মুহাররম ১৪৪১   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৯

আমার মুহসিন কিতাব-১০

মাওলানা সায়্যিদ মানাযির আহসান গিলানী রাহ.

[মাওলানা সায়্যিদ মানাযির আহসান গীলানী রাহ. ১৩১০ হিজরীর ৯ রবিউল আউয়াল/১৮৯২ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারের পাটনা জেলার ‘ইস্তানওয়া’য় জন্মগ্রহণ করেন। ইস্তানওয়া তাঁর নানার বাড়ির এলাকা। তাঁর পৈতৃক বাড়ি বিহারের ‘নালন্দা’ জেলার ‘গীলান’ নামক গ্রামে। তিনি সে অঞ্চলের বিখ্যাত খান্দান ‘হুসাইনিয়া ওয়াসিতিয়্যাহ’র একজন কৃতিসন্তান।

হযরত গীলানী রাহ. নিজ বাড়িতেই চাচা হাকীম আবুন নসর গীলানী রাহ.-এর তত্ত্বাবধানে কুরআন মাজীদ, প্রাথমিক উর্দু, ফারসি, নাহব ও সরফ ইত্যাদি পড়াশোনা করেন। এরপর ১৩২৪ হিজরী/১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে টোংকের বিখ্যাত আলেম মাওলানা সায়্যিদ আবুল বারাকাত টোংকী রাহ.-এর কাছে সাহিত্য, ফিকহ, মানতেক ও মা‘কূলাত শাস্ত্রে উচ্চতর পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর ১৩৩১ হিজরীতে দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। সেখানে শাইখুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী রাহ., আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মীরী রাহ., মাওলানা শাব্বীর আহমদ উসমানী রাহ. ও শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রাহ. প্রমুখ মনীষীদের কাছে হাদীসের দরস গ্রহণ করেন।

প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সমাপ্ত হলে কিছুদিন দারুল উলূম দেওবন্দেই তাদরীসের খেদমত আঞ্জাম দেন। সেসময়ই দারুল উলূম থেকে প্রকাশিত দুই পত্রিকা ‘আল-কাসিম’ ও ‘আর-রশীদ’ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন।

১৩৩৮ হিজরী/১৯২০ সালে তিনি জামিয়া উসমানিয়া হায়দারাবাদে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। ১৯৪৯ সালে দ্বীনীয়াত শাখার প্রধান হিসাবে খেদমতরত অবস্থায় অবসর গ্রহণ করেন।

হায়দারাবাদে থাকাকালে তিনি শায়খ হাবীব আল-আইদারুস রাহ. থেকে কাদিরিয়্যা সিলসিলার তরবিয়ত গ্রহণ করেন এবং তাঁর থেকে খেলাফত লাভ করেন। এরপর হায়দারাবাদেরই আরেক বুযুর্গ মাওলানা মুহাম্মাদ হুসাইন সাহেব থেকে চিশতিয়া সিলসিলায় খেলাফত লাভ করেন। এর আগে তিনি হযরত শাইখুল হিন্দ রাহ.-এর কাছে বাইআত হয়েছিলেন।

সায়্যিদ মানাযির আহসান গীলানী রাহ. ছিলেন বহুমুখী যোগ্যতা ও পা-িত্যে উপমহাদেশের হাতেগোনা উলামায়ে কেরামের একজন। তাফসীর, হাদীস, ফিকহ সব শাস্ত্রেই তাঁর যথেষ্ট জানাশোনা ছিল। মা‘কূলাতেও ছিলেন খুব পারদর্শী। ইতিহাসে তাঁর দৃষ্টি ছিল সুবিস্তৃত। আল্লাহ তাআলা তাঁকে দরদী ও আবেগী হৃদয় দান করেছিলেন।

তাঁর রচনাশৈলী অতুলনীয়, সাহিত্য মাধুর্য ও চিন্তা দৃষ্টিতে সমৃদ্ধ। ফলে পাঠক তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়। আন্দোলিত হয়। তিনি গদ্যের মতো পদ্য-সাহিত্যেও ছিলেন দক্ষ ও সিদ্ধহস্ত।

তাঁর বিখ্যাত রচনাবলির মধ্যে রয়েছে- আন-নাবিয়্যুল খাতাম, হিন্দুস্তান মেঁ মুসলমানোঁ কা নেযামে তালীম ওয়া তারবিয়াত (২ খ-), তাদবীনে হাদীস, আবূ যর গিফারী রা., ইসলামী মাআশিয়াত, ইমাম আবু হানীফা কি সিয়াসী যিন্দেগী, তাযকিরায়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ, সাওয়ানেহে কাসেমী (৩ খ-) ইত্যাদি।

১৩৭৫ হিজরীর ২৫ শাওয়াল/১৯৫৬ ঈসায়ীর ৫ জুন এই মনীষী আখেরাতের সফরে রওয়ানা হন। নিজ এলাকা গীলানেই তাঁর কবর। -অনুবাদক]

 

 

আমাদের খান্দান ছিল মৌলভী খান্দান। আমার দাদা মাওলানা মুহাম্মাদ আহসান গীলানী সাহেব ছিলেন বিহারের প্রসিদ্ধ একজন মা‘কূলী উস্তায (যিনি ‘মা‘কূলাত’ শাস্ত্রের দরস প্রদান করেন)। আব্বা আলেম ছিলেন না। তবে চাচা মাওলানা হাকীম আবুন নসর গীলানী রাহ. ছিলেন দরসে নেযামীর আলেম। তাঁর দরস-তাদরীসের যিম্মাদারী কম থাকলেও সবসময় মুতালাআয় মগ্ন থাকতেন। সেই যামানার সাধারণ মৌলভীদের চেয়ে তাঁর মুতালাআর পরিধি অনেক বিস্তৃত ছিল। তিনি আরবী-ফারসির সাথে সাথে উর্দু ভাষায় লিখিত ইলমী কিতাবাদিও মুতালাআ করতেন। একে মর্যাদার খেলাফ মনে করতেন না। সেজন্য মাওলানা শিবলী, স্যার সায়্যিদ, হালী, ডেপুটি নযীর আহমদ প্রমুখ মুসান্নিফদের রচনাবলীও খুব আগ্রহের সঙ্গে মুতালাআ করতেন। তবে তাদের পাশ্চাত্যমুখী ঝোঁকের সঙ্গে তিনি একমত ছিলেন না।

এই চাচার তরবিয়তেই আমি চোখ মেলেছি। তাঁর কোনো সন্তান ছিল না বলে আমাকে নিজের সন্তান মনে করতেন।

তিন বছর বয়সে যখন মাত্র কিছু কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে শিখেছি তখনই তিনি আমাকে অনেক ফারসি শব্দ মুখস্থ করিয়ে দেন। ফলে দীর্ঘকাল যাবৎ আমি অনেক শব্দেরই শুধু ফারসি জানতাম, উর্দু জানতাম না। যেমন, ‘সাগ’ (ফারসি শব্দ) ছাড়া কুকুরকে উর্দু অন্য কোনো শব্দেও বলা হয় কি না- আমি জানতাম না। আমার এই ফারসি বিদ্যার কারণে মাঝেমধ্যে ঘরের মহিলাদের অনেক মুশকিলে পড়তে হত ১।

সেসময় মোল্লা আবদুল্লাহ নামে দাদাজানের এক শাগরেদ আমাদের এলাকায় অধিবাস গ্রহণ করেন। তিনি বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনায় প্রভাবিত হয়ে দিল্লির মাওলানা নযীর আহমাদ সাহেবের কাছে গিয়ে হানাফী মাসলাক ছেড়ে গাইরে মুকাল্লিদদের মাসলাক গ্রহণ করেন। চাচাজান ছিলেন মজবুত হানাফী। পূর্বে তিনি মোল্লা আবদুল্লাহ সাহেবের কাছে কিছু পড়াশোনাও করেছিলেন। সেই সূত্রে দুজনের মাঝে সখ্য সম্পর্ক ছিল। তবে মুকাল্লিদ গাইরে মুকাল্লিদ বিষয়ে দুজনের মাঝে রাতদিন ছোট-বড় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতেই থাকত। বেশি তর্ক হত এক মজলিশে তিন তালাকের মাসআলা নিয়ে । এই সমস্ত তর্ক বিতর্ক কখনো লিফলেট ও পুস্তিকা লেখা পর্যন্ত গড়াত। উভয় পক্ষ থেকেই কিছুদিন পরপর এসব বিলি হত।

আমার বুঝ-বুদ্ধি হওয়ার পর যেহেতু চাচাজানের কাছেই পড়াশোনার শুরু তাই এই পরিবেশ খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি। সেজন্য হাফেয ইবনে হাজর, ইমাম ইবনে কায়্যিম, ইবনে তাইমিয়া ও শাওকানী রাহিমাহুমুল্লাহর নাম এত বেশি শুনেছি, মনে হয়েছে যেন তাঁদের যুগেই আমার জন্ম। আর এদের নামই যখন এত শুনেছি তাহলে বুখারী, মুসলিম, ইমাম আবু হানীফা, আবু ইউসূফ রাহ. এবং আবু হুরায়রা ও ইবনে উমর রাযিয়াল্লাহু আনহুমার নাম কী পরিমাণ শুনেছি সহজেই অনুমান করা যায়।

***

মকতবের সেই যামানায় সবচে বেশি যে বইটির প্রভাব আমার মধ্যে পড়েছে তার একটি লম্বা ঘটনা আছে। ঘটনাটি খুবই মজার এবং আশ্চর্যের।

স্বভাবগতভাবে আমি ছিলাম খুব দুষ্টু। সেজন্য চাচাজান আমাকে মারতে মারতে কখনো চামড়া ছিলে ফেলতেন। এরপরও পড়ায় ফাঁকি দেওয়া ছাড়তাম না। এরইমধ্যে একদিন ঘরে একটি উর্দু বই পেলাম। বইয়ের শুরুর কিছু পৃষ্ঠা নেই। মূলত এটি ছিল একটি ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ। এখনো জানতে পারিনি বইটির নাম কী। তবে তার প্রভাব-ক্রিয়া এখনো আমার মাঝে জীবন্ত। সেটি ছিল গল্পের বই। পুরো গল্প এখন মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে, এক পাদ্রি তার বাগানে বসবাস করত। সেখানে বাচ্চাদেরকে পড়াত এবং কাঠের বিভিন্ন কাজ শেখাত। তাদেরকে তার বাগানের ফলের রস পান করাত।

এদের মধ্যে ‘হেরি’ এবং ‘টমি’ নামে দুইজন ছাত্র ছিল। হেরি ছিল সৌভাগ্যবান, আর টমি দুর্ভাগা। সেখানে ‘হেরি’র যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার দ্বারা অবচেতন মনেই আমি প্রভাবিত হই। এমনকি তার জীবনের যে চিত্র সেখানে আঁকা হয়েছে তাতে মনে জাগত, যদি আমার জীবনও এমন হত!

এরপর থেকে আমার মধ্যে পড়াশোনার কিছুটা আগ্রহ তৈরি হয়। কিন্তু আমার প্রতি চাচার ধারণা তো ভালো ছিল না। তাই পিটুনির ধারাবাহিকতা তখনো অব্যাহত ছিল। অথচ সেসময় আমার জন্য এই মারপিট উপকারের পরিবর্তে ক্ষতিরই কারণ হতে লাগল।

ঠিক সেই সময়ে আমার সমবয়সী কয়েকজনের কাছে ‘দাস্তানে আমীর হামযা’ দেখতে পাই। বইগুলোর আকর্ষণ আমাকে গ্রেফতার করে ফেলে। যার পরিণাম হয় খুবই দুঃখজনক। অন্যদের শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে তা প্রকাশ করছি।

যখন আমি এই রোগে আক্রান্ত হই তখন আমার বয়স দশ-এগারো বছর। আমাদের গ্রামের এক সরদার ছিলেন-মরহুম যহূর মুহসিন। তারও গল্প উপন্যাসের বইয়ের প্রতি এক পর্যায়ের আসক্তি ছিল। আমার দুর্ভাগ্য যে, ‘নওল কিশোর’ প্রেস থেকে প্রকাশিত ‘আমীর হামযা সিরিজে’র এই সব আবর্জনা তার সংগ্রহে ছিল। ফলে খুব সহজেই আমি সেগুলো পেয়ে যাই। ‘কোচক বাখতর’, ‘বালা বাখতার’, ‘হাফত পীকর’, ‘নূর আফশাঁ’, ‘ঈরাজ নামা’ ইত্যাদি কত বই! এখন সবগুলোর নামও মনে নেই। ওগুলোর কারণে মাদরাসার নিয়মিত পড়াশোনা এককথায় মাচায় উঠে গেল। রাতদিন আমি ওসবের মধ্যেই ডুবে থাকলাম। একসময় চাচাজান মরহুম আমার এই অবস্থা টের পেলেন। তখন কিছু নেগরানিও শুরু করলেন।

আফসোস! এই বইগুলোর দ্বারা একসময় আমি আরো বেশি হামলার শিকার হই। বইয়ের কাহিনীগুলো আমি আমার জীবনেও বাস্তবায়নের চেষ্টা শুরু করি। সেই মুসিবতের কথা আর কী লিখব? তখন যে কতকিছু ঘটেছে!

ধোঁকা, প্রতারণা আর চালাকি ছিল এসব বইয়ের মূল বিষয়। ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমি সেগুলোকে উত্তম গুণ মনে করে অনুশীলন করতে থাকি। সাথী-সঙ্গীদের মধ্যে যারা এসব বই সম্পর্কে অজ্ঞ আমি তাদের গুরু বনে যাই এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেসব চালাকি ও প্রতারণার প্রশিক্ষণে ব্যস্ত হয়ে যাই। গ্রামের বাগান ও ক্ষেত-খামার ছিল আমাদের কর্মক্ষেত্র। অসহায় রাখালদের বিভিন্নভাবে কষ্ট দিতে থাকি। তাদের জিনিসগুলো নষ্ট করতে পেরে খুশি হই। মনে করি, তাতে আমাদের মিশন বেশ সফল হচ্ছে!

তখনো যৌবন ও যৌবনের অবস্থাদি সম্পর্কে ছিলাম অজ্ঞ। তাকদীর যদি সে সময়ই আমাকে আমার গ্রামের ঐ সঙ্গীদের থেকে বিচ্ছিন্ন না করত, তাহলে হয়ত আমার ধ্বংস ছিল নিশ্চিত!

***

প্রথমে চাচার ইচ্ছা ছিল, আমাকে ইংরেজি পড়াবেন। সেজন্য ভাগলপুর স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে পাঠানোও হয়েছিল। এর আগে গ্রাম থেকেও ইংরেজির প্রাথমিক দুয়েকটি বই পড়ে এসেছি। কিন্তু কোনো গায়েবী মদদে এমন কিছু কুদরতী বাধা সামনে আসে যে, তৎক্ষণাৎ আমার শিক্ষা পরিকল্পনা বদলে যায়। ফলে সৌভাগ্য আমাকে সেই কয়েদ থেকে মুক্ত করে ‘বিহার’ থেকে হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ‘রাজপুতানা’র বালুভূমিতে পৌঁছে দেয়। অর্থাৎ চাচা আমাকে আমাদের আত্মীয় টোংকের প্রসিদ্ধ মানতেকী ও মা‘কূলী আলেম হযরত মাওলানা বারাকাত আহমদ বিহারী রাহ.-এর খেদমতে পাঠিয়ে দেন। সেখানের পরিবেশে এবং হয়ত অজানা আরো কত কারণে আমি ধীরে ধীরে বদলাতে থাকি। আমার দিল-দেমাগে বিপুল পরিবর্তন আসে। ফলে সেখানেই আমার পূর্ব পাগলামির সমাপ্তি ঘটে এবং সেইসব বইয়ের জাদু থেকে মুক্তি পাই।

এভাবে মাওলানা মরহুমের কাছে আমি প্রবল আগ্রহী ও মেহনতী ছাত্রদের মধ্যে গণ্য হতে থাকি। যদিও চাচাজান মরহুমের মারপিট আমাকে নিশ্চিত করে দিয়েছিল যে, আমি খুবই বক্র প্রকৃতির। অন্যথায় সকাল-সন্ধ্যা আমি এত মার খেতাম কেন?!

এখানে সংক্ষিপ্তাকারে আমীর হামযা সিরিজের পরিচয় তুলে ধরছি-

সিরিজের দীর্ঘ ধারাবাহিকতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, প্রতিটি বইয়ে মোটামুটি তিনটি বিষয় অনিবার্যভাবে থাকে।

১. ধোঁকাবাজি, চালাকি ও বিভিন্ন প্রতারণার বিবরণ।

২. আমীর হামযা, তার সন্তান-সন্ততি ও নাতি-নাতনিদের সৌন্দর্য ও প্রেমের কাহিনী।

৩. কাল্পনিক কাফিরদের উপর কাল্পনিক মুসলমানদের বিজয়।

পূর্বেই বলেছি যে, প্রথম বিষয়-কেন্দ্রিক জাদুর শিকার আমি নিজেও হয়েছিলাম। সাথীদের বহুজনকে সেই শিকারে পরিণতও করেছিলাম। তবে বয়সের স্বল্পতার দরুণ আমার প্রভাব কেবল বাগ-বাগিচা আর ক্ষেত-খামারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আমার এক সাথী মিয়াঁ মুঈনুদ্দীন উরফে মুনা অনেক আগে বেড়ে গিয়েছিল। টোংক থেকে ফিরে এসে একবার আমি দেখেছি, সে গ্রামের মুরগী, ভেড়া ও ছাগলের উপর তার অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করছে!! মুনা আমি চলে যাওয়ার পরও কিছুদিন গীলানে ছিল। এরপর প্রায় বিশ পঁচিশ বছর ধরে নিখোঁজ। কারো কারো ধারণা, সে ঢাকার দিকে চলে গেছে। সেখানে যাওয়ার পর মাজযূব ধরনের হয়ে গেছে। ফলে সেই অঞ্চলে এখন সে ‘মুসতাজাবুদ দাওয়া’ (যার দুআ কবুল হয়) হিসাবে খ্যাত।

যাইহোক, আমীর হামযা সিরিজের শুরুর দিকে মুরগী ধরার কৌশল সংক্রান্ত যেসব ঘটনা আছে মুনার উপর সেই প্রভাবই পড়েছিল।

দ্বিতীয় যে বিষয়, (প্রেমের কাহিনী) সেসব ঘটনা দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার যোগ্যতাই তখন আমার ছিল না। তৃতীয় বিষয় (কাফেরদের উপর মুসলমানদের বিজয়) এর প্রভাব তখনো আমার উপর পরিষ্কারভাবে পড়েনি। তবে বাস্তবতা হল, অবচেতন মনেই তার কিছু প্রভাব আমাকে সম্মোহিত করেছে। ফলে কুফরের মোকাবেলায় ইসলাম-বিজয়ের যে জযবা আমার মধ্যে সদা জাগ্রত, তাতে ঐসব কাহিনী-উপাখ্যানের কিছু না কিছু দখল অবশ্যই আছে। তাছাড়া সেসময় চাচাজানের পীড়াপীড়িতে ওয়াকীদী রাহ.-এর ‘ফুতূহুশ শাম’ ও ‘ফাতহু মিসর’ ইত্যাদি কিতাবাদিও মুতালাআ করেছি। যদিও এই মুতালাআর শুরুটা হয়েছে বাধ্য হয়ে, তবে শেষে চাচাজানের মর্জি মোতাবেক আগ্রহ নিয়ে যা পড়েছি তার মধ্যে এই কিতাব দুটি ছিল।

এখন বাকি রইল উর্দু সাহিত্যের এই দীর্ঘ সিরিজ পড়ার দ্বারা আমার সাহিত্য যোগ্যতায় কোনো ফায়দা হয়েছে কি না?

আমার উত্তর ‘না’ বাচক। কারণ সেসময় লেখার কিংবা পড়ার কোনো ধরনের যোগ্যতাই তৈরি হয়নি। সামান্য কিছু যদি থেকে থাকে, সেটা চাচাজানের বলপূর্বক বিভিন্ন জিনিস পড়ানোরই প্রভাব।

আমার বেহুঁশী জীবনের দুঃখজনক কাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবেই কিছুটা সবিস্তারে বললাম। কেননা আমি আমার ঐ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই শিশু-কিশোর ও নবীন-যুবকদের জন্য এই বিষাক্ত বইগুলোকে প্রাণ সংহারক মনে করি। অথচ সেগুলো আজ কীট পতঙ্গের ন্যায় চতুর্দিক থেকে মানুষের ঘরে ঘরে প্রবেশ করছে। এরপর ছেলেদেরকে, এমনকি মেয়েদেরকেও বরবাদ করার জন্য তুফানের মতো কাজ করছে। ফলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বরবাদ হচ্ছে। ঘরের পর ঘর নষ্ট হচ্ছে। এরপরও মা বাবা তাদের সন্তানদেরকে এসব বইরূপী সাপবিচ্ছু দ্বারা খুশিমনেই দংশন করাচ্ছে!! রাষ্ট্রও তাদেরকে সহযোগিতা করছে। তারা বিভিন্ন একাডেমি, শিক্ষা মিশন ও নানা সংস্থার মাধ্যমে সুন্দর সুন্দর শ্লোগান, বাণী ও সাহিত্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে এসব বিষের পেয়ালা শিশু-কিশোরদের পান করাচ্ছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মনে হচ্ছে যেন ধ্বংসের এই ঝড় থামাবার সব উপায়-উপকরণ নিঃশেষ হয়ে গেছে। এখন অসহায় মনে শুধু বলছি, যা হবার তাই হবে। যা ঘটবার তা রোধ হবার নয়।

وَ اِذَاۤ اَرَادَ اللهُ بِقَوْمٍ سُوْٓءًا فَلَا مَرَدَّ لَهٗ،  وَ مَا لَهُمْ مِّنْ دُوْنِهٖ مِنْ وَّالٍ .

  কোনো সম্প্রদায়ের সম্পর্কে যদি আল্লাহ অশুভ কিছু ইচ্ছা করেন তবে তা রদ হবার নয় এবং তিনি ছাড়া তাদের কোনো অভিভাবক নেই। -সূরা রা‘দ (১৩) : ১১

যাইহোক, এটা ছিল আমার জাহেলিয়াতের যুগ, টোংক পৌঁছার পর যার সমাপ্তি ঘটেছে। তখন প্রকৃত অর্থেই উলূম ও ফুনূনের প্রতি আমার প্রচ- আগ্রহ হয়েছে। পড়ালেখার জযবা এত বেড়েছে যে, মানতেকের কয়েকটি ছাপা কিতাব প্রবল উৎসাহ নিয়ে যতেœর সাথে হাতে লিখেছি, এরপর সেই হাতেলেখা নুসখা থেকে পড়েছি। এ সময়েই ‘ঈসাগুজী’-এর একটি কলমী নুসখায় উস্তাযে মুহতারামের তাকরীরের সহায়তায় উর্দূ হাশিয়া লিখেছি। যা এখনো আমার কুতুবখানায় সংরক্ষিত আছে। মাওলানা বারাকাত আহমদ সাহেব মাওলানা আব্দুল হক খায়রাবাদী রাহ.-এর বিশেষ শাগরিদ হওয়ার কারণে তার মধ্যে খায়রাবাদী মাকতাবে ফিকিরের প্রভাব ছিল। যেখানে মানতেক ও ফালসাফার মানসিকতা বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেই মানসিকতা আমার মধ্যে আসার কথা, কিছুটা এসেছেও। কিন্তু চাচাজান চিঠির মাধ্যমে ইলম ও সাহিত্যের বিশেষ কিছু কিতাব ও পত্রিকা পড়ার জোর তাগিদ দিতে থাকতেন। যার সঙ্গে বারাকাতী পরিবেশ অপরিচিত ছিল বরং বিরোধী ছিল। আমার সেইসব কিতাব ও পত্রিকা পড়া অব্যাহত ছিল। চাচাজান একসময় আমার নামে ‘আন-নদওয়া’ জারি করে দিলেন। পরবর্তীতে এর মাধ্যমেই সায়্যিদ সুলাইমান নদভী আমাকে নদভীদের মধ্যে গণ্য করেন। অর্থাৎ দরসের সূত্রে না হোক, কলমের সূত্রে আমি নদওয়ার শাগরিদ। এক দৃষ্টিকোণ থেকে সায়্যিদ সাহেবের চিন্তা ঠিক আছে।

মাওলানা বারাকাত আহমদ সাহেব কখনো কোনোভাবে আমার এইসব রিসালা ও পত্রিকা পড়া সম্পর্কে টের পেলে খুব রাগ করতেন। বলতেন, এইসব সাতহিয়্যাত ও ভাসাভাসা জিনিস পড়তে পড়তে তো যোগ্যতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার অবস্থা ছিল শেখ সাদী রাহ.-এর গুলিস্তাঁ কিতাবে উল্লেখিত আবুল ফরজ ইবনুল জাওযী রাহ.-এর সেই মুরীদের মতো। (সেখানে আছে, আমাকে শায়খ ইবনুল জাওযী গান বাদ্যের মজলিশে যেতে যতই নিষেধ করেন এবং নির্জনতা অবলম্বনের আদেশ করেন আমি ততই আমার যৌবনের টানে প্রবৃত্তির তাড়নায় পরাজিত হই। আমি তাঁর হুকুম অমান্য করি এবং গান বাদ্য নিয়ে আনন্দ করি। এরপর যখন শায়খের নসীহতের কথা মনে পড়ে, বলি- স্বয়ং কাযীও যদি আমাদের সাথে বসতেন শরাবের পেয়ালার দিকে হাত বাড়াতেন।...)

যাইহোক, তিন চার বছর পর্যন্ত কোনো মুসান্নিফ বা কোনো কিতাবের প্রতি আমার বিশেষ কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি। অবশ্য যখন ‘শরহে আকায়েদ’-এর সবক শুরু হয় তখন আমার এক মুলতানী উস্তায মাওলানা মুহাম্মাদ আশরাফ রাহ. আমাকে এই কিতাবের একটি দুর্লভ শরহের সন্ধান দেন। নাম, নিবরাস। এখনো বহু মানুষ সেই শরহ থেকে বেখবর। এটি মুলতানেরই একজন অখ্যাত বুযুর্গ মাওলানা আব্দুল আযীযের রচনা। মুলতান থেকেই ছেপেছে। আমি কিতাবটি সংগ্রহ করি। তাতে দরসের আলোচনা থেকেও বেশি উপকারী কথাবার্তা পেয়ে যাই। মুতালাআয়ও বেশ মজা। আমি স্বীকার করি যে, তাসাওউফের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ইলমে কালামের যেসব বিষয়ে মিল রয়েছে ‘নিবরাসে’র মাধ্যমেই আমি সর্বপ্রথম তার সন্ধান পাই। এই কিতাবে পেঁচানো বিষয়াদি থেকে যেহেনকে বাস্তবতার নিকটবর্তী করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এরই মধ্যে ‘জালালাইন’ এর সবক শুরু হয়। চাচাজান পত্র মারফত আমাকে জালালাইন এর সাথে ‘তাফসীরে রাযী’ মুতালাআ করার কথা বলেন। ইমাম রাযী রাহ.-এর এই তাফসীর আমার চোখ খুলে দেয়। ছাত্রদের মধ্যে হাশিয়া-শরহের যে সমস্ত অর্থহীন ‘নিকাত’ হল্ করার মানসিকতা থাকে -আমার মধ্যেও একসময় সেই মানসিকতা ছিল- এই কিতাব দ্বারা তা থেকে খুব সহজেই মুক্তি পেয়ে যাই। ফলে হাশিয়া ও শরহ লেখকদের গুরুত্ব আমার কাছে কমে যায়। ইমাম রাযী রাহ. আমার প্রথম পথপ্রদর্শক, যিনি ইলমের সহীহ রুচি তৈরিতে আমাকে সহায়তা করেন। অবশ্য তখনও কেবল দেমাগের আরাম খুঁজতাম। দিলের খোরাক খোঁজার না আগ্রহ ছিল, না তার প্রতি কেউ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। চাচাজান রাহ.-এর মধ্যে মৌলবীয়ানা মেযাজই প্রবল ছিল। আর মাওলানা বারাকাত আহমাদ সাহেবের মধ্যে যদিও তাসাওউফের রং ছিল, কিন্তু দরসে তার কোনো প্রকাশ ঘটত না। এজন্য তখন পর্যন্ত আমার মধ্যে তার তাসাওউফের কোনো রং ছড়ায়নি। 

***

ঐ সময়েই হঠাৎ বলকানের যুদ্ধ শুরু হল। সেজন্য নদওয়ার একজন আলেম চাঁদা সংগ্রহের উদ্দেশে টোংক এলেন। সম্ভবত তার নাম সায়্যিদ মুহাম্মাদ। তার আবেদনে কেউ সাড়া দিচ্ছিল না। বিভিন্ন মজমায় তিনি ওয়াযও করলেন। তবু কোনো ইতিবাচক ফল পাওয়া গেল না। এসব দেখে একদিন আমার খুব আত্মমর্যাদায় লাগল। আফসোসও হল।

একবারের কথা। তখন ‘আলহেলাল’ নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। টোংকে এই পত্রিকা প্রথম আমিই আনিয়েছি। তো আমি এই পত্রিকার ভক্ত সাথীদের মজমায় ছিলাম। মাওলানা আবুল কালাম আযাদের বাক্য ও বর্ণনার ঢং অবলম্বন করতে পারার হিম্মত নিয়ে হঠাৎ জনগণের সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম। টোংকের ইতিহাসে সত্যিই সে ঘটনা স্মরণীয়। জামে মসজিদ ভরা মানুষ। وَامْتَازُوا الْيَوْمَ أَيّهَا الْمُجْرِمُونَ আয়াতের চিৎকার দিয়ে আমার বক্তৃতা শুরু হল। লোকজন যে যেখানে ছিল স্থির শান্ত হয়ে গেল। এরপর আর আমার মনে নেই কি বলেছি। পনেরো বিশ মিনিট পরে হুঁশ ফিরে এলে দেখলাম, আমি নিজেও কাঁদছি। পুরো মসজিদ জুড়ে কান্নার রোল পড়ে গেছে। রুপির স্তুপ আমার পায়ের সামনে। সত্যি সত্যিই লোকজন তাদের কাপড় ছিঁড়ে ফেলছে। মাথার চুল উপড়ে ফেলছে। নিজেরাই নিজেদের গালে থাপ্পর মারছে। মোটকথা পুরো মসজিদে মাতম শুরু হয়ে গেছে। আমি নিজেই অবাক হয়ে গেলাম, ঘটনা কী!! আজ পর্যন্ত সেদিনের ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা আমার বুঝে আসে না। হয়ত আমার দমিয়ে রাখা সব জযবা একসাথে উপচে উঠেছিল। আশ্চর্য! আমি কি বক্তৃতা করতে জানি? অন্যদের তো দূরের কথা, আমার নিজেরই জানা ছিল না। ঘটনাক্রমে তখন হযরাতুল উস্তায টোংকে ছিলেন না। থাকলে হয়ত আমাকে থামিয়ে দিতেন।

এরপর থেকে একের পর এক সুযোগ আসতে লাগল। জনগণ আমাকে বক্তা বানিয়ে ফেলল। মহল্লায় মহল্লায় মজমা মাহফিল শুরু হয়ে গেল। সেখানে আমাকে বক্তৃতা করতে বাধ্য করা হল। দুই তিন বক্তৃতা তো মুখস্থ বিদ্যা দিয়েই চলল। কিন্তু এরপর সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে গেল। তখন কথাও কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। বাধ্য হয়ে তখন ওয়াযের কিতাব মুতালাআর চিন্তা করলাম। আল্লাহর হুকুম, প্রথম দৃষ্টি পড়ল ইমাম গাযালী রাহ.-এর ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন-এর উপর। কয়েক অধ্যায় পড়ার পর আমার অবস্থাই বদলে গেল। অন্যদেরকে ওয়ায করার জন্য যে মুতালাআ শুরু  করেছিলাম সেটা আমাকেই ওয়ায করতে শুরু করল। গাযালীর প্রতিটি লাইন আমার উপর তীর-বল্লমের মতো কাজ করতে লাগল।

বোবা ও বধির হয়ে বুকের ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা আমার হৃদয় যেন কেঁপে উঠল। মীর যাহেদ, সায়্যিদ শরীফ, মোল্লা বাকের, মোল্লা মাহমূদ এবং সবশেষে ইমাম রাযীও কল্পনা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমার উপর তখন কেবলই ইমাম গাযালীর প্রভাব। শৈশবের সেই নেশাকর বইগুলো পড়তে গিয়ে যে অবস্থা হয়েছিল উনিশ বিশ বছরের এই যৌবনে এসেও আবার প্রায় সেই অবস্থা হল। আগে তো গীলানে কাটানো জীবনকে জাহিলিয়্যাতের জীবন মনে হত। এখন টোংকের জীবনকেও কিছুটা সেই রকম মনে হতে লাগল। মাকূলাতের আগ্রহ একেবারে উবে গেল। জীবন ও জীবনের দুর্বোধ্য বিষয়গুলো হল্ করার চিন্তা সওয়ার হয়ে গেল। এরপর বাধ্য হয়ে, জোর করে আরো কিছুদিন টোংকে কাটালাম। অস্থিরতার এক পর্যায়ে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে আজমীর শরীফ চলে গেলাম। মরহুম মাওলানা মুঈনুদ্দীন আজমীরী সাহেবের প্রতি আল্লাহ বে-হিসাব রহমত নাযিল করুন। তিনি আমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন। বিশেষ ব্যবস্থায় তিনি আমাকে আবার টোংক পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু এখানে মন টিকছিল না। পরের বছর বাড়ি থেকে টোংকের পরিবর্তে চলে গেলাম আমার শেষ গন্তব্যে। অর্থাৎ দেওবন্দে পৌঁছে গেলাম। যেই দেওবন্দকে ‘সাতহিয়্যাতে’র অপর নাম মনে করতাম আজ সেই দেওবন্দের উদ্দেশেই হাকীকতের খোঁজে চলে এলাম। দেওবন্দ ও খায়রাবাদের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কথা জানতাম। তাই বুকে পাথর বেঁধে এই মাদরাসায় প্রবেশ করলাম। আল্লাহ তাআলা ইমাম গাযালীকে উত্তম বদলা দান করুন, তিনি ইবনে সীনা ও বাকের-এর আশেককে শাইখুল হিন্দের হাদীসের দরসে পৌঁছার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কিছুদিন কাটল দ্বিধা-দ্বন্দ্বে। বড় কঠিন দিন ছিল সেগুলো। অবশেষে তাঁর গোলামীর ভাগ্য হল, তিন মাস যাবৎ যার সঙ্গে মুসাফাহা করার অপেক্ষায় ছিলাম। ঈমান, ইয়াকীন ইত্যাদি শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, তবে এসবের হাকীকত সম্পর্কে কোনো খবর ছিল না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের হাজারো শোকর যে, এই দৌলত লাভ করা সহজ হয়ে গেছে।

এতদিন মাওলানা মুহাম্মাদ কাসেম নানুতবী সম্পর্কে শুনেছি যে, তিনি শের ও বয়ান বক্তৃতায় খুব ভালো। কিন্তু যখন তাঁর টুটাফাটা সাহারানপুরী উর্দুতে লেখা কয়েকটি পুস্তিকা মুতালাআ করার সুযোগ পেলাম তখন মনে হল, এ যুগে যে ইলমে কালামের প্রয়োজন হযরতের উপর তা ইলহাম হয়েছে। ভাষার দিকে না তাকিয়ে পুস্তিকাগুলো মুতালাআ করলাম। ইসলামের এক নতুন সৌন্দর্য সামনে এল। তাঁর কিতাবের পর হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও শাহ শরফুদ্দীন ইয়াহইয়া মানীরীর মাকতুবাতের প্রভাবও আমার মধ্যে খুব পড়ল। এই মনীষীগণ কুরআন-হাদীসের আলোকে যে ফালসাফা ও দর্শন প্রস্তুত করেছিলেন, প্রবলভাবে আমার মধ্যে তার প্রভাব পড়ল। তখন শায়খে আকবার মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবীর ‘ফুতূহাত’ও মুতালাআ করেছি। এটি পড়ে মনে হয়েছে, আমার হারানো সব জিনিসপত্র এখানেই! অথচ এই কিতাবের কতো জায়গা আমার বুঝার উর্ধ্বে রয়ে গেছে। তবু মুতালাআ করতে ভালো লাগত। শায়খে আকবরের পর মাওলানা ইসমাইল শহীদ রাহ.-এর ‘আবাকাত’-এর প্রতি বেশি আকর্ষণ অনুভব করেছি। এ কিতাব আমার অনেক উপকার করেছে।

আশ্চর্যের বিষয় হল, শায়খে আকবরের আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ‘ওয়াহদাতুল উজূদ’। অথচ এ বিষয়ের প্রতি আমার সামান্যতম আগ্রহও ছিল না। বরং সত্য কথা হল, ভিতরে ভিতরে আমার ঝোঁক ছিল সেটার বিপরীত।

আগেই বলেছি, যে পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা সেখানে মুকাল্লিদ ও গাইরে মুকাল্লিদের বিতর্ক হত। সেজন্য কিছুদিন এসব বিষয় নিয়েও সামান্য ঘাঁটাঘাঁটি করেছি। এক্ষেত্রে শায়েখ আবদুল ওয়াহহাব শা‘রানী রাহ.-এর কিতাবাদি এবং বিশেষভাবে তার কিতাব ‘আলমীযানুল কুবরা’-এর মাধ্যমে মন শান্ত হয়ে যায়। মাওলানা আবদুল লতীফ রাহমানীর ‘তাযকেরায়ে আযম’-এর মাধ্যমেও চিন্তার কিছু মৌলিক সম্পাদনা সহজ হয়। এরপর দেওবন্দের দাওরায়ে হাদীসে, বিশেষভাবে শাইখুল হিন্দ ও আল্লামা কাশ্মীরী রাহ.-এর দরসের প্রভাবে আমি ‘গাইরে মুতাআসসিব’ হানাফী হয়ে যাই। আলহামদু লিল্লাহ এখন পর্যন্ত আমি এ অবস্থায়ই আছি। গাইরে মুতাআসসিব এর অর্থ হল, আমার কাছে হানাফী শাফেয়ীর ইখতেলাফের মধ্যে কোনো গোঁড়ামি নেই। ফলে সব মাযহাবের ইমামদের প্রতিই শ্রদ্ধাবোধ অনুভব করি। বিনা প্রয়োজনে কিংবা ফেতনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জনসাধারণের মধ্যে এসব ইখতেলাফ নিয়ে হৈচৈ করে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা দ্বীনী অপরাধ মনে করি। এছাড়া সমসাময়িক অন্যান্য মতবাদ- যেমন ন্যাচারালিজম (স্যার সায়্যিদের মতবাদ), হাদীস অস্বীকারকারী আহলে কুরআনের মতবাদ, তাসাওউফ অস্বীকারকারী ওয়াহাবী মতবাদ প্রভৃতি আমার মধ্যে কখনো কোনো প্রভাব ফেলেনি। কেননা চাচাজান মরহুমের সাহচর্যের ওসিলায় এসব মতবাদের নানান প্রশ্ন সম্পর্কে আগে থেকেই জানা ছিল। ভাবতে হত শুধু জবাব নিয়ে। অনেককেই দেখেছি, হঠাৎ করে তাদের সামনে এসব প্রশ্ন এসে পড়ে। তখন দীর্ঘ সময় চলে যায় প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতেই। এরপর আল্লাহ তাআলার তাওফীক হলে জবাব পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। সেই হিসেবে আমার আলহামদু লিল্লাহ প্রশ্নের পর্ব আগেই পার হয়েছে। তাই কেবল জবাবের জন্য আল্লাহর তাওফীকে চেষ্টা-মেহনত করেছি। দেওবন্দে আমি কিছুদিন ছিলাম ছাত্র হিসাবে। কিছুদিন খাদেম হিসাবে। এরপর হঠাৎ তাকদীর আমাকে নিয়ে গেল হায়দারাবাদে। সেখানে আল্লাহ তাআলা আমাকে মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহী রাহ.-এর সাহচর্য দান করলেন। যার কুরআন বিষয়ক অধ্যয়ন, গবেষণা ও জানাশোনার কথা আগে থেকেই জানতাম। তাঁর সাহচর্যের ওসিলায় কুরআনের আশ্চর্য কিছু দিক আমার সামনে উন্মোচিত হয়। সেসময় মাওলানা হুসাইন নামে হায়দারাবাদের এক উকিল যিনি বর্তমানে জজ, তার সঙ্গেও মুলাকাত হয়। তার কাছ থেকে কুরআন মাজীদের আয়াত থেকে উপকৃত হওয়ার নতুন একটি পদ্ধতির সন্ধান পাই।

শেষকথা হল, এখন ঊনপঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি এক ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত মুসাফির আমি। কৈশোরের উপন্যাস পড়া পাগলামী থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত বহু কিতাব পড়া হয়েছে। এখন ‘যা-লিকাল কিতাব’কেই শেষ কিতাব হিসাবে গ্রহণ করেছি। তবে যেহেতু শিক্ষকতা আর মৌলভীগিরি আমার পেশা, তাই পড়তে পড়াতে, লিখতে লেখাতে বিভিন্ন ধরনের কিতাবাদি মুতালাআ করতে হয়। এরপরও মুতালাআ-মগ্নতার তৃপ্তি শুধু এই কিতাব দিয়েই হচ্ছে। আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করি, যেন এর উপরেই আমার মৃত্যু হয়। সম্ভবত এখন প্রকাশ করতে কোনো সমস্যা নেই যে, কুরআনে কারীমের বড় একটি অংশ আমি মুখস্থ করেছি এই বৃদ্ধ বয়সে। আল্লাহ তাআলা যেন আশ্চর্য অভিজ্ঞতাময় এ জীবনের শেষ পর্যন্ত কুরআনের সাথেই থাকার তাওফীক দান করেন।

একটি লতীফা : কিতাবের সাথে সম্পৃক্ত শৈশবের একটি ঘটনা এখনও আমার খুব মনে পড়ে। ছোটবেলা যখন ইংরেজি পড়া শুরু করি এবং সবেমাত্র বর্ণমালা চিনতে শুরু করি তখন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। মাস্টার সাহেবের কাছে মোটা একটি ইংরেজি বই ছিল। তিনি সেটি পড়ছিলেন। কোনো এক প্রয়োজনে তিনি বইটি রেখে উঠে গেলে আমি সেটি হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম। ইংরেজিতে যেহেতু বাক্যস্থ বর্ণগুলোও ভিন্ন ভিন্ন লেখা হয়, তাই আমি সবগুলো বর্ণই চিনতে পারছি। ফলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা খুব দ্রুত পড়ে যাচ্ছি। (অর্থাৎ বর্ণগুলোর নাম বলে যাচ্ছি।) তাতে আমার খুশির কোনো অন্ত নেই। কারণ এই কয়েকদিনের মেহনতেই এত বড় একটি ইংরেজি বই অনায়াসে পড়তে পারছি! বুঝতে পারছি!

ঘটনাটি মনে পড়লে এখনও আমি অন্যরকম হয়ে যাই। মনে হয়, বর্তমানে যেসব বিষয় বুঝতে পারছি বলে খুশি লাগে, না জানি কখন আবার তা শৈশবের সেই ভুল বুঝের মতোই ভুল প্রমাণিত হয়! শুধু কিতাবের ক্ষেত্রে না, যিন্দেগীর বহু বিষয়ে আমার এই ধরনের ভুলের আশঙ্কা হয়। শৈশবের সেই ঘটনা আমার জন্য সতর্কীকরণ ও শিক্ষা হয়ে সামনে আসে।

আরেকটি কথা। ডক্টর ইকবাল ও মাওলানা মুহাম্মাদ আলী মরহুম, এই দুজনের বেশ কিছু চিন্তা-দর্শন আমার ভাবনা-কল্পনার সম্পাদনায় সাহায্য করেছে। সেজন্য ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলে না-শোকরী হবে। এমনিভাবে হযরত থানবী মুদ্দাযিল্লুহুর কিছু কিছু বাণী আমাকে অনেক ইসলামী বিষয় বুঝার ক্ষেত্রে রাহনুমায়ী করেছে। জাযাহুমুল্লাহু আন্না আহসানাল জাযা।

কাযী সুলাইমান মানসূরপুরীর ‘রাহমাতুল লিল আলামীন সা.’ কিতাবটির কাছেও আমি ঋণী। সীরাতে তায়্যিবাহর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তার মাধ্যমেই আমার সামনে এসেছে।

আরেকটি বিষয় যা এখানে উল্লেখ করা মুনাসিব নয়, সেক্ষেত্রে মাওলানা আবদুর রহমান জামী মরহুমের গযলের অনেক প্রভাব রয়েছে। কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহু।

অনুবাদ : তাওহীদুল ইসলাম তায়্যিব

 

 

advertisement