রজব ১৪৪১   ||   মার্চ ২০২০

সহীহ হাদীসের আলোকে মিরাজুন্নবীর ঘটনা

মুহাম্মাদ ত্বহা হুসাইন

[ইসরা ও মিরাজের ঘটনা নবী জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়,  নবীজীর রিসালাতের অনেক বড় মুজিযা আর উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য আল্লাহ প্রদত্ত একটি বড় নিআমত। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আল্লাহ তাআলা যেমন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সম্মান আরো বৃদ্ধি করেছেন, তেমনি তাঁর উচ্চ মর্যদা সম্পর্কে অবগত করেছেন সৃষ্টিজগৎকে। এই ঘটনা যেভাবে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবন ও সীরাতের সাথে সম্পর্কিত, সেভাবে তা ইসলামী আক্বীদা ও বিশ্বাসেরও অংশ। এই ঘটনায় একদিকে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও নির্দেশনা, অন্যদিকে সেখানে লুকিয়ে রয়েছে অসংখ্য ইলাহী হিকমত ও রহস্য। কিন্তু নবীজীর সশরীরে ইসরা ও মিরাজের বাস্তবতার উপর ঈমান আনার পর মুমিনের জন্য যে প্রয়োজনটি সর্বাগ্রে অনুভূত হয় তা হল কুরআনে কারীম ও সহীহ হাদীসের আলোকে ইসরা ও মিরাজের পুরো ঘটনার পূর্ণাঙ্গ ইলম হাসিল করা। এই প্রয়োজনটি আরো প্রকটভাবে দেখা দেয় যখন অনির্ভরযোগ্য কিছু পুস্তিকা ও চটি বই, দায়িত্বহীন অনেক বক্তা ও তাদের দায়িত্বজ্ঞানশূণ্য কতক লেকচারের কল্যাণে (!) অনেক মানুষকে ইসরা ও মিরাজের সঠিক ইলম থেকেও দুঃখজনকভাবে বঞ্চিত হতে দেখা যায়। ফলে তাদের মন ও মননে দিনদিন ভিত্তিহীন কিছু বর্ণনাই গ্রথিত হয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, মিরাজের তত্ত্ব ও রহস্য, শিক্ষা ও নির্দেশনা এবং মিরাজ নিয়ে জনমনে পোষণ করা কিছু ভুল ধারণার সংশোধন ইত্যাকার বিষয় নিয়ে দলীল-নির্ভর আলোকপাতধর্মী কয়েকটি প্রবন্ধ আমরা আলহামদু লিল্লাহ আলকাউসার পাঠকদের উপহার দিয়েছিলাম। আগ্রহী কোনো পাঠক ইচ্ছা করলে আলকাউসার আগস্ট ’০৫ও আগস্ট ’০৬ঈ.  সংখ্যা দু‘টি আবারও অধ্যয়ন করতে পারেন।

এ সংখ্যায় সহীহ হাদীসের আলোকে ইসরা ও মিরাজের ঘটনার পূর্ণাঙ্গ একটি বিবরণ আলকাউসার পাঠকদের উপহার দেওয়ার তাকিদ অনুভব করছি। এই অনুভূতি থেকে লেখক সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮৮৭ এবং সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৪ ও ২৫৯-এ সাহাবী হযরত মালেক ইবনে সা‘সাআ রা. ও হযরত আনাস রা. -এর বর্ণনাদু‘টিকে মূল হিসেবে অবলম্বন করে ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যবহুল এই ঘটনার মোটামুটি একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ একটি প্রবন্ধে আনতে প্রয়াস পেয়েছেন। নির্ভরযোগ্য অন্যান্য বর্ণনায় বিদ্যমান বিষয়গুলোও তার সাথে জুড়ে দিয়েছেন এবং হাদীসের প্রসিদ্ধ গ্রন্থাবলী থেকে তার উদ্ধৃতিও উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা  লেখককে জাযায়ে খায়ের দান করুন। আমীন। -তত্ত্বাবধায়ক]

 

হিজরতে মদীনার আগের কথা। বাধা আর সফলতার মাঝে এগিয়ে চলছিল ইসলামের অগ্রযাত্রা। কাফির-মুশরিকদের ঠাট্টা-বিদ্রƒপ আর অকথ্য নির্যাতনে শানিত হচ্ছিল মু‘মিনের ঈমান, জ্বলে উঠছিল মুসলমানের দ্বীনী জযবা। এমনি সময়ে কোনো এক রাতে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদের নিয়ে ইশার নামায আদায় করলেন। অতঃপর খানায়ে কাবা সংলগ্ন ‘হাতীমে’ শুয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলেন। এই সেই ‘হাতীম’, যা এক সময়ে খানায়ে কাবারই অংশ ছিল। মক্কার কাফেররা গুরুত্বপূর্ণ কাজে এখানে সমবেত হত, পরস্পর শপথ ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হত। সংকটাপন্ন মুহূর্তে দুআর জন্য প্রসারিত করত দু’হাত। মক্কার সর্দারেরা এখানে প্রায় বিশ্রাম নিত। নবীজীও মাঝে মাঝে আরাম করতেন। ওই রাতেও নবীজী সেখানে তন্দ্রাবিষ্ট ছিলেন; নিদ্রা তখনও আসেনি। আর নবী-রাসূলগণের নিদ্রা তো এমনই হয়; চোখ দুটো তাঁদের মুদে আসলেও ক্বলব থাকে সতত জাগ্রত। জিবরীল আমীন আ. নেমে এলেন। নবীজীকে জাগ্রত করলেন। অতঃপর তাঁকে নিয়ে গেলেন আবে যমযমের নিকটে। তাঁর বক্ষের অগ্রভাগ হতে চুল পর্যন্ত বিদীর্ণ করা হল। বের করা হল তাঁর হৃৎপি-। তা আবে যমযম দ্বারা শোধন করা হল। ঈমান ও প্রজ্ঞায় ভরপুর স্বর্ণের একটি পেয়ালা এনে তা দিয়ে ভরে দেওয়া হল নবীজীর বক্ষ মুবারক। অতঃপর হৃৎপি- যথাস্থানে রেখে দিয়ে উপরিভাগ সেলাই করে দেয়া হল। হযরত আনাস রা. বলেন, আমি এর চিহ্ন নবীজীর বুকে প্রত্যক্ষ করেছি।

‘বুরাক’ নামক ক্ষিপ্রগতির একটি সওয়ারী আনা হল, যা ছিল গাধার চেয়ে বড় ও খচ্চরের চেয়ে ছোট এবং দীর্ঘদেহী। রং ছিল শুভ্র। এমনই ক্ষিপ্র ছিল তার চলার গতি যে, দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে পড়ত তার পায়ের খুর। তার পিঠের উপর জিন আঁটা ছিল, মুখে ছিল লাগাম। নবীজী রেকাবে পা রাখবেন এমন সময় ‘বুরাক’ ঔদ্ধত্য দেখাল। জিবরীল তাকে থামিয়ে বললেন, হে  বুরাক! তুমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করছ? তুমি কি জান, আল্লাহ্র কাছে তার চেয়ে মহান ও প্রিয়তম কোনো ব্যক্তি কখনও তোমার উপর সওয়ার হয়নি। একথা শুনতেই বুরাক ঘর্মাক্ত হয়ে গেল।১ অতঃপর নবীজী বুরাকে আরোহণ করলেন। মুহূর্তেই এসে উপস্থিত হলেন জেরুজালেম নগরীর বায়তুল মাকদিসে। জিবরীল একটি পাথর ছিদ্র করে বুরাককে বেঁধে রাখলেন।২ এটা সেই বৃত্ত, যেখানে নবীগণও নিজেদের বাহন বেঁধে রাখতেন।৩ বায়তুল মাকদিসে ঢুকে তিনি দেখেন, হযরত মূসা আ. নামাযরত আছেন। তিনি ছিলেন ছিপছিপে ও দীর্ঘ দেহের অধিকারী। তাঁর চুল ছিল কোঁকড়ানো, যা ছিল কান পর্যন্ত ঝুলন্ত। দেখে মনে হবে যেন ‘ শানওয়া’ গোত্রেরই একজন লোক। হযরত ঈসা আ.-কেও দ-ায়মান হয়ে নামায পড়তে দেখা গেল। তিনি ছিলেন মাঝারি গড়নের, সাদা ও লাল রং বিশিষ্ট। তাঁর চুল ছিল সোজা ও চাকচিক্যময়। তাঁর আকার-আকৃতি সাহাবী উরওয়া ইবনে মাসউদ সাকাফী রা.-এর সাথে অধিক মেলে। হযরত ইব্রাহীম আ.-কেও নামাযরত অবস্থায় দৃষ্টিগোচর হল। নবীজী বলেন, তাঁর দেহাবয়ব আমার সাথে অধিক সামঞ্জ্যশীল।৪

ইতিমধ্যে জামাত প্রস্তুত হল। তিনি দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। সকল নবী-রাসূলগণ নবীজীর পিছনে ইক্তেদা করলেন। ওখান থেকে বের হয়েই দেখলেন, জিবরীল আ.-এর হাতে দুটি সুদৃশ্য পাত্র। একটি শরাবের, অপরটি দুধের । পাত্রদুটি পেশ করা হলে নবীজী দুধেরটিকেই বেছে নিলেন। এতদ্দর্শনে জিবরীল আ. তাঁকে বললেন, আপনি ও আপনার উম্মত স্বভাবজাত ফিত্রাতকেই বেছে নিয়েছেন। আপনি যদি শরাব পছন্দ করতেন, তাহলে আপনার উম্মত পথভ্রষ্ট হয়ে যেত।৫

এরপর শুরু হল ঊর্ধ্বজগতের সফর। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুরাকের উপরই ছিলেন। একে একে প্রতি আকাশের দ্বার তাঁর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হল। প্রথমে দুনিয়ার দৃশ্যমান আসমানে এসে জিবরীল আ. দ্বার উন্মুক্ত করতে অনুরোধ করেন। অপর প্রান্ত হতে প্রশ্ন হয়, কে আপনি? তিনি বললেন, আমি জিবরীল।

প্রশ্ন  করা হয়, কে আছেন আপনার সাথে? বললেন, মুহাম্মাদ।

প্রশ্ন হয়, আপনি কি তাঁর কাছে প্রেরিত হয়েছেন? বললেন, হাঁ

অতঃপর প্রথম আসমানের দ্বার খুলে দেওয়া হয়। তাঁরা এর উপরে উঠে আসেন। নবীজী বলেন, ওখানে এক ব্যক্তিকে দেখতে পেলাম, যার ডানদিকে রূহের একটি ঝাঁক দেখা গেল, বামদিকেও তেমনি একটি ঝাঁক।

ওই ব্যক্তি ডানদিকে তাকালে হাসেন আর বামদিকে তাকালে ক্রন্দন করেন। তিনি আমাকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন এবং বললেন, মারহাবা হে মহান পুত্র! মারহাবা হে মহান নবী!!

নবীজী জিবরীলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কে? তিনি বললেন, তিনি আদম আ.। তাঁর ডান ও বামদিকে যাদের দেখলেন তারা তাঁর আওলাদ। ডানদিকে যারা তারা জান্নাতী; আর বামদিকে যারা, তারা দোযখী। আর তাই তিনি ডানদিকে তাকিয়ে হাসেন এবং বামদিকে তাকিয়ে কাঁদেন।৬

এরপর জিবরীল আ. নবীজীকে নিয়ে দ্বিতীয় আকাশের পানে ছুটলেন। সেখানেও দ্বার উন্মুক্ত করতে বলা হলে জিজ্ঞাসা করা হল, কে? তিনি জবাব দিলেন, জিবরীল। প্রশ্ন করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি উত্তর দিলেন, মুহাম্মাদ। আবার প্রশ্ন হল, তিনি কি আহূত হয়েছেন? তিনি বললেন, হাঁ, তাঁকে আনার জন্য আমি প্রেরিত হয়েছি। দ্বার উন্মুক্ত করা হলে সেখানে দু’খালাত ভাই অর্থাৎ  হযরত ঈসা আ. ও ইয়াহইয়া ইবনে যাকারিয়া আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হল। তাঁরা উভয়ই নবীজীকে মারহাবা বলে দুআ করলেন। এরপর জিবরীল তাঁকে তৃতীয় আকাশে নিয়ে গিয়ে পূর্বের মতো প্রশ্নোত্তর পর্বের পর দ্বার উন্মুক্ত হলে সেখানে হযরত ইউসুফ আ.-এর সাথে মুলাকাত হল। আল্লাহ তাআলা তাঁকে গোটা রূপ-সৌন্দর্যের অর্ধেকটাই দান করেছিলেন। তিনিও নবীজীকে মারহাবা বলে উষ্ণ অভিবাদন জ্ঞাপন করলেন।

একই পদ্ধতিতে চতুর্থ আকাশে পৌঁছালে সেখানে হযরত ইদরীস আ.-এর সাথেও শুভেচ্ছা বিনিময় হল। নবীজী বলেন, আমরা যখন সেখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন হযরত মূসা আ. ক্রন্দন করতে লাগলেন। কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, এই যুবক আমার পরে প্রেরিত হয়েছে। তদুপরি তাঁর উম্মত আমার উম্মতের চেয়েও অনেক বেশি জান্নাতে যাবে। একথা ভেবেই আমি কাঁদছি। সেখান থেকে নবীজীকে সপ্তম আকাশে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তিনি হযরত ইব্রাহীম আ.-কে দেখলেন, তিনি বায়তুল মা‘মুরে ঠেস দিয়ে উপবিষ্ট। বায়তুল মা‘মুর সেই স্থান যেখানে প্রত্যহ এমন সত্তর হাজার ফেরেশতা ইবাদত করার জন্য প্রবেশ করে, যাদের পালা এরপর আর কখনও আসে না।

হযরত ইব্রাহীম আ.ও নবীজীকে দেখে অভ্যর্থনা জানালেন। অতঃপর তিনি নবীজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মুহাম্মাদ! আপনার উম্মতকে আমার সালাম বলুন এবং তাদেরকে অবগত করুন যে, জান্নাতের মাটি পবিত্র, এর পানি সুমিষ্ট। জান্নাত হচ্ছে খুব পরিচ্ছন্ন ও সমতল। এর বৃক্ষ হচ্ছে-

سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله، الله أكبر ولا حول ولا قوة إلا بالله العلى العظيم.

অতঃপর নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘সিদরাতুল মুনতাহা’ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হল। পৃথিবী থেকে যেসকল বস্তু অথবা রূহ উপরে আরোহণ করে, সেগুলো এখানে পৌঁছে থেমে যায়। তদ্রƒপ ঊর্ধ্বজগৎ থেকে নিম্নে আগমনকারী সব কিছু এখানে এসে থেমে যায়। নবীজী বলেন, সিদরাতুল মুনতাহার পাতা ছিল হাতির কানের মতো, আর ফল ছিল বড় মটকার মতো। আল্লাহ তাআলার নির্দেশ যখন বৃক্ষটিকে ঘিরে নিল, তখন সে এক অপরূপ সাজে সজ্জিত হল। কোনো মানুষের সাধ্য নেই সে সৌন্দর্য বর্ণনা করার। নবীজী বলেন, সিদরাতুল মুনতাহা পেরিয়ে এত ঊর্ধ্বে পৌঁছে যাই, যেখান থেকে আমি আল্লাহ্র হুকুম-আহকাম লিপিবদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত ফেরেশতাদের ‘কলমের’ আওয়াজ শুনতে পেলাম।

অতঃপর, আল্লাহ নবীজীকে যা দিবার ছিল তা দিলেন। তিনি দিনরাত্রিতে পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায ফরয করলেন। ফিরে আসতে হযরত মূসা আ.-এর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি নবীজীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার রব আপনার উম্মতের উপর কী ফরয করেছেন? নবীজী বললেন, পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামায। তিনি বললেন, আপনি মহান রবের কাছে ফিরে যান এবং আরও হ্রাস করার আবেদন করুন। এতটুকু পালনের সাধ্য আপনার উম্মতের নেই। আমি তো বনী ইসরাঈলকে এর চেয়ে অনেক কম ফরয দিয়ে খুব পরীক্ষা করে দেখেছি। নবীজী ফের মহান রবের কাছে ফিরে গেলেন এবং বললেন, রাব্বুল আলামীন! আমার উম্মতের জন্য নামায আরও হ্রাস করুন। আল্লাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায কমিয়ে দিলেন। ফিরে আসার সময় পঁয়তাল্লিশ ওয়াক্ত নামাযের কথা হযরত মূসা আ.-কে জানালে তিনি বললেন, আপনার উম্মতের এতটুকু পালন করার সামর্থ্য নেই। অতএব আরও হ্রাস করার আবেদন করুন। নবীজী বললেন, আমি এমনিভাবে বারবার আপন রব ও মূসা আ.-এর কাছে আসা-যাওয়া করতে থাকলাম। আর প্রতিবারই পাঁচ-পাঁচ করে কমতে থাকল। অবশেষে আল্লাহ পাক ইরশাদ করলেন, মুহাম্মাদ! দিবা-রাত্রির মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই মাত্র। প্রত্যেক নামাযের জন্য দশ নামাযের সওয়াব, ফলে সেই পঞ্চাশ নামাযই হয়ে যাবে। যে ব্যক্তি সৎকাজের ইচ্ছা করবে, এরপর তা আমলে পরিণত করবে না, তার জন্যও একটি নেকী লেখা হবে। আর যে ইচ্ছা করার  পর আমলেও পরিণত করবে, সে দশটি নেকী পাবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি মন্দ কর্মের কেবল ইচ্ছা করে, আমলে পরিণত করে না, তার কোনো গুনাহ লেখা হবে না। আর যদি আমলেও পরিণত করে তবে একটি মাত্র গুনাহ লিপিবদ্ধ হবে।

নবীজী বলেন, এরপর আমি নেমে এসে হযরত মূসা আ.-এর কাছে গেলাম। তাঁকে সবকিছু অবগত করলে তিনি বললেন, আপনার রবের কাছে গিয়ে আরও হ্রাস করার আবেদন করুন। আমি বললাম, মহান প্রভুর কাছে অনেকবার গিয়েছি, আবেদন করেছি। এখন আমার লজ্জা হচ্ছে। অবশেষে জান্নাত, জাহান্নাম ও সপ্তাকাশের দীর্ঘ সফর করে মহান মাওলার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য পেয়ে নবীজী ফিরে এলেন মক্কায়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ পবিত্র রজনীতে মুসলমানদের জন্য তিনটি বিষয় হাদিয়াস্বরূপ নিয়ে এসেছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামায, সূরা বাকারার শেষ আয়াতসমূহ এবং পুরো উম্মতের মধ্যে শিরক থেকে আতœরক্ষাকারী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত ও ক্ষমার ঘোষণা। এ ছিল উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য মিরাজের পুরস্কার।৮

 এ ছিল মিরাজুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র। এর মাঝে জান্নাত ও জাহান্নামসহ বৈচিত্র্যময় সৃষ্টির অনেক কিছুই প্রত্যক্ষ করেছেন নবীজী।৯ বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত বর্ণনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বিচিত্র ঘটনাবলি থেকে নির্ভরযোগ্য ঘটনা উল্লেখ করলে বিবরণ পূর্ণতা পাবে বলে মনে হয়। যেমন

১। এ রাতে নবীজী জাহান্নাম পরিদর্শনে গেলে মালেক নামক জাহান্নামের প্রধান রক্ষী নবীজীকে সালাম ও অভ্যর্থনা জানান।১০

২। তিনি দাজ্জালকেও দেখেছিলেন।১১

৩। এমন এক দল লোকের পাশ দিয়ে নবীজী গমন করেছিলেন, যাদের নখ ছিল তামার। এই নখ দ্বারা তারা স্বীয় মুখম-ল ও বক্ষ আচঁড়াচ্ছিল। এদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জিবরীল নবীজীকে জানালেন, এরা সেই লোক, যারা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত। অর্থাৎ একে অপরের গীবত ও মানহানি করত। অন্য এক বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, বরং দুনিয়াতে গীবতকারী এসব লোকদেরকে মৃত ভক্ষণ করতে দেখেছিলেন নবীজী।১২

৪। এই মহান রাতে নবীজী এমন কিছু লোককে দেখতে পেয়েছিলেন, যাদের ঠোঁট কাঁচি দিয়ে কাটা হচ্ছিল, ঠোঁট কাটা মাত্র তা পুনরায় জোড়া লেগে পূর্ববৎ হয়ে যেত। এদের স¤পর্কে প্রশ্ন করলে জিবরীল নবীজীকে উত্তর দিলেন, এরা এমন বিষয়ে বক্তৃতা ও ওয়ায করত, যা তারা নিজেরা আমল করত না।১৩

৫। শবে মেরাজে নবীজী এমন লোকদের দেখলেন, যাদের পেট ছিল এক একটি গৃহের মতো। পেটের ভেতরটা ভর্তি ছিল সর্পে, যা বাইরে থেকেই দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল। প্রশ্ন করা হলে জিবরীল জানালেন, এরা সুদখোর।১৪

৬। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাত দেখার সৌভাগ্যও লাভ করেছিলেন।১৫

৭। মোতি জমরদের প্রাসাদে ঘেরা একটি নহর দেখতে পেলেন, যার পানি ছিল মেশক-এর চেয়ে বেশি সুগন্ধিময়।  এটা কী- নবীজী জানতে চাইলে জিবরীল আ. বললেন, এর নাম ‘কাওসার’, যা আপনার প্রতিপালক একমাত্র আপনার জন্যই সুরক্ষিত করে রেখেছেন।

৮। মহানবী চারটি নদীও দেখেছিলেন। এর মধ্যে দু’টি জাহেরী আর দু’টি বাতেনী। বাতেনী দু’টি জান্নাতে প্রবাহিত আর জাহেরী দু’টি হচ্ছে নীল ও ফোরাত।

৯। নবীজী জান্নাতে প্রবেশ করে একপাশে একটি হালকা আওয়াজ শুনতে পেলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কিসের আওয়াজ? জিবরীল বললেন, মুয়াযযিন বেলালের কণ্ঠ। মিরাজ থেকে ফিরে নবীজী সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বললেন, বেলাল সাফল্য অর্জন করেছে, আমি তার জন্য এমন সব মর্তবা দেখেছি।১৬

১০। শবে মিরাজে নবীজী এক পবিত্র খোশবুর কাছ দিয়ে গেলেন। তিনি সুধালেন, এটা কীসের  খোশবু? ফেরেশতারা বলল, এটা ফেরাউন-তনয়ার কেশ বিন্যাসকারিনী ও তার সন্তানদের খোশবু। কোনো একদিন চুল আচঁড়াতে গিয়ে তার হাত থেকে চিরুনী পড়ে গেলে সে বিসমিল্লাহ বলেছিল। ফেরাউন-তনয়া বলল আমার পিতা? মহিলা বলল, আমার রব তিনি, যিনি আপনার ও আপনার পিতার প্রতিপালক। ফেরাউন-তনয়া বলল, আমার পিতা ছাড়া কি তোমার অন্য কোনো রবও আছে? মহিলা বলল, হাঁ। এ খবর ফেরাউনের কানে গেলে সে মহিলাকে ডেকে বলল, আমি ছাড়া তোর আরও রব আছে? সে বলল, হাঁ, আমার ও আপনার প্রতিপালক তো মহান আল্লাহ তাআলা। শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে ফিরাউন তামায় নির্মিত একটি বড় পাত্রে তেল ভরে খুব গরম করার আদেশ দিল। ওই মহিলা ও তার সন্তানদের এতে নিক্ষেপের হুকুম হল। ফিরাউনের লোকেরা এক এক করে সবাইকে তাতে নিক্ষেপ করতে লাগল। সবার শেষে মায়ের কোলে থাকা নিষ্পাপ শিশুটির পালা এল। ছোট্ট শিশু মুখ ফুটে মাকে অভয় দিল। বলে উঠল, মা নেমে পড়ো, পিছপা হয়ো না। আখিরাতের আযাবের তুলনায় দুনিয়ার আযাব তো অতি তুচ্ছ।১৭

১১। বিভিন্ন বর্ণনা দ্বারা জানা যায়, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়তুল মাকদিসে যাওয়া বা আসার পথে মক্কার কুরাইশদের বাণিজ্য কাফেলাও দেখতে পেয়েছিলেন।১৮

শবে মিরাজের সকাল বেলা। নবীজী হাতীমে কাবায় চিন্তিত মন নিয়ে একান্তে বসে আছেন। মনে মনে ভাবছেন, রাত্রে সংঘটিত মিরাজ ও ইসরার কথা প্রকাশ করলে মানুষ আমাকে মিথ্যুক ঠাওরাবে না তো? ইতিমধ্যে কাছ দিয়ে যাচ্ছিল আবু জাহল। নবীজীর কাছে বসে বিদ্রƒপের ছলে বলল, কোনো ব্যাপার আছে নাকি? নবীজী বললেন, হাঁ। সে বলল কী? তিনি জবাব দিলেন, আজ রাতে আমার মিরাজ হয়েছে। সে বিস্ময়ের সাথে সুধাল, কতদূর পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল? নবীজী বললেন, বায়তুল মাকদিস পর্যন্ত। সে আরও ঠাট্টা করে বলে উঠল, চমৎকার তো! এরপর সকালেই তুমি আমাদের কাছে এসে গেলে? তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, হাঁ। এরপর আবু জাহল কথা না বাড়িয়ে তাঁকে বলল, আচ্ছা! আমি যদি পুরো কওমকে ডেকে নিয়ে আসি তাহলেও কি তুমি একই কথা বলতে পারবে? নবীজী আরও সুদৃঢ় হয়ে বললেন, অবশ্যই। আবু জাহল লুয়াই ইবনে কা‘ব গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগল। আর তারাও দলে দলে খানায়ে কাবায় সমবেত হতে লাগল। সকলে এসে উপস্থিত হলে আবু জাহল বলল, আমাকে যা কিছু তুমি শুনিয়েছিলে, পারলে তা এদের কাছেও ব্যক্ত করো। নবীজী পুনরায় একই ঘটনা তাদের সম্মুখে ব্যক্ত করলে কিছু লোক বিস্ময়ে হাতের উপর হাত রাখল। আবার অনেকেই হতবাক হয়ে মাথায় হাত দিল। তারা বলল, তাহলে তুমি কি আমাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে পারবে? উল্লেখ্য, উপস্থিত অনেকেই বায়তুল মাকদিস সম্পর্কে সম্যক অবগত ছিল।১৯

নবীজী বলেন, আমি তাদের কাছে বায়তুল মাকদিসের অবস্থা বর্ণনা করতে লাগলাম। কিছু বিষয় আমার কাছে অস্পষ্ট মনে হচ্ছিল। মনে মনে আমি খুব চিন্তিত হচ্ছিলাম। আমি তখনও কাবার হাতীমে পুরো কওমের সামনে দ-ায়মান, ইতিমধ্যেই পুরো বায়তুল মাকদিস আমার চোখের সামনে উদ্ভাসিত করা হল। আকীলের ঘরের উপর উদ্ভাসিত বায়তুল মাকদিস আমি স্বচক্ষে দেখে দেখে সব কিছু নিসংকোচে বলতে লাগলাম। শুনে উপস্থিত লোকেরা মন্তব্য করল, মানচিত্র ও অবস্থা তো সঠিকই বর্ণিত হয়েছে।

মক্কার কোনো পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন হযরত আবু বকর রা.। মক্কার কাফেররা তাকে এ বিস্ময়ের কথা বলে সুধাল, তবুও কি তুমি তাকে বিশ্বাস করবে? হযরত আবু বকরের হৃদয়ে ঈমানের বহ্নিশিখা জ্বলে উঠল। তিনি এক আকাশ আস্থা নিয়ে সুদৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, আমি তো এর চেয়েও আরো দূরের অনেক জটিল বিষয়েও তাঁকে বিশ্বাস করি। তাঁর কাছে আসা আসমানী বার্তাসমূহের উপর রয়েছে আমার অটল বিশ্বাস ও সুদৃঢ় ঈমান। অতএব...২০

 

তথ্যসূত্র : ১. তিরমিযী. হাদীস ৩১৩১, ২. প্রাগুক্ত, হাদীস ৩১৩২, ৩. মুসনাদে আহমাদ ২/৫২৮, ৪. মুসলিম, হাদীস ১৬৭, ৫. প্রাগুক্ত, হাদীস ১৬৮, ৬. বুখারী, হাদীস ৩৪৯, ৭. তিরমিযী, হাদীস ৩৪৬২, ৮. মুসলিম, হাদীস ২৭৯, ৯. আহমাদ ৫/৩৮৭, ১০. মুসলিম, হাদীস ১৬৫, ১১. প্রাগুক্ত, ১২. আহমাদ ৩/২২৪, ১৩. প্রাগুক্ত ৩/১৮১, ১৪. প্রাগুক্ত ২/৩৫৩, ১৫. তিরমিযী, হাদীস ৩১৪৭, ১৬. আহমাদ ১/২৫৭, ১৭. প্রাগুক্ত ১/৩০৯-৩১০, ১৮. মুসান্নাফ, ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ৩২৩৫৭, ১৯. তিরমিযী, হাদীস ৩৪৬২, ২০. মুসতাদরাক ২/৩৬১

 

[রজব ১৪২৮হি. / আগস্ট ২০০৭ঈ. থেকে পুনঃমুদ্রিত]

 

 

advertisement