শাবান-রমজান ১৪৩১   ||   আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১০

তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যেঃ তোমরা কে? তোমরা কী? তোমাদের গন্তব্য কোথায়?

মাওলানা মানসুর নো'মানী রাহ.

আমি আপনাদেরই একজন আমার পেয়ারে ভাই! আপনারা হয়ত জানেন, আজ আমার এখানে আসার একমাত্র নিয়ত এই যে, এখানকার মাদারিসের তালিবানে ইলমের সামনে আমার মনের দীর্ঘ দিনের কিছু কথা এবং কিছু ব্যথা তুলে ধরবো। এখন আমার যা কিছু আবেদন ও নিবেদন তা আপনাদেরই খিদমতে, আপনাদেরই উদ্দেশ্যে। যদিও বলা হয়, কে বলছে তা দেখো না, কী বলছে তা দেখো, কিন্তু মানুষের স্বভাব এই যে, বক্তার পরিচয় দ্বারা শ্রোতাদের অন্তর প্রভাবিত হয়। বক্তার প্রতি আপনত্ব অনুভব করলে তার কথার একরকম আছর হয়, পক্ষান্তরে বক্তার প্রতি আজনাবিয়্যাত ও অপরিচয়ের কারণে অন্যরকম আছর হয়। তাই আমি শুরুতেই আমার পরিচয় পেশ করতে চাই, আমি কে? তো আমার পেয়ারে ভাই! আমি আপনাদের পর বা আজনবি কেউ নই। মাদরাসার পরিবেশেই আমার জন্ম ও প্রতিপালন। আমি আপনাদেরই একজন। আমার এবং আপনাদের দিলের ধড়কন ও হৃদয়ের স্পন্দন অভিন্ন। আমার মস্তিষ্ক আপনাদের জন্য চিন্তা করে, আমার হৃদয় আপনাদের জন্য ব্যাকুল হয় এবং আমার চোখ আপনাদের জন্য কাঁদে। একসময় আমি তালিবে ইলম ছিলাম, আলহামদু লিল্লাহ এখনো তালিবে ইলম আছি এবং ইনশাআল্লাহ যত দিন বেঁচে আছি, আপনাদের মত তালিবে ইলম হয়েই বেঁচে থাকবো এবং মৃত্যুবরণ করবো। সুতরাং আমার কথাগুলোকে আপনারা গায়র ও আজনবীর শিকায়েত মনে না করে, আপনজনের কাছে আপনজনের কান্না ও দরদ-ব্যথা মনে করবেন বলে আমি আশা করি। পেয়ারে বেরাদারান! যতই দিন যাচ্ছে, আমার দিলের জ্বালা-যন্ত্রণা ও ব্যথা-বেদনা তত বেড়েই চলেছে। মাদারিস ও তার তালিবানে ইলমকে কেন্দ্র করে আমার দিলে বিভিন্ন আন্দেশা ও আশঙ্কা প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে চলেছে। সামনে আমি যেন ঘোর অন্ধকার দেখতে পাচ্ছি, যদি আমরা আত্মসংশোধনের চিন্তা-ফিকির না করি। তাই কিছু দিন থেকে বড় অস্থির ও ব্যাকুল হয়ে ভাবছিলাম, যেখানে যেখানে আছে দ্বীনী মাদারিস ও তালিবানে ইলম, আমি যাবো তাদের কাছে এবং তুলে ধরবো আমার মনের ব্যথার কাহিনী, আমার দিলের আফসানায়ে দরদ! ভাই ও বন্ধু! সে উদ্দেশ্যেই আমি আজ এসেছি তোমাদের কাছে। আমার কিছু কথা শোনো, শুধু বাইরের কান দিয়ে নয়, দিলেরও কান দিয়ে। এটা তো স্বতঃসিদ্ধ সত্য যে, ওলামায়ে উম্মত হলেন উম্মতের কলব বা হৃৎপিণ্ড। (শোনো! দেহের ভিতরে একটি পিণ্ড আছে, যখন তা সুস্থ থাকে, গোটা দেহ সুস্থ থাকে। আর যখন তা অসুস্থ হয়ে যায়, গোটা দেহ অসুস্থ হয়ে যায়। শোনো, সেই পিণ্ডটি হচ্ছে কলব।) তো আমরা যাদের আলিম বলি, সমাজ যাদের আলিম বলে এবং দ্বীনী মাদারিসের ছায়ায় প্রতিপালিত হয়ে প্রকৃতপক্ষেই যারা আলিম-পরিচয় অর্জন করেছে এবং ইলমে দ্বীন হাছিল করেছে তারা যেহেতু এই উম্মতের কলব ও হৃৎপিণ্ড সুতরাং তারা যদি সুস্থ থাকে, গোটা উম্মত সুস্থ থাকবে, আর আল্লাহ না করুন, তারা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে যদি ফাসাদ ছড়িয়ে পড়ে তাহলে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা উম্মত আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়বে; তাদের মধ্যে ফাসাদ ও বিপর্যয় আরো ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়বে। আমার পেয়ারে ভাই! আপনাদের জীবন-যৌবন এবং সময় ও বয়সে আল্লাহ তাআলা ভরপুর বরকত দান করুন। ইনশাআল্লাহ আপনারাই হবেন এই উম্মতের আগামী দিনের আলিম। উম্মতের বাগানে আপনারা বর্তমানের কলি, ভবিষ্যতের ফুল। আপনাদের কাছে উম্মতের আশা ও প্রত্যাশা অনেক বিরাট। কারণ ঐ যে বললাম, উম্মত চায় আপনাদের মাধ্যমে রোগমুক্ত হতে এবং সুস্থতা লাভ করতে। উম্মত চায় আপনাদের কল্যাণে সমস্ত দুর্গন্ধ থেকে বেঁচে থাকতে এবং দ্বীনের ও ইলমে দ্বীনের সুবাস লাভ করতে। শুরুতেই আমি আমার পরিচয় দিয়েছি। আমি মাদরাসারই মানুষ। আপনাদেরই মত এক তালিবে ইলম। পার্থক্য এই যে, আমি বুড়ো, আপনারা যুবক। আপনাদের বয়স বিশ, আমার সত্তর। ইলমী সফরে আপনারা নতুন মুসাফির, আর এ পথে আমি পাড়ি দিয়েছি বহু দূর পথ। পথে পথে অর্জন করেছি অনেক অভিজ্ঞতা ও তাজরাবা, যা আজকের নও-মুসাফিরদের জন্য হতে পারে কীমতি যাদে রাহ এবং মূল্যবান পাথেয়। আমার ভাই ও বন্ধু! আবারও বলছি, আমি এখন বের হয়েছি আমার দেশের দ্বীনী মাদারিসের হালপুরসি করার জন্য। আমি বের হয়েছি নিজের তড়পে, নিজের দরদে; কেউ আমাকে ডাকেনি, আমার কাছে কারো আহ্বান আসেনি। আমি এসেছি আমার ভিতরের ডাকে, আমার আত্মার আহ্বানে। বলার কথা নয় তবু বলছি শুধু তোমাদের ভিতরের কানকে সজাগ করার জন্য। ভাই! বহু দূরদারাজের সফর করে, বহু কষ্টের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আমি তোমাদের কাছে এসেছি। আমি এখন এক ক্লান্ত পথিক, এক থকা হুয়া মুসাফির। সুতরাং আমি কি দাবী করতে পারি না! দাবী না হোক, অন্তত এইটুকু আব্‌দার কি করতে পারি না যে, তোমরা দিলের কান দিয়ে আমার কথাগুলো শোনবে! আমার দরদ-ব্যথা একটু বোঝার চেষ্টা করবে! আবার বলছি, তোমাদের দিলের দুয়ারে আজ দস্তক দিয়েছে এক পেরেশান মুসাফির। একটু দুয়ার খোলো! একটু কথা শোনো! কে আমরা? কোথায় আমাদের মানযিল? আমার প্রথম কথা, আপনারা আপনাদের আত্মপরিচয় সন্ধান করুন এবং নিজেদের চিনতে চেষ্টা করুন। কে আপনারা? কোথায় আপনাদের গন্তব্য? কী আপনাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য? সমাজের বুকে এবং উম্মতের মাঝে কী আপনাদের মর্যাদা? জীবনের পথে চলার জন্য বড় জ্বলন্ত উপরের প্রতিটি প্রশ্ন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর আপনাকে পেতে হবে এবং সেভাবেই জীবনকে পরিচালিত করতে হবে, যদি আপনি জীবনের সফলতা ও যিন্দেগির কামিয়াবি চান। আপনার জীবন দুদিনের নয়, অনন্তকালের! আপনার যিন্দেগি ফানা হওয়ার জন্য নয়, বাকি থাকার জন্য। কিন্তু আমার ধারণা, এখানে এমন তালিবে ইলম কমই আছেন, যারা এই প্রশ্নগুলো সম্পর্কে কখনো ভেবেছেন, যেমন ভাবা দরকার; যারা নিজেদের পরিচয় জানেন, যেমন জানা দরকার; যাদের অন্তরে দায়িত্ব ও মর্যাদার অনুভূতি আছে, যেমন থাকা দরকার। অবস্থা তো এই যে, না আছে কোন চেতনা ও গায়রাত, না আছে সাহস ও মনোবল। সকাল আসে, সন্ধ্যা হয়, দিন আসে, রাত যায়। এভাবেই সময়ের স্রোতে ভেসে চলেছে যিন্দেগির কিশতি। আমার মনে আছে, একসময় এমনই ছিলো আমার নিজেরও অবস্থা। তাই আমি বুঝতে পারি আপনাদের বর্তমান অবস্থা। বড় দুঃখজনক অবস্থা অবশ্যই, তবে এটাই সত্য, এটাই তিক্ত বাস্তব। আলহামদু লিল্লাহ! আপনারা সবাই সমঝদার। যদিও বয়সে আপনারা বিভিন্ন স্তরের এবং অধ্যয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শ্রেণীর, তবু আপনাদের সবার সাধারণ একটি বুঝ আছে। একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে আপনারা অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে, বিশ্বজগতে যা কিছু আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন সব মানুষের জন্য। মানুষ ছাড়া যা কিছু দেখা যায় এবং দেখা যায় না সবকিছু সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষেরই সেবা করার জন্য। বুঝতে যদি কষ্ট হয় তাহলে আপনাদের খুব কাছে সহজ একটি উদাহরণ দেখুন। এই যে মসজিদে আমরা একত্র হয়েছি, এখানে কত কিছু আছে! মিম্বর আছে, জায়নামায আছে। গালিচা আছে, ঘড়ি ও পাখা আছে। অযু-পানির পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে। এগুলো কী জন্য এবং কার জন্য? নামাযী ও মুছল্লীদের জন্য। এটা বুঝতে তো আপনাদের কারোই সমস্যা হওয়ার কথা নয় যে, এগুলো মুছল্লীদের জন্য, মুছল্লীরা এগুলোর জন্য নয়। এখানে যা সত্য, সৃষ্টিজগতের ক্ষেত্রেও তা সত্য। যা কিছু আছে আকাশে এবং পৃথিবীতে সব মানুষের জন্য। চাঁদ-সূর্য মানুষের জন্য, নদী-সাগর মানুষের জন্য, পাহাড় ও মরুভূমি মানুষের জন্য। গাছের ফল, মাঠের ফসল, বনের পশু, নদীর মাছ, এমনকি ভূগর্ভের সকল সম্পদ মানুষের জন্য, কিন্তু মানুষ এগুলোর কোনোটির জন্য নয়। দেখুন এ মহাসত্য কোরআনে কত বার কতভাবে ঘোষিত হয়েছে خلق لكم ما فى الارض جميعا (যমিনে যা কিছু আছে তা তোমাদের জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন।) সুতরাং এটা সুসাব্যস্ত হয়ে গেলো যে, সৃষ্টিজগতে মানুষই হচ্ছে আসল ও মুখ্য। মানুষ ছাড়া যা কিছু আছে সব সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের সেবা করার জন্য। এখন অনেক বড় একটি প্রশ্ন; সবকিছু মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, তো মানুষকে কীজন্য এবং কার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে? এমন তো কিছুতেই হতে পারে না যে, মানুষকে আল্লাহ তা‘আলা অযথা বানিয়েছেন! উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেছেন! সমগ্র সৃষ্টিজগতের উদ্দেশ্য হলো মানুষ, আর মানুষ হলো উদ্দেশ্যহীন! (এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে আল্লাহ ঊর্ধ্বে, বহু ঊর্ধ্বে।) কারো বলে দিতে হয় না, একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক-বিচক্ষণতা এবং ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা দান করা হয়েছে শুধু এজন্য যে, মানুষ যেন তার স্রষ্টাকে চিনতে পারে, স্রষ্টার আনুগত্য গ্রহণ করে এবং স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী জীবন অতিবাহিত করে। এভাবে যেন সে স্রষ্টার কাছ থেকে সর্বোত্তম প্রতিদান ও পুরস্কার লাভের উপযুক্ত হতে পারে। যারা এটা করবে তাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার অশেষ দয়া ও করুণা এবং অনুগ্রহ ও অনুকম্পার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটবে। পক্ষান্তরে যারা স্রষ্টার প্রতি বিদ্রোহ করবে এবং অবাধ্যতা ও নাফরমানির জীবন বেছে নেবে তাদের উপর মহাপ্রতাপশালী আল্লাহর ক্রোধ ও প্রতাপের এবং কাহর ও গযবের পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটবে। মানুষের প্রতি আল্লাহ তা‘আলার সবচে’ বড় অনুগ্রহ এই যে, মানুষকে তিনি তার সৃষ্টি-উদ্দেশ্য সম্পর্কে পূর্ণরূপে অবহিত করার পরিপূর্ণ ব্যবস্থা করেছেন। বিশ্বজগতের সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? মানুষের সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? মানুষের প্রতি আল্লাহর আদেশ-নিষেধ কী? স্রষ্টার প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার কী এবং অবাধ্যতার শাস্তি কী? এসকল বিষয় মানুষ যেন সুস্পষ্টরূপে জানতে ও বুঝতে পারে এবং মান্য করতে পারে সেজন্য আল্লাহ তা‘আলা কিতাব ও রাসূল এবং নবী ও পয়গম্বর প্রেরণের সিলসিলা কায়েম করেছেন। এই সিলসিলা শুরু হয়েছে মানবজাতির আদি পিতা হযরত আদম (আ.) থেকে এবং তা সমাপ্ত হয়েছে সর্বশেষ নবী এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। নবী ও ওয়ারিছে নবী এটা আমরা সবাই জানি যে, এই পৃথিবীতে আম্বিয়া আলাইহিমুস্‌- সালামের প্রতি আসমানী দায়িত্ব ছিলো দু’টি। প্রথমত অহীর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে আদেশ-নিষেধ ও হিদায়াত গ্রহণ করা, ধারণ করা এবং বহন করা। দ্বিতীয়ত অহীর মাধ্যমে প্রাপ্ত আদেশ-নিষেধ ও হিদায়াত আল্লাহর বান্দাদের নিকট পৌঁছানো এবং সেই হিদায়াতের উপর তাদেরকে পরিচালিত করার চেষ্টা-মেহনতা করা। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement