সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

দাম্পত্য কলহ নিরসনে ইসলামের শিক্ষা

হবীবা বিনতে আব্দুস সামাদ

মানব সভ্যতার রূপায়ণে দাম্পত্য সম্পর্কের ভূমিকা অপরিসীম। একটি সমাজ গঠনে দাম্পত্য সম্পর্ক প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। শরীয়ত-সম্মত পন্থায় দুজন নারী-পুরুষের মাঝে স্বামী-স্ত্রীর যে সম্পর্ক কায়েম হয় তা-ই দাম্পত্য সম্পর্ক। স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের দায়িত্ব ও ভালোবাসার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে একটি পরিবার। তারপর একটি সমাজ। সুতরাং আদর্শ সমাজ গঠন করতে চাইলে প্রয়োজন আদর্শ দাম্পত্য সম্পর্কের। সে সম্পর্ক হবে নিষ্কলুষ; দায়িত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনে মজবুত। তবে সবসময় এ সম্পর্ক একতালে চলে না। না চাইলেও অনেক সময় সামান্য ভুলের কারণে ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। মাঝে মাঝে এসব ঘটনা জটিলরূপ ধারণ করে স্বামী-স্ত্রীকে ঝগড়ার মতো হীনকর্মে লিপ্ত করে। সামাজিক ভাষায় স্বামী-স্ত্রীর এ ধরনের বিবাদকে বলা হয় দাম্পত্য কলহ

স্বামী-স্ত্রী একে অপরের আজীবন সঙ্গী। তাই তাদের জীবন চলার পথে মান-অভিমান, ভুল-ভ্রান্তি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয়ই অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে যখন তা দাম্পত্য কলহে রূপ নেয়।

পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে দাম্পত্য কলহ-বিবাদের প্রভাব অত্যন্ত ক্ষতিকর। যে কারণে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে কোনোক্রমেই মিল না হলে শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে বিচ্ছেদের অনুমতি রয়েছে। তবুও কলহ-বিবাদের সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে দাম্পত্য কলহ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সামান্য ঝগড়ার সূত্র ধরে স্বামীর হাতে স্ত্রী কিংবা স্ত্রীর হাতে স্বামী খুন জাতীয় সংবাদ এখন নিত্য-নৈমিত্তিক বিষয়। (আল্লাহ পাক আমাদেরকে হেফাযত করুন)

সমাজের সিংহভাগ পরিবারেই কলহের মতো অস্বাভাবিক বিষয়টি আজ স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অথচ সমাজের কর্ণধারদের এ ব্যাপারে কোনো চিন্তা এবং সমাধানের জন্য কোনো কল্যাণজনক ব্যবস্থা আছে বলে মনে হয় না। দুজন নারী-পুরুষের মাঝে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমাদের সমস্ত সমস্যার মূল কারণ একটাই- ইসলামের সুমহান আদর্শ তথা আল্লাহ প্রদত্ত বিধানকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের মনগড়া মতবাদের মধ্যেই শান্তি ও সফলতা খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করা। সুতরাং প্রকৃতপক্ষেই যদি আমরা সমস্যার সমাধান চাই, তাহলে ইসলামের ছায়াতলে ফিরে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। দাম্পত্য সম্পর্ক, তার সমস্যা ও সমাধানও এর ব্যতিক্রম নয়।

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে যেসব বিষয়ে বিবাদ দেখা দেয় সেজন্য মূলত দায়ী নিজের অধিকার সম্পর্কে ষোলআনা সচেতনতা আর অন্যের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে অবহেলা। প্রত্যেকে যদি নিজ দায়িত্ব আদায়ে সচেতন থাকে, তবে দাম্পত্য কলহের কোনো সুযোগ থাকে না।

এ কারণেই ইসলাম একের ওপর অন্যের অধিকার যেমন সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে তেমনি সেসব অধিকার আদায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে আদেশ করেছে। ইসলামী বিধানে স্ত্রীর উপর স্বামীর যেসব অধিকার রয়েছে তার প্রধান কয়েকটি হল-

* স্বামীর অনুগত থাকা এবং খেদমত করা।

* স্বামীর সাধ্যের বাইরে কোনো আবদার না করা।

* স্বামীর অনুমতি ব্যতীত কাউকে ঘরে প্রবেশ করতে না দেওয়া এবং নিজে ঘর থেকে বের না হওয়া।

* স্বামীর সম্পদ বিশ্বস্ততার সাথে সংরক্ষণ করা। এর মাঝে স্ত্রীর নিজের সতীত্বকে হেফাযত করাও অন্তর্ভুক্ত।

* শরীয়ত-সম্মত ওযর না হলে স্বামীর আহবানে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেওয়া।

অপর দিকে স্বামীর ওপর স্ত্রীর যেসব অধিকার রয়েছে তার কয়েকটি হচ্ছে-

* মোহর আদায় করা।

* হালাল মাল দ্বারা স্ত্রীর ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।

* বসবাসের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী বাসস্থানের ব্যবস্থা করা।

* সম্ভব হলে কাজের লোকের ব্যবস্থা করা।

* কর্তৃত্বসুলভ ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্ত্রীর প্রতি জুলুম না করা। স্ত্রীর ভুল-ত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা। তবে প্রয়োজনবোধে সতর্ক করা।

* একাধিক স্ত্রী থাকলে ভরণ-পোষণ, রাতযাপন প্রভৃতি বিষয়ে সকলের মাঝে সমতা রক্ষা করা।

উপরোক্ত অধিকারসমূহ ছাড়াও স্বামী-স্ত্রীর আরো অধিকার রয়েছে, যেগুলো আদায়ের মাধ্যমে দাম্পত্য-জীবনকে কলহমুক্ত রাখা যায়। এরপরও যদি কোনো কারণে মনোমালিন্য দেখা দেয় তাহলে স্বামী-স্ত্রী একে অপরের সাথে আলোচনা করে বোঝার চেষ্টা করবে মূল সমস্যা কোথায় এবং তার সমাধান কী। তারপর দুজনেই সেসব সমস্যা নিরসনে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট থাকবে। কিন্তু সমস্যা যদি আরো জটিল হয়, যার সমাধান শুধু স্বামী-স্ত্রীর দ্বারা সম্ভব নয়, তখন সংশ্লিষ্ট পরিবারের অভিভাবকগণ আলোচনা করে চেষ্টা করবেন তাদের দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য। সে সাথে ওলামায়ে কেরামের পরামর্শও নেওয়া যেতে পারে; বরং তা আরো উত্তম বলে বিবেচিত হবে।

লক্ষ্য রাখতে হবে, অভিভাবকমহল যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন তা যেন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য কল্যাণকর হয়। এমন যেন না হয়, সমাধানের জন্য যাদের ডাকা হল তারা এসে এক পক্ষের প্রতি দুর্বলতা প্রকাশ করে সমস্যা আরো জটিল করে তুললেন। আমাদেরকে সব সময় স্মরণ রাখতে হবে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বড় নাজুক সম্পর্ক। সামান্য অসচেতন হলে দুজনেরই অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইসলামের নির্ভুল পথ-নির্দেশনাই দাম্পত্য সম্পর্ককে মজবুত ও মধুর করে তোলার একমাত্র চাবিকাঠি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।#

 

 

advertisement