শাবান-রমজান ১৪৩১   ||   আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১০

ফতোয়া, কাযা, হদ ও তা’যীরঃ পরিচিতি ও কিছু মৌলিক বিধান - ২

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

গত সংখ্যায় এ প্রবন্ধের প্রথম কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে। যাতে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে ফতোয়ার আভিধানিক ও পারিভাষিক অর্থ, ফতোয়ার পরিচিতি এবং কুরআন-সুন্নাহ ও ইজমার আলোকে ফতোয়ার মর্যাদা ও কিছু মৌলিক বিধান সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই অংশে ফতোয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং প্রতি যুগে ফতোয়া-সংকলন সংক্রান্ত যে বিপুল ঐতিহাসিক তথ্য বিদ্যমান রয়েছে তার কিছু নিদর্শন উপস্থাপন করার চেষ্টা করা হয়েছে। বিষয়টি দীর্ঘ আলোচনার দাবিদার। এখানে কিছু ইঙ্গিত করা হয়েছে মাত্র। এ প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা আগামী কিস্তিতে আসবে এরপর নিম্নোক্ত শিরোনামগুলির উপরও সংক্ষিপ্ত আলোচনা থাকবে ইনশাআল্লাহ। ১. ফিকহ, ফতোয়া ও শরীয়তের পারস্পরিক সম্পর্ক। ২. ফতোয়ার বিষয়বস্তু ও তার পরিধি। ফতোয়া কি শুধু ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়েই সীমাবদ্ধ? ৩. ফতোয়া ও কাযার পার্থক্য। ফতোয়ার জন্য কি রাষ্ট্রীয় নিয়োগ অপরিহার্য? ৪. ফতোয়া কি আইনী ব্যক্তিত্বের আইনী সিদ্ধান্তের নাম? ৫. বিচারকদের জন্য মুফতীর শরণাপন্ন হওয়ার নির্দেশ। ৬. ফতোয়া ও মানবাধিকার। ৭. ফতোয়ার অপব্যবহার ও সরকারের দায়িত্ব। ৮. হদ, তাযীর ও তাদীব : পরিচিতি ও মৌলিক বিধান। ৯. হদ ও তাযীর কার্যকর করা রাষ্ট্রের কাজ। এটি ফতোয়ার আওতাবহির্ভুত। ১০. হদ ও তাযীর কার্যকর করা এবং কাযা ও বিচার সম্পর্কে ইসলামের মৌলিক বিধিবিধান। ১১. তাযীরের ভুলপ্রয়োগ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অপরাধ ও অশ্লীলতা বন্ধের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের অপরিহার্যতা। ১২. উক্ত সেমিনারের সম্পর্কে দৈনিক পত্রপত্রিকার রিপোর্টিং ও কিছু কথা। ১৩. ফতোয়ার নামে তাযীরমূলক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে আদালতের রায়। ১৪. পরিশিষ্ট। ফতোয়ার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং ফকীহগণের ফতোয়া-সংকলন যেদিন থেকে ইসলাম সেদিন থেকেই ফতোয়া আল্লাহতাআলা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যেসব দায়িত্ব ও পদের অধিকারী করেছেন তন্মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হচ্ছে ইফতা বা ফতোয়াপ্রদান। প্রকৃতপক্ষে বিধানদাতা একমাত্র আল্লাহ তাআলা। তিনিই বিধান দান করেন এবং তাহলীল-তাহরীম তথা হালাল করা ও হারাম করার অধিকার একমাত্র তাঁর। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহতাআলার আদেশে তাঁর নাযিলকৃত অহীর ভিত্তিতে শরীয়তের বিধান প্রণয়ন এবং হালাল-হারামের হুকুম প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছেন। কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তাআলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসার জবাব দিতে বলেছেন এবং কী জবাব দিবেন, কীভাবে দিবেন তা-ও বলে দিয়েছেন। দেখুন : সূরা বাকারা : ১৮৯, ২১৫, ২১৭, ২১৯, ২২০ ও ২২২; সূরা মায়িদা : ৪; সূরা নিসা : ১২৭, ১৭৬ এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইফতার দায়িত্ব পালন ছিল সরাসরি আল্লাহ তাআলার প্রতিনিধিত্ব। তাঁর ব্যক্তিসত্তা যেমন মাসূম ও নিষ্পাপ ছিল তেমনি তাঁর ইফতা ফতোয়াদানও ছিল মাসূম ও সন্দেহাতীতভাবে নির্ভুল। কারণ আল্লাহ তাআলা তাঁকে ভুলের উপর বিদ্যমান রাখতেন না। তো মূলকথা এই যে, ইসলামে (শরীয়তে মুহাম্মাদীতে) আল্লাহর প্রতিনিধি হয়ে সর্বপ্রথম ফতোয়াদানকারী হলেন স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইমাম ইবনুল কাইয়্যিমের ভাষায়- أول من قام بهذا المنصب الشريف سيد المرسلين অর্থাৎ ইফতার দায়িত্বে সর্বপ্রথম যিনি সমাসীন হন তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (ইলামুল মুয়াককিয়ীন খ : ১, পৃষ্ঠা : ৯) উম্মতের দ্বীনী জিজ্ঞাসার জবাবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা কিছু বলেছেন সব হাদীস ও আছার এবং সুন্নত ও সীরাতের কিতাবে হুবহু বিদ্যমান রয়েছে। ওয়ালিল্লাহিল হামদ। ২. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় অনেক সাহাবী তাঁর আদেশক্রমে নবী-শিক্ষা অনুযায়ী ফতোয়া দিতেন, বিশেষত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাঁদেরকে বিজিত অঞ্চলসমূহে দ্বীনের শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করতেন তাঁরা মানুষকে ফতোয়া প্রদান করেছেন। (সহীহ বুখারী,কিতাবু আখবারিল আহাদ) আটজন বিশিষ্ট সাহাবী সম্পর্কে তো সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, তাঁরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় ফতোয়া দিতেন। তাঁরা হলেন, আবু বকর রা., উমর রা., উছমান রা., আলী রা., মুয়ায ইবনে জাবাল রা., উবাই ইবনে কাব রা., আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা. ও যায়েদ ইবনে ছাবিত রা.। (আসসুয়ূতী (৯১১ হি.) : আদাবুল ফুতয়া পৃষ্ঠা : ৬৭-৭১) ৩. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরপর ফতোয়ার দায়িত্ব পূর্ণরূপে সাহাবায়ে কেরামের উপর অর্পিত হয়। লক্ষাধিক সাহাবীর মধ্যে ফতোয়াদানকারী সাহাবীর সংখ্যা ত্রিশেরও কম। তবে সারা জীবনে যাঁদের একটি বা দুটি ফতোয়া দেওয়া প্রমাণিত তাদের নাম যোগ করলে পূর্ণ সংখ্যা ১৩০ এর মতো দাঁড়ায়। সাধারণ সাহাবী ও সাধারণ তাবেয়ীগণ ঐসকল ফকীহ/মুফতী সাহাবীর নিকট থেকে মাসআলা জেনে আমল করতেন। (ইবনে হাযম (৪৫৬ হি.) : ইহকামুল আহকাম খ : ৫, পৃষ্ঠা : ৮৮; ইবনুল কাইয়্যিম (৭৫১ হি.) : ইলামুল মুয়াককিয়ীন, খ : ১, পৃষ্ঠা : ৭-১৮) এই ১৩০ জন সাহাবীর মধ্যে সর্বাধিক ফতোয়া দানকারী সাহাবী সাতজন : উমর ইবনুল খাত্তাব রা., আলী ইবনে আবু তালিব রা.,আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা., যায়েদ ইবনে ছাবিত রা., আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.। এঁদের ও অন্যান্য মুফতী সাহাবা-তাবেয়ীনের ফতোয়া আছারে ছাহাবা বিষয়ক গ্রন্থাবলিতে, বিশেষত কিতাবুল আছার, ইমাম আবু হানীফা (১৫০ হি.), মুয়াত্তা মালিক (১৭৯ হি.), জামে সুফিয়ান ছাওরী (১৬১ হি.), মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক (২১১ হি.), মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা (২৩৫ হি.) ইত্যাদি গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে এবং ইমাম বাকী ইবনে মাখলাদ (২৭৬ হি.) তো সাহাবা ও তাবেয়ীনের ফাতাওয়া বিষয়ে একটি দীর্ঘ গ্রন্থ সংকলন করেছেন। যা উপরোক্ত সব কিতাবের চেয়ে বড়। (সিয়ারু আলামিন নুবালা খ. ১৩, পৃ. ২৯১) আর শুধু আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর ফতোয়াসমূহ ইমাম আবু বকর ইবনে মুসা (৩৪২ হি.) বিশটি কিতাবে সংকলন করেছেন। (ইলামুল মুয়াককিয়ীন খ. ১, পৃ. ১০)। তদ্রূপ ইমাম তাকীউদ্দীন আসসুবকী (৭৫৬ হি.) হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর ফতোয়া গ্রন্থাকারে সংকলন করেছেন, যার নাম ফাতাওয়া আবী হুরায়রা। আর এখন তো উদ্যমী ব্যক্তিরা হাদীস, সুন্নাহ, সীরাত, তারীখ, ফিকহ প্রভৃতি বিষয়ের দীর্ঘ দীর্ঘ গ্রন্থ আদ্যোপান্ত অধ্যয়ন করে প্রত্যেক সাহাবীর ফতোয়া আলাদাভাবে সংকলন করেছেন, যা ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। জামেয়া উম্মুল কুরা মক্কা মুকাররমার অধ্যাপক ড. রাওয়াস কাল‘আজী এ ধরনের বেশ ক’টি মওসূআ প্রস্তুত করেছেন। অথবা তার নিজের তত্ত্বাবধানে প্রস্তুত করিয়েছেন। যেমন : মওসূআতু ফিকহি আবী বকর সিদ্দীক রা., মওসূআতু ফিকহি উমার ইবনুল খাত্তাব রা., মওসূআতু ফিকহি উসমান ইবনে আফফান রা., মওসূআতু ফিকহি আলী ইবনে আবী তালিব রা., মওসূআতু ফিকহি আবদিল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., মওসূআতু ফিকহি আয়েশা বিনতে আবী বকর রা., মওসূআতু ফিকহি যায়দ ইবনে সাবিত ওয়া আবী হুরায়রা রা., মওসূআতু ফিকহি আবদিল্লাহ ইবনে ওমর রা., মওসূআতু ফিকহি আবদিল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.। ফকীহ সাহাবীদের মধ্যে ফতোয়া দানের বিষয়ে যারা মধ্যম সারিতে ছিলেন, অর্থাৎ যাদের অধিক সংখ্যক ফতোয়া প্রদানের সুযোগ হয়নি তারা হলেন, আবু বকর সিদ্দীক রা., আনাস ইবনে মালিক রা., আবু সায়ীদ খুদরী রা., আবু হুরায়রা রা., উছমান ইবনে আফফান রা., আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আছ রা. আবদুল্লাহ ইবনুয যুবাইর রা., আবু মূসা আশআরী রা., সাদ ইবনে আবী ওয়াককাস রা., সালমান ফারেসী রা., জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা., মুয়ায ইবনে জাবাল রা., তলহা রা., যুবাইর রা., আবদুর রহমান ইবনে আওফ রা., ইমরান ইবনে হুসাইন রা., আবু বাকরা আছছাকাফী রা., উবাদা ইবনুস সামিত রা. ও মুয়াবিয়া ইবনে সুফিয়ান রা.। সর্বমোট ১৯ জন সাহাবী। এঁদের ফতোয়াও মুসান্নাফ আবদুর রাযযাক, মুসান্নাফ বাকী ইবনে মাখলাদ, মুসান্নাফ ইবনে আবী শায়বা প্রভৃতি গ্রন্থে সনদসহ বর্ণিত হয়েছে। কারো কারো ফতোয়া মওসূআ আকারেও সংকলিত হয়েছে। যেমন হযরত আনাস ইবনে মালিক রা.-এর ফতোয়াসমূহ মওসূআতু ফিকহি আনাস ইবনে মালিক নামে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। অবশিষ্ট যে সকল সাহাবী থেকে ফতোয়া দেওয়া প্রমাণিত তাঁদের প্রত্যেকের থেকে একটি, দু’টি করে ফতোয়া বর্ণিত হয়েছে। সারকথা, সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কিছুসংখ্যক সাহাবী মুফতী ছিলেন, অন্যরা ছিলেন মুসতাফতী। ইফতা ও ইসতিফতা তথা ফতোয়া জিজ্ঞাসা ও ফতোয়া প্রদান ছাড়া দ্বীন বাকী থাকার এবং দ্বীনের বিধান বর্ণনা ও প্রচারের সহজ ও সর্বশ্রেণীর জন্য উপযুক্ত কোনো উপায় না অতীতে ছিল, না এখন আছে। ৪. সাহাবায়ে কেরামের পর যখন তাবেয়ীদের যুগ এল তখন এক একজন ফকীহ/মুফতী এক একটি ইসলামী শহরের ইমাম ও ধর্মগুরু ছিলেন, যাঁদের ফতোয়া ও নির্দেশনা মোতাবেক ঐসব অঞ্চলে আমল করা হত। (শাহ ওয়ালি উল্লাহ (১১৭৪ হি.) : আলইনসাফ পৃষ্ঠা : ৬; ইবনুল কাইয়্যিম (৭৫১ হি.) : ই’লামুল মুয়াককিয়ীন খ : ১, পৃষ্ঠা : ১৮-২৩) যেমন মক্কা মুকাররমায় আতা ইবনে আবী রাবাহ (১১৪ হি.), ইয়ামানে তাউস ইবনে কাইসান (১০৬ হি.), মিসরে ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব (১২৮ হি.), শামে মাকহূল (১১২ হি.), জাযাইরে মায়মূন ইবনে মিহরান (১১৭ হি.), খোরাসানে যাহহাক ইবনে মুযহিম (১০৫ হি.), বসরায় হাসান বসরী (১১০ হি.) ও ইবনে সীরীন (১১০ হি.), কূফায় ইবরাহীম নাখায়ী (৯৬ হি.) ও তাঁর শীষ্য হাম্মাদ ইবনে আবী সুলায়মান (১২০ হি.) অতঃপর এই দু’জনের শীষ্য ইমাম আবু হানীফা রাহ. (৮০হি.-১৫০হি.), মদীনায় ফুকাহায়ে সাবআ অর্থাৎ প্রসিদ্ধ সাত ফকীহ ও তাঁদের শীষ্যবৃন্দ। (হাকিম আবু আবদিল্লাহ (৪০৫হি.) : মারিফাতু উলূমিল হাদীস, পৃষ্ঠা : ১৯৮-১৯৯; মুয়াফফাক মক্কী (৫৬৮ হি.) : মানাকিবু আবী হানীফা ১/৭-৮) জামেয়া উম্মুল কুরার অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ মুনতাসির কাত্তানীকৃত অনেক খণ্ডে রচিত একটি দীর্ঘ গ্রন্থ মুজামু ফিকহিস সালাফে উপরোক্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশ ফতোয়া সংকলিত হয়েছে। যা হাদীস ও আছারের দীর্ঘ কিতাবসমূহে বিশেষত দ্বিতীয় শতাব্দী ও তৃতীয় শতাদ্বীর শুরুতে সংকলিত হাদীসের কিতাবসমূহে সনদসহ বিদ্যমান রয়েছে। ৫. তাবেয়ীনের পর এই দায়িত্ব তাবে তাবেয়ীন ফকীহ/মুফতীদের উপর অর্পিত হয়। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ব্যক্তিদের নাম ইলামুল মুয়াককিয়ীন কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। তদ্রূপ ইবনে সাদ (২৩০ হি.) কৃত ‘আততবাকাতুল কুবরা গ্রন্থে বিভিন্ন ইসলামী শহরের শিরোনামে তাঁদের আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে। এই স্তরের মনীষীদের অন্যতম হলেন ইমাম মালেক রাহ. (৯৩-১৭৯ হি.) ৬. এঁদের পর অন্যান্য মুজতাহিদ ইমাম যথা, ইমাম শাফেয়ী (১৫০-২০৪ হি.), ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রাহ. (১৬৪-২৪১ হি.) ও অন্যান্য ইমামদের যুগ। এই দীর্ঘ আড়াই শত বছর এবং তার পর যেসব ফকীহ/মুফতী ফিকহ-ফতোয়ার কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে গণ্য হয়েছেন তাদের পরিচিতি ও আলোচনা তবাকাতুল ফুকাহা শীর্ষক গ্রন্থসমূহে বিদ্যমান রয়েছে। এ বিষয়েও বহু গ্রন্থ লিখিত হয়েছে। মুদ্রিত ও প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। কয়েকটি গ্রন্থের নাম এই- ১.তবাকাতুল ফুকাহা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, হায়সাম ইবনে আদী (২০৭ হি.) ২. তবাকাতুল ফুকাহা, আবু ইসহাক সীরাজী (৪৭৬ হি.) ৩. তবাকাতুল ফুকাহা, মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল মালিক আলহামাযানী (৫২১ হি.) ৪. তবাকাতুল হানাবিলা, আবুল হুসাইন ইবনে আবী ইয়ালা (৫২৬ হি.) ৫. তারতীবুল মাদারিক ওয়াতাকরীবুল মাসালিক লিমারিফাতি আলামি মাযহাবি মালিক, ইয়ায ইবনে মূসা আসসাবতী (৫৫৪ হি.) ৬. তবাকাতুশ শাফিইয়্যাতিল কুবরা, তাজুদ্দীন আসসুবকী (৭৭১ হি.) ৭. আলজাওয়াহিরুল মুযিয়্যাহ ফী তবাকাতিল হানাফিয়্যা, আবদুল কাদির আলকুরাশী (৭৭৫ হি.) ৮. আলমানহাজুল আহমদ ফী তারাজিমি আসহাবিল ইমামি আহমদ, আলউলাইয়মী (৯২৮ হি.) ৯. আততাবাকাতুস সানিয়্যাহ ফী তারাজিমিল হানাফিয়্যাহ, তাকী উদ্দীন আততামীমী (১০০৫ হি.) ১০. আলফাওয়াইদুল বাহিয়্যাহ ফী তারাজিমিল হানাফিয়্যাহ, আবদুল হাই আললাখনাবী (১৩০৫ হি.)। সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীন ফকীহ ও মুফতীদের ফতোয়া তো হাদীস ও আছারের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে। পরবর্তী যুগের ফকীহ ও মুফতীদের ফতোয়া সংকলিত হয়েছে ফিকহ-ফতোয়া বিষয়ক কিতাবসমূহে। এই কিতাবসমূহ দু’প্রকার : ১. যেসব গ্রন্থে ফতোয়া বা মাসাইল সংশ্লিষ্ট দলীলসহ বা দলীলের উল্লেখ ছাড়া সংকলিত হয়েছে। প্রশ্ন বা ইসতিফতা উল্লেখ করা হয়নি। এ শ্রেণীর কিতাবসমূহকে কুতুবুল ফিকহ বলা হয়। যার ও মুদ্রিত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যাও কয়েক হাজার। ২. যেসব গ্রন্থে প্রশ্নসহ উত্তর সংকলিত হয়েছে। প্রথমে প্রশ্ন উল্লেখ করা হয় এরপর মুফতীর ফতোয়া। এ ধরনের গ্রন্থকে কুতুবুল ফাতাওয়া বলা হয়। এ শ্রেণীর কিতাবের অপর নাম আলমাসাইল। অর্থাৎ প্রশ্ন এবং উত্তর। উভয় শিরোনামের কিছু কিতাবের নাম দৃষ্টান্তস্বরূপ নিচে উল্লেখ করা হল। ১. আলমাসাইলুল আসাদিয়্যাহ (৩০০ জুয), ইমাম আসাদ ইবনুল ফুরাত (২১৩ হি.) সংকলিত প্রশ্ন এবং উত্তর। যার মূল ভিত্তি হল ইমাম আবু হানীফা ও তার সঙ্গীদের দ্বারা সংকলিত ফিকহ। এই গ্রন্থে সংকলিত উত্তরগুলো তিনি সংগ্রহ করেছেন ফিকহে হানাফীর তৃতীয় ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশায়বানী (১৮৯ হি.)-এর নিকট থেকে। এরপর মিশরে গিয়ে ইমাম মালেক রাহ.-এর শীষ্য ইমাম ইবনুল কাসিম (১৯১ হি.)-এর নিকট থেকে ইমাম মালেক রাহ.-এর ফিকহ অনুসারে এইসব প্রশ্নের উত্তর সংগ্রহ করেন। অতঃপর স্বদেশ আফ্রিকায় ফিরে তা প্রচার করেন। ২. মাসাইলুল ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (২৪১ হি.)। ৩ খণ্ডে আবুল ফযল সালেহ ইবনে আহমদ (২০৩-২৬৬ হি.)-এর প্রশ্নাবলির জবাবে। ৩. মাসাইলু আহমদ লিআবদিল্লাহ ইবনে আহমদ, আবদুল্লাহ ইবনে আহমদের প্রশ্নাবলির জবাবে। ৪. মাসাইলু আহমদ লিআবী দাউদ, কিতাবুস সুনান-এর সংকলক ইমাম আবু দাউদ সিজিসতানী (২৭৫ হি.)-এর প্রশ্নাবলির জবাবে। ৫. আলফাতাওয়া আবু নাসর ইবনুস সাব্বাগ (৪৭৭ হি.) ৬. ফাতাওয়া ইবনিস সালাহ (৬৪৩ হি.) ৭. ফাতাওয়ান নাবাবী (৬৭৬ হি.) ৮. ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া (৭২৮ হি.) ৯. ফাতাওয়াস সুবকী (৭৫৬ হি.) ১০. ফাতাওয়াল আলায়ী (৭৬১ হি.) ১১. ফাতাওয়াল ইরাকী (৮০৬ হি.) ১২. আলহাভী লিলফাতাভী, জালালুদ্দীন সুয়ূতী (৯১১ হি.) ১৩. আলফাতাওয়াল ফিকহিয়্যাহ, ইবনে হাজার মক্কী (৯৭৪ হি.) ১৪. আলফাতাওয়াল হামিদিয়্যাহ (৯৮৫) ১৫. আলফাতাওয়াল খাইরিয়্যাহ (১০৮১) ইত্যাদি। এ ধরনের শত শত গ্রন্থ আছে, যেগুলোর শুধু তালিকার জন্যও অনেক কিতাব লেখা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ এ প্রসঙ্গে আরো কিছু কথা বলার ইচ্ছা আছে। (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement