সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

উম্মাহ : পাকিস্তানে বিয়োগান্তক ঘটনার পরিণতি কোথায়?

খসরূ খান

প্রাণের মূল্যে রাজনীতির অংক মেলানোর একটি কঠিন পর্বে প্রবেশ করেছে পাকিস্তান। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রবণতার দিক থেকে ভয়ঙ্কর। গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর বোমা হামলা কিংবা গুলিতে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো নিহত হন। তার সঙ্গে হতাহত হন বহু মানুষ। বেদনাদায়ক এ ঘটনার পরপরই এ হত্যাকান্ডের দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় জঙ্গিবাদীদের ওপর। আন্তর্জাতিক মিডিয়াই দোষ ধরার একাজটি প্রথম পর্যায়ে করেছে। বেনজিরকে হত্যা কে করেছে? কেন করেছে? হত্যাপরবর্তী পরিস্থিতি থেকে ফায়েদা হাসিলের সুযোগ কার? এসব প্রশ্ন সামনে নিয়ে ভাবলে বেনজিরকে জঙ্গিদের পক্ষে আঘাত করার অংকটা একদম মেলে না। বেনজির হত্যার পর পাক সরকারের বিভিন্ন রকম বক্তব্য, জঙ্গিদের ধরার জন্য সৈন্য পাঠানোর স্বতঃস্ফূর্ত মার্কিনী খায়েশ এবং পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা নিয়ে মোড়ল দেশগুলোর উদ্বেগ-দুশ্চিন্তার খোলামেলা প্রকাশ থেকেও এ অংকটার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। সত্যের আলো ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে থাকে। পাক সরকার ও মার্কিন কর্মকর্তারা এ হত্যার দায় জঙ্গিদের কাঁধে চাপিয়ে দিতে চাইলেও তাদের দাবির পক্ষে কোন প্রমাণ তারা পেশ করতে পারেনি।

তেমনিভাবে পাকিস্তানের জনগণেরও বিরাট একটি অংশের ধারণা, এ হত্যাকান্ডের পেছনে রয়েছে পাকিস্তান সরকার এবং তারও পেছনে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী। এ ধারণা পোষণকারীদের মাঝে বেনজির-সমর্থকদের অংশই বড়। মিডিয়াগুলোতে এ ধারণার খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ ধারণার পেছনে কারা রয়েছে- অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে সেটা ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রকাশ হতে দেওয়া হচ্ছে না। বেনজিরের অন্তিম মুহূর্তের চিকিৎসকদের প্রেসের সঙ্গে কথা বলেতে না দেওয়া, লাশের পোস্টমর্টেম করতে না দেওয়া এবং কিসের আঘাতে মৃত্যু হয়েছে সে বিষয়ে এক একবার সরকারের পক্ষ থেকে এক-এক রকম দাবি পেশ করায় জনসাধারণের মনে এ সন্দেহ ঘনিভূত হয়েছে। ঘনিভূত এ সন্দেহের বিষয়টি সরকারের রাডারে ধরা পড়ায় প্রেসিডেন্ট মোশাররফ বারবার বলতে বাধ্য হয়েছেন, আমি বেনজিরকে হত্যার আদেশ দেইনি।

বিগত কয়েক বছর ধরেই পাকিস্তানের রাজনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তির অঙ্গনে গুপ্ত আঘাতে খুনোখুনির ঘটনা ব্যাপকতা পেয়ে গেছে। বেশ কজন রাজনীতি ও শীর্ষ আলেম এ ধরনের গুপ্ত আঘাতে নিহত হয়েছেন। সরকারি উদ্যোগে প্রকাশ্যে হামলা চালিয়ে লালমসজিদ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। আর এসবগুলো বিয়োগান্তক ঘটনার পেছনেই বিদেশী গোয়েন্দা ও ঘাতক শক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অংশগ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। এরই ধারাবাহিকতায় বড় মাপের ঘটনা বেনজির হত্যাকান্ড। মার্কিন মদদে মোশাররফ সরকারের সাথে সমঝোতা করিয়ে বেনজিরকে দেশে প্রবেশের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়ে কি পাকিস্তানে বেনজির-অনুসারী, বেনজিরবিরোধী এবং ইসলামপন্থীদের মাঝে একটি ত্রিমুখী সংঘর্ষের বিরতিহীন যুদ্ধ চালু করে দেওয়াই উদ্দেশ্য- এ প্রশ্নটিই এখন জোরালো হয়ে উঠেছে। দেশে প্রবেশের আগে-পরে বেনজিরকে দিয়ে জঙ্গিবাদ বিরোধী বক্তব্য দেওয়ানো আর দেশে প্রবেশের প্রথম দিনেই ব্যাপক বিধ্বংসী বোমা বিষ্ফোরণের মধ্য দিয়ে কি পাকিস্তানে বিদেশী শক্তির অনুপ্রবেশের পথ রচনা করা হয়েছিল, যে পথের শেষ মঞ্জিলটি ধরেই কি পারমাণবিক মুসলিম শক্তিটির টুটি চেপে ধরা এবং পারমাণবিক বোমার ওপর মোড়লদের কর্তৃত্ব স্থাপনের আয়োজন সম্পন্ন হতে যাচ্ছে? এসব আয়োজনে মোশাররফ কি কেবল একজন ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন? বেনজির ভুট্টোর হত্যাকান্ডের পর এসব প্রশ্ন এখন মুখে মুখে উঠে এসেছে। বেনজির হত্যাকান্ডকে তাই দেশীয় বা আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি হিসাব-নিকাশের ফলাফল হিসেবে দেখতে পাচ্ছেন অনেকেই। খবর পাওয়া যাচ্ছে, নতুন সেনাপ্রধান কায়ানী এখন পাকসামরিক বাহিনীকে মোশাররফের প্রভাবমুক্ত করে গড়ে তুলেছেন। পাক সেনাবাহিনীর মূল ট্র্যাকে ফিরে আসা, পরমাণু বোমার ওপর বিদেশী শক্তির দখলদারিত্বের ঝুঁকি কমানো এবং নাগরিকদের সঙ্গে সেনা সদস্যের দ্বন্দ্বের সমাপ্তি টানার ইতিবাচক পথ রচিত হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। দুনিয়ার ক্ষমতাধররা হিসেব করে ঘটনা ঘটালেও পরিণতি টানার মালিক রাববুল আলামীনের কুদরতী হাত অনেক সাজানো অংক উলট-পালট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।#

 

 

advertisement