মুহাররম ১৪৪১   ||   সেপ্টেম্বর ২০১৯

সম্মাননা : হায়! এই সম্মাননা কীসের পুরস্কার?

গত ২৪ আগস্ট শনিবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব-আমিরাত ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করে। আমিরাতের প্রতিষ্ঠাতা শেখ যায়েদ বিন সুলতান আলে নাহিয়ানের ছবি-অঙ্কিত এই পদক দেশটির সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক। আমিরাতের যুবরাজ শেখ মুহাম্মাদ বিন যায়েদ আলে নাহিয়ান ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে এই পদক পরিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও এই পদক-প্রাপ্তিতে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে এক টুইট বার্তায় বলেছেন, ‘কিছুক্ষণ আগে অর্ডার অব যায়েদ সম্মাননা গ্রহণ করে ধন্য হয়েছি। ...’

একই সফরে বাহরাইনেও তাকে পদক দেয়া হয়।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিষয়টি বিশে^র কোটি কোটি মুসলিমের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। ‘জাযিরাতুল আরবে’র একটি দেশের পক্ষ হতে এই সম্মাননা এমন এক ব্যাক্তিকে দেয়া হয়েছে, যার সম্পর্কে আছে বহু ভারতীয় মুসলিমের প্রাণহানীর অভিযোগ। উপরন্তু এই সম্মাননা দেয়া হয়েছে এমন এক সময়ে যখন ভারতীয় সংবিধান থেকে কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা সম্বলিত ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে, যাকে আশঙ্কা করা হচ্ছে, মুসলমানদের ভূমি কাশ্মীর থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করার সুদূরপ্রসারী বন্দোবস্ত বলেই। শুধু তাই নয়, মুসলিম জাহানের চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের ভাষ্য অনুসারে সেখানে একটি ভয়াবহ মুসলিম গণহত্যারও আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে একাধিক আরব দেশের পক্ষ হতে সম্মাননা প্রদান নিছক সম্মাননাই নয়, ভারতের মুসলমান, বিশেষত কাশ্মীরী মুসলিমদের বিষয়ে বিজেপি সরকারের গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা-নির্লিপ্ততার প্রতিশ্রুতি-জ্ঞাপকও বটে।

কোনো কোনো রাজনীতি বিশ্লেষক আরব দেশগুলোর এই অবস্থানকে ব্যাখ্যা করছেন রাজনীতিতে ‘বাস্তববাদ’ বলে। অর্থাৎ তাদের মতে, বিশ্ব রাজনীতি এখন বাস্তববাদের যুগে প্রবেশ করেছে। নীতি-নৈতিকতার যুগ এখন নেই। সব জায়গায় এখন প্রাধান্য পাচ্ছে আঞ্চলিক স্বার্থ।’

যে বিষয়টাকে বিশ্লেষকেরা ‘বাস্তববাদ’ বলে সংজ্ঞায়িত করছেন এবং ‘কিছু করার নেই’ জাতীয় নিষ্ক্রিয়তার উপলব্ধি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন সেটা আসলে ‘বাস্তববাদ’ও নয়, কিছু করার নেই-জাতীয় বিষয়ও নয়। এর প্রকৃত পরিচয় হচ্ছে ‘ইহবাদ’ ও ‘বস্তুবাদ’। আর এই জাহেলিয়াত সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উম্মতকে হুঁশিয়ারও করেছেন, মুক্তির উপায়ও নির্দেশ করেছেন। এক হাদীসে তিনি ইরশাদ করেন-

يُوشِكُ الْأُمَمُ أَنْ تَدَاعَى عَلَيْكُمْ كَمَا تَدَاعَى الْأَكَلَةُ إِلَى قَصْعَتِهَا.

অচিরেই (এমন একটা সময় আসছে, যখন) বিভিন্ন জাতি একে অপরকে ডেকে তোমাদের বিরুদ্ধে একত্র হবে, যেমন একপাত্রে আহারকারীরা একে অপরকে খাবারের পাত্রের দিকে ডেকে নিয়ে আসে।’

একজন জিজ্ঞাসা করলেন-

وَمِنْ قِلّةٍ نَحْنُ يَوْمَئِذٍ؟

সেদিন কি আমাদের সংখ্যাস্বল্পতার কারণে এমনটা হবে?’

তিনি বললেন-

بَلْ أَنْتُمْ يَوْمَئِذٍ كَثِيرٌ، وَلَكِنّكُمْ غُثَاءٌ كَغُثَاءِ السّيْلِ، وَلَيَنْزَعَنّ اللهُ مِنْ صُدُورِ عَدُوِّكُمُ الْمَهَابَةَ مِنْكُمْ، وَلَيَقْذِفَنّ اللهُ فِي قُلُوبِكُمُ الْوَهْنَ.

বরং সেদিন তোমরা সংখ্যায় হবে অনেক। তবে তোমাদের অবস্থা হবে পানির তোড়ে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতো। আল্লাহ তাআলা দুশমনের অন্তর থেকে তোমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি উঠিয়ে নিবেন আর তোমাদের অন্তরে ‘দুর্বলতা’ সৃষ্টি করে দিবেন।’

একজন জিজ্ঞাসা করলেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، وَمَا الْوَهْنُ؟

আল্লাহর রাসূল! দুর্বলতা মানে কী?

তিনি বললেন-

حُبّ الدّنْيَا، وَكَرَاهِيَةُ الْمَوْتِ.

‘দুনিয়ার মোহ আর মৃত্যুর ভয়।’

হাদীসটি সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে। হাদীস নং ৪২৯৭।

তো যাকে ‘বাস্তববাদ’ বলা হচ্ছে তা আসলে ‘বস্তুবাদ’ ও ‘ইহবাদ’। বস্তুত ইহবাদী চিন্তা-চেতনা মানুষকে কখনো হিং¯্র ও স্বার্থপর করে আর কখনো ভীরু ও কাপুরুষ করে।

সহীহ বুখারীর এক দীর্ঘ হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বাণী বর্ণিত হয়েছে যে,

وَاللهِ مَا الفَقْرَ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدّنْيَا، كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا، وَتُلْهِيَكُمْ كَمَا أَلْهَتْهُمْ.

আল্লাহর কসম! তোমাদের ব্যাপারে দারিদ্র্য আমার কাছে শঙ্কাজনক নয়, আমার তো আশঙ্কা, পূর্ববর্তীদের মতো তোমাদের উপরও দুনিয়া খুলে দেওয়া হবে, ফলে তোমরাও তোমাদের পূর্বের লোকদের মতো এরই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়বে। আর আগের লোকদের মতো তোমাদেরকেও এই দুনিয়া গাফেল করে দিবে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪২৫

আরব দেশগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেন এই সময়ের জন্যেই কথাগুলো বলেছিলেন। আরব-দুনিয়ায় অর্থ-বিত্তের প্রবাহ যত বেড়েছে ততই বেড়েছে ভোগ-বিলাসে গা ভাসিয়ে দেওয়ার প্রবণতা। আরবেরা যেন ভুলে গেছে যে, একদা এই জযীরাতুল আরব থেকেই গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল তাওহীদের আলো। বিশ্ব মানবতা এখান থেকেই পেয়েছিল আল্লাহমুখিতা ও আখেরাতমুখিতার শিক্ষা। ঐ দিন কোনো পৌত্তলিক নেতাকে সোনার মেডেল পরিয়ে মুসলমানকে তার ব্যবসা-বাণিজ্য রক্ষার চেষ্টা করতে হয়নি; বরং আরবের এক অখ্যাত ব্যক্তি সোরাকা ইবনে মালিক রা.-এর হাতে উঠেছিল মহাপরাক্রমশালী পারস্য-স¤্রাটের হাতের কঙ্কণ!

আজ মুসলমানকে আবার নতুন করে এই সবক ইয়াদ করতে হবে যে, ‘বস্তুই’ যেমন একমাত্র ‘বাস্তব’ নয়, তেমনি বস্তুবাদই নয় বাস্তববাদ। ‘বাস্তবতা’ আরো অনেক বিস্তৃত। ইহকালই বাস্তবতা নয়, পরকালও বাস্তবতা। দুনিয়ার শান্তি-অশান্তিই বাস্তবতা নয়, জান্নাত-জাহান্নামও বাস্তবতা। দুনিয়ার উপায়-উপকরণই  বাস্তবতা নয়, আল্লাহর মদদ ও নুসরতও বাস্তবতা। এককথায় আমাদের প্রত্যক্ষ জগৎ তথা ‘আলমে শাহাদাত’ই বাস্তবতা নয় আমাদের অপ্রত্যক্ষ জগৎ তথা ‘আলমে গাইব’ও বাস্তবতা। কাজেই মুসলমানকে যদি প্রকৃত অর্থে বাস্তববাদী হতে হয় তাহলে অবশ্যই তাকে ঈমানের পথ ধরতে হবে। যে পথে আমাদের পূর্বসূরীগণ চলে পৃথিবীর বুকে ‘অমর ইতিহাস’ রচনা করেছেন। বস্তুবাদ, ভোগবাদ ও ইহবাদের কূপম-ূকতা থেকে অবশ্যই আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

ইতিহাসের বাস্তবতাও আমাদের জানায় যে, হীনতা ও নতজানুতা কখনো মুসলমানের জন্য কল্যাণ বয়ে আনেনি। সাম্প্রতিক বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে আরবের শরীফ হোসাইন থেকে কাশ্মীরের শেখ আব্দুল্লাহ পর্যন্ত এমন দৃষ্টান্ত একেবারে কম নয় যে, নতজানুতার পথে অন্যের কৃপা কামনা করে শুধু লাঞ্ছিতই হতে হয়েছে। দিনশেষে অনুতাপ ও ধিক্কার ছাড়া আর কিছুই ভাগ্যে জোটেনি।

 

 

advertisement