সফর ১৪২৯   ||   ফেব্রুয়ারি ২০০৮

মসজিদে রিংটোন ও অসংযত আচরণ

মাওলানা মুহাম্মাদ হেদায়াতুল্লাহ

এখন প্রায় সব মসজিদেই নামায শুরুর আগে ইমাম সাহেব কাতার সোজা করার অনুরোধের সাথে সাথে সবার মোবাইল বন্ধ করার অনুরোধও করে থাকেন নিয়মিত। অনেক মসজিদে দরজার চৌকাঠে কিংবা দেয়ালে মসজিদে মোবাইল বন্ধ রাখার নির্দেশ-অনুরোধের স্টিকার লাগানো থাকে। কিন্তু এত কিছুর পরও মাঝে মধ্যে দেখা যায় জামাতে নামায চলাকালে হঠাৎ গান, মিউজিকসহ বিভিন্ন সুরেলা রিংটোন বেজে ওঠে, যা স্বাভাবিকভাবেই নামাযরত অসংখ্য মুসল্লীর নামাযে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এটা অবশ্যই অনাকাঙ্ক্ষিত এবং এ ব্যাপারে অসতর্কতা সমীচীন নয়। যেখানে গান-মিউজিক (তা মোবাইলের রিংটোনই হোক না কেন) এমনিতেই গোনাহ সেখানে এগুলোর শব্দে মসজিদের পরিবেশ দূষিত করা এবং অসংখ্য মানুষের নামাযের ক্ষতি করা কত বড় অন্যায় তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না।

আরো দুঃখজনক বিষয় হল, মসজিদে এমন দুর্ঘটনা যাদের কারণে ঘটে তাদের মাঝে অনেক সময় এমন লোকও দেখা যায়, যাকে দেখলে এমন সন্দেহ করারও সুযোগ থাকে না যে, তার মধ্যে হয়ত বা সামান্য অপরোধবোধ কিংবা অনুতাপও জাগ্রত হয়েছে। তার মোবাইলের আওয়াজে পুরো মসজিদ হকচকিয়ে গেলেও তাকে দেখায় সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি মোবাইল রিসিভ করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অবশ্য এ বিষয়ে পূর্ণ সতর্কতা বজায় রাখা সত্ত্বেও এমন অসতর্ক ঘটনা মাঝে মধ্যে ঘটতে পারে। ভুলবশত কখনো এমন ঘটতে পারা যে কারো বেলায়ই অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে এমন ভুল ঘটে যাওয়ার পর মসজিদে অধিকাংশ সময়ই প্রকাশ পায় আপত্তিকর কিছু আচরণ। সে বিষয়েই কিছু কথা এখানে নিবেদন করতে চাই।

নামাযের মাঝে যে লোকটির মোবাইল বেজে উঠে, হঠাৎ যার অসতর্কতার বিষয়টি পুরো মসজিদের মুসল্লীদের কাছে প্রকাশ পেয়ে যায়, লজ্জায় ও  অনুশোচনায় এমনিতেই তিনি (দু একজন ব্যতিক্রম ছাড়া) চরম লজ্জিত ও সংকুচিত হয়ে যান; নামায শেষে তার দিকে কে কীভাবে তাকাবে, কে কী বলবে সে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় তার মনটা ছোট হয়ে আসে। এর উপর যদি কোন ভদ্রলোক পুরো মসজিদ জুড়ে চেঁচিয়ে তাকে শাসন-ধমক শুরু করেন তখন যে ওই লোকটাকে কী নাজেহাল হতে হয় তা সহজেই অনুমান করা যায়। ভেবে দেখা দরকার, ইচ্ছাকৃতভাবে নয়, হঠাৎ অসতর্কতার কারণে একজনের প্রতি এমন আচরণ অমানবিক নয় কি? হাদীস শরীফে দেখা যায়, একদিন এক বেদুঈন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে মসজিদের ভেতরেই পেশাব করতে আরম্ভ করেছে। উপস্থিত সাহাবায়ে কেরাম দৌড়ে ছুটেছেন তাকে বারণ করার জন্য। নবীজী তাঁদেরকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, তাকে তার কাজ শেষ করতে দাও। যখন তার পেশাব করা শেষ তখন নবীজী নিজে তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন, এটা নামাযের জায়গা, যিকির-আযকারের জায়গা, পেশাবের জায়গা নয়। অবশেষে মসজিদের যে জায়গায় সে পেশাব করেছে সেটি সাহাবীদের পবিত্র করে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

এ হাদীসে মসজিদের আদব, পরিবেশ রক্ষা এবং একজন সরল অপরাধীর প্রতি আচরণ বিষয়ক  নীতির  অত্যন্ত চমকপ্রদ শিক্ষা রয়েছে। চিন্তা করলে এটি আমরা জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই প্রয়োগ করতে পারি।

মসজিদে মোবাইল বেজে ওঠলে যে বিপত্তিগুলো সৃষ্টি হয় তা আসলে এরকম সুচিন্তা না করা এবং এখানে কার কী করণীয় তা না জানা বা না করার কারণেই হয়ে থাকে। তাই এখানে কার কী ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন তা জেনে রাখা উচিত।

প্রথমে যিনি সবসময় সতর্ক থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ কোন দিন মোবাইলটি বন্ধ করতে ভুলে গেলেন এবং নামাযের মাঝে মোবাইলটি বেজে ওঠল তার করণীয় হবে নামাযের মধ্যেই এক হাতে মোবাইল বন্ধ করে দেওয়া বা সাইলেন্ট (শব্দহীন অবস্থা) চালু করে দেওয়া।

উল্লেখ্য, এ অবস্থায় মোবাইলের কী-পেড লক করা থাকলে কেউ কেউ মনে করেন এখন মোবাইলটি বন্ধ করতে হলে প্রথমে লক খুলতে দুটি বাটন চাপতে হবে তারপর তৃতীয় বাটন চেপে মোবাইল অফ করতে হবে। আর এত কাজ নামাযের মধ্যে থেকে করা ঠিক হবে না। তাই তারা মোবাইল বন্ধ করেন না। ফলে দীর্ঘ সময় মোবাইল বাজতে থাকে। আসলে লক করা অনেক মোবাইলেই কল আসলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক খুলে যায়। তাই তখন মোবাইল বন্ধ করতে ভিন্নভাবে লক খুলতে হয় না; বরং সরাসরি অফ বাটন চাপলেই মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় পর্যায়ে আশপাশে যেসব মুসল্লী থাকবেন তাদের করণীয় হল এ অবস্থায় ধৈর্যধারণ করা এবং সঠিক মাসআলা জানা থাকলে সুযোগমত সুন্দরভাবে তাকে কোন আলেমের বরাত দিয়ে মাসআলা জানিয়ে দেওয়া। তা না করে তাৎক্ষণিক হৈ-হুল্লোড় করে তাকে বকাঝকা করে দেওয়া কোনভাবেই ঠিক নয়, শরীয়তও এমন কাজ সমর্থন করে না। তাই এ কাজ থেকে অবশ্যই বিরত থাকতে হবে এবং শোকর আদায় করতে হবে যেন আল্লাহ তাআলা আমাকে এমন বিব্রতকর অবস্থায় কোন দিন না ফেলেন।

তৃতীয়ত ইমাম সাহেবের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে বলা যায়। এখানে মূলত তাঁর ভূমিকাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে কার্যকর। ইমামের দায়িত্ব হল তিনি নিয়মিত দু-একটি করে হলেও বিভিন্ন সময় ও সুযোগে এ ধরনের নিত্যদিনের মাসআলাগুলো মুসল্লীদের বলতে থাকবেন। যাতে সকল মুসল্লীই তার দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলো রপ্ত করতে পারে। তাহলে আর এরকম অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না ইনশাআল্লাহ। অগত্যা কখনো এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে তিনি তাৎক্ষণিক সংশ্লিষ্ট মাসআলা অবহিত করে একটি সুসমাধান দিয়ে দেবেন, যাতে অজ্ঞতার কারণে এমন বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ না থাকে।

এ ছাড়া যেহেতু রিংটোন বন্ধ করতে ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তাই বাসা থেকে মসজিদে আসতে বিনাপ্রয়োজনে মোবাইলটি পকেটে করে নিতে হবে কেন? আমি তা বাসায় রেখে যেতে পারি। অপরদিকে ফোনের একটি আদব হল যাকে ফোন করা হবে তার সময়ের প্রতি লক্ষ রাখা। তার নামায, আরাম বা বিশেষ কোন ব্যস্ততার সময় ফোন না করা। সুতরাং নামাযের সময় মসজিদে মোবাইল বেজে ওঠলে তার দায় কিন্তু যিনি এ অসময়ে ফোন করলেন তার উপরও কিছুটা বর্তায়। এখানেও আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।

এখানে চলমান স্রোতের বিপরীতে হলেও আরো কিছু বলা দরকার মনে করছি। মোবাইল একটি প্রয়োজনীয় এবং উপকারী সামগ্রী বলে এর ব্যবহার যেভাবে লাগামহীন হয়ে নানামুখী ক্ষতির পথগুলো সম্প্রসারিত করে চলেছে এবং ব্যবহারকারী মানুষগুলোও সেই জোয়ারের সাথে ভেসে যাচ্ছে তা রীতিমত ভয়ঙ্কর। কিন্তু তা সত্ত্বেও মোবাইলের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে বলে অনেক কম লোকই মনে করেন; অথচ আমাদেরকে যারা মোবাইলের পেছনে ছুটিয়ে দিয়েছে তারা কিন্তু অনেক আগেই ভেবে-চিন্তে তাদের করণীয় ঠিক করে ফেলেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তারা মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছে। যাহোক, সেটা একটা  লম্বা বিষয়। আমি এখানে যা বলতে চাচ্ছি তার সারকথা হল মোবাইল যেহেতু প্রয়োজনীয় জিনিস তাই তার ব্যবহার প্রয়োজনেই হওয়া উচিত। কিন্তু আমরা যারা মোবাইল ব্যবহার করছি তারা সকলেই কি তা প্রয়োজনে ব্যবহার করছি? আমি এমন লোকও দেখেছি যার ঘরে পরিবার-পরিজনের আহার নেই, কিন্তু সে ঋণ করে মোবাইল কিনেছে। এটাকেও কি আমরা প্রয়োজন বলতে পারি? #

 

 

advertisement