু-কিশোর থেকে পৌড় পর্যন্ত সব স্তরে নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটাতে পারলে রাষ্ট্রের অনেক বাজে খরচ এমনিতেই কমে যাবে। কমে যাবে দুর্নীতি এবং উন্নয়ন বাজেটের ব্যয়। কমে যাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও আদালতের খরচ পর্যন্ত। নাগরিকদের মাঝে নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটলে সবরকম অপরাধ যেমন কমে যাবে, সেইসব অপরাধের সঙ্গে যুক্ত খরচের পাল্লাও কমে যাবে। বাজেট প্রস্তাব এবং পাশের সময় তাই নৈতিক খাতের উন্নয়নের বিষয়টির দিকে রাষ্ট্রের কর্ণধারদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। কীভাবে নাগরিকদের নৈতিকতার উন্নয়ন করা যাবে সেজন্য দেশের বিচক্ষণ মুত্তাকী আলেমদের পরামর্শ নিতে পারে।

স্বাস্থ্যখাতের বেহাল দশা

করোনার সময় স্বাস্থ্যখাতের হাহাকারের চিত্রটি সামনে এসেছে। এতদিন তো এই খাতের দুর্বলতা স্বীকারই করতে চাইতো না অনেকে। এখন উপর-নিচের সবাই এর ভুক্তভোগী। করোনা এদেশের স্বাস্থ্যখাতের দেওলিয়াত্বকে একেবারে উলঙ্গ করে দিয়েছে। যা হোক এবছর অবশ্য এ খাতে বরাদ্দ কিছুটা বেশি ধরা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতার বিচারে এটাও যে অপ্রতুল- এটা পরিস্থিতির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এ পরিস্থিতি একদিনে হয়নি, এক সরকারের কাজ নয় এটা। ধারাবাহিক অবহেলার ফল এখন জাতি ভোগ করছে। এজন্য নাগরিকদের দাবি- এ খাতের প্রতি ব্যাপক মনোযোগ দেওয়া উচিত। দৃশ্যমান ও উন্নয়নমুখী পরিবর্তন স্বাস্থ্যখাতে দরকার। ছোট-বড় বহু কার্যকর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা, জায়গায় জায়গায় বিপুলসংখ্যক ডাক্তার নিয়োগ এখন সময়ের দাবি। স্বাস্থ্যখাতের এ অব্যবস্থাপনার সবচেয়ে বড় শিকার দেশের গরিব নাগরিকরা। অথচ এ গরিব নাগরিকদের পকেট থেকেই বাজেটের বড় অংকটা আসে। ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর থেকে এবার আয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। সবাই জানে, ভ্যাটের আওতায় রয়েছেন একজন ভিখিরি থেকে নিয়ে শিল্পপতি পর্যন্ত প্রতিটি নাগরিক। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার এক অভিশপ্ত চক্কর যে, সাধারণ জনগনের দেওয়া কর’-এ নির্মিত ব্যবস্থায় তারাই থাকে সবচেয়ে বেশি অসহায়। স্বাস্থ্যখাতে ব্যবসা প্রবণতা, অবহেলা, অব্যবস্থাপনা নিয়ে মানুষের কষ্ট এখন অনেক। কয়দিন আগে উচ্চ আদালত থেকে চিকিৎসা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়ায় সে নির্দেশনার বিরুদ্ধে আপিল করেছে সরকার। এ থেকেই রাষ্ট্রের সামর্থ্যরে চিত্র ফুটে ওঠে। বোঝা যায়, সরকারি-বেসরকারি দেশের সামগ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা এখন কোন্ পর্যায়ে রয়েছে। আমরা মনে করি, স্বাস্থ্যখাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের পাশাপাশি সর্বোচ্চ মনোযোগের ব্যবস্থাও করা দরকার।

বাজেট নিয়ে মনের তাগিদ এবং সংশ্লিষ্ট স্বজনদের অনুরোধে কথা বলার সময় অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করে। অনেক সময় আবার মনে হয়, এ সবই অরণ্যে রোদন। তবুও কিছু কথা পেশ করলাম, নীতি নির্ধারণের সঙ্গে যারা রয়েছেন কেউ যদি দরকারি ও ভালো কিছু করতে একটু উদ্যোগী হন!

 

 

advertisement